নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আপনের রাফখাতা

পিছন ফিরে তাকানোর বদলে সামনে তাকানোই বেশি সহজ

ট্রিপল এ

নিজেকে জানার একটা মাধ্যম হচ্ছে লিখে যাওয়া।লেখালেখি করার অভ্যাস নেই বললেই চলে,মাঝে মাঝে "আউল ফাউল"লেখার চেষ্টা করি একটু.....

ট্রিপল এ › বিস্তারিত পোস্টঃ

দ্যা লাস্ট ল্যাপ

১৯ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৮:৩৩

“মামুজান,তোমারে বলছিলাম না আমি পরী দেখামু?”

বাইকের ইঞ্জিনের নিচে ছিলাম,আমি একটু অবাক হয়েই উপরে তাকালাম ফয়সাল মামার দিকে।অবশ্য মামাকে ভালো করে দেখতে পারছি না,চোখে খচখচ করছে কেন জানি।দুই হাতেই ইঞ্জিন অয়েল,সুতরাং এখন সেটার জন্য কিছু করাও সম্ভব না।পরী নিয়ে অবাক হচ্ছি না,মামার কাছে যেকোনো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান মেয়েকেই পরী লাগে।সমস্যা হচ্ছে এই মামুজান ডাকটা।ফয়সাল মামা আমার আম্মুর খালাত ভাই,সেই হিসেবে আমি মামা ডাকি,কিন্তু বিনিময়ে এই উদ্ভট প্রতিউত্তরটা আমি বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরে ডগলাসের মতো শহরে আশা করি না......

পরীর ব্যাপারটা ক্লিয়ার করার আগে আমি কেন বাইকের ইঞ্জিনের নিচে,সেটা মনে হয় ব্যাখ্যা করা দরকার। আমি আপাতত আছি Isle Of Man নামের একটা দেশে যেটা কিনা ইংল্যান্ড,স্কটল্যান্ড,আয়ারল্যান্ড আর ওয়েলসের চিপা খেয়ে একটা দ্বীপরাষ্ট্র হিসেবে আইরিশ সাগরে টিকে আছে।অনার্সটা শেষ করতে পারি নাই ঠিকমতো,আম্মা আমাকে লাত্থি মেরে এইখানে পাঠিয়ে দিয়েছে পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য।আমার আম্মার বদ্ধমূল ধারনা,মাস্টার্স যদি বাইরের ভার্সিটি থেকে করা যায়,তাহলে আমার জ্ঞান উপচাইয়া পড়বে এবং চাকরি পাওয়া অনেক সহজ হবে।বাইরে যেতে আমার কোন আপত্তি ছিল না,কারন দেশে থেকে যাওয়ার মতো কোন সুতা ছিল না আম্মু ছাড়া।অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা ছিল,কোনরকমে হাতে পায়ে ধরে ডগলাসে (Isle of Man এর ক্যাপিটাল) শিফট হওয়ার জন্য আম্মাকে রাজি করিয়েছি।অস্ট্রেলিয়াতে আমার কেউ নাই,কিন্তু ম্যানে আমার অন্তত পরিচিত কেউ তো আছে! আর ফয়সাল মামা সেই লেভেলের বাইক পাগলা,শুধুমাত্র এই কারনেই বিশাল তর্কাতর্কি করে এইখানে আসতে পেরেছি…………

এখন বাইকের নিচে থাকার কারনটা বুঝাই।ডগলাসে ফয়সাল মামার একটা মাঝারি সাইজের বাইকশপ আছে,সেখানে মামা বাইক কাস্টমাইজেশন,মডিফিকেশন,এসেমব্লিং করে থাকে।পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলে রাখি,ছোট এই দেশটা ১৯০৭ থেকে বিখ্যাত হয়ে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক স্পোর্টস সেগমেন্টটা তাদের দেশে আয়োজন করার জন্য।মোটরবাইক রেস,পৃথিবীর সবচেয়ে ফাস্ট স্পোর্টস বাইকগুলো দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে এক্সাইটিং রোডে টাইম ট্রায়াল নামের এই রেইসের জন্য Isle of Man দেশটা বিখ্যাত।ছোট এই দেশটার মানুষদের সারাদিনে অন্তত গড়ে দেড়শ থেকে দুইশ ভিনদেশী স্পোর্টস বাইকার এবং তাদের সুপার স্পোর্টস বাইক দেখার সুযোগ হয়।বাৎসরিক একটা গ্র্যান্ড ইভেন্ট আর প্রতি দুই মাস পর পর সিজনাল রেইস-এইটাই এই দেশের ইনকামের অন্যতম প্রধান উপায়।আমার বাইক পাগলা মামা তাই গত বারো বছর ধরে এই দেশে পড়ে আছে।এর মধ্যেই একটা বেশ ভালো বাইক শপ খুলে ফেলেছে মামা,নিজেও চমৎকার একটা এক হাজার সিসির স্পোর্টস বাইক চালায়।আমার বাইকের প্রতি নেশার কথাটা মামা জানতো,তাই ভার্সিটিতে এডমিশন নেয়ার এক সপ্তাহ পরেই মামা নিজের বাইকশপে আমাকে টেকনিশিয়ানের জবটা দিয়ে দিয়েছিলো।প্রায় পাঁচ মাস হয়ে গেছে এসেছি ডগলাসে,এর মধ্যেই লোন করে একটা সুপারস্পোর্টস বাইক কিনে ফেলেছি।পড়াশোনা,বিকালের পর থেকে বাইকশপে টাইম দেয়া,উইকেন্ডে বাইক নিয়ে গ্রুপের সাথে জেট প্লেনের গতিতে পুরো দেশটা চক্কর দেয়া-লাইফ বলতে গেলে সেট হয়েই গেছে।খালি রাতে ঘুমানোর সময় কষ্ট লাগে অনেক।আম্মু ফোন দেয়,আম্মার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে যায় অনেক।পাঁচ মাস বাসার বাইরের রান্না খেয়ে আছি,কতোদিন বেগুন দিয়ে চিংড়ি মাছ খাইনা!

এখন মামার পরীর ব্যাপারটা পরিষ্কার করা দরকার।গত আট নয় বছরে মামার বাইকশপের বেশ কিছু রেগুলার কাস্টমার তৈরি হয়েছে।এই রেইসে প্রত্যেকটা সুপারস্টার রেসারের স্পন্সর করা বাইক কোম্পানি,মডিফায়ার,এসেম্বলার আছে।মামার বাইক শপও ইয়ান হাচিনসন নামের এক সুপারস্টার রেসারের বাইক মডিফাই করার স্পন্সরশিপ নিয়ে রেখেছে।সেই জন্য অনেকেই তার প্রিয় রেসারের প্রেফার করা বাইকশপে নিজের বাইক মডিফাই এবং টিউন করাতে আসে,এদের অনেকের সাথে মামার বেশ ভালো সম্পর্কও হয়ে গেছে।দুই সপ্তাহ পরে রেইস ইভেন্ট শুরু হবে,সেই জন্য আজকে জুনিয়র ইভেন্টের এক রেসারের বাইক এসেছে আমাদের শপে,ইঞ্জিনটা পুরোটা নতুন করে বানিয়ে দিতে হবে।উইকেন্ডে এইরকম কাজ আসলে ঘুরতে যাওয়ার সময় হয় না আমার,কাজের মধ্যে ডুব দিতে হয়।দুপুরের দিকে লাঞ্চ করে এসেও সেটাই করছিলাম।ইঞ্জিনের কাজে ডুবে যাওয়ার কারনে বাইরে একটা বাইক থামার আওয়াজও আমার কানে তখন আসে নাই।কেউ এসেছে,আমি তখন বুঝতে পারলাম যখন আমার হাতের রেঞ্জের উপরে একজনের ছায়া পড়লো।আমি পিছনে ঘুরে দেখি মেয়েটার চেহারা ঠিক মতো দেখা যাচ্ছে না রোদের কারনে,কপালের সামনে একটু হাত নিতেই হটাত কেন জানি একটা হার্টবিট মিস হয়ে গেলো চেহারাটা দেখে।কাজীদা সম্ভবত এইরকম কাউকে ভেবেই মাসুদ রানার আই লাভ ইউ ম্যানের রাফেলা বার্ড চরিত্রটা বানিয়েছিল।ছয়-সাত সেকেন্ড আমি কথা বলতে পারছিলাম না কোনভাবেই।রিক,তুই তো পুরাই শেষ!!!!!!!!!!!!!



