নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।
করোনা মহামারীর কারণে প্রায় দু'বছর পর আজই প্রথম গিয়েছিলাম বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক দেখতে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দেশের ৬৪ জেলায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নাটক নির্মাণ কর্মসূচির উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কেন্দ্রীয় প্রযোজনা ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এই উদ্যোগের গতকালের (৪ ডিসেম্বর ২০২১) প্রযোজনা ছিল নাট্যকার মাসুম রেজা'র রচনা ও নির্দেশনায় 'জনকের অনন্তযাত্রা'।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চায়িত 'জনকের অনন্তযাত্রা' নাটকটি মূলত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যা করার পর উদ্ভুত পরিস্থিতি ও পরদিন ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করার ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর খণ্ড-খণ্ড চিত্রের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে রচিত। নাট্যকার মাসুম রেজা ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত এবং টুঙ্গিপাড়ায় সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষিদের উপর নিবিঢ় গবেষণা করে দেড় ঘণ্টার নাটক 'জনকের অনন্তযাত্রা' রচনা করেছেন।
এই নাটকের প্রধান চরিত্র করা হয়েছে টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারের মসজিদের ইমাম মৌলভী আব্দুল হালিমকে। যিনি একজন সুদক্ষ আলিম, আরবি ব্যাকরণবিদ, শিক্ষক, ইমাম ও স্বভাব কবি। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী সেনাদের অনুরোধে ও খন্দকার মুশতাক আহমদের নির্দেশে ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর ডেডবডি টুঙ্গিপাড়ায় সমাধিস্থ করার দায়িত্ব অর্পিত হয় মেজর হায়দারের উপর। মেজর হায়দার ও ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে সেনাদের যে ছোট্ট একটি দল সেদিন হেলিকপ্টারযোগে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছিল, তাদের সাথে সেদিন সরাসরি এক দুঃসাহসিক বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন এই মৌলভী আব্দুল হালিম।
সেনারা ধারণা করেছিল মৌলভী আব্দুল হালিম হয়তো বঙ্গবন্ধুর দাফনকার্যকে বিলম্বিত করে স্থানীয় মানুষদের উসকে দিয়ে একটা বিদ্রোহ করার ষড়যন্ত্র করছেন। হয়তো গ্রামের মানুষ মৌলভী আব্দুল হালিমের কথায় সেনাদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর লাশ ছিনিয়ে নিতে পারে! মৌলভী আব্দুল হালিম সেনাদের কাছে দাবি করেন যে, একজন মুসলমানকে ইসলামি বিধি-বিধান ও শরিয়া মেনেই দাফন করতে হবে। শেষপর্যন্ত মৌলভী আব্দুল হালিমের এই দৃঢ় অবস্থানের কাছেই সেনারা বঙ্গবন্ধুকে ইসলামি শরিয়া মেনে দাফন করতে বাধ্য হয়। সেনাদের সাথে মৌলভী আবদুল হালিমের এই কনফ্লিক্টকে ঘিরেই রচিত হয়েছে 'জনকের অনন্তযাত্রা' নাটকটি।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর মৌলভী আব্দুল হালিমই প্রথম ব্যক্তি যিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আরবি ভাষায় কবিতা রচনা করেন। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় মৌলভী আব্দুল হালিম প্রথম ব্যক্তি যিনি মুশতাক গংদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্যে বিরোধিতা করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। ইতিহাসের সত্যাশ্রয়ী ঘটনার প্রেক্ষাপটে এই নাটকের প্রধান চরিত্র হিসেবে মৌলভী আব্দুল হালিম তাই স্বাভাবিকভাবেই ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। নাট্যকার মাসুম রেজা অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথেই নাটকে এই চরিত্রটি ডিল করেছেন।
