নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অশান্ত বাশিওলা

raselabe

তাই মনে হয় আমি বড় স্বার্থপর।

raselabe › বিস্তারিত পোস্টঃ

মা : এক অভিমান

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০১

মায়ের কোল—একটি সন্তান তার প্রথম আশ্রয় খুঁজে পায় যেখানে। এই আশ্রয় থেকে সে জীবনের পথ চলা শুরু করে, পৃথিবীর আলো দেখতে শেখে। মা, যার ছায়ায় সন্তান তার শৈশবের প্রতিটি মুহূর্ত পার করে, একসময় সন্তান বড় হয়ে গেলে সেই মায়ের সাথেও তৈরি হয় এক অব্যক্ত দূরত্ব। ভুল বোঝাবুঝি আর অব্যক্ত কষ্টের মেঘ জমতে শুরু করে। এই সম্পর্কের টানাপোড়েন যেন এক মহাকাব্যিক বাস্তবতা, যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে ভালোবাসা, অপার স্নেহ, আবার কখনো তিক্ততা ও বেদনা।

সন্তানের জীবন যখন নতুন সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়ে যায়—বিয়ে, শ্বশুরবাড়ি, নতুন মানুষজন—মায়ের মনে কোথাও যেন এক ধরনের অনিরাপত্তা বোধ জন্ম নেয়। তিনি ভাবতে থাকেন, তার সন্তানের জীবনে তার স্থান হয়তো কমে গেছে। অথচ, সন্তানের মনোজগতে সবসময় একটাই চিন্তা—"মা যেন ভুল না বোঝে। আমি মায়ের স্নেহছায়ায় আজও আছি।"

মায়ের এই ভুল বোঝাবুঝি, অভিমান, নীরব অভিযোগ আর সন্তানের ব্যাকুলতা মিলে একটি অস্থির সম্পর্কের সৃষ্টি করে। প্রতিটি কথা, প্রতিটি ইঙ্গিতে মায়ের মনে অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধে। তিনি ভাবেন, "আমার ছেলে এখন শ্বশুরবাড়ির দিকেই ঝুঁকে পড়েছে। আমাকে আর আগের মতো মূল্য দেয় না।" অথচ, এই অনুভূতির পিছনে রয়েছে মায়ের এক ধরনের আঘাতপ্রাপ্ত গর্ব। তিনি নিজের অজান্তেই নিজের সন্তানকে ভুল বুঝে।

সন্ধ্যা নেমেছে। ঘরের বাতি জ্বলছে, আর ডাইনিং টেবিলে সাজানো রাতের খাবার। মা বসে আছেন চুপচাপ। টেবিলের চারপাশে সন্তানের খালি চেয়ারগুলো তাকিয়ে থাকছে। ছেলের জন্য অপেক্ষা, কিন্তু সে ফিরছে দেরিতে। এক সময়, দরজা খুলে ছেলেটি ঘরে ঢোকে। মা তাকান ছেলের দিকে, কেমন অপরাধীর মতো মনে হয় তাকে। ছেলেটি একটু অস্বস্তি নিয়ে বলে, "মা, আজ অফিসে কাজের চাপ ছিল। তাই দেরি হয়ে গেল।"

কিন্তু মায়ের মন সহজে ভোলার নয়। তিনি কষ্ট নিয়ে বলেন, "তুমি তো সব সময়ই এখন ব্যস্ত। অফিস, শ্বশুরবাড়ি—আমার কথা আর মনে রাখো না।" মা'র কণ্ঠে অভিমান, আর ছেলের মুখে হতাশা। সে মায়ের কষ্ট বুঝতে পারে, কিন্তু বলার ভাষা খুঁজে পায় না। চুপচাপ বসে থাকে, মায়ের দৃষ্টির মধ্যে যে ব্যথা, সেটি ভোলার নয়।

