নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শালীন ভাষায় সাহসী উচ্চারণ

মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব

সম্পাদক, মাসিক আরবি ম্যাগাজিন ‘আলহেরা’

মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইনসাফপূর্ণ মুদারাবা অর্থ ব্যবস্থা

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:০৮



ইসলামের মৌলিক বিনিয়োগ পদ্ধতি হচ্ছে মুদারাবা-মুশারাকা। মূলত অর্থনীতিকে ইসলামী রূপদানের ক্ষেত্রে এর বিকল্প নেই। এ দুইটি বিনিয়োগ পদ্ধতি এমন যুগান্তকারী যে, একমাত্র এ দুইটি পদ্ধতি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সমাজকে সুদমুক্ত করা সম্ভব।
মুদারাবা শব্দটি 'দরব' থেকে গঠিত। এর আভিধানিক অর্থ বিচরণ বা চলাফেরা করা। যেহেতু ব্যবসা পরিচালনাকারী পৃথিবীর একস্থান থেকে অন্য স্থানে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিচরণ করে থাকেন তাই ইসলামী আইনবিদরা এর নাম দিয়েছেন 'মুদারাবা'। পবিত্র কোরআনে মুদারাবা শব্দটি বিচরণের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, 'কিছু কিছু লোক আল্লাহর অনুগ্রহের সন্ধানে পৃথিবীতে বিচরণ করে।' মুদারাবা মূলত এমন একটি কারবার, যেখানে দুইটি পক্ষ থাকে। একপক্ষ মূলধন সরবরাহ করে, অন্যপক্ষ ব্যবসা করে। একটি চুক্তির মাধ্যমে কারবারটি সংগঠিত হয়, যাতে ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফার কে কত ভাগ পাবে তা নির্দিষ্ট করা হয়। লাভের কোনো নির্দিষ্ট অঙ্ক কারও জন্য নির্ধারিত করা হয় না; বরং সম্ভাব্য মুনাফার শতকরা হার নির্ধারণ করতে হবে। যেমন- মূলধনদাতা ৫০ শতাংশ, ব্যবসায়ী ৫০ শতাংশ অথবা এক পক্ষ ৬০ শতাংশ অপর পক্ষ ৪০ শতাংশ। এভাবে যে কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়। লাভের পরিমাণ কমবেশি যাই হোক তা উভয়ের মাঝে পূর্ব নির্ধারিত চুক্তি অনুযায়ী বণ্টন হবে। আর যদি লোকসান হয় তাহলে অর্থদাতার টাকা যাবে, ব্যবসায়ীর শ্রম যাবে। যিনি মূলধনের মালিক তাকে 'রব্বুল মাল' বা 'সাহিবুল মাল' ও যিনি শ্রমদান করেন বা উদ্যোগ নিয়ে মূলধন ব্যবহার করেন তাকে 'মুদারিব' বলা হয়। রাসুল (সা.) নবুয়ত লাভ করার আগে খাদিজা (রা.) এর সঙ্গে এ ব্যবসা করতেন, যা তিনি নবুয়ত লাভ করার পরও কিছুদিন বহাল রেখেছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের অনেকে এ ব্যবসা করতেন। আল্লামা কুরতুবি (রহ.) উল্লেখ করেছেন, 'কিরাজ অর্থাৎ মুদারাবার বৈধতার ব্যাপারে মুসলমানদের মাঝে কোনোরূপ দ্বিমত নেই।' (বিদায়াতুল মুজতাহিদ ২/২১৬)।
