![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আর্জেন্টিনায় পা রাখার আগে কল্পনায় ছিল ফুটবল, আন্দিজ পর্বত কিংবা বুয়েনস এইরেসের দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকার কথা। ভাবতাম, লোকালয় বা জনপদে দেখব, সকাল-বিকেল-রাত সবাই ফুটবল খেলছে। আমি দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে দেখতে হয়তো বলব—নিউমের উন আর্জেন্টিনা। কিন্তু না, এসব কিছুই হয়নি।
বরং আমি ছিলাম পাতাগোনিয়ার নির্জন উপত্যকায়, আন্দিজের গা বেয়ে নীরবতায় ঘেরা কাঁটা কম্পাস ধরে আঁকা সরলরেখার মতো সোজা এক রাস্তায়। সামনে-পেছনে কিছুই নেই, শুধু পাথুরে ধুলার ভাসমান রেখা আর গা ছমছমে বাতাস। মাঝেমধ্যে গর্জে ওঠা বিশাল ট্রাক আর দু–একটা গাড়ি চোখে পড়ে। নিমেষেই আবার হারিয়ে ফেলি। তবু এগিয়ে যাওয়া, শুধু মানুষ দেখব বলে।
ন্দিজ পর্বতের কোলে বসে থাকা পাতাগোনিয়া যেন পৃথিবীর এক নিঃসঙ্গ কবিতা।
বারিলোচের পূর্ণ নাম হলো সান কার্লোস দে বারিলোচে। বুয়েনস এইরেস থেকে দুই ঘণ্টার বিমানযাত্রা। লেক, পাহাড়, সুইস ঘরানার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য প্রসিদ্ধ বারিলোচে পাতাগোনিয়ার অন্যতম প্রবেশদ্বার। আদর করে যাকে ডাকা হয় সুইজারল্যান্ড অব আর্জেন্টিনা।
বারিলোচে থেকে পূর্বের শহরের নাম ভিয়েদমা। এ শহরেই আমাদের জামাল ভুঁইয়া খেলতে এসেছিলেন সোল দে মায়ো নামের এক ক্লাবে। এ শহরে আসতে সাইকেল চালাতে চালাতে যে ভূদৃশ্য পার হই, তা যেন এক বিশাল পাথুরে ক্যানভাস, ধুলামাখা হাতে বেলা রুটির মতো এবড়োখেবড়ো; যেখানে ঠান্ডা হাওয়া আর বিস্তৃত ফাঁকা আকাশের রং লেগেছে।
এখানকার সকালগুলো এতটাই শান্ত, মনে হয় যেন সময় থমকে আছে। দিনের আলো আসতে দেরি করে—আমার অভ্যস্ত ভোর পাঁচটায় নয়; বরং তখনো চাদের আলোয় ডুবে থাকে চারপাশ, অদূরের পাহাড় আর কুয়াশায় লুকিয়ে থাকে ঘুমন্ত জনপদ।
যত দূর চোখ যায়, বিস্তীর্ণ শূন্যতা। কোথাও কোথাও দু-একটা গবাদিপশু, কখনো এক-আধটা ট্রাক; আর মাঝেমধ্যে অনেক দূরে দূরে খর্বাকৃত গাছের থোক। এই হলো সব। এখানে জনসংখ্যা এতই কম যে দিনের পর দিন সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে মনে হতো, আমি যেন এই পৃথিবীর একমাত্র অভিযাত্রী।
সকালের রুটিন অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল কুকুরের ডাক। জোরালো, গভীর, যেন সবাইকে আমার আগমন জানিয়ে দিচ্ছে তারা। আগন্তুকের আবির্ভাব তারা হয়তো ভালো মনে করত না। আলো ফোটার আগে রাস্তায় নেমে যেতাম। গ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই কুকুরের তীব্র ঘেউ ঘেউ, আর সেই আওয়াজ পাহাড় ঘুরে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসত আমার কাছে। আমি ভীরু মনে দম বন্ধ করে পা চালাতাম যত না ঠান্ডার কাতরতায়, তার থেকে কুকুরের ভয়ে।
