নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যা ছিলো মনে, ছড়িয়ে পড়ুক জনে জনে।

মো: ওমুফা

এই যুদ্ধ, আমার ছায়াকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।

মো: ওমুফা › বিস্তারিত পোস্টঃ

অনুগল্পঃ বুকের ছাতি

১৫ ই জানুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১২:৫৪

রাত বারোটা চল্লিশ, ঢাকার মিরপুর এলাকায় একটা অন্ধকার গলির নিরব রাস্তার মধ্যে হাটতে হাটতে সোবহান ফারাজি অনুভব করেন তার ছাপ্পান্ন বছরের জীবনে আজ দ্বিতীয় বারের মত তার বুকের ছাতি হঠাৎ-ই চওড়া হয়ে উঠছে। চোখে একটু খানি অশ্রুও এসে পরছিলো কিনা তা বুঝার চেতনা পেলো না, পেলো না তার কারণ একটা কুকুরের ডাক। বুকের ছাতি ফুলে উঠার কারণ একটা ফোন কল, তার ছেলের ফোন কল। ফোন কলটা রাখার পর থেকে সোবহান ফরাজির দ্বিতীয়বারের মত মনে হলো তার জীবনের অর্থ আছে, প্রাপ্তি আছে, অর্জন আছে, সবচাইতে বড় কথা তার জীবন মূল্যবান, সে মূল্যবান, এই স্বীকৃতি সে পেয়েছে।
বয়স যখন সতেরো তখন থেকে সোবহান ফরাজি অনেক কিছু করেছে, বাবার বিশাল সংসারটা টেনে নিয়ে এসেছেন নিজের ছোট্ট জোড়া হাতেই। ছোট তিন বোনের বিয়ে থেকে শুরু করে প্রতিবন্ধী বড় ভাইয়ের ফ্যামিলি, খুনের মামলা থেকে বাবার অব্যহতি সবকিছু করে গেছেন নিজ হাতে। কিন্তু তার বাবার মৃত্যুর পর মুহুর্তেই যখন তার প্রতিবন্ধী বড় ভাই জমির ভাগ চাইলেন তখন হঠাৎ-ই সোবহান ফরাজি খেয়াল করলেন সে খুবি অপ্রয়োজনীয়! বাবার মত তার থাকা না থাকায় যেন কারো কিছু আসে যায় না। ভেতরে দুঃখ থাকলেও চেপে রেখেছেন, দুঃখ চেপে কাটিয়ে ফেলেছেন অনেকগুলো বছর। বোনেদের সংসার বড় হয়েছে, বৃদ্ধ মা আরো বৃদ্ধ হয়েছেন, বড় ভাইয়ের সাথে দূরত্ব বেড়েছে, চাউল-ডাল-তেল-দুধের দাম বেড়েছে, তার নিজের ব্যবসা হয়েছে, একটা কলমি ফুলের মতন নরম এবং সুন্দর বউ তার ঘরে এসেছে, সংসার হয়েছে, একটা ছেলে একটা মেয়ে তাকে বাবা ডাকে, একটা একতলা সুন্দর বাড়ি হয়েছে, বাড়ির চারপাশে খড়ের বদলে হয়েছে ইটের দেয়াল, বদল হয়নি শুধু সোবহান ফরাজির রুটিনের। বোন, বোন জামাই, ভাগিনা ভাগ্নী, নিজের পরিবারেরর খোঁজ নেয়া তার নিয়মিত রুটিন। কিন্তু একটু আন্তরিকতার সাথে তার খোঁজ কে কবে নিলো তা সোবহান ফরাজির মনে পড়ে না৷ অবশ্যি সে হয়তো কোনোদিন ভাবেও নি তার খবরও নেয়া উচিত!
কিন্তু একদিন, একদিন সোবহান ফরাজির বারান্দায় বসে একটা পত্রিকা পড়ছিলেন, তার স্ত্রী নূর-জাহান পাশের টুলে এক কাপ চিনি ছাড়া কড়া লিকারের চা রাখতে রাখতে একটু ভীত গলায় জিজ্ঞাসা করলো, 'আপনি কি কোনো ঝামেলায় আছেন? সারারাত এপাশ ওপাশ করেন, রাত্রের মধ্যে পানি খান আট দশ গ্লাস, ঝামেলায় থাকলে বলেন?'
সোবহান ফরাজি একটা ঝামেলায় ছিলেন, কিন্তু স্ত্রীর কথার জবাব দিলেন না শুধু কিছুক্ষন হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকলেন স্ত্রীর নরম মুখটার দিকে৷ সে রাতে ঘুমাতে পারছে না টেনশনে, সে খবর তার স্ত্রী রাখে! প্রায় সাতাশ বছরের সংসার, কই আগে তো রাখে নি, নাকি আগেও রাখতো, বলেনি! ভাবতে ভাবতে সোবহান ফরাজির বুকের ছাতি চওড়া হয়ে উঠতে থাকে, চোখে জল এসে পড়ে সুখে, এ কেমন সুখ! সাথে সাথে চোখ নামিয়ে চায়ের কাপ হাতে নেন। ছোট্ট কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, 'চা ভালো হইছে।' কিন্তু দেখতে পান সেখানে স্ত্রী নেই, চলে গেছে।
