নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্রাত্যজনের কথাকলি

মুশফিকুর মুজাহিদ অনিক

১০১১৯৯৩

মুশফিকুর মুজাহিদ অনিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

সেলিম আল দীনের বাহাস

১৩ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৯:৫৪

আমাদের নাটকের ইতিহাস কতদিনের? সাহিত্যের ইতিহাস যারা লিখেছেন তাদের ভাষ্য, রাশিয়ান ভদ্রলোক গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদফের হাত ধরে ১৭৯৫ সালে কলকাতার ২৫, ডোমতলা লেনের বাড়িতে বাংলা নাটকের শেকড় পোতা হয়েছিল। আধুনিক বাংলা নাটক লেখার ইতহাস আরও পরের কথা। কিন্তু ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নাট্য আন্দোলন ও নবনাট্য আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র বাংলা নাট্যসাহিত্যের এই বিবৃতিকে মানতে পারেননি। আবার বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে একজনের আবির্ভাব ঘটেছিল তিনিও এই বিবৃতিকে খণ্ডন করেছেন। শুধু তাই নয়, বাংলা সাহিত্য তথা শিল্পের মর্যাদা রক্ষায় তিনি রীতিমতো বাহাসে নেমে পড়েছিলেন। বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে বাহাস উস্কে দেওয়া ধ্রুবতারাটির নাম নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। তিনিই সেই ‘সংবেদনশীল ও ভূমিজ’ শিল্পানুসন্ধানী মানুষ। নাটক তথা শিল্পে স্বজাত্যের হারানো ইতিহাস খুঁজতে খুঁজতেই ২০০৮ সালে এই মানুষটি প্রয়াত হয়েছেন। আজকের দিনটি তাঁর প্রয়াণ দিবস। তাকে স্মরণ করার প্রয়োজন রয়েছে বাংলা ও বাঙালির।
গত শতাব্দীতে পঞ্চাশের দশকোত্তরকালে ঔপনিবেশিক শাসন প্রায় অস্তাচলে গেলেও তাদের বৃদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত তাত্ত্বিক অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ পাশ্চাত্যের চিন্তাকাঠামো, নয়া ওপনিবেশিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে বাকি বিশ্বের জন্য আলাদা তত্ত্বীয় কাঠামো 'ওরিয়েন্টালিজম' তথা 'প্রাচ্যতত্ত্ব' নিয়ে হাজির হন। তাঁর কাছাকাছি সময়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও পাশ্চত্যের শাস্ত্রীয় নন্দন চিন্তা বিরোধীতার মুখে পড়েছে 'তৃতীয় চলচ্চিত্র' আন্দোলনরূপে। লাতিন আমেরিকার ফার্নান্দো সোলানাস, আফ্রিকার ওসমান সেম্বেনে, ইরানের জাফর পানাহি, মহসিন মাখমালবেফের মতো পরিচালকরা বিকল্প পথ খুঁজেছেন চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়েই যা পাশ্চাত্যভাবনাকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করেছে। আমাদের মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকরা সে পথেই হেটেছেন। পাশ্চাত্যের চিন্তায় যা