নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গবেষক, পাঠক ও লেখক -- Reader, Thinker And Writer। কালজয়ী- কালের অর্থ নির্দিষ্ট সময় বা Time। কালজয়ী অর্থ কোন নির্দিষ্ট সময়ে মানুষের মেধা, শ্রম, বুদ্ধি, আধ্যাত্মিকতা ও লেখনীর বিজয়। বিজয় হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী চিন্তার বিজয়।

*কালজয়ী*

সভ্যতার উৎকর্ষ শুরু মানুষের মেধা, শ্রম, বুদ্ধি, আধ্যাত্মিকতা ও লেখনীর মাধ্যমে। ক্রম উন্নয়নের ধারায় শিক্ষা-ক্ষেত্রে কলমের কালীর রং কখনো কালো, কখনওবা সাদা। প্রাথমিক যুগে আবক্ষ শক্ত ভিত্তিতে (ব্লাকবোর্ডে) লিখতে ব্যবহৃত হত সাদা চক যা এখনো বিদ্যমান। বর্তমানে সাদা বোর্ডে কালো মার্কার কলম ও কালো বোর্ডে সাদা মার্কার কলম। কি-বোর্ডে সাদা-কালো অক্ষর বাটন নব প্রযুক্তির অবদান। Believes in the ultimate potential of Human Mind……

*কালজয়ী* › বিস্তারিত পোস্টঃ

পূর্ব বাংলার এক অকুতোভয় যোদ্ধা শহীদ মোহাম্মাদ রুহুল আমীনঃ হার না মানা এক বীরকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ … পর্ব (২)

১০ ই ডিসেম্বর, ২০২১ ভোর ৬:৩৩

পূর্ব বাংলার এক অকুতোভয় যোদ্ধা শহীদ মোহাম্মাদ রুহুল আমীনঃ হার না মানা এক বীরকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ … পর্ব (১)

সম্মুখ সমরে নৌ-কমান্ডো ইউনিট

৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে যশোর সেনানিবাসের পতন ঘটে। ৬ই ডিসেম্বর মংলা বন্দরে পাকিস্তানী নৌ ঘাটি পি. এন. এস. তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে 'পদ্মা', 'পলাশ' ও মিত্র বাহিনীর গানবোট (INS- Indian Navy) 'পানভেল' (এই রণতরী রাশিয়া থেকে ১৯৬৭ সালে ক্রয় করা) ভারতের হলদিয়া নৌ ঘাটি থেকে রওনা হয়। বাংলাদেশী কোনো অভিজ্ঞ উচ্চ পর্যায়ের নৌযোদ্ধা না থাকার কারণে (!!!) এই নৌ-অভিযানের অফিসার ইন টেকনিক্যাল কমান্ডের দায়িত্ব নেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন মহেন্দ্রনাথ সামন্ত। মুক্তিবাহিনীর পলাশ গানবোটের ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার ছিলেন মো. রুহুল আমিন। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা ৭ ডিসেম্বর ভারত থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন বাংলাদেশ অভিমুখে। দুই গানবোটে তাঁরা ছিলেন ৫৬ জন।


ছবিঃ ইন্ডিয়ান নেভি রণতরী “প্যানভেল”।

৮ই ডিসেম্বর সুন্দরবনের আড়াই বানকিতে বিএসএফের পেট্রোল ক্রাফট (INS- Indian Navy) 'চিত্রাঙ্গদা' তাদের বহরে যোগ দেয়। ৯ই ডিসেম্বর কোন বাধা ছাড়াই তারা হিরণ পয়েন্টে প্রবেশ করেন। পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত খুলনাস্থ নৌঘাটি দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে ভারতীয় গানবোট (INS- Indian Navy) পানভেলের সাথে যুক্ত হয়ে ১০ ডিসেম্বর মংলা বন্দরে পৌঁছায়। সেখানে পাকিস্তানি সেনা ও নৌবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। 'পলাশ' ও 'পদ্মা' মংলা বন্দর হয়ে খুলনার দিকে রওয়ানা দেয়। গানবোট (INS- Indian Navy) 'পানভেল' সামনে আর পেছনে 'পলাশ' ও 'পদ্মা'। কোনোরকম প্রতিরোধ ব্যতীতই তিনটি গানবোট/রণতরী পৌঁছে গেল মংলা বন্দরে। সকাল তখন সাড়ে সাতটা। মংলা বন্দরেই থেকে গেল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী (বিএসএফ)’র পেট্রলক্র্যাফট (INS- Indian Navy ) ‘চিত্রাঙ্গদা’। শুরু হলো মূল অভিযান। মংলা বন্দর পার হয়ে গানবোট/ রণতরীগুলো আরও ভেতরে খুলনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।


