নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নূর মোহাম্মদ নূরু (পেশাঃ সংবাদ কর্মী), জন্ম ২৯ সেপ্টেম্বর প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশালের উজিরপুর উপজেলাধীন সাপলা ফুলের স্বর্গ সাতলা গ্রামে

নূর মোহাম্মদ নূরু

দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন

নূর মোহাম্মদ নূরু › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ৯৬তম বার্ষিকীতে নিহতদের স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি

১৩ ই এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৪


(অমৃতসর শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগ)
ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ৯৬তম বার্ষিকী আজ। ১৯১৯ সালের এপ্রিল মাসের ১৩ তারিখ রোববার অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগে ইংরেজ সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এই শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক একটি বদ্ধ উদ্যানে সমবেত নিরস্ত্র জনগণের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল।

(ইংরেজ সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার রেগিনাল্ড ডায়ার)
হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ১৪ এপ্রিল, ১৯১৯ তারিখের ডায়ারের নিজের ডেসপ্যাচ অনুসারে ১৩ এপ্রিল ১০০ জন গুর্খা সৈন্য আর ২টি সাজোয়া গাড়ি নিয়ে ডায়ারের নির্দেশে জালিয়ানওয়ালাবাগে ২০০০-এর মত "বিদ্রোহীকে" হতাহত করা হয়েছিল। আর এতে খরচ হয়েছিল ১৬৫০ রাউণ্ড গুলি। জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঝখানে কুয়োতে পাথর ফেলে কিছু মানুষকে জীবন্ত প্রোথিত করা হয়। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (অমৃতসর হত্যাকাণ্ড) ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যা। ইতিহাসে অন্যতম জঘন্যতম জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ৯৬তম বার্ষিকীতে নিহতদের স্মরণে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি

(জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঝখানের কুয়ো)
উল্লেখ্য ১৭৫৭ সালে ভারতবর্ষ চিরকালের জন্য ইংরেজ শাসনের অধীনে আসে। শাসনের এক পর্যায়ে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ভারতের উদীয়মান ধনিক এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে। এই আকাঙ্ক্ষার সংহত রূপ প্রকাশ পায় ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। প্রথম দিকে এই রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসনাধীনে থেকেই ন্যায়বিচার এবং স্বায়ত্তশাসন লাভ। কিন্তু ইংরেজ সরাকারের পক্ষ থেকে এ দাবী মেনে নেয়া হয়নি। ইংরেজদের যুক্তি ছিল ভারতবর্ষ অনুন্নত বিধায় স্বায়ত্তশাসনের উপযুক্ত নয়। কিন্তু ভারতে এ ধরণের চিন্তাধারার প্রসার ঘটতে থাকে। ধীরে ধীরে এদেশের অনেক স্থানেই রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়, এক সময় টেলিগ্রাফ তারও বসানো হয়। কিছু কিছু কল-কারখানাও স্থাপিত হয়, মূলত কাপড়ের কারখানা প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনার প্রভাবও এখানে পরিলক্ষিত হয়। ১৯০৫ সালে রাশিয়ার মতো বৃহৎ শক্তি ক্ষুদ্র এশীয় শক্তি জাপানের কাছে রুশ-জাপান যুদ্ধে পরাজিত হয়। একই সময়ে রাশিয়ায় স্বৈরাচারী জারের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। ধনতান্ত্রিক দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হওয়ায় এশিয়া এবং আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলো দখল করে নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নেয়ার জন্য উন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এরই ফল ছিল ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধে জার্মানি ইংল্যান্ড তথা মিত্রবাহিনীর হাতে পরাস্ত হয়। যুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীও অংশ নিয়েছিলো। ইংরেজ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যুদ্ধে অংশ নিলে পরাধীন দেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে। এই কথায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত মহাত্মা গান্ধী সহ অনেকেই যুদ্ধে যোগ দেন এবং যুদ্ধে ভারতবাসীকে উৎসাহিত করেন।

১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু ইংরেজ সরকারের নীতিতে কোন রকম পরিবর্তন দেখা যায়নি। যেসব সৈন্য যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এসময় তাকে বেকার করে নিজ নিজ গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অর্থনৈতিক মন্দা এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারিতে এক কোটির বেশি মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ভারতবাসীর মনে সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকে। এই সন্দেহ থেকেই ক্ষোভ এবং ইংরেজ বিরোধী মনোভাবের সূচনা ঘটে। এসময় ইংরেজ সরকার একদিকে যেমন মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার আইন করে তাদেরকে শান্ত করার চেষ্টা করে একই সাথে আবার রাওলাট আইন করে ইংরেজ সরকার বিরোধী সকল বিক্ষোভ কঠোর হাতে দমনের জন্য নির্যাতনমূলক আইন জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়। এই আইনের অধীনে বিনা কারণে গ্রেপ্তার, অন্তরীন ও সংক্ষিপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণহীন বিচার ও বন্দীত্বের বেপরোয়া পদক্ষেপ গৃহীত হয়। মহাত্মা গান্ধী তখন অহিংস এবং সত্যাগ্রহ তথা রক্তপতহীন আন্দোলনের মাধ্যমে এর প্রতিবাদের আয়োজন করেন। এই সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাঞ্জাব যাওয়ার পথে গান্ধীজিকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে আহমেদাবাদের শিল্প শ্রমিক এবং পাঞ্জাবের সাধারণ জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। সরকার গান্ধীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এর পরও বিক্ষোভ কমেনি। ধর্মঘটে এবং বিক্ষোভের লক্ষ্য হয়ে দাড়ায় সরকারী দপ্তর এবং যানবাহন। সাদা চামড়ার ইউরোপীয় কর্মকর্তা এবং অধিবাসীদের উপরও ভারতীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। তাদের উপরও আক্রমণ করা হয়। এপ্রিলের ১৩ তারিখ দুজন রাজনৈতিক নেতাকে অমৃতসর থেকে গ্রেফতার করা হয়। এর পটভূমিতেই বলতে হয় হত্যাকাণ্ডের আবহ তৈরি হয়েছিল।

