নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

www.oputanvir.com

অপু তানভীর

আমার চোখে ঠোঁটে মুখে তুমি লেগে আছো

অপু তানভীর › বিস্তারিত পোস্টঃ

বড় গল্পঃ ইউ এন্ড আই

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৫৫


ছবিঃ গুগল

অফিসে এসে জানতে পারলাম সাদিক ভাইয়ের মন খারাপ। কেবল সাদিক ভাইয়ের না, অফিসের প্রায় সব পুরুষ মানুষের মন আজকে খারাপ। তাদের ভেতরে সাদিক ভাইয়ের মন সব থেকে বেশি খারাপ।

মন খারাপের কারন হচ্ছে, গতকাল রাতে মেহজাবিন আহমেদ তার ফেসবুক রিলেশনশীপ স্ট্যাটাস বদল করেছে। আগে সে সিঙ্গেল ছিল৷ কাল রাত থেকে মিঙ্গেল হয়েছে। এই কারনেই সাদিক ভাইসহ আরও অনেকের মন খারাপ।

গত কয়েক বছর ধরেই বাংলা নাটক আর চলচ্চিত্রের অবস্থা যখন মরমর, তখন এই মেহজাবিন আহমেদের আগমন ঘটে। তার বাবা এই দেশের বিশাল এক ব্যবসায়ী। টাকা পয়সার কোন অভাব নেই। মেয়ের শখ পূরন করতেই একটা ফিল্ম তৈরি করতে রাজি হলেন। বেশ আয়োজন করেই মুভি তৈরি হল এবং সত্যি বলতে কি, মুভিটা আসলেই হিট করে গেল। তারপর আর মেহজাবিন আহমেদকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। খুব বেছে বেছে মুভি করতে শুরু করলো। নায়িকা প্রধান চরিত্রের মুভিগুলোও হিট করলো বেশ। তারপর বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র পুরস্কার ওর ঝুলিতে আসতে সময় লাগলো না। সেরা নায়িকাদের তালিকাতে এবং জনগনের মনে আসন গেড়ে বসতেও সময় লাগলো না।

এই মেয়ে গতদিন তার রিলেশনশীপ স্ট্যাটাস বদলেছে, সাদিক ভাইয়ের মত হাজারো যুবকের মন ভেঙ্গেছে৷

আমি ডেস্কে বসতে না বসতেই সাদিক ভাই বলল, অপু, সুইসাইডের জন্য ভালো কোনো উপায় বলতে পারো ?

আমি অবাক হয়ে বললাম, সেকি!!

সাদিক ভাই বলল, মেহজাবিন অন্য কারো হবে -এটা আমি এই দুচোখ দিয়ে দেখতে পারবো না! কিছুতেই পারবো না।

আমি বললাম, এটা ব্লাফও তো হতে পারে!

সাদিক ভাই বলল, ব্লাফ মানে!

বললাম, আরে ব্লাফ মানে এমনিই বলেছে! আপনি নিশ্চয়ই জানেন সে কতটা জনপ্রিয়। প্রতিদিন কত ছেলে তাকে প্রেম আর বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সেটা থেকে বাঁচার জন্যই হয়তো এই ব্লাফ দিয়েছে!

সাদিক ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে আমি আসলে সত্যিকার অর্থেই কথাটা বলেছি কি না! নাকি কেবল সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলেছি। সাদিক ভাই বলল, সত্যিই বলছো?

আমি বললাম, মিথ্যা কেন বলবো? দেখেন কাল সে কেবল স্ট্যাটাস চেঞ্জ করেছে। কিন্তু মানুষটা কে সেটা কি বলেছে? শুধু বলেছে যে, যাকে সে ভালবাসে সে নাকি খুব সাধারন মানুষ ! এখন আপনিই বলেন তার মত এতো বিখ্যাত একজন মেয়ে সাধারণ একজনকে ভালবাসবে?

দেখলাম সাদিক ভাইয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে এল। বলল, আরে তাইতো ! সত্যি কথা বলেছো তো তুমি ! চল আজকে তোমাকে লাঞ্চ করাবো ! কি খাবা বল!!

এই হচ্ছে সাদিক ভাইয়ের অবস্থা। যাক আপাতত সামলানো গেছে। যদিও আমি কেবল এমনি এমনি কথাটা বলি নি। আমার সত্যি সত্যিই মনে হয়েছে যে মেয়েটা ব্লাফ দিচ্ছে। হয়তো ঝামেলার হাত থেকে বাঁচতেই এমনটা করছে ।

অফিস শেষ করে বাসায় যাওয়ার আগে আমি বাইক নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই। বাড়ি যাওয়ার আসলে কোন তাড়া নেই। বাবা মা দুজনই সন্ধ্যা বেলা একে অপরকে সময় দেন। আমার বাবা খানিকটা রোমান্টিক ধরনের মানুষ। বাংলার প্রফেসর। বেশ কয়েকটা বই বের হয়েছে তার। এই বয়সে এসেও মায়ের প্রতি তার ভালবাসা প্রকাশ করার ভঙ্গি অনেক বেশি রোমান্টিক। মা মুখে যা-ই বলুক তারও ভাল লাগে এইসব। তবে আমি বাসায় থাকলে মা খুব লজ্জা পায়। তাই একটু রাত করেই বাসায় ফিরি আমি।

আজও তাই করছিলাম। শঙ্কর বাসস্ট্যান্ড থেকে চা খেয়ে বাইকে উঠতে যাবো তখনই একটা মেয়ে আমার সামনে এসে দাঁঁড়ালো৷ বলল, ভাইয়া আপনি কি পাঠাও কিংবা উবার রাইডার ! মানে রাইড শেয়ার করেন !

আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। মেয়েটার মুখ একটা ওড়না দিয়ে পেঁচানো। কেবল চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। পোশাক পরিচ্ছদ বেশ ভাল। ভাল ঘরের মেয়েই মনে হচ্ছে। আমি বললাম, সরি, আমি রাইড শেয়ার করি না।

মেয়েটার কন্ঠে হতাশা টের পেলাম!

-ওহ!

হঠাৎ কি মনে হল, বললাম, কোথায় যাবেন আপনি?

মেয়েটা বলল, আসলে আমার পার্স আর ফোনটা হারিয়ে গেছে। সিএনজিতে উঠতে সাহস পাচ্ছি না। কাউকে যে ডাকবো সেটাও পারছি না।

বললাম, বাসা কোথায় আপনার?

মেয়েটি বলল, গুলশান দুই।

বললাম, আচ্ছা যদি সমস্যা না থাকে তাহলে আমার বাইকে উঠতে পারেন। আমি ঐদিকেই যাবো।

মেয়েটা আরও কিছু সময় ইতস্তত করে বাইকে উঠে বসলো। বাঙালি মেয়েদের মত পা দুটো একদিকে দিয়ে বসলো না। দুই পা দুদিকে দিয়েই বসলো। খানিকটা অবাকই হলাম৷ তবে সেই চিন্তা বাদ দিয়ে বাইক স্টার্ট দিলাম।

মেয়েটির বাসার সামনে আসতে ৪৫ মিনিটের বেশি সময় লেগে গেল। মেয়েটি যখন বাইক থেকে নেমে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো, আমি খানিকটা চমকে উঠলাম৷ এই মেয়ে এতো সময় আমার পেছনে বসে ছিল!

মাই গড!

আমার দিকে মিষ্টি করে হেসে মেয়েটি বলল, সরি, আপনাকে একটু মিথ্যা বলেছি। আসলে আমি আমার ব্যাগ মোবাইল কিছুই হারাই নি। মাঝে মাঝে আমি বাসা থেকে কিংবা সুটিং স্পট থেকে এভাবে গায়েব হয়ে যাই। সাথে কিছুই নিই না৷ তবে আজকে সত্যিই একটু ভয় পেয়েছিলাম। ঐদিকটা আসলেই কিছু চিনি না আমি।

আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, এমন করাটা ঠিক না। বুঝেছেন !

মেহজাবিন আবারও হাসলো। আমি বললাম, আচ্ছা ভাল থাকুন। আমি আসি।

-আপনিও ভাল থাকবেন !

আমি বাইক ঘুরিয়ে চলে আসার সময় আরেকবার মেহজাবিনের দিকে তাকালাম। দেখলাম ও হাত নাড়ালো আমার দিকে। আমিও নাড়ালাম। মনের ভেতরে একটা আলাদা ভাল লাগা কাজ করছিল। আমি মেহজাবিনের জন্য সাদিক ভাইয়ের মত পাগল না হলেও এটা স্বীকার করতে দোষ নেই যে মেয়েটা সত্যিই সুন্দরী আর খুব চমৎকার অভিনয়ও করে। আর আজকে যে কাজটা করলো সেটা যদি নিয়মিত করে থাকে তাহলে মেয়েটার মাঝে এখনো ছেলেমানুষী রয়ে গেছে ৷ এমন মেয়েকে সবাই পছন্দ করতে বাধ্য ৷



দ্বিতীয় পর্ব


বাসায় পৌঁছেও আমার কেবল মেহজাবিনের কথাই মনে পড়তে লাগলো । এমনভাবে মেহজাবিনের সাথে কোন দিন যে আমার পরিচয় হতে পারে সেটা আমি কখনো ভাবিও নি । সাদিক ভাইকে যদি কথাটা বলি তাহলে কি সে বিশ্বাস করবে ? আমার মনে হয় না যে সে করবে । সে কেন অন্য কেউই করবে না । যদি একটা ছবি তুলে রাখতাম তাহলে হয়তো বিশ্বাস করতো ।

কিন্তু আমার কাউকে বলার দরকার পড়লো না । সবাই এমনিই জেনে গেল মেহজাবিনের সাথে আমার দেখা হওয়ার ব্যাপারটা । এমনভাবে জেনে গেল যে আমি নিজেই অবাক হতে পর্যন্ত পারলাম না । অন্তত আমি নিজে এমনটা ভাবি নি ।

পরদিন অফিস গিয়ে হাজির হতেই আবিস্কার করলাম যে মানুষ জন যেন কেমন চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে । আমি মানুষের সাথে মোটামুটি ভাল ব্যবহার করে চলি । সবার সাথেই আমার সম্পর্ক ভাল, কিন্তু আজকে সবাই আমাকে কেমন যেন এড়িয়ে চলছে । সব থেকে অবাক লাগলো সাদিক ভাইয়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে । সে আমার দিকে এমন চোখে তাকালো যেন আমাকে সে চেনেই না । কিংবা আমি তার জীবনের অনেক বড় কোন ক্ষতি করে দিয়েছি । কেমন কাটা কাটা কন্ঠে কথা বলতে লাগলো । আমি সত্যিই বুঝতে পারলাম না যে কি বলবো আর কি করবো !

দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারের পর আসল কাহিনী বুঝতে পারলাম । ব্যাপারটা ধরতে পারার পর একটা তীব্র বিস্ময়বোধ আমাকে পেয়ে বসলো । অন্তত আমি তো কোন ভাবেই ভাবি নি যে এমন ঘটনা আমার সাথে ঘটতে পারে । গতদিন যে মেহজাবিন আহমেদ আমার বাইকের উঠেছিলো সেটা কিভাবে যেন মানুষ জেনে ফেলেছে ।

আমার মনে আছে যে বাইকে ওঠার সময় মেহজাবিনের চেহারাটা নেকাব দিয়ে ঢাকা ছিল । তাই প্রথমে তাকে আমি চিনতে পারি নি । কিন্তু বাইকে চলার পথে মেয়েটা তার নেকাব খুলেছিলো । যদিও আমি সেটা বুঝতে পারি নি । সে যেহেতু আামর পেছনে ছিল তাই দেখতে পারি নি । নেকাব খোলা অবস্থায় সে আমার পেছনে বসেছিলো, মোবাইল টিপছিলো, এই ছবি রাস্তার কেউ তুলেছে । সিগনালে থামতে হয়েছে । যারা মেহজাবিনকে চিনতে পেরেছে তারা দেরি না করে ছবি তুলে ফেলেছে। এবং সেটা সোস্যাল মিডিয়াতে দিয়েছে !

আমি তখন ব্যাপারটা ভাবতে শুরু করলাম । মেহজাবিন কেবল একদিন আগেই সোস্যাল মিডিয়াতে বলেছে যে তার বয়ফ্রেন্ড আছে এবং সে একজন সাধারন মানুষ । মিডিয়া জগতের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই । এবং তার পরদিনই দেখা গেছে যে সে একটা ছেলের বাইকে বসে আছে । মানুষজন ধরে নিয়েছে যে বাইকে বসা ছেলেটা মানে আমি হচ্ছি তার সেই বয়ফ্রেন্ড !

আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না । আমি জানি এখন আমি সাদিক ভাই কিংবা অন্য সবাইকে যতই বোঝাতে চাই না কেন তারা কোন ভাবেই এই কথাটা বিশ্বাস করবে না যে আমি মেহজাবিন আহমেদকে চিনি পর্যন্ত না । আমার সাথে কেবল ভাগ্যক্রমে দেখা হয়েছিলো তার ! আমি কাউকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম না । চুপচাপ কাজ করে যেতে লাগলাম ।

বিকেল হতে না হতেই সবগুলা অনলাইন পত্রিকাতে আমার আর মেহজাবিনের ছবি চলে এল । আগে তো কেবল সোস্যাল মিডিয়ার মানুষগুলো জেনেছিলো, এখন অনলাইনের মোটামুটি সবাই জেনে গেল যে মেহজাবিন আহমেদ আমার গার্লফ্রেন্ড ! আমি আমার ফেসবুক আইডি বন্ধ করে বসে থাকলাম । আমার প্রোফাইল খুঁঁজে বের করতে মানুষের খুব একটা সময় লাগার কথা না । এর থেকে কিছু সময় বন্ধ থাকুক !

আজকে অফিস থেকে বের হয়ে সোজা বাসায় গিয়ে হাজির হলাম । আজকে বাইরে ঘোরাঘুরি করতে ইচ্ছে করলো না । এই ঘোরাঘুরি করতে গিয়েই যত ঝামেলা শুরু হয়েছে । বাসার দরজা খুলতেই মা আমার দিকে অদ্ভুত চোখে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, ওই মেয়েটার সাথে তোর কতদিনের সম্পর্ক ?

আমি বুঝতে পারলাম যে বাসাতেও এই খবর চলে এসেছে । কিন্তু কিভাবে চলে এল সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না । মা কিংবা বাবা কেউই ঠিক অনলাইনের মানুষ না । দুইজনের কেউই স্মার্টফোনও ব্যবহার করে না । তাহলে তাদের কাছে এই খবর কিভাবে পৌঁঁছালো ? একবার মনে হল তাদের কাছে জানতে চাই কিভাবে এই কথা তারা জানলো । তারপর মনে হল দরকার নেই । এখন এই কথা কেউই ঠিক বিশ্বাস করতে চাইবে না । এমন কি মা-ও না । আমি কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম । মাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলাম । মা পেছন থেকে কন্ঠস্বর খানিকটা উচু করেই বলল, কি হল, জবাব দিলি না ?

আমি ঘুরে বললাম, শুনে কি করবা তুমি ?

-জানতে পারি না আমি ?

-এখনও কিছু হয় নি বলার মত । যখন হবে তখন বলব !

-তার মানে সত্যিই কিছু চলছে ?

-জানি না । সারা দিন অফিসে এমনিই সময় ভাল যায় নি । আমি এখন ফ্রেশ হয়ে ঘুমাবো !

আমি আর কোন কথা না বলে নিজের রুমের দিকে চলে গেলাম । বাথরুমে গোসল করতে করতে ভাবতে লাগলাম সামনের দিনগুলোতে আমার সাথে আর কি কি ঘটতে পারে । আমি অন্তত বাঙালী পুরুষদের ব্যাপারে একটা কথা খুব ভাল করে বলতে পারি । যখন তারা দেখে যে তাদের নিজের প্রেমিকা কিংবা বউয়ের থেকে অন্যের প্রেমিকা কিংবা বউ বেশি সুন্দরী, তখন আপনা আপনিই সেই মানুষটার ব্যাপারে একটা বৈরি মনোভাব চলে আসে তাদের মনের ভেতরে । তাকে শত্রু ভাবা শুরু করে । কারনে অকারনে তার পেছনে লেগে থাকতে পছন্দ করে, তার নামে নানান কথা ছড়াতে শুরু করে ।

আমি জানি এরপর থেকে আমার সাথেও ঠিক এই ব্যাপারগুলো ঘটতে শুরু করবে । আমাদের অফিসে মিলি রায়হান নামের এক এপ্লোয়ি আছে । ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করে । মেয়েটার পেছনে আমি মাঝে কদিন ঘুরেছিলাম । ঘুরেছিলাম বলতে সরাসরি কিছু করিনি কোনদিন । তবে আমার কেন জানি মনে হয়েছে যে মেয়েটা বুঝতে পেরেছিলো আমি তার প্রতি আগ্রহী । তবে সে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি । এই ব্যাপারটা আমি সাদিক ভাইকে বলেছিলাম । আমার এখন ভয় হচ্ছে যে কদিনের ভেতরেই এই কথা অফিসের সবার কানে পৌঁঁছে যাবে । সবার মাঝেই একটা ধারনা জন্মাবে যে আমি একই সাথে অনেক মেয়ের পেছনে ঘুরি, আমার স্বভাব চরিত্র ভাল না ।

দুদিনের ভেতরেই আমি ব্যাপারটা টের পেয়ে গেলাম । অফিসের সবাই আমার প্রতি অন্য রকম আচরন করা শুরু করেছে । দু একটা টিটকারিও শুনতে পেলাম । কি করবো ঠিক বুঝতেও পারছিলাম না । কয়েকজনকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমি সত্যিই মেহজাবিনের প্রেমিক নই । এর ভেতরে অন্য কাহিনী আছে । কিন্তু কেউ বিশ্বাস করলো না । উল্টো সবাই আরও বলতে শুরু করলো যে আমি এটা লুকাতে চাচ্ছি যাতে করে অন্য মেয়েদের সাথে লাইন মারতে পারি । আমি মানুষকে বোঝানো বাদ দিয়ে দিলাম । এমন এক বিপদে পড়েছি যে এর থেকে বের হওয়ার কোন উপায় আমার জানা নেই ।

তবে তখনও আমার বিপদে পড়া আরও খানিকটা বাকি ছিল । অফিস থেকে বের হয়ে বাইকের কাছে গিয়ে হাজির হয়েছি, এমন সময় একজন আমার কাছে এসে দাঁঁড়ালো । আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় ।

আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, কিছু বলবেন ?

মানুষটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে আমার মতই বয়স হবে তার । বেশ সুদর্শন চেহারা । পোশাক পরিচ্ছদ দেখেই বুঝতে পারলাম যে বেশ বড়লোক ঘরের ছেলে । ছেলেটা নিজের মোবাইল বের করে কি যেন করলো । তারপর স্ক্রিনটা আমার দিকে ধরে বলল, এটা আপনি ?

ছবিটার দিকে তাকিয়েই আমার মনটা বিষিয়ে গেল । আমার আর মেহজাবিনের ছবি । মেহজাবিন আমার বাইকের পেছনে বসে আছে !

আমি বললাম, দেখেন ভাই সাহেব, খুব বিপদে আছি । পরিচিত কেউ আামর কথা বিশ্বাস করছে না । আপনি আর প্লিজ কিছু জানতে চাইবেন না !

ছেলেটা হাসলো । তারপর বলল, আমি বিশ্বাস করি যে আপনি মেহেজাবিনের বয়ফ্রেন্ড নন ।

আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম, সত্যিই বিশ্বাস করেন ?

ছেলেটা হাসলো । তারপর বলল, হ্যা, করি ! আমি জানি আপনি মেহজাবিনের বয়ফ্রেন্ড নন ।

আমি বললাম, এতোটা শিওর হয়ে কিভাবে বলছেন ?

ছেলেটা বলল, কারন আমি ওর বয়ফ্রেন্ড !



পর্ব তিন


আমি খুশি হয়েছিলাম যে যাক, অন্তত একজন মানুষ পাওয়া গেছে যে বিশ্বাস করে যে আমার সাথে মেহজাবিনের কোন কিছু চলছে না । আর একেবারে মেহজাবিনের বয়ফ্রেন্ডকে সামনে পাওয়াতে মনে হয়েছিলো যে এইবার আমার সমস্যার সমাধান হবে । বিখ্যাত মানুষের হাজব্যান্ড/প্রেমিক হওয়ার ভেতরে অনেক ঝামেলা আছে যা আমি ইতিমধ্যেই টের পেয়ে গেছি খুব ভাল ভাবেই । তাই আমি যেকোনভাবেই এই ঝামেলার হাত থেকে মুক্তি চাই ।

কিন্তু সামনে বসা মানুষটা যা বলল তাতে আমার চোখদুটো আরও একটু কপালে উঠলো । মেহজাবিনের বয়ফ্রেন্ডের নাম আকিব রায়হান । নামটা আমার কেমন যেন পরিচিত মনে হচ্ছিলো, তবে ঠিক মনে করতে পারছিলাম না । আকিব নিজের ব্যাপারে খুব বেশি কিছু বলল না । কেবল বলল যে পারিবারিক ব্যবসার ভেতরে আছে সে !

