নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নূর মোহাম্মদ নূরু (পেশাঃ সংবাদ কর্মী), জন্ম ২৯ সেপ্টেম্বর প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশালের উজিরপুর উপজেলাধীন সাপলা ফুলের স্বর্গ সাতলা গ্রামে

নূর মোহাম্মদ নূরু

দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন

নূর মোহাম্মদ নূরু › বিস্তারিত পোস্টঃ

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬০তম বার্ষিকীতে শ্রদ্ধায় স্মরণ বিদ্রোহী শহীদদের

৩০ শে জুন, ২০১৫ সকাল ১১:২৫


আজ ৩০ জুন ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬০তম বার্ষিকী। আজ থেকে প্রায় ১৬০ বছর আগে আজকের দিনে আদবাসী সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে সাঁওতালসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ভারত উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশের আদিবাসী হিসেবে যাদের আখ্যায়িত করা হয তাদের মধ্যে সাঁওতাল সম্প্রদায হল সবচাইতে সরল জীবন-যাপনকারী অল্পেই সন্তুষ্ট একটি জাতী গোষ্ঠী। অত্যন্ত নিরীহ, শান্তপ্রিয় আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সাদামাটা স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর যোগসাজশে স্থানীয় জমিদার, জোতদার এবং মহাজনরা প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত করেছিল। সাঁওতালদের ওপর ক্রমাগত শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন, দাসত্ব আর নারীর অবমাননা যখন সহ্যের সীমাকে অতিক্রম করেছিল, তখনই শান্তিপ্রিয় সাঁওতালরা ঐক্যে পৌঁছেছিল। গড়ে তুলেছিল দুর্বার আন্দোলন। এই বিদ্রোহে প্রতিবাদী সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরবসহ প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল প্রাণ দেয়। সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬০তম বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরন করছি সাঁওতাল বিদ্রোহের সকল শহীদদের।

১৮৫৫ সালের ৩০ জুন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল দিন তথা ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস। সাঁওতাল বিদ্রোহ হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তার এদেশীয় দোসর, শোষক, সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম। সাওতাল বিদ্রোহে সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে সাঁওতালসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই সাঁওতাল বিদ্রোহই ছিল প্রথম কোনো সংগঠিত প্রতিবাদ। বিদ্রোহে ওই এলাকার দরিদ্র বাঙালি ও হিন্দু মুসলমান কৃষকেরাও অংশ নেন। এই বিদ্রোহে শহীদ হয়েছিলো অনেক আদিবাসী।

সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল এর সূচনা হয ১৮৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায়। সান্তাল হুলের ইতিহাস হতে জানা যায দামিন-ই কোহ ছিল সাঁওতালদের নিজস্ব গ্রাম, নিজস্ব দেশ। ১৮৫২ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশের প্রবর্তিত চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের ফলে তাদের উপর অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল। ইংরেজ আমলে স্থানীয় জমিদার, মহাজন ও ইংরেজ কর্মচারীদের অন্যায় অত্যাচারের শিকার হয়ে সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। এটি ছিল তাদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম। সাঁওতাল বিদ্রোহে যে সকল কারণগুলো মূখ্য ভুমিকা হিসেবে গণ্য করা হয সেগুলো হলোঃ-

১। ভুমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে সাঁওতালরা বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে যে জমি ফসল উৎপাদনের উপযোগী করে তোলে, সে জমি সমতল ভূমিতে বসবাসকারী জমিদার-জোতদার-তালুকদাররা জোরপূর্বক দখল করে এবং সাওতালদেরকে ঐ জমিতে ক্রীতদাস হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করে;
২। বৃটিশরাজ কর্তৃক মুদ্রা ব্যবস্থা প্রচলনের সুযোগ ব্যাপারী-মহাজনরা নিরক্ষর-অজ্ঞ ও সহজ-সরল সাঁওতালদের ছল-চাতুরির মাধ্যমে প্রতারিত করে;
৩। সাঁওতালদের অঞ্চলে ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যাপারী ও সুদখোর মহাজনদের অতি লোভ ও লুন্ঠনের প্রবৃত্তির ফলে জোরজবর দখল করে সাঁওতালদের সম্পদ ও উৎপাদিত আত্মসাৎ করা;
৪। ঋণদাযগ্রস্ত সাঁওতালদের ব্যক্তিগত বংশগত ক্রীতদাসত্বের মতো বর্বর প্রথা প্রচলনের মাধ্যমে তাদের আজীবন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা;
৫। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশের সীমাহীন অত্যাচার, দূর্নীতি, উৎপীডন এবং জমিদার-জোতদার-ব্যাপারী-মহাজনদের দুষ্কর্ম ও অত্যাচারে সহাযতা দান;
৬। সরকারি বিচার-ব্যবস্থা কিংবা আদালতে সুবিধা না পাওয়া। এরকম বিভিন্ন কারণে সাঁওতালিদের মনে ক্ষোভ জমতে থাকে, তারা প্রতিবাদী হতে থাকে। ১৮৫৫ সালে ভারতের দামিন-ই কোহ অঞ্চলের পাকুড় জেলার ভগনাডিহি গ্রাম থেকে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয সাঁওতাল নেতা সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব। ব্রিটিশ বাহিনীর কামান-বন্দুক ও গোলাবারুদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের তীর-ধনুক, বল্লম-টাঙ্গির অসম যুদ্ধ খুব বেশি দিন স্থায়ী না হলেও এই বিদ্রোহ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিকামী মানুষের মনে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে।


