![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এক
আজ শহীদ পীরেন স্নাল - এর ১৭তম হত্যা বার্ষিকী।
ফেইসবুকে অনেকের লেখা পড়লাম। কেউ কেউ 'ইকো - পার্ক" বিরোধী লড়াই - সংগ্রাম - আন্দোলন কে ২০০১, ২০০২, ২০০৩ সালের ঘটনা হিসেবে তাঁদের লেখায় উল্লেখ করেছেন যা সঠিক নয়।
ভিডিও দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন। লাইক, শেয়ার এবং কমেন্ট করুন
ইকো-পার্কের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ! ১৯৬২ সালে পাকি সরকার আবিমা থেকে গারো আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে জাতীয় উদ্যান করার উদ্যোগ গ্রহণ করলে আবিমা'র (হা'বিমা মধুপুরের) গারো আদিবাসীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। স্বর্গীয় পরেশ চন্দ্র মৃঃ এর নেতৃত্বে গারোরা সংগঠিত হয়ে "জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ" গড়ে তুলেন। খেয়াল করবেন পুরো বাংলাদেশের আদিবাসীরা সরকারের দেয়া 'উপজাতি" শব্দ টা মেনে নিলেও আবিমার গারো কখনও মেনে নেন নি। তখন অনেক মামলা, হামলা হয়। দুর্বার আন্দোলনে সরকার পিছু হটে। আবিমার গারো আদিবাসীরা ভালোবেসে তাঁদের নেতা শ্রী পরেশ চন্দ্র মৃঃ কে "গারো রাজা" উপাধি দেন। সেই থেকে আমরা তাঁকে গারো রাজা বলেই সম্বোধন করি।
আমাদের মনে রাখতে হবে এই লড়াই সংগ্রাম এর শুরুতে যারা ছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই, অনেকেই আজও বেঁচে আছেন।
স্বর্গীয় গারো রাজা পরেশ চন্দ্র মৃঃ, স্বর্গীয় মাইকেল মিজেন সিমসাং, পনেশ মাস্টার (নকরেক), যেরুম মাস্টার (হাগিদক), স্বর্গীয় জাসেন মাস্টার (নকরেক), অজয় এ মৃঃ, অধ্যাপক সমরেন্দ্র রিছিল, স্বর্গীয় সন্তোষ ম্রং, মাইকেল নকরেক, মাস্টার নেরে নরবারট দালবত, পঞ্চরাজ ঘাগরা, মালতী নকরেক, জসিন্তা নকরেক, মিরনী হাগিদক, আলবার্ট মানখিন সহ আরও অনেক শ্রদ্ধাভাজন মানুষের প্রায় দীর্ঘ ৫ যুগের জীবন দিয়ে সংগ্রামের ইতিহাস যেন আমরা ভুলে না যাই।
সব সরকারের আমলেই বিভিন্ন নামে এই "ইকো - পার্ক" সব সরকারই বাস্তবায়নের অপচেষ্টা করেছে, সব সরকারই কম বেশি আমাদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছে। আমরা আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছি লড়াই সংগ্রাম করেই। লড়াই - সংগ্রাম চালিয়ে টিকে থাকতে হবে।
দুই
১৯৭২-৭৩ সাল। সদ্য স্বাধীন দেশ। বন চলে যায় বন বিভাগের হাতে। জাতীয় উদ্যান করার পায়তারা এবার নতুন করে। গারো আদিবাসীদের মধ্যে নতুন করে উচ্ছেদ আতঙ্ক দেখা দেয়। আবারও জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের নেতৃত্বে লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু আবিমায় আসেন। গারো রাজা পরেশ চন্দ্র মৃঃ গারো আদিবাসীদের আকুতি জানাতে গিয়ে বলেন, "আমরা বনের সন্তান, বনেই আমাদের জম্ম। আমরা বন্য জীবনে এত অভ্যস্ত যে এখান থেকে উচ্ছেদ করলে আমরা বাঁচতে পারব না।"
বঙ্গ বন্ধু তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং কথা দেন, "বন থাকবে, আদিবাসীরাও থাকবে। এখান থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হবে না।"
তিন
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ খুন হন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। ক্ষমতায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭৬-৭৭ সাল আবারও গারোদের উচ্ছেদ করার নীল নক্সা চলে। আবারও জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের নেতৃত্ব লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলন।
জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধুর মত ঘোষণা দিলেন, "বন থাকবে, আদিবাসীরাও থাকবে, গারো আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে জাতীয় উদ্যান হবে না।"
