নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

www.oputanvir.com

অপু তানভীর

আমার চোখে ঠোঁটে মুখে তুমি লেগে আছো

অপু তানভীর › বিস্তারিত পোস্টঃ

বড়গল্পঃ বিড়ালকুমারী

২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ৮:৪৩



সকাল বেলা রাফিক ভাইয়ের ফোনে ঘুম ভাঙ্গলো । অফিসের কাছেই আমি বাসা নিয়েছি তাই একটু বেলা করে আমি ঘুমাতে পারি । অফিসে ঢুকতে হয় সকাল দশটার আগে । আমি সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ঘুমাই শান্তিমত । রফিক ভাইয়ে ফোন পেয়ে যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখনও নয়টা বাজে নি । একটু বিরক্ত হলেও কিছু বললাম না ।

হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে রফিক ভাইয়ের উত্তেজিত কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম !
-ফয়সাল কোথায় তুমি ?
ইচ্ছে হল বলি যে তাজিংডংয়ের উপরে আছি । মেঘ দেখতে আসছি । এই অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করার মানে কী আমি আজও ঠিক বুঝতে পারি না । মানুষ যে প্রশ্নের উত্তর আগে থেকে জানে সেই প্রশ্ন কেন করে ? রফিক ভাই খুব ভাল করেই জানে যে জীবন মরন সমস্যা না হলে এই সময়টা আমি সব সময় বিছানাতে থাকি ।
আমি বিরক্ত চেপে বললাম, যেখানে থাকি !
-আরে মিয়া উঠো জলদি ! খবর শুনছো নাকি?
-কিসের খবর?
-আরে মিয়া এমডি বদলাইয়া গেছে !

বলেই রফিক হে হে করে উঠলো । আমার ঘুম চলে গেল সাথে সাথেই । আমার কান সোজা করে বললাম, কে হয়েছে নতুন এমডি?
-গেস কর?
-কে?
রফিক ভাই বলল, টিভি চালু কর। তাহলেই বুঝতে পারবে নতুন এমডি কে হইছে !

আমি দেরি না করে টিভি চালু করলাম ! সাথে সাথেই চমকে গেলাম ।

যে কয়টা বাংলা চ্যানেল ঘুরলাম প্রতিটার সংবাদই একই খবর দেখাচ্ছে ! কয়েক মিনিট খবরের দিকে তাকিয়ে রইলাম একভাবে ।

দেশের বিখ্যাত শিল্পপতি রশিদ আরমানের বড় ছেলে রিগু আরমানের বিভৎস মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে বুড়িগন্ধা থেকে । রিভু আরমান মানে তার মেঝ সন্তান পলাতক । তাকে আজ সকালের ফ্লাইটে জার্মানি চলে যেতে দেখা গেছে । দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে কারো কষ্ট হয় নি । সম্ভবত বড় ভাইকে খুন করে সে বিদেশ পালিয়ে গেছে । এখন থাকে এক মাত্র ছোট মেয়ে রিয়ানা আরমান । খুব পরিস্কার ভাবেই রিয়ানা আমাদের কোম্পনীর নতুন এমডি হতে চলেছে !

আসলে বেশ কয়েকদিন ধরেই তিন ভাই বোনের ভেতরে একটা দ্বন্দ্ব চলে আসছিলো যে কে বসবে কোম্পানীর এমডির পদে । তাদের বাবা অর্থ্যাৎ আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবও কোন সিদ্ধান্ত জানাচ্ছিলেন না । কেমন একটা লুকোচুরি খেলছিলেন । আমার কাছে মনে হচ্ছিলো যে তিনি নিজেও ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না । বিশেষ করে তিনজনই যখন সমান দাবিদার ।
ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন বড় ছেলেকে । তবে সে বলেছিলেন যে খুব জলদিই জানাবেন যে স্থায়ী ভাবে কে এমডি পদে বসবেন !

কিন্তু রিগু আরমান যে খুন হয়ে যাবে সেটা আমরা কেউ ভাবতেও পারি নি । আর যেহেতু রিভু মিয়া পালিয়েছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নেওয়া যায় সে সেই অকাজটা করেছে । ফাঁক তালে রিয়ানা ম্যাডামের লাভ হয়ে গেল । তবে কেন জানি ব্যাপারটা আমার কাছে ঠিক হজম হল না ।

আমাদের চেয়ারম্যানের দুইটা বিয়ে । প্রথম পক্ষের সন্তান হল দুই ভাই । আর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান হচ্ছে রিয়ানা । খুব স্বাভাবিক ভাবেই দুই ভাইয়ের ভেতরে মিলটা বেশি ছিল । দ্বন্দ্ব যখন শুরু হয় তখন স্পষ্টই দুই ভাই মিলে রিয়ানাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলো কোম্পানী থেকে । কিন্তু এখন দেখছি দুই ভাইয়ের লড়ায়ে লাভ হল রিয়ানার !


আমি হাত বাড়িয়ে মিউকে খুজতে শুরু করলাম । রাতে সে আমার সাথেই ঘুমিয়েছিলো । পুরো রুমের ভেতরে চোখ বুলিয়ে দেখলাম সে নেই । নিশ্চিত ভাবেই গায়েব হয়ে গেছে । প্রতিদিনের মত আজও সে একই কাজ করেছে । রাতে আসে যখন আমি অফিস থেকে বাসায় আসি । সারারাত আমার গা ঘেষে ঘুমিয়ে থাকে । তারপর সকাল হলে আবার চলে যায় !

আমি জলদি জলদি উঠে পড়লাম । আজকে আজকে একটু আগে আগে অফিস যেতে হবে । এমডি বদলেছে সুতরাং অনেক কিছু বদলে যাবে ! আমাকে আগে আগে যেতে হবে ।

দুই
রশিদ আরমানের ব্যাপারটা আমার কাছে বরাবরই একটু যেন কেমন মনে হয়েছে । লোকটার ভেতরে রুক্ষতার পরিমানটা অনেক বেশি । মায়া দয়া কম । তার বড় ছেলে মারা গেছেন সেটা সেটা তার মুখের ভাব কিংবা কথায় বিন্দু মাত্র প্রকাশ পেল না । বরং দুপুর একটার সময়ে সে কোম্পানীর নতুন এমডি ঘোষণা দিলেন ।
রিয়ানা আরমান ।

তিনটার ভেতরে কোম্পানীর ওয়েবসাইটে সকল মেম্বারদের নামের তালিকা প্রকাশ পেল । আমরা এটা আগে থেকেই জানতাম যে রিয়ানা যখন নতুন এমডি হবে তখন বেশ কিছু রদ বদল হবে । কয়েকজন চাকরিও হারাবে । রিগু আরমান যখন কোম্পানী চালাচ্ছিলো তখন তার কিছু পছন্দের এপ্লোয়ী ছিল । তাদের সবাইকে ছাটাই করা হল । কয়েকজনকে পদন্নোতি দেওয়া হল । সেই সাথে কয়েকজনকে নামিয়ে দেওয়া নিচের পোস্ট ।

কিন্তু সব থেকে অবাক করা ব্যাাপর হচ্ছে আমার নাম কোথাও নেই । এটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না । আমাদের কোম্পানির ওয়েব সাইটেই প্রতিটি এম্প্লোয়ীর নাম সেই সাথে কার কি দায়িত্ব সব কিছু প্রকাশ করা থাকে । নতুন ভাবে প্রকাশিত দায়িত্ব সবার নতুন দায়িত্ব পেয়েছে । যারা যারা চাকরি হারিয়েছে তাদেরকে নামের নিচে এক্সপেল লেখা । কিন্তু এই সবের মাঝে আমার নাম একদম নেই । না আমার পদন্নোতি হয়েছে, না আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে । তবে আমার আগের যে পোস্ট টা ছিল সেখানে ঠিকই একজন নাম দেওয়া হয়েছে ।

আমি কি করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । রফিক ভাই আমাকে সান্তনা দিয়ে বললেন যে কোন চিন্তা যেন আমি না করি । সে আমার ব্যাপারটা নিয়ে রিয়ানা ম্যাডামের সাথে কথা বলবে । রিয়ানা ম্যাডাম অফিসে নেই আপাতত । কাল আসলেই এই ব্যাপারে কথা বলবেন। তার কথায় এখন বেশ মূল্য । রফিক ভাইকে এজিএম করা হয়েছে । আমি মন খারাপ নিয়ে বেশ কিছু সময় বসে রইলাম । তারপর টেবিল পরিস্কার করে বাসায় চল এলাম । আমার কি কাজ ওখানে । সম্ভবত চাকরি চলেই গেছে আমার ।

