নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রিয় কুমু,
জানো, আশরাফুল আলম পলিন নামে আমার একটা বন্ধু ছিল।পলিনটা ২০২১ সালের জানুয়ারী মাসে মারা যায়। ওর সাথে আমার শেষ দেখা ২০২০ সালের আগষ্ট মাসে,কোরবানীর ঈদে।ও মারা যাওয়ার পর আমাদের ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের সাথে একত্রে আর ইফতার করা হয় নি।শেষ ইফতার করেছিলাম আমি ,পলিন, আকিব আর বিকাশ দা টিএসসির ভিতরে বসে।
পলিন ছিল আমাদের ক্লাসের সিআর।ক্লাস রুমের বাইরে ও নিজের উদ্যোগেই সিআরের সব কাজ করতো।ট্যুর থেকে শুরু করে একটা মদের আড্ডা।কে কই ইন্টার্নী করছে এই খবর থেকে শুরু করে ক্লাসের কার গোপন প্রেম করা সাথে চলে এ খবর পর্যন্ত।
পলিনের সাথে আমার পরিচয় মাস্টার্সের ক্লাসে।প্রথম দিনেই।ও আমার পেছনের বেঞ্চে বসেছিল।যে বয়সে পলিনের সাথে আমার পরিচয় সে বয়সে লোকে চোখের বালি উপন্যাসের আশালতা হয়ে বিনোদিনীর সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে সারাক্ষণ মুগ্ধ হয়ে 'ভাই বালি' বলে সম্বোধন করে না ।ততোদিন সবার শরীরে জুড়ে,মন জুড়ে যাপিত জীবনের কালচে দাগ,এই বয়সে সবাই নতুন করে বুঝতে শিখেছে যে কেউ কারো নয়,মানুষ মোটের উপর স্বার্থপর।তাই প্রয়োজন ছাড়া নির্মল আনন্দের জন্যে ,নির্ভেজাল আড্ডা দেয়ার জন্যে বন্ধুত্ব করা সময় কই মানুষের?
আর বিশেষ করে আমার মতন যারা ঢাকা শহরের লোকাল, তাদের এমনিতেই এত্তো বন্ধু ছিলো যে চাইলেও নতুন বন্ধুত্ব পাতানো বেশ শক্ত।এতো কিছুর পরের মাস্টার্সে আমাদের খুব ভালো একটা গ্রুপ হয়েছিল।পলিনের সাথে আমার খুব ভালো একটা বন্ধুত্ব হয়েছিল।পলিন আমার রোল ছিল আগে-পরে।তাই আমাদের পরীক্ষার সীটও পড়তো পাশাপাশি।এমনিতেও ক্লাশ রুমে আমরা এক সাথে বসতাম।
আমাদের মধ্যে অনেকগুলো মিলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে মিল, তা হলো আমরা দু জনই মদ খেতে খুব ভালো বাসতাম।ইভেন ওর সাথে যে আমার শেষ দেখাটা হলো সেটাও এক মদের আসরেই।রামপুরা ওর এক বন্ধুর ছাদে সন্ধ্যেবেলা জ্যাক ডেনিয়াল নামে এক বিদেশি মদ খেতে বসেছিলাম।কোরবানী ঈদের ২য় দিন।তখন ও করোনা আমাদের কে পুরোদমে চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে।লক ডাউন চলছে।মদের লোভে অনেকটা বিপ্লবী বেশেই পলিনের ডাকে সাড়া দিয়ে মদ গিলতে চলে যাই।এমনিতেও বিশিষ্ট মদ সেবক হিসাবে বন্ধু মহলে আমার একটা বিশেষ পরিচিত ছিল।সেই সুনাম ,সেই পরিচিতি ধরে রাখার জন্যে হলেও আমায় মদের আতিথেয়তা গ্রহন করতে হতো।এই নেমন্তন্ন বিকাশ দাও পেয়েছিল।উনি কি কারণে যে যান নি সেটা এখন মনে ,খুব সম্ভবত সোশ্যাল ডেসটেন্সিং এর জন্য।আমি একলাই গিয়েছিলাম মতিঝিলের এজিবি কলোনীতে।পলিন সেখানেই থাকতো।কলোনির মাঠে আগে বহু বার বসে বন্ধুরা মদ খেয়েছি বিশেষ করে আমি আর বিকাশ দা।কিন্তু সে দিন চলে গেলাম রামপুরা ওর এক বন্ধুর বাড়ির ছাদে।পানাহার শেষ ও আমায় রিক্সায় তুলে দিয়ে বলেছিল,সাবধানে যাইস।এটাই খুব সম্ভবত ওর সাথে আমার শেষ কথা।
সরি,আসলে যে কথা বলছিলাম।হ্যাঁ সব কিছু তো আমাদের মিলতো না।যে বয়সে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে সে বয়স খুব মিল থাকার কথাও না।আমাদের মধ্যে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ মিল ছিল - আমরা দুজনেই একই ব্যাচের এর চেয়ে বড়ো কথা দুজনেই ছিলাম ক্লেদহীন টেনশনহীন বেকার।আমরা কেউই বেকার জীবন নিয়ে হাহুতাশ করতাম না।পলিন এটলিস্ট আমাদের সামনে করতো না।
