নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাসুদ কামাল

মাসুদ কামাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

হাওরে ত্রাণ, ক্ষুধার্ত মানুষের আওয়ামী লীগ-বিএনপি

০৭ ই মে, ২০১৭ ভোর ৬:৪৭


আমরা হাওরে গিয়েছিলাম। ২ মে মঙ্গলবার রাতে রওয়ানা হলাম ঢাকা থেকে। সাংবাদিক হিসাবে সংবাদ সংগ্রহের এসাইনমেন্ট নিয়ে নয়, গিয়েছিলাম আমাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে সেখানকার দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে। বেশি কিছু হয়তো পারবো না, কিন্তু একবেলা খাবারের মত ভাতেরও যদি ব্যবস্থা করতে পারি, সেটাই ছিল আমাদের লক্ষ্য।
শুরুতে উদ্যোগটা নিয়েছিল পান্না, মনজুরুল আলম পান্না। ইটিভিতে চাকরি করেছে, রিপোর্টিং ছাড়াও ‘একুশের রাত’ নামের অনুষ্ঠানটি দীর্ঘদিন সঞ্চালনা করেছে। আমার সঙ্গে পরিচয় অবশ্য আরও অনেক আগে থেকে। ওর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল কাজী চপল, মাসুদুল হাসান রনিসহ আরও বেশ কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী। ফেসবুকে পান্না একটা স্টাটাস দিলো, জানালো আমাদের ইচ্ছার কথা, কেউ সাহায্য করতে চাইলে কিভাবে করতে হবে, সেটাও বলা হলো সেখানে। বলা যায়, অভাবিত সাড়া পেলাম। পান্নার স্ট্যাটাসে আমাদের কয়েকজনের ফোন নাম্বারও ছিল। অনেকেই ফোন করলেন, জানতে চাইলেন আমাদের পরিকল্পনার কথা। হাওরের কোন এলাকায় যাবো, কিভাবে যাবো, কে কে যাবো, কি দেবো, ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন।
হাওরের মানুষ অভাবে আছে- এতটুকু ধারণা ছিল। কিন্তু সেই অভাবের স্বরূপটা কি, জানতাম না। বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে যে চেহারাটা পেয়েছিলাম, তাতে মনে হয়েছে খাদ্যাভাবটাই বুঝি প্রধান সমস্যা। সে কারণেই ঠিক করলাম, আর কিছু না হোক, কিছু খাবার নিয়ে যাই। দু’কেজি চাল আর এক কেজি আলু, প্রতিজনের জন্য এই ছিল আমাদের প্রস্তুতি। এভাবে এক হাজার চারশ’ প্যাকেট করা হলো। এই এক হাজার চারশ’জনকে আমরা দু’কেজি চাল আর এক কেজি করে আলু দিতে পারবো। আর ছিল কিছু বিস্কুট, ওষুধপত্র। বিস্কুটগুলো প্রধানত নেয়া হয়েছিল শিশুদের জন্য। তিন চার হাজার শিশুকে এক প্যাকেট করে বিস্কুট দেয়া যাবে- এমনই ছিল প্রস্তুতি। জানি, হাওরের প্রকৃত চাহিদার তুলনায় এই আয়োজন নিতান্তই অপ্রতুল। তারপরও আমরা গেলাম, আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু করার ইচ্ছা নিয়ে।
