নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিজের সম্পর্কে বলার আসলে কিছু নেই। বিপণি বিতানের কোন সিদ্ধহস্ত বিক্রায়কও আমি নই। হঠাৎ হঠাৎ কিছু শব্দ মনের মাঝে টুপটাপ করে ঝরে পড়ে। তাই লিখি এখানে।

আসাদুজ্জামান পাভেল

নিজের সম্পর্কে বলার মতো আসলে তেমন কিছু নেই।

আসাদুজ্জামান পাভেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ কাঁটা

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:৩৮

গল্পঃ কাঁটা

পর্ণা এক্সলিটরে চাপ বাড়ায়।
সিআরভি-টা সাথে সাথে লাফিয়ে ওঠে। গাড়িতে উঠেই দেখেছে তেলের বাতি দিয়ে দিয়েছে। তেল নিতে হলো তাই। সে যেহেতু সার্কেল-কে থেকে তেল নেয় সবসময়, তাই খানিক ঘুরপথে যেতে হল। গিয়ে দেখে বিশাল লাইন। তেল নিতে নিতে বেশ দেরি হয়ে গেছে ওর। সে তাই স্থানীয় পথে দ্রুত চালিয়ে পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। এখন রাস্তার পুলিশ এসে টিকেট ধরিয়ে না দিলেই হয়। তাহলে মুমিত আর আস্ত রাখবে না। ওর সবকিছুতেই নিয়মের বাড়াবাড়ি। সত্যিই কি তাই? কথাটি ভেবে পর্ণার হাসি পায়। সে ছুটছে নাঈমকে তুলতে। এখানকার একটি বিশেষ স্কুলে পড়ছে সে। ওর স্কুল ছুটি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ছেলেটা একা একা কী করছে কে জানে। এই সময়গুলোর জন্যই ওকে একটা ফোন কিনে দেওয়া দরকার, মাঝে মাঝে ভাবে সে। কিন্তু মুমিত কিছুতেই রাজি হয় না। ছেলের সাথে দেখা-অদেখার এই সময়টা ওকে পার করতে হয় চরম উৎকণ্ঠায়।
পারসিভাল রোডের কোথাও বোধ হয় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। বেশ ট্র্যাফিক রাস্তায়। পর্ণা ব্রেক চেপে বসে আছে অনেকক্ষণ। একটা অ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি পাশ দিয়ে ছুটে গেলো, দমকল গাড়িও দেখা গেলো ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে।এখানে রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে অ্যাম্বুলেন্স এবং দমকল দুটোই চলে আসে। আর পুলিশের গাড়ি তো আগেভাগেই ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অনড় বসে থেকে পর্ণা পাশের বিলবোর্ড দেখে। হাবিজাবি কতো কিছু যে আছে তাতে! ওসব বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপনের ছাই কিছুই সে বোঝে না, এতোটা কাল এখানে থাকার পরও নয়। কেবল স্মলউড আর পারসিভালের ইন্টারসেকশনের লাইটে এসে প্রতিবারই ওর চোখ একটি বিশেষ বিলবোর্ডে আটকে যায়। রাস্তায় ট্র্যাফিকে ফেঁসে গেলেও তার মোটেই খারাপ লাগে না। বিজ্ঞাপনটিতে একটি মেয়ে তন্ময় হয়ে ব্যালে নাচের ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তার প্রশান্তির হাসি। চোখ চিকচিক করছে। রোজ নাঈমকে উঠাতে সে এই পথেই যায়, আবার ফিরেও আসে। প্রতিবারই যাবার সময় সে দেখে মেয়েটিকে। কখনো বিরক্ত লাগে না। এটি একটি নাচের স্কুলের বিজ্ঞাপন।
বসে থাকতে থাকতে পর্ণা অধৈর্য হয়ে এদিক ওদিক তাকায়। ঠিক তখন একটা দৃশ্য চোখে পড়ে। দেখে, রাস্তার ঠিক মাঝখানের শোল্ডার দিয়ে একটি মেয়ে হেঁটে আসছে। দৃষ্টি আটকে যাবার মতো এমন কোন দৃশ্য নয় এটি। যে কেউ-ই তো এখান দিয়ে হেঁটে যেতে পারে। তার নজর আটকে আছে একটা কারণে, মেয়েটি পরে আছে সালোয়ার কামিজ। এ পোশাকে কেউ যে বাইরে বের হয় না, তা কিন্তু নয়। বেরোয়, হামেশাই বেরোয়। তবে এমন ভরদুপুরে রাস্তার মাঝের শোল্ডার ধরে কাউকে ঠিক এভাবে হেঁটে যেতে দেখা যায় না। পরিচিত কেউ নয় তো আবার? বাংলাদেশি কেউ কি? পাকিস্তান কিম্বা ভারতের কেউ হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। সালোয়ার কামিজ তো আজকাল সবাই পরে। সেদিন তো ওর অফিসের মিস র‍্যাভনেলই সালোয়ার কামিজ পরে এলো। ওদের অফিসে বছরে একদিন যে যার মতো ট্র্যাডিশনাল ড্রেস পরতে পারে। সবার ওয়ার্ক স্টেশনে গিয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাল ওর পোশাক। ওড়না পরে নি যদিও, তবু ওকে দারুণ মানিয়ে গেছে। পর্ণার কাছে আসলে সে চট করে একটা টিপ ওর কপালে বসিয়ে দিলো। আর তাতেই ওর চেহারাটা বিলকুল বদলে যায়। সব মেয়েরা উঁকি দিয়ে দেখছিল। সামান্য সেই টিপের কারণে যে ওর চেহারাটা বদলে গেছে, সেটা সবাই লক্ষ্য করেছে। সবাই একসঙ্গে তালি দিয়ে ওঠে। র‍্যাভনেল ওকে বেশ উষ্ণ ভাবে জড়িয়ে ধরেছিল সেদিন।
পর্ণা দেখে যতই কাছে এগিয়ে আসছে মেয়েটি তার চেহারাটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখন আর খুব অল্প বয়সী মনে হচ্ছে না। মাঝ বয়সী লাগছে, কিম্বা বয়স কিছুটা প্রৌঢ়ত্বের দিকে। খুব কাছ থেকে যখন হেঁটে গেলো, সে বুঝল এ মুখ তার অনেক পরিচিত। বহুকালের চেনা। নিপা ভাবীকে চিনতে তার একটুও অসুবিধা হয় না।আশে পাশে কোন দিকে না তাকিয়ে উনি সামনের দিকে হনহনিয়ে হাঁটছেন। সে দৃষ্টি ঠিক রাস্তার দিকে নামান না, বরং একটু উপরের দিকে। আবার ঠিক আকাশের দিকেও নয়। যেন দূরের কোন কিছুর দিকে তাকিয়ে চলছেন উনি। দৃষ্টি কিছুটা ভাসা ভাসা। সত্যিই কি ভাসা ভাসা দৃষ্টি, নাকি ওটা ওর নিজের ভাবনা? কিন্তু এই খটখটে দুপুরে উনি এভাবে ছুটছেন কোথায়? পথ হারান নি তো আবার? জানালার কাঁচ নামিয়ে ডাক দেবে? কিন্তু চট করে তা করতে পারে না। কোথায় যেন একটা বাধা টের পায়। ধুর, এতো ভেবে কী হবে। জানালার কাঁচ নামিয়ে যখনই ডাকতে যাবে, পেছনের গাড়িটি হর্ন দিয়ে বসে। সামনে তাকিয়ে দেখে রাস্তা পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। এখন আর কিছুই করার উপায় নাই। সামনের দিকে চলতে হবে তাকে। জানালার কাঁচ উঠিয়ে সে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে। তবু মনের মাঝের খচখচে অনুভূতিটা ঠিকই রয়ে যায়।