১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল, রোববার। দিনটি ছিল শিখদের নববর্ষ উৎসব। স্বর্ণমন্দিরসংলগ্ন জালিয়ানওয়ালাবাগে বিশেষ প্রার্থনাসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন অমৃতসরের নানা ধর্মের অন্তত ২০ হাজার মানুষ। শহরে তখন চলছে সামরিক আইন রাওলাট অ্যাক্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আন্দোলন থামাতে ব্রিটিশ সরকার জারি করেছে ১৪৪ ধারা। সে ধারা ভঙ্গ করেই নববর্ষ উৎসব পালনের জন্য সবাই সমবেত হয়েছে জালিয়ানওয়ালাবাগের ঐতিহাসিক ময়দানে। ময়দানের চারপাশ দেয়াল দিয়ে ঘেরা। প্রবেশদ্বারও ছোট। ব্রিটিশ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারের কানে পৌঁছে যায় এই জমায়েতের কথা। তৎক্ষণাৎ ডায়ার ৫০ জন রাইফেলধারী সেনা নিয়ে হাজির জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই প্রার্থনাসভায়। মূল ফটক বন্ধ করে নিরীহ ও নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। এই ময়দানের পাশেই ছিল একটি কুয়ো। গুলিবর্ষণের ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যায় উপস্থিত লোকজন। গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়ে একে একে। চলে ছোটাছুটি। পাশের কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে প্রায় ৩০০ নারী-পুরুষ-শিশু। একটানা ১০ মিনিট ধরে চলে গুলিবর্ষণ। এক হাজার ৬৫০টি গুলি কেড়ে নেয় প্রায় দেড় হাজার মানুষের প্রাণ।

এ ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়লে গোটা দেশের রাজনীতি হয়ে পড়ে উত্তাল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। খেপে ওঠেন মহাত্মা গান্ধী। ডাক দেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। প্রত্যাখ্যান করেন ব্রিটিশদের দেওয়া নাইটহুড সম্মান। দেশজুড়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ায় গণমানুষের চাপে ব্রিটিশ সরকার গঠন করে একটি তদন্ত কমিটি। তদন্ত শেষে ঘোষণা দেওয়া হয় এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞে নিহত মাত্র ৩৭৯ আর আহত এক হাজার ১০০ জন। যদিও সেদিন জাতীয় কংগ্রেস দাবি করে এই হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছে সহস্রাধিক মানুষ। তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. স্মিথ জানান, এই হত্যাযজ্ঞে নিহত মানুষের সংখ্যা এক হাজার ৫২৬ জন।

(জালিয়ানওয়ালাবাগ স্মৃতি সৌধ)
ঘটনার পরপরই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারকে অপসারণ করে ব্রিটিশ সরকার। তাঁকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় লন্ডন। কিন্তু প্রতিশোধের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে শিখদের মধ্যে। সে আগুনের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এক শিখ যুবক লন্ডনে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে ডায়ারকে। ডায়ার তখন লন্ডনের ক্যাক্সটন হলে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছিলেন।

১৯১৯ সালে তৎকালীন ঔপনিবেশিক ভারতের জালিয়ানওয়ালাবাগে গণহত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। গণহত্যার জন্য ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই প্রথম কোনো ব্রিটিশ কর্তা দুঃখ প্রকাশ করলেন। প্রায় এক শতাব্দী পর ভারতে তিনদিনের রাষ্ট্রিয় সফরের শেষ দিনে গত ২০ ফেব্রুয়ারি বুধবার পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসরে গণহত্যার স্মৃতিস্তম্ভে গিয়ে প্রার্থনা করে কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করেন ক্যামেরন। ঐ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে ক্যামেরন বলেন, “এ ঘটনা ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা।” স্মৃতিস্তম্ভের শোক বইয়ে স্বাক্ষর করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “এখানে যা ঘটেছে তা আমরা কখনোই ভুলব না।ইতিহাসে অন্যতম জঘন্যতম জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ৯৬তম বার্ষিকীতে নিহতদের স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.