আমি আকিবকে বললাম, ভাই সাহেব, আমাকে দয়া করে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন, প্লিজ !

আকিব হাসলো । তারপর বলল, দেখুন, অবশ্যই উদ্ধার করবো । কিন্তু এখন যদি আমি গিয়ে বলি যে আপনি নন, বরং আমিই হচ্ছি মেহজাবিনের বয়ফ্রেন্ড, তাহলে ব্যাপারটা কেমন যেন হয়ে যাবে না ! ওর একটা রেপুটেশনের ব্যাপার আছে । আমার বেলাতেও তাই ।

-তাহলে ? এখন কি করনীয় ?

-এখন একটা সহজ উপায় আছে ।

-কি ?

-এখন আপাতত কদিন এভাবেই চলুক । আপনি ওর বয়ফ্রেন্ডের ভূমিকাতে অভিনয় করুন । তারপর কদিন পরে ও আপনার সাথে ব্রেকআপ করবে । কিছু দিন একা একা থাকবে । মানে সবাই জানবে যে একা আছে, কষ্টে আছে ।

-কিন্তু .....

-দেখুন, অপু সাহেব ! ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা করুন । আমরা কেউই ইচ্ছে করে এই পরিস্থিতিটা ডেকে আনি নি । বুঝার চেষ্টা করুন, প্লিজ !

আমি আরও কয়েকবার নিজের ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু কাজ হল না । আকিব সাহেব যা বললেন সেটা ছাড়া অন্য কোন উপায় বের হল না । আমি মন খারাপ নিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলাম । এই কয়টা দিন তো মনে হচ্ছিলো যে একটা সময়ে মেহজাবিন নিজেই একটা না একটা কিছু বলবে । আমি সেই অপেক্ষাতেই ছিলাম । হয়তো নিজেই বলবে যে আমার সাথে ওর কিছু চলছে না । আমাকে সে চিনে পর্যন্ত না । কিন্তু এখন সেই আশাটাও চলে গেল ।

রাতে খাওয়ার সময় মা হঠাৎ বলল, মেয়েটাকে একদিন বাসায় নিয়ে আয় !

আমি প্রথমে ঠিক বুঝতেই পারলাম না যে মা কোন মেয়ের কথা বলছে । বললাম, কোন মেয়েকে বাসায় নিয়ে আসবো ?

মা বিরক্ত কন্ঠে বলল, কোন মেয়ে মানে ? তোর কয়জনের সাথে সম্পর্ক ?

আমি তখন বুঝতে পারলাম যে মা মেহজাবিনকে বাসায় নিয়ে আসতে বলছে । এবার আমিই খানিকটা বিরক্ত কন্ঠে বললাম, আগে আমার সাথে দেখা হোক, তারপর তোমার সাথে দেখা করিয়ে দিবো ।

আকিব সাহেবের সাথে কথা বলে আমার একটা ধারনা হয়েছিলো যে আমাদের এই ব্যাপারটা এই রকম ভাবেই চলতে থাকবে । আমাদের মাঝে কোনদিন দেখা হবে না । কিছুদিন পরে মেহজাবিন নিজের ফেসবুকে হয়তো স্ট্যাটাস দিবে সে সিঙ্গেল হয়ে গেছে । তখন সবাই বুঝে নিবে যে আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে । কিন্তু আমার ধারনাতে বেশ খানিকটা ভুল ছিল। সেটা আমি বুঝতে পারলাম পরদিন অফিসে গিয়েই । লাঞ্চ আওয়ারের কিছু আগে হঠাৎ করেই অফিসে বেশ হইচই শুনতে পেলাম । অন্য সময় হলে আমি নিজে গিয়ে হাজির হতাম কি হয়েছে সেটা দেখার জন্য । কিন্তু আজকে ইচ্ছে হল না ।

খানিকক্ষণ বাদে দেখলাম পিয়ন এসে হাজির হল আমার ডেস্কের সামনে । আমার দিকে তাকিয়ে বিগলিত হাসি দিয়ে বলল, স্যার, আফা মনি আইছে।

-আফা মনি ? কোন আফা মনি !

-আপনে জানেন না সে আইবো ?

-কে আসবে ?

পিয়নকে কিছু বলতে হল না । তার আগেই আমি আমার দরজার সামনে তাকে দেখতে পেলাম !

দরজা উজ্জ্বল করে মেহজাবিন দাঁঁড়িয়ে আছে । একটা নীল হলুদ রঙের কামিজ পরে আছে সে, সাথে সাদা ওড়না আর সাদা লেগিংস । ওকে দেখতে সত্যিই অনেক সুন্দর লাগছে । মনে হচ্ছে যেন এই পোশাকটা কেবল এই মেয়েটার জন্যই বানানো হয়েছে ।

আমি সত্যিই ভাবতে পারি নি যে মেহজাবিন এখানে এসে হাজির হবে । আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না ।

মেহজাবিন আমার ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালো । তারপর একটু হেসে বলল, সরি, না বলেই চলে আসলাম । কিছু মনে করনি তো ? আসলে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছি !

আমি তখনও কোন কথা বলতে পারছি না । আসলে কি বলবো সেটা বুঝতেই পারছি না ।

কিন্তু মেহজাবিন একজন পাকা অভিনেত্রী । সে ঠিকই বুঝতে পারলো যে আমি খুবই অপ্রস্তুত হয়ে গেছি । সে পরিস্থিতি সামলে নিল । তার পেছনে তখন অফিসের অনেকেই ভীড় করেছে । সবার আগে রয়েছে সাদিক ভাই । মেহজাবিন বলল, আগে তোমার কলিগদের সাথে পরিচয় করিয়ে দাও দেখি !

আমি সবার আগে সাদিক ভাইয়ের দিকে তাকালাম । তার চোখে একটা তীব্র আগ্রহ আমার চোখ এড়ালো না । সে যেন এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না যে মেহজাবিন আহমেদ তার সামনে দাঁঁড়িয়ে আছে । কয়েক ফুট দুরত্বেই । আমি সবার আগে সাদিক ভাইয়ের সাথেই পরিচয় করিয়ে দিলাম । মেহজাবিন খুব আন্তরিকভাবেই সাদিক ভাইয়ের সাথে হাত মেলালো ! এরপর একে একে সবার সাথেই পরিচিত হল । সবার সাথেই ছবি তুলল । এমন কি আমাদের ম্যানেজার সাহেবের সাথেও সেলফি তুলল । তারপর ম্যানেজারকে বলে আমার ছুটির ব্যবস্থা করলো । বলল যে আমাকে নিয়ে সে বাইরে যেতে চায় । লাঞ্চ আওয়ারের পরে যেন আমাকে ছুটি দেওয়া হয় । এই অনুরোধ ফেলে দেওয়ার মত মানুষ কেউই নেই । ম্যানেজার সাহেবও ফেলতে পারলেন না । ছুটি দিয়ে দিলেন । পার্কিং এসে দেখলাম মেহজাবিন কাকে যেন ফোন করলো । ফোনেই বলল, গাড়ি নিয়ে চলে যাও !

কিছু সময় নিরবতা । তারপর আবার বলল, আমার যাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হবে না । তুমি চলে যাও । ... হ্যা, হ্যা, গ্যারেজে রেখে দিয়ে তোমার ছুটি !

ফোন রেখে দিয়ে এবার মেহজাবিন আমার দিকে তাকালো । তারপর বলল, তো মিস্টার বয়ফ্রেন্ড ! চলুন !

-আপনি আমার বাইকে উঠবেন ?

মেহজাবিন হাসলো । তারপর বলল, বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডকে আপনি করে বলছে ! ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই ভাল শোনাচ্ছে না ।

-আসলে আমি .....

মেহজাবিন বলল, অল্প কটা দিন । এখন ঝামেলা হয়ে গেছে কি করবো বল ! চল আজকে তোমার বাইকে উঠে পড়ি । যেদিকে ইচ্ছে যাওয়া যাবে !

আমি আর কোন কথা বললাম না । মেহজাবিনকে নিয়ে বাইকে উঠে বসলাম । তারপর শহরের মাঝেই কিছু সময় এদিক ওদিক ঘুরলাম । মাঝে মাঝে যখন বাইক সিগনাল জ্যামে থামছিলো, আমি আমার চারিদিকে কেবল মানুষের বিস্ময় মাখানো চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম । সত্যি বলতে কি আমার খারাপ লাগছিলো না ।

শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে হাজির হলাম আমরা । বসিলা ব্রিজ পার হয়ে বেশ কিছু দূর গেলেই একটা খোলা মাঠ আছে । গাছের ছায়াতে বসলাম ওকে নিয়ে । কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । আমার তখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে দেশের সব থেকে কাঙ্খিত মেয়েটা আমার পাশে বসে আছে ।

মেহজাবিন বলল, দেখো, খুব বেশি দিন এই কাজটা করতে হবে না । ঠিক আছে ?

-কিন্তু আমি তো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবো না ।

-নাহ ! খুব একটা সমস্যা হবে না । এদেশের মানুষকে তো চেনোই । বেশিরভাগই হুজুগে । কদিন পরে যখন নতুন টপিক পাবে তখন সেটার দিকে ঝুকে যাবে । তবে হ্যা, একটু তো বদলাবেই । আই এম সরি ! আসলে বুঝতে পারি নি !

কিছু সময় আমরা কেউ কোন কথা বললাম না । নিজের মনকে বুঝালাম যে যা হয়ে গেছে সেটার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আপাতত আর কোন উপায় নেই । আমি বললাম,

-আচ্ছা এই যে তোমার বয়ফ্রেন্ডের ভূমিকাতে অভিনয় করছি, এতে কতখানি সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে ?

মেহজাবিনের চোখে দুষ্টামী দেখতে পেলাম । সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কতখানি সুযোগ চাও শুনি ?

-আমি ভাল ছেলে !

-হ্যা, তা তো দেখতেই পাচ্ছি !

এই বলে হেসে উঠলো জোরে । তারপর বলল, হাত ধরতে পারো । অভিনয়ের সাথে যুক্ত আছি তাই হরহামেশাই হাত ধরতে হয় !

আমি বললাম, নাহ ! কিছুই চাই না । এমনি বললাম কথাটা ! আমার কাছে প্রিয় মানুষটার হাত ধরা, তাকে চুমু খাওয়ার মাঝে কোন অভিনয় নেই । এটা যখন আমি অনুভব করবো তখনই করবো । কোন দরকার থেকে নয় ! তোমার বেলায় সেটা হবে না । তাই থাকুক আপাতত !

