নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভাগ্যক্রমে আমি এই সুন্দর গ্রহের এক বাসিন্দা! তবে মাঝেমধ্যে নিজেকে এলিয়েন মনে হয়। তবে বুদ্ধিমান এলিয়েন না, কোন আজব গ্রহের বোকা এলিয়েন!
লেখক: Mohiuddin Muhammad
জনাব শেখ হাসিনা,
মাননীয় শব্দটি এতো নষ্ট হয়েছে যে, এটি আর কোনো উপলক্ষে ব্যবহার করি না। এ জন্য ‘জনাব’ সম্বোধন করলাম। আমি কিছু খোলা চিঠি লিখেছি। প্রথমটি আপনাকে। তিখোমিরোভ যেমন ভাবেন নি কখনো নিকোলাসকে চিঠি লিখতে হবে, আমিও তেমনি ভাবি নি কোনোদিন আপনার উদ্দেশ্যে কলম ধরতে হবে। ফ্রান্সের দুর্যোগে এমন চিঠি এডমুন্ড বার্ক লিখেছিলেন, বই আকারে, রিফ্লেকশন্স অন দি রেভুলিউশন নামে। রাজাদের সময় কোথায় বই পড়ার? ফলে উত্তর দিতে হয়েছিলো থমাস পেইনকে, দি রাইটস অভ ম্যান লিখে। নিকোলাস ও ষোড়শ লুইয়ের ভাগ্যে যা ঘটেছিলো, তা যেন আপনার ভাগ্যে না ঘটে, সে-কারণেই এ চিঠি।
১।
খালেদা জিয়া ও আপনি, দু’জনের শাসনই আমি দেখেছি। যদি বলা হয়, দুই আমলের প্রধান পার্থক্য কী— তাহলে বলবো, খালেদাযুগে মানুষ নৌকায় ভোট দিতে পারতো, কিন্তু হাসিনাযুগে নৌকায় ভোট দেওয়ার সুযোগও নেই। কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকার আপনি স্থগিত করেছেন। বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করে, বিপুল উৎসাহে যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলো, তাদের আস্থাকে এতো দ্রুত জুতোচাপা দেবেন, তা কেউ কল্পনা করে নি। বাংলাদেশের মানুষ একইসাথে কুটিল ও সরল, বুদ্ধিমান ও নির্বোধ। তারা অনেক কিছুই দেখেও না দেখার ভান করে। আপনি আদালতের নাকে বালিশ রেখে ঘোষণা দিলেন, তত্বাবধায়ক সরকার থাকবে না।
কিন্তু জনগণ, মিষ্টি আখের মতো জনগণ, বাঁকা ঝাল মরিচের মতো জনগণ ইন্দ্রিয়বলে জেনে গেলো, আদালতে স্থাপিত মহামান্যরা কার আলমারির পুতুল। স্নিফিং ডগের মতো তারা বুঝে নিলো— খায়রুল হক নন, রায়ে সই করেছেন আপনি। আপনার চোখটিপ ছাড়া গ্যাবল ও কলম, দুটিই শূণ্যে ঝুলে থাকে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও একটি ইম্পার্শিয়াল জুডিশিয়ারি বাংলাদেশ পেলো না, এটি দুঃখের। যে-বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আপনি মঞ্চে উঠেছিলেন, একটি ‘হুইল অভ সিস্টেম’ দাঁড় করানো অসম্ভব ছিলো না। মন্টেস্কুর ট্রাইপাট্রাইট ব্যবস্থা সহজেই নিশ্চিত করতে পারতেন। একটি টেকসই রাষ্ট্র কাঠামো, যেখানে নির্বাহী, সংসদ, ও বিচার— তিনটি বিভাগ আপন শক্তিতে স্বাধীনভাবে চলবে, এ মহৎ স্বপ্নের বাস্তবায়ন আওয়ামী লীগের হাতের মুঠোয় ছিলো।
২।
আপনার মন্ত্রীসভা ও এমপিদলের কার্যক্রম মাঝেমধ্যে দেখি। বিপুল হাসির ঝুলি নিয়ে তারা হাজির হন। যেন কোথাও, দূর গ্রহে, চলছে আধুনিক গোপাল ভাঁড় সম্মেলন। এ গ্রহ সৌরলোকের নয়, অন্যলোকের। চার্চিল ও রজার্স, এঁরাই আমার রাজনীতিক হাস্যরসের প্রধান উৎস ছিলো। তবে বুদ্ধিমুখর উইট সবসময় আরামদায়ক নয়। এ অভাব আপনার সাংসদেরা ঘুচিয়েছেন সফলভাবে। রজার্স বলতেন— “কৌতুক আবিষ্কারের প্রয়োজন নেই, সঠিকভাবে সরকারের কাজকর্ম বর্ণনা করাই যথেষ্ট। সরকারই কৌতুক।” মহামানবরা প্রায়ই অতীতে বসে ভবিষ্যতের ছবি আঁকেন। কথাটি কি তিনি আপনার মন্ত্রীসভার উদ্দেশ্যেই বলেছিলেন?
