নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শেষ পর্যন্ত লেখাটাই থাকে। টিভি, রেডিও, ওয়েবসাইট, চলচ্চিত্র, মঞ্চ, বিজ্ঞাপণ, ব্লগ - লেখার যতো মাধ্যম সবখানেই লিখতে হবে। পৃথিবী পাল্টে গেছে - এখন আমরা দুহাতের দশ আঙুলেই লিখি।

মুম রহমান

পেশাদার ও নেশাদার লেখক, মাঝে মাঝে কবি

মুম রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

কেন থিয়েটার

২৮ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ১০:২৮





"The word theatre comes from the Greeks. It means the seeing place. It is the place people come to see the truth about life and the social situation. The theatre is a spiritual and social X-ray of its time. The theatre was created to tell people the truth about life and the social situation."

- Stella Adler



১৯৯০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই নাটক ও নাট্যতত্ব বিভাগে। আজ থেকে ২৪ বছর আগে থিয়েটার নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেয়ার ভাবনাটি খুব সুখকর ছিলো না। তুমি কিসে পড়ো? ‘নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে।’ এইটুকু উত্তরে কেউ সন্তুষ্ট হতো না। এ বিভাগে পড়লে কী হবে, আমার ভবিষ্যত কি, আমার মাথা কি ঠিক আছে, আমি কি জীবনটাকে ধ্বংস করছি কি না এমনি সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো নিয়তই। তখন সব কিছুর উত্তর ভাল করে দিতে পারতাম না। যৌবনে-কৈশোরে এটুকু জানতাম, এটুকু জেদ ছিলো, যা ভালো লাগে, তাই করবো। থিয়েটার ভাল লাগে। ১৯৮৮ সালে প্রথম যোগ দিয়েছিলাম ঢাকা লিটল থিয়েটারে, সেখান থেকে ভাল লাগার শুরু। ভাল লাগা, ভালবাসার প্রথম কালটা পার হলে আস্তে আস্তে ভেতরের রহস্যগুলো ধরা পড়তে শুরু করে, কারণগুলো বেরিয়ে আসে। ক্রমাগত চর্চা, পাঠ আর ভাবনার ভেতরে থিয়েটার ঢুকে পড়ায় আজ কেউ প্রশ্ন করলে পাল্টা প্রশ্ন করার সাহস রাখি, ‘কেন থিয়েটার করবো না”। নেশা করবো, মেয়েদের উক্তত্য করবো, ঘুষ খাবো, মারামারি করবো, ছিনতাই করবো... না কি থিয়েটার করবো? অবশ্যই এবং অতি অবশ্যই শিশু, কিশোর, যুবক, প্রবীণ, বৃদ্ধ সবার জন্য সবচেয়ে নির্দোষ, সৃস্থ, লাগসই বিনোদন আর শিল্প মাধ্যম তো একমাত্র থিয়েটারই।

সেই আদ্যিকালের পূর্ব পুরুষ তো শিকার থেকে ফিরে অভিনয় করে দেখাতেন কীভাবে বুনো জন্তুটিকে ঘায়েল করেছে, ছোট্ট শিশুটিও জন্মের পরে জেনে যায় কেমন করে ঠোঁট বাঁকিয়ে একটু হাসি দিলে সবার মন ভোলানো যায়। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে, মানুষের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় থিয়েটারই তো সবচেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা। শেকসপিয়র যখন ঘোষণা দেন, জীবনটাই একটা রঙ্গমঞ্চ আর আমরা সবাই সেখানে যার যার ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছি তখন তো কারো আর বুঝতে বাকী থাকে না, জীবনের সঙ্গে সবচেয়ে অঙ্গাঅঙ্গি সম্পর্ক থিয়েটারের। মানুষের আবেগ, ভাবনা ও স্বপ্ন পূরণের কথা তো সবচেয়ে বেশি থিয়েটারেই ফুটে ওঠে। ঈডিপাস কিংবা ইলেকট্রার বেদনা যুগ যুগ ধরে বয়ে যায় মানুষের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে, বোধের গহীনে। হ্যামলেটের মনের দ্বিধা, ওথেলোর হঠকারিতা, ম্যাকবেথের ক্ষমতা লিপ্সুতা থিয়েটারেই প্রকাশিত হয়।