ছবিঃ ভারতীয় নৌ-বাহিনীর ক্যাপ্টেন (cdr) মহেন্দ্রনাথ সামন্ত।

১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষের দিকে, খুলনার রূপসা নদীতে একটি ঘটনা ঘটে। ১০ই ডিসেম্বর ভোর ৪টায় তারা মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সকাল ৭টায় কোন বাধা ছাড়াই তারা মংলায় পৌছান। পেট্রোল ক্রাফট চিত্রাঙ্গদা মংলাতেই অবস্থান নেয় এবং পানভেল, পদ্মা ও পলাশ সামনে অগ্রসর হওয়া আরম্ভ করে। একসময় বটিয়াঘটা পেছনে ফেলে দুপুর বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে গানবোটগুলো খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে এলে - এ সময় আকাশে দেখা যায় তিনটি জঙ্গি বিমান। শত্রুবিমান মনে করে মো. রুহুল আমিন সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দেন বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র (কামান) দিয়ে বিমান প্রতিরোধের। তাঁর সহযোদ্ধারা দ্রুত প্রস্তুত হন। পাকিস্তানি বিমান ভেবে পদ্মা ও পলাশ থেকে গুলি করার অনুমতি চাওয়া হয়। কিন্তু অভিযানের সর্বাধিনায়ক ক্যাপ্টেন (cdr) মহেন্দ্রনাথ সামন্ত (ভারতীয়/মিত্রবাহিনীর গানবোট প্যানভেল) ওয়্যারলেসের মাধ্যমে জানালেন, বিমানগুলো ভারতের (পশ্চিমবঙ্গের) দক্ষিন দিনাজপুরের এয়ারফিল্ড (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ নির্মিত অস্থায়ী বিমানবন্দর যা পরবর্তীতে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও ব্যবহৃত হয় এবং বর্তমানে সেখানে বালুরঘাট বিমানবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ) থেকে এসেছে। সুতরাং উদ্বিগ্ন হবার মতো কোনো কারণ নেই। শুনে সবাই আক্রমণের প্রস্তুতি থেকে বিরত থাকল। কারণ ভারতীয় বিমান বাহিনীকে জানানো হয়েছিল এই এলাকায় যাতে কোনো ভাবেই বোম্বিং না করা হয়। আর তাছাড়া গানবোটগুলোর উপরিভাগ হলুদ রঙের কাপড় (১৫ ফুট লম্বা এবং ১০ ফুট চওড়া) বিছানো ছিল এবং মিত্রবাহিনীকে জানানো হয়েছিল হলুদ রং করা গানবোটগুলো আমাদের, অর্থাৎ এই গানবোটগুলোতে আক্রমণ করা যাবে না।

বিমানগুলো কিছুটা নিচে নেমে দক্ষিণ-পশ্চিমে সাগরের দিকে যায়। ১০-১১ মিনিট পর অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাত্ ঘুরে এসে বোমা বর্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের রণতরী পদ্মার ওপর। এরপর আবার বিমানগুলো পেছন দিক থেকে উড়ে এল। কোনোরকম বাধা ছাড়াই চালাল বোমাবর্ষণ। একটা বোমা এসে পড়ল ‘পলাশ-এর ওপর। ধ্বংস হলো ইঞ্জিনরুম। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলো না। বরং জাহাজে রাখা গোলাবারুদ ফুটতে শুরু করল।