ব্যাপার হচ্ছে আমার চমৎকার একটা মুখোশ আছে,ইগনোরেন্স।অবজ্ঞা জিনিশটাকে আমি প্রচণ্ড চমৎকার করে ব্যবহার করতে পারি একদম ভাবলেশহীন চেহারায়।কিন্তু মুখোশটা পড়তে আমার একটু দেরি হয়ে গেছে সম্ভবত,কারন মেয়েটার আবছা রোদ পড়া চেহারায় আমি একটু বিরক্তি দেখতে পারলাম সম্ভবত।ঘোর কাটলো তার কথায়,"ইজ ফিজল হেয়ার?”

আমি আরেকবার টাশকি খেলাম।বাংলাদেশের ফয়সাল কিভাবে আইরিশ এক্সেন্টে ফিজল হতে পারে,সেটা বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে।আমি কোনমতে টাশকিটাকে গলার ভিতরে রেখেই বললাম,"হি’স কাইন্ডা বিজি রাইট নাউ।এন্ড ইউ আর?” প্রশ্নটা শেষ করতে পারলাম না,সম্ভাব্য উত্তরদাতার চেহারায় একটা বিরক্তি আবার দেখতে পারলাম।অন্যমনস্ক,ক্লান্ত একটা বিরক্তি।অপাংক্তেয় মানুষের কথা শোনার বিরক্তি।সেটা না লুকিয়েই সে বললো,"ফারাহ।জাস্ট টেল হিম দ্যা নেইম।হি নোজ হোয়াট আই ওয়ান্ট”.........

সূক্ষ্ম এই অপমানটা ঠিক কি কারনে পেলাম,সেটা বুঝতে পারছি না দেখেই রিপ্লাই করতে পারছি না,এর মধ্যেই আমার “ফিজল” মামা এসে হাজির।কথা শুনে বুঝতে পারলাম ফারাহ এইখানে রেগুলার কাস্টমার,সে তার দুইটা বাইক কাস্টমাইজ করাতে এসেছে সামনের রেইসের জন্য।আমি একটু সাইডে দাড়িয়ে পিস্টন ভাল্ভগুলো চেক করছিলাম আড়চোখে ফারাহকে দেখতে দেখতে।একটা মানুষের চোখ এতোটা সুন্দর হয় কিভাবে!কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে আমার প্রচণ্ড জ্বলছে অপমানটার কারনে।সূক্ষ্ম একটা অপমান,শুধু দুই কি তিনটা সেকেন্ড হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার জন্য অপমান।মানতে চাচ্ছি না,কিন্তু উপায়ও নাই।এরই মধ্যে আমি আর মামা মিলে ওদের দুইটা বাইক হ্যাঙ্গারে ঢুকালাম,রিসিট দিলাম।কালকে তারা আসবে নিজস্ব কিছু সাজেশন দেয়ার জন্য.........

দুপুর থেকেই কাজে মনোযোগ বসছে না,ইঞ্জিনের থ্রাস্ট টু টর্ক রেটটা নিয়ে একটু ভেজালেই আছি।মামার প্রশ্নটা শুনে সম্ভবত বিরক্তই হয়েছি।তাই মুখের উপরে জবাব দিলাম,"পরী কই মামা?এইটা তো শ্বেতি রোগী দেখাইলা।এইরকম সাদা মাইয়া তোমার কেন ভালো লাগে বুঝি না।রুমে কি লাইটের অভাব?”

মামা একটু থতমত খেয়ে রেগে গেলো মনে হয়।বলা শুরু করলো,“আরে মামুজান তোমার পছন্দের কোন মাইয়াটা কালা ছিল?এত্তো সুন্দর একটা মাইয়া,আমাদের লোকাল টিমের হইয়া পার্টিসিপেট করবো,ভাবলাম তোমার লগে একটু খাতির করাইয়া দেই।আর তুমি আছো মামুজান মাইয়ার চেহারা নিয়া”

আমি এইবার বোল্ড হয়ে গেলাম।মেয়েটাকে দেখে আমার বিরক্তির কারনটা ব্যক্তিগত,কিন্তু মামাদের লোকাল টিমের রেসার যদি হয় এই মেয়ে হয়,তাকে সব রকম সাহায্য করা আমার নৈতিক দায়িত্ব।এর মধ্যে প্র্যাকটিস সেশনে এই রেসারদের ট্র্যাকের ব্যাপারে ব্রিফ করাও আমার কাজের একটা অংশ।আমি আর মামার সাথে কথা বাড়াতে চাইলাম না,সরি টরি বলে কোনরকমে বের হলাম শপ থেকে।মাথাটা খুব পরিচিত একটা কারনে জ্যাম হয়ে আছে,সি সাইড রোডে গিয়ে বিকালে একটু রাইড দিয়ে আসলে যদি মেজাজটা ভালো হয়!গত পাঁচ মাসে আমি খুব কষ্ট করে ফেসবুক,ইন্সটাগ্রাম সহ সমস্ত সোশ্যাল নেটওয়ার্ক থেকে দূরে ছিলাম,ফারাহ তার চোখ দেখিয়ে নেশাটা আবার চাঙ্গা করে তুলছে।ভার্সিটি লাইফের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার বছর একটা জলোচ্ছ্বাস আটকে রেখেছিলাম,আজকে এই মেয়েটা আমার উন্নাসিকতার বাঁধ ভাঙতে এসেছে।তার চোখ অদিতির সাথে মিলে যায়...........

ভার্সিটিতে তখন নতুন মাত্র ভর্তি হলাম,কলেজের সমস্ত ফ্রেন্ড সার্কেল বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ একা আলাদা কোথাও ভর্তি হয়েছিলাম।ইন্টারের রেজাল্ট আহামরি হয় নাই,ভালো কোথাও চান্সও পাই নাই।ল পড়ার ইচ্ছা আমার তেমন একটা ছিল না,কিন্তু আম্মুর জোরাজুরিতে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম।এডমিশনের প্রথম কয়েকদিন তেমন কারো সাথেই কথা হয় নাই,বিরক্তির সাথে ক্লাসে যাই আর আসি।তখনও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে আসলে কারা সিনিয়র আর কারা সেইম ব্যাচ।সুতরাং অদিতিকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম,সেদিনই মনে মনে একটা দোয়াই করেছিলাম,কোনমতে যেন অদিতি আমার সেকশনেই থাকে,তাকে যেন কোন একটা মুহূর্তও আমার চোখের আড়াল না হতে হয়।দুর্ভাগ্য আমার,কারন দেখা গেলো সে আমার প্রায় দুই সেমিস্টার সিনিয়র..................