নাটকে মূলত তিনটি স্থানকে প্রাধান্য দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। বঙ্গভবনে নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমদের কৌশলী আচরণ, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সেনাদের মধ্যে তৎপরতা এবং টুঙ্গিপাড়ায় মৌলভী আব্দুল হালিমের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ দাফন পর্ব। নাটকে এই তিনটি পর্বই অত্যন্ত সুবিবেচনাপ্রসুত নির্বাচন করা হয়েছে।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে ইতিহাসের নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে দেশি ও বিদেশি যোগসূত্র ছিল, তাকে উপজীব্য না করে নাট্যকার মাসুম রেজা কেবল ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর অন্তিমযাত্রাকে প্রেক্ষিত করে 'জনকের অনন্তযাত্রা' নাটকে আমাদের যা দেখান, এককথায় এই ঘটনার যেমন ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি সেনাদের যে অংশটি সরাসরি এই বর্বরতম হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয় অথচ সেনা কমান্ড ও নতুন রাষ্ট্রপতির নির্দেশ মানতে বাধ্য, সেরকম একটি সেনা ট্রুপসের ওই সময়ের হতাশা, ভয়, স্থানীয় বিদ্রোহের আশংকা ও বাস্তবতাকে তুলে এনেছেন। এরকম সুন্দর একটি ঐতিহাসিক প্লট নির্বাচনের জন্য নাট্যকার মাসুম রেজাকে আমি ধন্যবাদ জানাই।
নাটকে গল্পের শুরুটা হয় টুঙ্গিপাড়ায় মৌলভী আবদুল হালিমের অজানা আতংক থেকে বুক চিনচিন ব্যথা থেকে। তার স্ত্রী তখন তাকে মসজিদে না গিয়ে বাড়িতেই এষার নামাজ পড়তে অনুরোধ করেন। ওদিকে বঙ্গভবনে নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমদকে মেজর ফারুক-রশিদ-ডালিম গংরা জাতির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ বেতারে তাদের লিখিত বক্তব্য পাঠে বাধ্য করান। মুশতাককে তারা আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবেই জাহির করেন এবং রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেশে ইসলামি শাসনতন্ত্র কায়েম করাতে বাধ্য করেন। মুশতাক নিজেও অতি উৎসাহী হয়ে 'বাংলাদেশ বেতার'কে 'রেডিও বাংলাদেশ' এবং 'জয় বাংলা' স্লোগানকে 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' করেন।
'বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ২৫ বছরের শান্তি চুক্তি' ও বঙ্গভবনে তখন ভারতীয় হাইকমিশনের অনুপস্থিতিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়। পাশাপাশি ইসলামি দেশগুলোর কাছ থেকে মুশতাক সরকারের স্বীকৃতি আদায়ের পন্থা হিসেবে নানান কৌশলকে বেছে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী সেনারা বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে ঢাকায় দাফন করার ব্যবস্থা করলেও ব্যক্তিগতভাবে খন্দকার মুশতাক তার বিরোধিতা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর কবরকে ঘিরে ভবিষ্যতে যাতে মাজার হতে না পারে, সেজন্য বঙ্গবন্ধুর মরদেহ টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করার নির্দেশ দেন।