নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যা-ই লিখি, কাঠবিড়ালীর মত এখানে জমিয়ে রাখি। https://rimsabrina.blogspot.com/
১
খুব তাড়াহুড়ো আজকে। সেন্ট জোসেফ স্কুলে ইন্টার-স্কুল ক্যুইজ কম্পিটিশন। ওদিকে, ক্লাস এইটের ষান্মাসিক পরীক্ষা বিচ্ছিরি রকমের খারাপ হয়েছে। অঙ্কে একশোতে তেষট্টি না বাহাত্তর-এরকম কিছু একটা জুটেছে। যদিও এ নিয়ে বাসায় কেউ কিছু বলছে না। না বলাটাই নিয়ম। পড়াশোনা নিয়ে বাড়ির কারো খুব একটা মাথা ব্যথা নেই তেমন। বাবা-মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। দু’জনই প্রানিবিদ্যার অধ্যাপক। বন্যপ্রানি নিয়ে কারবার। তাই ছাগল পিটিয়ে মানুষ করার মত গবাদি উৎসাহ নেই অতটা। ঠেলেঠুলে পরের ক্লাসে উঠে গেলেই খুশি। সুতরাং অঙ্কের তেষট্টি নিয়ে মন খুঁতখুঁত ঝাঁৎ করে ঝেড়ে ফেলে তৈরি হচ্ছি জোরেসোরে।
ক্যুইজে ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়াটা জরুরি। গত এক মাসের পুরানো খবরের কাগজ, নীলক্ষেতের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের বই আর সেকেন্ড হ্যান্ড বিসিএস গাইড পাতি পাতি করে পড়া হয়েছে। পেটে রাজ্যের অদরকারি বিদ্যা ঘচঘচ করছে। এত জ্ঞান বৃথা যেতে দেয়া যাবে না কিছুতেই। আব্বা স্কুল ইউনিফর্মটা ইস্ত্রি করে হাঁক দিতে সেটা গায়ে চাপিয়ে বাটার সাদা কেডস পায়ে গলিয়ে এক্কেবারে রেডি।
চমৎকার সকাল। উত্তর ফুলার রোড ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারে থাকি আমরা। পাড়ার ভেতর বিরাট গোল মাঠ। মাঠের সবুজ ঘাসগুলো চিকচিক করছে নরম আলোয়। মনটাই ভাল হয়ে গেল। এখন রিকশা একটা বাগিয়ে রওনা দেয়াটাই যা বাকি। কিন্তু সামনে ওটা কি নড়ছে? কৌতূহল মেটাতে আবিষ্কার করলাম ডানা বাঁকাচোকা করে একটা প্রমান সাইজের চিল কাত হয়ে পড়ে আছে মাঠের পাশে। চিলটাকে খুব সাবধানে তুলে নিল আব্বা। উড়ে পালাবার ইচ্ছা না দেখিয়ে বরং পিটপিটিয়ে চোখ মেলে চাইলো বেচারা। ঠিক তখনি ঠকাশ্ শব্দ তুলে আরেকটা চিল এসে পড়লো পায়ের কাছে। আরো একটা একটু দূরে। তারপর আরো একটা।
দেখতে দেখতে দশ-বারোটা দশাসই সাইজের পাখি জমে গেল রাস্তায়। অদ্ভূত চিল বৃষ্টি দেখে আমরা ততক্ষনে হতভম্ব। আলফ্রেড হিচককের ‘বার্ড’ সিনেমার কথা মনে হল। পাখির দল একদিন হঠাৎ ক্যালিফোর্নিয়ার রোদ ঝকমকে এক শহর আক্রমন করে তুলকালাম বাঁধিয়ে দেয়। কিন্তু এই নিরীহ, নির্ভেজাল ফুলার রোডে আবার কি হরর মুভি শুরু হল। আব্বা চিল গোনায় ব্যস্ত। আর খুঁটিয়ে কি যেন দেখছে। আমি লুকিয়ে ঘড়ি দেখছি বারবার। ক্যুইক না গেলে ক্যুইজ আজকে ছুটে যাবে নির্ঘাত।
