নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভীষণ কঠিন পোড়ামাটিকে আবার সেই কাদামাটিতে ফিরিয়ে আনা,ভীষণ কঠিন আঘাত দেয়া শব্দমালা গুলো ফিরিয়ে নেয়া।ভীষণ কঠিন নিজের সম্পর্কে কিছু বলা।যে চোখ দেখিনি সে চোখ কেমন করে বিশ্বাস করবে জানি না।যে কখনো রাখিনি হৃদয়ের উপর হৃদয়;সে কেমন করে বুঝবে আমায়!

নীল মনি

শিশুর মত চোখ দিয়ে দেখি আমার এই বিশ্ব।মানুষ স্বপ্নের কাছে হেরে যায় না, হেরে যায় নিজের প্রত্যাশার কাছে। প্রত্যাশা থাকে আকাশচুম্বী অথচ প্রচেষ্টায় থাকে শুধুই স্বপ্ন।

নীল মনি › বিস্তারিত পোস্টঃ

ব্ল্যাকহোল

১২ ই এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৪:৪২

ব্ল্যাকহোল এর গল্পটি লেখকের কন্ঠে পাঠ
চারিদিকে মাতামাতি, ব্ল্যাকহোলের ছবি তোলা হয়েছে। এই প্রথম মানুষ ব্ল্যাক হোলের ছবি তুলেছে। কথিত ব্ল্যাক হোলের সেই ছবির দিকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছে নাজরীন। ছবিটা সুন্দর। কিন্তু কতটুকু সুন্দর! নাজরীন দেখছে একটা আগুন হাসছে। ভালো করে আবার তাকায় ছবিটার দিকে। খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে নাজরীন।পা' দুটো ভাঁজ করা, মাথার উপর বেশ জোরে সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে। নাজরীন ছবিটাতে দেখছে আর ভাবছে একটা আগুনের ভূত হাসছে যার কি'না বড় বড় দুটো কানও আছে।

নাজরীন খুব চঞ্চল একটা মেয়ে যার মাথার চুলগুলো ম্যাগী নুডুলসের মত কোঁকড়ানো, চোখ দু'টো বয়স তুলনায় বেশ কোটরাগত কিন্তু মেয়েটার হাসি ফুলের মত। তুমি কি কখনো খুব ভালো করে ফুল হাসতে দেখেছ? নাকি অবাক হচ্ছ এটা ভেবে যে ফুল আবার হাসে নাকি? হ্যাঁ সব ফুল হাসে না কিন্তু কোন কোন ফুল সত্যিই হাসে। যেমন হাসে নাজরীন। এই মেয়েটির কন্ঠ ও হাসে,এত সুন্দর কন্ঠ! মেয়েটি খুব ছোট ছোট বাক্যে কথা বলে। এই মেয়েটির বয়স কেমন হবে ঠিক ধারণা নেই তবে চৌদ্দ বছরের বেশি হবে বলে মনে হই না।

আমি আনা জরীন। নাজরীনকে আরবি শেখাই। নাজরীনের মা মিসেস রাকা কিছুতেই চান না বাসায় পুরুষ কোন শিক্ষক পড়াতে আসুক। নাজরীনের সমস্ত শিক্ষকই মহিলা।প্রথম যেদিন এসেছিলাম ভদ্রমহিলা আমাকে প্রথমে যে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলেন তা হল আমার জীবনের স্বপ্ন কী? আমি কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভদ্রমহিলা বেশ মোটাসোটা, চোখে চশমা,নাক বোঁচা এবং উচ্চতায় খুব বেশি না। তার দ্বিতীয় প্রশ্নে আমি আমার সম্বিৎ ফিরে পেলাম।