মেহজাবিনকে দেখলাম বেশ খুশি হল কথাটা শুনে !

বাসায় গিয়ে ফেসবুক ওপেন করে দেখতে পেলাম মেহজাবিন আমার অফিসে তোলা ছবিগুলোর বেশ কয়েকটা শেয়ার দিয়েছে । বাইকে যখন ও আমার পেছনে বসে ছিল সেই সময়েও বেশ কিছু ছবি তুলেছিলো, সেগুলো থেকে কয়েকটা ছবি সে আপলোড দিয়েছে । আবারও আমি আলোচনায় চলে এলাম । এবার আমি আর নিজের ফেসবুক আইডি ডিএকটিভ করলাম না ।

পরদিন অফিসে গিয়ে পড়লাম নতুন এক ঝামেলাতে । ম্যানেজার সাহেব আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন । খামটা খুলে একটু অবাক হলাম । আমার বেতনে একটা ভাল পরিমানের ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়েছে । বুঝতে কষ্ট হল না যে এমনি এমনি বছরের মাঝখানে এসে এই ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার কথা না । এর ভেতরে অন্য কোন মতলব আছে । সেটা বুঝতে পারলাম একটু পরেই ।

ম্যানেজার সাহেব আমাকে চেয়ারম্যান স্যারের রুমে নিয়ে গেলেন । তারপর তারা দুজন মিলে আমাকে যা বললেন তার অর্থ হচ্ছে, আমাদের প্রোডাক্টের ব্রান্ড এম্বাসেডর হিসাবে তারা মেহজাবিনকে চায় । এবং আমার দায়িত্ব হচ্ছে মেহজাবিনকে রাজি করানো । যে কোন ভাবে সেটা করতেই হবে । আমি তার বয়ফ্রেন্ড, এইটুকু তো আমি করতেই পারি !

আমি কিভাবে তাদেরকে বোঝাবো যে যে আসল ঘটনাটা অন্য কিছু । আমি জানতাম, যে ঝামেলার ভেতরে আমি পড়েছি, তাতে একের পর এক ঝামেলা আসবেই ।

প্রথম দুদিন আমি মেহজাবিনকে কোন কিছুই বলতে পারলাম না । অফিস থেকে আমাকে এক সপ্তাহের সময় দেওয়া হয়েছে । এর ভেতরেই মেহজাবিনকে রাজি করাতে হবে । আমি কিভাবে সেটা বলবো বুঝতেই পারছিলাম না । নিজেকে কেমন যেন ছোট ছোট মনে হচ্ছিলো ।

কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে মেহজাবিন নিজেই আমাকে বলল । খানিকটা রাগ দেখিয়েই বলল, তুমি কেন বলনি আমাকে ?

-কি বলি নি ?

-এই যে তোমাদের প্রোডাক্টের ব্রান্ড এম্বাসেডর বানাতে চায় আমাকে ?

-না মানে তুমি কিভাবে জানলে ?

-তোমার অফিস থেকে আমার ম্যানেজারের কাছে একটা চিঠি এসেছে । নামটা আমি প্রথমে চিনতে পারিনি । আমি না-ই করতে যাচ্ছিলাম তখনই কেমন যেন সন্দেহ হল । নামটা কেমন পরিচিত মনে হল । তারপর তোমার কার্ড বের করে দেখলাম যে তোমার কোম্পানী !

-আসলে ....

মেহজাবিন বলল, তুমি আমাকে প্রেমিকা না ভাবতে পারো অন্তত বন্ধুতো ভাবতে পারো, নাকি ? আমার কারনে তুমি ঝামেলার ভেতরে পড়েছো এবং সেটা মেনেও নিয়েছো ! সামান্য এই কাজটুকু আমি করতে পারবো না ?

-আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারি নি ।

-বুঝে নাও । ঠিক আছে ! আমি কাল আসবো তোমাদের অফিসে । বিকেলের দিকে একটা ফ্রি সিডিউল আছে । এই ধর চারটার দিকে । তোমার অফিসে বলে রেখো সব কাগজপত্র ঠিক করে রাখতে !

আমার মনটা কেন জানি ভাল হয়ে গেল । মেহজাবিন ঠিকই বলেছে । প্রেমিকা না-ই হোক, অন্তত বন্ধুতো তাকে ভাবতেই পারি । এতে তো কোন সমস্যা নেই ।





পর্ব চার



অফিসে আমার দামটা হঠাৎ করেই বেড়ে গেল। বিশেষ করে ম্যানেজার স্যার আমার উপর বিরাট খুশি। আমার কারনেই আমাদের প্রোডাক্টসের ব্র্যান্ড এম্বাস্যাডর হিসাবে মেহজাবিনকে পাওয়া গেছে। একটা ব্যাপারে আমি খুব বেশি অবাক হলাম যখন জানতে পারলাম যে মেহজাবিন এই কাজটা করতে কোন টাকা নেয় নি৷ যেন সত্যি সত্যিই সে আমার প্রেমিকা। আমার অফিস থেকে তাই অর্থ নেওয়াটা মোটেই ভাল দেখায় না। আমার নিজের কাছেও কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। অফিসের সবাই আমার দিকে কেমন চোখে তাকায়। আগে যে সবাই আমাকে অপছন্দ করতো, এখনও করে কিন্তু এখন তাদের চোখের দৃষ্টি অন্য রকম৷ সবার চোখে যে ঈর্ষা সেটা আমি বুঝতে পারি৷ মিথ্যা হলেও এই ঈর্ষা আমি উপভোগ করতে থাকি। আমার সত্যিই ভাল লাগে।

ফেসবুকে মেহজাবিনের সাথে তোলা একটা ছবিই আমার প্রোফাইল পিকচার হিসাবে সেট করা৷ আমি ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকি কেবল। আমার ভাবতে ভালই লাগে। তবে আমি জানি এই সব খুব জলদিই শেষ হয়ে যাবে৷ আমি আবার সাধারণ কেউ হয়ে যাবো। খুব ভাল করেই বুঝতে পারছিলাম যে যেদিন ব্রেকআপের সংবাদটা সবার কাছে পৌছাবে সেদিন আমার দিকে সবাই করুন চোখে তাকাবে৷ অফিসের সবাই খুব খুশি হবে৷ আমাকে নিয়ে কটাক্ষ আর মশকরা চলবে সেদিন।

কিন্তু সেই সব কিছু হওয়ার আগেই নতুন আরেক ঝামেলা এসে দেখা দিল। অফিস থেকে মাত্র বাসায় এসে হাজির হয়েছি। দরজার সামনে এসেই মনে হল বাসায় মেহমান এসেছে। আমি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম পায়জামা পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক আব্বুর সাথে বসে গল্প করছে হাসি মুখে ৷ আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন দুইজনই। তাদের পাশেই ডায়নিংয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি আম্মুর সাথে আরেক মহিলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টেবিল গোছাচ্ছে আর গল্প করছে। দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে তারা কত দিনের পরিচিত বান্ধবী। ভদ্রমহিলার চেহারা কেমন যেন পরিচিত মনে হল৷

কোথায় যেন দেখেছি!

কোথায় দেখেছি ! আরে ইনি তো.....

আমার মুখ খানিকটা হা হয়ে গেল। আম্মুর সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করা মহিলাটি আর কেউ নন, মেহরুমা আহমেদ, মেহজাবিনের আম্মু। ইনিও এক সময় নামকরা অভিনেত্রী ছিলেন৷ এখন অবশ্য অভিনয় ছেড়ে দিয়েছেন। মাঝে মধ্যে টিভিতে কিংবা পত্রিকাতে দেখা যায়৷

তাহলে বাবার সাথে গল্প করা মানুষটা নিশ্চিতভাবেই মেহজাবিনের বাবা। কিন্তু উনারা এখানে কি করছে? কি সর্বনাশের কথা!

আমাকে বাবা ডাক দিলো৷ আমি খানিকটা দ্বিধা নিয়েই তাদের পাশে গিয়ে বসলাম। মেহজাবিনের বাবা আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন। তারপর বললেন, মেহজাবিন একদমই ওর মায়ের মত হয়েছে। নীপু যা করেছে ও তা-ই করতে যাচ্ছে!

নীপু নিশ্চয়ই মেহজাবিনের মায়ের ডাক নাম। আমি খানিকটা দ্বিধান্বিত কন্ঠে বললাম, কি করতে যাচ্ছে?

মেহজাবিনের বাবা হাসলো৷ তার কিছু বলার আগেই আমার বাবা বলল, আরে তুই জানিস না এই গল্প? মেহরুমা আহমেদ আমাদের সময়কার জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন। তারপর আমরা একদিন শুনতে পেলাম তিনি নাকি দুম করে বিয়ে করে ফেলেছেন। তাও ফিল্ম জগতের কাউকে না। একজন ব্যাংকারকে।

মেহজাবিনের বাবা বলল, আসলে কোথা থেকে যে কি হয়ে গিয়েছিল আমরা দুজনের কেউই ঠিক বলতে পারবো না। এখন দেখো মেহজাবিনও ঠিক একই ভাবে একই পথে যাচ্ছে। আমাদের জীবনটা যেমন আনন্দময় হয়েছে, তোমাদের জীবনটাও তেমনি হবে আশা করি! তা বিয়েটিয়ে করার প্লান আছে তো! দেখো, এসব কাজে একদম দেরি করতে নেই।

আমি কি বলবো খুঁঁজে পেলাম না। কি বলা উচিৎ এখন?

সবার চোখে মুখে কেমন আনন্দ দেখতে পাচ্ছি। সবাই কেমন হাসি আর আনন্দের মাঝে মেতে আছে৷ আজই উনারা এখানে আসলেন কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে কত দিন ধরেই না উনারা পরিচিত! এখন যদি সত্য কথাটা উনারা জানতে পারেন, তাহলে সবার মনোভাব কেমন হবে!

আমি নিজের ঘরে চলে এলাম৷ আমার মনটা খারাপ হয়ে রইলো। কোন মিথ্যার ফলই ভাল হয় না৷ মিথ্যার ফলে সব সময় ক্ষতিই হয়৷ আমি জানি যখন আসল সত্যটা আমার বাবা মা জানবে তখন তারা কষ্ট পাবে!