আমরা গিয়েছিলাম নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরি আর মোহনগঞ্জ এলাকায়। আমাদের মধ্যে দু’একজন এমনও ছিলেন যারা জীবনে কখনো হাওর দেখেননি। নেত্রকোনা জেলা সদর থেকে ৪০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্ব পাড়ি দিয়ে মোহনগঞ্জ হয়ে আমরা যখন বোয়ালিয়া ঘাটে পৌছলাম, তখন রোদ বেশ চড়া। ঘাট মানে একটা উচু রাস্তা, সেই রাস্তার দুপাশে যতদূর দৃষ্টি যায়, কেবল পানি আর পানি। অনেক দূরে দূরে হালকা সবুজ দু’একটা দ্বীপের মত দেখা যায়, জানতে পারলাম সেগুলো এক একটি গ্রাম। বড় একটা ট্রলার ভাড়া করে তার মধ্যে সব মালামাল নিয়ে রওয়ানা হলাম।
বোয়ালিয়া ঘাটে আসাদ মিয়ার সঙ্গে কথা হলো। ছোট খাট মানুষ, মুখে একটু দাড়ি, চেহারায় অপুষ্টির ছাপ। অপুষ্টিজনিত কারণে বয়স ঠিক বোঝা যায় না, পঁয়ত্রিশও হতে পারে, আবার পঞ্চান্নও হতে পারে। তার বাড়ি নুরআলীপুর গ্রামে। গ্রামটি কোথায়- জানতে চাইলে হাত তুলে যে দিকে ইঙ্গিত করলো, ঠিক গ্রামের কোন অবয়ব চোখে পড়লো না। পানিতে ভেসে থাকা ছোট্ট একটা সবুজ কেবল দেখলাম। সে প্রথমেই জানতে চাইলো- আমরা কি সরকারি লোক? আমি মাথা নাড়লাম। তাহলে কোন এনজিও? আবার মাথা নাড়লাম। তাহলে আপনার কারা?
যখন বললাম, আমরা নিজেরা এবং অন্য অনেক সাধারণ মানুষের সাহায্য নিয়ে আপনাদের কাছে এসেছি, আসাদ মিয়া খুবই অবাক হলেন। তার আঞ্চলিক উচ্চারণে যা বললেন, তা হলো- তারা আগেও দেখেছেন, বন্যা বা কোন দুর্যোগে ত্রাণ বলতে যা কিছু আসে তা সরকার বা এনজিও’র কাছ থেকেই । সরকারী ত্রাণ হলে চেয়ারম্যান মেম্বার কিংবা সরকার দলীয় লোক ছাড়া আর কেউ কিছুই পায় না। এনজিও হলে রঙ ঢঙ বেশি হয়। সবাইকে দাঁড় করিয়ে ছবি টবি তুলে, কাগজে টিপসই নেয়, আরও কত কি। জানতে চাইলেন- কিভাবে দেবো আমরা এই চাল, আলু? উল্টা আমিই তার কাছে পরামর্শ চাইলাম, কিভাবে দেয়া যেতে পারে? আমাদের সঙ্গেই সেখানকার একজন মেম্বার ছিলেন, জানতে চাইলাম-এরকম মেম্বার কিংবা কোন জনপ্রতিনিধির হাতে দিয়ে দিলে কেমন হয়? আসাল মিয়া যেন আঁতকে উঠলেন। বললেন- তাহলে আর কেউই পাবে না। এই মেম্বার সাহেব লোক ভালো। টাকা পয়সাও আছে। প্রতিবছর হাজার মনের ওপর ধান পায়। কিন্তু এই বন্যায় সে নিজেও সর্বশান্ত হয়ে গেছেন। তার নিজের ঘরেও বেশি চাল আছে কি না সন্দেহ। তারচেয়ে বরং, আপনারা নিজে হাতে মানুষকে দেন।
আসলে আমাদের এমন পরিকল্পনাই ছিল। ট্রলার নিয়ে আমরা প্রথমে সেই নুরআলীপুর গ্রামেই গেলাম। পুরো গ্রামটাই যেন একটা দ্বীপ। আমাদের সঙ্গে ওই মেম্বার সাহেব ছিলেন, তার সঙ্গে আরও দু’জন। এ ছাড়া ঢাকা থেকে আমাদের সহযাত্রী, বাংলাভিশনের ভিডিও এডিটর লিটন আচার্য। লিটনের বাড়ি এই হাওর এলাকাতেই, তাই সবকিছুই তার চেনা। তারও পরামর্শ ছিল নুরআলীপুর গ্রাম দিয়েই শুরু করার।
নুরআলীপুর গ্রামটি তেমন বড় নয়। আসলে হাওর এলাকার অধিকাংশ গ্রামের চেহারা একই রকম। চারদিকে পানি, তার মধ্যে ভাসমান একটুকরো উচু এলাকা। এই গ্রামগুলো এলাকাবাসীরই তৈরি। মাটি তুলে তুলে উচু করে গ্রাম বানানো হয়। তারপর সেই গ্রামে গড়ে ওঠে বসতি। এক একটি গ্রামে এক দেড়শ’ থেকে শুরু করে চার পাঁচ শ’ ঘর। চারদিকের এই যে থই থই পানি, ছয় মাস থাকে এভাবে। পানি নেমে গেলে বাকি ছয় মাস শুকনো। তখনই সেখানে হয় চাষাবাদ। চাষ বলতে বছরে একটাই, বোরো ধান। এই ধানটা এমনভাবে চাষ হয়, যেন বৈশাখের মাঝামাঝি থেকে ধান কাটা শুরু করা যায়।
