![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের লাগোয়া। এ দুটি রাজ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষি মানুষ থাকার কারণে এবং নৃতাত্ত্বিক নৈকট্যের কারণে বাংলাদেশের তীক্ষ্ম দৃষ্টি রয়েছে রাজ্য দুটির সাম্প্রতিক নির্বাচনের ওপর। ইতমেধ্যে আসামের ভোটদান প্রক্রিয়া শেষ। পশ্চিবঙ্গে পাঁদফায় ভোট হওয়ায় বেশকিছু আসনে ভোটদান এখনও বাকি রয়েছে। আগামী মাসের দুই তারিখে রাজ্য দুটিতে কারা ক্ষমতায় বসছে, তা জানা যাবে। কিন্তু কারা ক্ষমতায় আসছে, তা নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা তুঙ্গে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বহু নাটকীয়তা হয়ে থাকে। টানা দুবার ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কেন্দ্রে শাসনক্ষমতায়। পশ্চিমবঙ্গে দলটি এবারের নির্বাচনে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে। রাজ্যটিতে এর আগে কখনোই সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল না তারা। বিগত লোকসভা নির্বাচনে ১৮ টি লোকসভা আসন দখল করে তারা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাফল্য পেয়েছে। অথচ, এর আগে এ রাজ্যে বিজেপির সাফল্য বলতে লোকসভায় সাকুল্যে দুটি আসন। এবার বিজেপি দাবি করছে, তারা ক্ষমতা দখল করবে। অন্যদিকে, আসামে বর্তমানে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। ক্ষমতা ধরে রাখতে তারাও আত্মবিশ্বাসী। আসামে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট লড়ছে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে। সেখানে জাতীয় নাগরিকপঞ্জিকরণ (এনআরসি), নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএ্এ) বেশ বড় ইস্যু। অসমীয় জাতিস্বত্ত্বার সঙ্গে বাঙালি বিভাজনকে কেন্দ্র করে সেখানে স্পর্শকাতর পরিস্থিতি রয়েছে। এনআরসি এ রাজ্যের জ্বলন্ত ইস্যু। আসামের করবি, দিসপুর ও বোডোঅধ্যুষিত অঞ্চলে আদিবাসীদেরও দাবিদাওয়া কিছু ভিন্ন রকম দাবিদাওয়া আছে। আদিবাসীদের বড় অংশ এবার কংগ্রেসের জোটে রয়েছে। সুতরাং আসামের বহু ইস্যুর মিথষ্ত্রিয়া দেখা যাবে, এবারের ভোটের ফলে। সবকিছুর মূলে জল্পনা, কংগ্রেসের জোট শাসন কী আবার ফিরে আসছে নাকি আবারো বিজেপি-সেটাই দেখার বিষয়।
এখন কী ঘটতে পারে এ দুটি রাজ্যের ফলাফল?
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বিজেপির প্রতিপক্ষ মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস। এছাড়া সর্বভারতীয় কংগ্রেস, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদি) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ও ফুরফুরা মরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দীকির দল ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) জোটগতভাবে লড়ছে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় ২৯৪ আসনের মধ্যে ১৪৮ আসন প্রয়োজন সরকার গঠন করতে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট থাকায় বেশ কিছু আসনে হিসাবনিকাশ বদলে গেছে। বিশেষ করে, মালদা, মুর্শিদাবাদ ও মুসিলম অধ্যুষিত জায়গায় এই জোট সুবিধা পাবে এই জোট। সে ক্ষেত্রে মমতার দলের ভোট কমবে কারণ সংখ্যালঘু ভোটে বাম-কংগ্রেসের জোট ভাগ বসাবে। বলা যায় না, এই মারপ্যাচে সাবেক সতীর্থ শুভেন্দু অধিকারীর (বিজেপি প্রার্থী) কাছে নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হেরে যান কী না। কারণ বামপ্রার্থী তরুণ মীনাক্ষী সেখানে যত সংখ্যালঘু ভোট কাটবেন সেখানে মমতার তত ক্ষতি। এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যতগুলো