সন্তান চায়, তার মায়ের মনে কোনো অভিযোগ না থাকুক। সে বোঝাতে চায়, "মা, আমি এখনও তোমাকেই বেশি ভালোবাসি। তোমার মঙ্গলেই সব সময় ভাবি।" কিন্তু মায়ের মনের গভীরে জমে থাকা সংশয় আর অভিমান এতটাই প্রখর হয়ে উঠেছে যে, সন্তানের কথা সেখানে পৌঁছানোর আগেই তা আড়াল হয়ে যায়। মা শুধু ভাবে, "তুমি আর আগের মতো নেই, আমার কথা আর মনে হয় না রাখো।"

সন্তান তখন ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে। সে বারবার চেষ্টার পরেও মাকে আশ্বস্ত করতে পারে না। মায়ের প্রতিটি অভিমান, প্রতিটি অভিযোগ তার মনের ভিতরে তীব্র ক্ষত তৈরি করে। সে ভাবে, "কেন মা বুঝতে পারে না, আমি আজও আগের মতোই আছি। আমি তাকে ভুলিনি, কখনোই দূরে সরে যাইনি।"
ভুল বোঝাবুঝির অবসান কীভাবে ঘটতে পারে? একদিন, একটি সন্ধ্যায় ছেলে মায়ের সামনে এসে বসে। মা তখনও অভিমানে মুখ ফিরিয়ে আছেন। ছেলে ধীরে ধীরে মায়ের হাত ধরে। বলে, "মা, অনেক দিন হলো তুমি আমার কথা শুনছ না। আমার মনে হয়, তুমি আমাকে ভুল বোঝো। আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যাইনি। আমি আজও তোমারই ছেলে।"

মা প্রথমে কিছুই বলেন না, তার চোখের জল থমকে থাকে। কিন্তু ছেলের কণ্ঠে যে সত্যতা আর ভালোবাসা আছে, সেটা তার হৃদয় স্পর্শ করে। ছেলে বলতে থাকে, "তোমার জন্য আমি আজও বেঁচে আছি, তোমার জন্যই সব কিছু করছি। কিন্তু কেন যেন তুমি আজ আমাকে অন্য চোখে দেখছ।"

মায়ের চোখ তখন ছলছল করছে। তিনি ধীরে ধীরে বলেন, "আমি তো শুধু ভয় পাই। তুমি এখন নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত, ভাবি তোমার জীবনে আমার স্থান বুঝি নেই আর।"

ছেলে মৃদু হাসে, "মা, নতুন মানুষ এসেছে বলে তোমার জায়গা তো কমে যায়নি। তুমি যেমন ছিলে, তেমনই আছো আমার কাছে।"

এই কথাগুলো শোনার পর মায়ের মনের গভীর সংশয় যেন মুহূর্তেই ভেঙে যায়। তিনি বুঝতে পারেন, তার ছেলে কখনো তাকে দূরে সরিয়ে দেয়নি। মায়ের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তিনি ছেলেকে কাছে টেনে নেন, আর বলেন, "তুমি ঠিক বলেছো, আমি তোমার ভালোবাসা ভুল বুঝেছি।
যাকে বলা হয় জীবনের প্রথম আশ্রয়, যার কোল থেকে শুরু হয় পৃথিবীকে চেনা। কিন্তু এই মায়ের সাথেও জীবনের এক সময় ভুল বোঝাবুঝি জন্ম নেয়, সৃষ্ট হয় এক অন্তর্দ্বন্দ্ব, যা কখনো প্রকাশ্য, আবার কখনো গোপনেই রয়ে যায়। মা-সন্তানের সম্পর্কের এই টানাপোড়েন যেন এক মহাকাব্যিক বাস্তবতা, যার গভীরে আছে অপার ভালোবাসা, আর সেই ভালোবাসার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা বেদনা।

সন্তানের জীবন যখন পরিপূর্ণ হতে শুরু করে, তার চারপাশে নতুন মানুষ, নতুন সম্পর্কের বাঁধন তৈরি হয়। মায়ের মন তখন কোথাও যেন একটু সংকীর্ণ হয়ে আসে। হয়তো মায়ের কাছে মনে হয়, তার সন্তানের জীবনে সে আর আগের মতো গুরুত্ব বহন করছে না। অথচ, সেই সন্তানের মনের গভীরে একটাই চিন্তা—"মা যেন কোনো ভুল না বুঝে, মা যেন মনে না করে আমি তার স্নেহ-ছায়া থেকে সরে যাচ্ছি।" সন্তানের এই ভাবনা, মায়ের কাছে পৌঁছাতে পারে না। মা ভেবে নেয়, ছেলে বোধহয় শ্বশুরবাড়ির দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে, নতুন সংসারের মানুষেরাই তার মনের একমাত্র ভাবনা।