কিন্তু ভারতীয় জাহাজটি সম্পূর্ণ অক্ষত থেকে যায় (!!!), কারণ বিমানগুলো সেটিকে লক্ষ করে হামলাই করেনি। প্রথম গোলা এসে পড়ে 'পদ্মা'য় এবং পরবর্তীতে 'পলাশে'। গোলা সরাসরি 'পদ্মা'র ইঞ্জিন রুমে আঘাত করে ইঞ্জিন বিধ্বস্ত করে। হতাহত হয় অনেক নাবিক। 'পদ্মা'-র পরিণতিতে পলাশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায় চৌধুরী নাবিকদের জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। রুহুল আমিন এই আদেশ মানতে পারেন নি। তিনি উপস্থিত সবাইকে যুদ্ধ বন্ধ না করার আহ্বান করেন। কামানের ক্রুদের বিমানের দিকে গুলি ছুঁড়তে বলে ইঞ্জিন রুমে ফিরে আসেন। শত্রুবিমান মনে করে মোঃ মহিবুল্লাহরা বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলা বর্ষণ করতে উদ্যত হন। কিন্তু অধিনায়কের আদেশ অমান্য করে বিমানগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। বিমানগুলো উপর্যুপরি বোমাবর্ষণ করে পলাশের ইঞ্জিনরুম ধ্বংস করে দেয়। আহত হন তিনি। কিন্তু অসীম সাহসী রুহুল আমিন তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যান 'পলাশ'কে বাঁচানোর। তবে ইঞ্জিন বিকল হয়ে আগুন ধরে যায়।

সূর্যপ্রতিম বীরের মৃত্যু ও সংরক্ষিত সমাধি

বোমার আঘাতে মুক্তিবাহিনীর গানবোটে আগুন ধরে যায়। বিপদ বুঝে যাঁরা আগেই পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, তাঁরা অক্ষত থাকেন। কিন্তু রুহুল আমিনসহ অনেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গানবোটেই ছিলেন। প্রথম আঘাতেই বোমার স্প্লিন্টার লেগে তাঁর বাঁ হাত ভেঙে যায়। তিনি মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এক সহযোদ্ধা (তাঁর নামও রুহুল আমিন) তাঁকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোঃ মহিবুল্লাহসহ যারা রণতরীতে ছিলেন, তারা শহীদ হন, নয়তো মারাত্মকভাবে আহত হন। মোঃ মহিবুল্লাহ প্রথম বিমান হামলাতেই শহীদ হন। প্রাণশক্তিতে ভরপুর বীরযোদ্ধা রুহুল আমিন একসময় পাড়েও এসে পৌঁছান। কিন্তু পাড়ে উঠার পর প্রতিপক্ষ বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা নিহত ও শহীদ হন। পরবর্তীতে স্থানীয় জনসাধারণ বাগমারা গ্রামে রূপসা নদীর পাড়ে তাকে দাফন করে এবং সেখান একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। তাঁর সমাধি চিহ্নিত ও সংরক্ষিত। পাড়ে উঠে আসা নৌ-কমান্ডোদের অনেককেই প্রতিপক্ষ বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা রুহুল আমিনের মতই হত্যা করে। ১৮ ডিসেম্বর নৌ-মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংসপ্রাপ্ত গানবোট/ রণতরী থেকে দুটি মরদেহ উদ্ধার করেন। এর মধ্যে একটি ছিল শহীদ মহিবুল্লাহর। আটদিনে তার মরদেহ শুকিয়ে হাড়ের সঙ্গে কেবল চামড়া লেগে ছিল। তারপরও সহযোদ্ধাদের তার মরদেহ চিনতে কষ্ট হয়নি।

মোহাম্মদ রুহুল আমিন (১৯৩৪/৩৫-১৯৭১) ছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একজন ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসার যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সেবা এবং সাহসিকতার জন্য মরণোত্তর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বীরত্ব পুরস্কার বীরশ্রেষ্ঠে ভূষিত হন। তিনি ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনএস পলাশের গানবোটে/রণতরীতে দায়িত্বরত অবস্থায় নিহত/ শহীদ হন যা ভারতীয় বিমান বাহিনীর (আইএএফ) একটি রহস্যময় অভিযানের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। (অসমাপ্ত)

