নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্রাত্যজনের কথাকলি

মুশফিকুর মুজাহিদ অনিক

১০১১৯৯৩

মুশফিকুর মুজাহিদ অনিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

\'সুবর্ণরেখা\', ঋত্বিক ঘটকের একটি স্রোতধারা

১২ ই ডিসেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:২৩

বিনোদের মাধ্যমে প্রাপ্ত চিঠিতে জানা যায় রেনুকা আত্নহত্যা করেছে। চিঠিতে লেখা আছে, ‘ঈশ্বরবাবু যাতে তার সন্তান দুটিকে দেখে রাখে’। ক্ষুধাতৃষ্ণার পীড়নক্লিষ্ট সন্তানদের মুখোমুখি দাড়াবার কোনো অবলম্বন খুজে না পাওয়া মায়ের ভরসা ছিল ঈশ্বর যিনি । কিন্তু সমষ্টির মুক্তির লক্ষ্যে লড়াই করছেন। কিন্তু সে সংগ্রাম থেকে ঈশ্বর পিছু হটলে তাঁর সঙ্গে হরপ্রসাদের লড়াই ততক্ষণে আদর্শে রূপ নিয়েছে। ঈশ্বরবাবুকে পলাতক বলছে হরপ্রসাদ। নবজীবন কলোনির মানুষের লড়াইয়ের প্রদীপ হয়ে থাকার কথা ছিল ঈশ্বরের। কিন্তু তা আর হয়নি।

সীতা, সাক্ষাৎ দেবী। হরপ্রসাদ কিংবা ঈশ্বরবাবুর কাছে সাক্ষাৎ দেবী। একজন উঠতি কিশোরী আসলে ভারতবর্ষ অথবা বাংলাদেশ, মানে মাতৃভূমি। ‘বন্দে মাতেরাম’ নতুন পতাকার সমীপে সবাইকে গাইবার আহ্বান করছিল ঈশ্বর। হরপ্রসাদকে দেবী সীতা বলছিল, ‘আমাদের ঘর হবে না?’। হরপ্রসাদ রাজনৈতিক সহযোদ্ধার সঙ্গে লড়াই করেছে বেনিয়া শয়তান ব্রিটিশদের তাড়াতে; লড়াই করেছে তার সাহচার্যে। তখনো স্বপ্ন দেখেন লড়াই করার। সীতার নতুন ঘরের স্বপ্নে তখন রঙ লাগে। হরপ্রসাদ বলে, ‘হ্যা! ঘরের জন্য লড়ব। আমি লড়ব, তোমার দাদা ঈশ্বর লড়বে’। এ লড়াইটা যেহেতু শেষ হয় নি তাই এ লড়াইটা অন্য লড়াই। এ লড়াই ভারতের নিপীড়িত মানুষের, বিভক্ত মানুষের সামনে দিগন্তব্যাপী বিস্তৃত সেই মুক্তির লড়াই। ভারতের মুটে-মজুরের আকাঙ্খার লড়াই। সে লড়াই একটি পতাকা অর্জন হওয়াতেই অর্জিত হয় না। ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’-সীতাকে যে লড়াইয়ের কথা বলেছেন হরপ্রসাদ, এটা সেই লড়াই। ঋত্বিক সে লড়াইকে হরপ্রসাদের বয়ানে অঙ্কন করেছেন। সীতার শৈশব সেই ভারতেরই শৈশব। দাদা ঈশ্বররা তারই ফেরি করছেন।

