নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
নিবারাণ কাকাদের বাড়িতে কয়েকটি পরিবার বাস করতো। যেমন সর্ব উত্তরে ছিল নিববারণ কাকার বাড়ি, তার দক্ষিণে নিশি কাকার বাড়ি, দিনেশ কাকা বাড়ি, রুহিনী ডাক্তার কাকা বাড়ি, সূর্য কাকারা দুই ভাই, শান্তি তাওয়াই, শুধাংশু দাদা এবং সবার দক্ষিণে ছিল শিরিশচন্দ্র কাকার বাড়ি। প্রত্যেকেরই ছিল আলাদা আলাদা পরিবার আলাদা আলাদা বাড়ি। বাড়িটি এক উঠানেই উত্তর দক্ষিণ কয়েকশ’ গজ লম্বা ছিল। এই পরিবারের সমস্ত লোকজনকেই চরে নিয়ে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। আমাদের ধারণা ছিল ঐ বাড়িতে আর কোন মানুষ জন নাই। বিকাল বেলা বাড়ির সামনে বসে ওয়াপদা বাঁধের দিকে তাকিয়ে আছি। বাঁধটি উত্তর দক্ষিণ প্রায় এক মাইলের মতো ফাঁকা। বাঁধটি জমি থেকে অনেক উঁচু এবং আশেপাশে কোন ঘরবাড়ি না থাকায় অনেক দূর থেকেই বাঁধে হেঁটে আসা মানুষ জন দেখা যায়। এই বাঁধ দিয়েই খান সেনাদের আসার সম্ভাবনা বেশি। যে কারণে দুই চারজন যারা এই এলাকায় বাড়ি পাহারা দেয়ার জন্য আছে, তাদের সকলেরই নজর ওয়াপদা বাঁধের দিকে। যদি খান সেনারা হুট করে চলে আসে তখন দূর থেকে দেখা মাত্রই যেন পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে, ঠিক সেই সময় দক্ষিণ পশ্চিম দিকের রাস্তায় তকিয়ে দেখি যজ্ঞেশ^র বুড়ো লাঠি ভর দিয়ে কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে আস্তে আস্তে আমাদের বাড়ির দিকে আসতেছে। একে তো খুনখুনে বুড়ো তারোপর পিঠ বাঁকা হয়ে কুঁজো হয়েছে। লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারে না। বুড়োকে কখনও বেশি দূর হাঁটা তো দূরের কথা বাড়ির বাহিরেও যেতে দেখি নাই। সেই বুড়োকে পরনে ধুতি এবং ঊর্ধ্বাঙ্গ বস্ত্রহীন অবস্থায় আমাদের বাড়ির দিকে হেঁটে আসতে দেখে কিছুটা আশ্চর্যই হলাম। আমার ধারণা ছিল কোন মানুষ জন আর ওই বাড়িতে নাই। সূর্য কাকার মা অচল মানুষ হাঁটতে পারে না প্যারালাইসিস হয়ে অনেক দিন হলো বিছানায় পড়ে আছে। সেই বুড়িকেও তারা বাড়িতে ফেলে রেখে যায় নাই। দুই ভাই পিঠে চরিয়ে নদী পার করে চরে নিয়ে গেছে। যেখানে অচল বুড়ি চরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে সেখানে এই সচল বুড়ো কি করে বাদ পরল বুঝতে পারছিলাম না। আমি মাটিতে খড় বিছিয়ে বসে ছিলাম। বুড়ো লাঠি ভর দিয়ে ঠক ঠক করতে করতে আমার কাছে এসে বসে পড়ল। গাইবান্ধার আঞ্চলিক ভাষায় জিজ্ঞেস করলাম, দাদা, তুঁই কোটে আছুলু? এখন কোটে থাকি আলু?
বুড়ো হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বাড়িত থাকি আলুম রে। বলেই বলল, তোর মাও বাড়িত আছেরে?