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিহত বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বনানী গোরস্তানে দাফন করা হলেও শেষ মুহূর্তে তাই মুশতাকের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করার ব্যবস্থা করে সেনারা। সেখানে কৌশল হিসেবে খুনের সাতে সরাসরি জড়িত নয় এমন সেনাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে দায়িত্ব দেওয়া হয় নিহত বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দাফন যজ্ঞের। একপর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বঙ্গবন্ধুর মরদেহ হেলিকপ্টারযোগে টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে দাফনের এসাইনমেন্ট দেন মেজর কাজী হায়দার আলীকে। মেজর হায়দারের সহযোগী হিসেবে সেই দায়িত্ব পালন করেন ১৮ জনের একটি সেনা দল, যারা সরাসরি বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত ছিলেন না। মেজর হায়দারের সহকারীর দায়িত্ব অর্পিত হয় ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিনের উপর।
ধানমন্ডি ৩২ ও ঢাকা মেডিকেল থেকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের নিহত সদস্যদের বনানী গোরস্তানে দাফন করা হয়। আর বঙ্গবন্ধুর মরদেহ সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে। সেখানে ক্যাপ্টেন হুদা, মেজর হায়দারের কাছে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ হস্তান্তর করেন। বিমানবন্দর থেকেই মেজর হায়দারের নেতৃত্বে হেলিকপ্টারযোগে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ টুঙ্গিপাড়ায় নেওয়া হয়। সেখানে সেনাদের নির্দেশে গোপালগঞ্জ পুলিশের তৎকালীন এসডিপিও নুরুল আলমের তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধুর দাফনের কাজ সম্পন্ন হয়। এসডিপিও নুরুল আলমকে সহায়তা করেন টুঙ্গিপাড়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল জলিল শেখ।
নাটকের এই পর্যায়ে টুঙ্গিপাড়ায় আমরা আরেক সাহসী যুবককে দেখতে পাই, যিনি গোপালগঞ্জের এসডিপিও নুরুল আলমের দেহরক্ষী কাজী সিরাজুল ইসলাম সিরাজ। সেনারা বঙ্গবন্ধুকে গোসল-কাফন ছাড়াই সরাসরি দাফনের উদ্যোগ নিলে সিপাহী সিরাজ অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে মেজর হায়দারকে গোসল দেবার বিষয়টি বলেন এবং ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিনের নির্যাতনের শিকার হন। মৌলভী আব্দুল হালিম, এসডিপিও নুরুল আলম ও সিপাহী সিরাজের দাবির কারণে মেজর হায়দার তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যোগাযোগ করতে বাধ্য হন। মৌলভী আব্দুল হালিম দাবি করেন- যদি বঙ্গবন্ধুর মরদেহ সরাসরি দাফন করতে চান, তাহলে তাকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। নইলে ইসলামি শরিয়া মেনে মরদেহ গোসল, কাফন ও দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। পরবর্তীতে মেজর হায়দার বঙ্গভবনের নির্দেশ অনুযায়ী মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে মৌলভী আব্দুল হালিমকে মরদেহ গোসল, কাফন ও দাফনের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন।
এই পর্য়ায়ে সিপাহী সিরাজের উপর দায়িত্ব পড়ে বাজার থেকে সাবান আনার, সে বাজারে গিয়ে গায়েমাখা সুগন্ধি সাবান না পেয়ে কাপড়কাঁচা ৫৭০ সাবান নিয়ে আসেন। টুঙ্গিপাড়া পোস্ট অফিসের মাস্টার আনোয়ার হোসেনের উপর দায়িত্ব পড়ে কাফনের কাপড় সংগ্রহের। সে টুঙ্গিপাড়া সায়েরা খাতুন রেডক্রস হাসপাতালের নার্স দিপালী রানীর কাছে থেকে সংগ্রহ করেন সাদা রিলিফের শাড়ি, যা থেকে পাড় আলাদা করে সেই কাপড় দিয়ে বঙ্গবন্ধু'র কাফন দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে গোসল করান মৌলভী আব্দুল হালিম। তারপর তিনি সেনাদের