তথ্যসূত্রঃ

[১] রহমান, মতিউর. (২০১৩). “একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা”, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩।
[২] জাতীয় তথ্য বাতায়ন. (২০২০). মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়; গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
[৩] বাংলাপিডিয়া. (১৮ মে, ২০১৮). “বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মাদ রুহুল আমিন”
[৪] বাংলা ট্রিবিউন. (১০ ডিসেম্বর, ২০১৭). “বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন”
[৫] ওবায়দুল হক.(২০২০). “বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর ভ্রমণ দিক-নির্দেশনা”
[৬] শেখ জাহিদুল ইসলাম. (২০২০). “বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের সমাধিক্ষেত্র ভ্রমণ দিক-নির্দেশনা”
[৭] Staff Correspondent. (26 May, 2008). "M M Ruhul Amin new chief justice". The Daily Star
[৮] Malik, Sarita. (10 June 2015). "Ruhul gears up for Hason Raja". Asian Lite News. Retrieved 1 October 2015.
[৯] লেফটেন্যান্ট (অন.) আব্দুল হাই ভূঁঞা বিএন (অব.). (১০ মার্চ, ২০১৫). “মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ”
[১০] মেজর রফিকুল ইসলাম, পিএসসি. (২০১৩) “মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন”, অনন্যা প্রকাশনী; দ্বিতীয় মুদ্রণ , বাংলাদেশ
[১১] স. ম. বাবর আলী. (২০১০). “স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান”, “সাকোবাড়ি প্রকাশন”
[১২] এহসান হাবীব. (৫ সেপ্টেম্বর, ২০১০). “বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন”
[১৩] দেবারতি গুহ. (৬ এপ্রিল, ২০১১). ‘রুহুলের মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় মানুষ’. Deutsche Welle
[১৪] somoynews.tv (). “বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মাদ রুহুল আমিন’র স্মৃতিচারণ”. [Remembrace of Birshrestho Ruhul Amin]. Facebook. বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মাদ রুহুল আমিন’র স্মৃতিচারণ

[১৫] Teamnoakhali/blog. (৩ আগস্ট, ২০১৯) . “বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন || নোয়াখালীর গর্ব”

[১৬] জাতীয় তথ্য বাতায়ন. (৭ মে, ২০২০). গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। সরকারী ওয়েবসাইটঃ
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বঃ

৯নং দেওটি ইউনিয়ন যেখানে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মাদ রুহুল আমিন ও প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বরা জন্মগ্রহন করেন


চলবে........................


Copyright (C): All Rights Reserved

সম্মুখ সমরে নৌ-কমান্ডো ইউনিট

৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে যশোর সেনানিবাসের পতন ঘটে। ৬ই ডিসেম্বর মংলা বন্দরে পাকিস্তানী নৌ ঘাটি পি. এন. এস. তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে 'পদ্মা', 'পলাশ' ও মিত্র বাহিনীর গানবোট (INS- Indian Navy) 'পানভেল' (এই রণতরী রাশিয়া থেকে ১৯৬৭ সালে ক্রয় করা) ভারতের হলদিয়া নৌ ঘাটি থেকে রওনা হয়। বাংলাদেশী কোনো অভিজ্ঞ উচ্চ পর্যায়ের নৌযোদ্ধা না থাকার কারণে (!!!) এই নৌ-অভিযানের অফিসার ইন টেকনিক্যাল কমান্ডের দায়িত্ব নেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন মহেন্দ্রনাথ সামন্ত। মুক্তিবাহিনীর পলাশ গানবোটের ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার ছিলেন মো. রুহুল আমিন। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা ৭ ডিসেম্বর ভারত থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন বাংলাদেশ অভিমুখে। দুই গানবোটে তাঁরা ছিলেন ৫৬ জন।