এই যাত্রায় বেশ কিছু খুদে শহর, এরা যাকে বলে গ্রাম, দেখা ও থাকা হয়েছে। তারই একটির নাম কুমালকাম। সেখানে এখনো পুরোনো স্টিম ট্রেন চলে পর্যটনের অংশ হিসেবে। তার কালো ধোঁয়া আর সিটি কল্পনাকে বাস্তবের এক সিনেমার দৃশ্যের মতো মনে হতো। লোহার একটা ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ট্রেনের কাঠামো দেখে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে, যেন ইতিহাস উঠে এসেছে অতীত থেকে।
পাতাগোনিয়ার রূপ বদলে যায় ধীরে। একসময়ের ধূসর, ধুলামাখা, শুকনা মরুভূমির মতো; আবার একসময় ঘাসে ঢাকা সবুজ তৃণভূমির মতো। এর মধ্যে দূরে ‘লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরি’র মতো। কিন্তু আকাশ সর্বদা সুবিশাল বিস্তৃত, মেঘে ঢাকা; অথবা একেবারে নির্মল নীল। আর হাওয়া? কখনো সামনে থেকে, কখনো পাশ থেকে আর কখনো পেছন থেকে। একবার আঁকড়ে রাখে তো আবার ছেড়ে দেয়। এই টানাটানি পাতাগোনিয়ার চরিত্র।
ক্লেমেন্তে অর্নেলি নামের এক জায়গায় থাকতে হয়েছে। এখানে ছিল না কোনো থাকার জায়গা। পরের গন্তব্য আরও ৮০ কিলোমিটার। তাই এখানেই থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষ যেহেতু আছে, হয়ে যাবে। একটা স্কুল আছে। আমার স্থানীয় সহযাত্রী আমাদের পরিচয় দেওয়ার পর বেশ খাতির পাওয়া গেল। ক্লাসরুমে ক্যামেরা, মুঠোফোন চার্জের ব্যবস্থা হলো। জনা ১৫ শিশুর কাছে বাংলাদেশের গল্পও বলতে হলো।
সাইকেলের পেছনে বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে রেখেছিলাম। ভাবতাম, কেউ থামিয়ে জিজ্ঞেস করবে এই পতাকা কোথাকার? কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। কিছু বাইকার, কিছু ট্রাকচালক চোখ মেলেছেন ঠিকই, কেউ কেউ হাত নাড়িয়েছেন। একমাত্র যে গাড়িটি দাঁড়িয়ে কথা বলল, তিনি ছিলেন কানাডিয়ান পর্যটক।
বাংলাদেশে যদি কোনো বিদেশি দেখা যায়, হোক সে সাইকেলে, হোক হেঁটে—অবধারিতভাবে কেউ জিজ্ঞেস করবেন, ‘আপনি কোথা থেকে?’ আর হাতে এক কাপ চা ধরিয়ে দেবেন। আর্জেন্টিনায় মানুষ ঠিক ততটাই অতিথিপরায়ণ; কিন্তু সেটা অনেকটাই সংযত, কম প্রকাশ্য। খোলা মুখে কথা কম; কিন্তু দরকারে পাশে দাঁড়ান মানুষ।
যেমন সান আন্তেনিও ওয়েস্তে থেকে ভিয়েদমা যাওয়ার সময় আমার সাইকেল বাসে উঠতে না দেওয়ায় তিনজন স্থানীয় এগিয়ে এলেন। তাঁরা বাইকসহ আমাকে নিজে গাড়িতে তুলে ভিয়েদমা পৌঁছে দিলেন। শুধু তা–ই নয়, তাঁরা বাংলাদেশের নাম জানতেন, আর বিদায়ের সময় উপহার দিলেন আর্জেন্টিনার পতাকা। সেই মুহূর্তে মনে হলো, পতাকা বদল হয় কিন্তু মানবিকতা হয়তো একই থাকে। মানুষ বলে কথা। যার জন্য আসা এত দূর!
