নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

pramanik99

আমার স্কুল জীবনের স্মৃতিগুলো বার বার মনে পড়ে। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই দিনগুলোতে।

প্রামানিক

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

প্রামানিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

পোড়াবাড়ির চমচম এবং পোড়াবাড়ির হাট (পর্ব-২)

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১:৩৩





পোড়াবাড়ির চমচম ও ভাসানীর বেগুন টালের কাহিনী (পর্ব-১)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক



ইটের হেরিমন করা এবরো থেবরো রাস্তা। রিক্সার অনবরত ঝাঁকিতে কোমরসহ পুরো শরীর পিটন খাওয়া সাপের মত অবস্থা। ঘটর ঘটর করতে করতে রিক্সা সোজা পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। ধরলা নদীর কিছু পূর্বে থাকতেই দক্ষিণ দিকে মোড় নিল। মোড় নেয়ায় আমি রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, চাড়াবাড়ি এখান থেকে কতদুর?

রিক্সওয়ালা হাত উঁচিয়ে পশ্চিম দিকে দেখিয়ে বলল, ওই তো দেখা যায়, ওইডাই চাড়াবাড়ি।

তার কথায় আমি পশ্চিম দিকে মুখ করে চাড়াবাড়ি দেখছি। রিক্সাওয়ালা আমার দেখার আগ্রহ দেখে নিজের থেকেই বলল, বাপ দাদার কাছে গল্প হুনছি, একসময় নাকি চাড়াবাড়ি ঘাটে জাহাজ ভিড়ছে। এখন নদী মইরা বালুচর পরছে। জাহাজ তো দুরের কথা নৌকাও ভিড়ে না।

আমি রিক্সাওয়ালার কথায় ভাল মন্দ কিছু বললাম না। রিক্সা ইটের রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় চলছে। পূর্ব দিকে ফাঁকা মাঠ। পশ্চিম পার্শ্বে মরা নদী। বালুচর পরে নদীর চিহ্ন বিলীন হওয়ার অবস্থা। সামান্য একটু রেখ আছে। কাঁচা রাস্তায় চলতে চলতে রিক্সওয়ালা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়ের বাড়ি কোন জায়গায়?

- ঢাকা থেকে এসেছি।

- আপনি তাইলে ঢাকা থাকেন?

- হ্যাঁ

- আপনি এর আগে কোন দিন টাঙ্গাইল আসেন নাই?

- এসেছি তবে পোড়াবাড়ি আসি নাই।

- আপনি কি পোড়াবাড়ির চমচম খাইছেন?

- সে তো অনেক খেয়েছি।

- খাইছেন তবে আসল চমচম খান নাই।

- কেন?

- আসল পোড়াবাড়ির চমচম পাইবেন কইত্থিকা। আসল ঘোষেরা তো বেশির ভাগ মইরা গ্যাছে। বাকিরা ইন্ডিয়া চইলা গ্যাছে, এখন মাত্র দুইটা ঘোষ হাটে আছে। এই দুই ঘোষের মধ্যে মদন লাল ঘোষ যে আছে, মওলানা ভাসানী পোড়াবাড়ি আইলেই এই দোকানে বইসা মিষ্টি খাইতো।

ভাসানীর মিস্টি খাওয়ার কথা শুনে আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মদন লাল ঘোষের দোকান কি এখনও আছে?

রিক্সাওয়ালা আমার আগ্রহমুলক প্রশ্নের জবাবে মৃদু হাসি দিয়ে বলল, আছে, আমি আপনারে হেই দোকানেই নিয়া যামু। চমচম তো ম্যালা খাইছেন। আইজকা খায়া দেইহেন আসল চমচম আর নকল চমচম কেমুন লাগে।

আমি বললাম, সারা বাংলাদেশে যে পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায় সেগুলা কি আসল না?