প্রতিভা, মেধা, ও কাম্পিটেন্স বলি দিয়ে ‘স্তুতিবাদ’ হয়ে উঠেছে মন্ত্রী হওয়ার প্রধান যোগ্যতা। একঝাঁক মৃত কাঠের গলায় ঝুলিয়েছেন মন্ত্রীত্বের মালা। তাদের কগনাটিভ ডিক্লাইন খুব চোখে পড়ে। যার যা কাজ নয়, সে ওই কাজ নিয়ে দায়িত্বপালনের অভিনয় করছে। এমন রাসপুতিনমন্ত্রী নিকোলাসের ছিলো, চার্লস ওয়ানের ছিলো, এবং বিস্ময়করভাবে— রাজা লুইয়েরও ছিলো! আপনার মন্ত্রীরা রাসপুতিন, ভিলিয়ার্স, ও নেকারের চেয়ে কম বিপজ্জনক নয়। ওরা নিজ নিজ রাজার জন্য যে-পরিণতি কুড়িয়ে এনেছিলো, সে-একই পরিণতি আপনার মন্ত্রীরা আপনার জন্য ডেকে আনছে।
আইন প্রণয়নের গুরুভার তুলে দিয়েছেন এমনসব মানুষদের হাতে, যারা এক হাজার বছর দরুদ শরীফ পাঠ করলেও একটি লেজিস্লেশন ড্রাফট করতে পারবে না। সঙ্গীতশিল্পী, অভিনেতা, পাগল, ভঙ্গিবিদ, খেলোয়াড়, কী নেই আপনার সংসদে?
৩।
স্মরণকালের সবচেয়ে রাষ্ট্রনাশী অপচয় ও দুর্নীতির অভিযোগ আপনার সরকারের বিরুদ্ধে। কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করে, টাকার মান কমেছে বঙ্গবন্ধুবাজ লুটপাটজীবীর কারণে। গরিব প্রবাসীরা যে-ডলার পাঠায়, সে-ডলার আপনার কর্মকর্তারা বিদেশে দু’হাত ভরে খরচ করেন। কেউ বাড়ি কেনেন, কেউ প্রমোদে যান, কেউ বা রাষ্ট্রীয় টাকায় হজ্বে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লটবহর নিয়ে আপনি জাতিসংঘে যান। রাষ্ট্রপতি নামক মহাভগবান, তিনি হেলথ চেকাপ করান সিঙ্গাপুরে। আর্বিট্রারি এরেস্ট, যখন-তখন তুলে নিয়ে যাওয়া, পীড়নমূলক আইন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, টর্চার আন্ডার কাস্টোডি, তাচ্ছিল্যপূর্ণ বক্তব্য, নকল দরদ, রঙিন দম্ভোক্তি, এসব মানুষ ভালো চোখে নেয় নি। ভয়ে হয়তো কেউ কিছু বলে নি, আপনার পুরো শাসনামলটিই ভয়ের জলবায়ু, কিন্তু মনের ভেতর পুষে রেখেছে রাগ। এখন যেকোনো উপলক্ষে এ রাগ উগড়ে দিচ্ছে। অ্যাট এভরি অপার্চুনিটি, দে আর ডিসচার্জিং দেয়ার অ্যাঙ্গার। ভেরি ভায়োলেন্টলি। বিয়েবাড়ির ফটকা পরিণত হয়েছে গ্রেনেডে। দুর্নীতি ও মূল্যস্ফীতি রোধে কোনো কার্যকর মেকানিজম গড়তে পারেন নি। সরকারপ্রধান হিশেবে পরিচয় দিয়েছেন শোচনীয় ব্যর্থতার। হাজার হাজার কোটি ডলার পাচার হয়ে গেছে। একটি নির্বোধ বানরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বানিয়ে রেখেছেন। লোকটির কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, আকাশ থেকে এইমাত্র একটি আহাম্মক মতিঝিলে পতিত হলো।
আপনি বাজারে যান না। না যাওয়ারই কথা। তবে গণভবনে রান্না হয় না, এমনটি মনে করি না। রান্নায় কী কী লাগে, তা আপনার অজানা নয়। সন্তানের জন্য খিচুড়ি রান্না করছেন, এমন ছবি আমরা দেখেছি। সরকারি কিচেনের খরচ দেশবাসী দেয় বলেই ভাবেন, দেশবাসীর রান্নার খরচও হয়তো ‘অন্যকোনো দেশবাসী’ দেয়। যদি একবার বাজার-সদাইয়ের বিলগুলোয় চোখ দুটি বুলাতেন, তাহলে বুঝতেন, এ দামে দেশবাসীর পক্ষে রান্নাঘর চালানো সম্ভব নয়। নিম্ন আয়ের মানুষ ফুড-রেশোনিং করছে। দ্রব্যমূল্যের প্রচণ্ড আঘাতে তারা খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনছে। নিকট অতীতে বাংলাদেশে এমনটি ঘটে নি। দ্রব্যমূল্য খুব সাংঘাতিক বিষয়। দেশে দেশে, রাজ্যে রাজ্যে এটি গণক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
৪।
