নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাসুদ কামাল

মাসুদ কামাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

এই কুকুর আমার না

০১ লা জুন, ২০১৪ রাত ১১:২১

আজ বরং একটা গল্প দিয়েই শুরু করা যাক।

পার্কের বেঞ্চে এক বৃদ্ধা মহিলা বসে আছেন। কিছু হাঁটাহাঁটি করে এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। তার পাশেই একটি কুকুর। এবার বেঞ্চে এসে বসলেন এক তরুণী। ক্লান্ত তরুনী ব্যাগ থেকে একটা পানির বোতল আর বিস্কুটের প্যাকেট বের করলেন। বিস্কুট খেতে খেতে লক্ষ্য করলেন-কুকুরটি শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বললো-আপনার কুকুরটা কিন্তু দেখতে বেশ সুন্দর।

-হুম, তা সুন্দর, জবাব বৃদ্ধার।

-আপনার কুকুর কি মানুষের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করে?

-খুবই করে।

-আপনার কুকুর কি বিস্কুট পছন্দ করে?

-বিস্কুট তো তার সবচেয়ে প্রিয়।

-সে কি মানুষকে কামড়ায়?

-নাহ, মানুষকে কামড়াবে কি, সে তো বিড়ালকে পর্যন্ত ভয় পায়।

এতটুকু শোনার পর তরুনী একটি বিস্কুট নিয়ে কুকুরটির মুখের কাছে ধরলো। বিস্কুটের পরিবর্তে কুকুরটি তার হাত কামড়ে দিল। তরুণীটি চিৎকার দিয়ে উঠলো। ব্যথায় কাঁদতে লাগলো। তারপর সে বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি না বললেন আপনার কুকুর কামড়ায় না?

-ঠিকই বলেছি। এটা তো আমার কুকুর নয়!

নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হলো। নিহত প্যানেল মেয়র নজরুলের শ্বশুর সাহস করে র‌্যাবের নাম উচ্চারণ করলেন। বললেন তারা নাকি আওয়ামী লীগ নেতা নুর হোসেনের টাকা খেয়ে ভাড়াটে খুনি হিসাবে এই কাজ করেছে।

অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার পরপরই র‌্যাব অ্যাকশনে গেল। প্রথমে তাদেরকে নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরৎ পাঠানো হলো। এরপর দেয়া হলো বাধ্যতামূলক অবসর। এখন র‌্যাবের ওই তিন কর্মকর্তা হত্যার অভিযোগে জেলে। কিন্তু ঘটনার মূল কুশীলব হিসাবে, যার দিকে সন্দেহের আঙ্গুল, সেই নুর হোসেন কোথায়? পালিয়ে গেছে সে দেশ ছেড়ে। হতভাগ্য ওই সাত জনকে অপহরণের পরও সে রাজধানীতে ছিল। নদী থেকে তাদের লাশ উদ্ধারের পরই নুর হোসেন অগ্রসর হতে থাকে সীমান্তের দিকে। এর আগে অবশ্য আলোচিত নেতা শামীম ওসমানের সঙ্গে তার টেলিফোনে কথা হয়। সেই কথপোকথনের দু’টি বিষয় এখানে প্রাসঙ্গিক। এক. তিনি নুর হোসেনকে বলেছেন-‘তুমি আগাইতে থাকো।’ তার এই পরামর্শ নুর হোসেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। সীমন্তের দিকে অগ্রসর হয়েছে। আর দ্বিতীয় কথাটি ছিল, ‘আমি তোমাকে নতুন আর একটা নাম্বার দিবো, তুমি সেটাতে কথা বলো।’ প্রথম পরামর্শটি যেহেতু পালিত হয়েছে, ধারণা করা যায়- দ্বিতীয়টিও পালিত হয়েছে। নতুন সিমে দু’জনে কথাও হয়েছে। সেই নতুন নাম্বার দিয়ে হওয়া কথপোকথনের রেকর্ড পাওয়া গেলে হয়তো বের হয়ে আসতো থলের আরও অনেক বিড়াল।