বিদ্রোহের প্রারম্ভেই সাঁওতালরা কুখ্যাত উৎপীড়কদের একে একে হত্যা করে দীর্ঘকালের পুঞ্জীভুত অপরাধের শাস্তি দেয়। বিদ্রোহীদের ভয়ে সমস্ত ইংরেজ সরকারের কর্মচারীগণ চাকরি ছেড়ে পালাতে থাকে। বিদ্রোহীরা চারিদিকে ঘোষণা করতে থাকে, “কোম্পানীর রাজত্ব শেষ হয়েছে এবং এখন তাদের স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” সাঁওতাল জাতির ইতিহাসে সিধো-কানুর নেতৃত্বে ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল যুদ্ধই ছিলো সর্বাধিক বৃহত্তম এবং গৌরবের বিষয়। তাদের এই বিদ্রোহই ভারতবর্ষে স্বাধীনতার বীজ বপন করে গিয়েছিল। এই যুদ্ধের ফলাফল হলো এই যে, ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তের ব্যবস্থা করলেন। ম্যাজিট্রেট এডন সাহেব সাঁওতালদের আবেদন শুনলেন। যুদ্ধের পরে সাঁওতালদের সমস্যা বিবেচনা করে আদিবাসী সাঁওতালদের জন্য একটি জেলা বরাদ্দ করা হলো। এই জেলার নাম হলো ডুমকা। এটাই সাঁওতাল পরগনা নামে পরিচিত। এখানে সাঁওতাল মানঝি, পরানিক, পরগনা জেলার শাসন পরিচালনার জন্য দারোগা, পুলিশ ও বিভিন্ন সরকারী কমকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতা প্রাপ্ত হলো। সাঁওতালদের বিচার সালিশ তাদের আইনে করার জন্য সরকার ক্ষমতা প্রদান করলেন। খাজনা, কর প্রভৃতি তাদের হাতে অর্পণ করা হলো। তারা জেলা প্রশাসক বা ডিসির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতে থাকলো। ১৮৮৫ সালে বেঙ্গল টেনান্সি এ্যাক্ট অনুযায়ী আদিবাসীরা তাদের জমি সরকারী অনুমতি ছাড়া বিক্রি করতে পারতো না। এই আইন এখন পর্যন্ত কার্যকর আছে। ১৮৫৫ সালে সাঁওতালরা সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। তারা এ যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল ইংরেজদের শাসন-শোষণ, সুদখোর, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ সৈন্য ও তাদের দোসর অসৎ ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর ও মহাজনদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।

এই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৮৫৬ সালের ২৭ জানুয়ারি লেফটেন্যান্ট ফেগানেরর বাহিনীর সঙ্গে ভাগলপুরে সাঁওতালদের মুখোমুখি যুদ্ধ হলো। যুদ্ধে মারা গেলেন সিধু-কানুর দুই ভাই চাঁদ ও ভৈরব। শুধু সিধু-কানুর ভাই-ই না, তারা ছিলেন সাঁওতালদের দুইজন বীরযোদ্ধা। এসময় সিধু-কানুর খোঁজে ইংরেজ সৈন্যরা গ্রামে গ্রামে হানা দিতে শুরু করলো। সাঁওতালদের উপর চালাতে লাগলো অমানুষিক নির্যাতন। সে নির্যাতন সইতে না পেরে কয়েকজন সাঁওতাল সিধু-কানুর গোপন আস্তানার খবর ইংরেজ সৈন্যদের বলেই দিলো। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ইংরেজ সৈন্যরা সিধুকে তার গোপন আস্তানা থেকে গ্রেফতার করে সেখানেই গুলি করে মেরে ফেলে । আর তার পরের সপ্তাহে বীরভূমের জামতারা থেকে পুলিশ কানুকে গ্রেফতার করে। পরে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। এই দুই বীর নেতার মৃত্যুর পর বিদ্রোহী সাঁওতালরা পরাজয় মেনে নেয়। এই বিদ্রোহে প্রায় ২৫ হাজার সাঁওতাল মারা গিয়েছিলো।

স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিকামী মানুষের মনে আজও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে সাঁওতাল বিদ্রোহ। সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬০তম বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরন করছি সেদিনের সব সাওতাল বিদ্রোহী ও শহীদদের। তাঁদের সবার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে জুন, ২০১৫ দুপুর ১২:০৬

কাবিল বলেছেন: সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব শহীদদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

৩০ শে জুন, ২০১৫ দুপুর ২:১৮

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
ধন্যবাদ কাবিল ভাই
সব সময় সাথে থাকার জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.