হাওরে বন্যা প্রতিবছরই হয়, এটা এখানকার মানুষের জন্য নতুন কিছু নয়। উজান থেকে আসা ঢালের পানিতেই হয় বন্যা। কিন্তু সেই পানি আসা শুরু করে বৈশাখের শেষ দিক থেকে। ততদিনের বেশিরভাগ জমির ধান কাটা হয়ে যায়। যা দু’একটা বাকি থাকে, সেগুলোও পানি আসতে আসতে কেটে ফেলা যায়। বৈশাখের পরেও উচু কিছু জমির ধান রয়ে যায়, তার কিছু কিছু হয়তো তলিয়েও যায় পানির নিচে। তখন গ্রামের গরিব লোকেরা ডুব দিয়ে দিয়ে সেসব ধান কেটে নিয়ে যায়। এরকম লোকের সংখ্যাও একেবারে কম নয়।
এবার এ এলাকায় ঢলের পানি এসেছে পুরো একমাস আগে, চৈত্র মাসের আঠার তারিখে। ধান পাকা দূরে থাক, কোন কোন জায়গায় ধান পুরুষ্ঠ পর্যন্ত হয়নি। কাঁচা সেই ধানের গাছগুলো ডুবে গেল মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই। এমন দুর্যোগের সঙ্গে পরিচিত নয় এই এলাকার মানুষ। আসাদ মিয়া বললেন, তিনি নিজে এরকম আর কখনো দেখেননি। তার বাবার বয়স এখন সত্তরের উপরে, তিনিও নাকি এত আগে বানের পানি নেমে আসতে দেখেননি। সব শেষ হয়ে গেছে। এক ছটাক ধানও কেউ ঘরে তুলতে পারেনি।
হাওরের এই গ্রামগুলোতে সবাই যে গরিব- তা নয়। প্রতিটি গ্রামে সাত আটজন লোক আছেন যাদের বছরে সাত আটশ’ মন থেকে শুরু করে দুই তিন হাজার মন ধান হয়। এই ধান দিয়েই চলে তাদের সারাটা বছর। তেমনই একজন অবস্থাপন্ন মানুষ বালুয়ারি গ্রামের মানিক মিয়া। জানালেন, প্রতিবছর তার সাতশ’ মনের মত ধান হয়, আর হয় দেড়শ’ মন বাদাম। এবার মনে হচ্ছিল ফলন খুবই ভালো হবে। কিন্তু এখন সবই শেষ, সব ভেসে গেছে। মানিক মিয়া বলছিলেন, আমার সতেরটা গরু। এদেরকে কি খেতে দিই? ঘরে চাল যা জমানো ছিল, তা দিয়ে আমাদের হয়তো আর মাস দু’য়েক চলবে। কিন্তু গরু খাবে কি? প্রতিবছর ধান থেকে যে খড় হতো, সেগুলো খেতো ওরা, এবার তো সেটাও নেই। গরুগুলোর দিকে তাকানো যায় না, শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে। কি করবো। গরুর চিন্তায় আমি নিজেই বিছানায় পরে গেলাম। বন্যা শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে স্ট্রোক করলাম। দাঁড়াতে পারি না, হাঁটতে পারি না। ডান দিকটা একেবারে অবশ। ময়মনসিংহ হাসপাতালে নিয়ে গেল। পুরা সতেরদিন পর আল্লাহ’র রহমতে কিছুটা ঠিক হলাম। বাড়িতে এসে ছয়টা গরু বিক্রি করে দিলাম। তিন লাখ টাকার গরু বেচলাম এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার টাকায়। সেখান থেকে পয়ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে গরুর জন্য খাবার কিনেছি। নিজেরা আধাবেলা খাই, কিন্তু অবলা জন্তুকে তো আর না খাইয়ে রাখা যাবে না।