এদিকে, একজন অভিরাম এসেছে অন্য প্রান্ত থেকে। গঙ্গা যেখানে পদ্মা হয়েছে সেই তীর থেকে সুবর্ণরেখার জল ছুঁয়ে যাওয়া মাটিতে এসে পড়েছে অভিরাম। বাগদী বৌদির উদ্বাস্তু জীবনের শেষ অবলম্বন অভিরাম এখন ঈশ্বরের আশ্রয়ে। কারণ জমিদারের পেয়াদা বাগদী বৌদকে তুলে নিয়ে যায়। আর বাগদী বৌদির ছেলে অভিরাম এবং সীতাই ঈশ্বরের নবজীবন কলোনি ছাড়ার নেপথ্যে। ঈশ্বর এ মর্ত্যের ঈশ্বর। সীতা-অভিরাম ঈশ্বরের কাছে এতোই গুরুত্ববাহী হয় যে, হরপ্রসাদের লড়াই তখন বেশ পেছনে পড়ে যায়। হরপ্রসাদের ‘নবজীবন কলোনি’র মানুষ তখন অন্য প্রস্তরে খোদাই হয়েছে। অভিরাম-সীতার প্রস্তর থেকে অন্য প্রস্তরটি অদৃশ্য।
অভিরাম আর সীতার শৈশব আর ঈশ্বরের নতুন আবির্ভাব ঘটেছে সুবর্ণরেখা পাড়ের যন্ত্রকলে। ঋত্বিক ঘটক তাঁর চলচ্চিত্রে দেখাচ্ছেন এই অভিনব দ্বন্দ্ব। একদিকে ঈশ্বরের দিকে চেয়ে থাকা কলোনির উদ্বস্তু মানুষ অন্যদিকে অভিরাম ও সীতার মতো দুজন 'অপর অথচ সবচেয়ে আপন' প্রাণরি জন্য নতুন 'ব্যক্তিবাদী বিচ্ছিন্নতা'য় নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। এ দুয়ের মিথস্ক্রিয়ায় একটা গল্প বলেছেন পরিচালক।

সুবর্ণরেখা চলচ্চিতত্রের অভিরাম চরিত্রে অভিনয় করেছেন সতীন্দ্র ভট্টাচার্য এবং মাধবী মুখোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন সীতার চরিত্রে। বিশেষত, সীতার চরিত্রে মাধবী অসামাণ্য অভিনয় করেছেন।
ঋত্বিক ঘটক তার গল্পে আসলে যা বলতে চেয়েছেন তার প্রতিটি সংলাপের ছত্রে ছত্রে ভিন্ন মাত্রার কথা লুকিয়ে রয়েছে। ঋত্বিক দেখাতে চাইছেন, ভারতের নতুন দিনে কার্যত নতুন কিছুর ফিকে হয়ে আসছে। আবার তিনি নিজেও স্থির থাকতে পারছেন না নিজের কর্মের ওপর। একজন নিখাদ রাজনৈতিক নির্মাতার বয়ান যে এত দ্বান্দ্বিক হতে পারে তা সুবণূরেখা চলচ্চিত্র না দেখলে বুঝা যাবে না। একদিকে ঈশ্বরকে দিয়ে বলাচ্ছেন প্রচলিত সমাজের অসঙ্গতির কথা আবার ঈশ্বরকেই বন্দী করছেন সংশয়ের আবর্তে। দেশভাগের যাতনা ঋত্বিককে ছুঁয়ে গিয়েছে। বিভক্ত ভারতবর্ষের মানুষের সামনে নতুন দিনে কী অপেক্ষা করছে- ঋত্বিক সেই ভাবনাতেই সবচেয়ে নিমগ্ন ছিলেন। ঈশ্বরের নতুন ঠিকানা চালকলের ফোরম্যান যখন সুবর্ণরেখার তীরে নতুন বাড়ির বর্ণনা দিচ্ছিলেন ঈশ্বর তখন তাকে মিথ্যা বলতে বারণ করেন। সুবর্ণরাখার তীরে নতুন বাড়ির সৌন্দর্য নিয়ে মিথ্যে না বলতে নিষেধ করেন। ঋত্বিক আসলে মোহভঙ্গের শঙ্কায়। প্রবলভাবে শংসয়াপন্ন। আবার এই সমাজের দিকে ছুড়ে দেওয়া বাক্যবাণ প্রমাণ করে, ঈশ্বর আসলে দ্বিধাগ্রস্ত- তিনি কোন পথে যাবেন। সংশয় এবং সিদ্ধান্তের মাঝপথের জীবনটাই চালকলের নিভৃতবাস।