চার
জেনারেল জিয়া খুন হলেন। ক্ষমতায় এবার স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ। তিনি ক্ষমতায় এসেই আবার "জাতীয় উদ্যান" প্রকল্প বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিলেন। কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে তিনি ফায়ারিং রেঞ্জ করার নামে গায়রা, জলই, টেলকি, নয়াপাড়া, রাজবাড়ি, গেটচুয়া গারো গ্রাম উচ্ছেদ করার উদ্যোগ নিলেন। আন্দোলনে সব গ্রাম রেহাই পেলেও নয়াপাড়া গ্রাম রেহাই পেল না।
ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা থাকলেও গারোরা কোন ক্ষতিপূরণ পায় নি। ২-১ টি পরিবার ৪-৫ হাজার পেয়েছে বলে জেনেছি। পুরো বিষয় টা নিয়ে ১৯৯৬-৯৭ সালে (সাল ঠিক মনে নেই) আজিয়ার আদুরী'তে আমি লিখেছিলাম "মাননীয় প্রধান মন্ত্রী - ঘুম নেই আবিমায়"। এবং লেখাটি প্রাইম মিনিস্টারের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছিলাম।
জেনারেল এরশাদ আরেক টি কাজ করেছিলেন। তিনি গ্যাজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ১৯৮২সালে ( সম্ভবত, ১৯৮৪ সাল ও হতে পারে!) আবিমার সকল জমি খাস ঘোষণা করেন। সেই থেকে মান্দিরা জমির অধিকার হারান। তখন থেকে বন বিভাগ দাবী করছে মধুপুরের বন, সকল জমি বন বিভাগের!
পাঁচ
এরশাদ সরকারের পতন হয়। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেই আবার গারোদের বন থেকে উচ্ছেদের পায়তারা করে। সামাজিক বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন কেটে, উজার করে বন ধবংস করে। হাজার হাজার মথ্যে মামলা হয় নিরীহ আদিবাসীদের নামে। উচ্ছেদ নোটিশ আসে।
এরই মধ্যেই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী সরকারের আমলেও সামাজিক বনায়নের নামে বন ধবংস যজ্ঞ চলে। এই সরকারের আমলেই এই "ইকো - ট্যুরিজম প্রকল্প" - এর পরিকল্পনা হয়। তখন জয়েনশাহী উন্নয়ন পরিষদ সক্রিয় ছিল না। আবিমা'কে বদলে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়েই আমরা বেশ কিছু বন্ধু মিলে ১৯৯৬ সালে আবিমা গারো ইয়ূথ এসোসিয়েশন (আজিয়া) গড়ে তুলি। এর পেছনে এই "ইকো - ট্যুরিজম প্রকল্প" টাও আজিয়ার জম্মের কারণে কাজ করেছে। কারণ ঐ সময় ফাঃ হোমরিক সিএসসি আমাদের প্রায়ই বলতেন, "আবার ন্যাশনাল পার্ক নিয়ে সরকার কাজ করতেছে। তোমাদের আবার লড়াই করতে হবে!" আজিয়ার উদ্যোগে আমরা "জয়েনশাহী উন্নয়ন পরিষদ" সক্রিয় করার জন্য আদিবাসী নেতা অজয় এ মৃঃ এর কাজে আমি আর প্রশান্ত চিরান প্রস্তাব নিয়ে যাই। অবশ্য আরও বেশ কয়েক বছর আগেই আমরা তাঁর সাথে কয়েকবার বসি তাঁর ২৫ মাইলের লাইব্রেরীতে। তিনি আমাদের দায়িত্ব নিতে বলেন। আমরা তাঁকে অনুরোধ করি তিনি যেন আরও ৫-১০ বছর দায়িত্বে থেকে আমাদের সিনিয়র নেতাদের কাছে থেকে শেখার সুযোগ দেন। তিনি রাজি হন। জয়েনশাহী উন্নয়ন পরিষদ সক্রিয় হয়ে উঠে। আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়, "জয়েনশাহী উন্নয়ন পরিষদ" "যুব পরিষদ" একটা উইং আছে, আমরা যেন সেখানে সম্পৃক্ত হই। আমরা সম্মত হই, কিন্তু পাশাপাশি "আজিয়া" সংগঠন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগি হই।
যেহেতু প্রকল্প টা ইংরেজিতে ছিল। আমরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে মান্দিদের বুঝাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। মিটিং গুলোতেও প্রকল্প সম্পর্কে উলটা - পালটা ব্যাখ্যা হচ্ছিল। প্রকল্প হলে মান্দিদের জন্য ভালও হতে পারে - এমন কথাও নেতাদের মধ্যেই কেউ কেউ বলতে শুরু করছিল। আজিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব প্রশান্ত চিরান আমাকে বলল, প্রকল্প টা বাংলায় অনুবাদ করা যায় কি না?