পরদিন সকাল বেলা মেহজাবিন আমাকে ফোন দিলো । আমি তখন নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলাম । গত রাতে যে ওর বাবা মা আমাদের বাসাতে এসেছিলো সেটা আমি ওকে জানাই নি । কিছু জানাতেও ইচ্ছে হয় নি । মেহজাবিন ফোন দিয়ে খানিকটা রাগতস্বরে বলল, বাবা মা যে তোমাদের বাসায় গিয়েছিলো সেটা আমাকে বল নি কেন ?

আমি বললাম, কেন, তারা বলে নি?

-না । আমি ড্রাইভারের কাছ থেকে জানতে পারলাম ।

-আমি ভাবলাম যে হয়তো বলেছে তোমাকে !

-তুমি মানে বুঝতে পারছো এসবের ?

-আমি কি করবো ?

-তুমি কি করবে মানে ? তুমি এমন একটা ভাব করছো যেন এসবে তোমার কোন মত নেই । তুমি তো চাও এই, তাই না ?

মেহজাবিনের কন্ঠের ভেতরে কেমন যেন একটা ভৎর্সনার সুর ছিল । কাল রাত থেকেই আমার মনটা খানিকটা খারাপ ছিল । আমার সাথে যা-ই হোক সেটা একটা আলাদা ব্যাপার ছিল । কিন্তু যখনই এখানে ফ্যামলি যুক্ত হয়ে গেছে তখন ব্যাপারটা অন্য রকম হয়ে গেছে । বারবার মনে হচ্ছে যে কাজটা করা মোটেও ভাল হয় নি । তার উপর মেহজাবিনের এমন কথা ! আমার মাথার ভেতরে হঠাৎ বিদ্রোহ করে উঠলো । আমি খানিকটা চিৎকার করে উঠে বললাম, আমি চাই ? রিয়েলি ? তোমার মাঝে কৃতজ্ঞতা বোধ নেই একদম ! নিজেকে কি ভাবো বল ? এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেটার জন্য আমি দায়ী ? আমার কোন কাজে এই সব হচ্ছে ? আমার বিন্দু মাত্র ইনভল্টমেন্ট আছে এসবের ভেতরে ? বল আছে ? আর তুমি বলতেছো যে আমি চাই?

আমি আর কিছু না বলে ফোনটা কেটে দিলাম । ফোন কাটার পরে চারিদিকে তাকিয়ে দেখি সবাই আমার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে আছে । আমি অফিসে খুবই শান্ত শিষ্ট স্বভাবের মানুষ । কারো সাথেই কখনই জোর গলাতে কথা বলি না । আর সেই আমি কিনা ফোনে এতো জোরে জোরে কথা বলছিলাম!

তারপর ঘটনা ঘটলো খুব দ্রুত । ঐ দিন রাতে মেহজাবিন তার ফেসবুক স্ট্যাটাস বদলে ফেলল । ছোট করে একটা স্ট্যাটাসও দিল । সেখানে সে লিখলো যে একটা ভুল থেকে আজ সে বেরিয়ে এসেছে । এখন তার ভাল লাগছে !

আমার সাথে তার কিছুই ছিল না । তবুও আমার খারাপ লাগলো লাইনগুলো দেখে । লাইনগুলোতে আমাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছিল যেন আমার দোষ সব । অথচ আমি কিছু করিই নি । অনলাইনে আবারও কমেন্ট শেয়ারের বন্যা বয়ে গেল । সেই কমেন্টের ভাষা আমি পড়তে পারলাম না । আমি ফেসবুক বন্ধ করে দিলাম । আমার সত্যিই অনেক মন খারাপ হল ।

সব থেকে বড় ঝামেলাতে পড়লাম পরদিন অফিসে গিয়ে । এতোদিন সবাই তো আমার দিকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকিয়েছে । এখন তারা আমার দিকে কটাক্ষ আর করুণার চোখে তাকাতে লাগলো । কেউ কেউ আবার টিটকারিও মারতে লাগলো । কুকুরের পেটে ঘি ভাত সহ্য হয় না, এই জাতীয় কথা ! আমি চুপ করে শুনে গেলাম কেবল । কিছু বলতে পারলাম না । বুঝতে পারলাম যে এই অফিসে হয়তো আর চাকরি করা হবে না ।

লাঞ্চ আওয়ারের পরেই অফিস থেকে বের হয়ে গেলাম । একটা মেইল পাঠালাম ম্যানেজারকে । এক সপ্তাহের ছুটি চেয়ে । যদি ম্যানেজার ছুটি না দেয় তাহলে চাকরি ছেড়ে দিবো ঠিক করেছি । বাসায় এসে মায়ের সাথে বিশেষ কথা বললাম না । মাকে কেবল বললাম যে আমি একটু ঢাকার বাইরে যাচ্ছি অফিসের কাজে । মায়ের কাছে এতো সময়ে খবর পৌঁঁছে যাওয়ার কথা । আমি সে সব নিয়ে আর কথা বলতে চাইলাম না । ব্যাগে কিছু জামা কাপড় নিয়ে বের হয়ে গেলাম বাসা থেকে ।

৫টা দিন কাটিয়ে দিলাম খুব শান্তিতে । মোবাইল ফোন সব সময় বন্ধই রাখতাম । রাতের বেলা মাকে একটু ফোন দিতাম । অল্প কথা বলে রেখে দিতাম । ছয় নম্বর দিনে মনে হল যথেষ্ঠ হয়েছে বিরহ বিলাস । আর মন খারাপ করে থেকে লাভ নেই । যা হবার হয়েছে । এখন স্বাভাবিক হওয়ার সময় ।

আমি এসেছিলাম গাজিপুরের একটা রিসোর্টে । রিসোর্টটা বেশ বড় । আমার রুমটা একেবারে কোনার দিকে ছিল । এরপর থেকেই গ্রাম শুরু হয়েছে । ধানের ক্ষেত, বিল ইত্যাদি নিয়ে বেশ ছিলাম । আমি রিসোর্টে ঘুরাঘুরি করতাম না । আমার চলাচল ছিল এই গ্রামের দিকেই । আমি গ্রামের ভেতরে হাটাহাটি করতাম । গ্রামের চায়ের দোকানে চা খেতাম । গ্রামটা একেবারেই ভোর গ্রাম । বিশেষ মানুষজন নেই । যারা আছে তারা সবাই কৃষিকাজ করে । দু'চারটা মুদি দোকান আছে ! এই হচ্ছে গ্রামের অবস্থা !

কিন্তু ছয় নম্বর দিনে যখন রিসোর্টের ভেতরে খানিকটা ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম তখন টের পেলাম রিসোর্টে কোন বড় অনুষ্ঠান হতে চলেছে । আরও একটু খোঁঁজ খবর নিতে গিয়েই জানতে পারলাম যে এখানে আজকে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান হবে । পুরো রিসোর্টটাই ভাড়া করে নেওয়া হয়েছে । আমিই এক মাত্র বাইরের গেস্ট । আমি আগে থেকেই ছিলাম বলে আমাকে ওরা বের করে দিতে পারে নি । আর আমি একজন মাত্র মানুষ তাছাড়া এদিকে আসিও না খুব একটা তাই ওরা খুব একটা আপত্তি করে নি । আমি বুঝতে পারলাম যে এখানে আর থাকা যাবে না । আমি বরং আবারও গ্রামের দিকেই যাই । ঘুরতে যাবো তখনই আমার চোখ গেল একজনের উপরে । কয়েকটা হার্ট বিট মিস করলাম আমি !

বারবার মনে হতে লাগলো যে এই ছেলে এখানে কি করছে ?

একজন বেয়ারাকে ডেকে জানতে চাইলাম । বেয়ারা আমাকে বলল, স্যার উনারই বিয়ে হচ্ছে !

আমি অবাক হয়ে বললাম, কার সাথে ?

বেয়ারা আর কথা না বলে একটা বোর্ডের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষন করলো । আমি বোর্ডের লেখাগুলো পড়তে লাগলাম অবাক চোখে !

"আকিব ওয়েডস আবন্তিকা"

আমি চোখদুটো দুহাত দিয়ে একটু ঘষে আবারও লেখাটা পড়লাম । আমার মনে তখন কেবল একটা প্রশ্নই জাগছে, "মেহজাবিনের বয়ফ্রেন্ড কেন অন্য মেয়েকে বিয়ে করতেছে ? হুয়াই ?"

আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারছিলাম না । বারবার নিজের মনকে বোঝাতে চাচ্ছিলাম যে থাকুক এইসব ব্যাপার । আমার এসব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে লাভ নেই । যে যা করে করুক ! আমার কি ?

কিন্তু কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখা গেল না । শেষে না পেরে আমি নিজেই ফোন দিলাম মেহজাবিনকে ! একটা ভয় ছিল যে মেহজাবিন হয়তো আমার ফোন রিসিভ করবে না । কিন্তু একবার রিং হতেই ফোনটা রিসিভ করলো ও ।

প্রথমে কিছু সময় কি বলবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । কিছু সময় কেটে গেল চুপচাপ । তারপর আমিই প্রথম বললাম, তুমি জানো ?

আমি জানো বলতে কি বোঝাতে চেয়েছি মেহজাবিন বুঝতে পারলো । ও মৃদ্যু স্বরে বলল, হ্যা জানি ! আগামী কাল ওর বিয়ে !

-তাহলে ? মানে ....

মেহজাবিন বলল, ঐদিনের স্ট্যাটাসটা তোমাকে নিয়ে ছিল না ।

-আমাকে নিয়ে না ?

-নাহ !

-তুমি ফোন কেটে দেওয়ার পর আমি আকিবকে ফোন দিয়েছিলাম । ওকে বললাম আমার বাবা মা তোমার বাসায় গিয়েছে । তখন ও আমাকে কি বলেছিলো জানো ? বলেছিলো যা চলছে তা-ই চালিয়ে যাও ! ওর পক্ষে আমাকে বিয়ে করা সম্ভব না । ওর বাবা নাকি ফিল্মের মেয়েকে মেনে নিবে না । খুব ঝগড়া হল আমাদের মাঝে । এক পর্যায়ে ও স্বীকার করলো যে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে ওর বসের মেয়ের সাথে ! এটা ওর জন্য একটা সুবর্ণ সুযোগ । এই সুযোগ ও হাতছাড়া করবে না !

আমি আসলে কি বলবো ঠিক খুঁঁজে পেলাম না । মেহজাবিন বলল, আমার কি মনে হয় জানো ?

-কি মনে হয় ?

-তোমার ব্যাপার মানে তোমাকে এইরকম ভাবে আমার বয়ফ্রেন্ড বানানো ওরই প্লান ছিল । ও অনেক দিন আগে থেকেই হয়তো আমার কাছ থেকে মুক্তি চাইছিলো । কোন পথ খুঁঁজছিলো । আমাকে এভাবে ধোঁঁকা দিলে আমি কিছু করতে পারতাম, মিডিয়ার সামনে কিছু বলতে পারতাম, তাই এমন কিছ করলো যাতে আমি কিছু না বলতে পারি ! বুঝতেই পারছো !