বললাম, আছে।
বুড়ো আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে বলল, মোক এ্যানা তোরঘরে বাড়ির ভিতরোত নিয়া যাতো দাদা।
বুড়োর বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় ছোট থেকেই বুড়োকে চিনি। বুড়োর নাতি নরেন্দ্র নাথ সরকার আমার বাল্যবন্ধু। আমরা দুইজন ছোট থেকেই একজন আরেকজনের খেলার সাথি এবং একই ক্লাসে লেখাপড়া করি। বেশিরভাগ সময় ঐবাড়িতেই খেলাধুলা করে সময় কাটাই। বুড়োর বাড়ির চিড়া মুড়ি অনেক গলধকরণ করেছি। নরেনের বড় ভাই কান্তি দা আমার বড় ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের বন্ধুত্ব আমাদের দুই পরিবারেই পারিবারিক ভাবে স্বীকৃত। সেই বন্ধুত্বের কারণে তাদের আর আমাদের মধ্যে একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে। কোন বিয়ে শাদী বা সামাজিক অনুষ্ঠান হলে তাদের দাওয়াত থেকে আমরা যেমন বাদ পড়ি না তেমনি আমাদের বাড়িতেও কোন অনুষ্ঠান হলে তারাও দাওয়াত থেকে বঞ্চিত হয় না। তবে হিন্দু মুসলিম দুই পরিবার দুই ধর্মের হওয়ার কারণে খাবার আয়োজন হতো আলাদা আলাদা। তারা আমাদের বাড়ির কোন দাওয়াতে আসলে তাদের রান্না তারা নিজেরা করে খেত আবার আমরা তাদের বাড়িতে গেলে আমাদের রান্না আমরা নিজেরাই করে খেতাম। একে তো আমাদের বাড়ির সন্নিকটে বাড়ি তারোপর তাদের বাড়ির সাথে আমাদের বাড়ির লোকজনের সব সময় যাতায়াত। এসব কারণে বুড়োর অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। বললাম, ও দাদা, তুই ক্যাংকা কতা কলু, হামার বাড়ির ভেতরোত যাবু তাক আবার কওয়া নাইগবে, আসেক মোর সাতোত উঠি আয়।
বুড়ো বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও দাঁড়াতে পারছিল না। হাত ধরে তুলতে গিয়ে বুঝলাম বুড়োর গায়ে একটুও শক্তি নাই, পুরো ভর আমার উপর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। যে বুড়ো নিজে নিজে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না সেই বুড়ো এতো পথ কি করে হেঁটে আসল ভেবে আশ্চার্য হয়ে গেলাম। বুড়োকে ধরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে দক্ষিণ দুয়ারি ঘরের বারান্দার জল চৌকিতে বসতে দিলাম। এমন সময় মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আসলে মাকে দেখেই বুড়ো কেঁদে দিল। কেঁদে কেঁদে বলল, বৌমা, মুই দুইদিন হলো না খায়া আছোম। খিদায় মাথাটা পিনপিন করি ঘুইরবা নাগছে। মোক এ্যানা খাবার দাও গো মা, মুই না খায়া মইরবার ধরছোম।