গাড়ির গ্যারেজ খুলে আব্বা একটা একটা করে চিল জড়ো করছে সেখানে। পাড়ার দারোয়ান এসে হাত লাগিয়েছে। আর খুব ক্যাজুয়ালি বলছে, ‘কেয়ামত আইস্যা গেল নাকি, স্যার? আবাবিল পাখি পাঠায়ে দেওনের কথা পড়ছিলাম কোনহানে জানি...’। যদিও তার ভেতর কেয়ামতজনিত আতঙ্ক তেমন একটা দেখা গেল না। আব্বা দু-একবার হ্যাঁ-হুঁ করে তাকে দিয়ে এক বাটি পানি আনালো পাখির জন্যে। অবশ্য কাজ হল না। চিলগুলো চোখ উল্টে আধমরা হয়ে পড়ে থাকলো। দৃশ্যটা ভয়াবহ। মায়া করে একটা চিলকে আলতো করে মাথায় হাত বুলাতে গেলাম। তড়াক করে ঘাড় ঘুরিয়ে খ্যাক্ করে ঠুকরে দিল। কোক্ করে পিছিয়ে এলাম ঘাবড়ে।
প্রায় বিশ-পঁচিশটা চিলের সারি লাইন দিয়ে শুইয়ে রেখে তাদের পেট টিপেটুপে পরীক্ষা চল বেশ খানিক্ষন। তারপর আব্বা কাকে যেন ফোন লাগালো। নীলক্ষেত থেকে শহীদুল্লাহ হল কি কার্জন হল এলাকার ভেতর কোথাও মরা গরু-ছাগল পড়ে আছে নাকি-এই হল তার জিজ্ঞাসা। মিনিট দশেকের ভেতর জানা গেল আনন্দ বাজারের ওদিকে বাছুর সাইজের গরু মরে আছে। বেশিক্ষন হয় নি, তবে তাকে নিয়ে বিড়াল-কুকুরের টানাটানি নেই। বাছুর নিজেই বিষাক্ত কিছু খেয়ে পটল তুলেছে। কুকুর-বিড়ালে সেটা টের পেয়ে আর ঘাটাতে আসে নি। কিন্তু বোকা চিলগুলোর অত বুদ্ধিতে কুলোয় নি। তারা খুব এক প্রস্থ মেজবান খেয়ে দড়াম আছড়ে পড়েছে ‘অবু, আকশ থেকে নেমে এল ছোট্ট একটা পাখি’ হয়ে।
তবে কাজের কাজ হল বটে। আব্বার কথায় প্রানিবিদ্যা বিভাগের কিছু ছাত্র আর এলাকার লোকজন মিলে মরা বাছুর অতি সত্ত্বর সরিয়ে ফেললো নিরাপদে। নইলে আরো আরো পশুপাখির আজকে লাস্ট সাপার হয়ে যেত এই মাংস দিয়ে। দারোয়ান ভাই আর ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ না গিয়ে খুব বিজ্ঞের মত বলে উঠলো, ‘কইছিলাম না স্যার, এরা রে তো মনে কয় বিষ খাওয়াইছে...’।
কার্যকারন যখন জানাই গেল, তখন দারোয়ান ভাইকে চিলগুলোর পাহারায় বসিয়ে রিকশা খুঁজতে পা চালালাম আমরা। পাখিগুলো নাকি বিশ্রাম পেলে আবার জ্যান্ত হয়ে উঠবে পুরোদমে। আব্বার কথায় ষোলআনা ভরসা রেখে রওনা দিলাম সেন্ট জোসেফের পথে।
সেদিন বিকালে ফিরে এসে দেখি একটা চিলও চিতকাৎ হয়ে নেই গ্যারেজের মেঝেতে। সব পাখি উড় গিয়া। আনন্দে হাততালি দিতে ইচ্ছে হল। বাপ-বেটি গ্যারেজে তালা লাগিয়ে বাসার দিকে এগোলাম। হাতে সোনালি ট্রফি আর আধ ডজন প্রাইজের বই। চিল মুড আর কাকে বলে।
২
