![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রচন্ড রোদ। এর মাঝেই শরীরে জ্বর নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে মুহিত। বেশী জ্বরে মানুষের মাথা আউলায়া যায়, মুহিতের গেছে চোখ আউলায়া। ও সবকিছু সাদা-কালো দেখছে। প্রচন্ড জ্বর আর রৌদ্র তাপে ওর চোখ রঙ্গীন টিভি থেকে সাদা-কালো টিভি তে রুপান্তরিত হয়েছে।
মুহিতের অবশ্য মজাই লাগছে। নিজেকে অন্ধ অন্ধ মনে হচ্ছে। রাস্তায় চলতে গিয়ে লোকজনের সাথে ধাক্কা লেগে যাচ্ছে, কেউ কেউ সহানুভূতি দেখিয়ে অন্ধ ভেবে রাস্তা পার করিয়ে দিচ্ছে। একটা ভাঙ্গা প্লেট থাকলে খুব ভাল হত, ফুটপাথের ধারে বসে ভিক্ষা করা যেত। কিন্তু সমস্যা হল ওর পোশাক, পরিষ্কার জিন্স্ আর শার্ট পরা একটা যুবক ছেলেকে কেউ ভিক্ষা দিবে না ।
-'মুহিত ভাই না ? হায় আল্লাহ! আপনার একী অবস্থা! আপনি এই ছেঁড়া লুঙ্গি পড়ে ফুটপাথে বসে আছেন কেন ?'
-'আম্মাগো, আমি অচল, অন্ধ মানুষ বাবারে, দুইটা টাকা দিয়া যান....'
-'ছি ছি ছি ছি আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন নাকি ? আপনি ফুটপাথে বসে ভিক্ষা করছেন, এই কথা শুনলে মানুষ কী বলবে! আর এই ছেঁড়া লুঙ্গি জামা আপনি পেলেন কই?'
ছেঁড়া লুঙ্গি মুহিত পেয়েছে তমিজ উদ্দিনের কাছ থেকে। তমিজ উদ্দিন নিউ মার্কেট এলাকার ভিক্ষুক সর্দার। সে নিজে ভিক্ষা করে না, দুই নম্বরী ভিক্ষুকদের ভিক্ষার সরঞ্জামাদি ঘন্টা চুক্তিতে ভাড়া দেয়। ঘন্টায় ১০ টাকা তার ভাড়া। আর একবার মেক আপের জন্য ৫০ টাকা। মুহিতের মেক আপ অবশ্য সে 'ফ্রি' তে করে দিয়েছে। ফার্ষ্ট টাইম বলে ফ্রি, এরপর থেকে টাকা দিতে হবে। মেক আপ মানে, মুহিতের মাথায় একগাদা বালু ঢেলে চুল গুলোকে উস্কুখুস্কু করা হয়েছে আর শরীরে ভেজা মাটি ঘষা হয়েছে, চেহারায় পাগল পাগল ভাব আনার জন্য এই কাজ করা হয়েছে।
-'কি হল মুহিত ভাই আপনি কথা বলছেন না কেন ? আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন না ? আমি রিমি। আপনি উঠুন, আমার সাথে বাড়ি যাবেন। না হলে কিন্তু আমি আন্টি কে ফোন করব এক্ষুনি।'
-'কোন আন্টি ? আর আপনি কে? আমি তো চোখে কিছু দেখি না মা! আপনাকে চিনতে পারছি না!'
-'মুহিত ভাই আপনার কি হয়েছে? আপনি কি সত্যি আমাকে চিনতে পারছেন না ?'
রিমির কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে, সে যখন তখন কেঁদে ফেলবে। রিমিকে প্রথম দেখাতেই চিনতে পেরেছে মুহিত, ওদের গলিতেই বাসা। ওর প্রতি এই মেয়ের দুর্বলতা আছে সেটা খুব সহজেই বোঝা যায়। কারণ ছাড়াই ওদের বাড়িতে দিনে তিন চার বার আসে, অকারণে খিলখিল করে হাসে। মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে কাছে এসে জিজ্ঞেস্ করে, "ভাইয়া দেখেন তো আমার কপালের টিপ টা ঠিক আছে কিনা?"