সেই সময় জাতপাত নিয়ে হিন্দুদের মাঝে খুব কঠোরতা ছিল। হিন্দুরা মুসলমান বাড়িতে ভাত খেলেই জাত চলে যেত, এমন কি জাত যাওয়ার ভয়ে মুসলমানদের খাওয়া গ্লাসে তারা কখনও পানি পর্যন্ত পান করতো না। হিন্দুদের খাওয়া হুকায় ভুল বশতঃ মুসলমানে মুখ দিলেও রক্ষা নাই সেই হুকো আর তারা গ্রহণ করতো না ছুড়ে ফেলে দিত। সেই জায়গায় বুড়ো নিজেই উপযাচক হয়ে ভাত খেতে চাচ্ছে। একটা লোক কোন পর্যায়ের ক্ষুধার্ত হলে জাতপাত ভুলে খাওয়ার জন্য পাগোল হয়ে যায়। ক্ষুধার্ত বুড়োর খাওয়ার আগ্রহ দেখে মা তাড়াতাড়ি বলল, তাওয়াই (তালুই), ভাত তো নাই, যেকনা পাক কইচ্চিলাম তামানে খায়া ফ্যালাছি। আপনে অল্পে এ্যানা ব’সেন মুই ভাত পাক করি দেম।
বুড়ো বলল, পাক পরে করো গো মা, এখন যা আছে তাই মোক দাও।
মা ঘরে থেকে একটা কাসার বাটিতে কিছু চাউল চিড়া আর গুড় এনে দিল। বুড়ো সেই চাউল চিড়া এক গ্লাস পানি দিয়ে ভিজিয়ে গোগ্রাসে খেয়ে সোজা হয়ে বসল। তার বসার ভাব ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে খাওয়ার পরে তার দেহে একটু হলেও বল ফিরে এসেছে। বুড়ো খাওয়া শেষে অনেকক্ষণ জলচৌকিতেই বসে থাকল। এরপর আমাকে ডেকে বলল, মোক এনা তোরঘোরে কাচারি ঘরোত নিয়া যা তো দাদা, খাওয়ার পরে গাওটা কেমন ছাড়ি দিছে, অস্থির নাইগবা নাইগছে, মুই এনা শুতিম। আমি তাকে ধরে এনে কাচারি ঘরে চৌকিতে বসিয়ে দিলাম। সেখানেই বুড়ো শুয়ে পড়ল।
রাতে মা হাঁসের মাংস রান্না করেছেন। পাক সেনারা গ্রামে হামলা করার পর থেকেই বাবার নির্দেশ, প্রতিদিনই একটা একটা করে হাঁস মুরগী জবাই করে খাওয়ার জন্য। খান সেনারা বাড়িতে হামলা করে মানুষ মারার পাশাপাশি হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল যা সামনে পড়ে তাই ধরে নিয়ে যায়। বাঙালিদের হাঁস মুরগি বিনা পয়সায় খেয়ে আবার তাদেরকেই গুলি করে মেরে ফেলে রেখে যায়। সেই জন্য বাবার কথা হলো বর্বরদের হাত থেকে বেঁচে থাকার যখন নিশ্চয়তা নাই তখন হাঁস মুরগি ওদের জন্যে রেখে লাভ কি তার চেয়ে মৃত্যুর আগে নিজেদের জিনিষ নিজেরাই খেয়ে মরা ভালো। তার কথা মতই প্রতি দিনই একটা করে হাঁস অথবা মুরগী খাওয়া হচ্ছে। হাঁস রান্না করার কারণে মা আর কোন তরকারি রান্না করে নাই।
রাতে বুড়োকে বারান্দায় বড় কাঁঠালের পিঁড়িতে বসিয়ে মা কলার পাতায় ভাত খেতে দিলে ক্ষুধার চোটে বুড়ো হাঁসের মাংস দিয়েই অনেকগুলো ভাত খেয়ে নেয়। তার খাওয়া দেখে মা খুব খুশিই হলেন। যে মানুষ জীবনে কোন দিন মুসলমান বাড়িতে এক গ্লাস পানি খায় নাই, সেই লোক অনেকগুলো ভাত খেয়েছে এটা মায়ের কাছে বেশ আনন্দের মনে হলো। কিন্তু বিপত্তি ঘটল আধা ঘন্টা পর। বুড়ো বারান্দায় বসেই উঁয়াক উঁয়াক করতে করতে হর হর করে বমি করে দিল। বমি করার কারণ বুঝতে বাকি থাকল না। হিন্দু ঘরে জন্ম নেয়ার পর থেকে বুড়ো মাছ ভাত খেলেও জীবনে কখনও মাংস ভাত খায় নাই। সেই জায়গায় একে তো হাঁসের মাংস ভক্ষণ তারোপর মুসলমান বাড়ির রান্না। বুড়ো ক্ষুধার চোটে গোগ্রাসে ভাত খেলেও পরবর্তিতে তা আর পেটে সহ্য