নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কবিতা লেখি মনের সুখে আর জীবনের কথা বলি। বলি দ্রোহের কথা। ভালোবাসা আমার জীবনের গল্প।

রিয়েল আবদুল্লাহ আল মামুন

রিয়েল আবদুল্লাহ, সম্পাদক, লিটল ম্যাগ রূপান্তর ময়মনসিংহ

রিয়েল আবদুল্লাহ আল মামুন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভালোবাসার কবিতায় কবি আবুল হাসান

২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:০৮

আমার বয়স তখন বার কি তের হবে। ছড়া লিখি অশুদ্ধ কবিতা লিখি। হয় কি না জানি না। তখনি একদিন আমার শ্রদ্দেয় মামা একখানি বই নিয়ে এলেন পড়ার জন্য। চমৎকার প্রচ্ছদ। বইয়ের নাম যে-তুমি হরন করো। আমার জন্য নতুন কবিতা পড়ে মজা পেলাম।লুকিয়ে লুকিয়ে পড়লাম।ভালোলাগার পরিমান বেড়ে গেলো।
'‘তোমাকে ভালোবাসি তাই ভালোবাসার কবিতা লিখিনি/আমার ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো কবিতা সফল হয়নি,/আমার এক ফোঁটা হাহাকার থেকে এক লক্ষ কোটি/ভালোবাসার কবিতার জন্ম হয়েছে।"

আধুনিক বাংলা কবিতায় ভালোবাসার কবিতা লিখে যে কজন কবি বিখ্যাত হয়েছেন কবি আবুল হাসান তাদের মধ্যে অন্যতম।
কবির ভেতর ভালোবাসার গভীরতা অসাধারণ। তিনি তার প্রেমিকাকে বেপরোয়া ভালোবেসে নিজেকে নিঃসঙ্গ করে জ্বলিয়ে দেন। চিতার মধ্যে বসেও কবির স্বচকিত উচ্চারণ-
"ভালোবাসার ঔরসে আমার জন্ম! অহংকার আমার জননী!/তুমি আমার কাছে নতজানু হও,তুমি ছাড়া আমি/আর কোনো ভূগোল জানি না,/আর কোনো ইতিহাস কোথাও পড়িনি!"

প্রেমিকাকে ভালোবেসে কবি পুরোটাই নস্টালজিক। এখন হয়তো তার প্রেমিকা নেই। তবুও চোখের সমূখে ভেসে উঠে তার সেই আদর-সোহাগ-স্নেহ-ভালোবাসা। বুকের খুব কাছে গিয়ে বুকের বুতাম লাগিয়ে দেয়া,চোখে চোখ রেখে ভেতর দেখা,জুতোর ফিতে লাগিয়ে দেয়া ইত্যাদি কবি কিছুতেই ভুলতে পারেননি -এখন প্রেয়সী নেই তার বিরহে উতালা কবি উন্মুখ। তাই তো কবি যুথীকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন-"আমার এখন নিজের কাছে নিজের ছায়া খারাপ লাগে/…রাত্রিবেলা ট্রেনের বাঁশি শুনতে আমার খারাপ লাগে/জামার বোতাম আটকাতে কি লাগে, কষ্ট লাগে /তুমি আমার জামার বোতাম অমন কেনো যত্ন করে লাগিয়ে দিতে?/অমন কেন শরীর থেকে অস্তে আমার ক্লান্তিগুলি উঠিয়ে নিতে?/তোমার বুকের নিশীথ কুসুম আমার মুখে ছড়িয়ে দিতে?/জুতোর ফিতে প্রজাপতির মতোন তুমি উড়িয়ে দিতে? /বেলজিয়ামের আয়নাখানি কেন তুমি ঘরে না রেখে/আমার এখন চাঁদ দেখলে খারাপ লাগে/পাখির জুলুম, মেঘের জুলুম, খারাপ লাগে/কথাবর্তায় দয়ালু আর পোশাকে বেশ ভদ্র মানুষ খারাপ লাগে,/এই যে মানুষ মুখে একটা মনে একটা. . ./খারাপ লাগে খারাপ লাগে"/(যে তুমি হরন কর)
কবি তার মনের কথাগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। একজন প্রেমিক যখন তার প্রেমিকাকে হারায় সে তার সব হারিয়ে ফেলে- তার মনের মধ্যে মন বলে কিছু থাকে না। নাইওর যায় তার প্রেমিকার সাথে আর প্রেমিক কষ্টের আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হোন। কবি তেমনি কষ্ট পেয়েছিলেন যুথির কাছ থেকে। আর লিখেছেন-"আজো আমি ভালোবাসার কবিতা লিখিনি/কোনোদিন ভালোবাসার কবিতা লিখিনি।/হে মেয়ে হে ম্লান মেয়ে তোমাকে ভালোবাসি তাই/ভালোবাসার কবিতা আমি কোনোদিন কখনো লিখবো না!"