রিক্সাওয়ালা আমার কথা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাব করে বলল, হেইগুলা কি চমচম নাকি! দুধের ছানা গোল গোল চ্যাপ্টা কইরা চিনির সিরার মধ্যে চুবাইলেই চমচম হইল? চমচম বানানের টেকনিক এই দুই ঘোষ ছাড়া আর কেউ জানে না। আর সামন্য একটু চমচমের কাজ শিখছে টাঙ্গাইলের পাঁচ আনি বাজারের চার পাঁচটা ঘোষ। এ ছাড়া যত ঘোষ আছে, তারা হুদা চিনির সিরার মধ্যে ছানা চুবায়া চমচম বানায়।



রিক্সাওয়ালার সাথে কথা বলতে বলতে একসময় হাটের মাঝে চলে এলাম। রিক্সা সোজা মদন লাল ঘোষের মিস্টির দোকানের সামনে গিয়ে থেমে গেল। আমি কিছু বলার আগেই রিক্সাওয়ালা বলল, ভাই এইডাই মদন লাল ঘোষের দোকান। মদন লাল ঘোষের নাম শুনে আমি তাড়াতাড়ি রিক্সা থেকে নেমে গেলাম। দোকানটি তেমন জাঁকজমক নয়। গ্রামের হাটের সাদামাটা একটি মিষ্টির দোকান। টিনের ঘর টিনের বেড়া। মাঝখানে কিছু অল্পদামি কাঠের চেয়ার টেবিল। তাও আবার অনেকগুলি নড়বড়ে। ইটের কোন বালাই নেই। মাটির মেঝে। তবে ঝাড়– দিয়ে পরিস্কার করা। দুই পাশে বেড়ার অনেকখানি খুলে ফাঁকা করে দেয়ায় পর্যাপ্ত আলো বাতাস আছে। সবগুলো চেয়ার টেবিল ফাঁকা। আমি ছাড়া আর কোন খরিদ্দার চোখে পড়ল না। রিক্সাওয়ালা নিজেও রিক্সা থেকে নেমে আমার সাথে সাথে দোকানে ঢুকল। আমাকে একটি ফাঁকা টেবিল দেখিয়ে বসতে বলল। আমি চেয়ারে বসতেই সে সোজা দোকানের ক্যাশে বসে থাকা অল্প বয়সী কিশোরকে বলল, এই গ্যাদা, এই ভাই ঢাকা থিকা আইছে, ভাইরে ভাল দেইহা চমচম দে। খায়া জানি ঢাকায় যায়া গল্প করে।



রিক্সওয়ালার কথা শুনে ছেলেটি চেয়ার থেকে উঠে লোহার কড়াই থেকে দু’টি বড় বড় চমচম টিনের প্লেটে তুলে নিয়ে এল। বিশাল সাইজ। একেকটি এক পোয়ার কম নয়। ছোট চামচ দিয়ে দু’টি মিস্টি খেয়ে তৃপ্তিবোধ করলাম। পোড়াবাড়ির চমচমের প্রশাংসা না করে পারছি না। পোড়াবাড়ির মিষ্টি অনেক খেয়েছি কিন্তু এরকম স্বাদ কখনও পাই নি। মিষ্টির উপরে খাঁটি মাওয়ার গুঁড়া ছিটানো। মিষ্টির ভিতরে বিশেষ কৌশলে ফাঁকা। ঢাকার নামকরা অনেক মিষ্টির দোকনে পোড়াবাড়ির নামে চমচম খেয়েছি, তবে এমন স্বাদ পাই নি। মিষ্টির ভিতরে ফাঁকা থাকে এমন চমচমও পাই নি। মিষ্টি খেয়ে পেট ভরল না বটে তবে চমচমের স্বাদে মুখ মেরে গেল। পুরো তৃপ্তি পেলাম। আর কোন কিছু খেতে ইচ্ছে হলো না। দু’টি মিষ্টির দাম নিল বিশ টাকা। নিবে না কেন? এতবড় ঢাউস সাইজের মিষ্টি এর আগে কখনও দেখিনি। পরে হিসাব করে দেখি কমই নিয়েছে। কারণ দু’টি মিষ্টি কম করে হলেও আধা সের হবে। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দাম।

মিষ্টি খেয়ে পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় পাকা চুল-দাড়িওয়ালা সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ এসে আমার পাশের টেবিলে চেয়ারে বসল। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, বাবাজি আপনে কার বাড়ি আইছেন?

আমি বললাম, আমি কারো বাড়ি আসি নাই, এমনি বেড়াতে এসেছি।

বৃদ্ধ আশ্চার্য হয়ে বলল, কারো বাড়ি আসেন নাই, এমনি এমনি বেড়াইতে আইছেন। এই গাঁও-গেরামে কেউ এমনি এমনি বেড়াইতে আইসে! এইডা কেমুন কথা কইলেন!