কিন্তু আজ আমাদের প্রসঙ্গ বিড়াল নয়, কুকুর।

নারায়ণগঞ্জের মর্মান্তিক এই ঘটনাটির পর সরকারী দলের কারও কারও মুখে শোনা যেতে থাকলো যে, নুর হোসেন আসলে শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের লোক নয়। এর আগে সে জাতীয় পার্টি করতো। এরপর বিএনপি আমলে সে নাকি অনেক কষ্ট করেছে। বিএনপি তাকে দেশেই থাকতে দেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টা তো বছর কয়েক আগে তাকে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা হিসাবে লিখিত সার্টিফিকেট পর্যন্ত দিয়েছেন। তো এমন সার্টিফিকেটধারী ত্যাগী নেতার দায়িত্ব অস্বীকার করার নানা চেষ্টা হতে থাকলো। দু’একদিন ছোটখাট নেতার গুনগুনের পর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন একদিন ভরা মজলিসে বলেই দিলেন, নুর হোসেন আসলে বিএনপির লোক। আওয়ামী লীগের বদনাম করার জন্য বিএনপি তাকে এখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিল! পার্কের সেই বৃদ্ধার অনেক ক’টি জমজ ভাইবোনকে এখন আমরা নিয়মিত দেখতে পাচ্ছি আমারদের রাজনীতির অঙ্গনে।

সাভারের মর্মান্তিক রানা প্লাজা দুর্ঘটনার কথা নিশ্চয়ই নতুন করে মনে করিয়ে দেয়ার দরকার নেই। এতগুলো মানুষ মরলো, অথচ সরকার ও তার দলের মধ্যে তখন দেখ গেছে কুকুরের মালিকানা অস্বীকার করার প্রাণান্তকর চেষ্টা। স্থানীয় এমপি বললেন, সোহেল রানাকে তিনি চেনেনই না। খোদ প্রধানমন্ত্রী বললেন, সোহেল রানার সঙ্গে আওয়ামী লীগের বা এর কোন সহযোগী সংগঠনের কোন সম্পর্ক নেই। কথাগুলো তারা কাকে শোনালেন? সাভারের মানুষ কি জানে না সোহেল রানা নামের এই কুকুরের মালিক কে? কার আস্কারা পেয়ে সে নাড়ে তার লেজ, দাঁত মুখ খিচিয়ে করে ঘেউ ঘেউ। সাভারের মানুষ জানলেও তখনও হয়তো দেশ বিদেশের অনেকেই অজ্ঞাত ছিল এ বিষয়ে। কিন্তু মিডিয়াগুলোতে যখন স্থানীয় এমপি’র সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ রানার ছবি প্রকাশিত হলো, তখন যেন জোকের মুখে নুন পড়লো। মিথ্যা বলার শাস্তি পেলেন স্থানীয় এমপি মুরাদ জং। পরের নির্বাচনে তাকে আর দল থেকে মনোনয়নই দেয়া হলো না। কিন্তু রানার দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকার করে পুরো জাতির কাছে যে ভুল তথ্য দিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী, তিনি কি কোন শাস্তি পেয়েছেন?

আমাদের নেতা নেত্রীদের এরকম এলোমেলো মন্তব্য করার অভ্যাস আছে। যেমন ধরা যাক এবারের ফেণীর ঘটনাটি। আওয়ামী লীগের নেতা, একজন নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান, দিনে দুপুরে জেলা শহরের ব্যস্ত রাজপথে নিহত হলেন। গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন তিনি। তার গাড়ি আটকে গুলি করা হলো। তারপর তাকে সহ পুরো গাড়িতে আগুন দেয়া হল। জীবন্ত দগ্ধ হয়ে গেলে একজন জনপ্রতিনিধি। এমন বেপরোয়া নৃশংসতা এই মাটিতে আগে শেষ কবে ঘটেছে, মনে করতে পারছি না। ঘটনার পরপরই আমাদের সরকারী দলের নেতারা বলা শুরু করলেন, এটা বিএনপি’র কাজ। বড় বড় মন্ত্রীরা বললেন, বেশ জোর দিয়েই বললেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যের তত্ত্বাবধানে হত্যা মামলা হলো। প্রধান আসামী করা হলো- একজন বিএনপি নেতাকে। মামলার বাদী হলেন নিহত উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাই। এর দু’দিন পরেই পাল্টে গেল দৃশ্যপট। বাদী বললেন, মামলার সময় তিনি জানতেন না কাদেরকে আসামী করা হয়েছে। সবকিছু লিখে এনে তাকে কেবল স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছে। অবস্থা তখন এমন ছিল যে, নিজ দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিযে আসা সেই কাগজে স্বাক্ষর না করে তার উপায় ছিল না।

এর মধ্যে ফেণীর মামলার তদন্তকাজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে হত্যাকাজে জড়িত এবং মদদদাতাদের মধ্যে নিজ দলের লোকের সংখ্যাই বেশি। তাহলে, একেবারে শুরুতেই, তদন্ত শুরুর আগেই, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা বিরোধীদলের নেতাদের দায়ী করে মন্তব্য করেছিলেন, তার কি হবে? গুরুত্বপূর্ণ পদের লোকেরা যখন জনসমক্ষে ফালতু মন্তব্য করেন, তখন কি সেই মন্তব্যটিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নাকি ব্যক্তিটিই ফালতুতে পরিণত হন?

