![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিউবা থেকে দৃষ্টিটা প্রাচ্যে আনুুন। পশ্চিমাদের গণতন্ত্র আর উদারবাদী অর্থনীতির জয়ঢাক কেমন তা দেখা যাবে। আফগানিস্তানে কী হচ্ছে! যা হচ্ছে তাকে এক কথায় বলা যায়, আফগানিস্তানকে নরক বানিয়ে চলে যাচ্ছেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিত্ররা। গোটা দুনিয়ার কোথায় আগুন জ্বলায়নি এরা। সবখানেই এদের হাত পড়েছে। পৃথিবীর অর্থনীতিকে হাতের তালুতে নিয়ে রাজ করছে। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে মারণস্ত্রের ঝনঝনানি। মানুষের মেৌলিক অধিকারটুকু পর্যন্ত এরা পদদলিত করেছে। জীবনের মূল্য স্রেফ অর্থ-লাভ-লোকসানের নিগড়ে বন্দী করেছে। পরমাণু অস্ত্রের মধ্যেই প্রতিদিন ঘুমোতে হয় বিশ্ববাসীকে। প্রাণ-পরিবেশ-জলা-জঙ্গল-ধরিত্রী নষ্ট করে উদগ্র শিল্পায়নের মহোৎসব চলছে। উদ্বৃত্ত খাদ্যেও আফ্রিকা-এশিয়ায় ক্ষুধার তৃষ্ণা কমেনি। ন্যূনতম চিকিৎসার সুবিধাটাও উদার অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।
করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে যা চলছে তা উদারবাদী অর্থনীতির স্বাদ তো এতদিনে মিটিয়ে দেওয়ার কথা। যতটা অবশিষ্ট ছিল তা তো নাঙ্গা হওয়ার কথা এতদিনে। পশ্চিমাদের টিকা অর্থনীতির খুল্লামখাল্লা রূপ দেখলে পিলে চমকাবে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ টিকার পূর্ণ ডোজ গ্রহণ করেছেন। ইউরোপে ৭০% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ টিকা গ্রহণ করেছেন। এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিনের মানুষ টিকার জন্য হাহাকার করছেন, অথচ পশ্চিমারা টিকার মজুদদারি করছে। মাহামারির সময়েও টিকা কোম্পানিগুলো একচেটিয়া মুনাফায় ক্ষ্যান্ত দেয়নি। বরং এটা তাদের মোক্ষম সুযোগ। একই অবস্থা হয়েছিল ইবোলার টিকা নিয়েও। টিকা কেনার সামর্থ্য না থাকায় আফ্রিকায় তা সরবারাহ করা হয়নি ইবোলা মহামারির সময়। আগামীতে ফাইজার, অ্যস্ট্রেজেনেকা, জনসনসহ বড় বড় টিকা উত্পাদনকারীদের ভবিষ্যত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাগুলো খেয়াল করলেই বোঝা যাবে কতটা আগ্রাসী তাদের তাদের টিকা অর্থনীতি। মহামারি মোকাবেলায় গোটা বিশ্বের যেখানে এক কাতারে দাঁড়ানো উচিত ছিল সেখানে আমরা দেখছি কী ভয়াবহ 'মারণ-কাঠামো' তৈরি করেছে এই ধনতন্ত্র। বাকি বিশ্বের জন্য দরদ কোথায় গেল তাদের? কিউবা নিয়ে এদের দরদ উথলে ওঠার কোনো অর্থ থাকতে পারে?
কিউবা হচ্ছে সেই দেশ যাদের নাগরিকরা অন্তত চিকিৎসার অভাবে মারা যায় না। তাদের যেটুকু সামর্থ্য রয়েছে তাতে সবার সমান চিকিত্সা নিশ্চিত করেছে তারা। পশ্চিমারা যতই নেতিবাচকভাবে দেখাক, প্রকৃতপক্ষে করোনা মহামারি মোকাবেলায় কিউবা অনেক উন্নত দেশ থেকে এগিয়েই ছিল। গোটা বিশ্বের চিকিত্সা ব্যবস্থায়ও তারা অনুকরণীয়। মানুষের বেঁচে থাকার খাবারটুকু সেখানে মোটামুটি নিশ্চিত। মনে রাখতে হবে, মার্কিন অবরোধের মধ্যেই তারা এসব নিশ্চিত করেছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতার নাম করে উদারবাদীরা যা বলেন, সেসব চর্মচক্ষের বিভ্রম চাড়া কিচ্ছু নয়। কোন চোখ দিয়ে তারা এই বিশ্বকে দেখেন? পশ্চিমা মালিকানার ১৫-২০টি সংবাদমাধ্যমের চোখ দিয়েই তো দেখেন, অন্য কিছু তো নয়। তাহলে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা এত সরল হয় কী করে তাদের! কিউবায় মতপ্রকাশের নিশ্চয়তা চাওয়ার আগে উদারবাদীরা বলবেন কী, ধনতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির মতপ্রকাশ গোটা দুনিয়ায় কী বয়ে এনেছে? গোটা দুনিয়া জানে, কিউবায় উদারবাদী অর্থনীতির বিষবাষ্প ছড়ানোর খায়েশটা আজকের নয়, বহু পুরনো। সামান্য একটি দ্বীপরাষ্ট্রের শিনাজুরিতে কী এমন মহিমা আছে যে তা মার্কিন মুল্লুকে জ্বালা ধরায়? মার্কিন অবরোধের মুখে দাঁড়িয়েও ১৯৫৯ সাল থেকে আজ অব্দি টিকে থাকাই সেই গাত্রদাহের কারণ। কিউবায় চলমান বিক্ষোভের মধ্যেই জো বাইডেন বলেছেন, তারা কিউবার জনগণের পাশে রয়েছেন। পাশে থাকার কথা বললেই চোখের নামনে ভেসে ওঠে একেকটা সিরিয়া, লিবিয়া কিংবা ইয়েমেন।
