![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ইসলাম একটি সার্বজনীন জীবনাদর্শ। মানবজীবনের সব দিক নিয়েই ইসলাম আলোচনা করেছে। মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন হয় উপার্জনের। উপার্জন করতে হলে পরিশ্রম করতে হয়। আর এজন্য ইসলাম মানুষকে পরিশ্রম করতে উৎসাহিত করেছে। প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী পরিশ্রম করবে। ইসলাম শ্রমকে উদ্বুদ্ধ করেছে সামর্থ থাকা সত্ত্বে ভিক্ষাবৃত্তিকে হারাম করেছে এবং অলস, কর্মবিমুখ ও পরশ্রম নির্ভর হয়ে থাকাকে তীব্রভাবে নিন্দা করেছে। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে- কোন ব্যক্তি (সামর্থ্যবান) মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করতে থাকলে সে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় উপস্থিত হবে যে, তার মুখম-লে একটুকরাও গোশত থাকবে না। (বুখারী ১৩৮১, মুসলিম ১৭২৪)
প্রত্যেক নবী-রাসূল পরিশ্রম করে উপার্জন করেছেন বলে হাদীসে উল্লেখ আছে, হযরত আদম (আঃ) কৃষিকাজ করতেন, হযরত দাউদ (আঃ) বর্ম তৈরি করতেন, হযরত নূহ (আঃ) কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন, হযরত ইদ্রিস (আঃ) সেলাইয়ের কাজ করতেন এবং হযরত মূসা (আঃ) রাখালের কাজ করতেন। (মুসতাদরাকে হাকিম) মহানবী (সাঃ) নিজে মেষচারণ করেছেন, কাপড় সেলাই করেছেন, ঘর ঝাড়– দিয়েছেন, বালতি দিয়ে কূপ থেকে পানি উঠাতেন, এমকি রান্নার কাজও করতেন। হযরত খাদিজার (রাঃ) সহকারী হিসেবে বাণিজ্য করেছেন। নিজের হাতের উপার্জনকে উত্তম খাদ্যও বলা হয়েছে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন- ‘নিজের হাতের শ্রমের উপার্জন দ্বারা খাওয়া হতে উত্তম খাবার আর কেউ কোনদিন খায়নি।’ (বুখারী) ইসলাম যেমন শ্রমকে উৎসাহিত করেছে, তেমনি শ্রমের ধারক ও বাহক শ্রমিককে হেয় প্রতিপন্ন করার অধিকার কাউকে দেয়নি, বরং শ্রমিকদের সম্মানের আসনে সামাসীন করেছে। শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আজকাল সাধারণত স্লোগান শোনা যায় যে, পুঁজিপতি এবং মালিকশ্রেণী শ্রমিকদের শোষণ করছে। শ্রমিকের সুযোগ-সুবিধা ও দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মে দিবস পালন করা হয় শ্রমিকদের অধিকার কায়েমের জন্য। আসলে শ্রমিকদের শোষণ করা নতুন কোন বিষয় নয়। রাসূল (সাঃ) আগমনের পূর্বেও এ ব্যাধি সারা বিশ্বে বিরাজমান ছিল। শ্রমিক শ্রেণীকে হেয় করে দেখা হতো। তাদের নি¤œশ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হতো না। তাদের অধিকার নিয়ে মালিকরা ছিনিমিনি খেলত। যার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্নভাবে- একদা মিসর বিজয়ী বীর হযরত আমর ইবনে আস (রাঃ) যারা জমিদারের জমিতে কাজ করত সেসব শ্রমিকদের কথা উল্লেখ করে হযরত ওমর (রাঃ)-এর কাছে চিঠি লিখেছিলেন। একশ্রেণীর লোক যারা মৌমাছির মতো (অন্যের জন্য) রাত-দিন পরিশ্রম করে কিন্তু এই পরিশ্রমের ফল থেকে তার নিজেরা কোন দিক দিয়েই উপকৃত হয় না।
এভাবে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে পুঁজিপতিরা ছলনার আশ্রয় নিয়ে অন্যায়ভাবে ফায়দা লুটে নিয়েছিল। সেসব মালিকদের দমন করাই ছিল ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য। শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকের সম্পর্ক কি রকম হবে, আচার-ব্যবহার কি রকম হবে সে সম্পর্কে ইসলামের সুন্দর নীতিমালা রয়েছে। মালিকরা তাদের অধীনস্থ শ্রমিকদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করবে সে সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘এরা (শ্রমিকরা) তোমাদের ভাই, আল্লাহ এদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। অতএব আল্লাহ তা‘আলা যে ব্যক্তির ভাইকে তার অধীন করে দিয়েছেন, তার উচিত সে যা খাবে তাকেও তা খাওয়াবে, সে যা পরবে তাকেও তা পরাবে, আর যে কাজ তার পক্ষে সম্ভব নয়, সে কাজের জন্য তাকে কষ্ট দেবে না। আর যদি কষ্ট দেয় তাতে নিজেও তাকে সাহায্য করবে।’ (আহমদ ৫/১৬৮, আবু দাউদ ২/৩৩৭) রাসূল (সাঃ) আরও বলেছেন, ‘তোমার যে পরিমাণ কাজ অনায়াসে করতে পারবে, সে পরিমাণ কাজই তোমরা (তোমাদের অধীনস্থদের জন্য) আয়োজন কর।’ (নাসাঈ, ইবনে মাযাহ) রাসূল (সাঃ) নিজের জীবনে এ আদর্শগুলো বাস্তবায়ন করে মানব সমাজকে দেখিয়ে গেছেন। রাসূল (সাঃ) এর একান্ত খাদেম হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, আমি দশ বছর রাসূল (সাঃ)-এর খেদমতে ছিলাম। তিনি কখনও উহ্ শব্দ উচ্চারণ করেননি এবং এও বলেননি যে তুমি এটা কেন করলে বা কেন করনি। রাসূল (সাঃ) তো শ্রমিকের সঙ্গে উত্তম আচরণের নজির দেখিয়ে গেছেনই, তার সাহাবায়ে কেরামও তাদের অধীনস্থদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। একদা হযরত ওমর (রাঃ) আপস চুক্তি সম্পাদনের জন্য যখন বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে রওনা হলেন তখন তিনি এবং তার ভৃত্য পালাক্রমে উটের ওপর সওয়ার হয়ে মদিনা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত দীর্ঘপথ অতিক্রম করেছিলেন। এমনকি বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছার পর সেখানকার লোকেরা বুঝতে পারেনি এ দু’য়ের মধ্যে কে আমীরুল মুমিনীন!।