তাই আমরা আজিয়ার উদ্যোগে "ইকো - ট্যুরিজম প্রকল্প" এর ইংরেজি প্রজেক্ট প্রপোজাল এর বাংলা অনুবাদ আমি, বুয়েট এর খন্ডকালীন শিক্ষক আমার বন্ধু পলাশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সোমা দে করি। আসলে প্রথম কয়েক প্যারা তাঁরা অনুবাদ করেন এবং বাকী টা আমি অনুবাদ করি। "ইকো - ট্যুরিজম প্রকল্প" এর বাংলা আমি "ইকো-পার্ক" লিখি কারণ প্রজেক্ট এর ভেতরে পার্ক শব্দ টা অনেক বার ছিল!
বাংলা অনুবাদ টা গাসু তাঁদের সালনামে আমার নামে ছাপে। আমার কাছে মনে হল - এটা ছিল আন্দোলনের জন্য টারনিং পয়েন্ট। কারণ বাংলা অনুবাদ টা সবাই পড়তে পারছিল। আমাদের আর আগের মত এত বুঝতে হচ্ছিল না।
ছয়
আজিয়া সকল সংগঠনকে সমন্বয় করে একটা মিটিং ডাকে। তার আগে গাসু, বাগাছাস আর আজিয়া এক টা ঐক্য সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। পরবর্তীতে সেটি জয়েনশাহী আদিবাসীকে নিয়ে "আদিবাসী সংগ্রাম ঐক্য পরিষদ" গঠন করা হয়। সেখানে আদিবাসী নেতা অজয় এ মৃঃ সভাপতি, আমি সাধারণ সম্পাদক, বীর চলেশ রিছিল সহ - সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
২০০০ সাল। আমি মধুপুর কলেজে যোগদান করি। এর মধ্যে আমাদের আন্দোলনে কিছু টা গতি পায়। ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন (জলছত্র হাসপাতাল) পরিদর্শনে আসেন বেলজিয়াম দেশের রাষ্ট্রদূত। আমরা মানব বন্ধন করে রাষ্ট্রদূতকে কালো পতাকা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিই। আমরা তার আগের রাতে বিদ্যুৎ মাংসাং এর বাসায় সারারাত পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার লিখি। যেহেতু প্রশান্ত চিরান ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন এর সেক্রেটারি হিসেবে চাকুরী করত, তাই তার পক্ষে মানব বন্ধনে থাকা সম্ভব ছিল না। আর প্রশাসন জেনে গিয়েছিল এমন কিছু হবে [আমাদের মধ্যেই দালাল কেউ ছিল যে আগেই আমাদের পরিকল্পনা সব ফাঁস করে দিত!] আমার কলেজ আমাকে সকালে ডেকে পাঠায়। তাই আমরা কৌশল পরিবর্তন করে মানব বন্ধনে মেয়েদের রাখি যেন মিডিয়া কাভারেজ টা পাই আর রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি।
কারিতাস সিল্ক এর সামনে মানব বন্ধন হয় রেখা নকরেক এর নেতৃত্বে। রাষ্ট্রদূত জানান, বেলজিয়াম কিংবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন 'ইকো - পার্কের' ফান্ড দিচ্ছে না, ফান্ড দিচ্ছে এডিবি!