ঈদের দিন সকালে এই মেয়ে একটা বড় বাটিতে সেমাই নিয়ে বাসায় এসে হাজির। মুহিতের মা'র হাতে সেমাইর বাটি দিয়ে ও মুহিতের হাতে একটা ভাঁজ করা কাগজ গুঁজে দিল। ভাইয়া এই চিঠি টা একটু পড়ে দেখেন। চিঠি পড়ার কোন প্রয়োজন বোধ করে নি মুহিত, চিঠিতে কি লেখা থাকতে পারে ও ভালো করেই জানে। রিমিকে একটা জ্ঞাণগর্ভ উপদেশ দিয়ে ফেলল মুহিত।
-"শোন রিমি, তুমি আমার থেকে অনেক ছোট হবে, তোমাকে এই সেদিনও হাফ প্যান্ট ফ্রক পড়ে খেলতে দেখলাম। তোমাকে বড় ভাই হিসেবে একটা উপদেশ দিই, এই বয়সটা তোমার পড়া লেখা করার বয়স। এখন মাথার মধ্যে অন্য কিছু ঢুকাবা না। প্রেম-ভালবাসা এই সবের জন্য অনেক সময় পাবা। কথাটা হয়ত এখন তোমার খারাপ লাগবে, পড়ে একসময় তুমিই আমাকে ধন্যবাদ দিবা যে আমি তোমাকে এই উপদেশটা দিয়েছিলাম।'
-'ভাইয়া, আপনি এইসব কি বলতেছেন? আপনি আগে পড়ে দেখেন কি লিখছি...''
রিমির কথায় মুহিত একটু অবাক হয়ে কাগজটা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল। গুটি গুটি অক্ষরে তিনটা শব্দ লেখা, "আমার সালামী কই?" মুহিত হাসবে না কাঁদবে কিছু বুঝতে পারছিল না। রিমি তখন ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরে হাসছে। মুহিত খেঁকিয়ে উঠেছিল, "ফাজিল মেয়ে কোথাকার! সালামী মুখে চাওয়া যায় না? চিঠি দিয়ে চাইতে হবে? আমার সামনে থেকে দুর হও!"
সেই মেয়ে এখন আবার এসেছে ভেজাল করতে। একে দ্রুত বিদায় করতে হবে।
-'শোন রিমি, এখানে একটা সিচুয়েশন ঘটে গেছে, তোমাকে আমি পড়ে বিষয়টা বুঝিয়ে বলব। তুমি এখন যাও, একটা কিশোরী মেয়ে যুবক ফকিরের হাত ধরে টানাটানি করছে, বিষয়টা ভালো দেখায় না।'
-'আমি কোন কথা শুনব না, আপনাকে আমার সাথে যেতেই হবে।'
রিমি একরকম টানা হেচঁড়া করেই মুহিত কে একটা সিএনজিতে উঠালো।
মুহিত মাথা সোজা করে রাখতে পারছিল না, রিমি ওর মাথাটা একহাতে নিজের কাঁধে চেপে ধরেছে, আরেক হাতে চোখের পানি মুছছে। এতদিন কষ্টে ওর চোখে পানি আসত, আজ অবাক হয়ে দেখল পরম সুখেও ওর চোখে পানি আসছে। মুহিত ভাই ওর ঘাড়ে মুখ ঘসছে আর বিড়বিড় করে নীলা, নীলা বলে ডাকছে। নীলা কে রিমি সেটা জানে না, কিন্তু মেয়েটা ভাগ্যবাণ।
নীলার নাম নেয়াতে রিমির একটুও খারাপ লাগছে না। মুহিত কে ও জড়িয়ে ধরতে পেরেছে এই আনন্দের কাছে নীলার প্রতি জমা হওয়া মৃদু হিংসা কিছুই না! ওর মনে হচ্ছে এই রাস্তা যদি শেষ না হত! যদি এই সিএনজিতে বসে আজীবণ মুহিতকে এভাবেই জড়িয়ে রাখতে পারত!
মুহিতকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় রিমি। ভালবাসার মানুষকে জড়িয়ে ধরতে এত সুখ !!
©somewhere in net ltd.