পশুপাখি আমাদের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল। বিচিত্র সব গল্প আছে ঝুলিতে। একবারের ঘটনা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। ট্রিং ট্রিং কলিং বেল। আমরা দরজা খুলে দেখি বিরাট বড় পাখির খাঁচায় বিড়ালের মত কি যেন একটা প্রানি নিয়ে উপস্থিত কয়েকজন। পাচার হয়ে যাচ্ছিল প্রানিটা। বিরল জাতের মেছোবাঘ। প্রবাল রঙের সবুজ চোখ আর ডোরাকাটা গা। গোপনে খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছে আমাদের ফুলার রোডের বাসায়।
ঠিক হল আজ রাতে মেছোবাঘ মশাই আমাদের অতিথি হয়ে থাকবেন। কাল তাকে পাঠানো হবে শ্রীমঙ্গলে, শিতেষ বাবুর চিড়িয়াখানায়। শিতেষ বাবু এককালে নামকরা শিকারী ছিলেন। জিম করবেট লেভেলের লোক। ভালুকের ভয়াল থাবার চিহ্ন তার মুখের একপাশে স্পষ্ট। তবে এখন আর শিকারের নেশা নেই। বরং পশুপাখির প্রান বাঁচানোয় মন দিয়েছেন। নিজের ছোট একটা সংগ্রহ আছে। পোচিংয়ের হাত থেকে বেঁচে ফেরা বিপন্ন প্রানির অভয়াশ্রম। আব্বা বন্যপ্রানি রক্ষা নিয়ে কাজ করার সুবাদে দুজনের বিরাট সখ্য।
কিন্তু আজ রাতে ঘরের ভেতর আস্ত একটা মেছোবাঘ থাকবে জেনে ভয় তো আর কাটছে না আমাদের। নড়বড়ে খাঁচা ঠেলে এই বুঝে সে ঝাঁপিয়ে বেরোলো। অবস্থা রীতিমত বেগতিক। শেষমেশ খুঁজেপেতে দেখা গেল স্টোররুমের পেঁয়াজ-রসুনের ঝাঁপিটা বেশ মজবুত। সাইজেও বড়। পেঁয়াজ-রসুন, আলু-পটল হঠিয়ে ঝাঁপি খালি করা হল ডোরাকাটা মেহমানের জন্যে। দেরি না করে আব্বা ম্যাজিশিয়ানের মত নিমিষেই মেছোবাঘটাকে খাঁচা থেকে তুলে ঝাঁপিতে নামিয়ে হুড়কো আটকে দিল আলপটকা। যথেষ্ট জায়গা পেয়ে মেছোবাঘটা হাত-পা টান টান করে গা এলিয়ে দিল বিরাট এক হাই তুলে। নামের মেছো অংশ বাদ দিলে তাকে আসল বাঘের মতই লাগছে। গুটলি পাকিয়ে শুয়ে চাপা গরগর্ শব্দে সেটাই সে যেন প্রকারান্তরে জানিয়ে দিল।
পরের দিন ইশকুল থেকে ফিরে দেখি বাঘ মামা গন কেস। গতকালের নড়বড়ে খাঁচায় করে শ্রীমঙ্গলের পথে। আব্বা তার লেজের মাপ, কানের সাইজ, মুখে কটা দাঁত-সব মেপে আর গুনে তবেই তাকে বিদায় দিয়েছে।
আরেকবার গুলিস্তানের ফুটপাথ থেকে ধরা পড়লো গোটা চারেক কালিম পাখি। সে সময়ে শীতকালে ঢাকা শহরে অতিথি পাখি হটকেকের মত বিক্রি হত। বেচারা কালিমগুলো ঠিক শীতের পাখি না হয়েও আটকে পড়েছিল হয়তো শিকারির দুষ্টু ফাঁদে। আর উদ্ধার হওয়া পশুপাখির জন্যে আমাদের বাসাটা গেস্টহাউস হিসেবে খুব চালু। তাই শিতেষ বাবুর চিড়িয়াখানা বা আর কোনো নিরাপদ আশ্রয় জোটা না পর্যন্ত লাল-নীলে ছোপানো চার সদস্যের কালিম বাহিনী নন-পেয়িং গেস্ট হয়ে হাজির হল বাসায়। আকারে দীর্ঘ বলে খাঁচায় আঁটলো না তারা। বরং লম্বা লম্বা ঠ্যাঙ ফেলে সারা ঘর দাপিয়ে বেরাতে থাকলো। দিন দুই বিরাট উৎপাত আর বিকট চ্যাঁচামেচি করে প্রায় পাগল বানিয়ে দিয়ে তবেই বিদায় নিয়েছিল তারা।