নাঈমকে মোটেই চিন্তিত মনে হল না। মায়ের দেরি দেখে তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। গাড়িতে বসে থেকেই পর্ণা দেখেছে নাঈম ওর সমবয়সী একটি ছেলের ঘাড়ের উপর দিয়ে আইপ্যাডে কি যেন দেখছে। ওকে দেখে আস্তে আস্তে ব্যাগটা নিয়ে চলে আসে। পর্ণা জিজ্ঞেস করে, অনেক দেরি করে ফেলেছি, না?
- উহু, তেমন দেরি হয় নি।
- ওখানে কি করছিলে? ওটা কি তোমার বন্ধু?
- হুম, ওর নাম সাজিদ। ওর আইপ্যাডে একটা গেইম আছে। ওটা দেখছিলাম। আমি কি ওই গেইমটা ডাউনলোড করতে পারি, মা?
- তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করো।
- বাবা দিবে না, আমি জানি।
রিয়ার ভিউ-এ তাকিয়ে দেখে নাঈম উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে। পর্ণা ওর মন ভালো করার চেষ্টা করে, আজ তোমার একটা প্রিয় জিনিস বানিয়েছি। ইউ আর গননা লাভ ইট।
বাচ্চারা কৌতূহলী হয়। অন্য যেকোনো বাচ্চা হলে প্রশ্ন করে করে মায়ের মাথা ঝালাপালা করে ফেলত। কিন্তু নাঈমের মাঝে ওসব কিছুই দেখা যায় না। ওর এই নিঃস্পৃহ ভাব দেখে সে আবার বলে, পাস্তা উইথ বেইকেড স্যামন।
- বেইকড স্যামন খেতে আমার ভালো লাগে না মা। আমি কি আজ একটা ম্যাক চিকেন খেতে পারি না?
- না পারো না। কারণ ওটা হালাল নয়। আর হালাল কিছু না খেলে রোজ হাসরের দিনে তোমাকে জবাব দিতে হবে যে বাবা।
পর্ণা দেখে নাঈমের মুখটা ছোটো হয়ে গেছে। এতক্ষনে মনে হলো সে বেশ ক্লান্ত। পর্ণা জানে সে এটা নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করবে না।। বাসায় গিয়েই খাবারের টেবিলে বসবে না। প্রথমে শাওয়ার নিবে, সুন্দর করে চুল আঁচড়াবে। হাতে পায়ে লোশন মাখবে, তারপর টেবিলে আসবে খেতে। পর্ণা এর মাঝে খাবার গরম করে ফেলে। সে যদিও ওর সাথে খাবারের টেবিলে বসে, কিন্তু খুব হালকা কিছুই খায়। অপেক্ষা করে মুমিতের জন্য। নাঈমের খাবার হয়ে গেলে সে আসরের নামাজ পড়ে নেয়। হোম-ওয়ার্ক সারতে সারতে মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে যায়।কখনো কখনো মুমিত এসে শামিল হয়। মাঝে মাঝে ওর দেরি হয়ে যায়। রিসার্চের কাজে ওকে অনেকটা সময় ল্যাবে থাকতে হয়। তবে রাতের খাবারটা ওরা তিনজন একসাথে করে। সেটা সন্ধ্যা সাতটার মাঝেই শেষ হয়ে যায়। এ নিয়মের কোনো ব্যাতিক্রম হয় না।
পথ ঘাটে ভিড় কমে গেছে। আরামে গাড়ি চালাতে চালাতে সে বাইরের দিকে তাকায়। আজ তার আর তাড়া নেই। নাইমের আর্লি-ডিসমিসাল হয়ে গেছে আজ, মানে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে। সেও অফিসে বলে এসেছে আজ আর ফিরবে না। একটু একটু করে ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। বেশ কিছু গাছের পাতা একেবারেই ঝরে গেছে। পথে সেসব পাতা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। গাড়ি চলে গেলে সে সব স্খলিত হরিদ্রাভ পত্ররাজি এলোমেলো উড়তে থাকে। কেমন বিষণ্ণ দেখায়। আর কদিন পরই তো থ্যাংকস গিভিং। সাউথ কারোলাইনায় সাধারণত শীতের প্রকট তেমন টের পাওয়া যায় না। বেশির ভাগ গাছই এভার গ্রীন।
বিয়ের পর যখন প্রথম প্রথম এলো এখানে, মনে আছে, ফল কালার দেখতে ওরা প্রায় প্রতি বছরই ব্লু-রিজ মাউন্টেইন কিম্বা টেনিসির কোন শহরে চলে যেতো। মিশেল মাউন্টেইনের উপর নিস্তব্ধ কোন রিসোর্ট, অথবা ন্যাশভিল শহরের কোন ক্যাফে। ন্যাশভিল ডাউন টাউনের পথ গুলোতে একধরণের চলমান শুঁড়িখানা দেখেছে সে। উচ্ছল তরুণ তরুণীরা ওখানে বসে পেডেল দিয়ে গাড়িটা চালায়। ওদের সামনে পরিবেশন করা হয় পানীয়, আর জোরে জোরে বাজতে থাকে কান্ট্রি মিউজিক। পথের পাশে বসে সেসব গান শুনতে শুনতে স্টেক খেতে দারুণ লাগতো। তখন কিন্তু মুমিতের হালাল-হারামের খুব একটা বাতিক ছিলো না। তবে এটা সত্যি লেবানিজ কাবাবের দোকানগুলো ওদের অনেক প্রিয় ছিলো। সে যেখানেই হোক না কেন। একে তো ভাজা-পোড়া, তার উপর হালাল। বেশ নিশ্চিন্তে খেতো ওরা। কলাম্বিয়াতেও আছে অমন একটি কাবাবের দোকান। মাঝে মাঝেই নিপা ভাবী আর বাবলু ভাই সামিল হয়ে যেতেন। তখন আর ঘরে ফেরার অতো তাগিদ থাকতো না। অদিতি-নদী কিছুটা সময় একা একা থাকতেই পারতো। ওরা তো তখন বেশ বড়ো হয়ে গিয়েছে। ফেরার সময় ওদের জন্য খাবার টু-গো বক্সে ভরে নিয়ে গেলেই হতো। উইক এন্ড হলে তো কথাই থাকতো না। সোজা চলে যেতো উনাদের বাসায়। বসতো গানের আসর। মাঝে মাঝে মুমিত বলতো, ঐ গানটা একটু গাইবেন ভাবী?
- কোন গানটা?
- ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন...’
- হি হি হি, পর্ণা দেখো, তোমার সাহেবের রস কতো। ‘ দিল ওহি মেরা ফাস গ্যায়ি’...
সবাই একসাথে হেসে উঠতো। ভাবী কিন্নর কণ্ঠে গেয়ে উঠলে বাবলু ভাই তবলায় টোকা মারতেন। পর্ণা দেখতো, গানে মগ্ন হয়ে মুমিত মৃদু মাথা নাড়ছে। অদিতি তখন সবে চা বানাতে শিখেছে। কোনো একটা উছিলায় সে চা বানিয়ে খাওয়াতো সবাইকে। কি অপূর্ব ছিল সেইসব সন্ধ্যাগুলো!
আজ কেন যে এতো নিপা ভাবীর কথা মনে পড়ছে। সেকি দুপুরে তাকে রাস্তায় অমন করে হাঁটতে দেখে? কে জানে। আমাদের চিন্তা কি সবসময় যুক্তির সাথে চলে? চলে না। এই যেমন এখন মনে পড়ছে ভাবীর মুখ থেকে শোনা ওদের আর মুমিতের পরিচয়ের গল্পটার কথা। সে পাঁচালী শুনতে শুনতে ওর প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে। এখানে আসার পর থেকেই তো শুনছে সেটা। গল্প বলায় ভাবী একেবারে ওস্তাদ।
বাবলু খুব একটা নামাজ পড়তো না তখন। শুধু জুম্মাটা অফিসের ফাঁকে গিয়ে সেরে আসতো। ফ্লেক্স কাজের সুবিধার জন্য মাঝে মাঝে শুক্রবারে আধাবেলা কিম্বা পুরো দিন ছুটি কাঁটাতে পারতো। সেদিনও বুঝি তেমনই একটা দিন ছিলো। নিপা অফিস থেকে ফিরে দেখে বাবলু নেই। ভেবেছিল, হয়তো দোকান টোকানে গেছে। চলে আসবে শীঘ্র। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে গেলেও সে আসে না। খানিক চিন্তিত হয়ে পড়ে নিপা। কি করে যে খোঁজ নেয়? তখন তো অতো মোবাইল ফোনের ছড়াছড়িও ছিল না।
ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে সে উপস্থিত। সাথে বেশ সুদর্শন লম্বা একটি ছেলে, আগে কখনো দেখে নি নিপা। সাদা স্ট্রাইপ সার্টের সাথে জিন্স পরা। সার্টের হাতা গুটানো। তেমন আহামরি কোনো পোশাক নয়। তবু ওর মাঝে নাকি একটা সহজাত বনেদিয়ানা চোখে পড়েছিলো তার। বাবলু বলেছিল, আজ মসজিদে গিয়ে মজার কাণ্ড হয়েছে। আমি আর ফরিদ ভাই কথা বলছি বাংলায়। এই ছেলেটি এসে বলে আপনারা কি বাঙালি? ওর নাম মুমিত, গত সপ্তাহেই এসেছে কলাম্বিয়ায় ইউএসসিতে পিএইচডি প্রোগ্রামে। বুদ্ধি দেখেছো! ঠিক জানে মসজিদে গেলে অন্তত দু’একজন বাঙালি পাবে। হা হা হা। বলে কিনা গত সাতদিন ভাত খায় নি। দোকান-পাটও ঠিক মতো এখনো চিনে উঠতে পারে নি। ওকে ধরে নিয়ে এলাম। আসার সময় সবগুলো ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান চিনিয়ে এলাম। এখন ওকে আচ্ছা মতো ভাত খাওয়াও তো নিপা।
বাবলুর এ স্বভাব নতুন নয়। বলা নেই- কওয়া নেই প্রায়ই হুট করে লোকজন ধরে নিয়ে আসতো বাসায়। সবাই যে বাঙালি তাও কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে ভারতীয়ও নিয়ে আসতো। একবার চারজনকে নিয়ে গেল কানাডার বর্ডার পর্যন্ত। ওদের ভিসা রিনিউ করা দরকার। ছাত্র মানুষ, তেমন টাকা পয়সা নেই যে প্লেনে যাবে। আবার খুব ভালো গাড়িও নেই ওদের কাছে। তাতে কি? বাবলু তো রয়েছেনই।
এমন আরো কত গল্প! বেশ হিউমার মেশানো সে সব গল্প নিপা ভাবীর মুখে শুনতে ভারি মজা লাগতো। খুঁটিনাটি কোন কিছুই বাদ পড়তো না উনার বলাতে। একেবারে চোখের সামনে ভাসে। অথচ সেই মানুষটাই কিনা আজকাল অনেককিছু ভুলে যায়! সে কথা ভেবে পর্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

