![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। হিন্দি একটি মুভি দেখেছিলাম, নাম- ‘ইনসাফ কা তারাজু।’ মোটামুটি বাজার চলতি কমার্শিয়াল চলচ্চিত্র। যতদূর মনে পড়ে এর নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জিনাত আমান। সেখানে ছিল একটি খল চরিত্র, তাতে অভিনয় করেছিলেন রাজ বাব্বর। এ লোকটির কাজ ছিল মেয়েদের নানা ভাবে ফাঁদে ফেলে রেপ করা। বিচারের আশায় কেউ আদালতে গেলে, সেখানে রাজ বাব্বরের পক্ষে ছিল একজন জাঁদরেল উকিল। আইনের নানা মারপ্যাচে সে মেয়েরপক্ষকে রীতিমত বেইজ্জত করে ছাড়তো।
এহেন মুখোশধারী ভদ্রলোক রাজ বাব্বরের খপ্পরে পড়লো একদিন জিনাত আমান। আদালতে কোন প্রতিকারই পেল না সে। বরং ধর্ষকের সেই দুঁদে উকিলের নানা কুট চালে নিজেই আরও বেশি বেইজ্জতি হলো। এর কিছুদিন পর জিনাতের কিশোরী ছোট বোনটিকেও ধর্ষণ করলো ওই একই লোক। এবার আর আদালতে না গিয়ে সুযোগ পেয়ে জিনাত আমান নিজেই একদিন রাজ বাব্বরকে গুলি করে হত্যা করলো। হত্যাকারী হিসাবে আদালতে আবার সেই জাঁদরেল উকিলের মুখোমুখি হয় জিনাত। আদালতে সে উকিলকে কয়েকটি মোক্ষম প্রশ্ন করে। জানতে চায়, লোকটি যে আসলেই খারাপ- তা তো উকিল সাহেব জানতেন। তা’হলে কেন সে প্রতিবারই তার পক্ষে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলে বলে তাকে বাঁচিয়ে দিত? উকিল হয়েছে বলেই কি সমাজের প্রতি তার কোনই দায়িত্ব নেই? তার মেয়েকে রেপ করে কেউ এসে যদি তাকে অর্থ দেয়, তবুও কি সে ওই ধর্ষকের পক্ষে আদালতে আইনী লড়াই করবে? নিছক অর্থের জন্য নিজের মেয়ে বিপক্ষে যদি লড়তে না পারেন, তাহলে অন্যের মেয়ের ক্ষেত্রে পারেন কিভাবে?
হিন্দি এই চলচ্চিত্রটি দেখার পর আমি বিষয়টিকে আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করি। এবং বলা বাহুল্য দারুন অসহায় বোধ করি। মনে প্রশ্ন জাগে, সমাজের প্রতি কি আইনজীবীদের কোনই দায়বদ্ধতা থাকতে নেই? কোন অপরাধী, এমনকি একজন খুনী, যখন আইনজীবীর শরণাপন্ন হয়, তখন নিয়মই হচ্ছে তার সকল অপরাধের কথা উকিলকে খুলে বলা। অপরাধের বিস্তারিত, খুটিনাটি জানার পরই কেবল একজন আইনজীবী তার মামলাটি গ্রহণ করেন। আইনজীবীর দায়িত্বটা কি? আদালতের কাছে মিথ্যা বলে, মিথ্যার ভিত্তিতে যুক্তি সাজিয়ে, অপরাধীকে নির্দোষ প্রমাণ করা? নাকি তা মক্কেল যাতে প্রকৃত আইন নির্ধারিত ব্যবস্থাটুকু পায়, কোন অনিয়মের শিকার না হয়, সেটি নিশ্চিত করা?