সাইকেলের পেছনে বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে রেখেছিলাম। ভাবতাম, কেউ থামিয়ে জিজ্ঞেস করবে এই পতাকা কোথাকার? কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। কিছু বাইকার, কিছু ট্রাকচালক চোখ মেলেছেন ঠিকই, কেউ কেউ হাত নাড়িয়েছেন। একমাত্র যে গাড়িটি দাঁড়িয়ে কথা বলল, তিনি ছিলেন কানাডিয়ান পর্যটক।
বাংলাদেশে যদি কোনো বিদেশি দেখা যায়, হোক সে সাইকেলে, হোক হেঁটে—অবধারিতভাবে কেউ জিজ্ঞেস করবেন, ‘আপনি কোথা থেকে?’ আর হাতে এক কাপ চা ধরিয়ে দেবেন। আর্জেন্টিনায় মানুষ ঠিক ততটাই অতিথিপরায়ণ; কিন্তু সেটা অনেকটাই সংযত, কম প্রকাশ্য। খোলা মুখে কথা কম; কিন্তু দরকারে পাশে দাঁড়ান মানুষ।
যেমন সান আন্তেনিও ওয়েস্তে থেকে ভিয়েদমা যাওয়ার সময় আমার সাইকেল বাসে উঠতে না দেওয়ায় তিনজন স্থানীয় এগিয়ে এলেন। তাঁরা বাইকসহ আমাকে নিজে গাড়িতে তুলে ভিয়েদমা পৌঁছে দিলেন। শুধু তা–ই নয়, তাঁরা বাংলাদেশের নাম জানতেন, আর বিদায়ের সময় উপহার দিলেন আর্জেন্টিনার পতাকা। সেই মুহূর্তে মনে হলো, পতাকা বদল হয় কিন্তু মানবিকতা হয়তো একই থাকে। মানুষ বলে কথা। যার জন্য আসা এত দূর!
প্রথমআলো তে মুদ্রন সংখ্যায় প্রকাশিত : ২৪০৫২৫ view this link
২৪ শে মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১৯
মুনতাসির বলেছেন: শুধু চলে যেতে হবে। যত চিন্তা করবেন তত বেশি দিন লাগবে।
২| ২৪ শে মে, ২০২৫ দুপুর ১:১১
রাবব১৯৭১ বলেছেন: চে গুয়েভারার সাইকেল ডাইরির কথা মনে পরে গেল।
২৪ শে মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১৯
মুনতাসির বলেছেন: ধন্যবাদ।
৩| ২৪ শে মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:১৮
জনারণ্যে একজন বলেছেন: @ মুনতাসির, লেখার সাথে কিছু ছবি দিলে খুব ভালো হতো। প্রথম আলো'র লিংকে যেয়ে দেখে এসেছি অবশ্য, তবে হতাশ হতে হলো মাত্র দু'টো ছবি দেখে। তাও আবার একটু অস্পষ্ট।
তবে সেই আফসোস কিছুটা হলেও পুষিয়ে গেছে আপনার পোস্ট পড়ে। এত সুন্দর লেখা! বর্ণনার আতিশয্য নেই - বাহুল্যবর্জিত, মেদহীন ঝরঝরে লেখা। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো আমিও ওখানে আপনার সাথে ভ্রমণসঙ্গী ছিলাম। বেশ ভালো লেখেন আপনি।
পুনশ্চ: আপনার প্রতি ঈর্ষা কিন্তু বেড়েই যাচ্ছে। গৎবাঁধা জীবনাচরণ থেকে বেরিয়ে এসে এমন একটা বোহেমিয়ান লাইফের স্বপ্ন একটা সময় আমারও ছিলো একদা; এখন তা ফিকে হয়ে গেছে।
৪| ২৪ শে মে, ২০২৫ রাত ৮:৩১
কোলড বলেছেন: Off topic. Bariloche was a favorite destination for a few Nazi fugitives after WWII. Now you know why!
৫| ২৫ শে মে, ২০২৫ রাত ১২:০৬
শায়মা বলেছেন: বাহ!! সাইকেলে চেপে আর্জেন্টিনা!!! অনেক ভালো লাগলো ভাইয়া।
৬| ২৬ শে মে, ২০২৫ সকাল ১১:১৯
রাজীব নুর বলেছেন: আহ!! দারুন।
জাস্ট গ্রেট।
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে মে, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৯
অপু তানভীর বলেছেন: আপনার লেখাটা পড়ে অনেক দিনের চেপে রাখা ইচ্ছে আবার মনের ভেতরে উকি দিল। সাইকেলে চেপে পুরো দেশ ঘোরার। এক জেলা থেকে থেকে অন্য জেলায় যাবো সাইকেলে চেপে। সেখানকার সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখবো। কিন্তু আর যাওয়া হয় না কোন কিছুইতেই।
লেখার জন্য ধন্যবাদ।