নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যা-ই লিখি, কাঠবিড়ালীর মত এখানে জমিয়ে রাখি। https://rimsabrina.blogspot.com/
আনত যীশুর শহরে ১
আনত যীশুর শহরে ২
৩.
মারিনপ্ল্যাৎজ স্টেশনটা উজ্জ্বল কমলা রঙে রাঙ্গানো। দেয়ালগুলো বাঁকানো কনকেভ আকারের। প্ল্যাটফর্মে ট্রেন থামলে মনে হয় যেন বিরাট এক কমলালেবুর পেটের ভেতর ঢুকে পড়েছি। কেমন খিদে পেয়ে যায় চট্ করে। তাজা কমলালেবুর ঘ্রানটা সপাটে নাকে ঝাঁপটা মেরে গেল। খিদেটাকে পাত্তা না দিয়ে চলন্ত সিড়ি ধরেছি। মার্যিনপ্ল্যাৎজ আমার গন্তব্য না। বাড়ি ফেরার পথে একটা জরুরী জিনিস কিনতে হবে। তাই মাঝ পথে থামা।
সৌম্য চেহারার এক প্রৌঢ়কে ঘিরে জটলা চোখে পড়ছে। কলেজ পড়ুয়া কতগুলো মেয়ে রাস্তা জানতে চাইছে বোধহয়। আমাকে না আটকালেই হল। পা চালিয়ে হনহন্ পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি।
‘এক্সকিউজ মি, একটু দাঁড়াবেন?’। ঠিক জালে আটকে গেলাম, ধুর্! সমস্বরের ডাকটা উপেক্ষা করা গেল না। অনিচ্ছায় ঘুরে দাঁড়ালাম।
‘ভদ্রলোক অমুক দোকানের ঠিকানা খুঁজছেন। কিন্তু আমরা তো পথঘাট চিনি না। নিজেরাই ম্যাপ হাতে ঘুরছি‘। মুঠোফোনের গুগল ম্যাপটা দেখিয়ে ইংরেজি টানে ভাঙ্গাচোরা জার্মানে দ্রুত কথাগুলো আওড়ালো ওরা। বেশ বোঝা গেল, নানা দেশ থেকে আসা ইন্টারন্যাশনাল ছাত্র আর কি।
নেহাৎ ভদ্রতায় পড়ে অনুরোধের ঢেঁকিটা ভাল করে গিলতে না গিলতেই মেয়েগুলো ভোজবাজির মত এক চম্পটে উধাও! অগত্যা সামনে এগোতেই হল।
ভদ্রলোকের পড়নে সাবেকি ছাঁটের বাভারিয়ান কোট। মুজিব কোটে হাতা জুড়ে দিলে যেমন দেখাবে আর কি। মাথায় ফেদোরা হ্যাটের মত সিল্কের লেস বসানো টুপি মিলিয়ে ভারিক্কি সাজ। এখানকার বয়স্কদের অনেকেই নিজেদের সিগনেচার পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়। উৎসব-পার্বণ ছাড়াই। দেখতে কিন্তু বেশ লাগে। আগের দিনের পোশাক-আশাকে বনেদী একটা ভাব আছে।
তবে জমকালো বেশভূষার সাথে ম্যাড়ম্যাড়ে সাদা ছড়িটা বড্ড বেমানান লাগছে। হঠাৎ মনে হল, ইনি অন্ধ। আনাড়ি হাতে এলোপাতাড়ি ছড়ি ঠোকার ভঙ্গী দেখে আরো মনে হল, চোখ খুইয়েছেন বেশি দিন হয় নি। ছড়ি বরাবর উঠে গেলে কালো চশমার আড়ালে অস্থিরতা টের পাওয়া যায়।
অবাক করে দিয়ে অস্থিরতার বনামে শান্ত অথচ গমগমে রাশিভারী কন্ঠ কানে এল, ‘ফোনের দোকানটা কোথায় বলতে পারো? ওরা বলেছিল, সিড়ি ধরে উপরে উঠলেই পেয়ে যাবো। কিন্তু ডান-বাম কিছুই বলে নি। কি করি বলো তো?’।
অনুযোগের সুরটা হতাশা মেশানো। দিক খুঁজে পাবার মত মামুলি, তুচ্ছ ব্যাপারটা আচমকাই কঠিন হয়ে গেছে তার কাছে। তাছাড়া, ছড়ি ঠুকে চলাফেরাটা ভাল করে না শিখিয়েই তাকে একা ছেড়ে দিয়েছে কেন কে জানে। এ লোক তো যে কোনো মুহূর্তে দড়াম করে আছাড় খেয়ে অক্কা যাবে।
কিছুটা ব্যস্ত সমস্ত স্বরে বললাম, ‘দোকানের নামটা আরেকবার বলবেন’?। মনে মনে ভাবছি, এনাকে পথের হদিস ধরিয়ে দিয়ে নিজের রাস্তা মাপতে হবে। কুইক মার্চ।
‘টি-মোবাইল শপ’। নামটা বলেই ভদ্রলোক দিশেহারা মুখে ইতিউতি চাইলেন। যেন খুব জোর চেষ্টা করলে দৃষ্টি ফিরে আসবে আর তিনি ঠিক ঠিকানা বরাবর রওনা দেবেন। দৃশ্যটা স্টেশনের ঝলমলে আলোতেও বড্ড অন্ধকার ঠেকলো।
জোর করে সহজ গলায় বললাম, ‘আরে, এতো খুব কাছে। সিড়ি ভেঙ্গে ওপরে পৌঁছে উঠলেই হল। পৌঁছে দিচ্ছি, চলুন‘। জবাব শুনে ভরসা পেলেন মনে হল। কপালের মিলিয়ে যাওয়া ভাঁজগুলো মসৃন হল কিছুটা। তার বদলে ভাঁজ হল ডান হাতটা। বল ড্যান্সের ভঙ্গিতে কনুই বাড়িয়ে দিয়ে দিলেন। যেন এই বলে উঠবেন, ‘শ্যাল ইউ গো, মাই লেডি?।