নির্লিপ্ততার চমৎকার একটা আবেদন আছে,যদিও নেগেটিভিটির দিক দিয়ে সেটা সবসময় এক নাম্বারেই ছিল।আমার ডিপার্টমেন্টের ক্যাম্পাসটা খুবই ছোট,সেখানে সবাই সবাইকে চিনতে এক মাসের বেশি সময় লাগে না।এই একটা মাস অবশ্য আমি কাউকেই আমাকে চিনতে দেই নাই,নির্লিপ্ততার শুকনো হাসি দিয়েই সবাইকে অভ্যর্থনা জানিয়েছি।আই ডোন্ট ফাকিং কেয়ারের মুখোশটা আমি এক মুহূর্তের জন্যও মুখ থেকে সরাই নি,সেটাকে আমি প্রত্যেক মুহূর্তের জন্য বর্ম বানিয়ে রেখেছিলাম।সবার অবশ্য এই ব্যাপারটার সাথে মানিয়ে নিতে একটু সময় লেগেছিল।শুরুতে সবাই মনে করতো আমি ভাবের ঠ্যালায় আসমানে আছি,কিন্তু একসময় সবাই বুঝে গেলো আমি আসলে এইরকমই।কয়েকজন ছিল আমার এই খোলসটাকে বেশ ভালোভাবেই মেনে নিয়েছিলো,তারা হয়তো আমার আশেপাশে বসতো,মাঝে মাঝে এক্সামে হয়তো একটু হেল্প টেল্পও করতাম।আমার নির্লিপ্ততাকে সবাই স্বাভাবিক মনে মেনে নিলেও অদিতি কখনোই মানে নাই।তার কেন জানি আলাদা একটা ভাইব ছিল,পুরো ক্যাম্পাসে সে সবচেয়ে অসাম মানুষদের একজন ছিল।আমি অনেক ছেলেকে দেখেছি অদিতি পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার পর প্রায় ফুসফুস খালি করা নিঃশ্বাস ছাড়তে,কারন এই নিঃশ্বাস ছাড়া পর্যন্তই সবার দৌড়।তাকে দুই তিনবার দেখেই ধরে ফেলেছিলাম আমার উন্নত একটা সংস্করণ হচ্ছে অদিতি।প্রত্যেকটা মানুষকে কাছে টেনেও কাউকেই কাছে না আসতে দেয়ার চমৎকার একটা আর্ট তার আয়ত্তে ছিল এবং সেটার ব্যাবহার প্রত্যেকটা মুহূর্তে করা মেইবি তার প্যাশনের মতো কিছু একটা!

দিন যায়,মাস যায়।আমার নির্লিপ্ততা আরও থিতিয়ে যায়।ভার্সিটিতে মন টিকিয়ে রাখার মতো আগ্রহজনক তেমন কিছুই পাচ্ছিলাম না।আম্মু অনেক বলছিল অবশ্য একটু সোশ্যাল হতে কিন্তু হয়ে উঠা হয় নি আর।অবশ্য কিছুই ছিল না বললে ভুল হবে,একটা আগ্রহের বিষয় অবশ্য ছিল আমার,সেটা হচ্ছে অদিতির উপর আগ্রহ না দেখানো।হ্যাঁ সে অসাধারণ,সে অনেক শার্প কিন্তু তার মানে এই না যে সবাই তার উপর হাম্লে পড়ছে এবং দৃশ্যটা খুব সুন্দর।জ্বলতো কিছুটা হলেও কিন্তু সেটা নিয়েও মাথা ঘামানোর দরকার মনে হতো না।ব্যাপারটা আলসেমি নাকি অন্য কিছু-সেটা নিয়ে আমার খুব একটা পরিষ্কার ধারনা ছিল না।মাথায় শুধু একটা বিষয়ই ঘুরতো,অদিতির থেকে দূরে থাকতে হবে আমার না হলে তার প্রেমে পড়ে যাবোই।কোনভাবেই এমন কিছু চাচ্ছিলাম না আমি।ভার্সিটি,বাসা,গিটার-লাইফে ব্যস্ত থাকার মতো অনেক কিছুই ছিল আমার।তাই ভার্সিটির ক্লাসমেটদের টাইম না দেয়ার চমৎকার কিছু অজুহাত আমার কাছে তৈরি ছিল।অবশ্য সেই পর্যায়ে কেউ আমার কাছে অজুহাত শোনার মতো অবস্থায় ছিল না,সবাই জানতো আমি আলাদা।সমস্যাটা অবশ্য শুরু হতে বেশি সময় লাগেনি।ফোর্থ সেমিস্টারের দিকে ক্লাস শেষ করে বাইরে দাড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম দুপুরে,এর মধ্যেই চোখে পড়লো অদিতি নামছে।এই চারটা সেমিস্টার কোনদিনই তার সামনে গিয়ে আমি কোন কথা বলি নাই,তার দিকে ফিরেও তাকাই নাই।আমি জানি অদিতি সেটা ধরতে পেরেছে কিন্তু কারনটা বের করার মতো আগ্রহ সে দেখাবে না,কারন তার মাথাতেও ঠিক আমার মতো মানসিকতা সেট করা এই নির্দিষ্ট ব্যাপারগুলোতে।কিন্তু সে অবাক হতে বাধ্য,সম্ভবত এইটা আমার জন্য একটা বড় প্লাসপয়েন্ট!সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে সে এইদিক ঐদিক তাকাচ্ছিল,হটাত তার চোখ পড়লো আমার উপর.........

অদিতির দিকে আমি সবসময় বিরক্ত,ক্লান্ত চোখে তাকাই,সম্ভবত সে এতোদিনেও সেটা কখনো খেয়াল করে নাই।আজকে সরাসরি যখন আমার চোখে সে বিরক্তি দেখতে পারলো,সে মনে হয় একটু থতমত খেয়ে গেলো।সে ধরে নিয়েছিল আমার মুখেও টিপিক্যাল ছ্যাবলামির ছাপ থাকবে,কিন্তু সে এইরকম কোন কিছু আশা করে নাই।চোখ আমিও সরাচ্ছি না,অদিতিও না।যতোটা সম্ভব নিঃস্পৃহতা আনা যায়,এরমধ্যেই চোখে এনে ফেলেছি।কোনভাবেই চাচ্ছি না অদিতি ব্যাপারটা ধরে ফেলুক।কিন্তু অদিতি গাধা না।আমি জানি সে বুঝে ফেলেছে,তার জায়গায় আমি থাকলে আমিও বুঝতাম আমার এই দৃষ্টির সত্যিকারের অর্থ।চোখটা আমিই আগে সরিয়ে নিলাম,এই মুহূর্তে হেরে যাওয়াটাও বেঁচে থাকার জন্য দরকার আছে............

আবারও দিন যায়,মাস যায়।সব কিছু আবারও আগের মতো শুধু একটা ব্যাপার ছাড়া।অদিতি সেই দিনের পর থেকে প্রত্যেকটা দিন একবারের জন্য,এক মুহূর্তের জন্য হলেও আমার দিকে তাকাতো।আমি তাকে নিরাশ করতাম না,প্রত্যেকটা বার তাকে সেই পুরনো নিরাসক্ত,ক্লান্ত,বিরক্তিমাখা একটা আগ্রহ লুকানো চেহারা দেখাতাম।কেন জানি মনে হতো মাঝে মাঝে তার চেহারায় সামান্য একটু হাসিও দেখা যেতো!হটাত করেই আমি ভার্সিটিতে আগ্রহ খুঁজে পেলাম কেন জানি।সবার সাথে কিভাবে জানি একটু হলেও সহজ হয়ে গেলাম।পরিবর্তনটা খুব সূক্ষ্ম ছিল কিন্তু অনেকেই পছন্দ করেছিলো ব্যাপারটা।এরপর অবশ্য অদিতির সাথে বেশ আনকমন কিছু জায়গায় দেখা হওয়া শুরু করলো।একই সাবজেক্টে ইনকমপ্লিট,লাইব্রেরির একই সেকশন-ব্যাপারগুলো চমৎকার ছিল।কিন্তু এর মধ্যেও একবারও আমরা কেউ কোন কথা বলি নাই,কেউ কারো কণ্ঠও শুনি নাই.........