ছবিঃ ইন্ডিয়ান নেভি রণতরী “প্যানভেল”।

৮ই ডিসেম্বর সুন্দরবনের আড়াই বানকিতে বিএসএফের পেট্রোল ক্রাফট (INS- Indian Navy) 'চিত্রাঙ্গদা' তাদের বহরে যোগ দেয়। ৯ই ডিসেম্বর কোন বাধা ছাড়াই তারা হিরণ পয়েন্টে প্রবেশ করেন। পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত খুলনাস্থ নৌঘাটি দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে ভারতীয় গানবোট (INS- Indian Navy) পানভেলের সাথে যুক্ত হয়ে ১০ ডিসেম্বর মংলা বন্দরে পৌঁছায়। সেখানে পাকিস্তানি সেনা ও নৌবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। 'পলাশ' ও 'পদ্মা' মংলা বন্দর হয়ে খুলনার দিকে রওয়ানা দেয়। গানবোট (INS- Indian Navy) 'পানভেল' সামনে আর পেছনে 'পলাশ' ও 'পদ্মা'। কোনোরকম প্রতিরোধ ব্যতীতই তিনটি গানবোট/রণতরী পৌঁছে গেল মংলা বন্দরে। সকাল তখন সাড়ে সাতটা। মংলা বন্দরেই থেকে গেল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী (বিএসএফ)’র পেট্রলক্র্যাফট (INS- Indian Navy ) ‘চিত্রাঙ্গদা’। শুরু হলো মূল অভিযান। মংলা বন্দর পার হয়ে গানবোট/ রণতরীগুলো আরও ভেতরে খুলনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।


ছবিঃ ভারতীয় নৌ-বাহিনীর ক্যাপ্টেন (cdr) মহেন্দ্রনাথ সামন্ত।

১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষের দিকে, খুলনার রূপসা নদীতে একটি ঘটনা ঘটে। ১০ই ডিসেম্বর ভোর ৪টায় তারা মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সকাল ৭টায় কোন বাধা ছাড়াই তারা মংলায় পৌছান। পেট্রোল ক্রাফট চিত্রাঙ্গদা মংলাতেই অবস্থান নেয় এবং পানভেল, পদ্মা ও পলাশ সামনে অগ্রসর হওয়া আরম্ভ করে। একসময় বটিয়াঘটা পেছনে ফেলে দুপুর বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে গানবোটগুলো খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে এলে - এ সময় আকাশে দেখা যায় তিনটি জঙ্গি বিমান। শত্রুবিমান মনে করে মো. রুহুল আমিন সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দেন বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র (কামান) দিয়ে বিমান প্রতিরোধের। তাঁর সহযোদ্ধারা দ্রুত প্রস্তুত হন। পাকিস্তানি বিমান ভেবে পদ্মা ও পলাশ থেকে গুলি করার অনুমতি চাওয়া হয়। কিন্তু অভিযানের সর্বাধিনায়ক ক্যাপ্টেন (cdr) মহেন্দ্রনাথ সামন্ত (ভারতীয়/মিত্রবাহিনীর গানবোট প্যানভেল) ওয়্যারলেসের মাধ্যমে জানালেন, বিমানগুলো ভারতের (পশ্চিমবঙ্গের) দক্ষিন দিনাজপুরের এয়ারফিল্ড (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ নির্মিত অস্থায়ী বিমানবন্দর যা পরবর্তীতে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও ব্যবহৃত হয় এবং বর্তমানে সেখানে বালুরঘাট বিমানবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ) থেকে এসেছে। সুতরাং উদ্বিগ্ন হবার মতো কোনো কারণ নেই। শুনে সবাই আক্রমণের প্রস্তুতি থেকে বিরত থাকল। কারণ ভারতীয় বিমান বাহিনীকে জানানো হয়েছিল এই এলাকায় যাতে কোনো ভাবেই বোম্বিং না করা হয়। আর তাছাড়া গানবোটগুলোর উপরিভাগ হলুদ রঙের কাপড় (১৫ ফুট লম্বা এবং ১০ ফুট চওড়া) বিছানো ছিল এবং মিত্রবাহিনীকে জানানো হয়েছিল হলুদ রং করা গানবোটগুলো আমাদের, অর্থাৎ এই গানবোটগুলোতে আক্রমণ করা যাবে না।

বিমানগুলো কিছুটা নিচে নেমে দক্ষিণ-পশ্চিমে সাগরের দিকে যায়। ১০-১১ মিনিট পর অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাত্ ঘুরে এসে বোমা বর্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের রণতরী পদ্মার ওপর। এরপর আবার বিমানগুলো পেছন দিক থেকে উড়ে এল। কোনোরকম বাধা ছাড়াই চালাল বোমাবর্ষণ। একটা বোমা এসে পড়ল ‘পলাশ-এর ওপর। ধ্বংস হলো ইঞ্জিনরুম। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলো না। বরং জাহাজে রাখা গোলাবারুদ ফুটতে শুরু করল।