করতে পারে নাই। পুরো খাবারই মনে হলো বমি করে উগ্রে দিল। তার এই অবস্থা দেখে মা কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ক্ষুধার্ত বুড়োকে না খেয়েও রাখা যাবে না, কিছু না কিছু তাকে খাওয়তে হবে। তানা হলে ক্ষুধার চোটে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারে। বুড়ো একটু সুস্থির হলে মা আবার কিছু চিড়া মুড়ি খেতে দিল। বুড়ো তাই খেয়ে একটু দম নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। বুড়ো যেতে চাইলেও মা বাবা দু’জনেই তাকে বাড়ি যেতে দিলেন না। কাচারি ঘরে থাকার ব্যাবস্থা করে দিলেন। বুড়ো সেখানেই শুয়ে রাত পার করলেন।
অনেক দিন আগেই বুড়োর স্ত্রী মারা গেছে। আমার বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই তার স্ত্রীকে দেখি নাই। একটাই মাত্র ছেলে নাম শান্তি সরকার। শান্তি সরকারের চার ছেলে দুই মেয়ে। মেয়ে দু’টির বিয়ে হয়েছে। চার ছেলের মধ্যে কান্তি দা সবার বড় হলেও এখনো বিয়ে করে নাই। এক দেড় বছর হলো শান্তি সরকারেরও স্ত্রী মারা গেছে। এর পর তিনিও আর বিয়ে করেন নাই। শান্তি সরকারের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে তাদের সংসারে খুব টানা পোড়ান যাচ্ছে। ধান চালের অভাব নাই কিন্তু রান্নাবান্না করার মত কেউ নাই। ছেলেসহ নাতীরা যতটা পারে রান্না করে খায়। বাড়ির রান্নার পাশাপাশি তাদেরকে আবার মাঠের চাষাবাদও সামাল দিতে হয়। একটা গৃহস্থ বাড়ির মহিলা না থাকলে সংসার নিয়ে যেরকম করুণ অবস্থা হয় বুড়োর বাড়িতেও সেই দশা। ছেলেদের পক্ষে ডাল ভাত রান্না করা সম্ভব হলেও চিড়া মুড়ি তৈরী করা সম্ভব নয়, সেই কারণে তাদের ঘরে বাড়তি কোন খাবার নাই। পাক সেনারা তার পাশের ঘরের রুহিনী ডাক্তারকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় বাড়ির সবাই জীবন নিয়ে পালিয়ে গেলেও বুড়ো পালাতে পারে নাই। বয়সের ভারে ন্যুজ্য হওয়া বুড়ো একাই বাড়িতে বসে ছিল। ঘরে মাচা ভরা চাল ডাল থাকলেও রান্নার অভাবে বুড়োর ভাগ্যে কোন খাবার জোটে নাই। শুধু পানি খেয়েই দুই দিন কাটিয়েছে।
সকাল বেলা মা মুরগীর মাংসের পাশাপাশি বুড়োর জন্য আলাদা করে ডাল রান্না করলেন। বুড়ো যেহেতু মাংস খেতে পারেন না সেই জন্য শুধু ডাল দিয়েই ভাত খেতে দিলেন। কিন্তু বুড়ো ভাত খেতে রাজি হলেন না। বলল, নাগো মা, মোক আর ভাতটাত দিস না, চিড়া মুড়িই এনা গুড় দিয়ে দে।
মা বলল, চিড়া মুড়ি খায়া কয় দিন থাইকপেন? না খায়া থাইকতে থাইকতে তো মাথা ঘুরি পরি মরি যাবেন, না খায়া থাকার চায়া ডাল দিয়া চারটা ভাত খান শরীরে তাগদ পাবেন।