কিছু উন্নয়ন, যা কিছু শুভ তা সবার জন্যও প্রযোজ্য-এই ধারণার বদল ঘটানোর রসদ সরবরাহ করে সাঈদের নবতত্ত্বায়ন এবং তৃতীয় চলচ্চিত্র আন্দোলন। ঠিক সেভাবেই, বাংলা সাহিত্যের পরিভাষা ও আঙ্গিকে ’প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্য’-এই বাহাসকে সেলিম আল দীন বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন। সেলিম আল দ্বীন এই ‘মৌলিক ও ‘অপরিহার্য’ তর্ককে অবলম্বন করেছেন একজন নিখাদ ভূমিপুত্র হিসেবে। ভারতীয় উপমহাদেশে উপনিবেশোত্তর সময়ে পাশ্চাত্যপুষ্ট জীবনপ্রণালী, রাজনীতি, অর্থনীতি ও শিল্পকে পাশ কাটিয়ে স্বীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন তিনি। সাহিত্য ও শিল্প সমালোচকদের বাহাসে তাঁর দিকে ধেয়ে আসা রূঢ় সমালোচনার মুখে দাড়িয়ে সেলিম আল দীনের মৌলিকত্বই বা কোথায়, আবিষ্কারই বা কী- তাতে নজর দেওয়া যাক।
বাংলা নাটকে অবিসংবাদিত মৌলিক ধারণার বিস্তার ঘটিয়ে বহু শতাব্দদীর ঐতিহ্য ও দর্শনের ঋদ্ধ জগত উন্মোচন করার পাশাপাশি নাটক রচনা, মঞ্চায়ন এবং নির্দেশনায় তিনি স্বজাতির ভাবনা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, নৃতত্ত্ব কিংবা বয়ানের মাধ্যমে ইউরোপের শাস্ত্রীয় নাট্যচর্চার 'একপেশে' ও 'বিজাতীয়' চিন্তাকাঠামোকে খণ্ডন করেছেন। নাটকটা ডোমতলা লেনে থেকে জন্ম নেয়নি বরং নাটকের শেকড় রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, গৌড়েই প্রোথিত ছিল- এ সত্যটুকুর মূল্য কতটা তা কী আমরা অনুভব করতে পারি? সত্যি কথা বলতে, পারিনা। পশ্চিমের বুননকে অস্বীকারের অভ্যাস এখনও করতে পারিনি আমরা। কিন্তু সেলিম আল দীন তা অস্বীকার করেন। 'মধ্যযুগের বাংলা নাট্য' গবেষণাগ্রন্থে তিনি দেখাচ্ছেন পাঁচালি, গীত, গম্ভীরা, কাব্য, শূণ্যপুরান, চর্যায় নাট্যবৈশিষ্ট্য-সংলাপ কাব্যধাঁচেই প্রোথিত ছিল এবং নাটকের গীতিবৈশিষ্ট্যও তৈরি হয়েছিল। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের ট্রাজেডি, আমাদের কমেডি আমাদের মতো করেই রয়েছে যুগ যুগ ধরে।
সেলিম আল দীন জীবনের সবচেয়ে মহতী কাজটি করেছেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। আশির দশকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই সংগঠনটি। পল্লী-প্রকৃতির গভীরে লুকিয়ে থাকা নাট্যধারা খুঁজে বের করতে তাঁর এই প্রচেষ্টা। প্রায় দুই শতাধিক গ্রামীণ নাট্যগোষ্ঠী কাজ করে এতে। যদিও এর কাজকর্ম কিছুটা স্তিমিত মনে হচ্ছে ইদানিং। তবে, গোটা বাংলা ভাষাভাষি ভূখণ্ডের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ করতে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের মঞ্চগুলোতেও সেলিমের মঞ্চভাবনার অনুপ্রেরণা গ্রামগঞ্জের এসব নাট্যগোষ্ঠী। মঞ্চ নিয়েও তাঁর বিস্তর মত-দ্বিমত।