আওয়ামী লীগ সরকার প্রকল্প নিয়ে আর আগায় নি। বেগম বদরুন্নেসা কলেজ এর প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল জাহানারা করিম ছিলেন মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর শিক্ষক। আমি অধ্যাপক জাহানারা করিমের শ্রুতলিপিকার ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার হাত ভেঙ্গে দেওয়া হলে তিনি লিখতে পারতেন না। পত্রিকায় তাঁর লেখা-লেখির কাজ উনি মুখে বলতেন আর আমি সেটি লিখে দিতাম। আমি তাঁকে অনুরোধ করে তাঁর ছাত্রী (প্রধান মন্ত্রীকে) ফোন করাই। আন্দোলনের কারণে ( ফোনের কারণেও হতে পারে) আওয়ামী লীগ ইকো - পার্ক থেকে সরে আসে।
সাত
এর মধ্যে আবার বি এন পি ক্ষমতায় আসে। ক্ষতায় আসার সাথে সাথেই বি এন পি "ইকো - পার্ক" বাস্তবায়নের জন্য মাঠে নামে। গিদিতা রেমা খুন হন। এর প্রতিবাদে মধুপুর হয় উত্তাল। আরও উত্তাল হয় ইকো - পার্ক আন্দোলন। আন্দোলন চাঙ্গা হলে সবাই পদ চান, পদবী চান। আমরা সিনিয়রদের পদ - পদবী ছেড়ে দিই।
বিএনপি মরিয়া হয় প্রকল্প বাস্তবায়নের। ২০০২ সাল। আমাকে তৎকালীন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ফোন করে আমাকে ধমকান, "আপনি সরকারের খান, সরকারের পড়েন আবার সরকারের বিরুদ্ধে লাগেন। আপনাকে হয় কলেজের চাকুরী করতে হবে, না হয় আন্দোলন ছাড়তে হবে!" তিনি কি পেলে আন্দোলন ছাড়ব আমরা সেটাও জানতে চেয়েছিলেন!
অবশ্য আমাদের নেতাদের ১০-১২ জন বেশ কিছু আর্থিক সুবিধা নিয়ে "ইকো - পার্ক" এবং সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ইকো - পার্ক মান্দিদের জন্য ভাল হবে বলে প্রচার প্রচারনা চালাতে শুরু করেন!
২০০৩ সাল। সরকার আমাদের সচিবালয়ে আমন্ত্রণ জানান ইকো - পার্ক নিয়ে কথা বলার জন্য। আমরা সরকারকে আহবান জানাই আবিমায় এসে আমাদের সাথে ডায়ালগ করার জন্য। আমাদের আহবানে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী দোখলাতে আসেন। তারিখ টা মনে নেই।
মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে বৈঠকে ৫ জনের প্রতিনিধি দল গারোদের নেতৃত্ব দেন অজয় এ মৃঃ, নিশারন থিওফিল নকরেক, বাবুল ডি' নকরেক, প্রবীণ চিরান [আরেক জনের নাম মনে নেই সম্ভবত মাস্টার নেরে দালবত]।
বৈঠকে মন্ত্রী মহোদয় আমাদের সাথে আলোচনায় পেরে উঠেন নি। ক্ষিপ্ত হন আমাদের উপর। আমরা ১৫ দফা শর্ত দেই যা সরকারের পক্ষে কোনদিন মানা সম্ভব ছিল না। মন্ত্রী তবুও কথা দেন সরকার সকল শর্ত পূরণ করেই 'ইকো - পার্ক' বাস্তবায়ন করবেন। প্রথম দাবী ছিল "গারোদের ভূমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত!" বাকী শর্ত মনে নেই!
পরের দিন মন্ত্রীর ইন্ধনে আমার বাসার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ১২ বছর আমরা ছিলাম বিদ্যুৎ বিহীন। কলেজ থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়। আমি পুরো এক মাস কলেজে পড়াতে যেতে পারি নি। এক মাস পর আমি পূনরায় কলেজে যোগ দিই। কিন্তু সরকার থেকে অব্যাহত চাপে রাখে আমাকে। "আন্দোলন অথবা কলেজের চাকুরী দুইটার একটা চাড়তে হবে।" আমি চাকুরী ছেড়ে দিই। আসলে আমি পদত্যাগে বাধ্য হই।
শান্তি নিকেতমে আজিয়ার মিটিং প্রায় ১৫০ জনের সমাবেশ! আমি বক্তৃতা শেষে বললাম, "নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় প্ররোয়জনে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে হতে। 'এখন যৌবন যার যুদ্ধের যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়।' তোমরা কে কে প্রয়োজনে জীবন দিতে প্রস্তুত?"