কষ্ট মানুষকে মাঝে মাঝে করে তুলে মহান। গ্রাম বাংলায় একটি প্রবাদ আছে-ছেকা খেলে কবি হয়-কলম তখন কথা কয়। কতটুকু সত্যতা আছে কে জানে। তবে ছেকা বা প্রেমিকার কাছ থেকে পাওয়া আঘাত যে একজনকে একটু উদাস করে সে সত্য;আর কবিকে আরোও সুক্ষ্ম কবি করে তোলে এও সত্য। কবি আঘাত পেলে কলমের ক্রন্দনে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তোলেন। এর বাস্তব উদাহরণ কবি আবুল হাসান। তার প্রতিটি কবিতা পাঠকের মধ্যে তোলে প্রবল আলোড়ন।"আমার একা থাকার পাশে তোমার একাকার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও!/হে মেয়ে ম্লান মেয়ে তুমি তোমার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও!" আসলে এ হাহাকার কবির হাহাকার । অন্যকারও নয়। কবির ভেতরের গভীর বেদনার বহিঃপ্রকাশ।
কবি আর ভালোবাসবেন না বরঞ্চ প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন ভালোবেসে। তাই তো তিনি তার প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী কবিতায় বলেন


/"অতো বড় চোখ নিয়ে, অতো বড় খোঁপা নিয়ে/অতো বড় দীর্ঘশ্বাস বুকের নিশ্বাস নিয়ে/যতো তুমি মেলে দাও কোমরের কোমল সারশ/যতো তুমি খুলে দাও ঘরের পাহারা/যতো আনো ও-আঙ্গুলে অবৈধ ইশারা/যতো না জাগাও তুমি ফুলের সুরভী/আঁচলে আগলা করো কোমলতা, অন্ধকার/মাটি থেকে মৌনতার ময়ূর নাচাও কোন/আমি ফিরব না আর, আমি কোনদিন/কারো প্রেমিক হবো না; প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী চাই আজ/আমি সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হবো।"

অন্যদিকে কবি আকাংক্ষা কবিতায় তার প্রেমকে প্রকাশ করেন ভিন্ন ভাবে -এই যেমনঃ তুমি কি আমার আকাশ হবে?/মেঘ হয়ে যাকে সাজাব/আমার মনের মত করে ।/তুমি কি আমার নদী হবে?/যার নিবিড় আলিঙ্গনে ধন্য হয়ে/তরী বেশে ভেসে যাব কোন অজানা গন্তব্যের পথে ।/তুমি কি আমার জোছনা হবে?/যার মায়াজালে বিভোর হয়ে/নিজেকে সঁপে দেব সকল বাস্তবতা ভুলে ।/তুমি কি আমার কবর হবে?/যেখানে শান্তির শীতল বাতাসে/বয়ে যাবে আমার চিরনিদ্রার অফুরন্ত প্রহর ।

আবার যে তুমি হরন করো এ কবি প্রকাশ করেন -
"এত প্রেম কোথায় ধরেছ এই দেহ ঝরনায়– এত স্ফূর্তি/ক্ষতের বেদনাঘন মনীষার নিটোল প্রবাহে/আমি তো আমূল মন ভেসে যাই/কলাগন্ধী তোমার যত মৃন্ময় শব্দযূথ/আমাকে হরণ করে কোন আঁধারপুরীতে যাবে নিয়ে/পতন সামলে নিয়েছি আমি অল্পেই" [যে তুমি হরণ কর (১৯৭৪)]

আবার সেই সুখ কবিতায় কবি তার ভেতরের প্রেমকে খুব কঠিন ভাবে প্রকাশ করেন। সত্যকে সহজাতভাবে ধারন করেন এবং বলেন-
প্রথম যে কার ঠোঁটে চুমু খাই মনে নেই/প্রথম কোনদিন আমি স্নান করি মনে নেই/কবে কাঁচা আম নুন লঙ্কা দিয়ে খেতে খেতে/দাঁত টক হয়েছিল মনে নেই/ /মনে নেই কবে যৌবনের প্রথম মিথুন আমি ঘটিয়েছিলাম//মনে নেই…//যা কিছু আমার মনে নেই তাই হলো সুখ !/আহ ! সে সুখ…"

“রাজা যায় রাজা আসে” গ্রন্থে কবি তার অন্য আরেক প্রেমিকা স্বাতীর প্রতিক্ষায় বসে থেকে লিখে যান কবিতা। প্রেমিকাকে কল্পনা করেন ভিন্ন ভঙিমায় যা সচরাচর অন্যান্য কবি এত সহজলভ্য ভাবে প্রেমিকাকে দেখেন না। কবি আবুল হাসানের প্রেমিকাকে দেখার উপকরণগুলো ভিন্ন এবং অসাধারণ।