সেলিম আল দীন এ অঞ্চলের লুপ্তপ্রায় মঞ্চরীতি পুন:প্রতিষ্ঠা করেছেন নগর সংস্কৃতির নাট্যাঙ্গনে। এ লক্ষ্যে, দর্শককে সামনে রেখে উপস্থাপনার ‘প্রসিনিয়াম’ রীতিকে ভেঙেছেন তিনি। আমাদের লোকগানে দেখা যায়, মাটিতে বসে গোল হয়ে আসর পাতা হয়, চারদিকে সমতলে উপস্থিত থাকে বৃত্তাকার দর্শক। সেলিম বলছেন- এটিই আমাদের আবহমান ঐতিহ্য। নাট্যকার এবং তাঁর অনুসারীরা পরবর্তীতে সফল মঞ্চায়নও করেছেন এভাবেই। কিত্তনখোলা নাটকের মঞ্চায়নে তার নজির সুস্পষ্ট। জগন্নাথ বিশ্বদ্যিালয়ে নাটককলা বিভাগের শিক্ষক ও সেলিম আল দীনের শিষ্য ড. কামাল উদ্দীন কবিরের সুর মিলে যাচ্ছিল গুরুর সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, ’আমাদের জাতীয় নাট্যশালাটিও ইউরোপীয় প্রসিনিয়াম মঞ্চ। অথচ, তা হওয়ার কথা ছিল না। আমরা আমাদের শিল্পবোধকেও ঔপনিবেশিকতায় আবদ্ধ করেছি।’ সেলিম আল দীনের লড়াইয়ের মর্ম বুঝতে তারপরও কী অসুবিধে হয়? নিশ্চয়ই না।
বাংলা ভাষায় পাশ্চাত্যের অনুকরণে প্রায় আড়াই শতাব্দীকাল ধরে নাটক লেখা হচ্ছে। তিনিও লিখছিলেন এক সময়। এর মধ্যেই বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলছে তাঁর অনুসন্ধান। নাটকের আঙ্গিক নিয়ে বিদগ্ধ নিরীক্ষণে অন্ত:প্রাণ তিনি। নিরীক্ষার মধ্যগগনে তিনি ’কিত্তনখোলা’র মেলার কথা বলছেন। এখানে সোনাই, বশির, ছায়ারঞ্জন থেকে শুরু যাত্রার নায়িকা বনশ্রীবালা, লাউয়া বেদেকন্যা ডালিমন, ওদিকে কপট ইদুর সমাবেশ ঘটিয়েছেন ইউরোপীয় নাট্যকৌশলকে প্রত্যাখান করে। কিত্তনখোলার চলমান নিরীক্ষায় আবিষ্কার করেন বাংলা নাটকের প্রথম বর্ণনাত্মক রীতি। বনশ্রীবালার রূপযৌবন, ডালিমনের শরীরের চুকা গন্ধ কিংবা নিপীড়িত কণ্ঠমসেমেত বিচিত্র উপাদানের সমাহার- নাট্যচার্য যেন শিল্পে সমস্ত প্রান্তজনের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। ভূমিজ চেতনায় এসব মৌলরূপ অনুসন্ধান করতে করতে আবিষ্কার করেছেন একদম হারিয়ে যাওয়া গীতিকথা, গীতপদ্ধতি। ইউরোপের পঞ্চাঙ্কবিশিষ্ট নাটক পরিত্যাগ করে নয়টি সর্গে নাটক শেষ করেছেন অসামান্য নাট্যগাথাটি। তবে সেলিম আল দীনের নিরীক্ষার বৈচিত্র্যপূর্ণ ও চূড়ান্ত নিদর্শন সম্ভবত ’চাকা’। নবগ্রামের উদ্দেশ্যে ছুটে চলা লাশের গাড়ির চাকার গতি সঙ্গে আশি-নব্বই দশকের বিক্ষুব্ধ রাজনীতির অনিশ্চয়তা মিলেমিশে একাকার। এদিকে, নবগ্রাম সেই লাশের ভুল ঠিকানা। চাকার গল্পের নিরন্তর আবর্তনে সেলিম নির্মাণ করেছেন এমনই এক অভূতপূর্ব নাট্যকৌশল যা রীতিমতো মাটির সোদাগন্ধমাখা আবিষ্কার। এবার কিত্তনখোলার সর্গ বিন্যাস থেকে উল্লম্ফন করেছেন মঙ্গলকাব্যের খণ্ড বিন্যাসে (মধ্যযুগে কালিকামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবমঙ্গল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে খণ্ডভাগে নাটক লেখার কৌশল)। ঠিক এভাবেই, ইতিহাসকে ভুল প্রমাণ করে তিনি দেখাচ্ছেন- রাধা-কৃষ্ণ, বেহুলা-লক্ষীন্দরসহ অনার্য কিংবা আর্য-অনার্য মিশ্রিত সংস্কৃতির গভীরে নাটক ও নাটকীয়তা বিরাজ করছিল।