আমি, পলিন, বিকাশ দা, সজীব, তুহিন, পাখি সব এক সাথে থাকতাম।মিনজাহ একটা সময় পর চলে গিয়েছে সেখানে তন্ময় এসেছে।তবে সবার বাড়িই দূরে দূরে থাকার কারণে আমার, বিকাশ দা, আর পলিনের বন্ধুত্বটা;এক সাথে আড্ডা দেয়ার ব্যাপারটা ছিল চোখে পড়ার মত।বিশেষ করে আমার আর বিকাশ দা টা লোকের চোখে বেশী পড়তো।হয়তো বন্ধুত্বটা অসম বয়সী বলে।
তবে পলিনের সাথেও কিন্তু ক্যাম্পাসে নেহাতই কম সময় কাটাই নি ।কারণ বিকাশ দা সংসার আছে,বউ বাচ্চা রয়েছে।আমাদের মতন চায়ের দোকানে বসে তো আর দিন কাটবে না।এ ছাড়াও তিনি একটা এনজিও'র ডিরেক্টর পদে আছেন।আমার আর পলিনের মতো বেকার না।
ক্লাসের অন্য ছেলেদের সাথে যে আমার খাতির ছিল না এমন তো নয়,তবুও পলিনের সাথেই সব করতাম এক জোট হয়ে।এদিকে পলিনের আরো বেশী সু্যোগ ছিল অন্যদের সাথে মেশার কারণ ও ছিল সিআর সবাই ওকে তোয়াজ করবে সেটাই স্বাভাবিক।আমরা মাস্টার্সের শেষ সেমিস্টারে টার্ম পেপার করেছিলাম এক টপিকে, এক প্রতিষ্ঠান থেকে।ও হ্যাঁ, পাখিও আমাদের সাথে এক প্রতিষ্ঠান থেকে ইন্টার্নী করেছিল।
এক রকম জামা পড়বো,এক সাথে সব করবো সেই সব গ্যাদগ্যাদে আবেগের বয়েস তো আমরা পার করে এসেছিলাম ,তবু ও প্রকাশ্যে কিংবা প্রচ্ছন্ন ভাবে আমরা এক সাথে সব করতে চাইতাম।পলিন কতোটা চাই তো জানি না ,তবে আমি খুব করে চাইতাম।এমন কি আমি আর পলিন তো এই স্বপ্ন ও দেখতাম যে আমাদের দুজন কে এক সাথে বিকাশ দা চাকরী দিয়েছে।রোজ সেই কামলা দিয়ে আমরা মদ খেতে যাবো।
পলিন কিন্তু একটা চাকরী নিয়েছিল।মরার আগ পর্যন্ত ও সেই চাকরীটাই করতো।আমি ই কোনো কাজে ঢুকি নি।আমি একাডেমিয়াতে থাকতে চেয়েছিলাম,যদিও সেই যোগ্যতা আমার কোনো কালেই ছিল না।তারপরেও একটা সময় তো খুব মনে হয়েছিল পরীক্ষার বেঞ্চে,মদের টেবিলে যদি এক সাথে বসা যায় তবে অফিসের ডেস্ক কেন এক হবে না?
তখন তো বোকা ছিলাম না,না ছিলাম বাচ্চা ।তাও এমন করে কেন ভাবতাম।
মানুষ সব সময় কাউকে না কাউকে আঁকড়ে রাখতে চায়।কেন চায়?কারণ মানুষ আদতে খুব ভীতু।মানুষ একা থাকতে ভয় পায়। সব কিছুতেই সে সহায় খুঁজে।আমি কি নতুন করে একা হয়েছিলাম?মোটেই তা নয়।সবার মত তো আমি একা ই ছিলাম।সে কথা বাদ দিলেও অনেক বন্ধুই তো আমার ছিল।ছোটোবেলার সব বন্ধুরাও ছিল।তবুও এই বুড়ো বয়সে এসে কেন পলিনের সাথে ভিরতাম?খুব সম্ভবত পলিন জাজমেন্টাল ছিল না বলে।কখনো মোর্যাল পুলিশিং করে নি বলে।আমাদের যে খুব বেশী কথা হতো এমন কি নয়।সব সময় যে এক বেঞ্চে বসতাম তাও নয়।
কিন্তু সব সময় আমাদের আশেপাশে থাকার একটা প্রবণতা ছিল।স্বাচ্ছন্দ্য কাজ করতো।মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর আমাদের খুব একটা দেখা হয় নি।কথা ও নিয়মিত হতো না।তবুও অবলম্বনের মানসিকতা টা রয়ে গিয়েছিল।আমাদের মাঝে কোনো প্রকারের ফর্মালিটি ছিল না।
২৬ মাস পার হয়েছে পলিনের মারা যাওয়ার।পলিন মরার পর দিনই সিদ্ধান্ত নেই পলিন কে নিয়ে বিশেষ কিছু লেখবো না।কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম?অভিমানে?শোকে?মনে হয় না।কিংবা ওকে নিয়ে লেখে সবটা উগড়ে দিতে,বমি করে দিতে চাইছিলাম না।লেখালেখি তো এক প্রকার বমি করা ই।আরো একটা কারণ হতে পারে শব্দ গুছাতে না পারা।কিন্তু এই ওকে নিয়ে না লেখার পেছনে এতো জাস্টিফিকেশন দিচ্ছি এগুলো কি আসলে কাকে দিচ্ছি? কেন দিচ্ছি?