মানিক মিয়া জানালেন, প্রতিবছরই বন্যায় কিছু কিছু ফসল নষ্ট হয়, বড়জোর চার আনা পানিতে ডুবে যায়। তবে সেগুলোও ঠিক নষ্ট নয়, কারণ গরীব মানুষেরা সেগুলো ডুবে ডুবে কেটে নেয়। কিন্তু এবার একেবার ষোল আনাই গেছে। সব ডুবে যাওয়ায় দিন মজুরদের খুবই খারাপ অবস্থা। ধান কাটা, মাড়াই করা- এসব কাজে জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত এদের অনেক চাহিদা। আটশ’ টাকা পর্যন্ত রোজ হতো তাদের মজুরি। এবার কোনই কাজ নেই তাদের। সে কারণে সেইসব শ্রমিক প্রায় সবাই চলে গেছে এলাকা ছেড়ে। গেছে তারা নিকটবর্তী শহরে, কাজের আসায়।
নুরআলী পুর, আসাদপুর নয়াপাড়া, আসবপুর, আসবপুর শিবির, বানিহারি- এরকম যে গ্রামেই গিয়েছি ত্রাণ দিতে, দেখেছি কর্মক্ষম পুরুষ মানুষ নেই বললেই চলে। ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় অনেকে আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ত্রাণ নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়, শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায় না। রাজনৈতিক কর্মীদের হস্তক্ষেপের কারণে অনেক সময় বিপদও তৈরি হয়। এতসব বিবেচনায় ঝামেলা এড়াতে আমরা ঠিক করেছিলাম, কেবল মাত্র নারী ও শিশুদের মধ্যে বিতরণ করবো চাল, আলু, বিস্কুট। যেখানে নেমেছি, নামার আগেই দেখেছি শতশত মানুষ পাড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সামান্য খাদ্যের জন্য এমন হাহাকার, আমার এতবছরের জীবনে আর কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। দেখেছি হয়তো দু’একজনের চোখেমুখে, কিন্তু পুরো গ্রামের সকল মানুষের মধ্যে এমন খাদ্যাভাব, ভাবাই যায় না।
গ্রামগুলোতে কেবল নারী শিশুদের মধ্যে ত্রাণ দেয়ার পর শেষ বেলায় এসে মোহনগঞ্জের ঘাগড়াছড়ি এলাকায় ভেসে থাকা পাকা সড়কের উপর ত্রাণ দিতে গেলাম। শুরুতে সেখানে থাকা অল্প কিছু লোককে বললাম, আপনার লাইন দিয়ে বসে পড়ুন, সবাইকে দু’টি করে প্যাকেট দেয়া হবে। দেয়া শুরু করলাম, কিন্তু যতই দিই, ততই যেন বাড়তে থাকে লোকের সংখ্যা। আমাদের নিয়ে যাওয়া চাল আলু যখন শেষ, তখনও দেখি চারদিকের গ্রাম থেকে নৌকা ভরে ভরে লোকজন কেবল আসছে আর আসছে। ত্রাণের খবর ছড়িয়ে গেছে মুখে মুখে, যে যেখানে যেভাবে ছিল, ছুটে আসছে। অনেককেই আর দিতে পারলাম না। মন খারাপ হয়ে গেল। কেন এত কম নিয়ে এসেছি? অথচ শুরুতে সকালে যখন নেত্রকোনা থেকে এক মিনিট্রাক ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল সারাদিনে এতগুলো দিয়ে শেষ করতে পারবো তো? দেখলাম মানুষের ক্ষুধা যে কত সর্বব্যাপী আকার ধারণ করেছে এই হাওর এলাকায়, তা নিজে সেখানে না গেলে বোঝার উপায় নেই।