আমার এক ইয়ার সিনিয়র ছিল অদিতি।তাই আমি যখন অনার্স ফাইনাল দিয়ে ভার্সিটির ক্লাস পার্টিতে গেলাম শেষের দিনে,সেদিন অদিতিদেরও মাস্টার্সের শেষ ক্লাস ছিল।সারাদিন হৈহুল্লোড় আর কেক থেকে খুব সাবধানে নিজেকে বাঁচিয়ে ভার্সিটির ছাদে দাড়িয়ে ছিলাম,ক্লাসের ভেতর ওভেনের মতো গরম হয়ে গিয়েছিলো।সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে পিছনে তাকাতেই দেখি অদিতি ছাদে আসছে।আমার দিকে সেই পুরনো দৃষ্টি দিয়ে একটু দূরে রেলিং ধরে দাড়িয়ে ছিল সে।হটাত করেই সে ডাক দিলো,হেই রিক.........

কণ্ঠটা শুনে মনে হলো কাঁচের টেবিলে কেউ একমুঠো মার্বেল ছড়িয়ে দিয়েছে।হার্টবিট একটা মিস করেছে কিনা টের পাচ্ছিলাম না,খুব সাবধানে বরফ হয়ে যাওয়া চেহারায় সেই পুরনো নিরাসক্ততা এবং একটু অবাক অবাক ভাব এনে ফিরে তাকালাম...

-কি অবস্থা,রিক?

-আপনি আমার নাম জানেন!

-জানি.........

নীরবতাটা একটু লম্বা ছিল,পাশে ফিরে তাকাতেই দেখি অদিতি আমার দিকে তাকিয়ে আছে।সম্ভবত এই চার বছরে এই প্রথমবার তাকে এতো কাছে থেকে দেখছি।তার চোখগুলো এতো ম্যাজিক্যাল কেন!সম্ভবত সে কিছু বলবে,আমার চোখটা দেখার অপেক্ষায় ছিল সে।খুব ধীর কণ্ঠে সে জিগ্যেস করলো,”তুমি কি আসলেই আমাকে পছন্দ করো?”

আমার প্রচণ্ড ইচ্ছা করছিলো হ্যাঁ বলে দিতে,সব খুলে বলতে।চারটা বছর ধরে অপেক্ষার পর আমি আজকে বলার সুযোগ পেয়েছি।কিন্তু শেষ আরেকটা বার ইগো দেখাতে ইচ্ছা করছে আমার।কণ্ঠে একটু ক্লান্তি মাখানো বিরক্তি এনে বললাম,”আমাকে দেখে কি আপনার সেটা কখনো মনে হয়েছে?”

অদিতি খুব ধীরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,”দেখো রিক,তুমি যে আমাকে চারটা বছর ধরে দেখতে,আমার কেন জানি কখনোই তাতে বিরক্তি আসে নাই।তোমার তাকানোর মধ্যে একটা মায়া ছিল,খুব আরামের ব্যাপারটা,জানো?আমার প্রচণ্ড দেখতে ইচ্ছা করতো যে তুমি কিছু বলো বা অপেক্ষা করো,কারন আলাদা হয়ে থাকাটা সবসময় কেন জানি মানায় না।মাঝে মাঝে সাধারন কোন ব্যাপারও চমৎকার লাগে।এই যে তুমি এখনো যেভাবে তাকিয়ে আছো না,সেটা দেখলে আমার ভয় লাগে।হেরে যাওয়ার ভয়,ভালোবেসে ফেলার ভয়।ইগো,এই একটা বিষয়ই তোমার আর আমার মধ্যে খুব সুন্দরমতো মিলে যায়।ঠিক এই জিনিশটাই আমাদের চমৎকারভাবে আলাদা রেখেছে।আমার ভাবতে খুব ভালো লাগে যে অন্তত কেউ আছে আমার জন্য যে ঠিক আমার মতোই হারতে চায় না।কিন্তু তোমার ব্যাপারে সেটা আমি কখনোই নিশ্চিত হতে পারি নাই।তোমার কাছে আমার প্রথম এবং হলেও হতে পারে শেষ অনুরোধ,একবার কি মুখোশটা সরাবে?প্লিজ?”

আমি তখন সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে ছিলাম,যদিও আমি জানতাম আমার কি করতে হবে।চার বছর আগে আমার প্যাট্রন,আমার কবি চমৎকারতম একটা কবিতা লিখে গিয়েছিলো,ক্লান্ত কণ্ঠে সেটা আবৃতি শুরু করলাম অদিতির জন্য..

আমার ক্ষুধা পায় না,আমার পিপাসাও পায় না
কামবোধ আমার শরীরে ভীষণ জ্বালাও ধরায় না
নিশিতে ডাকে না আমায়,আমায় প্রকৃতি টানে না।
আমাকে শুধু তুমিতে পায়;
তুমি ছাড়া আর কিছুই,আমার আমিকে জাগায় না...............

সেখানে কতক্ষন এরপর চুপ করে একে অন্যের দিকে চেয়ে ছিলাম,হিসাব রাখি নাই।অনেকক্ষণ পর অদিতি বলে উঠলো,”আমি নেক্সট উইকে প্রাগ চলে যাচ্ছি।ভেবেছিলাম দেশ থেকে আমি কিছুই নিয়ে যেতে পারবো না,তবে এখন আমি একটা কবিতা নিয়ে যাবো।ভালো থেকো রিক।হয়তো কোন একসময় দেখা হবে,হয়তো হবে না।কিন্তু কবিতাটা কখনোই সময়টাকে মুছে দিবে না।তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,তুমি যা দিয়েছ,এর চেয়ে বেশি আমি কিছুই তোমার কাছে চাইতে পারবো না।ভালো থেকো”..................


বাইকের শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো আমার।অবেলার ঘুম,ঘুমের মধ্যে সেই পুরান ইতিহাস দেখা কোনকালেই পছন্দ ছিল না আমার।ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে দেখি মামা বসে আছে।আমাকে দেখে বললো,”তোকে ডাকার প্ল্যান ছিল পাঁচ মিনিট পরেই।এখন শুনতে থাক।কালকে ট্র্যাক ডে তে ফারাহ সহ আরও দুইটা রাইডারকে পুরো ট্র্যাকের ব্রিফিং দিবি।এরা সবাই সিনিয়র সুপারস্পোর্ট সেগমেন্টের রাইডার,সুতরাং এদের ট্র্যাক এবং বাইক হচ্ছে সবচেয়ে ডেলিকেট।যেহেতু তুই নিজেও কালকে নামবি প্র্যাকটিসে,সেহেতু একটু লিড দিবি তুই কারন তুই লোকাল ট্র্যাক বুঝোস।আর ফারাহর দিকে একটু খেয়াল রাখবি।তার বাইকটা সবচেয়ে ভারী এবং পাওয়ারফুল,সুতরাং এঙ্গেলগুলাতে তারে টিপস দিবি কিন্তু।কালকে বহুত বড় একটা দিন,বেস্ট অফ লাক মামুজান”