বাংলাদেশের রাজনীতির ধারা এখন পাল্টে গেছে। এখানে রাজনীতি মানেই অর্থ সম্পদ কামানোর একটা প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতায় লেগে থেকে একবার সরকারী দলের লোকে পরিণত হতে পারলেই কেল্লা ফতে। জোগাড় হবে লুটপাটের একটা লাইসেন্স। কাজেই যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের নিজেদেরকেই নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় নামতে হয় সেই লাইসেন্সের ব্যবহার নিয়ে। প্রতিযোগিতা খুব দ্রুতই পরিণত হয় খুনাখুনিতে। কি নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, কি ফেণীর নৃশংসতা-সবই এই ক্ষমতা আর সম্পদ দখলের অবধারিত পরিণতি। বিরোধীদলের ভূমিকা এখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিছক দর্শকের। আর সে কারণেই সম্ভবত, খোদ বিরোধীদলীয় নেত্রী আন্দোলন করতে না পারার অজুহাত হিসাবে জনসভায় বলেন, আমরা ওদেরকে পচতে দিয়েছি। ওরা আরও পচুক, তখন জনগনই ওদেরকে ফেলে দেবে। সমালোচকরা তার এই বক্তব্যকে অক্ষমের অজুহাত হিসাবে হয়তো আখ্যায়িত করতে চাইবেন, তবে এর মধ্যে বাস্তবতা যে কিছু নেই সেটাও বলা যাবে না। আসলেই সরকারী দল এখন নিজেরা নিজেরাই মারামারি খুনাখুনিতে লিপ্ত হয়েছে

আমার ধারণা, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ফেণী হত্যা রহস্যের একটা কিনারা হবে, কিছু লোককে দোষী সাব্যস্ত করা হবে, সেখানে আওয়ামী লীগের বেশ বড়সড় দু’একজন নেতার নামও চলে আসবে। আর আমার প্রবল আশঙ্কা, যথরীতি তখন কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষ থেকে বলা হবে, ওই লোকটি আসলে তাদের লোক নয়। আসলে সে বিরোধী দলের লোক। দলের মধ্যে এতদিন ঘাপটি মেরে ছিল। এখন তার মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। এতদিন ভাবতাম সে বুঝি সুদর্শন কোন হরিণ শাবক। কিন্তু এখন দেখছি কুকুর, তাও আবার হাত কামড়ে দেয়া কুকুর। নাহ, এই কুকুর আমার না।

তবে, দলীয় নেতাদের এই প্রবণতাকে আমি ভালো বলবো না। ধরা যাক, সোহেল রানার কথা। অথবা নুর হোসেনের কথাই। হঠাৎ করেই কি তারা ভিলেন চরিত্র অর্জন করলো? আগে কি তাদের চরিত্র দুধে ধোয়া তুলসিপাতা ছিল? শোনা যায় নুর হোসেনের একটা রংমহল ছিল। সেখানে রঙ করতে অনেক বড় বড় নেতারাই নাকি যেতেন। রংমহল তো একটা দৃশ্যমান স্থাপনা। অথচ সেই ভবনে কত দুষ্ট ঘটনা ঘটতো, সে সব প্রকাশিত হতে শুরু করেছে এখন। এতদিন কারো কে কিছু বলতে শোনা যায়নি। যখন কুকুর কমড়ে দিয়েছে, তখনই সেটা কত খারাপ জাতের কুকুর, তা বলার জন্য উন্মুখ যেন সবাই।

শুরুর গল্পটা যেখানে শেষ করেছিলাম, সেটাই কিন্তু শেষ নয়, আরও একটু টেনে নেয়া যায়। হাতের ব্যাথায় কাঁদতে কাঁদতে তরুণীটি তো চলে গেল। তার হাতে থাকা প্যাকেটের সব বিস্কুটই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল নিচে। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, ঘাসের উপর ছড়িয়ে থাকা বিস্কুটগুলো খাচ্ছে কুকুরটি, আর সেই বৃদ্ধা হাত বুলাচ্ছে তার মাথায়!

আমাদের কুকুরগুলোও অপেক্ষা করছে পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়ার। আর তাদের মাথায় হাত বুলানোর মত মানুষের অভাব যে নেই, সেটা তো আর বলে দেয়া লাগে না।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪১

রাজীব নুর বলেছেন: লেখাটা এই সময় পত্রিকাতে পড়েছি। ভালো লিখেছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.