নাইম এর মাঝেই লাঞ্চ করেছে। কাল স্কুল নেই, তাই বাড়ির কাজ নিয়ে সে আর বসে নি। রিমোট হাতে নিয়ে টিভি দেখছে। রিমোটের বোতাম টিপতে টিপতেই সে বলে, মা, আজ সাজিদ একটা কথা বলল।
- কি কথা?
- সেদিন নাকি সানডে স্কুলে নিপা আন্টি সাডেনলি শোওড উপ। অদিতি আপু আর নদী আপুর খোঁজ করছিলো? কিন্তু ওরা তো অনেক বড় হয়ে গেছে। আর এখানে থাকেও না। তবে সানডে স্কুলে আসবে কেন?
- হয়তো ভুলে চলে এসেছে।
সে আর কথাটা বাড়তে দেয় না। কিছু আগের ভাবনাতে আবার ডুবে যায়। একটা মজার কথা মনে পড়ে ওর। একবার হঠাৎ নিপা ভাবীর একটা ওয়ার্কশপ পড়ে গেলো পিটসবারগে। বাবলু ভাইও গেলেন সাথে। বাচ্চাদের রেখে গেলেন ওদের এখানে। বৃহস্পতি থেকে রবি, এই কটা দিন কি যে আনন্দে কেটেছে তাদের! এই কদিন তিনজনে মিলে তুমুল নাচের মহড়া দিয়েছিলো ওরা। নাঈম তখনো হয়নি। ঠিক শুক্রবার বিকেলে নদীর পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়। তখন সে বেশ ছোটো। ঠিক কোন দিনটি থেকে শুরু হবে সে হয়তো বুঝতে পারে নি। এদিকে নিপা ভাবীও কিছু বলে যাননি। পর্ণা গিয়েছে স্যামস ক্লাবে সপ্তাহের কিছু কেনাকাটা করতে। মুমিত বাসায় ওদের সাথে। হঠাৎ অদিতির ফোন, আনটি একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।
- কি রকম?
- নদীর পিরিয়ড শুরু হয়ে গেছে। কিন্ত ও তো একটা ডাহা বুদ্ধু, কিছুই আনে নি সাথে। আমার ব্যাগেও কিছু নেই। আমার সাইকেল ওর থেকে আলাদা। এখন কি করি?
- আচ্ছা, তুমি আমাকে ঠিক পাঁচ মিনিট পর ফোন কর। আমি একটা জায়গায় খুঁজতে বলবো, স্যানিটেশন প্যাড ঠিক ওখানেই পেয়ে যাবে। যদিও ওগুলো কিছুটা বড় সাইজের। আসার সময় আমি ওর জন্য নিয়ে আসবো, কেমন?
পর্ণা কখনো ওগুলো বাথরুমে রাখে না, ওর লজ্জা করে। আবার এও জানে ওরা মুমিতকেও কিছু বলবে না। সে ঠিক জানেও না ওগুলো কোথায় থাকে। পর্ণা চট করে মুমিতকে ফোন করে বলে দিলো কি করতে হবে।তারপর পাঁচ মিনিট পর অদিতি ফোন করলে ওকে বললো, আমার ঘরের বাথরুমে যাও। সেকেন্ড টপ র‍্যাকে পাবে দুটো। আমি আসার সময় আরো নিয়ে আসবো।
রাতে শুতে এসে মুমিত হালকা স্বরে রসিকতা করে বলেছিল, তোমার গুপধনের খোঁজ তবে জানা গেলো। হা হা হা।
ওরা দুজন আসলেও সেবার ভিন্ন এক গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছিলো ।আর সেটা বাসায় বাচ্চা থাকার উপলব্ধি। ঘরের রঙটাই কেমন বদলে যায়। সেবারই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বাচ্চা নেবার।