৩
একবার বাসায় টিভি থেকে একদল সাংবাদিক এল। তাদের সাথে লাইইট-ক্যামেরা আর মাঝারি সাইজের লাল গামলা। গামলার ভেতর অদ্ভূত এক মাছ। হুটোপুটির বদলে গামলার দেয়ালে নাক আটকে থম মেরে গম্ভীর বসে আছে। এই মাছ নাকি ধরা পড়েছে ধানমন্ডি লেকে। মাছের নরম আঁশের বদলে সৈনিকের বর্মের মত ভীষন শক্ত আঁশে ঢাকা শরীর। চেহারায় জল্লাদ জল্লাদ ভাব আছে একটা। আর কোনো মাছ পেলে ঘাড় মটকে খেয়ে নেবে-এমন বিকট চাহনি।
আমরা দুই ভাইবোন পড়াশোনা ফেলে লাল গামলার চারপাশে হল্লা করছি। কারন, আব্বাকে টিভিতে লাইভ দেখানো হচ্ছে। সাংবাদিকরা গরম খবর চাইছিলো বোধহয়। ‘ধানমন্ডি লেকের পানিতে ভেসে উঠেছে রহস্যময় প্রাগৈতিহাসিক মাছ’ ইত্যাদি। সম্ভাব্য গরম খবরে জল ঠেলে আব্বা ঠান্ডা গলায় বলল, ‘এটা একটা সাকারমাউথ ক্যাটফিশ। স্পিসিশ Hypostomus plecostomus আর ফ্যামিলি Loricariidae। কাটাবনের পশুপাখির দোকানে মেলে। লোকে এ্যাকুরিয়ামে রেখে পুষতে ভালবাসে। কেউ হয়তো পোষা মাছ লেকের পানিতে ছেড়ে দিয়েছে। নইলে সাউথ আমেরিকান মিঠাপানির মাছ ওখানে থাকার কথা না...’।
বেচারা সাংবাদিকদের চোয়াল ঝুলে গেল। চোখের সামনে প্রাগৈতিহাসিক অদ্ভূত প্রানিটাকে মিঠাপানির মাছ বনে যেতে দেখে তাদের উৎসাহ ফুশ্ করে উবে গেল। ওদিকে আব্বা সিরিয়াস মুখে সায়েন্টিফিক তথ্য আউড়ে যাচ্ছে, ‘এর কোনো ফুড ভ্যালু নেই, এই মাছ খাওয়া যায় না। তবে সংখ্যায় বেড়ে গেলে এরা লেকের অন্য মাছের খাবার প্লাংকটন খেয়ে সাফ করে দেবে’। তথ্যটা শুনে সাংবাদিকের ঝিমিয়ে পড়া চেহারা আবার জ্বলে উঠল। মাইক হাতে খুব কনফিডেন্স নিয়ে বলে গেল, ‘আজকের উদ্ধারকৃত মাছটি কোনো রহস্যময় প্রানি নয়, বরং একটি দুর্ধর্ষ ক্যাটফিশ প্রাজাতির মাছ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ পরামর্শ অনুযায়ী ধানমন্ডি লেকে অনুসন্ধান চালিয়ে এই প্রজাতি নির্মুলের উদ্যোগ গ্রহনের জন্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করছি’..., ইত্যাদি ইত্যাদি।
টিভির লোক বিদায় নিল। কিন্তু লাল গামলা আর তার বাসিন্দা ক্যাটফিশ রয়ে গেল। পরদিন মজবুত প্লাস্টিকের ব্যাগে করে মাছ চলে গেল আব্বার সাথে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানিবিদ্যা বিভাগে গবেষনার কাজে।
৪