বাধ্য করেন বঙ্গবন্ধুকে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে গার্ড অব অনার প্রদান করার জন্য। গোসলের সময় বঙ্গবন্ধুর কফিনে পাওয়া দ্রব্যাদি চশমা, পাইপ, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি ইত্যাদি মৌলভী আব্দুল হালিম তুলে দেন বঙ্গবন্ধুর জ্ঞাতিচাচা শেখ মোশররফ হোসেনকে। নাটকের এই পর্বে এক হৃদয় বিদারক ঘটনা দেখা যায়। যা দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। নার্স দিপালী রানী, টুঙ্গিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার আব্দুল হাই, ও মৌলভী আব্দুল হালিমের স্ত্রী বঙ্গবন্ধুর দাফন কাজে স্বল্পসংখ্যক গ্রামবাসীসহ সহযোগিতা করেন। বঙ্গবন্ধুকে সেনাসদস্য ও পুলিশের যৌথ গার্ড অব অনার প্রদানের মাধ্যমে 'জনকের অনন্তযাত্রা' নাটকটি শেষ হয়।
আমার কিছু পর্যবেক্ষণ:
বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ দাফনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে। আর সেটা ঘটেছিল সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর আগ্রহে। পরে খালেদ মোশাররফ এই কাজের জন্য আলাদাভাবে মেজর হায়দারকে এসাইনমেন্ট দেন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের নারকীয় ঘটনার সময় কর্নেল রউফ ছিলেন ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি)। যদিও নাটকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে অনুপস্থিত রেখে ডিজিএফআই ডিজি কর্নেল রউফের ভূমিকা দেখানো হয়েছে।
নাটকের চিফ মানে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ। তখন বঙ্গভবনে সফিউল্লাহ'র সাথে চিফ অফ জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানও অনেকটা ফারুক-রশীদ-ডালিমদের কাছে বন্দী অবস্থায় ছিলেন। যাকে ২৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে খন্দকার মুশতাক সেনাপ্রধান করেন। নাটকে নাট্যকার মাসুম রেজা হয়তো বিতর্ক এড়াতেই ইচ্ছা করেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও জেনারেল জিয়াকে অনুপস্থিত দেখান। বঙ্গভবনে তখন এয়ার চিফ ও নেভাল চিফ ও ছিলেন, তাদেরও নাটকে অনুপস্থিত রাখা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর মরদেহ ধানমন্ডি ৩২ থেকে সরাসরি তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে নেওয়ার আগে আদতে সকাল ১১টায় প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসে নেওয়া হয়েছিল। ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন হেডকোয়ার্টারে কর্মরত সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ ১৫ আগস্ট নিহত ১৮ জনের একটি রিপোর্ট সেনানিবাসে লিখিতভাবে দিয়েছিলেন। যা ওই সময়ের ইতিহাসের একটি সাক্ষ্য বহন করে। সেখানে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা হলো- সিএসডি ক্যান্টিন থেকে বাকিতে বঙ্গবন্ধুর কাফনের কাপড় কেনা হয়েছিল, যা দিয়ে মূলত বঙ্গবন্ধুর মরদেহ ঢেকে দেওয়া হয়েছিল, আর নিচে দেওয়া হয়েছিল পলিথিন। বিমানবন্দরে মেজর হায়দারের কাছে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ হস্তান্তর করছিলেন মেজর বজলুল হুদা। ক্যাপ্টেন হুদা বললে একটু বিভ্রান্তি লাগতে পারে। কারণ হত্যাযজ্ঞের পর ক্যাপ্টেন হুদাকে ফারুক অনারারি মেজর পদে উন্নীত করেছিলেন।
