![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে এখন প্রায় সবাই ব্যস্ত। দেশের রাজনীতি যেন এখানে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি-না, সুষ্ঠু ভাবে জনগণ ভোট দিতে পারলে কে জিতবে- এসবই এখন রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনার বিষয়।
গত জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি’র লাগাতার অবরোধ এবং দু’একদিন পরপর হরতাল কর্মসূচির কারণে পুরো দেশে যখন একটা আচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল, তখন এই সিটি নির্বাচনের ঘোষণা সকলের জন্যই একটা সুবাতাস বয়ে নিয়ে আসে। দুই দলের অবস্থানটা ছিল জেদাজেদি’র। বিএনপি’র প্রথমে ধারণা ছিল, এভাবে অবরোধ হরতাল আর কিছুদিন চালিয়ে নিতে পারলে বুঝি সরকারের পতনই হয়ে যাবে। তাদের কর্মসূচির কারণে দেশের অর্থনীতিতে ক্ষতি হচ্ছিলো, মানুষের জীবন যাপন হয়ে পড়েছিল আতঙ্কগ্রস্থ। শুরুতে দাবি ছিল তাদের, নতুন করে নির্বাচন দিতে হবে। সরকার তাদের দাবি মানেনি, বরং বলা যায় শুরুতে একেবারে পাত্তাই দেয়নি। দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে, ব্যবসা বাণিজ্য ধ্বংস হচ্ছে, মানুষ পুড়ে মরছে- তাতে সরকারের কি? সরকার বরং উল্টো পথ নিয়েছে, এইসব অপকর্ম হতে দিয়েছে এবং এর জন্য বিরোধীদলকে দায়ি করেছে। সন্দেহ নেই, প্রকান্তরে দুই পক্ষের উদ্দেশ্যই একভাবে অর্জিত হয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে সরকার এবং বিরোধীদল- দু’পক্ষের গ্রহণযোগ্যতাই ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। দু’পক্ষই বুঝতে পেরেছে, এভাবে আর চলতে পারে না, এবার ফিরতে হবে। কিন্তু বাঘের পিঠ থেকে নামার উপায় খুঁজে পাচ্ছিলো না কেউই। সিটি নির্বাচন তাদেরকে সেই বের হয়ে আসার পথটা করে দিয়েছে।
শুনতে কিছুটা খারাপ শোনালেও, এটাই এখন বাস্তবতা যে, সিটি নির্বাচনের ঘোষণা হওয়া মাত্র সকল রাজনৈতিক দল এতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। যেন, এদের তেমন কোন কাজ নেই, হঠাৎ করেই একটা কাজ পেয়ে গেছে।
আইনগতভাবে সিটি নির্বাচন একটা অরাজনৈতিক নির্বাচন, রাজনৈতিকভাবে এতে অংশগ্রহণের কোনই সুযোগ নেই। কিন্তু সেই আইন ভাঙ্গছেন সবাই, নির্দ্বিধায়। প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রার্থীদের নিয়ে মিটিং করছেন, দলের প্রার্থী কে হবে তা নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। তারপর হয়তো কিছুটা চক্ষুলজ্জার খাতিরে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলছেন, এই নির্বাচনগুলো আসলে দলীয়ভাবেই হওয়া উচিৎ। সবাই চাইলে, এই পরিবর্তন করা হবে।
হুম, ভালো কথা, “পরিবর্তন করা হবে।” তার মানে পরিবর্তন করা তো হয়নি এখনো। কেন করা হলো না? সংসদ তো আপনাদের ইচ্ছা অনুযায়ীই চলে। তাহলে আইনটা পরিবর্তন করেই না হয় নির্বাচন করতেন। দেরি তো আর কম হয়নি। ঢাকা সিটির নির্বাচন হচ্ছে নির্ধারিত সময়ের পুরো ৮ বছর পর। মানুষ আর ক’টা দিন অপেক্ষা করতেই পারতো। কিন্তু তা হলো না। আইন পরিবর্তন করলেন না, কিন্তু আবার আইন মানলেনও না- এটা কেমন হলো?