নাঈমের জন্মের পর থেকেই আস্তে আস্তে অনেক কিছু বদলে যেতে শুরু করে। বলতে দ্বিধা নেই সেও পাল্টে গেছে অনেক। সবচেয়ে প্রথম পরিবর্তন এলো তার নামে।
একদিন রাতের খাবার খেতে খেতে মুমিত বললো, তোমার আসল নামটা কিন্তু বেশি সুন্দর। মেহজাবিন। ইসলামি নাম। আমি তোমাকে এই নামেই ডাকবো। তুমিও সবাইকে তোমার নাম ওটাই বল। পর্ণা নামটি সুন্দর হলেও ঠিক ইসলামি নাম না।
- কিন্তু আমার আব্বা-আম্মা অনেক শখ করে এই ডাকনামটি রেখেছেন।
- তাতে কি, এখন তো তুমি আর তোমার বাবা-মার সাথে নও। এখন থেকে তোমাকে মেহজাবিন বলেই ডাকা হবে।
নাগরিকত্বের সময় ওর পর্ণা নামটি একেবারেই খসে গিয়ে মুৎসুদ্দি জুড়ে গেলো। ওর নাম হয়ে গেলো মেহজাবিন মুৎসুদ্দি, নামের শেষে মুমিতের পদবী।
নাঈম হবার আগে থেকেই সে নাচ স্থগিত রাখলো। ভাবলো, বাচ্চা হয়ে যাবার পর আবার অনুশীলন করবে। এখন মুলতবি। নাঈমের বয়স যখন তিন মাস, একদিন সে বের করে নিল ওর ঘুঙুর। আনন্দ নিয়ে নাচল কিছুক্ষণ। বেশ ওজন বেড়েছে, তাই একটুতেই ঘেমে-নেয়ে অস্থির। দম অনেক কমে গেছে। অনুশীলনের পর ঘুঙুরগুলো রেখে দিলো পাশের টেবিলে। সেদিন সে ছিল বেশ ফুরফুরে। বিকেলে মুমিত এসে তা দেখে বলে, আজ প্র্যাকটিস করেছিলে?
- হুম, অ-নে-ক দিন পর!কী যে ভালো লাগলো, জানো!
- আর কর না।
- কেন?
- নাচ করা আসলে ঠিক না। আমাদের ধর্ম এটাকে ঠিক অ্যালাও করে না।
- কিন্তু নাচ যে আমার অনেক প্রিয়!
- আমাদের অনেক প্রিয় জিনিসই তো কোরবানি দিতে হয়। হজরত ইব্রাহিমও তো তাঁর নিজের ছেলেকে কোরবানি দিয়েছেন...।
পর্ণার নাচ বন্ধ হয়ে গেলো। সে তাঁর ঘুঙুরগুলো তবু যত্ন করে রেখে দিয়েছে আলমারিতে। মাঝে মাঝে একলা একলা থাকার সময়ে সে ওগুলো বের করে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শব্দ করে। নাঈমের কানের কাছে বাজায়। ছোট্ট মুখে সে হাসে, কি সুন্দর সে হাসি। পর্ণার চোখ ভিজে আসে।

