![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভারতের আসাম থেকে আসা একটা হাতি গত দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশের চারটি জেলা দাপিয়ে বেড়িয়েছে। না, একটু বোধকরি ভুল বললাম। এই সময়ে ওই এলাকাজুড়েই কি কেবল ছিল হাতিটির পদচারণা? ছিল না কি দেশের অনেক মানুষের হৃদয়জুড়েও? প্রায় প্রতিদিনই হাতিটির কর্মকাণ্ড, তাকে ঘিরে আমাদের কর্মযজ্ঞ- জায়গা করে নিয়েছিল মিডিয়াতে। হাতির খবর পড়তে পড়তে, দেখতে দেখতে, অনেকে হয়তো বন্য এই প্রাণীটিকে ভালোও বেসে ফেলেছিল। নয়তো এর হঠাৎ মৃত্যুতে মন খারাপ কেন হবে?
হাতিটি কারও পোষা ছিল না, ছিল বন্য হাতি। আসাম থেকে বাংলাদেশে ঢুকে কোন ভিসা ছাড়াই। বানের পানিতে ভেসে বাংলাদেশে প্রবেশ করে কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে। সেখান থেকে গাইবান্ধা হয়ে জামালপুর জেলায়। জামালপুরে দুই দিন থাকার পর যায় বগুড়া। সেখানে থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে আবার জামালপুরে। এরপর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত জামালপুরেই ছিল। এই যে মুক্তভাবে পুরো দেড়টি মাসেরও বেশি সময় ঘুরে বেড়িয়েছে সে লোকালয়ে, কোন মানুষকে হত্যা দূরে থাক বিনা কারণে আহত পর্যন্ত করেনি। কিন্তু আমরা মানুষেরা তাকে নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধরেছি, আহত করেছি, ক্লান্ত করেছি, এবং শেষ পর্যন্ত মেরেই ফেলেছি।
এই যে ‘মেরে ফেলেছি’ বললাম, এর সঙ্গে হয়তো কেউ কেউ একমত হবেন না। বিশেষ করে, গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, সরকারপক্ষের কেউই এটা স্বীকার করবেন না। এরই মধ্যে তাদের ভাষ্য পাওয়া গেছে। তারা বলেছেন, হাতিটির মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তদন্ত করে দেখবেন, কেন কি কারণে মরে গিয়ে হাতিটি কতিপয় সৎ ও আন্তরিক সরকারী কর্মকর্তাকে বিপাকে ফেললো। তবে এরই মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘তাপদাহে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাতিটি মারা গেছে।’
শেষ পর্যন্ত এই তাপদাহ এবং হৃদরোগ তত্ত্বটিই যে প্রতিষ্ঠিত হবে তা নিয়ে আমার অন্তত কোন সন্দেহ নেই। ময়না তদন্তের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠনের কথাও যেন পড়লাম কোথায়। তারা যে কি বলবে, সেটা তো জানাই। আমাদের দেশে মানুষের জন্য যে পদ্ধতি প্রচলিত, তা দেখে দেখে আমাদের অনুভূতি অনেক আগেই ভোঁতা হয়ে গেছে। অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কুমিল্লার তনু হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ময়না তদন্ত সেখানে হয়েছিল। একবার নয়, দু’বার হয়েছিল। প্রথমবার বলা হলো, তনুকে ধর্ষণ করা হয়নি। দ্বিতীয়বার বলা হলো সেক্স হয়েছে, তবে ধর্ষণ হয়নি। দিন কয়েকের ব্যবধানে দুই বার হলো ময়না তদন্ত। এই তদন্ত যারা করেছেন, তারা সবাই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার। দুই ডাক্তার দুই ধরনের মতামত দিলেন। আমরা কারটা নেবো?