বলার ধরনের থিয়েটারী কায়দাটা দুর্দান্ত লাগলো। একটু আগের অসহায় বুড়ো লোকটা কই যেন মিলিয়ে গেছে। চওড়া একটা হাসি ফুটেছে মুখে।
এক মুহূর্ত ইতস্তত করলাম। ভাবছি, এই করোনাকালে ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে চলবো কি না। কিন্তু এমন করে বাড়িয়ে দেয়া হাত ফিরিয়ে দেই কি করে। তাই সংকোচ ঝেড়ে ঠিকানা খোঁজার সঙ্গী হলাম।
চলন্ত সিড়িতে বেভুল পা দিতেই ভদ্রলোক হড়কে গেলেন প্রায়। হ্যাঁচকা টানে ধরে না ফেললে হোঁচট ঠেকানো মুশকিল হত। এই লোক কি এই আজকেই প্রথম একা বেরিয়েছেন? অন্ধদের আলাদা ট্রেনিং দিয়ে তবেই একা ছাড়া হয় যদ্দূর দেখেছি। এমন আনকোরা অন্ধ আর দেখি নি কখনো। শিশুর মত খুব সাবধানে তাকে বের করে আনলাম পাতাল রেলের সুরঙ্গ থেকে।
মারিনপ্ল্যাৎজের সুবিশাল চত্বরে বিকালের নরম আলো ঠিকরে পড়ছে। ওপরে খোলা নীল আকাশে সাদা মেঘের পালক ভাসছে। তাতে কবুতরের ঝাঁক ডানা ঝাপ্টে ইচ্ছেমতো উড়ছে। এই সদ্য অন্ধ ভদ্রলোক তার কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। এর কোনো মানে আছে? কেমন একটা অন্ধ ক্ষোভ আমাকেও জেঁকে ধরলো।
‘কই, বলো, এবার কোন দিকে যাবো?’। নিজের ভাবনার জগত থেকে সম্বিত ফিরে তাকালাম। ফোনের শো-রুমটা তো চিরকালই এখানে ছিল। স্টেশন থেকে উঠলে ‘রিশার্ট’ নামের বেকারী, তারপরই একটা কসমেটিক শপ। আর গা ঘেঁষেই ফোনের দোকান। কিন্তু এখন কোথায় হাপিশ হয়ে গেল সেটা।
হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, সারি সারি দোকানপাটের কোনোটারই নাম পড়তে পারছি না। অক্ষরগুলো ঘোলাটে লাগছে। যেন ঘষা কাঁচ বসিয়ে দেয়া হয়েছে সাইনবোর্ডগুলো উপরে।
‘কি, ঠাহর হচ্ছে না ঠিক মতো? একবার ফোনে দেখবে নাকি?’। ভদ্রলোক তাড়া লাগালেন।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এক্ষুনি দেখছি...’। পকেট হাতড়ে মুঠোফোন বের করতে করতে বললাম।
এবার সত্যিকারের নার্ভাস লাগছে। মোবাইলের স্ক্রিনটাও বুঝি কেউ ঘষে দিয়েছে দেয়ালে। ম্যাপে দেখানো রাস্তাগুলো বোঝা যাচ্ছে না ভাল করে। সাপ বনে গিয়ে তারা এঁকেবেঁকে চলছে নিজের খেয়ালে। চারপাশের বিকাল উবে গিয়ে গাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল আচমকাই। কিছুই দেখতে না পাবার বিকট আতঙ্ক গলা চেপে ধরলো তীব্রভাবে।
‘হাই, কোনো সাহায্য করতে পারি?’। মাঝবয়সী এক মহিলা থেমে দাঁড়ালেন।
‘জি, মানে, আমরা টি-মোবাইল শপটা খুঁজছি...’। কোনোমতে চিঁ চিঁ করে বললাম।
‘তোমরা তো দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে আছো, পেছনে লোকের লম্বা লাইন, দেখছো না?’। ঘাড় ঘুরিয়ে বোকা বনে গেলাম। নিয়ন গোলাপিতে বড় বড় করে লেখা নামটা। এই তো পরিষ্কার দেখছি আবার।
‘এই যে নিন, পৌঁছে গেছি’। আমতা আমতা করে করে জানালাম সাথের ভদ্রলোককে।
হাতের ইশারায় রিসেপশনে দাঁড়ানো লোকটাকে ডাকলাম। সে এক পলকে সাদা ছড়িটা দেখে এগিয়ে এল। তার অন্ধ কাস্টমারকে লাইন ভেঙ্গে সামনে নিয়ে যাবে।
বুড়োটা এবার ঘুরে তাকালো, ‘বাছা, অনেক ধন্যবাদ। ঠিকঠাক মতো ফিরে যাও’। বলতেই খেয়াল হল, এখনো তার বাহু ধরে রেখেছি। লজ্জা পেয়ে হাত গুটিয়ে নিতেই হাতটা আবার খপাৎ মুঠোয় পুরে নিল সে। আলতো একটা উষ্ণ চাপ দিয়েই আবার ছেড়ে দিল।
ধীর লয়ে হাঁটছি। ঠিকঠাক তো আমি ঠিকই ফিরবো। কিন্তু এই লোকটা ঠিক বাড়ি ফিরে যেতে পারবে তো? স্টেশনের সিড়িতে হোঁচট খাবে না তো? আবার অমন হঠাৎ করেই বা ক্ষণিকের তরে দৃষ্টি হারালাম কি করে। অন্ধত্ব কি কখনো কখনো সংক্রামক?