ঘরে ঢুকতেই দেখি সোফার উপরে মিউ বসে রয়েছে চুপচাপ । টিভি চলছে । আমি একটু মনে করার চেষ্টা করলাম যে যাওয়ার সময় কি আমি টিভি চালু করে গিয়েছিলাম ! মনে করতে পারলাম না । অবশ্য সেটা নিয়ে আর খুব একটা ভাবলামও না । এগিয়ে এসে মিউকে কোলে তুলে নিলাম । ওর নরম তুলতুলে শরীরে হাত দিতেই আমার মনটা ভাল হয়ে গেল অনেকটাই । আমার আদর পেয়ে মিউ যেন আরাম পেল । মিউ মিউ করে ডেকে উঠলো ।
আরও আদর পেতে চাইছে । আমি মুখের কাছে নিয়ে ওর কপালে একটু চুমু খেলাম । একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ আসছে ওর শরীর থেকে । এই সেন্ট টা ওর শরীরে সম্ভবত ন্যাচারালি তৈরি হয় । আমি ওকে গোসল করাই ঠিকই তবে কোন আলাদা সুগন্ধী মাখিয়ে দেই না । আলাদা ভাবে এটা কোথা থেকে আসে কে জানে । আমি ওকে আরও একটু আদর করলাম । তারপর বলল, জানিস মিউ আজকে আমার চাকরি চলে গেছে !
সে বলল, মিউ !
-সত্যি । আমি বুঝতেই পারলাম না আমি কী করলাম । আমাকে তো রিয়ানা ম্যাডামের চেনার কথা না । এমন কি আমি কোন তার ভাইদের দিকের লোকও না । আমার কি মনে হয় জানিস, কেউ আমার নামে তার কানে কিছু বলেছে ।
-মিউ ।
-নাহ ! আমি আর যাবো না । চাকরির জন্য মোটেও তেল দিবো না । নতুন চাকরি পেয়ে যাবো । আর হাতে হাতে বেশ কিছু টাকা জমানো আছে । ৪/৫ মাস এমনিতেই চলে যাবে । -
-মিউ ।
আমি বললাম, দাড়া আমি গোসল করে আসি । তারপর আজকে তোর সাথে সেই গল্প করবো ।


আমি বাসায় একাই থাকি । কাজের একটা লোক আছে রান্না করার জন্য । আমি যখন অফিসে থাকি সে এসে রান্না করে দিয়ে যায় । তার কাছে চাবি রাখা আছে । তাই কাপর চোপড় বদলানো, ওয়াশরুমে যাওয়া এগুলোর সময় আমি খুব একটা দরজা আটকাই না । আজও আটকাই নি ।


সম্পূর্ন কাপড় ছেড়ে গোসল পরার সময় খেয়াল হল মিউ এসে দাড়িয়েছে দরজার কাছে । একভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । এই ব্যাপারটা এই বেড়ালের ভেতরে খুব আছে । আমার সাথেই সে প্রতিবার গোসল করে । আমি হাত বাড়িয়ে ডাক দিতেই সে দৌড়ে চলে এল ঝর্ণার নিচে । দুজন মিলে বেশ লম্বা সময় ধরে গোসল করে বের হলাম।


তিন
পরের দিন আমার অফিস যাওয়ার কোন তাড়া ছিল না । তাই মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করে ঘুমালাম । রাতে একটু দেরি করেই ঘুমিয়েছিলাম । যেহেতু সকালে কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই । ঠিক করেছিলাম যে সকালের আর দুপুরের খাবার এক সাথে খাবো কিন্তু আমাকে জেগে উঠতে হল ।
আমার ঘুম খুব বেশি গাঢ় না । একটু শব্দ হলেই আমি জেগে উঠি । আজকে জেগে উঠলাম ফোনের শব্দে । কোন মতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে কোন নাম্বার নেই । লেখা প্রাইভেট নম্বর ।
ঘুম চোখে একটু অবাক হতে হল । পাশের দেশ ইন্ডিয়াতে এই ভিআইপি নম্বরের প্রচলন আছে ! আমাদের দেশেও আছে, সেটা তো জানা ছিল না । আমি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ের গলা শুনতে পেলাম ! কোন প্রকার সম্মোধন ছাড়াই সে বলল, আপনার অফিসে আসার কথা দশটার আগে ! ইতিমধ্যে এগারো মিনিট লেট আপনি !

আমার ঘুম ছুটে গেল সাথে সাথেই । আমি কোন দিন রিয়ানা ম্যাডামের সাথে সরাসরি কথা বলি নি । কিন্তু আমি তার কন্ঠে চিনে ফেললাম সাথে সাথেই । এই মেয়ে আমাকে কেন ফোন দিয়েছে !
নিজে ফোন দিয়েছে !
খাইছে আমারে !
আমি কোন মতে বললাম, আসলে ম্যাম আমার তো চাকরিই নেই !
-কে বলেছে নেই?
-আসলে বোর্ডে আমার নাম নেই তো !
-আর ইউ সিওর ?

আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম । কালকে অফিস থেকে আসার পরে আমি আর বোর্ড চেক করি নি । হয়তো বিকেল কিংবা রাতের বেলা আমার নাম এন্ট্রি করা হয়েছে । আমি কী বলবো খুজে পেলাম না । ওপাশ থেকে আবারও তার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম ।
-আপনাকে আধা ঘন্টা সময় দিলাম । এর ভেতরে আমার কেবিনে হাজির হবেন ।

লাইন কেটে গেল!

ফোন কাটার পরেও আমি কিছুটা সময় চুপ করে বিছানাতেই পড়ে রইলাম । আমার ঠিক বিশ্বাস হল না যে রিয়ানা ম্যাডাম আসলেই আমাকে ফোন দিয়েছে । নিজে ফোন দিয়েছে ! নাকি আমি ঘুমের ভেতরেই স্বপ্ন দেখলাম এতো সময়ে ।
কিন্তু দুই মিনিট পরে বুঝতে পারলাম যে আমি আসলেই স্বপ্ন দেখছিলাম না । রিয়ানা আরমান সত্যিই সত্যিই আমাকে ফোন দিয়েছিলো । আমি আর দেরি করলাম না । অফিস আমার বাসার কাছেই । তাই তৈরি হয়ে সেখানে পৌছাতে আমার খুব একটা বেশি সময় লাগলো না ।

রিয়ানা আরমানের কেবিনের সামনে এসে কিছু সময় চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম । অনুভব করতে পারছিলাম যে বুকের ভেতরে একটা অচেনা অনুভূতি হচ্ছে । খানিকটা ভয়ভয়ও করছে । এই কেবিনের ভেতরে আমি কোন দিন ঢুকি নি । কোন দিন ঢোকার সুযোগ আসবে সেটাও কোন দিন ভাবি নি । যদিও আমি এখনও ঠিক জানি না যে আমি এর ভেতরে ঢুকে কী করবো আর আমাকে এখানে কেনই বা ডাকা হয়েছে !

আমি বড় একটা দম নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম । ঢুকতেই দেখি রিয়ানা আরমান একেবারে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে । যেন তিনি জানতেনই আমি ঠিক এই সময়েই ঘরে ঢুকবো । আমার অবশ্য কেবিনে ঢোকার আগে একবার নক করা দরজার ছিল ।
রিায়ানের চোখে সানগ্লাস নেই । আর আগে আমি তাকে যতবার দেখেছি ততবার তার চোখে কালো সানগ্লাস দেওয়া ছিল । আজকে তার চোখ আমি সরাসরি দেখতে পাচ্ছি ।

আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে । আমি কিছুতেই সেই অদ্ভুত সুন্দর চোখ থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নিতে পারলাম না । একভাবে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে । হালকা নীল চোখ !

আমাদের দেশের মেয়েদের চোখের রঙ সাধারনত কালো কিংবা হালকা খয়েরী হয় । নীল চোখ আগে দেখেছি বলে মনে পড়লো না । অথবা এমন হতে পারে রিয়ানা আরমান চোখে কন্ট্যাক্ট লেন্স পরেছে । ইদানীং অনেকেই এমনটা পরে । আমার মনের কথা রিয়ানা কিভাবে বুঝে গেল আমি জানি না । সে আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত চোখে বলল, আমি কন্ট্যাক্ট লেন্স পরি না !