আমরা গুনছি ১২৬ টা হাত জীবন দিতে প্রস্তুত। সবার পেছনে দাঁড়ানো পীরেন স্নালও হাত তুলেছে। আমি ঘোষণা দিলাম, যে জাতিতে বন বাঁচানোর জন্য ১২৭ জন প্রস্তুত থাকে, সেখানে কস্মিঙ্কালেও ইকো - পার্ক, সিকো - পার্ক হবে না।
আজিয়ার বর্তমান আহবায়ক (সাবেক সিনিয়র সহ- সভাপতি) মিথুন হাগিদক মাস্টার দুশটামি করে আমাকে বলেন, "উস্তাদ, হুদাই আপনে পীরেনরে জোড় করে ডাইকা নিয়া হাত তুলায়া মাইরা ফেললেন!"
আমিও হাসি। দুষ্টুমিও করি। কিন্তু সে হাসিতে অনেক কান্না থাকে, শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া কষ্ট থাকে।
পীরেন স্নাল আমাদের গ্রামে আমার এক আচ্চুর বাড়িতে অনেক দিন গরু চড়িয়েছে। তার সাথে পরিচয় সে সূত্র ধরেই। পরবর্তীতে আমার দূর সম্পরকের খালাত বোনকে বিয়ে করে।
যখন জাডিল মৃ এর কাছে খোঁজ নিয়ে শুনি পীরেন স্নাল এর ছেলে-মেয়রা টাকার অভাবে আর পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারছে না, লজ্জাই মরে যাই! আমাদের শত শত নেতা, সংগঠন, বুদ্ধিজীবি যারা বড় বড় কথা বলেন, লিখেন, তাঁরা সেখানে নীরব। আমাদের কি দায়িত্ব নেই? একটু লজ্জাও নেই?
শুরুতে আমরা আজিয়া দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলাম। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম একটি সংগঠন তাঁদের দায়িত্ব নিয়েছে!
একদিন ওদের খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওরা দুই ভাই বোন ঢাকা চলে গেছে। ভাইটা মাছের আড়তে আর বোন টা বিউটি পার্লারে কাজ করছে!
আমি পীরেন স্নালের ছেলে - মেয়েদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। বন্ধুদের বলি, আমাদের জন্য এদের বাবা জীবন দিয়েছেন। তাঁদের বাবার রক্তের বিনিময়ে রক্ষা পায় আমাদের অস্তিত্ব। আমরা এদের দায়িত্ব নিতে পারি কি না? সবাই চুপ! আমি থ হয়ে যাই। কেউ সারা দেন নাই। একজন বন্ধু, ব্যাংকার, জুয়েল ভাই আমাকে লিখেন, "বাবুল দা, আপনি উদ্যোগ নেন, আমি আপনার সাথে আছি!" সেই থেকে আমরা দুই বন্ধু চেষ্টা করছি!
পীরেনের ছেলে মেয়েকে আমি সাত সমুদ্র তের নদীর ওপাড় থেকে বলি, "তোমাদের পড়াশুনা করে অনেক বড় হতে হবে, মানুষ হতে হবে! আমি তোমাদের মামা! দুই মা সমান এক মামা! আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন তোমরা যতদূর পড়াশোনা করতে চাও, আমি এবং আমার পরিবার তোমাদের পড়াব। তোমরা বাড়ি ফিরে আস।"
শহীদ পীরেন স্নালের মেয়ে রাত্রি নকরেক আমার অনুরোধে ঢাকা বিউটি পার্লার থেকে ফিরে আসে। কিন্তু উৎস নকরেক আমার ঘন ঘন ফোনে হয় তো বিরক্ত হয়ে তার ফোন টাই অফ করে রাখে!"