এই যে, ওকে নিয়ে যে লেখছি না সাথে এগুলো হারিয়ে যাবে না?উধাও হয়ে যাবে না?বাতাসে ছাই হয়ে কিংবা মাটিতে ধুলো হয়ে?আবার সাথে সাথে ই ভাবি লেখলেই বা কি ,কে পড়বে আমাদের সেসব অবাধ্য ঘোর লাগা চোখের দাস্তান।আর পড়লেই বা কি ?এতে পলিনের কি হবে?আমার কি হবে?মাঝে মাঝে কাউকে স্মৃতিতে বাচিয়ে রাখার কনসেপ্টটা আমার কাছে বড়ো গোলমেলে লাগে।আসলে কি আমরা স্মৃতিতে চলে যাওয়া মানুষটা কে বাঁচিয়ে রাখি, না উল্টো চলে যাওয়া মানুষটার স্মৃতিতে আমরা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখি?
ইতি -
বিভ্রান্ত জাদুকর নাকি শুদ্ধ কেউ?
পুনশ্চ ১-
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই রবীন্দ্রনাথ কে একটা লেখা পড়লাম।দুঃখ কাকে বলে বলে রবীন্দ্রনাথ সব ই তার এক জীবনে পেয়েছে।কিভাবে যেন তিনি সেই শোকের হিলিং খুঁজে পেতেন।এতো সব মৃত্যু নিয়ে সয়েছিলেন কি করে?
পুনশ্চ ২-
কাল রাতে ঋতুপর্ণ ঘোষের এক সাক্ষাৎকার শুনতে শুনতে ঘুময়ে পড়েছিলাম।সেখানে তিনি তার মায়ের মৃত্যু নিয়ে কথা বলছিলেন।তিনি বলেন এই যে মায়ের চলে যাওয়া টা,এটার শোক কষ্ট টা সো মাচ পিওর।আমি আগে কখনো এই ব্যথার সম্মখীন হই নি।এখন বুঝি,আগে যতো ব্যথা পেয়েছি সব ই ছিল রাগ অভিমান ক্ষোভ বা অন্য কোনো না পাওয়া থেকে।বাট এই মায়ের চলে যাওয়ার কষ্ট টা সো মাচ পিওর।
পুনশ্চ ৩-
কিছু মনে করো না কুমু চিঠিটা হয়তো বেশী বড়ো হয়ে গেলো।তাও একটা মরা মানুষ নিয়ে।অপরাজিত উপন্যাসে অপর্ণা যখন মারা যায় অপু দিন রাত এক করে ভাবতো,একটা মানুষ মরে গেলে কই যায়?এতো ভালোবাসা,এতো আদর,এতো সম্পর্ক ,সব কথা শূন্যে হারিয়ে যায়? কোথাও কোন সদুত্তর অপু পায় না।হয়তো বিভূতিভূষণও পায় না।তাই হয়তো অপরাজিত'র মতন উপন্যাস লেখার ১২ বছর পরে ও কোন এক দূর্দমনীয় আকর্ষণ থেকে মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে দেবযানের উপন্যাস লেখতে হলো।ভালো কথা, খেয়াল করেছো কি না জানি না একটা সময় পর হূমায়ন আহমদের লেখাতেও কিন্তু মৃত্যুচিন্তা,মরার পরে মানুষের কি হয় এসব কথা উঠে এসেছে।তারা যতো ই ভাবুক ,যতোই লেখুক খুব একটা কূল কিনারা করতে পেরেছিল বলে আমার মনে হয় না। আসলে এর উত্তর কখনো কারে কাছে থাকে না।উত্তর থাকে না বলেই জীবনের এতো আয়োজন।এতো লড়াই।খেয়াল আছে যে দিন আমাদের শেষ কথা হলো ,সে দিন বলেছিলে আমি মরে গেলেও তোমার কিছু যায় আসে না!
২| ০২ রা এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ১:৫৯
নির্বাক স্বপ্ন বলেছেন: সাড়ে পাঁচ বছর বাদে আবার ব্লগ লেখলাম।ভাই আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় নিয়ে লেখাটা পড়ার জন্যে।
©somewhere in net ltd.
১| ০২ রা এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ১:৩৬
রাজীব নুর বলেছেন: সহজ সরল সুন্দর চিঠি। ভাষা সুন্দর।
পুরো চিঠি জুড়ে একটা হাহাকার ছিলো। একটা না পাওয়া ছিলো।