আসলে এই নেয়াটা নির্ভর করে, আপনি কার পক্ষে তার ওপর। যেহেতু, দেশের বেশিরভাগ মানুষ তনুর পক্ষে, তাই তারা তনুর পিতা-মাতার মত দুই ভষ্যের কোনটিকেই গ্রহণ করেনি। মানৃষ বুঝে গেছে, শুরু থেকে এই হত্যাকাণ্ডটিকে যেভাবে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলেছে, সেটাই আসলে শেষ অব্দি টিকে থাকবে। এর মাঝে জনগণের চাপে মাঝেমধ্যে তদন্ত, ময়না তদন্ত ইত্যাদি কিছু নাটক হবে। কাজের কাজ আর কিছু হবে না। সে তুলনায় অবলা হাতি আর কি?
তবে এই হাতিটিকে একেবারে নামগোত্রহীন হয়তো বলা যাবে না। বনের হাতি, সেখানে আর নাম কে দেবে? তবে আমাদের লোকালয়ে এসে যখন পড়লোই, তখন আমাদের কতিপয় সরকারী কর্মকর্তা এর নাম দিলেন ‘বঙ্গ বাহাদুর।” এই নামটা আমার ঠিক পছন্দ হয়নি। প্রথম কথা হলো, হাতিটা তো আমাদের ছিল না। ওটা প্রতিবেশি দেশ থেকে আসা, তাই বড়জোর আমাদের অতিথি ছিল। ঠিক আছে, মানলাম অনুপ্রবেশকারী, তবু অতিথি তো। আমি তো মনে করি, সম্ভব হলে হাতিটিকে আবার ওদের দেশে ফেরত পাঠানোই যুক্তিযুক্ত হতো। হাতিটি যেহেতু আমাদের নয়, তাই আগ বাড়িয়ে তার নামকরণ করতে হবে কেন?
আমাদের দেশে নামকরণ করাটা একটা রোগে পরিণত হয়েছে। এই রোগটি সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যেই দেখা যায়। এরশাদ সাহেব যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি নিজের নামে স্টেডিয়াম করলেন, প্যারেড স্কোয়ার করলেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জনরোষে ‘এরশাদ’ ভূলিণ্ঠিত হলো। এমনকি যেখানে তার ‘এরশাদ’ নামটি ছিল না, সেই ‘চন্দ্রিমা উদ্যান’ পর্যন্ত বিএনপি আমলে পাল্টে হয়ে গেল ‘জিয়া উদ্যান।’ সরকার পাল্টালো, এরশাদ অবশ্য ক্ষমতায় এলেন না, এলো আওয়ামী লীগ। এরা ক্ষমতায় প্যারেড স্কোয়ার বা আর্মি স্টেডিয়ামের ভূলুণ্ঠিত ‘এরশাদ’কে তুলে না আনলেও ‘জিয়া উদ্যান’ পাল্টে আবার সেই ‘চন্দ্রিমা উদ্যান’ই করলেন। ২০০১ এ বিএনপি ক্ষমতায় এসে আবার ‘চন্দ্রিমা’ কে ‘জিয়া’ বানালো। ২০০৮ সালে আবার ‘চন্দ্রিমা।’ দুর্দান্ত এক মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা!