হেলিকপ্টার থেকে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ নামিয়েছিলেন টুঙ্গিপাড়ার তৎকালীন সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার কাসেম, পোস্টমাস্টার আনোয়ার হোসেন, স্থানীয় মেম্বার আব্দুল হাই, গ্রামবাসীদের মধ্যে আকবর কাজী, মো. ইলিয়াস হোসেন, জহর মুন্সি, সোনা মিয়া কবিরাজ, শেখ নুরুল হক, গেদু মিয়া, সোহরাব মাস্টারসহ অন্যান্যরা (মোট ১২ জন)। বঙ্গবন্ধুর মরদেহের গোসল করানোর আগে কফিন খুলেছিলেন কাঠমিস্ত্রি হালিম শেখ ও তার ১০ বছর বয়সী ছেলে আইয়ুব আলী শেখ। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ গোসল করিয়েছিলেন তিন জন, তারা হলেন ইদ্রিস আলী, সোনা মিয়া ও মান্নাফ শেখ। আশরাফ মোল্লার দোকান থেকে ৫৭০ কাপড়কাঁচা সাবান কেনা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর গোরখোদকের কাজও করেছেন এই তিনজন। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ বুঝে পেয়েছে এই মর্মে সেনারা তিনজনের স্বাক্ষর নিয়েছিলেন, তারা হলেন বঙ্গবন্ধুর দূরসম্পর্কের মামা পান্নু শেখ, এসডিপিও নুরুল আলম ও ওসি আব্দুল জলিল। যা নাটকে কিছুটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
টুঙ্গিপাড়ার ঘটনায় আরো কয়েকজনের ভূমিকা নাটকে দেখা যায়নি। গোপালগঞ্জের ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল কাদের, সিআই আব্দুর রহমান, ও রেডক্রস অফিসের পিয়ন রজব আলী। বঙ্গবন্ধুর জানাজায় প্রায় ৩৫ জন উপস্থিত ছিলেন। যার মধ্যে ১৮ জন সেনা, কয়েকজন পুলিশ ও ১০-১২ জন গ্রামবাসী। নাটকে সেই উপস্থিতি কিছুটা কম দেখানো হয়েছে।
অভিনয়:
প্রায় ২৬ বছর পর মঞ্চে ফিরলেন আরণ্যকের আজিজুল হাকিম। নাটকে মৌলভী আব্দুল হালিম চরিত্রে তিনি এককথায় অসাধারণ অভিনয় করেছেন। অনেকদিন পর হাকিম ভাই'র এমন মুর্দান্ত অভিনয় দেখে আমি সত্যি সত্যিই মুগ্ধ। হাকিম ভাইকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন মুনিরা বেগম মেমি। মেমি আপার অভিনয়ও দাগ কেটেছে। মেজর হায়দারের চরিত্রে রমিজ রাজু ছিলেন আরেক মুগ্ধতার নাম। আদতে এই নাটকে মেজর হায়দারের চরিত্রটি সবচেয়ে আকর্ষণীয়। কারণ তাকে দু'ধরনের ভূমিকা পালন করতে হয়। একদিকে তারা খুনের সাথে সরাসরি জড়িত নন। আবার টুঙ্গিপাড়ায় তার মিশনটি ছিল সত্যি সত্যি চ্যালেঞ্চিং। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিনের চরিত্রে সাইফুল জার্নাল ছিলেন অনন্য।
খন্দকার মুশতাক চরিত্রে কামাল বায়েজীদ অসাধারণ অভিনয় করেছেন। বিশেষ করে তার গেটআপ ছিল একদম পারফেক্ট। মেজর ডালিমের চরিত্রে শামীম সাগরের প্রথম এন্ট্রিটে কিছুটা জড়তা থাকলে পরে দুর্দান্তভাবে মানিয়ে নিয়েছেন। কনস্টেবল সিরাজের চরিত্রে সাজ্জাদ আহমেদের শুরুটা জড়তা দিয়ে হলেও পরে বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। এছাড়া নুরুল আলমের স্ত্রী ও নার্স দিপালী রানীর চরিত্রে সৈয়দা শামছি আরা সায়েকা অসাধারণ অভিনয় করেছেন।
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক:
আবহসঙ্গীতে ফোয়াদ নাসের বাবু'র কাজ ভালো লেগেছে। বাবু ভাই'র কাছ থেকে থিয়েটারে আরো এরকম কাজ চাই। বাবু ভাইকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন ইমানুর রশীদ খান ও শাহেদ নাজির হেডিস।
কস্টিউম:
ওয়াহিদা মল্লিক জলি নাটকে যে কস্টিউম পরিকল্পনা করেছেন, এককথায় সুন্দর। বিশেষ করে খন্দকার মুশতাক ও মৌলভী আব্দুল হালিমের ও তার স্ত্রী'র কস্টিউম। গ্রামবাসীদের পোষাকেও ওই সময়ের ছাপ ছিল। সেনাদের পোষাকও ম্যাচ করেছে।
লাইট:
নাসিরুল হক খোকন ভাই'র লাইট নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই। খোকন ভাই পরিবেশ অনুযায়ী সুন্দর লাইট করেছেন।
সেট:
সাদামাটা সেট করার কারণে আর ওরকম সেটে যে ধরনের আলোক সম্পাত ঘটেছে, তা নাটকটিকে একটা আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। আলী আহমেদ মুকুলের এই ভাবনাটি ভালো লেগেছে।
নাটকটির রূপসজ্জা পরিকল্পনা করেছেন শুভাশীষ দত্ত তন্ময়। পোস্টার ডিজাইন করেছেন চারু পিন্টু। স্যুভেনির অলঙ্করণ করেছেন মো. আহসান হাবীব বিপু। প্রযোজনা ব্যবস্থাপক ছিলেন এহসানুল আজিজ বাবু। নির্মাণ ও মঞ্চায়ন নির্বাহী ছিলেন আলী আহমেদ মুকুল। প্রযোজনা তত্ত্বাবধায়ন করেছেন আফসানা করিম। প্রযোজনা উপদেষ্টা ছিলেন লিয়াকত আলী লাকী। সহকারী নির্দেশক ছিলেন অয়ন চৌধুরী। আর নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন মাসুম রেজা।
'জনকের অনন্তযাত্রা' নাটকটিতে বেশ কয়েকটি থিয়েটার দলের সুদক্ষ কলাকুশলী ও শিল্পীরা পারফর্ম করেছেন। সবাই মিলে একত্রে কাজ করলে যে ভালো কিছু হয়, 'জনকের অনন্তযাত্রা' নাটকটিতে সেই ছাপ সুস্পষ্ট। সর্বশেষ মাসুম ভাইকে একটা পরামর্শ দিয়ে এই লেখা শেষ করতে চাই। যদিও আমি অনুমান করতে পারছি যে এটি প্রথম শো হবার কারণে রিদম, ও অ্যাক্টে অনেকের মধ্যে কিছুটা জড়তা চোখে পড়েছে। যা আরো কয়েকটা শো'র পরেই হয়তো দুর্দান্ত গতি পাবে। কিন্তু বঙ্গভবন ও সেনাদের কথপোকথনে বিশেষকরে 'ডায়লগ'-এ আরো একটু সতর্ক হবার অনুরোধ রইলো। করোনা মহামারীর কারণে দীর্ঘ বিরতির পর সবমিলিয়ে 'জনকের অনন্তযাত্রা' নাটকটি আমার ভালো লেগেছে। মাসুম ভাইকে অভিনন্দন ও টিমের সবাইকে শুভেচ্ছা। শিল্পকলা একাডেমিকে এই উদ্যোগটির জন্য ধন্যবাদ জানাই। জয়তু থিয়েটার।
-------------------
৫ ডিসেম্বর ২০২১
২| ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ৯:০৫
রাজীব নুর বলেছেন: জানলাম।
৩| ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১০:৩০
ঠাকুরমাহমুদ বলেছেন:
পোস্টটি প্রিয়তে রাখা ছাড়া আর কিছু বলার নেই। ধন্যবাদ। +++
৪| ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ১১:৫০
সাহাদাত উদরাজী বলেছেন: সুযোগ পেলে দেখবো।
©somewhere in net ltd.
১| ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:০৫
হাসান কালবৈশাখী বলেছেন:
আপনার কিছু পর্যবেক্ষণ: সমস্যা আছে।
নাটকের চিফ মানে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ। তখন বঙ্গভবনে সফিউল্লাহ'র সাথে চিফ অফ জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানও অনেকটা ফারুক-রশীদ-ডালিমদের কাছে বন্দী অবস্থায় ছিলেন। যাকে ২৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে খন্দকার মুশতাক সেনাপ্রধান করেন।
বাস্তবতা হচ্ছে জিয়া অলিখিত ভাবে সেনা প্রধান তথা খুনি প্রধান হয়ে গেছে দুদিন আগেই।
৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট বংগবন্ধুকে হত্যা করা হয়,
খুনিদের চিফ ছিল জিয়া,
সে ছিল ডেপুটি চিফ। কিন্তু খুনের পর ভোর সকালে ইউনিফর্ম পরে সেজেগুজে রেডি হয়ে ছিল। অনেকেই দেখেছে। মোস্তাক ও খুনিদের সাথে অনুষ্টানে যাবে পুতুল মোস্তাককে সমর্থন জানাবে।
প্রতিবেশী সেনা অফিসাররা সেই সকালে বাসায় যায়। বললো "সার প্রেসিডেন্ট নিহত হয়েছে"।
জিয়া নির্বিকার ভাবে দাড়ী কামানো শেষে ফিনিশিং দিচ্ছিল, বললো "সো হোয়াট, ভাইস প্রেসিডেন্ট তো আছে, সমস্যা কি"
নির্বিকার। সবই জানে।
আর আসল চিফ অব স্টাফ সফিউল্লা সেই রাতে বঙ্গবন্ধু্র বিপদে সাহায্যর জন্য ফোনে কাউকে পাচ্ছে না, কেউ ফোন ধরছে না, নিজে যাবে কিন্তু ড্রাইভারটাকে পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। কারন নাটের গুরু বাস্তব চিফ আগেই তাকে ক্ষমতাচুত করে সব স্টাফদের সরিয়ে ফেলেছে।