সে আমাকে জিজ্ঞেস করল তুমি আরবীর শিক্ষক অথচ বোরকা পরো না কেন? এবারও আমি নিশ্চুপ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম। উনি বললেন বোরকা পরেও বা কী আর হবে? সময়টা এত খারাপ যাচ্ছে। সমগ্র পুরুষ মানুষের উপর আমার রাগ কিংবা বলতে পারেন অভিমান। যদিও অভিমানের নির্দিষ্ট কারণ হয় না। তবুও মানুষ হুট করে খুব ছোট্ট কোন কিছুর জন্য অভিমানী হয়ে ওঠে । যে অভিমানে সারাটা জীবন কোন এক দূরত্বে কেটে যায় প্রহর।ভদ্রমহিলাকে থামাতে ইচ্ছে করল না।মনে হল বলুক তার মনে যা কিছু লুকিয়ে আছে।হৃদয়ের ব্যথা তার এত বেশি যে নিজের ভেতর সে ব্যথার ভার সইতে পারছে না।

উনাকে বললাম- "বোরকা এটি একটি পোশাক। এই পোশাকের অর্থ আমি অন্যদের থেকে একটু দূরত্ব চাইছি । দূরে থাকো। এই সুন্দর পোশাকটার মর্যাদা কিংবা আবেদন হারিয়েছে কিছু মেয়ের অপকর্মের জন্য। আমি বোরকা পরি না কিন্তু ঢিলেঢালা পোশাক পরি। পর্দার জন্য প্রয়োজন ঢিলেঢালা পোশাক,আঁটসাঁট বোরকা নয়। "উনি আমার দিকে ভ্রু কোঁচকালেন কিন্তু কী বোঝাতে চাইলেন আমি জানি না।তবে এটুকু বুঝলাম কোথাও যেন উনার ক্ষোভ লুকিয়ে আছে।

সপ্তাহে চারদিন আসি এ বাড়িতে। এখানে নাজরীন, তার আম্মু ও আব্বু, আর গ্রাম থেকে আসা নাজরীনের এক চাচা ও চাচাত ভাই থাকে। আমার সাথে অবশ্য তেমন কারো সাথে দেখা হইনি।যে রুমে নাজরীন পড়তে বসে সেখানে আমি পড়াই না। ঘরটার দেয়াল জুড়ে শুধু বিভিন্ন প্রাণীর ছবি এবং বড় বড় পুতুল সাজানো বিছানার উপর। নাজরীনকে বললাম এ ঘরে পড়াব না, যে ঘরে এসব পুতুল আর ছবি নেই সে ঘরে পড়াব। নাজরীন চিন্তিত হয়ে পড়ল কারণ এ বাসায় এ রকম কোন ঘর নেই যেখানে প্রাণীর মূর্তি নেই।নাজরীন তার ঘর থেকে সব ছবি আর পুতুল সরিয়ে নিল।আমাকে বলল ম্যাম এগুলো থাকলে কী হয়? আমি বললাম এসব ঘরে থাকলে রহমতের ফেরেশতা আসতে পারেন না।আমাদের ধর্মে মানা আছে।তুমি বই পড়ে জেনে নিও।

এভাবে ভালোই কাটছিল দিনগুলো কিন্তু হঠাৎ একটা বিষয় খেয়াল করলাম নাজরীন পড়তে বসার পর ওদের বাসায় থাকা সেই কাজিন ডাক দেয়। নাজরীন পড়া রেখে চলে যায়। আমি বসে থাকি।দুপুরের এ সময়টাতে রাকা ম্যাডাম অফিসে থাকে।ঘরের সামনে দিয়ে একজন মধ্য বয়সের মানুষের চলাচল করতে দেখা যায়। নাজরীন একদিন পড়তে বসে উঠে চলে গেছে,অনেক সময় হয়ে যায় তবুও সে আসে না। দেখি নাজরীনের চাচা আমার ঘরে এসেছেন।ঘরে ঢুকতেই আতরের গন্ধে সারা ঘর ভরে উঠেছে।আমি আতরের গন্ধ মোটেও সহ্য করতে পারি না। আমার গা গুলিয়ে ওঠে। উনি আমাকে বলে, "আপনার ছাত্রীকে পড়া থেকে এত উঠতে দেন কেন? বকা দিতে পারেন না? " আমি মাথা না তুলে, চোখে চোখ না রেখেই বলি জ্বী আচ্ছা।তবে বুঝতে পারি প্রকান্ড স্বাস্থ্যবান একজন মানুষ তিনি।