প্রশ্নগুলো বুদ্বুদ হয়ে ভাসতে লাগলো মারিনপ্ল্যাৎজের কমলালেবু প্ল্যাটফর্মে। (ক্রমশ)
০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১:২৮
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: আগেও বোধহয় বলেছি, আপু, আপনি আমার লেখা পড়লে অন্য রকন আনন্দ হয়।
২| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সকাল ১০:৪৯
ৎঁৎঁৎঁ বলেছেন: বরাবরের মতই ভালো লাগলো, আগের পর্বগুলো পড়তে হবে।
*অফটপিক - কিছুদিন আগে প্রথম আলো পত্রিকায় একটা ভ্রমণ কাহিনী পড়লাম, জার্মানির কোথাও মনে হয়, দেখেই মনে হল এরকম তো ব্লগে একজন লেখে, লেখনীতে অনেক মিল- পরে দেখি ঐ ব্যক্তিটাও আপনি!!!
শুভেচ্ছা।
০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১:৩০
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: জি, সে শর্মাটি আমিই। কালেভদ্রে সেখানে লেখা পাঠানো হয়। আপনার চোখে পড়াতে দারুণ খুশি হলাম।
৩| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সকাল ১১:৩৪
রাজীব নুর বলেছেন: বাভারিয়ান কোট কি রকম?
০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১:৩১
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: ভালো ধরেছেন। সামান্য বর্ননা যোগ করে দিচ্ছি। পড়ে দেখবেন সেটুকু। আর জানাবেন ।
৪| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১:৪০
সাগর শরীফ বলেছেন: আগের দুটি মিস করেছি বলে এটা পড়ে খুব একটা বুঝিনি। লিংক টুকে রাখলাম। সময় করে পড়তে হবে। ধন্যবাদ আপনাকে।
০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৩:৪২
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: প্রথমে ধন্যবাদ । দ্বিতীয়ত, আগের দু'টোর সাথে গল্পের মিল নেই। তবে থিম একই। হারিয়ে যাওয়া কিংবা পথ খুঁজে না পাওয়া লোকের সাথে দেখা হয়ে যায় মাঝে মাঝেই। এদের গল্পগুলো মনে দাগ কেটে যায়। তাই টুকে রাখা। এছাড়া তেমন বিশেষত্ব নেই বিশেষ।
৫| ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ২:২৯
রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: ভালো ধরেছেন। সামান্য বর্ননা যোগ করে দিচ্ছি। পড়ে দেখবেন সেটুকু। আর জানাবেন ।
ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ২:৩৩
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: আপনিও ভাল থাকবেন, রাজীব ভাই।
৬| ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:০৫
বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: এই জগতে আপনার মত ভাবনা নিয়ে চলা লোকের খুব বেশী প্রয়োজন, কিন্তু বড্ড অভাব। আপনার লেখাগুলো পড়ে মনে হল একটি প্রিয় গানের একটি কলি কোথায় কখন কবে কোন তারা ঝরে গেল আকাশ কি মনে রাখে
চলুক সিরিজ, অপেক্ষায় থাকবো। ভালোলাগা রইলো লেখায়। ভালো থাকুন সবসময়।
২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৩:০৫
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: অনেকদিন পর আপনার দেখা পেয়ে দারুন লাগছে। ভাল আছেন তো?
৭| ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৮:৪৯
সোহানী বলেছেন: ওহ নো....... তুমি একজন দারুন লেখিয়ে। আমার মতো সাধারন তোমার লিখা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারি।
২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৩:০৩
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: কি যে বলেন আপু। আপনি অনেক গুনী একজন ভাল মানুষ।
©somewhere in net ltd.
১| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সকাল ৭:২৭
সোহানী বলেছেন: ভালো লাগলো। আগের পর্বগুলো পড়বো।