আব্বার গবেষনার অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিল সাপখোপ। প্রানিবিদ্যা বিভাগের রিসার্চ গার্ডেনে আব্বার একটা সাপের ঘর ছিল। সাপের ঘরে আসলেই সাপ থাকতো। ঘরের মাঝে কুয়ার মত একটা গভীর গোল ট্যাংকি। তার উপরে লোহার জালির ঢাকনা। তার ভেতর জ্যান্ত সাপ কিলবিল করছে। স্কুল শেষে বাড়ি না ফিরে আব্বার সাথে তার সাপের ঘরে গিয়ে বসা থাকা ছিল প্রায় দিনের আফটার স্কুল অ্যাক্টিভিটি। সাপের ঘরে বসে সমুচা চিবানো আর কোক-ফান্টার বোতলে সুড়ুৎ সুড়ুৎ টান দিতাম। আর আব্বা নানান কায়দায় সাপের ছবি তুলতো, কিংবা তাদের মাপজোখ করতো। কাঁচাবাজারে গিয়ে লোকে যেমন সবজি টিপেটুপে দেখে কেনার আগে, আব্বা তেমনি খালি হাতে সাপ ধরে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করত। ব্যাপারটা এত স্বাভাবিক ছিল যে ভয় পাবার কথা মনে হয় নি কখনো।
সাপের কারনে দেশের নানান প্রান্তের বেঁদে আর সাপুড়ের সাথে তার ছিল বেজায় খাতির। এরা এক-আধ সময়ে ঝুড়ি বগলে আস্ত সাপ নিয়ে হাজির হত তার কাছে। ‘স্যার, গেরামে একটা কালা গোঁখড়ার ছাও ধরা পরসে। মাইনষে পিটায় মারতো আরেকটু হইলে। স্যার, সাপটা কি ঢাকা নিয়া আসবো?’। ফোনের ওপাশ থেকে হ্যাঁ-সূচক উত্তর শোনার সাথে সাথে সাপুড়ে মিয়া অতি দ্রুত ঝাঁপি বগলে সাপের ঘরের ঠিকানা বরাবর রওনা দিত।
গবেষনার কাজ হয়ে গেলে কিংবা ছানা সাপ বড় হয়ে গেলে আব্বা আর তার ছাত্ররা মিলে সাপগুলোকে কোনো অভয়ারন্যে বা গহীন বনে ছেড়ে দিয়ে আসত সযত্নে। সেই খবর আবার পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হত, ‘অমুক জঙ্গলে তমুক প্রজাতির সাপ অবমুক্ত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের নেতৃত্বে’। সাথে হয়তো তেরো ফুটি সাপ হাতে গামবুট পায়ে আব্বা আর তার দলবলের হাস্যোজ্জ্বল ছবি।
৫
গবেষকরা সাধারানত গোবেচারা টাইপ হয়। আলাভোলা, অগোছালো ধরনের। সেই সংজ্ঞা মেনে আব্বাও তা-ই ছিল। কিন্তু তফাৎ ছিল খানিকটা। আমাদের বৈঠকখানায় তার পড়ার টেবিল লাগোয়া রাজ্যের বই বিছানো খাটের নিচে ছিল লাইসেন্স করা ইয়া বড় এক রাইফেল। সত্তরের দশকে ফ্রান্সের বর্দ্যো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সময়ে কেনা হয়েছিল ওটা। দেশে ফেরার সময়ে এক বাক্স বুলেটসহ রাইফেলটাও সাথে করে নিয়ে এসেছিল আব্বা। বিনে ব্যবহারে পড়ে থাকলেও বছর বছর ট্যাক্স দিয়ে সাথে রেখেছিল সে বহুদিন তার প্রিয় বন্দুকটাকে। মাঝে মাঝে রাইফেলটা বের করে ঘষামাজা করা হত। উৎসব উৎসব লাগতো সে সন্ধ্যাগুলো। টিউবলাইটের সাদা আলোতে পালিশ করা রাইফেলের বাট ঝলকে উঠতো যেন। বন্দুকের নিকষ গাড় নীল নল দেখে সম্মোহন জাগত। অবশ্য সে বন্দুক আর নেই এখন। রমনা থানায় জমা দেয়া হয়েছে সেই কবে।