মা বারবার অনুরোধ করা সত্বেও বুড়ো খেতে রাজি হলেন না, বাধ্য হয়ে মা বুড়োকে আবার চাউল চিড়ার সাথে গুড় দিয়ে বাটি ভরে দিলেন। বুড়ো তাই খেয়ে কাঁচের গ্লাসে পানি খেলেন। বুড়োর খাওয়া শেষ হলে মা এক হাঁড়িতে ভাত আর অন্য হাঁড়িতে তরকারি দিয়ে বহন করার সুবিধার্তে একটা বালতির ভিতর সাজিয়ে দিলেন। চরে আমার তিন ভাইবোনের সাথে আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসে মেজ মামাও না খেয়ে বসে আছে। আমি যতক্ষণ না যাবো ততক্ষণ তাদের খাওয়া হবে না। মা আমাকে খাবার নিয়ে চরে যেতে বললে বুড়ো আমার পিছু নিল। আমাকে বার বার অনুরোধ করতে লাগল, দাদারে, মোকো এ্যানা তোর সাতোত নিয়ে যা ভাই। মুইয়ো তোর সাতে চরোত যাইম।
বুড়ো আমার সাথে চরে যেতে চাইলেও আমি নিতে চাচ্ছিলাম না। যে বুড়ো ঠিকমতো হাঁটতে পারে না তাকে কিভাবে এতো পথ হাঁটিয়ে চরে নিয়ে যাবো। বুড়ো পিছু নেয়ায় চরে যাওয়ার আগ্রহই হারিয়ে ফেললাম। বুড়ো যাতে আমার সাথে না যায় সেই উপায় খুঁজতে লাগলাম, বললাম, দাদা, তুই এতো রাস্তা হাইটপার পাবুনা। তুই এ্যাটে থাকি যা। তিন বেলা খাবু আর ঘুমাবু। তোর চিন্তা কিসের। বুড়ো আমাদের বাড়ি থাকলেও সমস্যা নাই, বুড়োর ঘর ভরা ধান চাল, তাকে আলাদা রান্নার ব্যাবস্থা করে দিলে সারা বছর খেয়েও শেষ করতে পারবে না।
কিন্তু বুড়ো নাছোড় বান্দা আমার সাথেই যাবে। আমি যতই তাকে থাকার জন্য বলি সে ততই আমার পিছু নেয়। আমি যেখানে যাই সেও সেখানে যায় আর বলে, তোর হাত পাও ধরি কম দাদা, মোক তুই সাতোত করি চরোত নিয়া যা ভাই, মোর বেটার কাছোত নিয়া থুইয়া আয়। বেটার কাছে যায়া মরলেও হামার দুক্কো থাইকপা নয়।
তার কাকুতি মিনতি দেখে মা আমাকে অনুরোধ করতে লাগল, বাবা যেতে চায় যখন সাথে নিয়ে যা। তিন দিন হলো ভাত খায় নাই, খালি চিড়া খায়া আছে, যদি তালবেতালে না খেতে খেতে মরে যায় তখন বিপদে পড়ে যাবো। মোছোলমান হলে তাও হতো। হিন্দু মানুষ যদি মারা যায় তাকে শ্মশানে নিয়া দাহ করবে কে। তার চেয়ে জ্ঞাতি গুষ্ঠির কাছে দিয়ে আয় তারা যেভাবে পারে দেখে শুনে রাখবে।
মায়ের ভয়টা আমি বুঝতে পারলাম। মা বুড়োর খাওয়া পরা নিয়ে চিন্তিত নয়, তার ভয় হলো বুড়োর শরীরের অবস্থা খুবই নাজুক, এই অবস্থায় যদি কিছু একটা হয়ে যায় তখন এই ঝামেলা সামাল দিবে কে। তার চেয়ে কষ্ট করে হলেও যাদের লোক তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ায় শ্রেয়। মায়ের অনুরোধ অগত্যা ঢেঁকি গেলার মতো আমাকে গিলতে হলো। আমার এক হাতে বালতি। বালতিতে ভাই বোনদের দুই বেলার ভাত তরকারি মিলে চার পাঁচ সেরের কম নয়। বুড়োর কাপরের পোটলার ভিতর মা কিছু চিড়া মুড়ি দিয়ে দিয়েছে। সেটাও দেড় দুই সেরের মতো হবে। আমি যদি বুড়োকে রেখে যাই সেই ভয়েই বুড়ো তার কাপড়ের ঝোলা ঘাড়ে নিয়ে আমার পিছে পিছে হাঁটতে লাগল।