ঘাগড়াছড়ির সেই সড়কের উপরে থাকা অনেককে আমরা কিছুই দিতে পারিনি। একজন বললো- কেউ কেউ দু’বার করে নিয়েছে। একবার নিয়ে সেটা পিছনে রেখে এসে আবার নিয়েছে। কেন এমন করলো? এমন না করলে তো আরও বেশি লোক পেতে পারতো? আমাদের এমন কথায়, ছোট একটা বাচ্চা, বয়স বড়জোর দশ কি এগার হবে, বললো- কি করবে, ঘরে তো চাল নাই। দুই কেজি দিয়ে একবেলার বেশি চলবে না।
এই যে এমন বিপদ, এসময় সরকার কি করছে? কি করছে দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা? সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য ত্রাণের ঘোষণা এসেছে। খোদ ত্রাণমন্ত্রী বলেছেন প্রতিটি পরিবারকে মাসে ত্রিশ কেজি করে চাল আর পাঁচশ’ করে টাকা দেয়া হবে। আমাদের সঙ্গে যে মেম্বার সাহেব ছিলেন, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি যা শোনালেন, হতবাক হয়ে গেলাম। জানালেন, তার ওয়ার্ডে আঠারশ’ পরিবার বা খানা আছে। তিনি পেয়েছেন মাত্র আড়াই শ’ পরিবারের জন্য সরকারী ত্রাণ। এই আড়াই শ’ পরিবারই মাসে ত্রিশ কেজি চাল ও পাঁচশ করে টাকা পাবে। এখন আঠারশ’ থেকে কোন আড়ইশ’ কে আমি এই ত্রাণ দেবো? আমি খুবই চিন্তায় ছিলাম। আড়াই শ’ নাম দিলে বাকিরা তো আমার উপর নাখোশ হবে। তবে শেষ পর্যন্ত আমার তেমন বিপদ হয়নি। কারণ সরকারের কাছে আমাকে আর নাম দিতে হয়নি, আওয়ামী লীগের লোকেরাই নাম দিয়ে দিয়েছে।
আমরা যখন ফিরে আসছিলাম, তখন সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার হয়ে গেছে। তারপরও আমাদেরকে ঘিরে অনেক মানুষ। তারা ভাবছিল, আরও যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে দেয়ার জন্য! কাজী চপল একটা ছোট ছেলের সঙ্গে কি যেন কথা বলছিল। আমাদেরকে ডেকে বললেন, শুনুন কি বলছে এই বাচ্চাটা। আমরা এগিয়ে গেলাম। ছেলেটি লজ্জা পেল। কথা বলতে চাইছিল না। চপল বললো- আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সরকারী ত্রাণ পাওনি তোমরা? জবাবে সে কি বললো শুনুন। আমরা বারবার চাপ দিতে আবার বললো ছেলেটি- ওইটা তো আওয়ামী লীগের লোকরা পাইছে। আমরা নাকি বিএনপি। তাই আমাগো দিবো না!
এই বন্যা, এই অভাব, এই সরকারি ত্রাণ, ছোট্ট ওই বাচ্চাটিকেও আওয়ামী লীগ বিএনপি শিখিয়ে দিচ্ছে। দলীয় আদর্শ দূরে থাক, হাসিনা খালেদার নাম না জেনেও সে বুঝে গেছে- সে বিএনপি, তাই ত্রাণ পাবে না। এদের সংখ্যাই বেশি, আঠার শ’ জনের মধ্যে সাড়ে পনেরশ’। এরা হয়তো বেড়ে উঠবে আওয়ামী লীগের প্রতি একধরনের ঈর্ষা নিয়ে, ক্রোধ নিয়ে।
সরকারী দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কি এসব জানেন? আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ত্রাণের খবর বেশি বেশি করে মিডিয়াতে প্রচার করতে। ঢাকা থেকে আমরা কতিপয় গণমাধ্যম কর্মী গিয়েছিলাম হাওর অঞ্চলের ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে।