আপনাকে কারা বুদ্ধিপরামর্শ দেয়, জানি না। বাট অ্যাকশন স্পিক্স দা মাইন্ড। পত্রিকাভিশনে যাদের মুখ দেখি, তাদের কাউকেই জ্ঞানী ও চক্ষুষ্মান মনে হয় নি। প্রত্যেককেই লেটার্ড ইডিয়ট মনে হয়েছে। ফেসবুকে ঢুকলেই নজরে পড়ে, জুনায়েদ আহমেদ পলক নামের একটি বেকুব আপনার মুখপাত্র। পররাষ্ট্রমন্ত্রীগুলো যেন ডিপ্লোম্যাটিক স্যামসন। এবং মুখ খুললে, আপনাকেও অবুদ্ধিমানই দেখায়। কিছু পাখি ডানা না মেললেই বেশি সুন্দর, কিছু মানুষ মুখ বন্ধ রাখলেই অধিক উপকারী। আপনার সংবাদ সম্মেলনগুলো হাস্যকর ও করুণ। কয়েকশো রঙমিস্ত্রী সেখানে দাওয়াত পায়। আঁকে স্তবের আল্পনা। গরিব ধার্মিক যে-কায়দায় ঈশ্বরের প্রশংসা করে, সে-কায়দায় প্রশ্নকারীরাও আপনার তসবীহ জপতে থাকে। আপনি উপভোগ করেন, কিন্তু আমরা বিরক্ত হই। দেশবাসী বিরক্ত হয়। পেশাদার সাংবাদিকতার রূপ আপনি জানেন না, এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। তারপরও বছরের পর বছর, সংবাদ সম্মেলনের নামে এ ধরনের কৃত্রিম এবাদতের আয়োজন করছেন। সাংবাদিকরাও দু’হাত ভরে সুবিধা লুটছেন। কেউ এক টন, কেউ দুই টন। প্রধানমন্ত্রীত্ব ও সাংবাদিকতা, দুটিরই বিশ্বাসযোগ্যতা লম্বাকালের জন্য নষ্ট হয়ে গেছে। আপনার কন্ঠ ও ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপুল হাস্যরসের বস্তু। আপনি কাঁদলেও মানুষ হাসে। হাসলেও হাসে। ভাবে, সবই অভিনয়।
ব্যর্থ ও ক্ষতিকর দীপু মনিরা আপনার আস্থাভাজন। মোস্তাফা জব্বার নামক একটি বিজ্ঞানী, খুবই নামকরা বিজ্ঞানী, সম্ভবত শ্রেষ্ঠ, মহাবিশ্বের, সে আরেকবার মন্ত্রী হওয়ার আশায় ফেসবুকে মানুষকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। লিখেছে: “নিয়মিত শুদ্ধি অভিযান চলছে। মন্তব্য করার সময় সতর্ক থাকুন। ডিজিটাল দুনিয়ায় আমি সহজেই শনাক্ত করতে পারি।”
আহাম্মক দিয়ে কোনো কাজই ঠিকমতো হয় না। ভালো মানের হুমকি দিতেও ভালো মানের বুদ্ধি দরকার। বিজ্ঞানীটির কাজকারবার নিয়ে মানুষ বিস্তর কৌতুকে মেতেছে। বুদ্ধিমান প্রাজ্ঞজনের চেয়ে এ ধরনের বনবিড়াল আপনার অধিক পছন্দ, এমনটি দীর্ঘদিন ধরেই খেয়াল করছি। উপযুক্ত যোগ্যতার উপযুক্ত ব্যক্তি আপনার চাওয়া নয়। আপনারা চাওয়া হলো, কেউ স্তুতিগান ঠিকমতো করে কি না, তা। কোনো আধুনিক রাষ্ট্র এভাবে বাঁচতে পারে না।
সম্প্রতি শামসুদ্দিন মানিক নামের আরেকটি সূর্য উদয় হয়েছে। টেলিভিশনে আপনার পক্ষে খুব আলো ছড়াচ্ছে। লোকটি বিচারপতি ছিলো, এমন তথ্য বিস্ময়কর। তার মানসিক অবস্থা ও ইন্টেলেকচুয়াল হাইট দেখে মনে হয়, যাত্রীর সাথে ভাড়া নিয়ে ঝগড়া করা কোনো পেশাদার রিকশাওয়ালা। আওয়ামী লীগ বুদ্ধিজীবী সংকটে ভুগছে, এটি টের পাচ্ছি। তাই বলে এ ধরনের ম্যাড কাউ মাঠে নামাতে হবে? মানুষ এদেরকে ক্লাউন ডাকছে, মিম বানাচ্ছে, তৈরি করছে আকর্ষণীয় প্যারোডি। সরকার ও জনগণের মাঝে কোনো সংযোগ এরা স্থাপন করতে পারছে না। বরং দূরত্ব বাড়াচ্ছে। তাদের ক্রেডিবিলিটি ঋণাত্মক। বুদ্ধির সিন্দুক শূন্য। উঁচু স্বরে কথা বলাকে আর্গুমেন্ট ভাবলে বিপদ। প্রয়াত টেলি সামাদের অভাব পূরণ করাই এদের একমাত্র সফলতা।
৫।