জরিপ হয়েছে তার নিরিখে বলা যায়, তৃণমূল আসন পাবে ১৫০ টির আশেপাশে, বিজেপি ১১০-১১৫ টি, বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ ২০-২৫ টি। তাহলে তৃণমূল সরকার গড়ার মতো প্রয়োজনীয় আসন পাচ্ছে। অন্যদিকে, বিজেপি প্রথমবারের মতো বিরোধীদলের আসনে বসছে। অবশ্য আসনসংখ্যার এই হিসাব মানতে নারাজ কোনো পক্ষই। তৃণমূলের দাবি, তারা পাবে ২০০'র ওপরে, বিজেপিও তাই বলছে, বাম-কংগ্রেস-আইএসএফও তাই। বিষয়টি হচ্ছে, নির্বাচনি মাঠ থেকে অনুমান করা যায়, দুইশত আসন কোনো পক্ষই পাবে না। যদি পায়ও সেটা বেশ আশ্চর্যের হবে। কারণ, রাজ্যে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিজেপির উত্থানের পর থেকে রাজনীতির অঙ্ক বদলেছে। বিজেপি'কে বাইরে রেখে রাজনীতির হিসেব এখানে এখন অসম্ভব।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, বিজেপি তৃণমূলকে ভেঙে খান খান করে দিয়ে তার শক্তি বৃদ্ধি করেছে। পশ্চিমবঙ্গের সিনে ইন্ডাস্ট্রি থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী মহলেও দলটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। করপোরেট দাপটই হোক আর কেন্দ্রের ক্ষমতা বা এজেন্সিগুলোকে কাজে লাগিয়েই হোক, দলটি শক্তি বৃদ্ধি করেছে-এই বিষয়টি গায়ের জোরে অস্বীকার করে লাভ নেই। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো- বাংলাদেশে সংঘটিত বিভিন্ন সময়ের সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো বিজেপিকে সেখানে হিন্দুত্বের ট্রামকার্ড খেলতে অক্সিজেন জুগিয়েছে।
আসল কথায় আসা যাক। তৃণমূল যদি ১৫০-১৬০টি আসন পেয়ে সরকার গড়ার চেষ্টা করেও সেই সরকার আলোর দেখবে কি না সন্দেহ রয়েছে। আবার সরকার গড়ে ফেললেও সেই সরকার দীর্ঘস্থায়ী হবে কী না সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ হচ্ছে, নির্বাচিত বিধায়কদের দল ত্যাগ করিয়ে বিজেপিতে যোগদান করানোর উদাহরণ দলটির রয়েছে। এমনকি বিধায়ক কিনে সরকার পাল্টে দেওয়ার ইতিহাস নিকট অতীতে কম নয়। মধ্যপ্রদেশে কমলনাথের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার ফেলে দিয়েছে বিজেপি, কর্ণাটকে কংগ্রেস-জেডিইউ সরকার ফেলে দিয়েছে বিজেপি। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে যদি কোনোমতে তৃণমূল সরকার গড়ে, সেই পরিস্থিতিতে সেই সরকার নড়বড়ে হবে। তৃণমূল দলটি কোনো আদর্শিক ভিত্তির উপর দাড়িয়ে নেই। বামফ্রন্টের বিরোধীতা করে এবং সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনে ভর করে ক্ষমতায় আসে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস। প্রকৃতপক্ষে মমতার জেদী মনোভাবই দলটির সম্পদ। দলের বিধায়করাও তাই আদর্শতাড়িত নন। তৃণমূল মানেই দলছুট বামপন্থী সিপিআইএম, নকশাল আর কংগ্রেসি। তাই এসব নেতাদের দল পরিবর্তনের ইতিহাস অতীতেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। মমতার দল কতটা ভঙ্গুর তা চলতি নির্বাচনের আগে বেশ ভালোবাবেই বুঝেছেন। এক ঝাক বিধায়ক-নেতা এখন বিজেপিতে। সে কারণেই কয়েকদিন আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার এক জনসভায় বলেছেন,'আমাকে আপনারা ২০০ আসন দিন, না হলে ওরা (বিজেপি) ভোটের পর ভাগিয়ে নিবে।' সুতরাং তৃণমূলের সরকার স্থায়ী করতে হলে কমপক্ষে বড় অঙ্কের আসন লাগবে যেটা ১৪৮'র বেশ উপরে থাকবে।