প্রচলিত সুদি বিনিয়োগ ব্যবস্থার সঙ্গে মুদারাবা ব্যবস্থার বেশ কিছু ব্যবধান রয়েছে। যেমন- সুদি অর্থ ব্যবস্থায় মুনাফা নির্ধারিত থাকে, বিনিয়োগকৃত টাকার ১৫ বা ২০ শতাংশ। ব্যবসায় যে পরিমাণ লাভই হোক না কেন, সে তার বিনিয়োগকৃত টাকার ওপর নির্ধারিত সুদ পাবেই। ব্যবসা লসের সম্মুখীন হলেও অর্থদাতা শুধু তার মূলধনই নেবে না; বরং মূলধন ও মূলধনের ওপর নির্ধারিত সুদও সে আদায় করে নেবে। যে কোনো পদ্ধতিতেই হোক তা সে আদায় করবেই। অপরদিকে মুদারাবা ব্যবসায় এভাবে মুনাফা নির্ধারণ করার সুযোগ নেই। ব্যবসায় লাভ বেশি হলে তা পূর্ব নির্ধারিত হার অনুযায়ী বণ্টন করে উভয়েই লাভবান হবে। আর লোকসান হলে উভয়েই লসের ভার বহন করবে।
তাছাড়া পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় যত বেশি পরিমাণ লাভই হোক না কেন, এ বিপুল পরিমাণ মুনাফা একা ব্যবসায়ীই ভোগ করেন। আর অর্থদাতা অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের দেয়া হয় ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ১৫ বা ২০ শতাংশ। একথা বলা বাহুল্য যে, ব্যাংকগুলোর টাকার মূল উৎস হচ্ছে আমানতকারী তথা অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের জমাকৃত টাকা। এদের মাঝে ধনী ও দরিদ্র, কম ও বেশি সব ধরনের জমাকারীই রয়েছেন। তবে এদের অধিকাংশই যে দরিদ্র ও তুলনামূলক কম আয়ের লোক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং বলা যায়, গরিবের ছোট অঙ্কের টাকাগুলো কাজে লাগিয়ে ধনী ও শিল্পপতিরা ক্রমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন আর গরিব হন নিঃস্ব থেকে আরও নিঃস্ব। তাদের অর্থ কাজে লাগে তবে তারা ন্যায্য মুনাফা থেকে হন বঞ্চিত। এভাবে সম্পদ হয়ে ওঠে এককেন্দ্রিক। বাড়তে থাকে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান। কিন্তু মুদারাবা ব্যবস্থায় যেহেতু প্রকৃত মুনাফাই শুধু বণ্টনযোগ্য তাই ব্যবসায় লাভ বেশি হলে কোনো পক্ষেরই তা এককভাবে ভোগ করার সুযোগ নেই।
শুদ্ধ হওয়ার কিছু শর্ত
১ মূলধন নির্দিষ্ট করে মুদারিব তথা উদ্যোক্তার পূর্ণ দখলে দিতে হবে।
২ মালিক ও উদ্যোক্তার মধ্যে মুনাফার অংশ আগেই নির্দিষ্ট হতে হবে। এক্ষেত্রে স্মরণ রাখবে যে, শরিয়ত মুনাফা বণ্টনের কোনো অনুপাত নির্দিষ্ট করে দেয়নি। বরং তা উভয় পক্ষের স্বাধীন মতামতের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। তারা মুনাফা সমহারেও বণ্টন করতে পারে আবার সাহিবুল মাল তথা মালিক ও মুদারিব তথা উদ্যোক্তার জন্য পৃথক পৃথক কোনো অনুপাতও নির্দিষ্ট করতে পারে। তবে মুনাফা বণ্টন করতে হবে মুনাফাকেন্দ্রিক; মূলধনকেন্দ্রিক নয়। অর্থাৎ মূলধনের আনুপাতিক হারের সঙ্গে মুনাফা নির্দিষ্ট করা যাবে না। উদাহরণস্বরূপ মূলধনের ২০ শতাংশ রব্বুল মাল পাবে। অর্থাৎ ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে লাভ কত আসল না আসল সেটা দেখার বিষয় নয়; বরং ১০০ টাকায় ২০ টাকা মালিক পেয়ে যাবে। এরূপ শর্ত করলে তা সুদে পরিণত হবে। অনুরূপভাবে কোনো পক্ষের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ ধার্য করাও যাবে না। এমনিভাবে লাভ হোক বা না হোক সর্বাবস্থায় কোনো এক পক্ষকে লাভ দিতে হবে- এমন চুক্তিও করা যাবে না। (তাবয়িনুল হাকায়েক ৫/৫১৫)। যেমন- মূলধন যদি ১ লাখ টাকা হয় তাহলে সমুদয় মুনাফার ১০ হাজার টাকা মালিক পাবে আর বাকি যা থাকবে সেটা মুদারিব বা উদ্যোক্তা পাবে। এ ধরনের চুক্তি করা যাবে না। বরং এভাবে চুক্তি করতে পারবে যে, প্রকৃত মুনাফার ৪০ শতাংশ মুদারিব পাবে এবং ৬০ শতাংশ রব্বুল মাল পাবে, কিংবা ৬০ শতাংশ মুদারিব পাবে এবং ৪০ শতাংশ রব্বুল মাল পাবে। স্থান, কাল, পাত্রভেদে ও ব্যবসা পণ্যের ধরন বুঝে মুনাফার হার পরিবর্তন হতে পারে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজজাক : ১৫১৩২, তাবয়িনুল হাকায়েক ৫/৫১৪, হাশিয়াতুশ শিলবি ৫/৫১৮)।
৩. ব্যবসায় লোকসান হলে তা প্রথমে লাভ এবং এরপর পুঁজি থেকে আদায় করা হবে। ব্যবসায়ী পুঁজির দায়ভার গ্রহণ করবে না। প্রখ্যাত তাবেঈ কাতাদাহ (রহ.) বলেন, মুদারাবা কারবারের লভ্যাংশ চুক্তি অনুযায়ী বণ্টন হবে এবং লাভ না হলে অথবা লাভের তুলনায় খরচ বেশি হলে লোকসান পুঁঁজি থেকে ধর্তব্য হবে। (মুসান্নাফ আবদুর রাজজাক : ১৫০৮১)।
৪. তবে ব্যবসা পরিচালনাকারীর অবহেলা বা ত্রুটির কারণে যদি ব্যবসায় লোকসান হয় তবে এর দায়ভার ব্যবসায়ীর ওপরই বর্তাবে। এক্ষেত্রে পুঁজিদাতা কিছু দিতে বাধ্য হবে না। হাকীম ইবনে হিসাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি এক ব্যক্তিকে মুদারাবার ভিত্তিতে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে পুঁজি প্রদান করেন এবং তার ওপর কিছু শর্তারোপ করেন। ... এবং তাকে বলেন যে, এই শর্তগুলো অমান্য করলে এর দায়ভার তুমি বহন করবে। (সুনানে কুবরা, বায়হাকি ৬/১১১, তাবয়িনুল হাকায়েক ৫/৫৩৪)।
মুদারাবার চুক্তি একজন পুঁজি বিনিয়োগকারী ও একজন কারবারির মাঝে যেমন হতে পারে, তেমনি একদল পুঁজি বিনিয়োগকারী ও একদল কারবারির মাঝেও হতে পারে।
আবার একদল পুঁঁজি বিনিয়োগকারী ও একজন কারবারির মাঝেও হতে পারে। এ চুক্তি নগদ টাকার ওপর যেমন হতে পারে, তেমনি পণ্য বা পণ্য উৎপাদনকারী কলকব্জা ও মেশিনারির ওপরও হতে পারে। যেমন- একজন পুঁজির মালিক একটি ট্রাক বা বাস কিনে ড্রাইভারের সঙ্গে এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হতে পারে যে, এই ট্রাক কিংবা বাস তুমি তোমার হেফাজতে রেখে পরিবহনের কাজ করবে। তাতে ব্যয় বাদে যে লভ্যাংশ থাকবে তা আমার আর তোমার মাঝে হারাহারি ভিত্তিতে বণ্টন করা হবে। অথবা একটি মেশিন কিনে কারও সঙ্গে এ মর্মে চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া যেতে পারে যে, এর দ্বারা তুমি তোমার উৎপাদন কাজ আঞ্জাম দেবে। এতে ব্যয় বাদে যা লভ্যাংশ থাকবে তা আমার ও তোমার মাঝে হারাহারি ভিত্তিতে বণ্টন হবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.