পরেরদিন সকালে ফারাহ এবং তার টিমমেট যখন গ্যারাজে আসলো,ততোক্ষণে তাদের বাইক রেডি হয়ে গেছে।আমিও গিয়ার পড়ে আমার বাইকের উপর বসে আছি।তারা বাইক নিয়ে বের হওয়ার পর ছোটখাট একটা ভাষণ দিলাম রোডের ব্যাপার,রাতে হালকা বৃষ্টি হওয়ায় রোড এখনো কিছু জায়গায় ভেজা,সেটা নিয়েও সাবধান করলাম।এরপর সব শেষে সবার বাইকে একবার সূক্ষ্মভাবে চোখ বুলালাম।বেশিরভাগই সিবিআর ওয়ান থাউজেন্ড আর,কিছু ডুগাটি পিনেগালে এবং একটা বিএমডাব্লিউ এস ওয়ান থাউজেন্ড আরআরও আছে।ফারাহর বাইকটা দেখে আসলেই একটু চিন্তায় পরে গেলাম,মেয়েটা একটা এপ্রিলিয়া আরএসভি ফোরের উপর বসে আছে।Isle of Man এর রেইসে যদি কোন বাইককে আমি সত্যিকার অর্থে ভয় পাই,তাহলে সেটা এপ্রিলিয়া।এই বাইকটা প্রচণ্ড লম্বা,ভারী এবং এইটার মধ্যে এপ্রিলিয়া গ্রুপ একটা ভি ফোর ইঞ্জিন ভরে দিয়েছে!সুপারস্পোর্টস বাইক সেগমেন্টের সব বাইকের টপ স্পিড কাছাকাছিই,কিন্তু টর্ক মাত্রাতিরিক্ত হওয়ার কারনে এই বাইকটা পারলে একটা ট্রাক টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবে,এমন পাওয়ার হোল্ড করে।ইন্টারনাল গিয়ার রেশিও অনেক শর্ট,তাই স্পিডও উঠে ঝড়ের বেগে।মোট কথায় এই জিনিশটা একটা ফ্রিকিং রকেট।রাইডারের ওজন বেশি হলে এই বাইকটা বেশ সুইটেবল,কিন্তু ফারাহর গিয়ার সহ ওজন কোন মতেই ৬০-৬২ কেজির বেশি হবে না।এই বাইক পছন্দ করার একটা কারনই থাকতে পারে ফারাহর,সেটা হচ্ছে স্পিডের একটা জুয়া খেলা।হয়তো জেতা সম্ভব,কিন্তু ভুল হলেই মরতে হবে...............

মুখটা পাথরের মতো করে নিজের বাইকটার দিকে তাকালাম।ইয়ামাহা আর ওয়ানএমের ২০১৫ এডিশন।বেশিদিন হয় নাই এই বাইকটা হাতে পেয়েছি।দেশে যখন থাকতাম,ইয়ামাহা ছাড়া অন্য কোন বাইক কেন জানি ভালো লাগতো না,জাপানি এই ব্র্যান্ডটার মধ্যে কেন জানি একটা জানোয়ারের গন্ধ পেতাম।সুতরাং ১৬ হাজার ইওরো ম্যানেজ হয়ে যাওয়ার পর অনেক অপশন থাকার পরেও ইয়ামাহার আরওয়ানএমই কিনেছি বেঁছে।এরপর টানা দুই মাস আমার আর ফয়সাল মামার হাতে এইটা টিউনড হয়েছে,কাস্টমাইজড হয়েছে।এইবারের ইভেন্টে এই বাইকটার সমস্ত কিছু নিংড়ে বের করবো ট্র্যাকে আমি,আমার এই বাইকটাও আমাকে হতাশ করবে না,আমি টের পাচ্ছি।কে কি চালাচ্ছে,হটাত করেই সেটা ভুলে গেলাম,কারন আমি জানি আমি কিছু একটা করে দেখাবো............

ট্র্যাকে ধীরে ধীরে একটা ল্যাপ দিয়ে এইবারের ট্র্যাকের কোনখানে কোন বাঁকে কতোটা স্পিড ধরে রাখতে হবে,সেটা নিয়ে একটা লম্বা আলোচনা হচ্ছিলো।এরপর যখন অফিশিয়ালি প্র্যাকটিস ল্যাপের এনাউন্সমেন্ট হলো,সিরিয়ালে সবাই রেডি হলাম।ফারাহ ফার্স্টে,আমি সেকেন্ডে,বাকি পাঁচ জন রাইডার সিরিয়ালে।হুইসেলের সাউন্ড শোনা মাত্রই ফুল থ্রটলে সামনে এগিয়ে গেলাম,স্পিড চোখের পলকে দেড়শ মাইলের উপরে উঠে গেলো।আমার ১৫ সেকেন্ড আগে ফারাহ স্টার্ট করেছে,তাকে ধরা ছাড়া এই মুহূর্তে কোন কিছু ভাবতে চাচ্ছি না।মাথাটা বরফের মতো ঠাণ্ডা,চিন্তায় শুধু সামনের রোড,ব্রেক আর স্পিড।আর কিছুই না।রাস্তার দুই পাশ গতির কারনে কিছুটা আবছা হয়ে গেছে,বাতাসের ঝড়ো শব্দে এর মধ্যেই কান ভো ভো করছে।তিন মিনিটের মাথায় অনেক সামনে ফারাহকে দেখা গেলো।তার ওজন কম হওয়ার পুরো সুযোগ সে নিচ্ছে,তার এপ্রিলিয়া যেন বাতাসে উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে।তাকে এখনই ধরা যাবে না,আমার পিছনের রাইডারও অনেক পিছনে।ধুম মুভির জন আব্রাহাম হওয়ার এই সুযোগটা ছাড়তে চাইলাম না,ফুল থ্রটলে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলাম।আরওয়ানএমের সবচেয়ে চমৎকার অপশন হচ্ছে এইটার রেসিং পজিশন,সেটার পূর্ণ সুবিধা ব্যাবহার করতে থাকলাম কর্নারগুলোতে।প্রত্যেকটা কর্নারে আমাদের মধ্যের দূরত্ব কমছিল।শেষ ২৫ মাইলে একেবারে প্রায় পাশাপাশি এসে গেলাম আমি ফারাহর............

ট্র্যাকের লাস্টের অংশটুকু বলতে গেলে প্রায় সোজা,এবং সাগরের তীরে মালভুমির উপর দিয়ে করা চমৎকার একটা রাস্তা।এই অংশটা সবচেয়ে বেশি বিপদজনক কারন এইখানে কোন স্পিড লিমিট মানতে হয় না,এইখানে ব্রেক ধরার দরকার পড়ে না।নিজের বাইক থেকে সবটুকু নিংড়ে এইখানে সবচেয়ে বেশি গতি তুলতে হয় সবচেয়ে কম সময়ে ল্যাপ শেষ করার জন্য।ফারার বাইকের দিকে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছি না,আমার থেকে এক হাত এগিয়ে আছে সে বেশি হলে।দুইজনই চেষ্টা করছি একজন আরেকজনকে ক্রস করার।এক মাইল সামনে একটা হালকা ব্রেকারের মতো উঁচু নিচু আছে,সেটা হচ্ছে আমাদের ফ্লাই জোন।সেখানে বাইক কনট্রোল রাখার কথা মাথায় রেখেই ফুল স্পিড ধরে রেখেছি।কিন্তু যেই ফ্লাই জোনে জাম্প করে আমাদের বাইকের চাকা রাস্তায় টাচ করলো,ফারাহর বাইক দুলতে শুরু করলো,ভয়াবহ দুলুনি.........