আমরা কোন খবর প্রচার করবো?



মন্তব্য ১০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই মে, ২০১৭ সকাল ৭:৩৩

ডঃ এম এ আলী বলেছেন: হাউর বাসীর অবর্ণনীয় দুর্দশার করুন চিত্র ফুটে উঠেছে লিখাটিতে ।
তাদেরকে নীজ উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে সম্পুর্ণ ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোগে
ত্রান দেয়ার মহতি কার্যক্রমকে স্বাগত জানাই ।
কামনা করি সংষ্লিস্ট সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অকাল বন্যা কবলিত
হাউর বাসীদের দু:খ দুর্দশার অবসান হোক ।

পোষ্টটি প্রিয়তে গেল ।

অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল ।

০৭ ই মে, ২০১৭ সকাল ৯:০৮

মাসুদ কামাল বলেছেন: ধন্যবাদ, ডঃ এম এ আলী।
আপনি ঠিকই বলেছেন, সংশ্লিষ্ট সকলের প্রচেষ্টা থাকলেই কেবল হাওরবাসীর দুঃখের অবসান হতে পারে।

২| ০৭ ই মে, ২০১৭ সকাল ৭:৪৪

মানবী বলেছেন: গত বেশ কিছুদিন ধরে তিস্তা পাড়ের মানুষদের দুর্দশা সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করছি। আমেরিকায় সিএনএন এর একটি প্রতিবেদনের পর থেকে কক্সবাজারে রিফিউজি ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের কথাও। যেহেতু দেশ থেকে সহস্রমাইল দূরে আছি বাস্তবতার সত্য চিত্রটা পাওয়া খুব সহজ নয়।

কানাডা প্রবাসী একজন ব্লগার আছেন, তিস্তা পাড়ের মানুষ বলেছিলেন নিজেকে, আমি ব্লগে তাঁকে সম্প্রতি অনলাইনে তাঁকে পাইনি তাই তাঁর কাছেও জানতে চাওয়া হয়নি।

আপনার কাছে অন্তঃত হাওড় পাড়ের মানুষদের দুর্দশার কথা জানা হলো। পুরো পোস্ট পড়েছি, প্রতিটি লাইন তবে সবচেয়ে শক্তিশালী শেষাংসে নিঃসন্দেহে।

"এদের সংখ্যাই বেশি, আঠার শ’ জনের মধ্যে সাড়ে পনেরশ’। এরা হয়তো বেড়ে উঠবে আওয়ামী লীগের প্রতি একধরনের ঈর্ষা নিয়ে, ক্রোধ নিয়ে।"
- এই শিশু, এই মানুষেরা যে অনুভূতি নিয়ে বেড়ে উঠবে তার প্রকৃত নাম খুব সচেতন ভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে কিনা বুঝতে পারছিনা কারণ সেই এক ও অনন্য অনুভূতিটি হলো "ঘৃনা"!
প্রধানমন্ত্রী যে এসব অ্ভুক্ত মানুষ আর তাঁদের অবোধ প্রাণীদের বন্ছিত করে তাঁদের খাবারের টাকায় নিজ দল কর্মী আত্মীয় স্বজনের ৫০০+ বাহিনী নিয়ে নিয়মিত ভাবে বিদেশ সফরে যান, শুধু একবারের সফরের টাকায় এই ১৮শ মানুষের অভাব দূর করা সম্ভব! কোন দয়া ভীক্ষা নয়, শুধু তাঁদের হকের টাকাটা দিলেই হলো।


"আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ত্রাণের খবর বেশি বেশি করে মিডিয়াতে প্রচার করতে।"
- খুব ভালো খবর। প্রধানমন্ত্রীর এই পরামর্শটি সত্যি ভালো লেগেছে, আপনারা ত্রানের স্বরূপটা প্রচার করুন। জানিয়ে দিন ১৮০০র মাঝে শুধু নৌকা মার্কায় ভোটপ্রদানকারী ২৫০ এর কাছে ত্রাণ পৌছায়, ত্রাণবন্চিত বাকি ১৫৫০ এর নাম হয় বিএনপি! প্রধানমন্ত্রী হয়তো এই সত্যটা সব সময় জানতে পারেননা।

তবে আপনারা যা করেছেন এমনটাই তো স্বাভাবিক। দেশের মানুষের বিপদে অন্য মানুষেরা এগিয়ে যাবে। আর আমরা যারা ক্লিবের মতো হাত গুটিয়ে ঘরে বসে আছি, আমরা কীটসম প্রজাতী- স্বার্থপর আর অমানুষ!