নাজরীন আজ মন খারাপ করে বসে আছে। গতদিন ভেবেছিলাম নাজরীনের আম্মুকে বিষয়টা জানাব, কিন্তু জানানো হয়নি। নাজরীন দিন দিন মনমরা আর চুপ হয়ে যাচ্ছে।আজকে যখন পড়াচ্ছি, পড়তে পড়তে হড়হড় করে টেবিলে বমি করে দিল।আমার ব্যাগে স্যালাইন ছিল তাড়াতাড়ি ওকে স্যালাইন বানিয়ে খাওয়ালাম।মেয়েটা স্যালাইন খেতে পারে না।
বড়লোকদের অনেক কষ্ট,অনেক কিছুই তারা খেতে পারে না। তারা অল্পতেই অসুখী হয়ে ওঠে।অথচ সুখ তো বিরল মুক্তার মত। যা মানুষের মনের মধ্যে লালিত হয় প্রতিনিয়ত কিন্তু বিত্তবানরা সেটা ভাবতে পারে না। এই মেয়েটাকে দেখে এখন অসুখী লাগছে। কাঁদছে নাজরীন।আমি নিজের পরিধেয় পোশাকটা পানি দিয়ে ধুয়ে নিলাম।ভীষণ ঘৃণা করছিল কিন্তু ভাবলাম নাজরীন আমার আপন ছোটবোনের মত।আমার আপন ছোটবোনের নাম রিনি। মায়ের আঁচলের তলে সারাক্ষণ লুকায়। পড়াশুনা করতে চায় না। নাজরীনের মতই বয়স হবে রিনির। আমার পরিবারের সবাই গ্রামে থাকে। আমিই কেবল শহরে থাকি পড়াশোনার জন্য।
নাজরীন বিছানায় শুয়ে আছে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কাঁদছ কেন নাজরীন? শরীর কী তোমার বেশি খারাপ? আম্মুকে ফোন করব?

নাজরীন আমার হাতের মুঠো চেপে ধরে তার কপালে হাত রাখতে বলল।আমি নাজরীনের পাশে কপালে হাত রেখে বসলাম।এই মুহুর্তে রিনির কথা মনে আসছে।রিনি কী করছে? ওর শরীর ভালো তো? গত ছ'মাস হল বাড়িতে যেতে পারিনি। বাড়িতে যেতে হলে অনেক খরচ। এত খরচ করে যাওয়াটা বোকামি লাগে।তবুও প্রিয় মুখগুলো দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করে।
নাজরীন এখনো কাঁদছে। আমি ওর কান্নার কারণ বের করতে পারছি না।

-তোমার কি বেশি শরীর খারাপ লাগছে?

নাজরীন চোখ বন্ধ করে বলছে ম্যাম আমার পেট ব্যথা করছে।আমি ব্যস্ত হয়ে ফোনটা হাতে নিতে যাচ্ছিলাম ও আমাকে বাধা দিল। বলল আপনাকে আমি ম্যাম বলি কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি বড়বোনের মত মনে করি।আমার তো কোন ভাই বোন নেই। নিঃসঙ্গ আমি! আজ তোমাকে একটু আপু ডাকি। আমি মাথা ঝাঁকালাম।ও আমার মাথা ঝাঁকানো দেখতে পেল না। তবুও ও বলা শুরু করল। -আপু ব্ল্যাকহোলের ছবি দেখেছ? আমি দেখেছি। জানো আপু এই ব্ল্যাক হোলের ছবি আমি স্বপ্নেও দেখেছি। তোমাকে তুমি বলি। আমি আবারও মাথা ঝাঁকালাম ও দেখল না চোখ বন্ধ করেই রইল। তুমি তো জানো আপু ব্ল্যাকহোল আশেপাশের সব তারা, হোক তা কোন গ্রহ, ধুমকেতু বা স্পেসক্রাফট মহাকর্ষীয় বল দিয়ে টেনে নিয়ে যায়।জানো প্রত্যেক ব্ল্যাকহোলের চারদিকে একটি সীমা আছে যেখানে একবার ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। নাজরীন এসব কথা কেন আমাকে বলছে জানি না। আমি শুনছি আর মাঝে হ্যাঁ, হু বলছি।