বর্তমানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। এখন সবচেয়ে অব্যর্থ নামকরণ হচ্ছে- ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি জুড়ে দেয়া। এটা এতটাই কার্যকর যে, কেউ কোন অপকর্ম জায়েজ করতে যেয়েও যদি এই নামটি ব্যবহার করে বসে, সমালোচকরা কিছু সময়ের জন্য হলেও থমকে যান। ধরা যাক, কতিপয় দুষ্ট লোক সরকারী একটা জায়গা দখল করলো, আর তার পর সেখানে ছোট একটা ঘর তুলে সাইনবোর্ডে লিখে দিলো “বঙ্গবন্ধু নৈশ বিদ্যালয়।” সেখানে নৈশকালে শিক্ষাই হোক আর কুশিক্ষার আসরই বসুক- সেটি ভেঙ্গে দেয়া কিন্তু অন্য সকল দখলদারদের উচ্ছেদ করার মত সহজ হবে না। আসলে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটাই এমন। এই নামের কিছুমাত্র অবমূল্যায়ন হোক, সেটা কোন সচেতন মানুষই চান না। পুরো জাতির কাছেই এটি একটি শ্রদ্ধার নাম, আবেগের নাম। হয়তো এসব কারণেই, অতিথি হাতির নামের সঙ্গে ‘বঙ্গ’ শব্দটা জুড়ে থাকা, আমার ভালো লাগেনি। আমি এ থেকে কোন ইঙ্গিতপূর্ণ পরিণতির কথা কখনোই ভাবিনি, তবে বিষয়টি আমার পছন্দ হয়নি। যিনি এমন নামকরণ করেছেন, আমার বিবেচনায় তিনি কাজটি ঠিক করেননি। হাতিটি মারা যাওয়ার পর, আমার বিবেচনাকে আরও বেশি যথার্থ মনে হচ্ছে।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ‘বঙ্গ বাহাদুর’ মারা গেছে। আমি বলবো- আমাদের অতিথি আপ্যায়ন যথাযথ ছিল না। যখন যা কিছু করা দরকার ছিল, করতে পারিনি। হাতিটির মৃত্যুর পর, সংশ্লিষ্ট এক সরকারী কর্মকর্তা ফেসবুকে তার স্ট্যাটাসে নাকি লিখেছেন- “…আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি… কিন্তু স্যরি।” সাংবাদিকদের কাছে অন্য কর্মকর্তারাও যার যার মত করে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করছেন। যেমন একজন বলেছেন, “আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। এখন আর কথা বলার শক্তি নেই।” কথা না বলতে পারার মত ক্লান্ত তারা কি করে হলেন? সে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বলেছেন, টানা কাজ করতে গিয়ে উদ্ধারকারী দলের সদস্যরাও হাতিটির মত দুর্বল হয়ে পড়েছেন, কিন্তু বন্যপ্রাণীর প্রতি ভালোবাসার টানেই তারা নাওয়া-খাওয়া ভুলেছিলেন। তিনি আরও বলেন, “তাকে (হাতিটিকে) ভালোভাবে সরানোর সব প্রস্তুতি রাখা ছিল। কারও ক্ষতি করেনি সে, এলাকাবাসী ও উদ্ধারকারী দলসহ সবার ভালোবাসা পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত আর পারা গেল না।”
এসব আবেগপ্রবণ কথা। শুনতে ভালো লাগে। হাতিটি যদি শেষ অব্দি বেঁচে থাকতো, এই কথাগুলো অত্যন্ত অর্থবহ হতো। মানছি, তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, মানছি- নাওয়া খাওয়া ভুলে টানা কাজ করতে যেয়ে হাতিটির মতই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু এসব জেনে আমাদের লাভ কি? আপনারা তো হাতিটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি। অথচ সেটাই ছিল আপনাদের দায়িত্ব। সেই দায়িত্বটাই আপনাদেরকে দেয়া হয়েছিল।