সন্তান তখন মাকে বোঝাতে চায়—"মা, তুমি ভুল বুঝছ। আমি তোমাকেই ভাবি বেশি। তোমার ভালো চাই সবসময়।" কিন্তু মায়ের অন্তরে জমে থাকা সন্দেহের মেঘ এতটাই গাঢ় যে, সন্তানের কথা সেখানে পৌঁছানোর আগেই তা আড়াল হয়ে যায়। মা কেবল অনুভব করেন অভিমান, আর সেই অভিমানেই জন্ম নেয় নীরব অভিযোগ। মায়ের সেই নীরবতা সন্তানের হৃদয় ছিঁড়ে ফেলে, তার প্রতিটি কথাকে ভুল বুঝে নেয়ার যন্ত্রণা দিন দিন তীব্র হয়।

এই ভুল বোঝাবুঝি আর অভিমানের প্রান্তে দাঁড়িয়ে সন্তান তখনও মায়ের প্রতি তার দায়িত্ব পালনে অটল থাকে। প্রতিটি মুহূর্তে সে চায়, মা যেন তাকে ভুল না বোঝে, মা যেন আবার আগের মতোই তার জন্য গর্বিত হয়। কিন্তু এই চেষ্টায় সে যেন নিজেকেই বারবার বিপর্যস্ত করে ফেলে। মা তার দিকে তাকিয়ে বলেন—"তুমি আর আগের মতো নেই," আর সন্তান মনের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে—"মা, তুমি কেন বুঝছ না, আমি তো সেই আগের মতোই আছি।"

মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা যেন এক অব্যক্ত বেদনার ধারাবাহিকতা, যার শেষ নেই, সমাপ্তি নেই। সন্তানের জন্য মায়ের অভিমান যতটা তীব্র, ততটাই গভীর সন্তানের মনের অসহায়ত্ব। এ এক এমন সম্পর্ক যেখানে কেউ অপরাধী নয়, তবুও আঘাত লেগে যায় প্রতিনিয়ত। মা তার স্বাভাবিক অভিমানেই সন্তানের ওপর অভিমান করেন, আর সন্তান সেই অভিমান ভাঙানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। কিন্তু সেই চেষ্টার ফলাফল কি সবসময় সুখের হয়?

সমাধান হয়তো নিহিত আছে মনের গভীরে জমে থাকা কথাগুলো খুলে বলা ও শোনার মাঝে। মা যদি সন্তানের মনের সত্যিটা শুনতে চাইতেন, আর সন্তান যদি মায়ের অভিমানটুকু বুঝে নিতে পারতো, তবে হয়তো ভুল বোঝাবুঝির অন্ধকার ঘনিয়ে আসতো না।

তবু এই সম্পর্কের বৈপরীত্যে নিহিত আছে চিরন্তন স্নেহ ও ভালোবাসার সুর। মা তার সন্তানকে কখনো ভুলে যান না, আর সন্তানও মায়ের প্রতি তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয় না। কিন্তু জীবনের জটিলতার মধ্যে তারা কখন যেন দূরে সরে যায়, আর সেই দূরত্বই ভুল বোঝাবুঝির উৎস।

মায়ের এই অভিমান আর সন্তানের না বলা কথাগুলো হয়তো কোনোদিন প্রকাশ পাবে না, তবুও একদিন মা হয়তো বুঝবে—"আমার ছেলে সবসময় আমারই ছিল, সে কখনোই দূরে যায়নি।" আর সন্তানের মনের অশ্রু হয়তো তখন থেমে যাবে, যখন সে শুনবে মায়ের কণ্ঠে শান্তির সেই সুর—"আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি।"

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.