দেশের ভেতর যেমন গবেষনার কাজে মানচিত্রের পুরোটাই হাতের তালুর মত মুখস্থ ছিল, তেমনি, দেশের বাইরে দেশ ভ্রমনের সুযোগও এসেছে বহুবার। কেনিয়া আর জিম্বাবুয়ের সাফারি পার্ক ঘুরে এসে গল্প শুনিয়েছে কি করে ছাদখোলা জিপের জানালায় জিরাফের দল এসে উঁকি দিয়ে গেছে কিংবা বাইসনের দল কেমন বিপদজনক পাশ কাটিয়ে ধূলা উড়িয়ে দিগন্তে মিলিয়েছে। তার দেশ-বিদেশের কনফারেন্স আর জঙ্গল অভিযানের ফর্দ করলে তিন হাত লম্বা লিস্টি হবে নির্ঘাত। এ মাসে জাপান, তো ওমাসে জার্মানি। এই অস্ট্রিয়ার নয়নাভিরাম ভিয়েনা, তো আবার সেই ভারতের দুর্গম দেরাদুন।
তার কাজের ব্যাপ্তির একটা-দু’টো বড়সড় স্বীকৃতিও মিলেছে। বনপ্রানি সংরক্ষনে গবেষনার জন্যে ২০১৩ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার, বঙ্গবন্ধু পদক দেয়া হয়। নির্বিকার চপ্পল পায়ে আব্বা পদক নিচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে-এমন ছবি আছে আমাদের সংগ্রহে। স্বীকৃতি তার কাছে ছিল বোনাস। সৃষ্টি সুখের উল্লাসটাই ছিল আসল পাওয়া।
আর তাই বাবার স্মৃতি মানেই সোনালি খাঁচায় ডোরাকাটা অগুনতি রোমাঞ্চকর দিন। (সমাপ্ত)
২৫ শে অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১২:০১
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: সালাম। ভাল আছেন? জি, করছি। তবে গবেষনা নয়, ক্যান্সারের ওষুধ আর অন্য থেরাপি বাজারে আসার আগে যে ক্লিনিক্যাল স্টাডি হয়, সে সব রিপোর্ট লেখার কাজ করছি। মেডিকেল রাইটার আর কি। দোয়া করবেন আমার বাবার জন্যে।
২| ২৫ শে অক্টোবর, ২০২২ ভোর ৬:১৬
কবিতা ক্থ্য বলেছেন: আমার সবচাইতে প্রিয় মানুষটা থাকতেন ফুলার রোড এ।
তাঁর নাম আব্দুল মাতিন। সম্পর্কে উনি আমার খালু। উনি ছিলেন বোটানি বিভাগে।
খালা মসুদা মাতিন; উনিও বোটানি তে প্রফেসর ছিলেন। খালুর মারা যান কয়েক বছর আগে। খালা রিটায়ার করার পরে তাদের ফুলার রোডের বাসা টা ছেড়ে দিতে হয়।
আমার বেশ কিছু স্মৃতি আছে ফুলার রোডে।
আপনার বাবা কে জিগাস করেন বোটানির আব্দুল মাতিন এবং মাসুদা মাতিন কে চিনতেন কি না।
২৫ শে অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১২:০২
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। বাবা নেই আর। মাকে জিজ্ঞেস করবো। সেও প্রানিবিদ্যার অধ্যাপক ছিল।
৩| ২৫ শে অক্টোবর, ২০২২ সকাল ৯:০২
শেরজা তপন বলেছেন: এমন একজন মহান মানুষের প্রতি অতল শ্রদ্ধা!