আমি বৃদ্ধের সন্দেহমূলক প্যাচানো কথা শুনে তাড়াতাড়ি বললাম, চাচা এমনি এমনি মানে, পোড়াবাড়ির চমচম খাওয়ার জন্য এসেছি।

পোড়াবাড়ির চমচম খেতে এসেছি শুনে বৃদ্ধ টেবিলে একটা থাপ্পার দিয়ে হো হো করে হেসে বলল, এইবার না বুঝবার পারছি। তাই তো কই, কেউ কি এমনি এমনি গাঁও-গেরামে আইসে। কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকে। তা বাবাজি মিষ্টি খাইছেন?

আমি বললাম, হ্যাঁ চাচা, খেয়েছি।

বৃদ্ধ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তা মিস্টি কেমুন লাগল?

আমি হাসি হাসি ভাব করে বললাম, হ্যাঁ চাচা, খুব ভাল লাগল।

বৃদ্ধ হাসি হাসি মুখে বলল, আরে বাবা, এই দোকানের মিষ্টি খারাপ কইবার পারবা না। এই দোকানের মিষ্টি ভাসানী খাইছে, আর পি সাহা খাইছে, পি সি সরকার খাইছে, সরোয়ার্দী খাইছে, শেরে বাংলা খাইছে বলেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবাজি কইলে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, শুধু চমচমের কারণে জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, নবাব আলী চৌধুরী, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, প্রমথ নাথ চৌধুরীর মত লোকেরাও এই হাটে আইসা মিষ্টি খায়া গ্যাছে। অনেকরেই আমি নিজের চোখে দেখছি।

বৃদ্ধ আরো জানালো, পোড়াবাড়ির হাটে প্রথম চমচম তৈরী করেন দশরথ গৌড়। তিনি আসাম থেকে এসেছিলেন। তার মিষ্টি লঞ্চ স্টীমার যোগে ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় চলে যেত। ধরলা নদীর পানি আর এই এলাকার দুধের গুণে পোড়াবাড়ির চমচমের স্বাদই আলাদা। এই এলাকার চমচমের স্বাদ অন্য কোন এলাকায় পাওয়া যাবে না। বৃদ্ধের কথা শুনে খুব ভাল লাগল। বৃদ্ধ পুরানো দিনের অনেক কাহিনী শোনাল। এই এলাকায় নাকি কুছুমুদ্ধি নামে এক কুখ্যাত ডাকাত ছিল। সবাই তাকে কইছা ডাকাত নামে ডাকত। সে এতো গুনমন্ত্র জানতো যে, দারগা-পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে রাখতে পারতো না। হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে থানা হাজতে রেখে দিলে, ইঁদুর বিড়াল হয়ে পুলিশের চোখে ধাঁ ধাঁ লাগিয়ে কোন ফাঁকে যে বের হয়ে যেত, কেউ বলতেই পারতো না।

(চলবে)

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১:৪৮

সাজেদ বলেছেন: পড়ে ভাল লাগল। আমিও চমচমের ভক্ত।

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১:৫৯

প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই সাজেদ। আপনিও চমচমের ভক্ত। জেনে খুশি হলাম। শুভেচ্ছা রইল।

২| ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৩:০৯

খেলাঘর বলেছেন:



েবার বুড়ো আপনার গল্পও করবেন; বলেছেন তো আপনি ব্লগার?

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ ভোর ৪:৩৭

প্রামানিক বলেছেন: তখন তো ব্লগ ইন্টারনেট বলে কোন শব্দ ছিল না। ব্লগারের কথা বলবো কিভাবে।

ধন্যবাদ ভাই খেলাঘর। শুভেচ্ছা রইল।

৩| ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:০৫

কাবিল বলেছেন: চমচমের ছবি দেখে খেতে ইচ্ছে করছিল।
মিষ্টি যাতিও জিনিস আমার খুব প্রিও।



পড়ে খুব ভাল লাগল


ধন্যবাদ

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:১২

প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই কাবিল। শুভ্চেছা রইল।

৪| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:০৩

দেশ প্রেমিক বাঙালী বলেছেন: পড়ে খুব ভাল লাগল

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৫১

প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই। দেশ প্রেমিক বাঙালী।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.