আমার হাতে এক সেকেন্ডেরও কম সময় ছিল তাকে বাঁচানোর জন্য।আমি জানতাম না কি করতে হবে,কোন রকমে ডান দিকে হেলে যাওয়া অবস্থায় ফারার বাইকে প্রচণ্ড জোরে একটা লাত্থি মারলাম নিজের বাইকটা সামান্য বামে কাত করে,যেন আমিও না পড়ে যাই।দুই দিকের ধাক্কার কারনে দেড় থেকে দুই সেকেন্ডের জন্য একটা ব্যালান্স আসলো,সেই সময়ের মধ্যে ফারাহ তার বাইক কনট্রোলে এনে স্পিড কমিয়ে ফেললো,আমি হুশ করে অনেকটা সামনে চলে আসলাম।আমার দেখা উচিত ছিল যে পিছনে তার কি অবস্থা,কিন্তু এই মুহূর্তে আমার রেইসটা শেষ করা জরুরি।বুকটা এখনো কাঁপছে,কোন মতে ভালো একটা টাইমিং নিয়ে ল্যাপ কমপ্লিট করলাম.........

রেইস শেষে প্রেস কনফারেন্স,ফটোশুট,নেক্সট রেইসের এনাউন্সমেন্ট সহ সব কিছু শুনে বাইকটা নিয়ে শপে আসলাম।সারাটা দিন আজকে প্রচণ্ড চাপে গেছে,হিরোগিরি দেখাতে গিয়ে কোনরকমে জানে বেঁচে ফিরেছি।রিভলবিং চেয়ারে কোমরটা কোনরকমে ঝুলিয়ে গান শুনছিলাম,হটাত দেখি ফারাহ আসছে,চেয়ারটা টেনে বসে আমার দিকে তাকালো।কান থেকে হেডফোন খুলে ফেললাম,ব্যাপারটা অভদ্রতা হবে নাহলে।সে ধীরে ধীরে বললো,থ্যাংকস।তুমি না থাকলে আজকে মারা যেতাম......
-ইট’স ওকে।আমি কিক করেছি নিজেকেও সেভ করতে।নাহলে তোমার বাইক আমার উপরে এসে পড়তো......
-আসলে ঐ জাম্পটা ঠিকমতো বুঝতে পারি নাই আমি
-না পারাটাই স্বাভাবিক।তবে তোমার বাইকটা আরেকটু কম ভারী হলে সমস্যাটা হইত না।এপ্রিলিয়া তো বিশাল ঝামেলা।এইটা চালাও কেন?আর ঐ যায়গাটা সাবধানে থাকবা,গতবছরও ঐখানে এক রাইডার মরেছে........

কথাটা বলে একটু খেয়াল করতেই দেখলাম সে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।ব্যাপারটা ঠিক আমার কাছে ক্লিয়ার ঠেকল না।কারন জিগ্যেস করতে যাবো,এই মুহূর্তে হটাত করে সে বলে উঠলো,বিয়ার?প্রত্যেক রেইসের পরই লম্বা ন্যাপ নেয়া জরুরি......

কথাটা বলার সময় তার চেহারায় একটা ক্লান্তির হাসি ছিল,ব্যাপারটা আমার প্রচণ্ড পরিচিত।আমার কাজটা এতো নিখুঁতভাবে সে করছে কিভাবে!অবশ্য এইখানে ফারাহ আমার টিমমেট,তার সাথে একটা ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং জরুরি রেইসে টিকে থাকার জন্য,তাই না করলাম না।দুইজনই বাইক বের করে পাবের দিকে মুভ করলাম............

বিয়ারে চুমুক দেয়ার মধ্যেই ছোটখাটো তথ্য আদানপ্রদান চলছিলো।গতকালকের ফারাহ আর আজকের ফারাহ ঠিক একরকম না,অনেক আলাদা।সুইডিশ এই মেয়েটা ঠিক কি কারনে জানি খুব পরিচিত মনে হচ্ছিলো আমার কাছে।কে কোথায় আছে,কি করছে,রেইসের ব্যাপারে প্ল্যান কি-এইসব টুকিটাকি কথা হচ্ছিলো।হটাত ফারাহ বললো সি সাইডে একটা রাইড দিয়ে আসার জন্য।রাজি হয়ে গেলাম কারন গতকাল যাওয়া হয় নাই।এইবার খুব অল্প গতিতেই সাগরের ধারে যাচ্ছিলাম,ক্রুজ করার মেন্টালিটি নিয়ে।আজকের প্রায় এক্সিডেন্টের যায়গাটার একটু সামনে বসে থাকার চমৎকার একটা স্পট আছে,অনেক রাইডারই বিকালে এইখানে থামে।আমরাও থেমে সমুদ্র দেখছিলাম।হটাত করেই ফারাহ আমার দিকে ঘুরে আস্ক করলো,আচ্ছা রিক,তুমি রেইস করো কেন?

আমি ঠিক শিওর ছিলাম না যে আমি কি উত্তর দিবো?আসলেই তো!এই হাই স্পিড চেসিং,প্রত্যেকটা মুহূর্তে মরে যাওয়ার ভয় নিয়ে এড্রেলিন রাশের নেশায় কেন আছি আমি?আম্মু এখনো ঠিকমতো জানে না ব্যাপারটা,যদি স্পোর্টস চ্যানেলগুলোতে চোখ লাগিয়ে রাখতো,এতোদিনে আমাকে অবশ্যই দেশে ব্যাক করতে হইত।আমি উত্তরটা ঠিক কেন জানি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।আমি বললাম,”উত্তরটা গুছাতে আমার একটু সময় লাগবে।কিন্তু তুমি কেন রেইস করো জানতে পারি?তোমার প্রশ্নটা তোমাকেই ফেরত দিলাম,যাও”.........

ফারাহ বেশ লম্বা একটা বিরতি নিয়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে বললো,”জানো রিক,নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোও করে ফেলা যায়।কিন্তু এই কাজগুলোর জন্য সেইরকম একজন প্রিয় মানুষ লাগে।এই যে তোমাদের এই বিশাল রেইসট্র্যাকটা আমার এতো ভালো লাগে কেন জানো?কারন আমার সেই সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা এই রেইসট্র্যাকের কারনেই বেঁচে ছিল।বাইক ছিল তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিশ,আমি যেন তার অভাব অনুভব না করতে পারি,সেই জন্য আমাকে সে বাইকিং আর রেসিং শিখিয়েছিল,যেন সে প্রত্যেকটা মুহূর্তে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় দুইটা জিনিশ একসাথে রাখতে পারে।কিন্তু বেঁছে নেয়ার ব্যাপারটা খুব কঠিন,জানো?কেন জানি দুইটা কখনোই বেঁছে নেয়া যায় না।ডিয়েগো যখন গতবছর ক্র্যাশ করেছিলো ঐ জাম্পে,আমার মনে হয়েছিলো কেউ যেন আমার সব কিছু কেড়ে নিয়েছে।আমি গডের কাছে খালি প্রে করছিলাম সে যেন বেঁচে থাকে।কিন্তু বললাম না,বেঁছে নেয়ার ব্যাপারটা?সব কিছু একবারে কখনোই সম্ভব না,তাই গড আমার প্রেয়ার শুনে নাই তখন।রেসিং আমার কখনোই খুব একটা প্রিয় ছিল না,কিন্তু আমি বাইকের উপর বসেছিলাম ডিয়েগোর জন্য।জানো আজকে কেন আমি পড়ে যেতে নিয়েছিলাম?ডিয়েগো সেখানে দাড়িয়ে ছিল আমার জন্য,আমি তাকে দেখে সামলাতে পারি নাই নিজেকে।কিন্তু তাই বলে ছেড়ে দিচ্ছি না।আমি যতক্ষণ বাইকের উপর থাকি,আমার মনে হয় সে আশেপাশেই আছে।এই অনুভূতির জন্য কয় কোটিবার মরে যাওয়া যায়,বুঝতে পারো রিক?”.........