বুড়ো তার সমস্ত শক্তি দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেও বেশি দূর যেতে পারল না। কয়েক শ’ গজ যাওয়ার পরেই বসে পড়ল। রাস্তায় ঘাসের উপর বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, দাদারে-- তুই একনা মোর সাথে বোসেক। এত্তি বসি এ্যানা জিরি ন্যাম তার পরে আবার হাঁটা ধইরমো।
বুড়োর সাথে বাধ্য হয়ে আমাকেও বসতে হলো। বাড়িতে রেখে আসলে সমস্যা ছিল না কিন্তু রাস্তায় এনে মানবিক কারণেই তাকে আর ফেলে রেখে যাওয়া যাচ্ছে না। দশ পনোরো মিনিট জিরানোর পর আবার বুড়োকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বুড়োর সাথে হাঁটতে গিয়ে অনেকটা বিরোক্ত হয়ে গেলাম। একে তো বুড়ো আস্তে আস্তে হাঁটে তারোপর একশ’ গজ পরে পরেই বসে পড়ে। একটা পর্যায়ে বুড়ো আর হাঁটতেই চায় না, অনেকক্ষণ বসার পরে বড় জোড় একশ’ গজের আগেই বসে পড়ে। বুড়োর এই অবস্থা দেখে বুড়োর ঘাড়ের ঝোলা আমার কাঁধে নিতে বাধ্য হলাম। ডান হাতে বালতি আর বাম কাঁধে বুড়োর ঝোলা। এখন আমারো হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। অল্প একটু হেঁটে যাওয়ার পরে অনিচ্ছা সত্বেও বুড়োর সাথে বসতে হচ্ছে, কিছুক্ষণ বুড়োকে জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটতে হচ্ছে। এভাবেই বুড়োকে নিয়ে অনেক কষ্টে মাইল খানেক যাওয়ার পরেই আরেক বিপদ দেখা দিল। কহাই মারির সামসুল মৌলুভীর বাড়ির কাছে যেতেই বুড়ো আবার বসে পড়ল। রাস্তার পাশে দুইজন বসে আছি, এমন সময় পশ্চিম দিক থেকে ধানের ক্ষেতের ভিতর দিয়ে দেখি তিন চারজন লোক হাতে ধারালো ছুরি নিয়ে আমাদের দিকেই ছুটে আসতেছে। এই দৃশ্য দেখেই বুড়ো আমার এক হাত ধরে বলল, দাদারে ওরা ছুরি নিয়ে আইসপা নাইকছে ক্যা?
ছবি ঃ ইন্টারনেট
২৬ শে জুন, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০
প্রামানিক বলেছেন: ঠিক বলেছেন, যুদ্ধের সময়ের কষ্টের কথা মনে হলে এখনো চোখের সামনে ধোঁয়া উড়ে। ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্য করার জন্য
২| ২৬ শে জুন, ২০২৪ দুপুর ২:০৭
এম ডি মুসা বলেছেন: মুক্তিযুদ্ধ বইতে বা ইতিহাসে থাকলে হবে না তার ফল সে আশা অধিকার মানুষের মাঝে থাকতে হবে। দেশের সেক্টরে থাকতে হবে। জনাব ওবায়েদুল কাদের সাহেব গতকাল বলেছে , আমলা েএকা দুর্নীতে করে না অন্য সেক্টরেও হয়া ।তাহলে এটা কি মুক্তিযুদ্ধর দেশ?
২৬ শে জুন, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২
প্রামানিক বলেছেন: যে আশায় বাঙালিরা এ দেশটা স্বাধীন করেছিল তার বিপরীত এখন। যুদ্ধের সময় যারা কষ্ট করেছে তাদেরকে এখন মূল্যই দেয়া হয় না। ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্য করার জন্য
৩| ২৬ শে জুন, ২০২৪ দুপুর ২:০৮
সত্যপথিক শাইয়্যান বলেছেন:
ছবিটা কি সেই সময়ের নাকি কোন মুভির ক্লিপ থেকে নেওয়া?