কিন্তু ভারতীয় জাহাজটি সম্পূর্ণ অক্ষত থেকে যায় (!!!), কারণ বিমানগুলো সেটিকে লক্ষ করে হামলাই করেনি। প্রথম গোলা এসে পড়ে 'পদ্মা'য় এবং পরবর্তীতে 'পলাশে'। গোলা সরাসরি 'পদ্মা'র ইঞ্জিন রুমে আঘাত করে ইঞ্জিন বিধ্বস্ত করে। হতাহত হয় অনেক নাবিক। 'পদ্মা'-র পরিণতিতে পলাশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায় চৌধুরী নাবিকদের জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। রুহুল আমিন এই আদেশ মানতে পারেন নি। তিনি উপস্থিত সবাইকে যুদ্ধ বন্ধ না করার আহ্বান করেন। কামানের ক্রুদের বিমানের দিকে গুলি ছুঁড়তে বলে ইঞ্জিন রুমে ফিরে আসেন। শত্রুবিমান মনে করে মোঃ মহিবুল্লাহরা বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলা বর্ষণ করতে উদ্যত হন। কিন্তু অধিনায়কের আদেশ অমান্য করে বিমানগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। বিমানগুলো উপর্যুপরি বোমাবর্ষণ করে পলাশের ইঞ্জিনরুম ধ্বংস করে দেয়। আহত হন তিনি। কিন্তু অসীম সাহসী রুহুল আমিন তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যান 'পলাশ'কে বাঁচানোর। তবে ইঞ্জিন বিকল হয়ে আগুন ধরে যায়।

সূর্যপ্রতিম বীরের মৃত্যু ও সংরক্ষিত সমাধি

বোমার আঘাতে মুক্তিবাহিনীর গানবোটে আগুন ধরে যায়। বিপদ বুঝে যাঁরা আগেই পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, তাঁরা অক্ষত থাকেন। কিন্তু রুহুল আমিনসহ অনেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গানবোটেই ছিলেন। প্রথম আঘাতেই বোমার স্প্লিন্টার লেগে তাঁর বাঁ হাত ভেঙে যায়। তিনি মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এক সহযোদ্ধা (তাঁর নামও রুহুল আমিন) তাঁকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোঃ মহিবুল্লাহসহ যারা রণতরীতে ছিলেন, তারা শহীদ হন, নয়তো মারাত্মকভাবে আহত হন। মোঃ মহিবুল্লাহ প্রথম বিমান হামলাতেই শহীদ হন। প্রাণশক্তিতে ভরপুর বীরযোদ্ধা রুহুল আমিন একসময় পাড়েও এসে পৌঁছান। কিন্তু পাড়ে উঠার পর প্রতিপক্ষ বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা নিহত ও শহীদ হন। পরবর্তীতে স্থানীয় জনসাধারণ বাগমারা গ্রামে রূপসা নদীর পাড়ে তাকে দাফন করে এবং সেখান একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। তাঁর সমাধি চিহ্নিত ও সংরক্ষিত। পাড়ে উঠে আসা নৌ-কমান্ডোদের অনেককেই প্রতিপক্ষ বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা রুহুল আমিনের মতই হত্যা করে। ১৮ ডিসেম্বর নৌ-মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংসপ্রাপ্ত গানবোট/ রণতরী থেকে দুটি মরদেহ উদ্ধার করেন। এর মধ্যে একটি ছিল শহীদ মহিবুল্লাহর। আটদিনে তার মরদেহ শুকিয়ে হাড়ের সঙ্গে কেবল চামড়া লেগে ছিল। তারপরও সহযোদ্ধাদের তার মরদেহ চিনতে কষ্ট হয়নি।