শ্রমিকের সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত রয়েছে, সেটি হচ্ছে তার পারিশ্রমিক। শ্রমিকের পারিশ্রমিক নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইসলামী অর্থনীতি একটি সুন্দর ও সমাজের কল্যাণকর বিধান নির্ধারণ করেছে। মালিকরা তাদের শ্রমিকের পারিশ্রমিকের হার যতদূর সম্ভব বৃদ্ধি করবে। যাতে করে শ্রমিকরা তাদের জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে কোন সমস্যায় না পড়ে। ইসলাম মালিকদের কাছ থেকে শ্রমিকের পারিশ্রমিকের ব্যাপারে সে রকম পদক্ষেপই কামনা করে।
শ্রমিকরাও পরিশ্রম করে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য এবং পারিশ্রমিক দিয়ে যদি সে বাঁচতে না পারে তার মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করবে। ফলে সে শ্রমিকের কাছ থেকে ভালো উৎপাদন আশা করা যায় না। শ্রমিকের পারিশ্রমিক আদায় করা সম্পর্কে আল্লাহপাক হাদীসে কুদসীতে বলেছেন- ‘এমন তিনটি লোক আছে কেয়ামতের দিন আমি তাদের শত্রু হয়ে দাঁড়াব। এর মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তিটি হচ্ছে, যে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোন লোক নিয়োগ করে অতঃপর তার কাছ থেকে পুরোপুরি কাজ আদায় করে নেয় কিন্তু তার বিনিময়ে কোন পারিশ্রমিক দেয় না।’ পারিশ্রমিক আদায়ে দীর্ঘসূত্রতা শ্রমিকদের জন্য একটি কষ্টকর ব্যাপার। সময়মতো বেতন না পেলে তাদের অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়। এজন্য শ্রমিকের পারিশ্রমিক আদায়ের তাড়া সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছেন- ‘শ্রমিকের পারিশ্রমিক তার ঘাম শুকানোর আগেই দিয়ে দাও।’ (ইবনে মাযাহ ২/৮১৭ সহীহ আল জা‘মে ১৪৯৩)
শ্রমিকদের রক্ষণাবেক্ষণ, তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করার দায়িত্ব মালিকদের। মালিক তার অধীনস্থদের সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হবে, তাদের ওপর কোন রকম অত্যাচার-নির্যাতন করতে পারবে না। শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন করলে তার কঠোর শাস্তি রয়েছে। একদা আবু মাসুদ আনসারী বলেন, একদিন আমি আমার কৃতদাসকে মারধর করছিলাম। এমন সময় পেছনের দিক থেকে আওয়াজ এলো হে আবু মাসুদ! জেনে রাখ, আল্লাহ তোমার চেয়ে অধিক শক্তিশালী, আমি মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখি স্বয়ং রাসূল (সাঃ) আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে নিবেদন করলাম হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমি এ কৃতদাসকে আজাদ (মুক্ত) করে দিলাম। রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি এরকম না করলে দোজখের আগুন তোমাকে ঝলসে দিত।
ইসলাম মূলত এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায় যেখানে শ্রমিক-মালিক সবার অধিকারই সংরক্ষিত থাকবে এবং চাওয়ার আগেই প্রত্যেকের অধিকার আদায় করে দিতে সবাই উদ্বুদ্ধ হবে। ইসলামী সমাজে কোন দাবি পেশের দরকার হয় না। যদি কোন শ্রমিককে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় সে দাবি প্রকাশের অধিকার রাখে। অধিকার আদায়ের দাবি কারও কাছে প্রার্থনা বা অনুকম্পার বিষয় নয় বরং এ হচ্ছে তার বাঁচার অধিকার।
বর্তমান বিশ্বে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের মাধ্যম হিসেবে আন্দোলনকে বেছে নেয়া হয়েছে, কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে সাময়িকভাবে অধিকার আদায় করলেও চিরস্থায়ীভাবে সম্ভব নয়। শ্রমিক-মালিকের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা একমাত্র ইসলামের আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমেই সম্ভব। শ্রমিক-মালিক উভয় পক্ষ যদি ইসলামের প্রদর্শিত নীতিমালা অনুসরণ করে তাহলে শ্রমিকরা দাবি আদায়ের নামে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করবে না, মালিকদেরও শোষণ করার মানসিকতা থাকবে না। উভয়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং একে-অপরের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। আর এর মাধ্যমেই সমাজে বা দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
©somewhere in net ltd.