আপনার লেখার ভাষায় মনে হচ্ছে তিনি আর বেঁচে নেই!
এমন একজন বাবা পাওয়া বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার। আপনার বাবার এমন মহান কৃর্তী নিয়ে আরো কিছু লিখুন।
২৫ শে অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১২:০৩
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: অনেক শ্রদ্ধা আপনার প্রতিও। কথাগুলো মন ছুয়ে গেছে।
৪| ২৫ শে অক্টোবর, ২০২২ বিকাল ৩:৪৫
রাজীব নুর বলেছেন: আপনি অন্য কারো পোষ্ট পড়েন না কেন? মন্তব্য করেন না কেন?
আমি রাগ করেছি।
২৫ শে অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩২
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: রাজীব ভাই, কি করে যেন সব সামলে পেরে উঠি না। পড়া আর লেখার মধ্যে পড়ার অভ্যাস প্রায় গেছে। এখন লেখার সময়টাও যায় যায়।
৫| ২৫ শে অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৪৬
মিরোরডডল বলেছেন:
যোগ্য বাবার যোগ্য কন্যা ।
বাবার স্মৃতি এতো চমৎকার করে লিখেছে আমি মুগ্ধ !
বাবার জন্য অনেক শ্রদ্ধা আর মেয়ের জন্য শুভকামনা ।
রিমাপুর কাছ থেকে এরকম লেখা আরও চাই ।
২৫ শে অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৫৬
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: আন্তরিক ধন্যবাদ নেবেন আপনার কথাগুলোর বনামে।
৬| ২৬ শে অক্টোবর, ২০২২ সকাল ৭:৩৯
কবিতা ক্থ্য বলেছেন: আমার খালার ২ ছেলে ১ মেয়ে।
বড় ছেলে - শুভ- আমেরিকাতে থাকে আর পড়েছে ইকনোমিক্স এ
মেজো ছেলে- অনিক - সে ও আমেরিকাতে থাকে
ছোটো মেয়ে পৃথুলা- সে ঢাবি তে পড়তো।
আপনকি এদের কাউকে চিনতেন?
০২ রা নভেম্বর, ২০২২ রাত ২:০৯
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: আমার বয়সের তুলনায় স্মৃতিশক্তি বেশ ক্ষীণ। তবে আমি আমার মাকে জিজ্ঞেস করে দেখবো। জ্যুলজির অধ্যাপক বোটানির প্রফেসরকে চিনবেন নিশ্চয়ই।
৭| ৩০ শে অক্টোবর, ২০২২ সকাল ৭:১৪
সোহানী বলেছেন: অনেক ভালো লাগলো তোমার স্মৃতিকথা। তোমার বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থাকলো।
০২ রা নভেম্বর, ২০২২ রাত ২:১০
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: আপু, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমাদের বাবার জন্যে দোয়া করবেন।
©somewhere in net ltd.
১| ২৫ শে অক্টোবর, ২০২২ ভোর ৬:০৭
সোনাগাজী বলেছেন:
ক্যান্সার নিয়ে কাজ করছেন এখনো?