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি চিন্তিত। দলটি টিকবে কি না, এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংগঠনটি স্বাধীন কাঠামো নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, এমন চিন্তা কখনো করেছেন বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ জনগণের দল ছিলো, এককালে, এখন তা পারিবারিক কোম্পানি। ফ্যামিলি কর্পোরেশন। আপনি মারা গেলে দলটি গণতান্ত্রিকভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারবে, এমন বিশ্বাস ক্ষীণ। কারণ দলের ভেতর কোনো কার্যকর গণতান্ত্রিক চর্চা চালু রাখেন নি। দলের সবকিছু আপনি। আপনিই আল্লাহ, আপনিই রাসূল। কমিটি গঠনে কয়েকটি সম্মেলন করেছেন, কিন্তু কেউ সভাপতি পদে দাঁড়ানোর সাহস পেলো না। সেক্রেটারি, উপসেক্রেটারি, সব আপনিই ঠিক করেন। আপনি দলেরও সভাপতি, দেশেরও প্রধানমন্ত্রী। কোনো সাস্টেইনেবল রাজনীতিক দলের ট্রাজেক্টোরি এরকম হয় না। দলটিকে পঙ্গু করে দিয়েছেন। নটরডেমের হাঞ্চব্যাকও এর চেয়ে সবল ছিলো। সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে আত্মীয়-স্বজন ও অনুগত স্তাবক বসিয়ে রেখেছেন। কর্মীরা গণতান্ত্রিকভাবে স্বাধীন ভোটে নেতা নির্বাচন করবে, এ উপায় নেই। টাকার বিনিময়ে পদবী, অভিনয়ের বিনিময়ে টিকেট, শক্তির বিনিময়ে পদ, এই হলো আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক নাটবল্টু। মেরিট, পোটেনশিয়াল, রাজনীতিক প্রতিভা, এগুলোর কার্যকর মূল্যায়ন দলটিতে নেই। দূরদর্শী মানবিক মানুষেরা রাজনীতিতে আসবে, এমন দরজা-জানালা খোলা রাখেন নি। চাষ করেছেন সর্বভূক পাঙ্গাস ও মাগুরের। এমপিদের কথা শুনলে মনে হয়, কোথাও একটি ভাঙা রেডিও অনন্তকাল ধরে কৌতুক প্রচার করছে।
রাজনীতিবিদ সৃষ্টির কোনো অনুকূল আবহাওয়া আপনি তৈরি করেন নি। যা করেছেন, তা কেবলই স্থূল চিন্তার হাঙ্গামা উৎপাদন কারখানা। শ্লোগান ও উত্তেজক বক্তৃতা, অন্তহীন স্তবমাল্য, এগুলোই আজ বুদ্ধি ও জ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত বিকল্প। একটি মুজিব কোট গায়ে দিলেই আপনি তাকে আওয়ামী লীগের লোক বলে স্বীকৃতি দেন। সারা দেশ থেকে নষ্টরা ওই কোটের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। শুনেছি, সম্মেলনের আগে ভারতীয় দূতাবাস থেকে সুপারিশপত্র আসে। বর্তমান কমিটির ৩৫ জন নেতা বিদেশী সুপারিশে স্থান পেয়েছেন, এমন গুঞ্জন বাতাসে আছে। সত্যতা নিশ্চিত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার ভালো জানার কথা। যদি সত্য হয়, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক কিছু কল্পনা করা কঠিন।
৬।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বানিয়েছেন দলীয় কার্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের এলাকা। শিক্ষিতদের চারণভূমি। এলাকাটির সব লোক একযোগে নষ্ট হবে, এমনটি আশা করা রূপকথা। বেছে বেছে সবচেয়ে বাঁকা, সবচেয়ে অকেজো লোকটিকে উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছেন। পদে পদে দলকানা চাকর। জ্ঞানজগতে এ ইকোসিস্টেম টেকসই নয়। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এতো তীব্র একটি আন্দোলন হলো, মুক্তিযুদ্ধবাদী প্রধান বুদ্ধিজীবীকে পাঠিয়ে সে-আন্দোলন থামালেন, কিন্তু ভদ্রলোকের সম্মানটা রাখলেন না। স্থাপন করলেন বিশ্বাস ভঙ্গের নতুন নমুনা। উপাচার্য ফরিদ বহাল তবিয়তে রইলো। এখন ছাত্ররা কাউকেই বিশ্বাস করছে না। ফেরেশতা পাঠালেও শ্লোগান দিচ্ছে— দালাল! দালাল!