আসলে এই দেশে আইন যেন পরিচালিত হয় ক্ষমতাবানের ইচ্ছা অনুযায়ী। তারা যা চাইবেন, তাই হবে। তাদের ইচ্ছার সঙ্গে কোন আইনের বিরোধ দেখা দিলে, আইনই অকার্যকর হবে, অথবা পাল্টে যাবে। আইনের এই অসহায়ত্ব নিয়ে না হয় আর একদিন কথা বলা যাবে, আজকের আলোচনাটা বরং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাক।
আমার মনে প্রথমেই যে প্রশ্নটা আসে, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সিটি কর্পোরেশন বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোন দরকার কি আছে? এই দেশে স্থানীয় সরকার কি আদৌ কার্যকর? মাস কয়েক আগে উপজেলা নির্বাচন হয়ে গেল। এর মাঝে গাজীপুর, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, কুমিল্লা আর নারায়ণগঞ্জে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনও হলো। উপজেলা নির্বাচন হয়েছে কয়েক দফায়। প্রথম দুই দফায় বিরোধীদল সমর্থিত প্রার্থীরা যখন বিজয়ী হতে থাকলো, পরের দফাগুলোতে সরকার তার স্বরূপে ফিরে এলো, ফলাফল তাদের পক্ষে আসতে থাকলো। আর সিটি কর্পোরেশনগুলোতে ভরাডুবি হলো সরকারের। প্রতিটিতেই সরকার দলীয় প্রার্থীরা পরাজিত হলো। এই যে দেশের প্রধান নগরীগুলোতে সরকার দলীয় প্রার্থীর পরাজয়, এতে কি সরকারের কোনই বোধোদয় হয়েছে? তারা কি একবারও মনে করেছেন যে, এই দেশের নগরবাসীরা যেহেতু তাদেরকে পছন্দ করছে না, তো বরং একটু ভেবে দেখা যাক, তারা কি চায়? বরং উল্টো তারা নগরবাসীদের মতামতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, তাদের সেই মতের উপর নিজেদের গোয়ার্তুমি চাপিয়ে দিয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত মেয়র কে নানা ছুতানাতায় জেলে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেদের পছন্দের একজনকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে।
উদাহরণের অভাব নেই। সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে তাকে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। সিলেটের মেয়র জেলে গেছেন সাবেক অর্থ মন্ত্রী কিবরিয়া হত্যা মামলায়। এ মামলার চার্জশিটভূক্ত আসামী হিসাবে তিনি আদলতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করার পর জামিনের আবেদন করেন। আদালত তাকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। আত্মসমর্পনের আগে আদালতে প্রাঙ্গণে মেয়র আরিফুল হক বলেন, এই মামলায় নয় বছর পর সম্পূরক চার্জশিটে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নাকি তার নাম ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। মেয়র না হলে নাকি তিনি এই মামলার আসামী হতেন না।
একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে গাজীপুরের নির্বাচিত মেয়রকে। বলাবাহুল্য, ইনিও আরিফুল হকের মতো বিএনপি দলের কেন্দ্রীয় নেতা। গাজীপুরের মেয়র আবদুল মান্নানকে গ্রেফতার করা হয়েছে গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, নাশকতার পরিকল্পনাকারী, অর্থের যোগানদান ও উস্কানি প্রদানের অভিযোগে।
এই দুই মেয়রই এখন জেলে অন্তরীন। তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলোর চেহারা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নাকি অগ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে- সেটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ সাধারণ মানুষের মনোভাবের তোয়াক্কা কে করে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে-বিরোধীদল থেকে নির্বাচিত এই মেয়র ক্ষমতায় থাকছেন কি থাকছেন না। বাস্তবতা হলো, এদেরকে ক্ষমতায় নয়, থাকতে হচ্ছে জেলখানায়। মেয়র জেলখানায়, তাই বলে নগরীর কাজকর্ম তো আর থেমে থাকতে পারে না। অগত্যা কি আর করা, কমিশনারদের মধ্যে থেকে একজনকে দেয়া হলো ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব। সিলেট আর গাজীপুর- দু্’ই জায়গাতেই করা হলো এই কাজ। আর বলাবাহুল্য, দায়িত্বপ্রাপ্ত এই দুই কমিশনারই কিন্তু আওয়ামী লীগ সমর্থিত। যে লোক নিজেই নিজেকে মেয়র পদে যোগ্য মনে করেননি, আর তাই কমিশনার পদে নির্বাচন করেছেন, তাকে সরকার মেয়র পদে বসিয়ে দিয়েছেন!