আমি বললাম, ঐ প্লানটা তাহলে তার ছিল ?

-হ্যা ও-ই আমাকে এই বুদ্ধি দিয়েছিলো । বলেছিলো পাব্লিক যা ভাবছে তাকে তা-ই ভাবতে দাও তো !

-এখন ? এখন কি করবে ?

-জানি না । তুমি কোথায় ? তোমার ফোন বন্ধ যে ! কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম । কারো সাথে কথা বলতে মন চাইছিলো । তুমি ছাড়া আর কেউ ছিল না যাকে মন খুলে কিছু বলতে পারতাম ! আসল সত্যটা কেবল তুমি জানতে !

আমি বললাম, আমি এখন এমন এক জায়গাতে রয়েছে যেখানে তোমার এক্সের বিয়ে হতে চলেছে ।

আবারও কিছু সময় কেউ কোন কথা বললাম না । হঠাৎ মেহজাবিন বলল, তুমি কদিন থাকবে ওখানে ?

-বেশি না । আর দুই দিন । তারপর চলে আসবো ?

-আমি আসবো কাল ওখানে । ঠিক আছে !

-সেকি !

-হ্যা । আমি আসছি !



পর্ব ৫

বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা বিকেল থেকে । সেই ভাবেই সব আয়োজন শুরু হয়েছিলো । আমি দুর থেকে সেসব দেখে যাচ্ছিলাম । কাছে যেতে ইচ্ছে করছিলো না । আর মনের ভেতরে একটা অস্বস্থি কাজ করছিলো যে আকিব সাহেব যখন জানতে পারবে যে আমি এখানে আছি তখন কি বলবে !

আমাকে খুব বেশি সময় এই চিন্তা করতে হল না । একটা সময় আকিব সাহেব হঠাৎ কোথা থেকে আমার সামনে এসে হাজির হল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি এখানে ?

আমি নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম, হ্যা আমি এখানে ?

-কিন্তু আমি তো আপনাকে এখানে আসতে বলি নি !

-আপনাকে কেন আসতে বলতে হবে ? আমি এখানে গত এক সপ্তাহ ধরে আছি !

আকিব সাহেব একটু থামলো । কিছু যেন বোঝার চেষ্টা করলো । তারপর বলল, ও আপনি তাহলে সেই গেস্ট ?

-হ্যা আমিই সেই গেস্ট !

আকিব সাহেব আর কিছু বলার মত খুজে পেল না । আমিও ঠিক কিছু বলতে পারছিলাম না । মনের ভেতরে একটা কথা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিলো । বারবার বলতে ইচ্ছে করছিলো যে মেহজাবিন আসছে ! তুমি জানো এটা ? কিন্তু সেটা বলতে পারছিলাম না । আকিব হঠাৎ বলল, দেখুন আপনি যদি আমার বিয়ের এরিয়াতে না আসেন তাহলে আমার জন্য ভাল হয় ! বুঝতেই পারছেন এটা একটা ফ্যামিলি অনুষ্ঠান ! আমি চাই না বাইরের কেউ আসুক !

আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই মেহজাবিনের কন্ঠ শুনতে পেলাম ! সে পেছন থেকেই বলল, আপনার বিয়েতে যাওয়ার আমাদের কোন ইচ্ছে নেই । আমরা এখানে একান্তে কিছু সময় কাটাতে এসেছি !

সাথে সাথেই মেহজাবিনের দিকে আকিব সাহেব ঘুরে দাড়ালো । মেহজাবিন আস্তে আস্তে হাটতে হাটতে আমার একেবারে পাশে এসে দাড়ালো । আকিব রায়হান চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে । কিছু যেন বলতেই পারছে না । আমি চুপচাপ তাকিয়ে আছি দুজনের দিকে । ঠান্ডা একটা লড়াই চলছে যেন দুজনের । মেহজাবিনের মুখে একটা দৃঢ়তা দেখতে পেলাম । আকিব বলল, এখানে কোন সিন ক্রিয়েট করবে না ?

মেহজাবিন যেন আকাশ থেকে পড়লো । তারপর বলল, সিন ক্রিয়েট ! মানে কি ? আমি এখানে আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে একটা সময় কাটাতে এসেছি । এখানে সিন ক্রিয়েটের কি দেখলে !

-বয়ফ্রেন্ড ! আমি জানি না কেমন বয়ফ্রেন্ড !

মেহজাবিন এবার খানিকটা হিসহিস কন্ঠে বলল, আমিও দেখেছি বয়ফ্রেন্ড ! শোন নিজের চরকাতে তেল দাও । আমাকে মুখ খুলতে বাধ্য কর না !

আকিব কিছু বলতে যাবে তখনই আরও একজনের উপস্থিতি টের পেলাম সেখানে । ভদ্রলোকের বয়স আমার বাবার মত হবে । তিনি স্যুট পরে আছেন ! আমাদের ঠিক মাঝখানে এসে হাজির হলেন । তাকে দেখে আকিব একেবারে চুপ করে গেল । ভদ্রলোক আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ও মাইগড! মেহজাবিন আহমেদ ! এখানে ?

মেহজাবিন একটু হাসলো !

ভদ্রলোক আবারও বলল, আপনি এখানে ?

মেহজাবিন খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ওর কাছে এসেছি । কাজ কাজ আর কাজ ! ভাল লাগছিলো না । ও বলল যে এখানে চলে আসতে ! জায়গাটা তে নাকি সুন্দর !

ভদ্রলোক এবার আমার দিকে তাকালো । কিছু যেন ভাবার চেষ্টা করছে । তারপর বলল, ও আপনি তো সেই গেস্ট ! আমি তো ভালছিলাম আপনাকে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করবো । কিন্তু এখন দেখছি আপনাকে আর যেতে দেওয়াই যাবে না ।

তারপর মেহজাবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার স্ত্রী আপনার খুব ভক্ত ! আপনাকে দেখলে খুব খুশি হবে ! আপনরা কি আমার মেয়ের বিয়েতে আসবেন ! আমি জানি আপনারা একান্তে লোক জন থেকে দুরে সময় কাটাতে এসেছেন ! তবুও আসবেন কি ?

মেহজাবিন হাসলো । তারপর বলল, হ্যা অবশ্যই ! কোন সমস্যা নেই ! আসবো !

-অনেক ধন্যবাদ !

তারপর আকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, আকিব আমি তোমাকে দায়িত্ব দিলাম । তুমি অবশ্যই মেহজাবিন এবং ইনার যেন কোন সমস্যা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবে ! মনে থাকবে ?

আকিব যেন অনেক কষ্টে মাথা নাড়ালো । ভদ্রলোক আবার পেছন দিকে হাটা দিল ।

মেহজাবিন এবার আমার হাতটা ধরলো । এমন ভাবে ধরলো যেন আকিব সেটা দেখতে পারে ! তারপর কোন কথা না বলেই হাটা দিল ঘুরে । আমিও হাটতে বাধ্য হলাম ।

-তোমার কেবিন কোন দিকে !

-ঐ তো !

-আগে একটু ফ্রেশ হওয়া যাক !

আমার সাথেই ও আমার কেবিনে এসে হাজির হল । খুব স্বাভাবিক ভাবেই ঘরের ভেতরে ঘোরাফেরা করতে লাগলো । তারপর আরও স্বাভাবিক ভাবে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল । আমি খাটের উপর বসে ভাবতে লাগলাম কি হল এই সব কি হচ্ছে আর কেন হচ্ছে ! মেহজাবিন এতো স্বাভাবিক আছে কিভাবে ?

অবশ্য ও খুব পাকা অভিনেত্রী । সব অবস্থাতেই অভিনয় করতে পারে খুব ভাল ! এখানেো হয়তো অভিনয় করে চলেছে !

কিন্তু আমার হাত এভাবে ধরার মানে কি ?

আমি আরও কিছু ভাবতে যাবো তখনই দরজা খুলে গেল বাথরুমের । মেহজাবিনকে বের হতে দেখলাম । আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল । মেহজাবিন কেবল একটা তোয়ালে জড়িয়ে আছে শরীরে । ভেজা চুল দিয়ে এখানও পানি পরছে !

আমার বুকের একটা হার্ট বিট মিস করলো ! শুনে এসেছি যে অনিনয় জগতের মানুষের সৌন্দর্য্য আসলে সবটাই মেকাপ । মেকাপ ছাড়া নাকি তাদের একদমই সুন্দর লাগে না । কিন্তু মেহজাবিনের ক্ষেত্রে সেটা মোটেই সত্য নয় । সবে মাত্র গোসল করে এসেছে ও । এখনও চুপ দিয়ে একটু একটু পানি পড়ছে । আমি আমার জীবনে এতি স্নিগ্ধ আর মোলায়েম চেহারা দেখেছি বলে আমার মনে পড়ে না । আমি কেবল এক ভাবে ওর দিকে তাকিয়েই রইলাম !

মেহজাবিন লক্ষ্য করলো সেটা ! তারপর বলল, কি ব্যাপার কি দেখো !

-তোমাকে দেখছি !

-এভাবে মেয়েদের দিকে তাকাতে নেই, জানো না ?

-নিজের গার্লফ্রেন্ডের দিকে তাকানো যায় ১

-ইস আসছে আমার বয়ফ্রেন্ড !

মেহজাবিন নিজের ব্যাগ থেকে কাপড় বের করছিলো । সেটা নিয়ে আবারও ওয়াশরুমের ভেতরে ঢুকে গেল । আমার চোখে সামনে ওর চেহারাটা ভাশতেই লাগলো । আমি কি দেখলাম একটু আগে ! আমি যেন ভাবতেই পারছিলাম না । সত্যিই ভাবতে পারছিলাম না ।

একটু পরে আবারও বের হয়ে এল ওয়াশরুম থেকে । এবার অবশ্য তোয়ালে খুলে পোশাক পরে এসেছে । আয়নার সামনে দাড়িয়ে হালকা একটু সাজগোজ করলো । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চল কিছু খাওয়া যাক ! আমার ক্ষুধা লেগেছে !