ছাত্রলীগকে বানালেন দলীয় লাঠিয়াল। এতো বড় একটি সংগঠন, কতো কাজ তারা করতে পারতো ছাত্রদের কল্যাণে, শিক্ষার কল্যাণে। কিন্তু ক্ষুদ্র স্বার্থে তাদেরকে পরিণত করা হলো ভীতিকর ষণ্ডায়। বুয়েটে একটি মৃত্যুতে বিশটি ছেলের জীবন নষ্ট হলো। এর দায়ভার আওয়ামী লীগের কেউ নিলো না। বিশ্বজিতের মৃত্যুর দৃশ্যটি চোখে ভাসে। এ ছাত্রদের তো এমন হওয়ার কথা ছিলো না। কে তাদের জীবনখেকো সিপাহী বানালো? আপনি? আপনার দল? কুয়াশা এতো কম যে, উত্তরটি আমরা সকলেই জানি। এক সহপাঠী মাথা ফাটাচ্ছে আরেক সহপাঠীর, মারছে কিল, লাথি, ও ঘুষি, ছুড়ে ফেলছে বস্তার মতো ছাদ থেকে, কার জন্য? এরা তো একে অন্যের দুশমন নয়। মানুষ রাজনীতিক প্রাণী, ছাত্ররা রাজনীতির বাইরে থাকবে, এমনটি কল্পনা করি না। কিন্তু রাজনীতি তো এমন নয়। গণরুমের যে-চিত্র মাঝমধ্যে দেখি, সে-দৃশ্য দান্তের দোযখেও নেই। আপনার সুযোগ ছিলো, একটি উপভোগ্য রাজনীতিক আবহাওয়া, নিরাপদ রাজনীতিক সংস্কৃতি ছাত্রদের জন্য তৈরি করার।
শিক্ষকদের এতো নষ্ট করা হয়েছে যে, অল্প বলতেও বিবমিষা জাগে। ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক’— এমন পরিচয় একসময় গৌরবজনক ছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে দেশবাসী রাষ্ট্রপতির সম্মান দিতো। আজ তার মাথায় তেলেভাজা সিঙ্গারার মুকুট। যোগ্যরা পুরস্কৃত, অযোগ্যরা তিরস্কৃত, এ চর্চা স্বর্গবাসী হয়েছে। যোগ্যতাকে ঝাঁটা মেরে বিদায় করেছে স্তব ও আনুগত্য। এ যেন সর্বনাশের চূড়ান্ত মানচিত্র।
৮।
আপনার সরকার যতো পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, যতো বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে, তার প্রতিটিকেই মানুষ মিথ্যে মনে করে। তাকায় গভীর সন্দেহে। এটি এখন ‘জেনারেল পাবলিক পারসেপশন’। বাঙালি ঘরপোড়া গরু। সিঁদুরে মেঘ দেখলে ধোঁয়া অনুমান করে। ভাবে, গোয়ালে আগুন লেগেছে। সকল সভ্য দেশে সরকারি পরিসংখ্যান সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপাত্ত। নাগরিকরা তা চোখ বুজে বিশ্বাস করে। কিন্তু আপনার দপ্তরগুলোর পরিসংখ্যান অনির্ভরযোগ্য। সত্যকে বিকৃত করা কোনো লাভজনক কাজ নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক, সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, প্রতিটি সংস্থা মিথ্যের বাকসোয় পরিণত হয়েছে। সত্য প্রকাশ করলেও ধরে নেওয়া হয় মিথ্যা। সরকারি কোনো বিজ্ঞাপনেই মানুষের আর আস্থা নেই। দীর্ঘকাল জনগণকে সত্য থেকে বঞ্চিত রাখলে যা হয়, তাই হয়েছে। কেন এমনটি করলেন? হয়তো আপনি করেন নি, আপনারা মন্ত্রীরা করেছে, উপদেষ্টারা করেছে, আমলারা করেছে, কিন্তু দায়ভার আপনার মাথায়ই পড়ে। ম্যানুফ্যাকচার্ড থ্রুদ, বানোয়াট সত্য, এতো ব্যাপকভাবে ফিড করা হয়েছে যে, মানুষের কান ক্লান্ত হয়ে উঠেছে।
আপনি রাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছেন। দি স্টেইট ইজ নো লঙ্গার আ ক্রেডিবল এনটিটি। যিনিই রাষ্ট্রের পক্ষে মুখ খুলছেন, তিনিই মিথ্যের বদনা হিশেবে সাব্যস্ত হচ্ছেন। এমনকি বিচার বিভাগও। দেশের ইতিহাসে, আদালতের উপর থেকে মানুষের আস্থা এতো খারাপভাবে সরে যায় নি। সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের নিয়ে মানুষ মশকরা করছে। গায়েবি মামলা নামক এক অদ্ভুত বস্তুর উদ্ভাবন আপনার আমলে ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছে বহুল বিক্রিত পণ্য। মানুষের হাত-পা-মুখ, এগুলো বন্ধ রাখা যায়, কিন্তু মন? মন বন্ধ রাখার কোনো ওষুধ বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারে নি। কোটি কোটি মানুষ রাষ্ট্রকে একযোগে অবিশ্বাস করছে, ভয় পাচ্ছে, ঘৃণা করছে। এই ক্ষতি পোষানোর নয়।
৯।
আপনার কোনো মন্ত্রীকে মানুষের দাবি-দাওয়া আন্তরিকভাবে শুনতে দেখি নি। সারাক্ষণ তারা ‘আপা’-র দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন শেকলবাঁধা দাস। খুব ভয় পায় আপনাকে। কোনো স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের আছে বলে মনে করি না। কোথাও সামান্য কন্ঠ উঁচু হলেই সন্দেহ করা হয়, শ্লোগানকারীটির রাজনীতিক মতলব নেই তো?