সাউথ ক্যারোলাইনার কলাম্বিয়াতে বাঙালি সম্প্রদায়ে দুটো বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। একটি স্বাধীনতা দিবসের পরের কোনো একটি দিনে, স্বাধীনতা দিবস এবং অমর একুশেকে স্মরণে রেখে। অন্যটি ঈদ উৎসব। প্রতিবারই ওরা যেতো ওখানে এবং পুরো অনুষ্ঠান দেখে তবেই বাড়ি ফিরত। কোন অংশই বাদ পড়তো না। প্রথম প্রথম নিজেরাই রান্না-বান্না করে পট-লাক কায়দায় খাওয়ার আয়োজন করতো। পরে পরিসর বেড়ে যাওয়াতে কেটারিং করতো। কিন্তু দু-একটি পরিবার শুধু খাওয়ার অংশটাতে থাকতো। গান-বাজনা শুরু হলেই চলে যেতো। তবে মুমিত-পর্ণা ওদের দলে ছিল না মোটেই। বরং নামাজের সময় হলে সুযোগ মতো চট করে তা সেরে ফেলতো। তবে এ দৃশ্যের আমূল পরিবর্তন হতে থাকে আসফিয়া ভাবী আর মইনুদ্দিন ভাই আসার পর থেকেই। তাঁরা এসে আলাদা ভাবে দুটো অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করলেন। সেখানে বাঙালিদের পাশাপাশি ভারত ও পাকিস্তানের মুসলমানরাও সামিল হতে থাকে। দেখতে দেখতে সেসব অনুষ্ঠানের পরিধি বাড়তে থাকে। মিডিল ইস্টের কিছু দেশের লোকদেরও দেখা যায়। ওরা শুরুর দিকে গড়হাজির থাকতো। কিন্তু আসফিয়া ভাবী বেশ কঠিন প্রকৃতির মানুষ। সবার সামনে হুট করে বেশ তির্যক কথা বলে ফেলেন। একদিন আসরে তো দুম করে বলেই ফেললেন, এই যে নিপার যে অসুখটা হল তা কি এমনি এমনি হয়েছে? প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে একটি বিশেষ কারণ থাকে। আল্লাহপাকের বিচার ঠিকই আছে। আলজেইমার কঠিন রোগ, কোন চিকিৎসা নেই।
অন্যদিকে মইনুদ্দিন ভাই-এর আবার মধুর সুর। খুব সহজেই মুমিতকে দলে ভিড়িয়ে নিলেন।কিম্বা মুমিত নিজেও হয়তো মনে মনে সে সংস্কৃতি ধারণ করতো। শুরু হয়ে যায় ওদের সেসব অনুষ্ঠানে আসা যাওয়া। এর পাশাপাশি প্রায়ই বসে আলোচনা অনুষ্ঠান, ‘হালাকা’। আটলান্টা, অরল্যান্ডো কিম্বা ডালাস থেকে আলোচক আসতে থাকে।দেখার বিষয় হলো, বাঙালি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রত্যেককে খাওয়া এবং ভেন্যু ভাড়া বাবদ নির্দিষ্ট পরিমান টাকা গুনতে হয়। কিন্তু এইসব ইসলামি অনুষ্ঠানগুলোতে কোনো খরচ নেই, একদম ফ্রী। আর খাবার দাবারও প্রচুর। পর্ণা লক্ষ্য করেছে বেশ কিছু ছাত্রও আসে এসব অনুষ্ঠানে। তবে তারা কতটুকু ধর্মবোধ থেকে আর কতটুকু মুফৎ খাওয়ার উদ্যেশ্যে-সেটা বলা মুশকিল।
এই পরিবর্তনের লেবাস হিসেবে এখানকার অনেক নারীই এখন কান-চুল-কব্জি অবধি ঢেকে একধরণের পোশাক পরে। আর এ সংস্কৃতির সাম্প্রতিক সংযোজন-পর্ণা, মানে মেহজাবিন।
প্রতিটি পরিবর্তনের কিছু দায় থাকে, কিছু মাশুল দিতে হয়। কখনো কখনো তা সম্পর্কের মাঝে দেয়াল তোলে। নিপা ভাবীদের সাথেও এমনটাই হল। অদিতি আর জো-র বিয়ের দাওয়াত পাওয়ার পরপরই মুমিত ওদের ফোন করেছিলো। বলেছিলো, বাবলু ভাই আমাদের পক্ষে এই বিয়েতে অংশ নেওয়া সম্ভব নয়। আমার ধর্মবোধ এবং নীতি এই বিয়ে মেনে নেয় না। মুসলমান মেয়ের বিধর্মী ছেলেকে বিয়ে করা ভয়াবহ গুনাহ। আপনারা জো-কেই কেন মুসলমান বানিয়ে নেন না? আমাদের ধর্মে এর বিধানও আছে। কন্যার পিতামাতা হিসেবে অনেক সোয়াব হাসিল করতে পারবেন আপনারা।
বাবলু ভাই ওপাশ থেকে বলেছিলেন, জো- কে ধর্ম বদলানোর কথা আমরা বলতে পারি না। সেও তো আমার মেয়েকে খ্রিস্টান হতে বলে নি। আমরাই বা ওটা কেন বলতে যাবো। আর আমরা এসবে বিশ্বাসীও নই।
- আল্লাহর দরবারে পরের জীবনে আপনারা কী উত্তর দেবেন তা আমার জানা নাই। এই বিয়েতে আমরা আসতে পারবো না। আশা করি অদিতি আর জো এই দুনিয়াতে সুখেই থাকবে।
সেদিনের পর থেকে ওদের এতদিনকার সম্পর্কটা কর্পূরের মতো মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো! অথচ তাতে মেহজাবিনের তেমন সমস্যা হয়নি। যেন সে সম্পর্ক ছিল না কোন দিন। বরং আল্লাহ পাকের মহিমায় তারা ভালোই আছে। নামাজ-কালাম পড়ছে, মানুষের উপকার করার চেষ্টা করছে। সন্তান ইসলামি স্কুলে পড়ছে। সুশীল হয়েই বেড়ে উঠছে সে।তাদের দাম্পত্য জীবন সুন্দর, সুশৃঙ্খল।দু’বছর আগেই হজ্ব করে এলো তারা। দেশে বিভিন্ন সময় দান-খয়রাত করে ওরা।
তবুও একটি বিষয় কেবল ওর মনে সেই কবে থেকে কাঁটা হয়ে আছে। কিছুতেই দূর করতে পারে না সে। কতো বার নিজেকে ভ্রুকুটি করেছে, ভরতসনা করেছে- নিজেকেই নিজে বলেছে, ওটা তোমার বোঝার ভুল। অমন কিছুই ছিল না বিষয়টি। তবু একা একা থাকলেই ওসব কথা তার মনে পড়ে। এই আজ যেমন হঠাৎ করে মনে পড়ছে। সে কি নিপা ভাবীকে দেখে? উনার কথার সাথে সাথে ওটিও মনে পড়ছে। আমাদের ভাবনার লেজ বুঝি একটির সাথে আরেকটি ঝুলে থাকে। ছাড়ানো যায় না। ভাবনা তো আর নুডুলস নয় যে কাঁটা চামচ দিয়ে যে আলগোছে ছাড়ানো যাবে।