রিসোর্টের ক্যান্টিনটা মাঝখানে । অন্যান্য দিন এখানে নানান ধরনের খাবার তৈরি হয় তবে আজকে ক্যান্টিন বন্ধ । বিয়ে উপলক্ষ্য সবাই কাজে ব্যস্ত ! তবে সেলিব্রেটি বলে কথা ! মেহজাবিন একটু অনুরোধ করতেই কাজ হল । বোঝা গেল রিসোর্টের ম্যানেজারও মেহজাবিনকে চেনে খুব ভাল করেই । সে বলল আপাতত কয়েকটা বার্গার তারা বানিয়ে দিতে পারবে । তারপর বিয়ের রান্নাটা শেষ হলে আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবে !

আপাতত তাই হল । আমি আর মেহজাবিন ক্যান্টিনে বসে বার্গার খেতে লাগলাম । মোটামুটি খাওয়া শেষ হতে না হতেই পুরো স্টাফ আর রিসোর্টের অন্য সবাই জেনে গেল যে মেহজাবিন এখানে আছে । কয়েকজন একটু উকু ঝুকি মারছিলো । মেহজাবিনই কয়েকজন কে ডাকছিলো । জানতে চাইলো যে কিছু বলতে চায় কি না । কয়েকজন খুব খুশি হল । অটোগ্রাফ নিল ছবি তুলল । আমিই তুলে দিচ্ছিলাম !

ইতিমধ্যে কয়েকজন গেস্ট চলে এসেচিলো । তারাও কয়েকজন এসে মেহজাবিনের সাথে কথা বলল ।

একটা পর্যায়ে আমি বুঝতে পারছিলাম যে মেহজাবিন এই কাজটা কেন করছে ! আসলে ও আকিবকে অশান্তিতে ফেলতে চাচ্ছে । ওর সাথে ছেলেটা যা করেছে সেটার জন্য ও আকিবকে শান্তিতে দিতে চাচ্ছে না । সত্যিই আপানর নিজের বিয়েতে যদি আপনি আপনার প্রাক্তন প্রেমিকাকে ঘুরতে দেখেন চোখের সামনে তাহলে সেটা কি আপনার ভাল লাগবে ? মোটেই লাগবে না !

খাওয়া শেষ করেই আমরা এবার গ্রামের দিকে হাটতে বের হলাম । মেহজাবিন আমার হাত ধরলো হঠাৎ । তারপর খুব স্বাভাবিক ভাবেই হাটতে লাগলো । আমি জানি না এই হাত ধরাটা আমার কেন জানি ভাল লাগলো । আমার কাছে সত্যিই সত্যিই মেহজাবিনকে আমার প্রেমিকা মনে হল ।

মেহজাবিন বলল, এই গ্রামটা তো বেশ চমৎকার ! এখানে মানুষ টিভি সিনেমা দেখে না মনে হচ্ছে !

আমি বললাম, গত এক সপ্তাহে এই গ্রামেই বেশি সময় কাটিয়েছি । সত্যি বলতে এরা বেশ গরীব । কেবল কৃষিকাজ ছাড়া আর কিছু করে না ।

-আমার জন্য বেশ ভাল !

-মানে ?

-মানে হচ্ছে টিভি সিনেমা দেখলে আমাকে ঠিকই চিনে ফেলতো । আগে পিছে দৌড়াদৌড়ি করতো ! সব সময় এসব ভাল লাগে না । মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো ?

-কি মনে হয় ?

-মনে হয় যে এমন জীবন যদি না হত তাই বুঝি ভাল হত । স্বাভবিক জীবন হত । অল্প কিছু মানুষ চিনতো আমাকে ! যেখানে ইচ্ছে যেখানে যেতে পারতাম । একটা লাভিং প্রেমিক থাকতো । তার সাথে হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে পারতাম !

বললাম, এই তো ঘুরছো ?

মেহজাবিন হাসলো । তারপর বলল, সত্যিই ভাল লাগছে !

আমি জানতে চাইলাম, আকিব সাহেবের জন্য খারাপ লাগতেছে ?

-নাহ ! খারাপ লাগছে না । আমি ভেবেছিলাম ওকে ভালবাসি বেশ । প্রথম দিন কষ্ট পেয়েছিলাম এটা সত্য কিন্তু এখন কিছুই মনে হচ্ছে না । বরং মনে হচ্ছে ছাগলটা নিজের আসল পরিচয় দিয়ে ভালই করেছে ! আমি বেঁচে গেছি !

-তাহলে এখানে কেন এসেছো ?

-বেটাকে একটু প্যারা দেই । বেটা এমন বাটপারিটা করলো এতো শান্তিতে থাকতে দেওয়া কি ঠিক হবে ?

বলেই মেহজাবিন হেসে উঠলো জোরে । তারপর বলল, আরও একটা কারন আছে ?

-কি কারন ?

-আমার কারনে তোমার জীবনে একটা ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে । হয়েছে না?

-ওটা ব্যাপার না ! ঠিক হয়ে যাবে !

-হ্যা যাবে ! ভাবলাম সেটা যদি আরও একটু ভাল ভাবে শেষ করা যায় । তাই !

-আমার জন্য এতো ভাবো তুমি ?

-বাহরে ! নিজের বয়ফ্রেন্ডের জন্য ভাববো না ?

আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম !



মেহজাবিন আমার হাতটা যেন আরও একটু শক্ত করে চেপে ধরলো । দুজনে গ্রামের পথে হাটতে শুরু করলাম । আমার মনে হতে লাগলো যে মেহজাবিন আসলেই আমার সত্যি শুদ্ধ প্রেমিকা ! এই অনুভূতিটার কোন তূলনা নেই !





পর্ব ছয়

বিকেল বেলা যখন আমরা ফিরে এলাম তখন চারিদিকে বিয়ের আমেজ চলে এসেছে । প্রায় সবাই চলে এসেছে মনে হল । যদিও একটা বিয়ে অনুযায়ী যত মানুষ হওয়ার কথা তত মানুষ হয় নি । আমরা ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই এক ঝাক মানুষ এসে মেহজাবিনকে ঘিরে ধরলো । আমরা যাওয়ার আগেই আমাদের সাথে কয়েক জনের সাথে আমরা কথা বলে গিয়েছিলাম । মেহজাবিন যে এখানে এসেছে এটা তখন সবাই জানতো । ও আবার অনেকের সাথে ছবি তুলেছিলো তাদের সাথে । তারা এতোক্ষনে ফেসবুকে সে সব ছবি পোস্ট দিয়ে ফেলেছে নিশ্চয়ই । সেখান থেকেও জানতে পেরেছে নিশ্চয়ই ।

মেহজাবিনকে দেখলাম সবার সাথেই কথা বলছে হাসি মুখে । যেন এই ব্যাপারটা ও খুব উপভোগ করছে । কিন্তু একটু আগঈ ও বলছিলো যে এমন ভীড় ওর ভাল লাগে না কিন্তু এখন কি চমৎকার ভাবেই না সবার সাথে কথা বলছে ! আমাদের কত কিছু না চাইলেও করতে হয় । বিখ্যাত মানুষদের তো আরও বেশি কিছু ।

বিয়ের অনুষ্ঠানটা দেখে মনে হল যে খুব বেশি বড় করে আয়োজন করা হয় নি । খুব সম্ভবত এখন কেবল ঘরোয়া ভাবে অল্ল কয়েকজন মানুষকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে । পরে মনে হয় বড় করে আয়োজন করা হবে । বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই খুশি মনে হচ্ছিলো কেবল একজন ছাড়া ।

সে হচ্ছে আকিব সাহেব !

সে কেমন চোখে আমার আর মেহজাবিনের দিকে তাকিয়ে থাকলো । তার কিছুতেই ভাল লাগছিলো না মনে হচ্ছে । অবশ্য ভাল না লাগারই কথা । বিশেষ করে মেহজাবিন যখন আমার সাথে সাথে ঘুরছিলো তখন আকিব সাহেবের মুখটা কেমন যেন ক্ষোভে ফেটে পড়ছিলো । কিন্তু সে কিছুই বলতে পারছিলো না ।

মেহজাবিন যেন আমার শরীরের সাথে একেবারে লেগে থাকছিলো সব সময় । সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা যে দেখো এটা আমার বয়ফ্রেন্ড ! আমার অবশ্য বুঝতে কষ্ট হচ্ছিলো না যে ও আসলে আকিবকে জ্বালানোর চেষ্টা করছিলো । পুরুষ মানুষ যতই একজন কে ছেড়ে চলে যাক যদি প্রাক্তন প্রেমিকাকে অন্য পুরুষের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে দেখে তাহলে সেটা তার পক্ষে সহ্য করা খানিকটা মুশকিল হয়ে পড়ে । আকিবেরও সেই অবস্থা হচ্ছে ।

মেহজাবিন আমার কানের কাছে এসে বলল, আমার কেন জানি খুব মজা লাগছে ! সত্যিই বলছি । এতোদিন নাটক সিনেমাতে এই রকম কাহিনীতে কত অভিনয় করেছি কিন্তু আজকে আমার নিজের সাথেই এমন কিছু হচ্ছে । ভাবতে পারি নি আগে !

আমি বললাম, তাহলে ভেবে দেখো আমার কি অবস্থা !

-তাই ভাবছি ! তবে আই এম গ্ল্যাড যে ঐদিন আমাদের দেখা হয়েছিলো । নয়তো এসব কিছু হতই না !

আমরা এই ভাবে কথা বলছিলাম আর এদিক ওদিক হেটে বেড়াচ্ছিলাম । এমন সময় লাইট অফ হয়ে গেল । পুরো রিসোর্টের আলো বন্ধ হয়ে গেল । সব কিছু থেকে থেমে গেল । তখন অনুভব করলাম মেহজাবিন আমার আরও কাছে চলে এসেছে । আমি বললাম, কি হল আবার !

মেহজাবিন কানের কাছে এসে বললাম, আমার অন্ধকার ভয় লাগে !

আমি বললাম, ভয় কি আমি আছি তো তোমার পাশে !

-সবাই থাকে না । মাঝে পথেই চলে যায় !

-আমি যাবো না !

কয়েকজন চিৎকার চেঁচামিচি শুনলাম । বুঝতে পারলাম মেয়ের বাবা চিৎকার করছে । আলো ফিরে আসতে আরও কয়েক মিনিট সময় লাগলো । আলো আসতেই দেখলাম কনের বাবা ম্যানেজারের সাথে বকাবকি করছে ।

ম্যানেজার সাহেব মাথা নিচু করে শুনে যাচ্ছে । সে লজ্জিত । আমি খানিকটা অবাক হলাম । এই রকম হয় না স্বাধারনত । আমি এখানে এক সপ্তাহ ধরে আছি । বিদ্যুৎ গেলে প্রায় সাথে সাথেই জেনারেটর চালু হয়ে যায় । তাহলে আজকে কেন হল না ?