আমি কথাটা শোনার সাথে সাথ চমকে গেলাম । এই মেয়ে কিভাবে জানলো যে আমি তার নীল চোখের কথাই ভাবছি ! আবারও আমার মনের কথা যেন সে বুঝতে পারলো । বলল, কীভাবে বুঝলাম এই ভাবছেন তো ! এটাই স্বাভাবিক না ? যেই আমার চোখ সরাসরি দেখে সবার আগে ভাবে যে আমি হয়তো কন্ট্যাক্ট লেন্স পরেছি । কারণ এই দেশের মেয়েদের চোখের রং নীল হয় না । তাদের অবাক হওয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারি । যাই হোক আসুন ! বসুন আমার সামনে !

আমি ধীর পায়ে তার সামনে গিয়ে বসলাম । মনের ভেতরে তখনও কেমন যেন মনে হচ্ছে । এই অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা নেই । আমার কেবল মনে হচ্ছে যে সামনে বসা এই মেয়েটির ভেতরে কিছু একটা অস্বাভাবিকত্ব রয়েছে । কিন্তু কী সেই অস্বাভাবিকত্ব সেটা আমি ধরতে পাচ্ছি না । আমি রিয়ানা আরমানের দিকে তাকিয়ে রইলাম আরও কিছু সময় । অথবা বললে ভাল হয় যে আমি বাধ্য হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে । কিছুতেই আমি আমার চোখ সরিয়ে নিতে পারি নি ।

রিয়ানা বলল, আপনার নতুন পোস্ট সম্পর্কে কোন কিছু বলার আছে কি?
আমি বললাম, আসলে আমি জানিই না যে আমার পোস্ট টা কি?
রিয়ানা হাসলো । তারপর একটা খাম আমার দিকে এগিয়ে দিল । খামটা খুলতেই আমার চোখ কপালে উঠলো । আমাকে এমডির পিএস বানানো হয়েছে । আমার অবাক হওয়ার ব্যাপারটা যেন রিয়ানা খুব উপভোগ করছে । তার মুখের হাসির দিকে তাকিয়েই আমি সেটা খুব ভাল করেই বুঝতে পারছিলাম । আমার মাথায় ঠিক এমন কিছু আসছিল না যে আমি এমন কী করলাম যে আমাকে হঠাৎ করেই রিয়ানা তার পিএস বানিয়ে দিল !
কিছু একটা কারণ তো আছেই । আমাকে সেই কারণটা খুজে বের করতে হবে !


চার
আমার আগের সেই সুখের দিন আর রইলো না । আমি যেমন আগে অফিস শুরু হওয়ার ঠিক আধা ঘন্টা আগে উঠতাম, অফিসে আসতাম এখন আর সেটা হচ্ছে না । আমাকে উঠতে হয় বেশ আগেই । আমার বাড়ির কাছে গাড়ি এসে উপস্থিত হয় । সেই গাড়িতে চড়ে আমাকে গিয়ে হাজির হতে হয় রিয়ানা ম্যাডামের বাসায় । সেখান থেকে তাকে নিয়ে আসতে হয় অফিসে । তারপর সারাদিন তার সাথেই ঘোরাঘুরি । রাতে একেবারে তাকে বাসায় দিয়ে এসে আমাকে বাসায় আসতে হয় । অবশ্য গাড়ি আমাকে বাসা পর্যন্ত পৌছে দেয় ! বাসায় এসে আমার ক্লান্তিতে শরীর ভরে ওঠে । অবশ্য বাসায় আসার আগেই দেখি মিউ সোফার উপরে বসে রয়েছে । আমি ঘরে ঢুকতেই সে দৌড়ে আমার কাছে চলে আসে । আমার কাছ থেকে কিছু সময় আদর নেয় । তারপর শোবার ঘরের দিকে চলে যায় । এটা হচ্ছে তার সাথে এখন ঘুমাতে হবে সেই ইঙ্গিত ! আমিও, ফ্রেশ হয়ে, খাওয়া দাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়তাম । এভাবে কিভাবে মাস খানেক পার হয়ে গেল সেটা টেরই পাই নি ।

তারপরই একদিন নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলো । সেদিন রিয়ানা ম্যাডামকে বাসায় রেখে আমিও বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম । মাঝ পথেই গাড়িটা কেমন যেন করে উঠলো । কিছুদুর গিয়েই গাড়িটা থেমে গেল । আমার বাসা থেকে তখনও গাড়িটা একটু দুরে । গাড়ি ঠিক হতে কত সময় লাগবে কে জানে, আমি এই ভেবেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম । এখান থেকে বাসায় হেটে যেতে খুব বেশি হলে মিনিট বিশেক লাগবে । আর পথে যদি রিক্সা পেয়ে যাই তাহলে তো আরও কম সময় লাগবে ।

গাড়ি থেকে নেমে হাটা দিবো তখনই ড্রাইভার বলল, স্যার গাড়ি থেকে নাইমেন না । ঠিক হয়ে যাইবে এখনই !
-আরে সমস্যা নেই । এখান থেকে হেটে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না !
-ম্যাডাম আমারে কইছে আপনেরে বাসার সামনেই নামায়ে দিতে । আগে যেন না নামিয়ে দেই !
-তোমার ম্যাডামকে বলার দরকার নেই । তাহলেই তো হল ! কোন চিন্তা কর না । তুমি গাড়ি ঠিক করে চলে যাও । ম্যাডাম কিছু জানতে চাইলে বলবে যে আমাকে নামিয়ে দিয়েই গেছো । আমিও তাই বলবো । ব্যাস !

আমি আর দাড়ালাম না । গাড়ি থেকে নেমে হাটা দিলাম । আমার কাজটা যেন ড্রাইভার মজিদের মোটেও পছন্দ হল না । তবে সে আমাকে বাঁধাও দিতে পারলো না । আমি আপন মনে হাটতে শুরু করলাম । যদি কোন রিক্সা নাও পাই তবুও খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না !

আমার বাসা যখন আর মিনিট দশেক দুরে রয়েছি তখনই অনুভব করলাম যে জায়গাটা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে আছে । এমন কি রাস্তায় কোন আলোও জ্বলছে না । আমি আগেই বলেছি আমি থাকি অফিসের কাছাকাছি । পিক আওয়ারে এই এলাকাটা বেশ জমজমাট থাকে কিন্তু ছুটির দিন গুলোতে কেমন যেন নিশ্চুপ আর নির্জন মনে হয় । এই যে অফিস ছুটির পরে এই স্থানটা যেন মৃত্যুপুরি হয়ে গেছে । কিন্তু আজকে যেন আরও বেশি নির্জন মনে হচ্ছে । এতো নিশ্চুপ হওয়ার কারণ কী?

আমি দ্রুত হাটতে শুরু করলাম । তখনই আমার মনে হল কেউ যেন আমার পেছন পেছন হাটছে ।
যতদুরে চোখ যায় আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না । রাস্তার পাশে অন্য দিন হকারের দোকান বসে, রিক্সাওয়ালা থাকে আজকে কেউ নেই কিছু নেই ! ঢাকা শহর এতো নির্জন হয় নাকি?
এই ব্যাপারটা আমার কাছে সত্যিই বেশ অস্বাভাবিক মনে হল । আমি দ্রুত পা চালালাম । সেই সাথে এবার সত্যিই অনুভব করলাম খুব আস্তে সমর্পনে কেউ যেন আমার পিছু নিয়েছে । সে রাস্তায় এমন ভাবে পা ফেলছে যে আওয়াজ হচ্ছেই না একদম । তারপরেও আমি তার উপস্থিতি টের পাচ্ছি । আমি এবার হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম । অনুভব করলাম পেছন থেকেও হাটার গতি বেড়ে গেছে ।

নিজেকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করলাম যে কোন ভাবেই পেছনে তাকানো যাবে না, সামনে এগিয়ে যেতে হবে । তবে সেটা আর হল না । আমি পেছনে তাকিয়ে ফেললাম । আর তাতেই মনে হল যে তাকানোটা মোটেই ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না । আমার থেকে হাত বিশেষ দাড়িয়ে রয়েছে । মিশমিশে কালো দেহ । দেহে কোন পোশাক নেই তার । সব কিছু অন্ধকার কেবল তার চোখ ছাড়া । কোন মানুষের চোখ এমন লাল হতে পারে আমার সেটা ধারণা ছিল না । সে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । আমার মনে হল এখান থেকে আমার এখনই পালাতে হবে । যে কোন ভাবেই আমাকে পালাতেই হবে । কিন্তু তখনই অনুভব করলাম যে আমি একদমই নড়তে পারছি না । আমার পুরো শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে । ঐ চোখের দিক থেকে আমি নিজের নজর সরাতে পারছি না একদমই । আমাকে যেন সম্মোধন করে ফেলেছে সে । সে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগলো আমার দিকে । আমি অসহায়ের মত দাড়িয়ে রইলাম কেবল । আমার যেন কিচুই করার নেই । যতই সে এগিয়ে আসতে লাগলো ততই আমি তার অয়বয়টা ভাল করে ধরা পড়তে লাগলো আমার চোখ । হ্যা সে দেখতে মানুষের মতই । তারপরেও আমার মনে হল যে সে মানুষ না ।

সে আরও এগিয়ে এল আমার দিকে । যখন আমার থেকে আর মাত্র কয়েক হাত দুরে তখনই একটা অবাক করা ব্যাপার ঘটলো । আমি দেখতে পেলাম কোথা থেকে যেন মিউ লাফিয়ে এসে পড়লো আমাদের দুইজনের মাঝে । তারপর সামনের ঐ প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে প্রবল কন্ঠে ডেকে উঠলো । সাথে সাথেই আরও অবাক করা ঘটনা ঘটলো । কোথা থেকে যেন আরও সাত আটটা বেড়াল আমাকে ঘিরে ধরলো । এমন ঐটার দিকে আক্রমনত্মক ভঙ্গি করে হিশহিস করতে লাগলো । আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম । কী হচ্ছে, আর কেন কীভাবে হচ্ছে কিছুই যেন মাথায় ঢুকলো না আমার ! তবে দেখলাম সেই লাল চোখের মানুষটা পিছাতে শুরু করলো । আস্তে আস্তে সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ।
তখনই আমি নিজেকে ভার মুক্ত অনুভব করলাম । আমার সামনেই মিউ দাড়িয়ে ছিল । আমি দ্রুত মিউকে কোলে তুলে নিলাম । তারপর আমার বাসার দিকে হাটা দিলাম । আমি আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করলাম । আমাদের আশে পাসে ঐ অন্য বেড়াল গুলোও আসতে লাগলো। আমার কাছে মনে হল ওরা যেন আমাকে গার্ড দিয়ে নিয়ে আসছে বাসায় । বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ওরা চলে গেল । মিউকে নিয়ে বাড়ির গেট পর্যন্ত এসেছি এমন সময় সে আমার কোল থেকে ঝাপিয়ে পড়লো । তারপর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ।
ঐদিন রাতে মিউ আর বাসায় এলো না । আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা অস্বাভবিক মনে হল । তবে এটার কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই । আমি খুজেও পেলাম না ।


পাঁচ
পরদিন সকালে ঘটলো আরেক ঘটনা । আমাকে নিতে অফিসের গাড়ি আসে । আজকে গাড়িতে উঠেই অবাক হলাম । গাড়ি যদিও আগেরটাই রয়েছে তবে গাড়ির ড্রাইভার বদলে গেছে । এই ড্রাইভারকে আমি আগেও দেখেছি । কিন্তু সে তো এই গাড়ি চালায় না । আমি নতুন ড্রাইভারকে বললাম, কী ব্যাপার মজিদ কোথায়?
ড্রাইভার আমার দিকে তাকিয়ে একটা না জানার হাসি দিলো । বলল, জানি না স্যার । শুনছি মজিদের চাকরি নাই ।

তথ্যাটা আমি একটু চমকে গেলাম । আমার কেন জানি কাল রাতেই মনে হচ্ছিলো যে রিয়ানা আরমানের কাছে তথ্যটা ঠিকই চলে গেছে । কেমন করে গেছে আমি জানি না । বিশেষ করে কাল যে অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো সেটার কোন ব্যাখ্যা ছিল না । এখন মজিদের চাকরি নেই শুনে মনে হল নিশ্চিত ভাবেই রিয়ানা আরমানের কাছে খবর চলে গেছে ।


আমার ধারণা সত্যি করে দিতেই রিয়ানা আরমান যখন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল তখন তার চেহারার দিকে তাকিয়েই আমি একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে রিয়ানা আরমান গতকালকের ঘটনা জানে । আমি যে তার নির্দেশ অমান্য করে গাড়ি থেকে বের হয়ে রাতে হেটে হেটে বাসায় ফিরেছি এবং পথের মাঝখানে বিপদে পড়েছিলাম, এই তথ্য সে জানে ।

গাড়ি এগিয়ে চলল । রিয়ানা মুখ গম্ভীর করে বসে রইলো সিটের উপর । আমার দিকে কেবল একবার তাকিয়েছে সে । তারপর নিজের মোবাইলে কী যেন করছে । আমি যেন গাড়িতেই নেই এমন একটা ভাব করে আছে । আমি কিছু বলার সাহস পেলাম না । চুপ করে বসে রইলাম । তখনই খেয়াল হল গাড়ি অফিসের দিকে যাচ্ছে না । গাড়িটা যাচ্ছে মুন্সিগঞ্জের দিকে ।

আমি ড্রাইভারকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই পেছন থেকে রিয়ানা বলল, রফিক, ফার্ম হাউজের দিকে নিয়ে যাচ্ছো তো ?
-জে ম্যাডাম ।
-গুড ।

আমি আর কিছু জানতে চাইলাম না । তবে একেবারে চুপচাপ বসে থাকতেও ভাল লাগছিলো না । কি যে করি !
অনেক সাহস করে পেছনে ফিরে তাকালাম । তারপর বলল, ম্যাম ফার্মহাউজে যাচ্ছি ! কোন কাজ ছিল কি?
-হ্যা ।
-ও !

আবারও আমি চুপ করে গেলাম । কি বলবো খুজে পেলাম না আর । বসে বসে আপন মনেই গত রাতের কথা ভাবতে লাগলাম । কিভাবে গত কাল রাতের ঘটনাটা ঘটে গেল ! কালো মত ঐ প্রাণীটা আসলে কি ছিল ? আর মিউ ওভাবে সামনে চলে এল কেমন করে ! এছাড়া মিউর আশে পাশে ঐ বিড়াল গুলোই বা কোথা থেকে এল । মিউয়ের আশে পাশের ঐ বিড়াল গুলো দেখে আমার কেন যেন মনে হয়েছে ওরা সবাই মিউয়ের বডি গার্ড টাইক কিছু একটা ।
কিন্তু মিউয়ের সাথে আমার প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিলো সেইদিন মিউয়ের সাথে তো কেউ ছিল না । আর সেদিন মিউয়ের তো এতো সাহসও ছিল না যেমনটা ও গত রাতে দেখালো । আমার মিউয়ের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দিন মনে পড়লো । সেদিনও এমন রাতই ছিল । তবে সেদিন বেশ বৃষ্টি হয়েছিলো । আমার অফিসে বেশ কিছু কাজ ছিল । বের হতে হতে প্রায় রাত দশটা বেজে গেছে । আমি যখন অফিস থেকে বের হয়েছি তখন সব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে । আমি আগেই বলেছি যে দিনের বেলা এই অফিস পাড়াটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যায় । আর সেদিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে এলাকাটা যেন একেবারে সুনসান নিরব হয়ে গেছে । আমি চুপচাপ নিজের বাসার দিকে হাটা দিলাম ।

সেদিনও অর্ধেক পথ এসেছি তখনই কাছে কোথাও কয়েকটা বেড়ালের তীব্র চিৎকার শুনতে পেলাম । এতোই জোড়ে যে আমি বেশ চমকে গেলাম । রাস্তায় কেবল ল্যাম্প পোস্টের আলো জ্বলছে । সেই আলোতেই আমি দেখতে পেলাম একটা ধবধবে সাদা বেড়ালে দৌড়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে । ঠিক তার পেছনেই দুটো কালো বেড়াল ধাওয়া করে আসছে । আমি সত্যিই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে । পেছনের বেড়াল দুটো একটু বড় । বনবেড়ালের সমান বড় !
সাদা বেড়ালটা দৌড়ে এসে আমার পায়ের পেছনে লুকালো । আমি একবার ওটার দিকে তাকালাম এবং অবাক হয়ে দেখলাম কাধের কাছে একটা ক্ষত হয়ে আছে । সেখান দিয়ে রক্ত ঝরছে । এতো চমৎকার একটা বেড়াল আর এই দুটো পাজি বেড়াল ওটাকে একা পেয়ে এমন ভাবে আঘাত করেছে । মেজাজটা এতো খারাপ হল ! কালো বেড়াল দুটো এগিয়ে আসছে আর মুখ দিয়ে কেমন ঘড়ঘড় করতে লাগলো ।