মুমিতের অধিনে প্রতিবারই বেশ কিছু ছাত্র পিএইচডি প্রোগ্রামে ঢোকে। এদের কিছু বাঙালি, কেউ কেউ ভারতীয়, কিছু চাইনিজ, আবার কেউ কেউ অ্যামেরিকান। বোস্টন থেকে এখানে পড়তে আসা স্টেলা একজন অ্যামেরিকান । তবে তার মায়ের দাদা ছিল একজন ইতালীয়। হয়তো সে কারণেই, ওর চুল অদ্ভুত সুন্দর। কালো কিন্তু সিল্কি। চোখের মাঝে একধরণের গভীর স্বচ্ছতা নজরে পড়ে। স্পষ্ট নাক আর দারুণ একজোড়া ঠোঁটের নিচে ঝকঝকে হাসি। খুব হাসতে পারে মেয়েটা। ওকে প্রথম দেখেছিল থ্যাংকস গিভিং অনুষ্ঠানে।
নভেম্বরে শীত পড়তে শুরু করে দেয় এখানে। সেদিন ঘরে ঢুকে স্টেলা তার ব্লেজারটা খুলে রাখে। পিঠের খোলা অংশে, চুল সরে গেলে, একধরনের আভা ঠিকরে পড়ে। লো-কাট ফুল স্লিভ কালো টপসের বাইরে অনাবৃত বুক ও পিঠের অংশে আলো পড়ে। মেহজাবিন দেখেছে, কিছু একটা সেখানে চিকচিক করে ওঠে। সূক্ষ্ম সোনার চেইনে একটা সরু ক্রুশ ঠিক দু’স্তনের ভাঁজের ওপরে ঝুলছে। কথা বলার সময় এদিক ওদিক মাথা নাড়ালে ওটিও নড়ে ওঠে। সাথে সাথে আলোর বিচ্ছুরণও চিকণ অভিধায় ছড়িয়ে পড়ে। একজন নারী হয়েও মেহজাবিন মনে মনে স্বীকার করে, স্বাস্থ্যে আর সৌন্দর্যের মিশেলে স্টেলার রয়েছে অপূর্ব এক নান্দনিকতা। দৃষ্টি আটকে যায়।
থ্যাংকস গিভিং-কে ধরা হয় সবচেয়ে চমৎকার ছুটির পার্বণ। বাবা-মা, ভাইবোন-সবার সাথে দেখা কর, খাওদাও ফুর্তি কর, কেনাকাটা কর। সাধারণত, অন্যদেশের ছাত্রদের কোথাও যাবার জায়গা থাকে না, বিশেষ করে নতুন যারা। আবার ছুটি এতোটা লম্বা নয় যে দেশে গিয়ে ঘুরে আসবে। টিকিটের দামও তো মেলা! মুমিত তাই প্রতি বছর এই সময়টাতে ওদেরকে আসতে বলে। ব্যাক-ইয়ার্ডে পাশাপাশি দুটো গ্রিলিং মেশিন চালু করে দেয়। একটাতে সব হালাল জিনিস, অন্যটিতে ভিন্ন। ঘরের ভিতরে ওভেনে টার্কি বেইক হতে থাকে। ওটি হালাল পাওয়া যেতো না তখন। দুপুরের পর থেকেই দারুণ আয়োজন শুরু হয়ে যায়। ছাত্ররা বেশ চটপটে, উৎসাহী। আনন্দ হয় অনেক। নাঈম তো ওদের সাথে প্রথম থেকেই একদম লেগে থাকে। সেবার ওদের দলে স্টেলাও যোগ দিয়েছিল।
স্টেলার বাবা-মার মাঝে অনেক আগেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। বাবা ডেনভারে থাকে, একটি গানের দলে ড্রামস বাজায়। ওদের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। মাঝে মাঝে আচমকা একটা কার্ড উড়ে আসে। অথবা জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তা! ওর মা তার বর্তমান বয়ফ্রেন্ডের সাথে বোস্টন থাকে। স্টেলার যা যোগাযোগ-তা ওর মায়ের সাথেই। বছরের ঠিক এই সময়তাতেই সে যায় ওখানে। তবে সেবার যেতে পারে নি। মা তার সঙ্গীর সাথে ছুটিতে মেলবোর্ন বেড়াতে গেছে। ওরা জেনেছিল, বোস্টনে সেবার নভেম্বরে নাকি অনেক বরফ পড়বে। পড়েও ছিল তাই। স্টেলা রয়ে গেলো কলাম্বিয়ায়।ওর কোনো ছেলে বন্ধুও জোটে নি তখনো।
এসেই জমিয়ে ফেললো সে। সে একটা ইটালিয়ান পদ বানালো, ‘টরটেলিনি উইথ জুকা।- বেশ মজার একটা পাস্তা আইটেম। প্রধান ডিশের আগে অল্প করে পরিবেশন করতে হয়। যেহেতু মাংশের বালাই নেই কোনো, হারাম-হালালের ঝক্কিও নেই, মেহজাবিন তাই বেশ স্বস্তি নিয়েই খেয়েছিল।
নৈশভোজের পর আর সবার মতো স্টেলাও বক্তব্য দেয়। ‘প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পর এই প্রথম একটা থ্যাংকস-গিভিং সন্ধ্যা উদযাপন করলাম, যেখানে অ্যালকোহলের বালাই নেই। এবং আরো একটি নতুন বিষয় স্মৃতিতে থাকবে আমার। সেটি হলো, হালাল খাদ্য দ্রব্য। বলতেই হচ্ছে, ওগুলো সত্যিই মজাদার। ক্রমাগত অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনে বৈচিত্র্য এনে দেয়। কখনোই নৈরাশ্য ঘর বাঁধে না মনে। হৃদয় থেকে তাই মিউডসুড্ডী পরিবারকে ধন্যবাদ জানাই’- সে বলেছিলো।
সবাই চলে যাবার পর, আনুসঙ্গিক কাজগুলো শেষে শুতে এসে মেহজাবিন বলেছিলো, স্টেলা মেয়েটা দারুণ!
মুমিতের ছোট্ট উত্তর ছিলো, ‘হুম’,- ওর মনে আছে।
এরপরও স্টেলার সাথে তার দেখা হয়েছে।মাঝে মাঝে সে এসেছে তাদের বাসায়। হয়তো নাঈমের জন্মদিনে, কিম্বা ওদের বিবাহ বার্ষিকীতে। এসব অনুষ্ঠান যদিও ওরা উদযাপন করে না। কিন্তু স্টেলা কি করে যেন জেনে নিয়েছিলো। হঠাৎ উপস্থিত হয়ে চমকে দিয়েছে। কখনো কেক, আবার কখনো ফুল। স্টেলার উপস্থিতি মোহনীয়। মেহজাবিনও মুমিতের ডিপার্টমেন্টে গেলে দেখা করেছে ওর সাথে, আড্ডা মেরেছে। ওর জন্মদিনে পাঠিয়েছে কাঁচা ফুলের তোড়া।
