নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নূর মোহাম্মদ নূরু (পেশাঃ সংবাদ কর্মী), জন্ম ২৯ সেপ্টেম্বর প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশালের উজিরপুর উপজেলাধীন সাপলা ফুলের স্বর্গ সাতলা গ্রামে

নূর মোহাম্মদ নূরু

দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন

নূর মোহাম্মদ নূরু › বিস্তারিত পোস্টঃ

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়কদের অন্যতম শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের ৫০তম শাহাদাত বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১০:০৪


বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম অগ্রপথিক শহীদ ব্যক্তিত্ব সার্জেন্ট জহুরুল হক। তদানীন্তন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর যে সকল অকুতোভয় বীর কর্মকর্তা পাকিস্তানী স্বৈরশান ও পরে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার হয়েছিলেন সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিলেন তাদের অন্যতম। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী ছিলেন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটির সরকারী নাম রেখেছিল 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার'। এই মামলায় ৩৫জনকে আসামী করা হয়। তন্মধ্যে ১নং আসামী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাখা হয়আর সার্জেন্ট জহুরুল হককে ১৭নং আসামী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার শিরোনামের মামলার অভিযোগনামায় উল্লেখ করা হয়েছিল যে, "অভিযুক্তরা ভারতীয় অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটিয়ে কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিল "। মামলার স্থান হিসেবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে অবস্থিত 'সিগন্যাল অফিসার মেসে' নির্ধারণ করা হয়। মামলার শেষ তারিখ ছিল ১৯৬৯ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি। প্রথমে আসামীদেরকে 'দেশরক্ষা আইন' থেকে মুক্তি দেয়া হয়। পরবর্তীতে 'আর্মি, নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স অ্যাক্টে' সার্জেন্ট জহুরুল হক-সহ অন্যান্য আসামীকে পুণরায় গ্রেফতার করে সেন্ট্রাল জেল থেকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয় এবং ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন পুনরায় মামলাটির শুনানি কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে প্রবল গণ-আন্দোলন তথা উত্তাল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খানের সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে একান্ত বাধ্য হয়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমান-সহ অন্যান্যদের মুক্তির দাবী করেছিল। সরকার প্রধান হিসেবে আইয়ুব খান সমগ্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ঠিক এ সময়টিতেই সার্জেন্ট জহুরুল হকের জীবনে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে। ১৯৬৯ সালের আজকের দিনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তরূপে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলীতে নিহত হন সার্জেন্ট জহুরুল হকে। বাংলাদেশের স্বীধীনতা সংগ্রামে চরম আত্যত্যাগের জন্য তিনি আজও বাংলার মানুষের অন্তরে চিরস্মরণীয হয়ে রয়েছেন। আজ তাঁর ৫০তম শাহাদাত বার্ষিকী। শহীদ ব্যক্তিত্ব সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

জহুরুল হক ১৯৩৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী জেলার সোনাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কাজী মজিবুল হক। এই পরিবারের বহু কৃতি সন্তান জন্ম নিয়েছে। বাংলাদেশের সাবেক এর্টনী জেনারেল আমিনুল হক সার্জেন্ট জহুরের বড় ভাই এবং প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. মজহারুল হক এই পরিবারের কৃতী সন্তান। জহুরুল হক ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও নির্ভীক। খেলাধূলায় ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। ততকালীন পাকিস্তানে তিনি একাধারে বেশ কয়েক বছর বিমান বাহিনীর সাঁতার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তিনি ছবি আঁকাতে ভালবাসতেন। তাঁর যে ছবিটি সবচেয়ে পরিচিত সেটি তাঁর নিজেরই আঁকা। এছাড়াও তিনি নানা রকম হাতের কাজে পারদর্শী ছিলেন। তিনি কাঠ খোদাই করে নানা রকম শিল্পকর্ম করতেন। কাঠের ছোট ছোট টুকরো সংযুক্ত করে ছবি আকতেন। জাতীয় যাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধ জাতিঘরে তার স্বহস্তে নির্মিত বেশ কিছু শিল্পকর্ম নিদর্শন রক্ষিত আছে। জহুরুল হক ১৯৫৩ সালে নোয়াখালী জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৬ সালে জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থেকে ইন্টারমেডিয়েড পাশ করেন এবং ঐ বছরই পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদান করেন। কালক্রমে তিনি 'সার্জেন্ট' পদে উন্নীত হন। এই সময় কোহাটে তাঁর পোস্টিং হয়। ১৯৬৫-৬৮ সালে তিনি ট্রেনিং ইন্সষ্ট্রাকটার হিসেবে করাচীতে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালের ২৬ জানুয়ারী বিমান বাহিনী থেকে তাঁর অবসর গ্রহণ করার কথা ছিল।