তাহলে দাঁড়ালোটা কি? মেয়র যদি সরকার দলের হন, তাহলে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। আর যদি বিরোধী দলীয় হন, তাহলে তাকে জেলে যেতে হবে। এবং আশা করা যায়, তার বাকি মেয়াদকালে তাকে আর বের হতে হবে না্।
সকলকেই জেলে যেতে হবে, বিষয়টা হয়তো এতটা সরলীকৃত নয়। অন্যরকম কিছু দৃশ্যও দেখা যায়। রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের কথাই ধরা যাক। এই ভদ্রলোকের বিরুদ্ধেও গোটা পাঁচেক মামলা আছে। ওই গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, ইত্যাদি অভিযোগে মামলা। গ্রেফতার আতঙ্কে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এর মধ্যে রাজশাহীর পুলিশ আবার সরকারের কাছে আবেদন করেছে, বুলবুলকে যেন বরখাস্ত করা হয়। কারণ তিনি মেয়র হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকলে নাকি মামলায় তিনি প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। এতসব দেখেই কিনা কে জানে, খুলনার মেয়র মনিরুজ্জামান তো অসুস্থ হয়ে অনেকটা শয্যাশায়ী। নারায়ণগঞ্জের মেয়রের অবশ্য সমস্যা হয়নি। কারণ আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করলেও তিনি নিজে বিএনপি’র নন। বরং, নিজেকে তিনি আওয়ামী লীগের বলেই দাবি করেন। ভাগ্য ভালো নারায়ণগঞ্জে নির্বাচনের আগের রাতে বিএনপি দলীয় প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার দলীয় সিদ্ধান্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। নয়তো বিজয়ী হলে এখন তাকেও জেলে কিংবা দৌড়ের ওপর থাকতে হতো।
বিরোধীদলের হয়েও ভাগ্যবান যে দু’একজন মেয়র নিয়মিত অফিস করার সুযোগ পান, তারা আসলে কি ভালো আছেন? উত্তরটা পাওয়া যায় চট্টগ্রামের মেয়র প্রার্থী মোঃ মনজুর আলমের বক্তব্য থেকেই। এই মনজুর আলম গত ৫ বছর মেয়র হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু নগরীর অনেক সমস্যারই সমাধান করতে পারেননি। এবার ভোট প্রার্থনার সময় তাকে অতীতের সেই ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন করলে, তিনি বলেন সরকারের অসহযোগিতার কথা। বিরোধীদলের লোক হওয়ার কারণে মেয়র হওয়ার পর কাজই যদি না করতে পারলেন, তাহলে আবার নির্বাচন করছেন কেন? সাধারণ ভোটাররা কিন্তু এ প্রশ্ন করতেই পারে।
এমন প্রশ্ন করে মনজুর আলমদের মত মানুষকে হয়তো জব্দ করা যাবে, কিন্তু সরকারের যে মানসিকতার কারণে এই পরিস্থিতির উদ্ভব, সেটা কি পুরো জনরায়কেই পরিহাস করছে না? জনগণের রায় কার পক্ষে গেল, সেটা কোন বিষয় নয়, সরকার যা চায় তাই হবে। জনরায় পছন্দ না হলে সরকার নির্বাচিত ব্যক্তিকে হয় জেলে পুরে দেবে, অথবা কাজ করতে দেবে না। এ ধারা চলে আসছে বেশ কয় বছর ধরেই।
তাহলে আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দরকারটা কি? অহেতুক টাকা পয়সার অপচয়। টাকা তো একেবারে কম লাগে না। যেমন ধরা যাক, এবারের তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কথাই। ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনেরই ব্যয় হবে কমপক্ষে ৫৩ কোটি টাকা। এই টাকার মালিক কে? কার টাকা কে খরচ করে? এর বাইরে আবার রয়েছে প্রার্থীদের দেদারছে অর্থব্যয়ের মচ্ছব। এর পুরোটাই কি অপব্যয় নয়? যে নির্বাচন জনরায়ের প্রতিফলন ঘটায় না, তা নিয়ে এত মাতামাতিই বা কেন?
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি চান স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে হোক। বলেছেন যখন, তখন ধারণা করা যায় খুব শীঘ্রই আইন পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। আর আইন পরিবর্তন করা তো এই সরকারের পক্ষে কোন ঝামেলার বিষয় নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এরা ইচ্ছা করলে সংবিধানই পরিবর্তন করে নিতে পারে। তাই সরকারের প্রতি অনুরোধ, দয়া করে নির্বাচন পদ্ধতিটাই পাল্টে দিন। নিয়ম করে দিন, কেবল সিটি কর্পোরেশনই নয়, পুরো স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাতেই কোন ভোটের ব্যবস্থা থাকবে না।
এ বিষয়ে আমার একটা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আছে। প্রস্তাবটা এরকম: দেশে পাঁচ বছরে নির্বাচন হবে মাত্র একবার। যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারা সব দখল করে নেবেন। সব কিছুর জন্য দায় দায়িত্ব তাদের। ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার, পৌরসভার মেয়র-কমিশনার, এমনকি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র-কমিশনার, এই সকল পদে সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর পরই নিয়োগ দেবে। তাহলে পুরো দেশে একই রকম উন্নয়ন হতে পারবে। নির্বাচিত হওয়ার অপরাধে কাউকে আর জেলে যেতে হবে না, উন্নয়ন করতে না পারার জন্য কেউ আর অজুহাত হিসাবে সরকারের দিকে আঙ্গুল তুলতে পারবে না। মাঝখান থেকে কিছুটা হলেও লাভ হবে জনগণের। তাদের কষ্টার্জিত অর্থের বিপুল আপচয় অন্তত কিছুটা হলেও কমবে।
©somewhere in net ltd.