ডান পাশের বেড়াল একটু যেন বেশিই কাছে চলে এসেছে । এতো সাহস দেখে আমি খানিকটা অবাকই হলাম । এবং সাথে সাথে মেজাজ আরও খারাপ হল । ডান পায়ে আমার ফুটবলের শট খুব ভাল । ক্যাম্পাসের ফুটবল টিমে আমি সেকেন্ড ফরওয়ার্ড ছিলাম । অনেক দিন যদিও খেলি না তবে এই বেড়ালকে মিস করার কোন চান্সই নেই ।

বেড়ালের ঠিক পেট বরাবর আঘাতটা লাগলো । এবং সেটা উড়ে গিয়ে কোথায় যে পড়লো আমি নিজেও জানি না । কেবল একটা ভয়ংকর ডাক শুনতে পেলাম বেড়ালটার । অন্য বেড়ালটা দেখলাম একটু পিছিয়ে গেছে । একবার আমার দিকে, একবার আমার পায়ের দিকে তাকালো কয়েকবার । তারপর কয়েক মুহুর্ত চুপ করেই কেটে গেল । আমি আরেকটা লাথি মারার জন্য প্রস্তুতি নিয়েই রাখলাম । বেটা সামনে এগিয়ে আসতে গেলেই আরেকটা লাথি হাকাবো । কিন্তু বেটা এল না । আস্তে করে পেছনে সরে গেল ।

আমি পায়ের কাছে তাকিয়ে দেখি সাদা বেড়ালটা কেমন যেন মাটিতে শুয়ে পড়েছে । ক্ষত থেকে রক্ত পরছে । আমি সেটাকে কোলে তুলে নিলাম । তারপর নিজের বাসার দিকে দ্রুত হাটা দিলাম ।
বাসায় পৌছে সবার আগে বেড়ালটাকে পরিস্কার করে, ক্ষত স্থানে স্যাভলন দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলাম । তারপর যত্ন করে নিজের বিছানার পাশেই শুইয়ে দিলাম ওটাকে । আরাম করে ঘুমাতে শুরু করলো ।

পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন তাকিয়ে দেখি বেড়ালটা সেখানে নেই । তবে ঐদিন রাতে ঠিকই ফিরে এসেছিলো । অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম ক্ষত স্থানটা প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে । এতো দ্রুত শুকিয়ে যাবে আমি ভাবি নি । এরপর থেকে অফিস থেকে ফিরে এসেই তাকে দেখতে পেতাম । রাতে থাকতো আর সকালে হাওয়া হয়ে যেত ।

খেয়াল করলাম যে গাড়ি থেমে গেছে । একটা বাংলো টাইপের বাড়িতে ঢুকছে গাড়ি । আমি কয়েকবার শুনেছি এই ফার্ম হাউজের কথা । তবে এইবারই প্রথম এসে হাজির হলাম । গাড়ি থামতেই রিয়ানা বের হয়ে গেল গাড়ি থেকে । তারপর সোজাসুজি হাটতে শুরু করলো । আমি দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে তার পেছনে হাটা শুরু করে দিলাম । সত্যি আমি এসবের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না ।

ঘরের ভেতরে ঢুকতেই দেখি রিয়ানা বসার ড্রয়িং রুমের সোফার উপরে বসে রয়েছে গম্ভীর ভাবে । আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম সেদিকে । এখনও আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ।
-ম্যাম !
-ইয়েস !
-আপনি কি কোন কারণে আমার উপরে রেগে আছেন ?
-তোমার কি মনে হয় না আমার রেগে থাকা উচিৎ?

আমি খানিকটা অবাক হলাম । কারণ এই কয়দিন রিয়ানা আমাকে ঠিকই আপনি আপনি করে বলতো আজকে সোজাসুজি তুমি করে বলছে । এবং আমাকে তখন আরও অবাক করে দিয়ে বলল, চাইলে তুমিও আমাকে তুমি করেই বলতে পারো!

আমি কয়েক মুহুর্ত কেবল অবাক হয়ে রিয়ানার দিকে তাকিয়ে রইলাম । এই মেয়ে কিভাবে জানলো আমার মনের কথা! আমি কী ভাবছি সেটা তো কোন ভাবেই তার জানার কথা না !

এই কথাটা ভাবতেই দেখলাম রিয়ানা সোফা থেকে উঠে দাড়ালো । তারপর আস্তে আস্তে আগিয়ে আসছে লাগলো আমার দিকে । পুরোপুরি চোখ আমার চোখের দিকে । আমি এমনিতেই রিয়ানার চোখের দিকে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না । এই মেয়ের চোখের ভেতরে কিছু একটা আছে যা আমাকে খানিকটা অস্বস্তিতে ফেলে দেয় । আর এমন সুন্দর চোখের দিকে খুব বেশি সময় এমনিতেও তাকিয়ে থাকা যায় না । কিন্তু আজকে আমি চাইলেও চোখ সরিয়ে নিতে পারলাম না । একেবারে ওর নীল চোখের দিকে আমাকে তাকিয়ে থাকতে হল । রিয়ানা থামলো একেবারে আমার সামনে । ওর মুখ থেকে আমার মুখ মাত্র কয়েক ইঞ্চি দুরে । আমি তখনই একটা গন্ধ পেলাম । খুব পরিচিত গন্ধ । এই সুগন্ধটা আমি কোথায় পেয়েছি !

মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম ।

আমার চোখের দিকে তাকিয়েই রিয়ানা বলল, মনে পড়েছে?
কোন মতে বললাম, মানে?
-মানে এই পরিচিত গন্ধটা । মনে পড়েছে ?

আমার তখনই মনে পড়লো ! এটা মিউয়ের শরীরের গন্ধ । কিন্তু রিয়ানার শরীর থেকে কিভাবে আসছে এই গন্ধ !
কিভাবে?

রিয়ানা এবার আমার আরো কাছে এল । আলতো করে আমার ঠোঁটে চুমু খেল একটা । আমি যেন একেবারে জমে গেলাম । আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারছি না । কেন হচ্ছে আর কিভাবে হচ্ছে ! একবার মনে হল আমি নিশ্চিত ভাবে গাড়িতে আসতে আস্তে ঘুমিয়ে পড়েছি । সেই ঘুমের ভেতরেই আমি স্বপ্ন দেখছি । নয়তো এমন কিছু তো হওয়ার কথা না ।

রিয়ানা আবার গিয়ে বসেছে সোফাতে । আমাকে ইশারা করলো ওর পাশে বসতে । আমি কোন কথা না বলে গিয়ে বসলাম ওর পাশে । রিয়ানা আমার হাত ধরলো । তারপর বলল, ভেবেছিলাম তোমাকে কোন দিন জানাবো না ব্যাপারটা । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে জানাতেই হবে । এটার সাথে তোমার জীবনের নিরাপত্তা জড়িত ।
-মানে?
-বলছি !

রিয়ানা একটা দম নিল জোড়ে । তারপর বলল, আমি এখন যা বলবো তা তোমার কাছে হাস্যকর মনে হবে কিংবা অবিশ্বাস্য । তবে এটা সত্য !
আমি একভাবে তাকিয়ে রইলাম রিয়ানার দিকে । রিয়ানা বলল, এটা তো মানো এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু রয়েছে যার কোন ব্যাখ্যা নেই । আছে না?
-হ্যা । তা তো আছেই!
-আমাদের জাতিটাও ঠিক তেমনই একটা জাতি, যা কোন ব্যাখ্যা নেই ।
-আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না ।
-আমাদেরকে বলা হয় মিরুচুং । সুন্দরবনের ইন্ডিয়ান পোরসনে বাস করতো আমাদের পূর্বপুরুষেরা । তারপর একজন সময় বন কমতে শুরু করলে তারা লোকালয়ে চলে আসে । সেখানেই বসবাস করতে শুরু করে । যখন দেশ ভাগ হয়ে যায় তখন এই এদেশে চলে আসে । তারপর থেকে এখানেই থাকছি । যদিও আমাদের কিছু অংশ এখনও বনের ভেতরেই বাসবাস করে । তবে গোত্র প্রধান এখন এখানে । সেটা হচ্ছে আমার বাবা ।
-তার মানে তুমি প্রিন্সেস ?