আওড়পারের অসহায় মানুষদের কথা আমাদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা মাসুদ কামাল।

০৭ ই মে, ২০১৭ সকাল ৯:২৭

মাসুদ কামাল বলেছেন: আপনি একটা দারুন কথা বলেছেন, বিশাল লটবহর নিয়ে আমাদের সরকার প্রধানদের বিদেশ যাত্রায় যে অর্থের অপচয় হয়, তা দিয়ে অনায়াসেই হাওরবাসীর দুর্দশা দূর হতে পারে। সেক্ষেত্রে আর বাড়তি মায়াকান্নার দরকার হয় না।
কিন্তু আমাদের আর কতটুকুই বা করার আছে, বলুন। জানেন, খুব মন খারাপ করে আমরা ফিরেছি হাওর থেকে। মনে হয়েছে আরও কিছু বেশি চাল, আলু নিয়ে গেলে হয়তো আরও কয়েকজনকে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারতাম। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও দরিদ্র মানুষ, টানাটানির মধ্যে জীবন যাপন। কিন্তু অভাব যে কি ভয়ঙ্কর হতে পারে, ক্ষুধা যে মানুষকে কতটা অসহায় করে দিতে পারে, এবার হাওরে না গেলে বুঝতে পারতাম না।
ফিরে আসার পর থেকে মোটেই স্বস্তি পাচ্ছি না। চোখে বারবার ভেসে ওঠছে ওই ক্ষুধাক্লিষ্ট মুখগুলো।

৩| ০৭ ই মে, ২০১৭ সকাল ৯:৪২

মাজুবিবি বলেছেন: ধন্যবাদ জানাচ্ছি এমন মহতী উদ্যোগের জন্য। আমি নিজে খুঁচ্ছিলাম। এমন সম্পূর্ন অরাজনৈতিক টিম যদি আরো যায় দয়া করে আমাকে জানাবেন। অন্তত একটা লিপস্টিক এর টা্কাও যদি আমি পাঠাতে পারি!

০৭ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৪

মাসুদ কামাল বলেছেন: আগামীতে এধরনের কোন উদ্যোগ নিলে অবশ্যই আপনাকে জানানোর চেষ্টা করবো। এবার অবশ্য আমরা ফেসবুকে এনিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন। তাদের সেই সাহায্য নিয়েই গিয়েছিলাম সেখানে।
আপনার আগ্রহের কথা জেনে ভালো লাগলো।

৪| ০৭ ই মে, ২০১৭ সকাল ১১:৫২

পদ্মপুকুর বলেছেন: 'মানবতা'র রাজনীতিকরণের এই কুফল ক্রমেই আমাদের সমাজকে আরো কলুষিত করবে।
মনে হচ্ছে, যারা পেছন থেকে আমাদের দেশকে কুক্ষিগত করতে চায়, তারা বৃটিশের সেই ডিভাইড এন্ড রুল নীতিই এখনও অনুসরণ করে যাচ্ছে।

আপনার লেখাটা ভালো লাগলো। যদি অতি সামান্যসংখ্যক মানুষকেও এই লেখা মানবতার দিকে এগিয়ে নেয়, সেটাই স্বার্থকতা।

ভালো থাকবেন, শুভ ব্লগিং।

০৭ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৫

মাসুদ কামাল বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকেও।

৫| ০৭ ই মে, ২০১৭ সকাল ১১:৫৮

সত্যের ছায়া বলেছেন: দেশে পাশাপাশি দুইটা প্রজন্ম বেড়ে উঠছে:
১। আওয়ামী সুবিধাবাদী
২। আওয়ামী বিদ্বেষী।

এই দ্বি-মেরুকরণের কু-ফল পেতে আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত অপেক্ষা করতে হচ্ছে!

০৭ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৯

মাসুদ কামাল বলেছেন: সমস্যা হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদী এই কুফল নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনই মাথাব্যথা নেই।
আপনার সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.