ইন্টারনেট থেকে নিয়েছেন বলে জানতে আগ্রহী হলাম।
২৬ শে জুন, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬
প্রামানিক বলেছেন: ছবিটি একাত্তরের স্মরণার্থীদের ছবি। ইন্টারনেট থেকে নেয়া। ধন্যবাদা মন্তব্য করার জন্য
৪| ২৬ শে জুন, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৫
শায়মা বলেছেন: তারপর কি তাকে মেরে ফেললো!!!
২৬ শে জুন, ২০২৪ বিকাল ৫:২৯
প্রামানিক বলেছেন: এরপর কি ঘটেছে সে ঘটনা আগামী কাল দেব। ধন্যবাদ
৫| ২৬ শে জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩১
শেরজা তপন বলেছেন: পরের ঘটনাটুকু জানার অপেক্ষায় রইলাম ভাই ...
২৬ শে জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭
প্রামানিক বলেছেন: ঠিক আছে ভাই আগামি কাল দিয়ে দিব। মন্তব্য করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ
৬| ২৬ শে জুন, ২০২৪ রাত ৮:৩৫
গিয়াস উদ্দিন লিটন বলেছেন: চমৎকার স্মৃতিচারণ।
৭১ এ আমার বয়স কম থাকায় তেমন কিছু মনে নেই।
২৮ শে জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৯
প্রামানিক বলেছেন: অনেক কিছু মনে থাকলেও লেখা যাবে না।
৭| ২৬ শে জুন, ২০২৪ রাত ৯:৫৬
কামাল১৮ বলেছেন: অনেক হিন্দু বাড়ী খালি পড়ে ছিলো।বাড়ীর পাশের ছোট পুকুরে অনেক কিছু ফেলে রেখে ভারতে চলে যায়। বরিশালে আমি এমন অনেক খালি বাড়ী দেখেছি।ঘরে কিছুই নাই।
২৮ শে জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১
প্রামানিক বলেছেন: আমাদের গ্রামেও তাই হয়েছিল। অনেকই ভারত থেকে ফিরে এসে শোয়ার কাঁথা পর্যন্ত পায় নাই।
৮| ২৭ শে জুন, ২০২৪ ভোর ৫:৫৩
শ্রাবণধারা বলেছেন: যজ্ঞেশ্বর দাদুর কাহিনী ভালো লাগলো প্রামানিক ভাই।
আপনাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলা কথাগুলো অনেকদিন পরে শুনলাম, বেশ লাগলো।
২৮ শে জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২২
প্রামানিক বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ, তখনকার বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করতে হলো।
৯| ২৭ শে জুন, ২০২৪ দুপুর ১২:২৫
আহলান বলেছেন: নে ক্স ট প্লিজ ...
২৮ শে জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২২
প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে
১০| ২৭ শে জুন, ২০২৪ রাত ১১:০৭
বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: পুরো স্মৃতিচারণটি হৃদয়স্পর্শী হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক কথোপকথন এর কারণে। +++
বহুদিন পর....,
প্রামাণিক ভাই চা খাওয়াবেন না?
২৮ শে জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৩
প্রামানিক বলেছেন: আমি তো আপনাদের চা খাওয়ানোর জন্য সব সময় রেডি কিন্তু আপনাদের খুঁজেই পাই না। ধন্যবাদ আপনাকে
১১| ২৭ শে জুন, ২০২৪ রাত ১১:৩৯
মনিরা সুলতানা বলেছেন: আহা সময় মানুষ কে কেমন বদলে দেয়।
২৮ শে জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৪
প্রামানিক বলেছেন: ঠিক বলেছেন, সেই সময়ের ভয়াবহ দিনগুলির কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে উঠে।
©somewhere in net ltd.
১| ২৬ শে জুন, ২০২৪ দুপুর ২:০৭
সত্যপথিক শাইয়্যান বলেছেন:
সময়ে কত কিছু বদলায়, গুরুজী!!!
এখনকার মানুষ অনেক আধুনিক আর সেইফ!
আমরা অনেক ভাগ্যবান।