আপু কাল রাতে আমি অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমাদের এই দেশের প্রায় প্রতিটা জেলায় ছোট ছোট ব্ল্যাকহোলের সৃষ্টি হয়েছে। দুর্বার গতিতে সে টেনে নিচ্ছে মানুষকে।তবে সব মানুষকে নয়; যাদের অন্তর কলুষিত, যারা অন্যায় করে হাসিমুখে, যারা ধর্ষণ করে মেয়েদেরকে,যারা বিনা কারণে অন্যের হক কেড়ে নেয়,এতিমের সম্পদ ভোগ করে আরো অনেক কিছু। আপু সেই ব্ল্যাক হোলের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। সেখানে দেখতে পাচ্ছি,আমার বাবা, আমার চাচাও চলে যাচ্ছে। হাত দিয়ে ইশারা করছে আর চিৎকার করে বলছে বাঁচাও, বাঁচাও! আমি চাচাকে না আর বাবাকেও না -কারোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিইনি। আমার বাবা কখনো আমাদেরকে বাবার মত আদর করেননি।মা'কে ভালোবাসেননি।

সারাটা জীবন শুধু টাকার নেশায় ছুটেছেন আর বাহিরে মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করেছেন।আর চাচা সে তো আমাকে শেষ করে দিল।আমি আর বাঁচতে চাই না আপু। চাচা আমার সাথে চরম অন্যায় করেছেন। মধ্য বয়স্ক লোকটার আতরের গন্ধ আমার নাকে আসছে। অসহ্য লাগছে সবকিছু। আমি বুঝলাম নাজরীনের সাথে খারাপ কিছু ঘটেছে কিন্তু এ মুহুর্তে আমার মন সাঁয় দিচ্ছে না।যেভাবে হোক এখান থেকে বের হতে হবে।আমি নাজরীনকে বললাম আমি আজ চলে যাই। তুমি বিশ্রাম নাও। নাজরীন হাসল কিন্তু চোখ খুলল না। আমার হাত চেপে ধরে বলল চিরদিনের মত বিশ্রাম নেব আমি তবে তার আগে চাচা আর বাবাকে ব্ল্যাক হোলে ফেলে দেব আমি।নাজরীন প্রলাপ বকেই চলেছে।আমি ওর আম্মুকে ফোন করলাম যেন দ্রুত বাসায় আসে।
আশেপাশে তেমন কোন হাসপাতাল আমি চিনি না তবে বুঝতে পারছি নাজরীনকে ডাক্তারের কাছে নেয়া প্রয়োজন।

বসে আছি হাসপাতালে।নাজরীনের মা কাঁদছে।আমি উনার হাতদুটো ধরে রেখেছি।সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। নাজরীন নেই আর। তিনমাসের গর্ভবতী ছিল, একসাথে অনেকগুলো স্লিপিং পিল খেয়েছিল।নিজেকে নিরাপদ লাগছিল এই ভেবে ভাগ্যিস আমি মেয়ে শিক্ষক ছিলাম তা না হলে নাজরীনের সমস্ত দায়ভার আমার উপর এসে পড়ত! ওখান থেকে চলে আসব ঠিক এমন সময়ে বাড়ি থেকে ফোন এল। রিনিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে কে বা কারা যেন ওর সর্বনাশ করে আখ ক্ষেতে ফেলে গেছে। নিজেকে সামলাতে পারছি না।মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটা এক সাথে দুলে উঠেছে। এখনি মাথা ঘুরে পড়ে যাব। চোখের সামনে নাজরীনের স্বপ্নটা ভাসছে।মনে হচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে হাজার হাজার,লাখ লাখ ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি হোক যেখানে পাপীরা পাপ করার সাথে সাথেই ব্ল্যাকহোলে চলে যাবে।
হারিয়ে যাবে নিঃসীম অন্ধকারে। পৃথিবীর উপরে হেঁটে বেড়াবে শুধু পরিশুদ্ধ মানুষ!
©রুবাইদা গুলশান

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.