ব্যক্তি ঋত্বিকের প্রতি মানুষের ছুড়ে দেয়ার কথাগুলোই মনে হয় একবার ঈশ্বর অভিরামকে বলছিল, ‘কি যে ছাইভষ্ম লেখো। খালি কষ্ট আর দুঃখ’। প্রত্যুত্তরে অভিরাম বলছে, ‘ওগুলোই তো দেখি চারপাশে’। কিন্তু ঈশ্বরবাবু সতর্ক করেন, ‘হরপ্রসাদের মতো দশা হবে তোমার’। ঈশ্বর এবং অভিরাম- এ দুই চরিত্র ঋত্বিকের নিজের সঙ্গে কথোপকথন। মনে হয়, স্বার্থবাদী-আত্নকেন্দ্রিক ও লুকিয়ে থাকা ঈশ্বরের সঙ্গে যুযুধান হরপ্রসাদ। বলা যায়, ব্যাক্তিবাদী বনাম সমাজবাদে নিমগ্নতার প্রশ্নে নিজেকে উৎসর্গ করার মতো জরুরী প্রশ্ন। ঈশ্বর বলছে, ‘সবাই একটু গুছিয়ে নিয়ে সেগুলোকেই আকড়ে ধরে থাকতে চায়-এইটাই নিয়ম’। দ্বিধান্বিত প্রজন্মের সামনে এর থেকে জরুরী উপলব্ধি আর কি হতে পারে? ঋত্বিকের ক্যামেরায় এই নিররন্তর বিতর্কটাই প্রাণ। গল্পের বুননে বিতর্কটাই সংলাপ। মূর্ত বিষয়টি হলো, দিনশেষে ঋত্বিক শ্রেণীগত অবস্থানকে উর্ধ্বে তুলে ধরেন।

অভিরাম এবং সীতার ভালবাসার মাধ্যমে একটি নতুন যুগের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ঈশ্বর তাদের প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু অভিরামের মৃত্যুর পর একজন পতিতা হয়ে দাদা ঈশ্বরের সামনে হাজর হন সীতা। ঋত্বিক বাঙালী দর্শক কে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা দিয়েছেন এখানেই। কী মর্ম যাতনা! এত শক্ত আঘাতের সামনে দাঁড়িয়ে দর্শক বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। । এরপর সীতার মৃত্যুর পর ঈশ্বর আবারও পুরনো পথেই ফিরে আসেন। ঈশ্বরের নতুন জীবন কিন্তু বেশ পুরনো। যেভাবে সীতা-অভিরামের সঙ্গে তাঁর জীবনের রেখাচিত্র অঙ্কন হয়েছিল এবার তাদের পুত্রকে নিয়ে একই রকম পথের দিকে ছুটছেন ঈশ্বর। সুবর্ণরেখার তীর থেকে দেখা যায় সেই নয়পথ। চালকলের চাকরি খুইয়ে এবারের গন্তব্য নতুন দিকে। মেদিনীপুরের কোল ঘেষে বয়ে গেছে সুবর্ণরেখা। এর তীরেই সেই চালকল। ঋত্বিকের গল্পে সুবণূরেখা উপলক্ষ্য নয়। সত্যিই নয়। একটা বহমান জীবন, ভারতের মানুষের মুক্তি, মুক্তির পথ অনুসন্ধান- ঋত্বিক ঘটন এতসব কিছুকে সুবর্ণরেখা নদীর স্রোতের মতো জোগার করেছেন। যেন গোটা চলচ্চিত্রটাই স্রোতধারা।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:২১

রাজীব নুর বলেছেন: মুভিটা দেখা হয় নাই। আজ দেখব।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.