আসলে এতসব কথা বলছি, আমাদের জাঁদরেল কতিপয় আইনজীবীর সাম্প্রতিক কথাবার্তার ভিত্তিতেই। দিনকয়েক আগে উচ্চতম আদালতে কথা বলছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। আদালতে তিনি তার মক্কেলের সাজা কমানোর আবেদন জানালেন। এ কথার উপর ভিত্তি করে সরকার পক্ষের আইনজীবী এটর্নী জেনারেল মন্তব্য করলেন যে, এই প্রথমবারের মত একজন তার যুদ্ধাপরাধের দোষ স্বীকার করলেন। এটর্নী জেনারেলের এই বক্তব্য সেদিনই বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে বেশ ফলাও করে প্রচার হলো। পরদিন এ প্রসঙ্গে নিজামীর আইনজীবী তার ব্যাখ্যা দিলেন। তিনি কি বললেন সেটা একবার দেখা যাক। খন্দকার মাহবুব হোসেন জানান, আদালতে তিনি বলেছেন যে, এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ যে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করেছে তাতে নিজামীর অপরাধ প্রমাণিত হয় না। বক্তব্যের একেবারে শেষ প্রান্তে যেয়ে বলেছেন, “অনেকগুলো অভিযোগের কোনোটিতে যদি মনে হয়, অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, সেক্ষেত্রেও আসামির বয়স ও স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে তিনি লঘু দণ্ড পাওয়ার যোগ্য।”
তাহলে দাঁড়ালোটা কি? গুরু কিংবা লঘু- যাই হোক না কেন, দণ্ডটা যখন মেনে নিচ্ছেন, তখন অপরাধ করেননি এমন দাবি করছেন কোন নৈতিকতার জোরে? তিনি যদি আসলেই অপরাধী না হয়ে থাকেন, তাহলে কোন দণ্ডই তো তার প্রাপ্য নয়। দণ্ড মানলে, অপরাধ মানতেই হয়। লঘু দণ্ড যদি চান, তাহলে বরং বলুন- ছোট খাটো অপরাধ তিনি করেছেন। খন্দকার মাহবুব আসলে ঠিক কি বলতে চাইছেন, সেটাই আমার কাছে পরিষ্কার নয়।
তবে, আমার আজকের এই লেখার প্রতিপাদ্য কিন্তু নিজামীর বিচার নয়। তার বিচারের কি রায় হবে না হবে, অপরাধ স্বীকার করলেই অপরাধ ক্ষমা করার এখতিয়ার আদালতের নাকি ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিবর্গের- সেসব নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। এরকম বিতর্কে অংশ নেয়ার যোগ্যতা আমার নেই। সাধারণ মানুষ হিসাবে আমার প্রশ্নটি অন্য জায়গায়। খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালতে বলেছেন, “এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ যে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করেছে তাতে নিজামীর অপরাধ প্রমাণিত হয় না।” দুঁদে আইনজীবীর এই বাক্যটি নিয়েই আমার প্রশ্ন। এর অর্থ কি তাহলে এমনই দাঁড়াচ্ছে যে, নিজামী একজন যুদ্ধাপরাধী নাকি যুদ্ধাপরাধী নয়, সেটা সম্পূর্ণই নির্ভর করছে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের দক্ষতার ওপর? অথবা দুই পক্ষের আইনজীবীর লড়াইয়ে কোন পক্ষ জিতেছে, তার ওপর?
আদালতে তাহলে লড়াইটা হয় কিসের? ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের, আইনের সঙ্গে আইনহীনতার, নাকি বড় উকিলের সঙ্গে ছোট উকিলের? আদালত কি দুই আইনজীবীর দ্বন্দ্বযুদ্ধের রিং, নাকি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পবিত্র স্থান? মহামান্য বিচারক কি দুই আইনজীবীর লড়াইয়ের রেফারি, নাকি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান?
আর আইনজীবীর নৈতিকতা বা সামাজিক দায়িত্ব- সেটার কথাই বা ভাববো না কেন? খন্দকার মাহবুব হোসেন এই সমাজের একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসাবে পরিচিত। তিনি কি জানেন না, তার মক্কেল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কি করেছেন? তিনি নিজে হয়তো প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না, কিন্তু নিজামী সাহেব কি তাকে সব খুলে জানাননি? এভাবে তিনি যা জানেন, এবং এখন তিনি যা কিছু বলছেন তার মধ্যে কি কোনই বিরোধ নেই? যদি তার জানা এবং বলার মধ্যে কিছুমাত্র তফাৎ থাকে, তাহলে তিনি কি তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করছেন বলে আত্মতৃপ্তি পেতে পারেন?