মোহাম্মদ রুহুল আমিন (১৯৩৪/৩৫-১৯৭১) ছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একজন ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসার যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সেবা এবং সাহসিকতার জন্য মরণোত্তর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বীরত্ব পুরস্কার বীরশ্রেষ্ঠে ভূষিত হন। তিনি ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনএস পলাশের গানবোটে/রণতরীতে দায়িত্বরত অবস্থায় নিহত/ শহীদ হন যা ভারতীয় বিমান বাহিনীর (আইএএফ) একটি রহস্যময় অভিযানের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। (অসমাপ্ত)

তথ্যসূত্রঃ

[১] রহমান, মতিউর. (২০১৩). “একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা”, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩।
[২] জাতীয় তথ্য বাতায়ন. (২০২০). মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়; গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
[৩] বাংলাপিডিয়া. (১৮ মে, ২০১৮). “বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মাদ রুহুল আমিন”
[৪] বাংলা ট্রিবিউন. (১০ ডিসেম্বর, ২০১৭). “বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন”
[৫] ওবায়দুল হক.(২০২০). “বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর ভ্রমণ দিক-নির্দেশনা”
[৬] শেখ জাহিদুল ইসলাম. (২০২০). “বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের সমাধিক্ষেত্র ভ্রমণ দিক-নির্দেশনা”
[৭] Staff Correspondent. (26 May, 2008). "M M Ruhul Amin new chief justice". The Daily Star
[৮] Malik, Sarita. (10 June 2015). "Ruhul gears up for Hason Raja". Asian Lite News. Retrieved 1 October 2015.
[৯] লেফটেন্যান্ট (অন.) আব্দুল হাই ভূঁঞা বিএন (অব.). (১০ মার্চ, ২০১৫). “মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ”
[১০] মেজর রফিকুল ইসলাম, পিএসসি. (২০১৩) “মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন”, অনন্যা প্রকাশনী; দ্বিতীয় মুদ্রণ , বাংলাদেশ
[১১] স. ম. বাবর আলী. (২০১০). “স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান”, “সাকোবাড়ি প্রকাশন”
[১২] এহসান হাবীব. (৫ সেপ্টেম্বর, ২০১০). “বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন”
[১৩] দেবারতি গুহ. (৬ এপ্রিল, ২০১১). ‘রুহুলের মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় মানুষ’. Deutsche Welle
[১৪] somoynews.tv (). “বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মাদ রুহুল আমিন’র স্মৃতিচারণ”. [Remembrace of Birshrestho Ruhul Amin]. Facebook. বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মাদ রুহুল আমিন’র স্মৃতিচারণ

[১৫] Teamnoakhali/blog. (৩ আগস্ট, ২০১৯) . “বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন || নোয়াখালীর গর্ব”

[১৬] জাতীয় তথ্য বাতায়ন. (৭ মে, ২০২০). গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। সরকারী ওয়েবসাইটঃ
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বঃ

৯নং দেওটি ইউনিয়ন যেখানে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মাদ রুহুল আমিন ও প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বরা জন্মগ্রহন করেন


চলবে........................


Copyright (C): All Rights Reserved

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ৭:৩৩

Abida-আবিদা বলেছেন: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ। তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়। ভারতীয় নৌ বাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বহরে থাকা স্বত্বেও কেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণ মুক্তিযোদ্ধাদের বহনকারী রণতরীর উপর হল? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া দুরূহ, তবে অসম্ভব নয়। আশা রাখি একদিন সত্য উন্মোচন হবে। ধন্যবাদ।

২| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:২৮

চাঁদগাজী বলেছেন:



ভয়ংকর ঘটনা, কোন ধরণের কো-অরডিনেশন ছিলো বলে মনে হয় না। এই ধরণের যুদ্ধে ২/৪টা ভ্রান্তি হওয়া খুবই সম্ভব।

৩| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:২৯

চাঁদগাজী বলেছেন:


শিরোনামে "বাংলাদেশ" শব্দের স্হানে "পুর্ব বাংলা" শব্দটা আসার পেছনে কোন কারণ আছে?

৪| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১১:২৭

রাজীব নুর বলেছেন: এডিট করে ঠিক করে নিন।
লেখাটা দুবার এসেছে।

৫| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১:৪৭

নেওয়াজ আলি বলেছেন: উত্তর দিলে ভালো হয় মন্তব্যের

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.