এখানেই শেষ নয়; নাট্যাচার্য স্বজাতির জীবনাচারকেও নমস্য মেনেছেন। আবহমান পল্লীপ্রকৃতির মানুষ, ধর্ম, রীতিকে উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন ’স্বর্ণবোয়াল’ নাটকের মধ্য দিয়ে। একটি সোনাদেহের বোয়াল মাছকে ধরতে গিয়ে প্রজন্মক্রমে জনম মাঝি, খলিশা মাঝি, যুবক তিরমনের তপস্যা দ্বারা নাট্যকার স্বজাতির ওদার্য-গৌরবকে পূজা করেছেন। তার ভাষ্যে, ’পশ্চিম’ প্রাপ্তির মাঝেই শেষ দেখে ফেলে। কিন্তু তাঁর স্বজাতি পরম প্রত্যাশার মাঝে ’প্রত্যাখানের বেদনা’কে আকড়ে ধরেও বাঁচতে পারে। লোকায়ত গল্পের প্রতি অনুরাগের সুর ষোলআনা উঠে আসে 'প্রাচ্য' নাটকটকে। ঝাঞ্জা-বিরুদ্ধতার মধ্যে ক্লান্ত নৃগোষ্ঠীর হাহাকার ’বনপাংশুল’, ওদিকে সোমেশ্বরী নদীর পূর্বপাড়ে একটি গ্রামের বন্ধ্যা গৃহবধূ সুবতীর সঙ্গে গৃহপালিত প্রাণীর বন্ধনের চিরায়ত সঙ্কটের বিষয়-'ধাবমান', জীবনেরই কথা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে অসহায় বঞ্চিত মানুষের জীবন বিধৃত হয়েছে ’হরগজ' নাটকে। বৃদ্ধ আনার ভাণ্ডারির সমুদ্রতীরের জীবনের বিচিত্র সদাইয়ের কথা বর্ণিত হয়েছে ‘হাতহদাই’ এ। আবার যুদ্ধবাজ পরাশক্তিদের সৃষ্টি করা কাজিয়ায় বলি হওয়া মানুষদের প্রতিনিধি হয়েছেন ‘নিমজ্জন’ নাটকটি লিখে। তাঁর নাটকে যেন এভাবেই সমস্ত প্রান্তজনের সমাবেশ ঘটেছে। যৈবতী কন্যার মন, মুনতাসির ফ্যান্টাসি, জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুনসহ আরও অনেক সৃষ্টি তাঁর এবং সর্বশেষ ’পুত্র’ নাটকের মধ্য দিয়েই এই ভূমিপুত্রের জীবনের ইতি ঘটেছে।
সমালোচকরা একদিন তাঁর চিন্তাকে গ্রহন করেননি কিন্তু দেশজ শিল্পের এত মহামূল্য চিন্তার পথকে রুদ্ধ করাও যায়নি। সেলিম আল দীন আজ না থাকলেও এই মহাপুরুষের শিল্প আন্দোলনে এখন আন্দোলিত বাংলা নাটক। তার পথ ধরে ঔপনিবেশিকতাকে বিযুক্ত করে গোটা বাংলা ভাষাভাষিরা নাটক লিখে চলেছেন, মঞ্চস্থ করছেন। সেলিমের মৌল ভাবনাগুলো পৌছে গিয়েছে বিশ্বময়। সম্প্রতি, ’স্বর্ণবোয়াল’ লন্ডনের একটি ইনস্টিটিউটের থিয়েটার ও পারফরম্যান্স বিভাগে পাঠ্য হয়েছে। বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে তাঁর নাটক। বাংলা নাটকের মহকবির প্রয়াণদিবসে রইল ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’।




মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.