তাদের এই দায়িত্ব পালনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সরিষাবাড়ির কয়রা গ্রামের অধিবাসীদের অভিমতের দিকে একবার তাকানো যেতে পারে। এই গ্রামেই শেষ দিনগুলো কাটিয়েছে হাতিটি। এখানেই মারা গেছে, এখানেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে। এই গ্রামের সম্পন্ন কৃষক বরকত উল্লাহ হাজি জানান, হাতিটির কারণে এলাকাবাসী আতঙ্কিত থেকেছে, কিন্তু তারপরও তারা কোন উৎপাত করেনি। বরং হাতিটিকে খাবার জোগাড় করে দিয়েছে। হাতিটির মৃত্যুর জন্য তিনি সরাসরি সরকারের উদ্ধারকারী দলের লোকজনের গাফিলতিকে দায়ি করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমার দুই বিঘা জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। তাতে আমার দুঃখ নাই। কিন্তু একদল সরকারি লোক হাতিটাকে বাঁচাতে পারল না। এটা দুঃখজনক।”
এই গ্রামের এক গৃহিণী ছাহেরা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা যখন ভাবছিলাম হাতিটা সুন্দরভাবে তার বনে ফিরে যাবে তখন তার মৃত্যু হল। এটা মানা যায় না।” ছাহেরার অভিযোগ, “হাতিটাকে ঠিকমতো খাবার দেয়নি ব্যাটারা। কয়েকটি করে আখ দেওয়া হত। দুই-একটা কলাগাছ। এই খেয়ে কি অত বড় প্রাণীটার জান বাঁচে।”
আমি নিজে ঘটনাস্থলে ছিলাম না। হাতিধরা বিষয়ে তাত্ত্বিক কোন জ্ঞানও নেই। এতসব কথা যে গ্রামবাসী বলছেন, তাদেরও হয়তো নেই সেই জ্ঞান। তবে সফলতা এবং ব্যর্থতা উপলব্ধির মত জ্ঞান তো রয়েছে। ওই যে ছাহেরা বেগম, তিনি যখন বলেন, “এই খেয়ে কি অত বড় প্রাণীটার জান বাঁচে?” তখন তার কণ্ঠে যেন সন্তানের জন্য চিরন্তন মায়ের আকুতি শুনতে পাই। অনেকে এমন কথাও বলেছেন, আসলে হাতিটিকে একদিনের ব্যবধানে দুই দুইবার ট্রাংকুলাইজার দেয়াটাই আসলে তার জন্য কাল হয়েছে। প্রথমবার ঘুম পাড়ানোর পরপরই তাকে সরিয়ে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু সেটা তারা করতে পারেনি। কড়া ওষুধের প্রভাবে হাতিটি যখন প্রথমবার দশ ঘন্টার জন্য ঘুমালো, তখন দেখা গেল আমাদের ‘মহাজ্ঞানী কর্মকর্তারা’ হাতিটিকে সরানোর জন্য দরকারি ক্রেনটি নিতেই ভুলে গেছেন! ক্রেনই যখন নেই, তখন অত তড়িঘড়ি করে তাকে অজ্ঞান কেন করা হলো? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
জানা কথা, আগামী কয়কেটি দিন এভাবেই চলবে। ওই কর্মকর্তারা নানাভাবে প্রচার করতে থাকবেন, আসলে হাতিটিরই দোষ ছিল। হার্টের রোগী হওয়া সত্ত্বেও তার বানের জলে ভেসে এই দেশে আসাই ঠিক হয়নি। সেই সঙ্গে একথাও বলবেন- তারা কতটা অসম্ভব রকম আন্তরিক ছিলেন। পরিশ্রম আর টেনশনে কার কতটা ওজন কমেছে, হয়তো সে সংক্রান্ত স্ট্যাটাসও আসবে ফেসবুকে।
শেষ পর্যন্ত যদি তাদের আন্তরিকতাকে গ্রহণও করি, তারপরও কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাবে যোগ্যতা নিয়ে। যোগ্যতার বিকল্প আন্তরিকতা নয়। অযোগ্য ব্যক্তি সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়েও বিমান চালাতে পারবেন না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- সরকারী কর্মকর্তারা কখনোই তাদের এই অযোগ্যতার বিষয়গুলো মানতে চান না। তারপর যখন পরিস্থিতি পুরোই এলোমেলো হয়ে যায়, তখন আর কিছু করার থাকে না।
অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটা প্রশ্ন মনে জাগছে। আচ্ছা, রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য যে সকল সরকারী কর্মকর্তা এখন গোঁ ধরে বসে আছেন, তাদের এমন সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর্যাপ্ত যোগ্যতা আছে তো? নাকি শেষে সুন্দরবনেরও এই বঙ্গ বাহাদুরের পরিণতি হবে?
©somewhere in net ltd.