‘‘এ মুহূর্তে সিগ্রেটের ছাই থেকে/ শিশিরের মতো নম্র অপেক্ষার কষ্টগুলি ঝেড়ে ফেলেছি কালো এ্যাসট্রেতে!/রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবেনা আজ স্বাতী?/ তোমার কথার মতো নরম সবুজ /কেকগুলি পড়ে আছে একটি পিরিচে /তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ!/তোমার হাসির মতো উড়ছে চাইনিজ পর্দা রেস্তোরাঁয় –’’

আবার কখনও কখনও তিনি ভিন্ন নারির প্রেমে পড়েছেন। মূলতঃ এ তার প্রেমে পড়া নয় নারীর প্রবল সৌন্দর্যের কাছে নতোজানু হওয়া।

“মিসট্রেস : ফ্রি স্কুল স্ট্রীট” কবিতায় কবি লিখেছেন-

“ প্লাস্টিক ক্লিপের মত সহস্র কোকিল যেই বনভূমি গেঁথে নেয়/ সবুজ খোঁপায় ভোরবেলা-ময়ূরের পেখমের মতো খোলা রোদে বসে /ব্লাউসের বোতাম লাগিয়ে মিসট্রেস আসে ইশকুলে আর /কয় ঝাঁক বালকের নির্দোষ নিখিল ভরা ক্লাসরুমে এসেও সে শোনে /বনখোঁপা বাঁধা কোকিলের কূজন তার চুলে, চমৎকার/ চিরোল গ্রীবায়,শেষে গৌর লাজুক শিয়রে শিহরিত শুধু/ পেতে গিয়ে এক হারানো প্রেমের ঘ্রাণ, বয়ে নেয় সে তখন /কী যে এক আর্দ্র পরাজয় তার আত্মব্যস্ত অতীতের অথই সীমায় !/

এ যেনো নারীর আকর্ষিত রূপে মোহময় কবির কবিতা লেখার অসাধারন প্লত খোঁজে পাওয়া। একবিতায় তিনি কেবল নারীর রুপেই মুগ্ধ হননি নারীকে দেখেছেন সন্মানের চোখে। এই যেমন তিনি বলেছেন-নারী, নারীই কেবল যদি বোঝে কোনো নারীর হৃদয়- তবে /তুমি ভুখন্ডের মানে এই ঢাকা শহরের এক সবুজ তনয়া,নারীতুমি কি বোঝোনা তার তিরিশ বছর কাল কুমারী থাকার অভিশাপ?/বোঝো না কি তিরিশ বছর কত কাঁদায় যৌবন কোকিলের পাষণ্ড রোদন !/
কবি আবুল হাসানের কবিতা আমাকে শুধু কাছেই টানে না ভাবতেও শেখায় কি করে সহজাত শব্দাবলি তার কবিতাকে দিয়েছে নান্দনিক রূপ আর সহজাত উপমা উৎপ্রেক্ষা গুলো কবিতাকে করে তুলেছে গাম্বীর্যপূর্ণ।

কবি ভালোবাসার স্বীকৃতি চান তাই তো তিনি ঋদ্ধ কন্ঠে "স্বীকৃতি চাই "কবিতায় বলেন-
"আমার ভালোবাসার স্বীকৃতি চাই /স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে,/মৃত্যুমাখা মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছি একলা মানুষ,/
বেঁচে থাকার স্বীকৃতি চাই,/স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে!"
আবার অন্যদিকে কবি "কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন" কবিতায় প্রেমিকার উপর তাই তো এতো অভিমান অভিযোগ -মান অভিমানের দোলাচল।
"কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন/আমাকে শাসাবি খুব, কষ্ট দিবি , ক্লান্তি দিবি, আর/রাত হলে স্বপ্ন দিবি শুতে দিবি বুকের খোঁপায়/শরীরে সেলাই করবি সেই সাপ, সেই আদি পাপ/হাতের পাতায় তোর বেলফুল, বক্ষময় লতা/কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন"
অসাধারণ শব্দাবলীর বিমূর্ত বাহার কবিসত্ত্বার গহীণে তোলে প্রবল আলোড়ণ
-সে আমাকে কাছে ডেকে,বসন্তের হাওয়ার মতোন/ আঙুরের ঘ্রাণ দিয়েছিল; /আমি যে তা বলিনি কখনো!
আমরাও তাই কবির কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলি-কবি তুমি আমাদের কাছে ডেকে দিয়েছিলে ভালোবাসা-যেটুকু দিয়েছো তা ভুলা যাবে না কোনদিন ।
সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ কবির বইসমূহ

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.