সমাজে অপরাধ সংঘটিত হবেই। মানব সমাজের শুরু থেকেই অপরাধ হয়ে আসছে। অপরাধমুক্ত সমাজ কল্পনায় হতে পারে, বাস্তবে হয় না। আর হয় না বলেই বিচারের ব্যবস্থা থাকে। আইন আদালত থাকে। সেই আদালতে প্রতিটি মানুষ যাতে সুবিচার পায়, তা নিশ্চিত করতে আইনজীবী থাকেন। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এখন সুবিচারের সংজ্ঞাটাই পাল্টে গেছে। খুনীর আইনজীবী মনে করছেন তার মক্কেলের জন্য সুবিচার হচ্ছে বেকসুর খালাস পেয়ে যাওয়া। আচ্ছা, ধরা যাক কুখ্যাত খুনী এরশাদ শিকদারের কথাই। দীর্ঘদিন তার মামলা চলছে। বিচারকদের সামনে দাঁড়িয়ে এরশাদ শিকদারের আইনজীবীরা কি একবারও বলেছেন যে, তাদের মক্কেল একজন খুনী? তারা কি আইনের নানা অলিগলি হাতড়িয়ে তাকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করেননি? অথচ তিনি কি জানতেন না, এরশাদ শিকদার কত ভয়ঙ্কর খুনি? তাহলে তারা কি আদালতে সমাজের প্রতি তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন তখন? আইন পেশা কি সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করার শিক্ষা দেয়? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয়া যায় যে সত্যমিথ্যা যা-ই হোক না কেন, মক্কেলকে জেতানোই আইনপেশার প্রধান এবং একমাত্র লক্ষ্য, তাহলে আইনপেশার যৌক্তিকতা নিয়েই তো প্রশ্ন উঠতে পারে।
পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই, যেখানে অপরাধ সংঘটিত হয় না। অপরাধ হবেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অপরাধীর যথাযথ বিচার হচ্ছে কি-না। যে রাষ্ট্র সেই বিচারটিকে নিশ্চিত করতে পারে, সেই রাষ্ট্রের প্রতিই সাধারণ মানুষের আস্থা থাকে বেশি। মানুষ নিজেকে তখন নিরাপদ মনে করে। সমাজে কোন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর, সেই অপরাধের যদি বিচার না হয়, সেটাও কি প্রকারন্তরে একটা অপরাধই নয়? অপরাধ যতো আগেই হোক, তার বিচার হওয়া দরকার। চল্লিশ বছর, নাকি তেতাল্লিশ বছর, এসব কোন অজুহাত হতে পারে না। আইনের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে, রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে, নির্মোহভাবে এই বিচারটি করতে পারা জরুরি। জাতীয় স্বার্থে, আইনের গতিশীলতার স্বার্থে উভয়পক্ষের আইনজীবীরই দায়িত্ব হওয়া উচিৎ সত্যভাষণের মাধ্যমে বিচারককে সঠিক রায় প্রদানে সহায়তা করা। আমাদের আইনজীবীরা কি তা করছেন?
আদালতের দৃশ্যটা একবার কল্পনা করলে আমরা কি দেখি? একই বিষয়ে দুই পক্ষের আইনজীবী দুই ধরনের কথা বলছেন। পরস্পরকে মিথ্যাবাদী প্রমাণে জানপ্রাণ লড়িয়ে দিচ্ছেন। এই দুইজনই যে সত্যকথা বলছেন, এমন দাবী তো আর করা যাবে না। তাহলে এতটুকু নিশ্চিত করেই বলা যায় এই দুইজনের একজন মিথ্যা বলছেন। কেন বলছেন তিনি মিথ্যা? কেবলই অর্থের লোভে? তাহলে কেবল অর্থ কিংবা ক্ষমতার লোভে যারা এভাবে মিথ্যা বলেন, তাদেরকে শ্রদ্ধা করতেই হবে কেন?
এসব প্রশ্নকে অনেকই হয়তো “আপত্তিকর” হিসাবে চিহ্নিত করতে চাইবেন। আপত্তিকর না হলেও প্রশ্নগুলো যে কারও কারও জন্য অনেকটাই “অস্বস্তিকর” তা বলা যায় নির্দ্বিধায়। তাই এ নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে না যেয়ে বরং আবার একটা মুভি’র কথাই বলি।
মুভিটার নাম ‘লায়ার লায়ার’। ১৯৯৭ সালের এই মুভিটিতে নায়ক জিম ক্যারি একজন একজন লইয়ার বা আইনজীবী। একেবারে শুরুর দৃশ্যেই দেখা যায়, তার ছোট বাচ্চাটির স্কুল টিচার একদিন ছাত্রদের কাছে জানতে চাইলো কার বাবা কি করেন। কারও বাবা টিচার, কারও বাবা ডক্টর, বিজনেসম্যান, ইত্যাদি। জিম ক্যারির বাচ্চা বললো, তার বাবা একজন ‘লায়ার’। টিচারের তো ভিরমি খাওয়ার অবস্থা, তিনি বুঝতে পারলেন না। তারপর একটু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে বুঝতে পারলেন ছাত্র তার লইয়ারকেই ভুল করে লায়ার বলেছে।
ছোট বাচ্চাটি কি আসলে ভুল বলেছিল?
©somewhere in net ltd.
১|
১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:০৭
মাঘের নীল আকাশ বলেছেন: দারুন কথা বলেছেন! জলি এল এল বি মুভিটাও দেখতে পারেন!
এসব উকিলরাই কিন্তু আবার আমাদের সার্টিফিকেট সত্যয়ন করে, কী হাস্যকর! আমি মনে করি, এসবক্ষেত্রে বিচারপতিও তাঁর দায় এড়াতে পারেন না!