রাজনীতিক মতলব থাকা কি অপরাধ? রাজনীতি করা নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার। ন্যচারাল রাইটস। জন লকিয়ান রাইটস। কেউ রাজনীতি করছে, এই অজুহাতে তার দাবি অবহেলা করা অন্যায়। মানুষ নির্ভয়ে মনের কথা রাষ্ট্রকে জানাবে, সরকার সেটি মন দিয়ে শুনবে, মেরিটফুল হলে আমলে নেবে, এই তো স্বাভাবিক চর্চা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আপনি এমন ব্যবস্থা করলেন, দুটি বাক্য ফেসবুকে লিখতেও ভয় হয়। কেন এ ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হলো? মানুষ কথা বলতে পছন্দ করে। তাকে কথা বলতে দিতে হয়। চুপ হয়ে গেলে সে আরও প্রতিক্রিয়াশীল, আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আগে দোকানপাটে জমজমাট রাজনীতিক আড্ডা হতো। ভালো হোক মন্দ হোক, দুটি কথা মানুষ শেখ মুজিবকে নিয়ে বলতো। এখন ভালোমন্দ কিছুই বলে না। কী থেকে কী হয়, এ শংকায় আড়ষ্ট থাকে। মুজিব-বিষয়ক কোনো স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনা চোখে পড়ে না। কারণ আপনি জোর করে তাঁর সম্পর্কে ভালো কথা শুনতে চেয়েছিলেন। এতে যে ক্ষতিটা করেছেন— শেখ মুজিবকে মানুষের ‘পলিটিক্যাল কানশাসনেস’ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। যাকে নিয়ে আলোচনা থেমে যায়, তাকে মানুষ ভুলে যায়। ভালোটা শুনতে হলে, মন্দটা শোনার প্রস্তুতিও রাখতে হবে। কেউ কাউকে মন্দ বললেই তিনি মন্দ হয়ে যান না। কিন্তু আপনি মানুষের উপর আস্থা রাখেন নি। প্রণয়ন করলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ আইন যে কতো মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে, তা হিসেব করা কঠিন। বাংলাদেশের ইতিহাসে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে জনগণের মুখোমুখি এভাবে আর কেউ দাঁড় করায় নি।
১০।
সেকুলার ও প্রগতিশীল কোটি কোটি মানুষ আপনার উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা লক্ষ করেছে, রাজনীতিক স্বার্থে নানা সময় সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সাথে আপনি আঁতাত করেছেন। চুমু খেয়েছেন সাপের মুখে। আদালতগুলো ভরে উঠেছে মৌলবাদী ভাবাদর্শের বিচারকে। জেলাগুলোয় সরকারি ভালো হাসপাতাল নেই, কিন্তু মডেল মসজিদ আছে অনেক। আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে খাচাসম বাণিজ্যিক মাদ্রাসা। শিশুদেরকে গবাদি পশুর মতো বন্দী করা হয়েছে ধর্মীয় খোয়াড়ে। কোনো ইনক্লুসিভ কালচারাল এটমোস্ফিয়ার তারা পাচ্ছে না। নানা আজেবাজে মতাদর্শ ও বিশ্বাস নিয়ে ওরা বড় হচ্ছে। হাজার হাজার সুবিধাবাদী মৌলবাদ-মেশিন আওয়ামী লীগের ছায়ায় মোটাতাজা হয়েছে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। একসময় বাংলাদেশ সহনশীল ধর্মপ্রাণ মুসলমানের দেশ ছিলো। এখন যেদিকে চোখ যায়, দেখি ছোট ছোট আল্লাহ। আল্লাহ যা করবেন না, কখনো করেন নি, তা আল্লাহর দোহাই দিয়ে ভিডিওবন্দী অনলাইন বেহেশতীরা করছে। ধর্মপ্রাণ থেকে তারা হয়ে উঠেছে ধর্মবন্দী। এসব প্রতিরোধে কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা আপনি নেন নি। উল্টো আপনার দল তাহাজ্জুদ পড়ার গল্প ছড়িয়েছে। ভেবেছে, নামাজের খবরে মৌলবাদীদের মন নরম হবে।
‘হেফাজতে ইসলাম’ নামক সাম্প্রদায়িক সুবিধাগোষ্ঠীর সাথে আপনার প্রেম দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে। জনগণের সাথে যার বিচ্ছেদ ঘটে, তার লাম্পট্য আনপ্রেডিক্টেবল। লম্পটরা বন্ধু ও শত্রু, দুটি চিনতেই ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগের হয়েছে এ দশা। দিনে যাকে আদর করে বুকে টানে, রাতে দেখে পেটের উপরে ছুরিকার দাগটি সে-ই সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি গভীরভাবে বলতে গেলে আমাকে ডিএইচ লরেন্স হতে হবে। রচনা করতে হবে সন্স অ্যান্ড লাভার্স, উইমেন ইন লাভ, বা লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার। বাংলাদেশের সমাজে এটি খুব অশ্লীল দেখাবে।
১১।