আমি সেই মুহূর্তে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না।তার প্রশ্নের উত্তরটা সম্ভবত আমার জানা আছে।আমিও প্রত্যেকটা মুহূর্তে মৃত্যুভয় নিয়ে বেঁচে থাকি কারন অদিতিকে ভুলে থাকাটা আমার দরকার,তাকে মনে রাখলে আমার পাগল হওয়া ছাড়া কোন গতি নাই।তার চোখ,তার ভালো থাকতে বলা-প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমার মাথায় ঘুরছে।বেঁচে থাকার জন্য,অদিতিকে ভুলে থাকার জন্যই দেড়শ মাইলের উপরে গতি তুলতে হয় আমার,কারন তখন বেঁচে থাকতে হলে অদিতির চোখটা ভুলতেই হবে,তার কণ্ঠটা একটু সময়ের জন্য হলেও মাথা থেকে দূরে সরাতে হবে।ফারাহকে যখন ব্যাপারটা ভেঙ্গে বললাম,তখন সে সামান্য একটু হাসি দিয়ে বললো,”দেখলে,তুমি নিজেও ঐ মেয়েটার জন্যই বাইকের উপর আছো কারন বেঁচে থাকার জন্য মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখাটা জরুরি,আর এই অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর ফিরে আসা সহজ না,তুমি নিজেও সেটা জানো।“............

কথাগুলো শেষ করার পর সম্ভবত তার মুখে সামান্য একটু হাসি ছিল,কেন জানি সেটা প্রচণ্ড পরিচিত ছিল আমার জন্য।অদিতির সাথে অনেক কিছু মিলে যায় ফারাহর,স্পেশালি তার চোখ দুইটা।আমি জানতাম অদিতির সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হবে না,তবুও সেদিন আমি আসলে ঠিক ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারি নাই।চমৎকার কিছু একটা এইভাবে শুরু হওয়ার সাথে সাথে কেন নষ্ট হয়ে যাবে!প্রচণ্ড একটা অভিমান ছিল,যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে অভিমানটা আসলে কিসের উপর।অনেকদিন পর ফারাহর দিকে তাকিয়ে ঠিক শেষ বারের অদিতির মতো কিছু একটা পাচ্ছিলাম আমি।বলতে ইচ্ছা করছিলো অনেক কিছু কিন্তু জানি,ব্যাপারটা ঠিক হবে না।ফারার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললাম,”দেখো,তোমার কথাটা ঠিক।অভ্যাসটা টিকিয়ে রাখাই সম্ভবত বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য।মনে রাখতে হয়,কষ্টটা গ্রহন করতে হয়।একটা সময় যন্ত্রণাটা সহ্য করতে করতে মনে হয় ভালোবাসার মানুষের অস্তিত্বটাই যদি না থাকতো!তাহলে হয়তো এইরকম কষ্ট পেতে হইত না।আমি সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করি,সেই সময়টা পর্যন্ত টিকে থাকতেই এই রেইসটা করি।ডিয়েগোর সবচেয়ে প্রিয় অভ্যাসটাকে নিজের করে হাজারবার সেটার পুনরাবৃত্তি করা হয়তো ভালোবাসা,কিন্তু সেটার জন্য তোমার বেঁচে থাকতে হবে।আমি কথা দেয়ার মতো কেউ না,কিন্তু আমি তোমার জায়গায় থাকলে অবশ্যই এখন ডিয়েগোকে কথা দিতাম যে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার জন্য বেঁচে থাকবো,ইচ্ছা করে কখনোই মরতে চাইবো না”............

কথাগুলো আমার কাছেই বেশ ক্যাচি লাগছিলো কিন্তু তখন কেন জানি এইটাই আসছিল মুখ দিয়ে।ফারাহ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল,আমি চোখে চোখ মেলাতে সাহস পাই নাই।তাকিয়ে থাকার এই ঘটনাটা অনেক পরিচিত।আগামীকালের অজুহাত দিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম দুইজনেই।আগামীকাল আমাদের মেইন রেইস............

সেদিন সন্ধ্যা থেকে আমরা ইয়ান হাচিনসনের বাইক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম,এর মধ্যে মামা আর তার দুইজন ক্রু দেড় দুই ঘণ্টা ফারাহর বাইকের পিছনে দিয়েছে।আর আমরা বাকি সবাই আমাদের এইবারের স্টার বাইকারের বাইক নিয়ে ব্যস্ত।আমার বাইকটা অবশ্য আগেই রেডি করা আছে,নতুন একসেট টায়ার লাগানো ছাড়া আর কোন কাজ নেই।নেক্সট দিন সকালে রেস শুরু হওয়ার সময় প্রত্যেকটা রেসারের বাইক চেক করা হচ্ছে,এর মধ্যে মামা আমাকে এসে একটু পর পর দেখে যাচ্ছে।এইটা আমার সেকেন্ড বারের মতো টিটি রেইস,সো একটু টেনশনেই আছি আমি।জেতার আশা করছি না,তবে সেরা তিনে থাকতে পারলে অসাম হইত আমাদের বাইকশপের জন্য।কম্পিটিটর লিস্টে দেখি ফারাহ আমার একজনের আগে।একটু খুজতেই দেখি সে তার বাইক চেক করাচ্ছে।একটু ইঞ্জিন রেভিং করিয়ে তার পাশে থামলাম গিয়ে।সে আমার দিকে ঘুরে বললো,”নার্ভাস?” আমি সত্যিই নার্ভাস ছিলাম,তাই হ্যাঁ বলে লেল্লাম।,”আমি তোমাকে নিয়েই নার্ভাস।তোমার তো আবার বাইক নিয়ে উড়ার খুব শখ।“এর মধ্যে সেও ইঞ্জিন রেভিং করছে,দুইজনই যেন কার বাইকের সাউন্ড বেশি,সেটা শো করতে নেমে পড়েছি!কিন্তু কিছু একটা খটকা লাগছে,শব্দটা আমার পরিচিত না।তার আরপিএম খুব দ্রুত রেডলাইন ছুয়ে ফেলছে,আওয়াজটাও কেমন জানি একটু দ্রুত।এপ্রিলিয়া নামের জানোয়ারটা আমি চিনি,এইটা তো ঠিক এইরকম না।তো সমস্যাটা কি?

এর মধ্যেই আমাদের লাইন রেডি করতে বলা হচ্ছে,ফারাহ তাই আমার আগের রাইডারের সামনে চলে গেলো।রেইস শুরু হচ্ছে,আমি প্রচণ্ড টেনশনে আছি।এই বাইকটা নিয়ে এই প্রথমবার অফিশিয়ালি কোন রেইস দিচ্ছি,তাও বিশ্বের বাঘা বাঘা রেসারদের সাথে।গলা শুকিয়ে যাচ্ছে কেন জানি,মামা লাস্টবারের মতো এসে পিঠ চাপড়ে দিলো,এর মধ্যেই ফারাহ রেইস স্টার্ট করে দিয়েছে,আমিও লাইনে দাড়িয়ে আছি,চল্লিশ সেকেন্ড পরেই আমি স্টার্ট করবো।হুইসেলব্লোয়ার আমার ডানে দাড়িয়ে আছে,স্পিকারে আমার নাম এনাউন্স করা হয়েছে,আমি হটাত করেই একটু নর্মাল হওয়ার চেষ্টা করলাম।আমি একটা ওয়াইল্ড কার্ড,যা দেখাবো,সেটাই আমার লাভ।সো সেরাটাই দিবো।যেই মাত্র হুইসেলব্লোয়ার আমার পিঠে থেক হাত সরাল,ব্রেকটা ছেড়ে দিলাম আমি।লেট’স গো,রিক...............