রিয়ানা হাসলো । তারপর বলল, বলতে পারো ।
আমি বললাম, এতে অবিশ্বাস করার কী আছে ! খুবই স্বাভাবিক ঘটনা ! আগে একটা সম্প্রদায় বনের ভেতরে থাকতো তারপর তারা লোকালয়ে চলে এসেছে । সিম্পল !
-এতো সিম্পল না । আমাদের গোত্রটা ঠিক অন্য সব গোত্রের মত স্বাভাবিক না । এমন কী আমরা ঠিকঠাক মত মানুষও না ।
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, কী বলছো এসব?
-বন বেড়াল চেনো তো ? যেটাকে তোমাদের এলাকাতে খাটাস বলে ! চিনো না ?
-হ্যা । মুরগি চুরি করে খায় !
রিয়ানা হেসে ফেলল । তারপর বলল, হ্যা । ওটাই । ঐ বনবেড়াল হচ্ছে সম্পর্কে আমাদের কাজিন !
আমি কোন কথা না বলে রিয়ানার দিকে তাকিয়ে রইলাম ।
-রিয়ানা বলল, বিশ্বাস করছো না জানি । কিন্তু এটা সত্য । আমরা অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক বেড়াল । আমরা মানুষের মনের কথা খুব ভাল করে বুঝতে পারি কেবল তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে । একটু আগেই তুমি বুঝতে পেরেছো সেটা ।
অন্য কেউ হলে আমি এই কথা হেসেই উড়িয়ে দিতাম তবে রিয়ানার চোখের দিকে তাকিয়ে সেটা আমি পারলাম না ।

আমি বললাম, কিন্তু এতো কিছুর ভেতরে আমি কোথা থেকে এলাম ?
-তুমি ! আমাকে তুমি কিভাবে পেয়েছিলে মনে আছে?
-তোমাকে !

আমি যেন ঠিক মত বুঝতে পারলাম না ওর কথাটা !
রিয়ানা বলল, তোমার মিউকে ! ঐ রাতের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই ?

আমার খুব ভাল করে মনে আছে ! রিয়ানা বলল, আমি আসলে আমার গোত্রের পিওর ব্লাড না । পিওর ব্লাড বলতে আমার বাবা আগের স্ত্রীর পক্ষের দুই ছেলে । ওদের মাও একজন মিরুচুং। কিন্তু আমার মা মিরুচুং নয় । আমার মা একজন মানুষ । এই জন্য আমি মিক্স ব্লাড । এটাই আসলে আমার দুই ভাই পছন্দ করতো না । আমাদের গোত্রে ছেলেরাই গোত্র প্রধান হবে এমন কোন কথা নেই । ছেলে মেয়ে যে কেউ প্রধান হতে পারে । আমিও পারি । কিন্তু একজন মিক্স ব্লাড প্রধান হবে সেটা ওরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না । তাই সেদিন দুইজন মিলে আক্রমন করেছিলো । নিশ্চয়ই দেখেছো ওদের তুলনাতে আমি খানিকটা ছোট । পেরে উঠতাম না । তাই পালাচ্ছিলাম । যেহেতু ভাই বোন আমরা তাই অন্য কেউ আমাদের মাঝে ইন্টারফিয়ার করে নি । এমন কি আমাদের বাবাও না । তার ভাষ্য হচ্ছে ক্ষমতার লড়াই একান্তই আমার । এখানে আমাকে সাহায্য করলে অন্য ছেলেদের প্রতি অবিচার করা হবে । ওরা হয়তো ঐদিন আমাকে মেরেই ফেলতো যদি তুমি মাঝে না চলে আসতে । বিশেষ করে ওভাবে কিকটা যে মেরেছো ! মাই গড ! ও কোথায় গিয়ে পড়েছিলো জানো?
-কোথায়?
-গাছের ওপাশেই একটা দেওয়াল ছিল । দেওয়ালের উপরে লোহার শিক দেওয়া ছিল । ঠিক ওটার মাঝে !

রিভুকে তারপর শায়েস্তা করতে আমার খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি । আমরা মিরুচুং রা মানুষ হিসাবে একটু ভলনারেবল । যখন বেড়ালের বেশে থাকি তখন শক্তিশালী । কিন্তু আমি মিক্স ব্লাড হওয়ার কারণে মানুষের বেশেও আমি বেশ ভাল ।
আমি এবার বললাম, তার মানে তুমি বলতে চাও তুমি মিউ ? আমার বেড়াল !
-এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না?
-না । সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছে না ।
-আচ্ছা থাক, দরকার নেই বিশ্বাস করার । ওটা সময় আসুক নিজ চোখের দেখবে । এখন তোমাকে যে কারণে আমি সব সময় চোখে চোখে রাখি, সেটা হচ্ছে রিগুকে ওভাবে কিক মারার কারণে কিছু মিরুচুংয়ের রাগ রয়েছে তোমার । গতকাল রাতেই ওদের পাঠানো একটা মিরুচ তোমাকে আক্রমন করেছিলো । মিরুচ হচ্ছে এক বিশেষ ধরণের অপদেবতা । যখন আমরা প্রথম এই লোকালয়ে বাস করতে এলাম মানুষের সাথে তো শক্তিতে আমরা পেরে উঠতাম না । তখন এই মিরুচ কে ডেকে আনা হয় নরক থেকে আমাদের সাহায্য করার জন্য । এখন যদিও আর দরকার পড়ে না তারপরেও কেউ কেউ এখনও এসবের চর্চা করে ।

এইবার আমি একটু ভয় পেলাম । যতই আমি রিয়ানার কথা বিশ্বাস না করি, গতকাল যে কিছু একটা আমার সামনে এসেছিলো সেটার ব্যাপারে তো কোন সন্দেহ নেই । এবং মিউ সহ ঐ বেড়াল গুলো যে আমাকে রক্ষা করেছিলো সেটাও ভুল না । কেবল মাত্র মিউই যে রিয়ানা এই ব্যাপারটা বাদ দিলে রিয়ানার পুরো গল্পটুকু একেবারে বিশ্বাস যোগ্য ।

আমি কিছু বলতে যাবো তখনই রিয়ানা উঠে দাড়ালো । বেড়ালের মত নাক উচু করে কি যেন শুকলো বাতাসে । সাথে সাথেই দেখলাম আমাদের ড্রাইভার ও সাথে আরেকজন দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো ।
রিয়ানা তাকে জিজ্ঞেস করলো, কত জন ?
-অন্তত দশ জন ! আমাদের আজকে এখানে আসার কথা ছিল না । আমি বলেছিলাম বডিগার্ড নিয়ে আসতে ! ওদের কেউ হয়তো পিছু নিয়েছিলো তারপর অন্যদের খবর দিয়েছে !
-চিন্তা কর না । গেট লক কর । আর খবর পাঠাও । বাকিটা দেখছি ।

ওরা চলে গেল !
আমি রিয়ানার দিকে তাকিয়ে বললাম, কি হচ্ছে এসব ?
রিয়ানা শান্ত কন্ঠে বলল, বিভু বাইরে গিয়েও ঠিক হয় নি । ওকে যেতে দেওয়াই ঠিক হয় নাই ।

আমি অবাক হয়ে ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলাম । ওকে এই কদিনে কাছ থেকে যেমন টা দেখেছি আজকে কেমন যে অপরিচিত মনে হচ্ছে। ও মোবাইল বের করে কাকে যেন ডায়েল করতে লাগলো । তারপর আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, তুমি এক কাজ কর, পাশের ঘরের ভেতরে চলে যাও । দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে ।

একটা মেয়ে আমাকে বলছে ঘরের ভেতরে গিয়ে বসে থাকতে এই বাক্যটা কেন জানি আমার পৌরষত্ব্যে খানিকটা আঘাত করলো ।
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই রিয়ানা বলল, এখানে অন্য কোন ভাবে নিও না । যা আসছে সেটার সাথে তুমি কোন ভাবেই লড়তে পারবে না । সো দরকার কি ! এখানে হিরোইজম দেখানোর কোন মানে নেই । আর আমি আছি, আমার সাথে ওরা আছে । সামলাতে পারবো । ততক্ষনে ফোর্স চলে আসবে । কোন চিন্তা নেই ।