১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় ২৮জন বাঙ্গালি অফিসার সহ গ্রেফতার হন সার্জেন্ট জহুরুল হক। যাদের মধ্যে দুজন সিএসপি অফিসারওছিলেন। সরকারীভাবে জানানো হয়, অভিযুক্তরা ভারতীয় অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটিয়ে কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিল। তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকে রাখা হয়। সার্জেন্ট জহুরুল হক স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক সৈনিক ছিলেন। কোনো কারণে কারো কাছে মাথা নত করেননি। ১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ক্যান্টমেন্টে সৈনিকদের খাবারের উচ্ছিষ্ট সংগ্রহের জন্য বাঙালি শিশুরা ভিড় করে। এতে অবাঙালি সৈনিকেরা কয়েকজন অভুক্ত শিশুকে ধরে এনে বন্দী শিবিরের সামনে অমানবিকভাবে প্রহার শুরু করে। কয়েকজন বন্দী এ ঘটনায় প্রতিবাদ জানালে হাবিলদার 'মনজুর শাহ' বন্দীদের নিজ নিজ কামরায় ফিরে যেতে আদেশ করেন। জহুরুল হক সে আদেশ উপেক্ষা করে মনজুর শাহের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এতে মনজুর শাহ প্রচণ্ডভাবে রাগান্বিত হয়ে রাইফেলের বেয়োনেট লাগিয়ে তাঁর দিকে ধেয়ে আসেন। কিন্তু সার্জেন্ট জহুরুল হক পাশ কাটিয়ে আক্রমণকারীর হাত থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেন এবং বিজয়ী বীরের মতো কামরার দরজায় গিয়ে তাকে রাইফেল ফেরত দেন। পরদিন অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ তারিখ ভোরবেলা জহুরুল হক ঘর থেকে বের হলে মনজুর শাহ তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। ঐ গুলিটি তাঁর পেটে বিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে কম্বাইন্ড মিলিটারী হাসপাতাল বা সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হলেও রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে আইয়ুব বিরোধী গণ-আন্দোলন আরো গতি লাভ করে। ব্যাপক গণ-বিক্ষোভের মুখে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটে। তাঁর শহীদ স্মৃতি পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে শাণিত করে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ গণ-আন্দোলনের পথ ধরেই পরবর্তীতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দেশের মুক্তির লক্ষ্যে তাঁর অসামান্য অবদানের কথা বিবেচনায় এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আবাসিক ছাত্রাবাস ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে 'সার্জেন্ট জহুরুল হক হল নামকরণ করেন' বিশ্ববিদ্যালয় কৃর্তৃপক্ষ এবং বিমান বাহিনীর চট্রগ্রাম ঘাঁটিতে সার্জেন্ট জহুরুল হকের নামাংকন করা হয়। বাঙালি-জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে সার্জেন্ট জহুরুল হকের নাম চিরকাল জ্বলজ্বল করে ভাস্বর থাকবে। 'বাঙালি জাতির সূর্য সন্তান' হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে থাকবেন চিরকাল। আজ সার্জেন্ট জহুরুল হকের ৫০তম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১০:৫৫

রাজীব নুর বলেছেন: মহান ব্যাক্তিদের শ্রদ্ধা জানাতে কখনও দেরী করা ঠিক না।

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:৩৭

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
সেই জন্য্ আপনাকে ধন্যবাদ
আপনি কখনোই দেরী করেন না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.