সংসার আর দায়িত্বের বোঝা বইতে বইতে সোবহান ফরাজি কখনো কারো বন্ধু হতে পারেন নাই। তার কাছে সব সম্পর্ক এবং জীবনের মূল লক্ষ্য দায়িত্ব নেয়ার ক্ষমতা। সাতাশ বছরের সংসারে স্ত্রী-কে নিয়ে শশুরবাড়ি যাবার মতন ফুসরতও ছিল না তার, কাজে একদিন না যাওয়া মানে একদিনের দায়িত্বে অবহেলা। ছেলে মেয়ের সাথে বসে কোনোদিন দেখা হয় নাই সিনেমা বা বিশ্বকাপ ফুটবল, স্ত্রীর মুখোমুখি বসে খাওয়া হয় নাই এক কাপ দুধ-চিনি বেশির চা।
সবার সাথে সে তার যা দায়িত্ব সে বিষয়ে কথা বলতো, তার সাথে সবাই তাই সেই পরিসীমার বাইরে কখনো যেতো না। এভাবেই চলে যাচ্ছিলো একটা জীবন, একটা সংসার আর অনেকগুলো বছর।
ছেলে-মেয়েদের খুব বেশি শাসন সে কোনোদিন করে নি। কিন্তু নিজের অজান্তে কিভাবে যেন কথার বলারও একটা বৃত্ত এঁকে ফেলছিলেন তা টের পান নি সোবহান ফরাজি নিজেও। ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীও জোড় করেন নি সে বৃত্ত ভেঙে সমান্তরাল রেখা তৈরি করার।
সবার জীবনই চলে যাচ্ছে! কিন্তু সোবহান ফরাজির দুঃখ লাগতো তখন, যখন খাওয়ার টেবিলে স্ত্রী-ছেলের কথা লুকিয়ে শুনতে হতো পাছে সামনে আসলে ওদের গল্প করাও বন্ধ হয়ে যায়! সোবহান ফরাজির কাছে এত লুকোচুরি কেন! তার মনে হতে থাকে এই জীবনের কি দরকার! কি আছে এই জীবনে! দেশের জিডিপি বাড়ে, পেয়াজ-রসুনের দাম বাড়ে, ছেলে-মেয়ের বয়স বাড়ে, নিজের চোখের চশমা লাগে, স্ত্রীর হাতু ব্যথার ওষুধ লাগে এত এত পরিবর্তনের মধ্যে তার জীবনটা সেই একইরকম, অপ্রয়োজনীয়! কিন্তু তবুও সেই অপ্রয়োজনীয় জীবনটাই বয়ে চলতে হয় বছরের পর বছর।
তারপর এক মাঝরাতে ঢাকা শহরের মিরপুর এলাকায় অন্ধকার গলির মধ্য দিয়ে হাটার সময়ে তার স্ত্রীর ফোন আসে। স্ত্রী বলে, 'আপনি পৌঁছাইছেন ঠিকমত?'
সিগারেটে টান দিতে দিতে সোবহান ফরাজি বলেন, 'পৌঁছাইছি, তয় বাসায় ঢুকি নাই। নিচেই আর কি!' স্ত্রী বলে, 'আচ্ছা ঠিক আছে। সাজিদরে ফোন দিয়েন, ও অনেকক্ষণ যাবৎ ট্রাই করতেছিলো। আপনার ফোনে কল যাইতেছিলো না।'
কথাটা শুনে সোবহান ফরাজি সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ভুলে যান, তার কাশি উঠে। কাশতে কাশতেই স্ত্রীকে বলেন, 'দিতাছি।' ছেলেকে ফোন দিয়ে সোবহান ফরাজি বলেন, 'বাস থিকে বারোটার দিকেই নামছি। ফোনে চার্জ আছিলো না, এরজন্য ফোন ঢুকতেছিলো না, বুচ্ছোস? পরে এক হোটেলে বইসা চার্জ দিয়া নিলাম। এহন বাসার নিচেই আছি। গলির মুখে ঐ যে নতুন বড় একটা ফার্মেসি হইছে না? ঐটার সামনে।' ছেলে বলে, 'আচ্ছা।' সোবহান ফরাজি আবার বলেন, 'তুই খাইছোস?' ছেলে বলে, 'হুম।' সোবহান ফরাজি বলেন, 'আচ্ছা তাইলে ঘুমা।' ছেলে বলেন, 'আচ্ছা।'
সোবহান ফরাজি কল কেটে, ফোনটা বুক পকেটে রেখে দেন। কেন যেন তার চোখে পানি চলে আসে, কি এক সুখ, কি এক বেদনায় তার সারাটা বুক হুঁ হুঁ করে ওঠে। হুঁ হুঁ করা সেই বুকের ছাতিটাও ক্রমশই বড় হয়ে উঠতে থাকে, পিছনে থেকে যায় একটা নিরব অন্ধকার গলি আর একটা কুকুরের ডাক।

--- বুকের ছাতি
--- ওমুফা
---০২.০১.২২

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.