আমি তবুও দাড়িয়ে রইলাম । কিছুতেই আমি ঘরের ভেতরে গিয়ে বসে থাকবো না । তখনই অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটলো । রিয়ানা আমার চোখের দিকে তাকালো । একেবারে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । সাথে সাথেই আমার মাথায় ভেতরে কেউ যেন বাড়ি মারলো কিছু একটা দিয়ে । সেখানে কেউ আমাকে বলছে এখনই ঘরের ভেতরে যাও । দরজা বন্ধ করে বসে থাকো !
আমি কিছুতেই এই নির্দেশ অগ্রাহ্য করতে পারলাম না । আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে চাইলাম, কিছু বলতে চাইলাম কিন্তু অবাক হয়ে কেবল লক্ষ্য করলাম যে আমার হাত পা নির্দেশের প্রতি সাড়া দিতে শুরু করেছে । আমি আস্তে আস্তে দরজার দিকে পা বাড়াতে শুরু করেছি ।

আমি কয়েকবার নিজের মনকে নিজের নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোন কাজ হল না । বিন্দু মাত্র লাভ হল না । আমি ঘরের ভেতরে গিয়ে হাজির হলাম । তারপর দরজা বন্ধ করে দিলাম । আমি নিজের ভেতরে যেন নেই । বারবার আমার মাথার ভেতর থেকে কেউ যেন বলছে ঘরের ভেতরে ঢুকে বসে থাকো । চুপ চাপ বসে থাকি । আমি খাটের উপরে চুপ করে বসে রইলাম ।

কত সময় এই ভাবে বসে রইলাম আমি নিজেও বলতে পারবো না তবে হঠাৎ আমার কানে বেড়ালের ভয়ংকর আওয়াজ প্রবেশ করলো । যেন অনেক গুলো বেড়াল এক সাথে চিৎকার করছে । এই সব আওয়াজের ভেতরে মিউয়ের আওয়াজ চিনতে কেন জানি আমার মোটেও কষ্ট হল না । আমার বারবার মনে হতে লাগলো বাইরে কিছু হচ্ছে, রিয়ানা মানে বিপদে পড়েছে । ওরা মাত্র তিনজন । সবার সাথে কি পারবে !
আমার মস্তিষ্ক যেই এই চিন্তা করতে লাগলো যে আমাকে এখন বাইরে যেতে হবে তখনই একটা সুক্ষ যন্ত্রনা টের পেলাম আমি । সেটা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো । চিন্তাটা আমি যতই করতে থাকলাম যন্ত্রনাটা ততই বাড়তে লাগলো । আমি জানি কোন ভাবে আমার মনের ভেতরের নিয়ন্ত্রন রিয়ানা নিয়ে নিয়েছে । সে যা হুকুম দিয়েছে আমাকে এখন সেটাই শুনতে হচ্ছে ।

আমি চিন্তা করাটা বাদ দিলাম না । আমাকে এই চিন্তা করে যেতেই হবে । ঠিক তখনই কাজ হল । মনে হল যেন আমার মাথার উপর থেকে একটা ভার কমে গেল । সাথে সাথে বাইরে আমি সেই বেড়ালের আওয়াজ শুনতে পেলাম !

আমার মনের ভেতরে কু ডেকে উঠলো । সম্ভবত রিয়ানার কিছু হয়েছে এই কারণে তার আমার উপর থেকে নিয়ন্ত্রন কমে গেছে ।

আমি দ্রুত দরজা খুলে ড্রয়িং রুমে বের হয়ে এলাম । দরজা দিয়ে বাইরে বের হতে যাবো তখনই দেওয়ালে সাজানো একটা তরবারির দিকে চোখ গেল । সেটা নামিয়ে নিলাম । খাপ থেকে খুলে আবারও বের হয়ে এলাম ।

বাইরে বের হয়ে দেখলাম মিউকে ঘিরে ধরে ধরেছে অন্তত ডজন খানেক বেড়াল । আকারে সব গুলো বড় বড় । চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আরও গোটা ৫/৬ বেড়াল । রক্তাক্ত । মিউয়ের শরীরেও লাল রক্ত আমি দেখতে পেলাম । আমার মাথার ভেতরে কি হল আমি সোজা দৌড়ে গেলাম সেদিকে । আমার সেই বিখ্যাত কিক মারলাম বেড়াল গুলো দিকে । একজনের শরীর লাগলো কেবল সেটা । আর বাকি গুলো সরে গেল । আমি সরাসরি মিউকে আড়ালে নিলাম ঠিক সেদিনের মত ।

এবং সেদিনেই সেই কালো বেড়ালটাকেও চোখে পড়লো আমার । আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে । আমি যেমন ওটাকে চিনতে পেরেছি আমার মনে হল সেটাও আমাকে চিনতে পেরেছে । এটাই তাহলে রিভু আরমান ! সত্যিই কি তাই । তবে আজকে তার চোখে আগের মত সেই দৃষ্টি নেই । আমি কিছু চিন্তা না করে আগের মত করেই তাকে কিক মারতে গেলাম তবে সেটায় কাজ হল না । অদ্ভুত দক্ষতায় সে কটিয়ে গেল আমার কিক । তারপর আমার উপর লাফিয়ে উঠে এল । হাত দিয়ে গালে আচড় দিল বেশ জোড়ে । তীব্র একটা যন্ত্রনা অনুভব করলাম । একটু পরেই বুঝতে পারলাম গাল বেয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছে । বেড়ালট থাবা দিয়ে লাফ দিয়ে দুরে সরে গেছে । অন্যান্য বেড়াল গুলো একটু যেন স্থির হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে । সবাই যেন মজা দেখছে এমন একটা ব্যাপার । এরপর কালো বেড়ালটা একের পর এক আমার উপর হামলা করতেই লাগলো । এতো তীব্র আর দ্রুত যে আমি বিন্দু মাত্র কোন প্রতিরোধ করতে পারলাম না । আমার পুরো শরীরে বেয়ে রক্ত ঝড়তে শুরু করলো । শেষ আঘাতটা পায়ের কাছে এমন ভাবে দিয়েছে মনে হল পায়ের অর্ধেক মাংশ উঠে গেছে । আমি হাটু গেড়ে বসে পড়লাম কেবল ।

পেছনে তাকিয়ে দেখি মিউ কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে । ওর পুরো শরীর রক্তাক্ত !

আমার কেবল মনে হল এখন আমার মরার সময় হয়ে গেছে । আজকে সকালেই কি আমি জানতাম যে আমার সাথে এই রকম কিছু হটে চলেছে । এই ভাবে মরে যাবো !!

শেষ একটা চেষ্টা করে দেখি ! মরলে মরবো ! বেটা রিভুকে নিয়েই মরবো !

আমি এবার তরবারিটা শক্ত করে চেপে ধরলাম । তাকিয়ে দেখি কালো বেড়ালটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে । ওর চোখ মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব । সেই সাথে বেপোয়ারা । এমন একটা ভাব যেন আমার উপরে সে পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব পেয়ে গেছে । এইটাই আমাকে সুযোগ করে দিল । বেটা যখন শূন্যে, আমার থেকে আর কয়েক মুহুর্তের দুরত্ব, আমার দিকে এগিয়ে আসছে তখনই আমি তরবারিটা ঠিক বেটাকে লক্ষ্য করে তুলে ধরলাম ।
কাল হল এতেই । বেটা সোজা এসে ঢুকলো ফলার ভেতরে ! ঢুকে গেল অর্ধেক । এবার শরীরের সব শক্তি একত্রে করে তরবারিটা উল্টে মাটিতে চেপে ধরলাম । বেশ পুরো টুকু ঢুকে গেল ভেতরে । কিছু অংশ মাটিতেও পুতে গেল !

আমি সরে এলাম । বেটা এখানেই শেষ । যেভাবে গেথেছে বের হতে পারবে না আর !
তবে আর দরকার পরলো না । কিছু সময় চিৎকার করতে করতে নিস্তেজ হয়ে গেল । আমার শরীর থেকে রক্ত বের হয়েছে অনেক । কেমন মাথা ঘুরে উঠলো । তবে তখন বিপদ কাটে নি । আরও কত গুলো বেড়াল রয়ে গেছে । মিউকে রক্ষা করতে হবে !