আর এতো শুধু একটি প্রকাশ ভঙ্গিই নয়। এর প্রকাশ মানুষকে ভাবায়, সচেতন করে, শিক্ষিত করে। তাই তো ইবসেনের নোরা যখন শেষ দৃশ্যে দরজা বন্ধ করে নারী স্বাধীনতার অঙ্গিকার নিয়ে বেরিয়ে আসে তখন ইউরোপের হাজার হাজার ঘরে তার প্রভাব পড়ে, নারীরা আর পুতুলের সংসারে আটকে থাকায় বিশ্বাসী নয়। নারী সচেতনতায় ইবসেনের ‘ডলস হাউস’ সারা বিশ্বকে সচেতন করে তোলে। ব্রেখটের প্রতিটি নাটক মানুষকে শেখায়, সচেতন করে। শ্রেণী সংগ্রাম আর অর্থনৈতিক মুক্তি নিয়ে হাজার প্রবন্ধ লিখে যা করা সম্ভব নয় ব্রেখটের ‘লোক সমান লোক’ কিংবা ‘বিধি ও ব্যতিক্রম’ তা করে দেয়। এরিস্টফানিসের ‘লিসিট্রাট্রা’ কিংবা ব্রেখটেরই ‘মাদার কারেজ’ মানুষকে যুদ্ধ বিরোধী করে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা মানব সভ্যতার মুখে যে কালি মেখে দেয় তার অর্থহীনতা নিয়ে হাসাহাসি করেন বেকেট, আয়ানেস্কো, এদামভ এর মতো নাট্যকাররা। ‘বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো’ আমাদের শিখিয়ে দেয় জীবনের প্রতিটি পদে, প্রতিটি পলে আমরা শুধু অপেক্ষাই করে যাচ্ছি। উদ্দেশ্যহীন সেই অপেক্ষা কখনো হাস্যকর, ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর পরিণতিতে ঠেলে দেয়। তবু ভøাদিমির, এস্ট্রাগনের মতো আমরা ‘চলো যাই’ বলেও কোথাও যাই না, ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকি। মানব জীবনের সত্যগুলোকে, নিগুঢ় তত্ত্বগুলোকে থিয়েটারের মতো করে আর কোন মাধ্যমই কি তুলে ধরতে পারে? পপকর্ন খেতে খেতে সিনেমা হলের ঠা-া রুমে বান্ধবী নিয়ে আমরা চলচ্চিত্র দেখি, আমোদিত হই, সে চলচ্চিত্র কতটুকু ভাবালো তা নিয়ে না-ভাবলেও চলে। কতো টাকা খরচ করে, কতো টাকা উশুল হলো সিনেমায় সেটাই মূল কথা। আর টেলিভিশন তো ‘ঘরকা মুরগি ডাল বরাবর’। মোবাইলে গল্প করতে করতে, ল্যাপটপ চালাতে চালাতে হাজারো বিজ্ঞাপণের ভিড়ে আমরা টেলিভিশন দেখি। কিন্তু থিয়েটার তেমন আয়েশ সাধ্য নয়। মাসের পর মাস মহড়া দিয়ে যে নাটকটি তৈরি হয়, তা দেখতে দর্শকদেরও তৈরি থাকতে হয়। থিয়েটারে চিপসের শব্দ চলে না, হাতে হাতে রেখে গল্প বলা চলে না। এ যে একমাত্র মুখোমুখি মিলন। অভিনেতা আর দর্শক একেবারে সামনা সামনি, যা ঘটছে তা এখনই ঘটছে, সব কিছু চোখের সামনে, পলক ফেলার অবকাশ নেই। থিয়েটার জীবন্ত, তাই স্বভাবগতভাবে পুরোটা মনোযোগ কেড়ে নেয়। জীবন্ত এই শিল্প মাধ্যম মানুষের সাথে মানুষের বন্ধন সৃষ্টি করে দেয় সরাসরি। একটা কথাই তো চালু আছে, Theatre is life. Cinema is art. Television is furniture..

মানুষের সাথে মানুষের মহামিলন ঘটে থিয়েটারেই। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিটি থিয়েটার কর্মী কাজ করে, সে কাজের অংশীদার প্রতিটি দর্শকও। এ যেন গণতন্ত্রের সহজপাঠ। মত বিনিময়, আলোচনার এমন সূবর্ণ পাটাতন আর কোথায়ই বা আছে! হয়তো সে কারণেই সমাজ গঠনেও থিয়েটার সরাসরি ভূমিকা রাখে। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’, মীর মোশারফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’, মাইকেল মধূসূদনদত্তের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’, মামুনুর রশীদের ‘ওরা কদম আলী’, মমতাজ উদ্দিনের ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’ কিংবা আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘মেরাজ ফকিরের মা’ শুধু বাংলা থিয়েটারের সম্পদ নয়, বাঙালি ও বাংলাদেশের সমাজ বদলের একটি ধারাবাহিক পাঠ হিসাবেও বিবেচ্য। সমাজ গঠনে এই সব নাটক অগ্রজের ভূমিকা পালন করে।

সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র Ñ যাই বলি না কেন, সে তো মানুষকে নিয়েই সৃষ্টি। তাই থিয়েটারের কেন্দ্রবিন্দুও মানুষ। থিয়েটার ব্যক্তি মানুষের বিকাশেও সব্বোর্চ্চ ভূমিকা রাখে। ব্যক্তি মানুষের সৃষ্টিশীলতা, আত্মবিশ্বাস, শৃঙ্খলাবোধ বাড়াতে আর কোন শিল্প মাধ্যম এতোটা অগ্রগণ্য নয়। সবচেয়ে লাজুক মানুষটি গলা ছেড়ে সংলাপ দিতে পারে থিয়েটারে এসে। সবচেয়ে গুটিয়ে থাকা মানুষটিও প্রাণ ফিরে পায় থিয়েটারের মাধ্যমেই।

আর এতো কিছু পরও কেন থিয়েটার করি প্রশ্নটি উঠলে বলতেই হয়, থিয়েটারের চেয়ে ভাল কোন বিকল্প মাধ্যম আর জানা নেই। থিয়েটারের আছে নিজস্ব এক শক্তি যে শক্তি সে প্রাণে প্রাণে বিলিয়ে দেয়। প্রাণের আনন্দেই তাই থিয়েটার করি আমি।

আপনি কেন থিয়েটার করেন?

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.