ঠিক তেমনই ছিলো সেদিনের অপরাহ্ণ।অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সোজা গিয়েছিলো রেজিস্ট্রার অফিসে। ওর ট্রান্সক্রিপ্ট-টা এইচআরে পাঠাতে হবে। না এসে কেবল ফোন করলেও হয়। কিন্তু ভেবেছিলো কাজ শেষে মুমিতকে অবাক করে দিবে সে। আগে থেকে কিছুই জানায় নি ওকে।
সাধারণত ক্লাস না থাকলে লাইব্রেরিতে কিম্বা নিজের অফিসে বসে পড়াশোনা করে মুমিত। মাঝে মাঝে ল্যাবেও থাকে। মেহজাবিন প্রথমে ওর অফিসে খোঁজ করে। আজো তাই করলো। সামার চলছে, তাই ক্লাসের চাপ নেই বললেই চলে। ইউনিভার্সিটি বেশ সুনসান। ওর দরজাটা ভেজানো, তা ঠেলে ঢুকে মেহজাবিন দেখে মুমিত গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা জার্নাল পড়ছে। হয়তো ওরই কোন রিসার্চ পেপার ছাপা হয়েছে। মাথা উঠিয়ে ওকে দেখে একটু হাসে। বলে, ‘তুমি?’ কিন্তু মোটেই অবাক হয় না। সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলে, এমনিই চলে এলাম।ট্রান্সক্রিপ্ট তোলার বিষয়ে একটা কাজ ছিলো। ভাবলাম দেখা করে যাই।
- জানাও নি যে?
- এমনি, তোমাকে অবাক করে দিতে চেয়েছিলাম। অবাক হয়েছো?
- হুম, কিছুটা।
- কই দেখে তো মনে হয় না।
মুমিত বেশ শব্দ করে হাসে। যে পাতায় পড়ছিলো ওখানে কিছু একটা রেখে হাতের জার্নালটা বন্ধ করে রাখে।মেহজাবিন বলে, কফি খাওয়াও।
- আমার কফি শেষ। ভেন্ডিং মেশিনেরটা খেতে চাইলে এনে খাওয়াতে পারি। তবে ওগুলো তো অখাদ্য।
- তাই খাওয়ায়। মাথাটা ধরেছে খুব।
মুমিত চলে গেলে সে কিছুক্ষণের জন্য একা হয়ে পড়ে। ভেন্ডিং মেশিনটা একটু দূরে। ওর ফিরতে দেরি হবে। কিছু একটা করার জন্য জার্নালটা খুলে দেখার চেষ্টা করে। পড়ে বোঝার চেষ্টা করে। ভাবে, খুব শিগগিরি তার লেখাও বের হবে এমন সব জার্নালে। যে পাতায় মুমিত পড়ছিলো, ওখানে কি যেন একটা চিকচিক করছে। পুরোপুরি খুলে অবাক হয়ে যায় সে। ঠিক মাঝখানে একটা ক্রুশ, সরু। কাঁটার মতো, অথচ বেশ শক্ত। এ জিনিস কোথায় যেন সে দেখেছে, ঠিক মনে করতে পারে না। একটু অবাক হয়। ওর বইয়ে জেসাসের ক্রস!মুমিতের ফিরে আসার শব্দ পায় সে। ঠিক আগের মতো, যেখানে ওটি ছিল তা রেখে দেয় সে। কিন্তু মনে করার চেষ্টা করে কোথায় দেখেছে সে। মুমিত ফিরে এলে ‘ একটু রেস্ট-রুম থেকে আসছি’ বলে বাইরে আসে সে। আসলে এই ফাঁকে স্মরণ করার ফুরসৎ পাবে। মুখ ধুয়ে যখন ন্যাপকিন দিয়ে মুছছে, ঝাঁ করে ওর মনে পড়ে যায়। সে টের পেলো ওর নিঃশ্বাস দ্রুত হতে শুরু করেছে। নাকি সে দ্রুত এগুচ্ছিলো মুমিতের অফিসের দিকে সে জন্যই, সে কথা এখন আর মনে নেই। কিন্তু অতো দৌড়ে গিয়েই বা ও কি করবে? কেন অতো তাড়াতাড়ি ছুটছিলো সে?
ফিরে এসে দেখে মুমিত ঠিক আগের মতোই মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। ওর কাগজের কফির মগটি ঢাকা। সেই সূক্ষ্ম ক্রুশটি আর দেখতে পায় না সে। সাবধানে এদিক ওদিক তাকিয়েও না। কফির মগটি হাতে নিয়ে সে জানালার কাছে চলে আসে। মুমিতের ঘরের অন্য পাশটায় একটা বিশাল জানালা রয়েছে। তারই সামনে একটা ঢাউস কাঠের সাদা টেবিল। মুমিত মাঝে মাঝে কিছু ড্রইং–এর কাজ করে। ওপরে একটা বিশাল বাতি, ওটি আবার প্রয়োজনে সরানো কিম্বা উপর নিচ করা যায়। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে আনমনে তাকিয়ে থাকে সে। তার উদাস ফাঁকা দৃষ্টি ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণ হয়ে এক জায়গায় স্থির হয়ে যায়। সে দেখে ওখানে একটি লম্বা চুল পড়ে আছে। শুধু একটি কালো সিল্কি চুল! এমন সতেজ চুল সহজে চোখে পড়ে না। আড় চোখে দেখে মুমিত পুঁথিতে নিমগ্ন। সে খুবই সাবধানে সন্তর্পণে সেটি তুলে ওর ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়।
পরদিন সে স্টেলাকে ফোন করেছিলো, স্টেলা আজ বিকেলে কি তোমার কোনো কাজ আছে? আমাকে একটু সময় দিতে পারবে?
- ও ইয়েস মিসেস মিউডসুড্ডী । কি ব্যাপার বল তো?
- আমার একটা ভাগ্নি আছে। ওর শারীরিক গড়ন ঠিক তোমার মতোই। সে সবে কাজে ঢুকেছে। এবার দেশে যাবার সময় ওর জন্য কিছু পোশাক নিয়ে যাবো ভাবছি। লফট বেশ ভালো ডিল দিচ্ছে। তুমি যদি একটু কষ্ট করে স্যান্ডহিলের লফটে আসতে খুব ভালো হতো তাহলে।
- ও শিওর।