অন্যদিকে, আসামেও একই কথা প্রযোজ্য। ১২৬ আসনের বিধানসভায় সরকার গড়তে ৬৪ টি আসন দরকার। এই রাজ্যে বিজেপির দুই প্রভাবশালী নেতা বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সেনোয়াল এবং সাবেক কংগ্রেস নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মা। গতবার ১৫ বছরের কংগ্রেস শাসন হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় আসে বিজেপি ও অসম গণ পরিষদের (অগপ) জোট। কংগ্রেস এবার আদিবাসী এবং করিমগঞ্জ-ধুবড়িসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের নেতা বদরুদ্দিন আজমলের দল ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (এআইইউডিএফ) সঙ্গে জোট করেছে। কংগ্রেস নির্বাচনে এনআরসি ও সিএএ বিরোধীতা করে প্রচার চালিয়েছে। তাদের দাবি, বিজেপিকে আসামের মানুষ প্রত্যাখান করেছে। এনআরসি এবার বেশ বড় ইস্যু হয়েছে এ রাজ্যে। বিজেপি'ও এনআরসি ইস্যুতে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে এক প্রকার ব্যর্থই। ফল বের হলেই বোঝা যাবে, ইস্যুটি অসমীয়রা কিভাবে নিয়েছে। জাতিগত আসামিদের সঙ্গে সেখানকার বাঙালিদের বিরোধের মধ্যে বিজেপি মুসলিম তাড়ানোর ফন্দি ঢুকে যাওয়ায় পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিয়েছে। আসামের নির্বাচনের ফলাফল তাই ঘোরতর অনিশ্চয়তায় ঠাসা। তবে এখানে যদি বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতার চাইতে কম আসন পায় সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মতো সহজে ক্ষমতা দখল করা যাবে না। কারণ, এখানে তার প্রতিপক্ষ সর্বভারতীয় কংগ্রেস। দল ভাঙানো পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে এখানে একটু কঠিন। তবে কংগ্রেসের বাইরের অ-বিজেপি শক্তিগুলোতে ভাঙন ধরানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তবে,
এই দুই রাজ্যে কেউই প্রয়োজনীয় সংখ্যগরিষ্ঠতা না পেলে খেলা জমে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল যদি ১৪৮'র কম পায় অথবা স্থায়ী সরকার গড়তে কোনো দলের সমর্থন চায় তবে পরিস্থিতি বেশ জমে যাবে। সে ক্ষেত্রে বামপন্থীরা জানিয়েছে, তারা কোনো অবস্থাতেই মমতার সঙ্গে যাবে না। বিজেপি'র সঙ্গে তো বাম-কংগ্রেসের সম্ভবই নয়। আইএসএফ বাম-কংগ্রেস ছেড়ে মমতার দলকে সমর্থন দেয় কী না-সেটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিজেপিকে আটকাতে সেই হিসেব মিলতেই পারে। যদিও আব্বাস সিদ্দীকি এ বিষয়ে কিছু বলেনি, পুরোটাই পর্যবেক্ষণ। কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস তথা মমতার সর্বভারতীয় স্তরে বোঝাপড়া আছে। সেক্ষেত্রে মমতার ডুবন্ত নৌকাকে টেনে তুলতেই পারে কংগ্রেস। সোনিয়া গান্ধীর কাছে মমতা সমর্থন চাইলে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় বিজেপি বিরোধীতার নীতি এখানে কাজে লাগতে পারে। শোনা যায়, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরীর এক্ষেত্রে ভিন্নমত রয়েছে। তবে তাকে কংগ্রেসের হাইকমান্ডোর সিন্ধান্ত মানতেই হবে, যদি সেরকম হয়।
আর, আসামের পরিস্থিতি এত জটিল নয়। সেখানে অবশ্য আঞ্চলিক গণ মোর্চা ও জেপিপি- এই দুইটি আঞ্চলিক দলকে নিয়ে দোদুল্যমানতা রয়েছে। তারা যদি বলার মতো আসনও পায় তবে ভোটপরবর্তী জোটে তারা বিজেপির সঙ্গী হলেও হতে পারে। কংগ্রেসের কাছে চ্যালেঞ্জ হবে বোডো অঞ্চলের নেতাদের ধরে রাখা। মোটকথা হচ্ছে, ভোট পরবর্তী জমজমাট খেলাটা আসামে একটু কমই হবে। যদি হয়ও সেই খেলায় বিজেপি খেলবে, কংগ্রেস দর্শক হবে। এক্ষেত্রে কংগ্রেসকে স্বস্তি দিতে পারে বদরুদ্দিন আজমলের দল। তারা ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে যত আসন পাবে কংগ্রেসের মুখ ততো উজ্জল হবে। সিএএ-এনআরসি'কে কেন্দ্র করে আজমলের এআইইউডিএফ ভালো ফল করবে বলে মনে করছেন অনেকে।
দেখা যাক, দুই তারিখ কী হয়...
©somewhere in net ltd.