ইয়ামাহাকে আমি শুধু শুধুই দানব মনে করি না,বাইকটা আসলেই দানব।শুরুর দশ সেকেন্ডেই স্পিড উঠে গেলো একশো চল্লিশ মাইলের উপরে,আধা মিনিটের মধ্যে প্রথম বাঁকটাতেই আমাকে একটু স্লো করতে হচ্ছিলো,কিন্তু এর পর ফিফথ গিয়ারে চলে যাওয়ার পরেও আমার সামনের চাকা ট্র্যাক ছুঁতে চাচ্ছিল না,গতি এতো দ্রুত উঠে যাচ্ছিলো!আমার মাথায় কিছুই কাজ করছিলো না তখন গতি ছাড়া,এমনকি রাস্তাটাও দুই পাশে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।আমি খালি বুঝতে পারছিলাম যে কোন মতে আমাকে এই গতিটা ধরে রাখতে হবে।কোনরকমে তিনটা মিনিট পার করতেই সামনের রাইডারটাকে দেখতে পারলাম,বেকুবটা একটা কাওয়াসাকি জেডএক্স টেন চালাচ্ছে।একে খেয়ে ফেলা আমার জন্য কোন ব্যাপার না,রিক তুমি জানো তুমি অসাম।থ্রটল পুরোটা খুলে রেখে কর্নারগুলোতে স্পিড যতোটা কম কমানো যায়,সেটাই ট্রাই করছিলাম।দেড় মিনিটের মধ্যে সামনের কাওয়াসাকিটাকে ক্রস করে ফেললাম।আমার টার্গেট হচ্ছে ফারাহ,কারন তাকে ধরতে পারা মানেই আমার ল্যাপ টাইমে বিশাল একটা স্কোর এসে পড়া।কিন্তু তাকে আমি দেখতেই পাচ্ছিলাম না।একশো আশি মাইলের উপর ছুটতে থাকার পরেও সামনে ফারাহকে না দেখাটা কোনমতেই আমার হিসাবে আসছিল না।হটাত সামনের প্রায় ইউ শেপের কর্নারটা ঘুরতেই দেখলাম ফারাহর বাইক।সে কর্নারে অতিরিক্ত স্লো হয়ে গিয়েছিলো।পিছনে রাইডার সম্ভবত সে টের পেয়েছে,সে থ্রটল পুরোটা খুলে দিলো।আমি অবাক হয়ে গেলাম প্রচণ্ড ফাস্ট ওয়েতে তার বাইক স্পিড তুলছে।কিন্তু তার এপ্রিলিয়া কোনভাবেই আমার ইয়ামাহার চেয়ে ফাস্ট হতে পারে না,এইটা সম্ভবই না!তাকে ওভারটেক করতে পারছিলাম না,সে আমার চার পাঁচ মিটার সামনে হবে সে।আমি সিক্সথ গিয়ারে চলে যাওয়ার পরও তার সাথে গ্যাপ কেন জানি কমছে না।হটাত করেই আমি বুঝতে পারলাম,সে তার ইঞ্জিনের এয়ার ফ্লো বাড়িয়েছে,তার বাইকের টপ স্পিড আমার বাইকের চেয়ে সম্ভবত একটু বেশি হয়তো হতেও পারে।ভয় ঢুকে গেলো মনে,তাকে হারাতে পারবো আমি?


ছয় সাত মিনিট পার হয়ে গেছে,তের মিনিটের এই রেইস শেষ হতে আর বেশি সময় নাই।সি সাইডের ওপেন রোড এসে গেছে প্রায়,এর মধ্যেই ফারাহ আমার ২০-২৫ মিটার সামনে এগিয়ে গেছে,কোনভাবেই আমি তাকে ধরতে পারছি না।বেশি সময় নেই,ফারাহকে ওভারটেক করা যেতো যদি কোনভাবে!ইঞ্জিনের শব্দে,বাতাসের ধাক্কায় কান ঝিমঝিম করছে,কোনমতে সামনে একটু মাথা উঁচু করতেই দেখি হটাত ফারাহ ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তিন চার সেকেন্ডের মতো তাকিয়ে থাকলো,হেলমেটের কারনে তার চোখ দেখা সম্ভব হচ্ছে না।এতো রিস্ক নিয়ে সে পিছনে ঘুরেছে কেন!তবে কি আজকেও!!!!!!!!!!!!!!!!

সাডেনলি আমি বুঝতে পারলাম আজকেও ঠিক একই জায়গায় তার বাইক ব্যালান্স হারাবে।সে মরতে এসেছে,বেঁচে থাকার কোন ইচ্ছাই আসলে ফারাহর নাই।শেষ বারের মতো এই জন্যই সে আমাকে দেখেছে।চিৎকার করে তাকে ডাকতে চাইলাম কিন্তু একশো নব্বই মাইল গতিতে একটা রেসিং বাইক থেকে শব্দ সামনের বাইকারের কানে যাবে না।তাকে আজকেও সেইভ করতে হবে আমার,আজকেও তার স্পিড কমাতে হবে।আমি থ্রটলটা পুরোটা খুলে দিলাম,রেডলাইন পুরোটা ক্রস করে ফেলেছে ইন্ডিকেটর,ইঞ্জিনের সাউন্ডটা আরও তীক্ষ্ণ হয়ে গেছে।স্পিডটা আরেকটু বাড়াতে হবে আমার,জাম্পটা আর আধা মিনিটের মধ্যে এসে যাবে,তাকে আমি চিৎকার করে ডাকছি,কিন্তু সে শুনছে না,সেও স্পিড কমাচ্ছে না।দুইশ আটানব্বই কিলোমিটার স্পিড দেখাচ্ছে,কিন্তু দূরত্বটা কমছে না।আরেকটু স্পিড দরকার আমার।একটু দূরত্ব হয়তো কমেছে,আমার ইয়ামাহাটা হয়তো তার এপ্রিলিয়াকে একটু হলেও হারিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।আর ১৫ সেকেন্ডও নাই,আর একটু স্পিড দরকার আমার।চিৎকারের পরিমানটা বাড়ছে,স্পিডটা আর একটু বাড়াতে হবে,আর মাত্র পনেরো মিটারের মতো দূরে সে।আর একটু স্পিড,আরেকটু..............




অজুহাতসমগ্রঃআমি জানি এইটা প্রচণ্ড আনফিনিশড এবং ফাউল একটা জিনিশ,কিন্তু বাইকের উপ্রে ভালোবাসা হয় না।হইলেও আমি পারি না দেখাইতে।কোন একটা লেখায় আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় চরিত্রের নাম দিতে,আর সেই কারনে আমি সবসময় প্যাসিভ ফর্মে লেখা সাজিয়েছি।শুধু নাম দিতে হবে দেখে আমি কোনদিন গল্পই লেখার সাহস ই করি নাই।এই লেখাটায় যখন নাম দেয়ার সময় আসলো,আমি খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম।রক্ষা পেয়েছি রিয়েল ডেমোন নামের চমৎকার একজন লেখকের বদৌলতে।রিক চরিত্রটা উনার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি,আমার প্রচণ্ড প্রিয় একটা ক্যারেক্টার।ফারাহ নামটা সহজ,প্রিন্স অফ পার্সিয়ার প্রিন্সেসের নামে বসিয়ে দিয়েছি।আর অদিতি?সেটাও কোন একটা গল্প থেকে নেয়া,নাম মনে আসছে না।চরিত্রটা অনেক রহস্যে ঘেরা ছিল,তাই এইখানেও এপ্লাই করে দিয়েছি.........

জানি অখাদ্য,সাড়ে চার হাজার শব্দের গল্প পড়ার ধৈর্যও অনেকের নেই।সুতরাং পাঠক আশা করি না আমি।লেখাটা দরকার ছিল আমার জন্য,বহুদিন লেখা হয় না কিছু.....................

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৭:৪৭

Rezuan বলেছেন: একটানে পড়েছি।আপনার আর লেখা কই

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.