মেহজাবিন ওর গলায় সেদিন সোনার সেই সূক্ষ্ম চেইনটি দেখেছে। কিন্তু কাঁটার মতো ক্রুশটি নয়। সে কিন্তু মোটেও অসৌজন্য দেখায় নি স্টেলার সাথে। ওর জন্য একটা উপহার কিনে দিলো লফট থেকে, দুজনে মিলে কফি খেতে খেতে অনেক গল্প করলো। যেন দু’জন নিকট বন্ধু। এ প্রসঙ্গে সে মুমিতকেও কিছু জিজ্ঞেস করে নি। আবার এটাও ভেবেছে হয়তো ওসব কিছুই নয়। সে-ই শুধু শুধু মনের অতলে দুর্গন্ধময় শেওলা খুঁজে ফিরছে। হয়তো ওটি স্টেলার কাছ থেকে নিছক উপহার মাত্র। একজন ছাত্র তো তার প্রিয় শিক্ষককে তা দিতেই পারে। কিম্বা হয়তো স্টেলা যে কোনও অসচেতন মুহূর্তে হারিয়ে ফেলেছে, মুমিত ঠিক সেদিনই খুঁজে পেয়েছে। হয়তো ওকে ফেরত দেওয়া হয়ে ওঠেনি। আবার হয়তো ঐ টেবিলের পাশে কাজ করার সময় স্টেলার একটি চুল পড়ে গেছে। এমন হয় না বুঝি? আমাদের কারো কেশরাজিই তো অটুট নয়। এইতো কতো সহজ বিষয়টি। আসলে সহজভাবে দেখলেই অনেক কিছু সুন্দর হয়ে যায়। আমরাই কেবল আমাদের চারপাশকে জটিল করে তুলি। এ ভাবে ভেবে মেহজাবিন একধরণের প্রশান্তি খুঁজে পায়।
তবু একাকি মুহূর্তগুলোতে ওর ভাবনার কাঁটা ধীরে ধীরে ওকে ঠেসে ধরে। এই আজ যেমন ধরেছে। কেন মুমিত ওকে বলেনি ব্যাপারটা? কেন রেস্ট রুম থেকে ফিরে সে আর ওটিকে আগের জায়গায় খুঁজে পায়নি? তার মানে মুমিত ওটি চট করে লুকিয়ে ফেলেছিল! কিন্তু কেন? ভাবনা ক্রমেই আগ্রাসী এবং ক্রুর হয়ে উঠলে তার কল্পনা আরো নিবিড় হয়ে ওঠে। সামারের অপরাহ্ণগুলো কেমন নিথর আর শিথিল। খুব আস্তে আস্তে ফিসফিস করে কথা বললেও স্পষ্ট শোনা যায়।সে কথোপকথন মনের মাঝে আবেশের রঙ ছড়িয়ে দেয়। সুঠাম মুমিত খুব সহজেই স্টেলাকে শুইয়ে দিতে পারে শক্ত সাদা গবেষণার টেবিলে। শরীর ঠিকই খুব দ্রুত বুঝে নেয় অপর শরীরের কম্পাঙ্ক, সময় লাগে না। মেহনে অনেক স্খলনের মতো দু’ চারটি চুল খসে পড়বে, এ আর আশ্চর্যের কি? মেহজাবিন আর ভাবে না। নিজেকে তার নিচ মনে হয়। তবু এখনো রোজ সে মুমিতের পকেট অনুসন্ধান করে। খুঁজে দেখার চেষ্টা করে সে চোর কাঁটা। পায় না। নিজেই কেবল ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে ভাবে, নিপা ভাবীর মতো তারও যদি অমন ভুলে যাবার রোগটা হতো, তবে মন্দ হতো না। বিস্মৃতি আমাদের অনেক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়।
স্টেলা কদিন পর তার প্রশিক্ষক পাল্টে নেয়। খুব দ্রুত পিএইচডি শেষ করে কোথায় যেন চলে যায়। মাঝে আর দেখা হয় নি ওদের। শুধু যাবার আগে ওকে ফোন করেছিলো। বলেছিলো, তোমাদের সাথে অনেক সুন্দর সময় কাটিয়েছি মিসেস মিউডসুড্ডী। যাবার আগে তাই বিদায় নিচ্ছি। তোমাদের সাথে পরিচয় আমার জন্য দারুণ স্মৃতি হয়ে থাকবে। অনন্য স্মৃতি আমাদেরকে কখনো বুড়ো করে দেয় না। ভালো থেকো।
অনেক পরে স্টেলার কাছ থেকে একটা কার্ড পেয়েছিলো সে। ওটা সে পাঠিয়েছিল অরিগন থেকে। সেদিন ছিল ওদের দশম বিবাহ বার্ষিকী। এমনিতে ওরা সেটা উদযাপন করে না। মুমিত প্রতিবারই ঐ দিনটির কথা বেমালুম ভুলে যায়। মেহজাবিন ভুলে না। প্রতিবারই হাফডে ছুটি নেয় সে। ঘরেই ভালো কিছু রান্না করে। সেদিনও করেছিলো। বিকেলে মুমিত আসার আগেই গোসল করে একটু ফ্রেশ হয়ে নেবে। তারপর একটা নতুন শাড়ি পরবে-সে ভেবেছিলো। । নিজের ঘরেই আছে বলে বাড়তি আবরণের দরকার নেই। কেউ তো আর আসছেও না। বাথরুমে ঢুকার আগে মেইল বক্স থেকে সেদিনের চিঠিগুলো নিয়ে আসে। দেখে স্টেলা কার্ড পাঠিয়েছে। ওর ঠিকই মনে আছে এই দিনটির কথা। সেখানে কেবল একটি কথাই লেখা, ‘হ্যাপি ম্যারেজ এনিভারসারি এন্ড আই অ্যাম সরি’।‘আই অ্যাম সরি’ কথাটি কেন লিখেছিল? না লিখলেও পারতো। জীবনের অনেক অদৃশ্য কাঁটার মতো, সেই ক্রুশ কাঁটা আর অজস্র প্রশ্ন সে সাবধানে মনের মাঝে লুকিয়ে ফেলেছিল। ওসব ভেবে কী আর হবে। নারীর হৃদয় অতল কুয়োর মতো। কতো অজস্র কণ্টক এভাবে তলিয়ে যায়! কে তার খোঁজ রাখে। ‘বাকিটা সময়, এমনি তো হয়’।

মেহজাবিন শোনে ডোর বেল বাজছে। হয়তো মুমিত ফিরেছে। দরজা খুলে দেখে ঠিক তাই। ঘরের ভিতরের আলো ওর মুখে পড়েছে। সে আলোয় ওর মুখটা পুরোপুরি দেখা যায় না। কিছু অংশে একধরণের অন্ধকার মিশে থাকে। মুমিতের সম্প্রতি রাখা দাড়ির সাথে সে আঁধার মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ওকে কেমন যেন অচেনা মনে হয়।

অরেঞ্জবার্গ,
সাউথ ক্যারোলাইনা থেকে

***

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:১৮

মামুন ইয়াজ দাইন বলেছেন: সুন্দর। প্রতিটি চরিত্র তার নিজ নিজ বলয়ে আবৃত শুধু মুমিত ছাড়া....!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.