জলছত্র ছেলে হোস্টেল সুপার বিপুল রিছিল স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করেন, "কই আপনার না একজন ছেলে আসার কথা ছিল! সীট তো খালি রেখেছিলাম।" আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি, "আগামী ফাগুনে আমরা হব দ্বিগুণ।"
সবার প্রতি একটা অনুরোধ। লেখার সময় কেউ আমাদের প্রায় দীর্ঘ ৬০ বছরের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই - সংগ্রামকে ২০০১, ২০০২, ২০০৩ সালের একটা ঘটনা, একটা আন্দোলন বলে লিখে দিবেন না। দীর্ঘ ৬০ বছরের সংগ্রামে কত হাজার গারো হাজার হাজার মামলায় তাঁদের জমি, জীবন হারিয়েছে। কত মানুষ আমার মত চাকুরী কিংবা জীবিকা হারিয়েছে। কত শত যুবক তাঁর স্বপ্ন হারিয়েছে বন বিভাগের মিথ্যে মামলায় তার হিসেব নেই। মামলায় মামলায় অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে কত যুবক গ্রাম থেকে পালিয়ে গেছে শহরে। বীর চলেশ রিছিল এর মত কত শিরিন নকরেক, পনেশ নকরেক মাসের পর মাস, বছর জেল খেটেছেন। কত নিন্থনাথ, অধীর দফো, বিহেন নকরেক, নিবাস মৃঃ, চলেশ রিছিল, বাসন্তী মাংসাং প্রকাশ্যে খুন হয়ে গেছে --- তার হিসেব কেউ রাখে নি। রাষ্ট্রের কাছে আমাদের খুন হয়ে যাওয়া সংখ্যার মধ্যেই নেই!
আমি যখন প্রায় ১ মাস কলেজে পড়াতে যেতে পারি নি, ঐ সময় একটা কুকুরও আমার বাসাতে পা ফেলেনি, মানুষ তো অনেক দূরের কথা। বাস্তবতা এমন কঠিন। আপনার চাকুরী যখন থাকে না, তখন আপনার বন্ধু - স্বজন - নেতা - কর্মী কেউ পাশে থাকে না! অনেক মানুষ 'ইকো - পার্ক বিরোধী নেতা - কর্মীদের এড়িয়ে চলত এমনিতেই সরকারের, বি এন পি নেতা কর্মীদের ভয়ে!
আমার মত কত মানুষ বেঁচে থেকেও মরে গেছে এই লড়াই - সংগ্রামে তার হিসেব কে রাখবে?
তবুও কিছু মানুষ, কিছু সাংবাদিক, কিছু লেখক, কিছু রাজনীতিকদের কথা বলতেই হয় যারা আমাদের মধুপুরের আদিবাসীদের দুঃসময়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, বন্ধু হয়েছিলেন --- শ্রদ্ধাভাজন স্বর্গীয় এড প্রমোদ মানকিন এমপি, আদিবাসী নেতা সন্তু লারমা,সুভাষ সাংমা (জেংচাম), আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং, পংকজ ভট্টাচার্য, সাইদুর রহমান রিমন, কামনাশীষ শেখর, অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন, অধ্যাপক গোলাম ছামদানী, পিনাকী রয়, জুয়েল বিন জহির, পাভেল পার্থ, ফিলিপ গাইন, অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, ড কামাল হোসেন, বঙ্গ বীর কাদের সিদ্দিকী আরও অনেকেই।
৩ জানুয়ারি এলে সবাই আমরা শহীদদের প্রতি লাল সালাম জানিয়ে দায়িত্ব শেষ করি! আগুন ঝরা বক্তব্য দিয়ে মঞ্চ কাপিয়ে দায়িত্ব শেষ?
পীরেন স্নালের মেয়ের পড়াশুনার দায়িত্ব তো আমরা ২ বন্ধু আর আমার পরিবার নিলাম। তাঁর ছেলে উৎস নকরেক এর দায়িত্ব কি নিবেন কেউ?
পুনশ্চঃ সন তারিখ হয় তো ঠিক নেই। আমাদের জম্মের আগে থেকে যে দীর্ঘ লড়াই - সংগ্রাম, তার সাল, তারিখ মিলাতে না যাওয়াই ভাল। কাউকে ছোট কিংবা বড় করার জন্য লেখা হয় নি। Watch the video, like, comment and share