সবাই আমাকে লেখক হিশেবে জানলেও আমার আরেকটি পরিচয় আছে। আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ। সরাসরি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ল’ নিয়ে পড়াশোনা করেছি। আইসিসি বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারক হওয়ার কেতাবি যোগ্যতা আমার আছে। সে-অবস্থান থেকে বলতে পারি, কোটা আন্দোলন ঘিরে যে-সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তাতে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমের উপাদান রয়েছে। কিছু ভিডিও দেখেছি। সেগুলো সত্যি হলে, আপনার সরকার ‘ক্রাইমস অ্যাগেইন্সট হিউম্যানিটি’ কামিট করেছে, যা রোম স্ট্যাচিউটে বিচারযোগ্য। একটি ভিডিও সরাসরি জেনেভা কনভেনশন নাইনটিন ফোর্টি নাইনের ভায়োলেশন। ওয়ার ক্রাইম। ছাদের কার্নিশে আশ্রয় নেয়া ডিফেন্সলেস ভিক্টিমকে গুলি করা হয়েছে। বহু শিশু ও নিরস্ত্র ছাত্র, ইনডিস্ক্রিমিনেইট সিস্টেম্যাটিক এটাকের শিকার হয়েছে। নিহতের সংখ্যা শতো শতো, আহতের সংখ্যা হাজার হাজার। কারও চোখে গুলি, কারও মাথায়। অনেকে অন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো কার নির্দেশে, কার বুদ্ধিতে হলো, তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। তবে মানুষ বলছে, আপনার নির্দেশে হয়েছে। কেউ কেউ আরোপ করছে কমান্ড রেসপোনসিবিলিটি। লান্ডোভেরি ক্যাসল মামলা আমলে নিলে, নিরাপত্তাবাহিনীর মাঠ পর্যায়ের সদস্যরাও বিপদে পড়বে। কারণ অবৈধ আদেশের ক্ষেত্রে সুপিরিয়র কমান্ড ডিফেন্স গ্রহণযোগ্য নয়।
ভাগ্য ভালো, আইসিসিতে ব্যক্তি উদ্যোগে মামলা করা যায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্য ডানা মেলতে থাকলে, রোম স্ট্যাচুটের সিগন্যাটোরি, এমন শত্রু রাষ্ট্র আইসিসিতে এ ঘটনা রেফার করতে পারে। প্রি-ট্রায়াল চেম্বার অনুমতি দিলে, শুরু হতে পারে আনুষ্ঠানিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন। প্রসিকিউটর চাইলে, গণমাধ্যম ও অন্যান্য উৎস থেকে তথ্য নিয়ে, নিজ উদ্যোগেও ইনভেস্টিগেশন ওপেনের আবেদন করতে পারেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেরও ক্ষমতা আছে, রেজুলিউশনের মাধ্যমে আইসিসিতে এ হত্যাকাণ্ড রেফার করার। যদি একবার ইন্টারন্যাশনাল এরেস্ট ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়, আপনাকে হাসান আল বশিরের পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে। গ্রেপ্তারের ভয়ে রোম স্ট্যাচুটের শরিক রাষ্ট্রগুলোয় ভ্রমণ করতে পারবেন না। ইন্ডাইক্টেড হবেন বাহিনীপ্রধানরাও। বাংলাদেশকে বিশ্ববাসী চিনবে নতুন সুদান নামে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো লেনদেনে লিগাল ও মোরাল উভয় জটিলতায় পড়বে। লেজিটিমেইট গভর্নমেন্ট নেই, এ অজুহাতে আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য সাময়িকভাবে রিজার্ভ বাজেয়াপ্ত করতে পারে, যেমনটি করেছিলো ভেনেজুয়েলা ও আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে।
আইসিসির চেয়েও বড় বিপদ ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে, কোনো রাষ্ট্রপ্রধান যে-দেশেই যান না কেন, তার বিরুদ্ধে যদি আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ থাকে, তাহলে যেকোনো ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠান বাদী হয়ে সেই দেশের আদালতে মামলা করতে পারে। প্রক্রিয়াটি কতোটা বিপজ্জনক, তা বুঝতে আপনাকে একটি উদাহরণ দিই। ২০১১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সুইজারল্যান্ড সফরের কথা ছিলো। খবর শুনে মানবাধিকার সংগঠন ‘সেন্টার ফর কানস্টিটিউশোনাল রাইটস’ ও কিছু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, সুইশ আদালতে, বুশের বিরুদ্ধে গুয়ান্তানামো কারাগারে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনা ফাঁস হলে, গ্রেপ্তারের ভয়ে বুশ সুইজারল্যান্ড সফর বাতিল করেন। স্টেইট ইমিউনিটি ইজ নট আ গ্যারান্টি আন্ডার ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন। সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানদের বেলায় তো একেবারেই নয়। ভারতেও এটি ঘটতে পারে। ভারতের বিচার বিভাগ বেশ স্বাধীন। কলকাতার কোনো ক্ষুব্ধ নাগরিক যদি ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশনে ভারতের আদালতে মামলা দায়েরের উদ্যোগ নেয়, তাহলে আপনার সরকার গুরুতর বিপদে পড়বে। চিলির স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোশেকে লণ্ডনে ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশনের আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। মামলা হয়েছিলো স্পেনে। স্পেনের আদালত যুক্তরাজ্যের কাছে এক্সট্রাডিশন অর্ডার পাঠিয়েছিলো।
১২।