আমি দ্রুত মিউয়ের কাছে গিয়ে হাজির হলাম । এরপর নিজের শরীর দিয়ে গোল কোরে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । বাইরে যতই আক্রমন আসুক মিউ পর্যন্ত আসবে না । এভাবে জড়িয়ে ধরেই কখন যে জ্ঞান হারালাম আমার মনে নেই ! হয়তো আর জ্ঞান ফিরবে না আমার । তবে একটা কাজ তো অন্তত করতে পেরেছি !

তাজা রক্তের গন্ধ আসতে লাগলো আমার নাকে । তবে সেই সব ছাপিয়ে মিউয়ের শরীরের সেই অদ্ভুত চমৎকার গন্ধটা আমার নাকে লাগলো ! গতকাল রাতে মিউয়ের সাথে ঘুমানো হয় নি । আজকে শেষ ঘুমটা হোক !


পরিশিষ্টঃ

চোখ মেলে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম সাদা সিলিংয়ের দিকে । একটু নড়তে গিয়েই টের পেলাম সারা শরীরে ব্যাথা ।
-এই নড়বে না !

আমি একটু মাথা কাত করতে পারলাম । তাকিয়ে দেখি বেডের ঠিক পাশেই রিয়ানা বসে রয়েছে । আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে । বলল, কিছু লাগবে ?
কোন মতে বললাম, কিছু না ।
-তাহলে নড়ছো কেন ? আগে সুস্থ হও । তারপর তোমাকে আমি মজা দেখা্চ্ছি । হিরো সাজতে গেছে, না ?
আমি রিয়ানার চোখে হঠাৎ কেন জানি চিকচিক অশ্রু দেখতে পেলাম ! কিভাবে এখানে চলে এলাম সেটা পড়ে শোনা যাবে । আপাতত যে বেঁচে আছি আর রিয়ানাও ঠিক রয়েছে সেটাই হচ্ছে সব থেকে আনন্দের ব্যাপার !



গল্পের থিমটা কিছুটা ম্যাঙ্গাটুন থেকে অনুপ্রাণীত

গল্পটা আগে নিজেস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ।
Picture sources

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ৯:২৮

মনিরা সুলতানা বলেছেন: আহা রাজ্য সহ রাজকন্যা !!!

২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১০:৩০

অপু তানভীর বলেছেন: গল্পেই কেবল রাজ্যসহ রাজকন্যা পাওয়া যায় । বাস্তবে রাজকন্যা তো দুরে থাকুক কোন কন্যাই খুজে পাওয়া যায় না ! :D

২| ২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ৯:৩২

জুল ভার্ন বলেছেন: খুব বেশী লম্বা গল্প, যা দুই পর্বে দিলে পাঠকদের জন্য ভালো হতো।
গল্পের চরিত্রগুলো আমাদের চারপাশের কর্পোরেট জগতের সাথে খুবই পরিচিত। রিয়ানা চরিত্রটা অত্যন্ত সুন্দর করে তুলে ধরেছেন। তবে সমাপ্তিটা হয়েছে কিছুটা আধ্যাত্মিকতার আদলে- যা গপ্লের গাথুনীকে পূর্ণতা দিয়েছে।

২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১০:৩৪

অপু তানভীর বলেছেন: একবার ভেবেছিলাম যে দুই পর্বে দিই তারপর মনে হল যে সামুতে এমনিতে এখন পোস্ট কম আসে । দুই পর্ব করে দিলে আমার একই পোস্ট কাছাকাছি থাকবে । তাই আর দিলাম না । আস্তে ধীরে পড়ে নিবে যার ইচ্ছে হবে !

গল্পে চমৎকার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ । সব সময় ভাল থাকুন !

৩| ২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১১:৩৫

কঙ্কাবতী রাজকন্যা বলেছেন: ম্যাঙ্গাটুন কি জিনিস?

কার্টুন নাকি?

ছোটবেলা পড়েছিলাম ব্যাঙ কুমারী, ডালিম কুমার আজ পড়লাম বিড়ালকুমারী।


তবে বনবিড়ালরা তার কাজিন শুনে এক চোট হেসেছি। :P

২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১১:৪২

অপু তানভীর বলেছেন: ম্যাঙ্গাটুন, টুনামিস, ওয়েবটুন এই হচ্ছে ওয়েব কমিক পড়ার এপস । গুগল প্লেতে গিয়ে দেখতে পারেন । আগে খুব পড়তাম ।

ব্যাঙ কুমারী থেকে বিড়ালকুমারী কিন্তু অনেক ভাল । অনেক সুইট আর কিউট !

৪| ৩০ শে নভেম্বর, ২০২১ ভোর ৪:১৮

নেওয়াজ আলি বলেছেন: গল্প মানে অপু তানভীর । তবে কুমারী ধীরেসুস্থে পড়ছি

৩০ শে নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:২৩

অপু তানভীর বলেছেন: বড় গল্প হলে ধীরে সুস্থে পড়াই ভাল । অনেকেই স্ক্রিনের দিকে একভাবে তাকিয়ে থেকে পড়তে পারে না । আমি নিজেই পারি না মাঝে মাঝে !

গল্প পড়ে শেষ করুন । ভাল লাগলেই হল !

৫| ৩০ শে নভেম্বর, ২০২১ সকাল ১০:১৭

ইসিয়াক বলেছেন:



ওয়াও! দারুণ গল্প।

৩০ শে নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:২৪

অপু তানভীর বলেছেন: গল্প ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো !
এটা আমার নিজেরও পছন্দের একটা গল্প ।

৬| ৩০ শে নভেম্বর, ২০২১ সকাল ১০:১৭

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
বিড়ালকে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ গোসল করাসহ অন্যান্য কান্ডগুলো অবাস্তব কাহিনী হয়ে গেছে এমনিতে কর্পোরেট জগতের গল্পটা ভাল হয়েছে।

৩০ শে নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:২৫

অপু তানভীর বলেছেন: অবশ্যই মনে রাখতে হবে এটা গল্প । গল্পে কত কিছু হয় । অথবা আরও ভাল করে বললে গল্পের গরুকে আকাশেও উড়ানো যায় ! এটাই গল্পের মজা ।

ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য !

৭| ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ৮:৪৯

নীল আকাশ বলেছেন: মানলাম, আপনার কল্পনা শক্তি মারাত্মক। এই কহিনী মাথায় আসলো কীভাবে?

০২ রা ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১০:৪১

অপু তানভীর বলেছেন: সেফ শিফটিংয়ের ব্যাপারটা তো কমন একটা ব্যাপার । টুয়ালাইট মুভি দেখেন নি যেখানে জ্যাকব নেকড়ে থাকে । নেড়কে মানব । এখানেও তেমন হয়েছে ।

গল্প পড়ার জন্য ধন্যবাদ

৮| ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ৯:৫৪

মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: আহা! অপু ভাই, প্রথম দিকে কেমন যেন লাগছিল এই ভেবে যে বিড়ালের গালে চুমু :P বিড়ালের সাথে ঘুমু। পরে দেখি খালি মজাই মজা।
তখন খালি ভাবি, এত মজা রাখুম কই ;)। বিড়াল কুমারিরে চাইপা ধরুম,ছাড়ুম না। তবে একটু ভয়ও যে পাইনি, তা নয়। ব্যাপোক ভয়ও পাইছিলাম। তবে, এখন চিন্তায় আছি,ভাল হয়ে গেলে বিড়াল কুমারী কি করবে,তা ভেবে। মিউ কি আচ্চা করে আচড়ে দিবে না চুক চুক করে চুমু খাবে?
ব্যাপোক টেনশনে আছি ভাইজান। তবে,এটা বুঝতে পারছি যাই কিছু হউক তা যে মজার B-)) হবে, এটা নিশ্চিত।

০২ রা ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১০:৪৩

অপু তানভীর বলেছেন: আমি আসলে বিড়াল খুবই পছন্দ করি । বাসায় চলে গেলে অনেক গুলো বিড়াল পুষবো ঠিক করেছি । বিড়ালী নামে আমার আরেকটা গল্প আছে । এই গল্পে আসলে ঠিকঠাক ভয়ের কোন উপাদানই নেই । বিড়ালী গল্পটা পড়ে দেখতে পারেন যদি পড়ে না থাকেন । সেখানে ভয় পাবেন আশা করি ।

বিড়াল কুমারী চুমুই দিবে খামচি কেন দিবে ! বিড়ালরা ভাল প্রাণী !

ভাল থাকুন সময় ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.