সেটা জানা গেল কয়েক মিনিট বাদেই । একজন স্টাফ হাতে করে একটা তার নিয়ে এসে হাজির । ম্যানেজারকে দেখিয়ে বলল, স্যার কেউ মেইন সুইট অফ করে দিয়েছিলো । আর এই জেনারেটরের তারটাও কেটে দিয়েছে !

ম্যানেজার অবাক হয়ে বলল, কে করবে এই কাজ !

স্টাফ বলল, স্যার আমরা সবাই এখানে । আমরা তো কেউ করি নি । আর আমরা কেন করবো ?

কনের বাবা চিৎকার করে বলল, তাহলে কে করবে ? এটার কোন মানে আছে ?

তখনই কনের বাবার কানে কানে একজন কিছু বলল । সেটা শুনে সে জলদি কেবিনের দিয়ে দৌড়ে গেল । আমরা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম । এবং কিছু সময় পরে সত্যটা জানা গেল ।

কনে গায়েব !

সবাই এদিকে ব্যস্ত ছিল । আবার মেহজাবিনকে ঘিরেই ছিল সবার আগ্রহ । এই ফাঁকে কখন যে কনে গায়েব হয়ে গেছে সেটা কেউ টেরই পায় নি ।

পুরো রিসোর্টে হইচই পড়ে গেল মুহুর্তেই । আমি মেহজাবিনের দিকে তাকিয়ে দেখি ও অবিশ্বাষ্য চোখে তাকিয়ে রয়েছে । মুখে একটা আলাদা হাসি ছড়িয়ে পড়েছে !

আরও খানিকটা রাত হলে আসল ঘটনা জানা গেল । আকিবের বস আকিবকে পছন্দ করতো । সেই সুবাধে সে মেয়ের সাথে তার বিয়ে দিতে চেয়েছিলো । আকিব তো এক পায়ে খাড়া ! কিন্তু মেয়ে রাজি ছিল না কিন্তু বাবার ভয়ে কিছু বলতে পারি নি । মেয়ে সুযোগ বুঝে আজকে কেটে পড়েছে । সম্ভবত প্লান আগে থেকেই করে রেখেছে । তার প্রেমিক সম্ভব এই আলো যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে । আর মেহজাবিন আসায় ওদের পালানোর পথ আরও সহজ হয়েছে । রাতে আস্তে আস্তে গেস্ট রা চলে যেতে লাগলো । আমি ভেবেছিলাম মেহজাবিনও চলে যেতে চাইবে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে মেহজাবিন থাকতে চাইলো । আমরা খাওয়া শেষ করে আবারও সেই গ্রামের পথ ধরে হাটতে লাগলো । চাঁদের আলো ঠিক ছিল না তবে পথঘাট অন্ধকার ছিল না একেবারে । মেহজাবিন হাটছিলো আমার হাত ধরে । আমি জানি না মেহজাবিনের মাথায় কি চলছিলো তবে এই টুকু বুঝতে পারছিলাম যে ওর আমার সঙ্গ ভাল লাগছিলো বেশ । আমার নিজেরও বেশ ভাল লাগছিলো ।

বেশ রাত করেই আবার আমরা ফিরে এলাম । তখন রিসোর্ট টা একেবারে শান্ত হয়ে গেছে । পুরো রিসোর্টে স্টাফ ছাড়া সম্ভবত আমরাই ছিলাম । আমি আমার দরজার সামনে এসে দরজা খুলতে খুলতে বললাম, চাইলে আলাদা একটা রুমের ব্যবস্থা করতে পারি । করবো ?

মেহজাবিন বলল, কেন ভয় হচ্ছে যে আমি তোমার কোন ক্ষতি করতে পারি?

আমি হেসে ফেললাম । বললাম, হতেই পারে ! বুঝতেই পারছো অবলা এক ছেলে আমি !

মেহজাবিন বলল, ভয় নেই জনাব । আমি অতি ভাল মেয়ে ! জোর জবরদস্তি করবো না !

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে যাবো তখনই পেছন থেকে কারো ডাক শুনতে পেলাম । তাকিয়ে দেখি আকিব সাহেব দাড়িয়ে আছে !

মেহজাবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা এক সাথে থাকবে ?

মেহজাবিন বলল, কোন সমস্যা তোমার ?

মেহজাবিনের উদ্ধত ভাব দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম । আকিব সাহেবকে দেখলাম খানিকটা সংকুচিত হয়ে যেতে ! বলল, আমি খুবই সরি মেহজাবিন । আমি আসলে ভুল করেছি ।

-সেটা তো দেখতেই পারছি ।

-আমি আসলে লোভে পড়ে গিয়েছিলাম । সত্যিই বলছি । আমি খুব ভুল করেছি ।

-তো এখন কি করনীয় ?

-আমি আসলে .....

-দেখো আকিব তুমি যা চেয়েছো তাই হয়েছে । আমি আমাকে কিছু বলার সুযোগ দাও নি তুমি । আমি মেনে নিয়েছি । এখন সব দিক হারিয়ে আবার আমার কাছে ফিরে এসেছো ? আমি প্রথমে তোমাে চুজ করেছিলাম । তুমি আমাকে অল্টারনেটিভ হিসাবে নিয়েছো । এখন দয়া করে এখান থেকে বিদায় হও ।

আকিব বলল, আমি আমাদের ব্যাপারটা সবাইকে জানিয়ে দিবো ! তোমার সাথে অপুর কি সম্পর্ক সেটাও বলে দিবো সবাইকে !

মেহজাবিন হাসলো । তারপর বলল, বলে দিবে ? দাও । এখন তো কেবল মেয়ে তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে যখন তুমি সত্যটা বলবে তখন তোমার বস তোমাকে পেছনে লাথি দিয়ে কোম্পানি থেকে বের করে দিবে ! এবং আমিও সবাই এটা বলে দিবো যে তুমি কতখানিক চিট করেছো । আমার খুব একটা সমস্যা হবে না আশা করি । আর অপুর সাথে আমার কি সম্পর্ক সেটা আমাদের মাঝে ছেড়ে দাও !

আকিব একটু এগিয়ে আসতে গেল তখনই আমি সামনে চলে এলাম !

আকিবের দিকে তাকিয়ে বললাম, আই থিংক ইউ স্যুড লিভ !

আকিব বলল, আমি তোমার সাথে কথা বলছি ।

-ইয়েস, ইউ আর টকিং টু মি ! ইউ আর টকিং টু হার, ইউ আর টকিং টু মি । নাউ, আস্ক ইউ টু লিভ প্লিজ ! আই ওন্ট আস্ক নাইসলি নেক্সট টাইম !

আমি জানি না আমার কন্ঠে কি ছিল তবে সেই কন্ঠস্বরটা আমি নিজেই ঠিক মত চিনতে পারলাম না ! আমি যে কারো সাথে এতো কঠিন স্বরে কথা বলতে পারি সেটা আমি নিজেও জানতাম না । আমি অনুভব করলাম মেহজাবিন আমার কাছে চলে এসেছে । আমার হাত ধরলো । তাররপ বলল, উই ডান টকিং ! চল ভেতরে ....

দরজার ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম ওর মুখের উপর । দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পরপরই মেহজাবিন হঠাৎ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ! কত সময় যে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো আমি জানি না । আমাকে জড়িয়ে ধরেই বলল, আই নেভার ফিল সো সেইফ লাইক দিস । রিয়্যালী আই মিন ইট ! আমাদের শুরুটা যেভাবেই হোক ! আমাদের শেষটা ভাল হবে ! আই নো দিস !

আমারও তাই মনে হল ! আমাদের শেষটা খুব বেশি ভাল হবে !



তোমার আর আমার গল্পটা এভাবেই শেষ সেটা কি আমি ভেবেছিলাম কোন দিন ! না তুমি, না আমি ! কেউ ভাবি নি । কিন্তু জীবন সব সময় গল্প থেকেও বৈচিত্রময় !



মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:০৬

সাঈদ_মাহমুদ বলেছেন: পড়লাম পুরোটাই। ভাল লাগল।
গল্পে পিলাচ

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:১৩

অপু তানভীর বলেছেন: ধন্যবাদ পড়ার জন্য :)

২| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:১২

ইসিয়াক বলেছেন: ভালো লেগেছে।
ধন্যবাদ

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:১৮

অপু তানভীর বলেছেন: ধন্যবাদ পড়ার জন্য :)

৩| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:২৬

রাজীব নুর বলেছেন: শিরোনামটা কি বাংলায় দেওয়া জায় না?? বাংলাতেই বেশি ভালো লাগবে।

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:২৭

অপু তানভীর বলেছেন: এখানে পাঠকের চেয়ে লেখকের ইচ্ছেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ।

৪| ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৪৯

রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: এখানে পাঠকের চেয়ে লেখকের ইচ্ছেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ।

হুম। তা ঠিক।
তবে লেখক তো পাঠকের জন্যই লিখেন। পাঠকের দিকে লেখকের অবশ্যই নজর দেওয়া উচিত।

০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:২৮

অপু তানভীর বলেছেন: এটাও ভুল কথা । লেখক পাঠকের মনরঞ্জনের জন্য লিখে না । লেখক লিখে নিজের মনের শান্তির জন্য । অন্তত আমি লিখি আমার মনের শান্তির জন্য । এখানে পাঠক সেটা পছন্দ করুক কিংবা না করুক তাদের আসলে কিছু যায় আসে না । একজন লেখক কি লিখবে, না লিখবে, তার লেখায় কি কি ধরনের জিনিস পত্র ব্যবহার হবে, সেটা নিয়ে পাঠকের কিছু বলার থাকতে পারে না ।
পাঠক কেবল সেই লেখা পড়ে নিজের মনভাব ব্যক্ত করতে পারে, সে বলতে পারে লেখাটা ভাল হয়েছে কি হয় নি কিংবা তার ভাল লেগেছে কিংবা লাগে নি । পাঠক কোন ভাবেই লেখকে এই পরামর্শ দিতে পারে না যে "আপনি এই ভাবে লিখুন" কিংবা "ঐভাবে লিখুন", "এই জিনিস ব্যবহার করলে ভাল হয়" "এটা না লিখলে ভাল হয়" !

৫| ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৯ বিকাল ৪:১৮

অঞ্জন রায় বলেছেন: মানুষের কল্পনা শক্তি কতটা প্রখর হতে পারে সেটা আপনাকে দেখে শিখেছি।
একটা প্রশ্নঃ এটা কি শুধুই কাল্পনিক? নাকি কিছুটা বাস্তবতাও আছে??

২৮ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১২:৫৪

অপু তানভীর বলেছেন: কেবলই কল্পনা

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.