জনগণ আপনার উপর ক্ষুব্ধ। এ ক্ষোভ তারা নানা ভঙ্গিতে প্রকাশ করছে। কেউ ফেসবুকে লিখছে, কেউ মাঠে উস্কানি দিচ্ছে। আপনার দলের বহু কর্মী নিরব হয়ে গেছে। তাদের মনেও ক্ষোভ আছে। এ বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না। বিশ্বের নানা দেশে আপনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। আমেরিকা, ইউরোপ, ও অস্ট্রেলিয়ার বহু এমপি, কংগ্রেসম্যান, সিনেটর আপনার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। ভারত ও নেপালে প্রতিবাদী মিছিল হয়েছে। বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠাবেনা বলে শপথ নিয়েছে। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই— আপনি সৎ মনে বাংলাদেশের উন্নয়নে ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছেন, চলমান সহিংসতায় আপনার কোনো ইনভল্বমেন্ট নেই, তাহলেও বলবো, দেশের কোটি কোটি মানুষ আপনাকে পছন্দ করছে না। দিস ইজ নট দা রাইট ওয়ে টু রিমেইন ইন পাওয়ার। ডু দা রাইট থিং। নানা কারণে নাগরিকরা আপনার উপর রেগে আছে। হোয়াট ইজ হ্যাপেনিং ইজ আ স্ট্রং ডিসচার্জ অভ রিসেন্টমেন্ট। এটা অনুধাবন করুন। দেশকে সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচাতেই আমার এ চিঠি। আরও রক্ত, আরো লাশে বাংলাদেশ ডুবে যাক, এটি আমি চাই না। ফরাসী ও বলশেভিক বিপ্লবের মতো প্রতিশোধকামী উন্মত্তদের হাতে যেন বাংলাদেশ বন্দী না হয়, এ ভয় থেকেই এতো বাক্যব্যয়। রবস্পিয়েররা উৎ পেতে আছে। সুযোগ পেলেই রক্তে ভাসিয়ে দেবে দেশ। বৃহৎ স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। সারা জীবন ভুল-সঠিক কী করেছেন, সে-হিসেব চাইবো না, এ আমার কাজও নয়। শুধু চাই, এ ঐতিহাসিক মুহুর্তে, এই আনপ্রিসিডেন্টেড সংকটে, একটি মহৎ কাজ করুন। জাতি আপনাকে ক্ষমা করলে করতেও পারে। আপনার প্রধান রাজনীতিক প্রতিপক্ষ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, তাদের সাথে আলোচনায় বসুন। মানুষ মানুষের সাথে মন খুলে কথা বললে অনেক মেঘই কেটে যায়। এ মেঘও না কাটার মতো নয়। সব দম্ভ ও ইগো ভুলে গিয়ে, দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে, ভবিষ্যতের স্বার্থে, ঘনিয়ে আসা ভয়াবহ রক্তপাত এড়াতে, এখনই খালেদা জিয়ার বাসায় যান। সবাইকে ডেকে নিয়ে আলোচনা করুন, কীভাবে নিরপরাধ কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, পার্লামেন্ট ভেঙে, দ্রুত একটি অবাধ ও অর্থবহ নির্বাচন দেওয়া যায়। কোনো অপরিহার্য শর্তের প্রয়োজন হলে, সেটি নিয়েও আলোচনা করুণ। যদি সৎভাবে আন্তরিক হন, আমার ধারণা, শীঘ্রই বৃষ্টি হবে।
যে-প্রাণগুলো ঝরে গেলো, যে-পরিবারগুলো ভেসে গেলো দুঃখে, তা রিস্টোর করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। বিচার চাওয়ার পরিবেশ অনুপস্থিত। কার কাছে বিচার চাইবো? যে-বেদনার ঝড় দেশের উপর দিয়ে বয়ে গেলো, তা অকল্পনীয়। আরও মৃত্যু, আরও সহিংসতা এখনই এড়াতে হবে। যে-ছাত্রদের গ্রেপ্তার করা হলো, তাদের কাছে চিরকাল আমাদের মাথা হেঁট হয়ে থাকবে। যে-সময়টি বইপত্রের সাথে কাটানোর কথা, সে-সময়টি তারা কাটাচ্ছে অন্ধকার কারাগারে। এ দুঃখ ওরা ভুলবে কী করে? এখনই, এই মুহুর্তে, সকল গ্রেপ্তার অভিযান বন্ধ করুন। ছাত্রদের ফেরত দিন মায়ের বুকে। যা ঘটেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। দীর্ঘকাল জাতিকে এর অনুতাপ বয়ে বেড়াতে হবে। আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেলো।
.
—মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
পহেলা আগস্ট, ২০২৪
২| ০৩ রা আগস্ট, ২০২৪ সকাল ১১:৪৯
আমি সাজিদ বলেছেন: পড়তে পড়তে বাউন্ডেলে ভাইয়ের দাঁত বোধহয় ভেঙ্গেই গেল, কঠিন কঠিন টার্ম।
৩| ০৩ রা আগস্ট, ২০২৪ দুপুর ১২:০৯
সেলিম আনোয়ার বলেছেন: বেচারা। অনেক না বলা কথা। আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব আজ ভুয়ায় নিহিত।
৪| ০৩ রা আগস্ট, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৯
মোহাম্মদ গোফরান বলেছেন: পুরোপুরি সহমত নই। তবে উনি ৭০% ঠিক।
৫| ০৩ রা আগস্ট, ২০২৪ বিকাল ৪:০৫
নতুন বলেছেন: কিছু মানুষের কথায় মনে হচ্ছে দেশের আয়ামী সমর্থক বাদে সবাই ভুল জানছে , বুঝতে পারছে।
শেখ হাসিনা কি বুঝতে পারছেনা?
নাকি বুঝতে চাইছে না?
নাকি তাকে বুঝতে দিচ্ছে না?
তিনি বুঝতে পারছেন যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে তার নেতারা ব্যার্থ। তাই নিজেই বসতে চাইছেন।
কিন্তু যদি না বসে। তবে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে?
আবার কার্ফূ জারী করবে? ইন্টারনেট বন্ধ করবে?
©somewhere in net ltd.
১| ০৩ রা আগস্ট, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯
বাউন্ডেলে বলেছেন: ভালো টাকা পেয়েছেন- মনে হচ্ছে।