গত বছরের কথা। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকার আইএমএফ থেকে ঋণসহায়তা চায়। কিন্তু জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি নয় উল্লেখ করে সংস্থাটি মাদুরো সরকারের সেই প্রস্তাব খারিজ করে দেন। উত্তর কোরিয়া সরকারের ওপরও একই রকম অবরোধ দিয়ে রেখেছে পশ্চিমারা। এ তো গেল বর্তমান কালের কথা। গত শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী সমাজতানি্ত্রক আন্দোলনের প্রভাব রুখতে হেন কোনো কূটকেৌশল নেই যা তারা করেনি। উদারবাদীদের মতপ্রকাশের তীর কতটা সফল এই সংঘবদ্ধ পুঁজিবাদী আগ্রাসনের ত্রাহিসঙ্কুল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে, সেই হিসেব করাটা জরুরী। অন্যথায়, ধনতন্ত্র বনাম চীন-উ. কোরিয়া-কিউবা'র অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট- এই দুইয়ের মধ্যবর্তী সাম্যাবস্থায় নিজেকে নিরাপদ রাখার পরিতৃপ্তিটা নিছক আত্মসমর্পণ কিংবা বশীভূত হওয়ার শামিল । হ্যা সত্যি, পশ্চিমা প্রপাগান্ডায় বশ মানার মতোই ব্যাপারটা।
পৃথিবীর স্বৈরশাসকদের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের দহরম-মহরম ভুলে যায়নি কেউ। লাতিন আমেরিকার যেখানেই স্বৈরশাসক ছিল সেখানেই তাদের মদদ ছিল। উপনিবেশোত্তর সময়েও আফ্রিকা তাবেদার শাসক থেকে মুক্ত হয়নি। আজকের এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্যেও কী তার ব্যতিক্রম কিছু দেখা যায়? মোটেও না। সুতরাং জনঅসন্তোষের ধোয়া তুলে কিউবাকে প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র হিসেবে দেখানোর আগে উদারবাদীরা ভেবে দেখুক তারা কোন বিশ্বব্যাবস্থার পক্ষে ওকালতি করছেন।
সোভিয়েত সমাজব্যবস্থা কিংবা আজকের চীন- এই দুই প্রেক্ষাপটে একটি বহুল চর্চিত অভিযোগ হচ্ছে, মতপ্রকাশ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে গণতানি্ত্রক মূল্যবোধকে আঘাত করেছে কমিউনিস্ট কিংবা সমাজতন্ত্রীদের কর্তৃত্ব। সোভিয়েত যুগের মধ্যগগন থেকে শুরু হওয়া আমলাতন্ত্রের বল্গাহীন প্রভাব ও এখনকার চীনের কর্তৃত্ববাদকে অন্তত অস্বীকার কেউ করে না। মার্কস সম্ভবত গোথা কর্মসূচির সমালোচনায় বলেছিলেন, সমাজতন্ত্র বৈষম্যকে নিয়েই টিকে থাকে। অর্থাত্ গোটা দুনিয়ার সাম্যবাদী অগ্রযাত্রার একটি মাধ্যমিক পর্যায় হলো সমাজবাদী অর্থনীতি। সে কারণে সমাজতন্ত্রের অভ্যন্তরে সংকট থাকবে-এ কথা মার্ক্সবাদীরাও মানেন। এ পরিস্থিতিতে মার্ক্সবাদীদের জন্য শিক্ষা হলো- সমাজতন্ত্রের কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার বিলোপ সাধন। সেটা কীভাবে হবে- সেই পথরেখা আমাদের খুঁজতে হবে। এটাই মূল কথা। কিউবাকে টিকিয়ে রেখেই সেই পথ খুঁজতে হবে।
আরেকটি বাস্তবতা আমলে নিতে হবে। কিউবার চলমান বিক্ষোভ কিংবা উত্তর কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো আমাদের যা যা আওড়াতে বলে আমরা মোটামুটি তাতে 'মসি্তষ্ক প্রক্ষালন' যন্ত্রে 'প্রক্ষালিত' হয়ে যাই। পক্ষান্তরে কিউবা-কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমগুলোকেও আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। সংকটটা এখানেই। 'আইডিওলজিকেল স্টেট অ্যাপারেটাসের' পাশাপাশি 'রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস' আমাদের সেই বিশ্বাস রাখতে দেয় না। খোদ মার্কসও সেই বিশ্বাস রাখেননি। যতই সেটা সমাজতানি্ত্রক ব্যবস্থা হোক। কিন্তু আমরা ঠিক কোন পক্ষাবলম্বন করব। এসব বিক্ষোভের সুরে সুর মেলাবো নাকি 'প্রতিবিপ্লব' আখ্যা দেব ঠিক যেমনটা মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেল বলেছেন। সোজা কথা কোনোটিই নয়। কিউবাকে বিসর্জন দিয়ে পুঁজিবাদী দু:শাসনের মহীরূহ বৃক্ষে আর জল ছিটাতে চাওয়ার অর্থই থাকতে পারে না। কিউবার পিণ্ডি চটকানোর আগে খেয়াল রাখতে হবে, এখনকার বিশ্ব বাস্তবতায় ধনতন্ত্রের লাগান টেনে না ধরলে আগমীর পৃথিবী পরিবশেগত বিপর্যয়ে ধ্বংস হবে অথবা মারণাস্ত্র-মুনাফার বলি হতে হবে। সে কারণে আমি কিউবার গণবিক্ষোভকে মান্যতা দিয়ে বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে।
©somewhere in net ltd.