![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
৮।।
এই প্রথম সাগর পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখলো তনুজা। অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য। সে অভিভুত হয়ে গেলো। সূর্যোদয় সে আগেও দেখেছে কিন্তু সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে এই প্রথম দেখলো। এই দৃশ্যের সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয়না। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আবির। এক হাতে তনুজার একটা হাত ধরে রেখেছে। সমস্ত ক্রেডিট তো ওরই। ভোরে হোটেলে পৌছেই তনুজা ঘুমুবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আবির এক রকম জোর করেই ওকে সাগরের পাড়ে নিয়ে এসেছে। এই সূর্যোদয় দেখাবে বলে। মনে মনে আবিরকে ধন্যবাদ দিলো তনুজা; এত সুন্দর একটা দৃশ্য দেখানোর জন্য। তারপরেই ওর মনে হলো, নাহ, মনে মনে ধন্যবাদ দিলে হবেনা। মুখেই বলতে হবে। এই সাত সকালে সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে জীবনসঙ্গীর হাত ধরে সূর্যোদয় দেখার মত আনন্দের আর কিছু হতে পারেনা।
- আপনাকে এত্তগুলা থ্যাংক ইউ।
- কেন?
- আপনি এখানে নিয়ে না আসলে এই অপূর্ব দৃশ্য দেখতেই পারতাম না।
- তুমি তো আসতেই চাওনাই।
- কি করবো? রাতের বেলা ট্রেনে ঘুম হয়নাই। আমার মাইগ্রেনের প্রবলেম আছে। মাথার ব্যাথায় টিকতে পারতেছিলাম না। মনে হচ্ছিল, হোটেলে গিয়েই একটা ঘুম দিব।
- এখন মাথা ব্যাথা করতেছেনা?
- হুম। এখনো আছে। কিন্তু আগের মত এতটা খারাপ লাগতেছেনা।
- সহ্য করো। আজকের আর কালকের দিনটাই তো। পরশুদিন সকালে রওনা হবো।
হঠাত আবিরের ফোন বেজে উঠলো। আবির বললো, তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি আসতেছি।
- কোথায় যাচ্ছেন?
- আম্মা ফোন করেছে। কথা বলে আসি।
তনুজা একা দাঁড়িয়ে থাকলো। একটা হালকা বাতাস ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সূর্যের আলোটা অনেকখানি ছড়িয়ে পড়েছে। জোয়ারের পানিগুলো পায়ের উপর আছড়ে পড়ছে। একটু পর আবির ফিরে আসলো। এসেই ওকে তাড়া দিলো, চলো যাই। চোখে মুখে একটা রাগের ছাপ। তনুজা মনে মনে ভাবলো, কি এমন কথা হলো ফোনে?? এরকম করে আবিরের মুড অফ হয়ে গেলো। কিছুক্ষন আগেও তো মন মেজাজ ভালো ছিল।
হোটেলে ফিরে বুঝতে পারলো, আবিরের আম্মা চিল্লাচিল্লি করতেছে। যদিও চিল্লাচিল্লি করার কারনটা ওর বোধগম্য হলো না। ঢাকা থেকে তনিমা ফোন করে জানালো, ওরা ট্রেনে উঠার পরে ওর শাশুড়ি নাকি ওদের বাসায় ফোন করেছিলেন। আগের দিনের ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে তিনি ওর চাচার সাথে অনেক ঝগড়া করেছেন। এও বলেছেন যে, বিয়ের পরের দিন সকাল সকাল আবির ওদের বাসায় গিয়েছে। ওরা নাকি নতুন জামাইকে ঠিকমত আপ্যায়ন করেনি। তখন চাচা জানিয়েছেন, তিনি আবিরের আসার কথা কিছুই জানতেন না। তনুজার শাশুড়ি বলেছেন, তনুজা সব জানতো। সে কেন আপনাদের জানায়নি, সেটা আপনাদের মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন।
তনুজার শাশুড়ি শুধু ওদের বাসাতে ফোন করেই ক্ষান্ত হননি; আবিরকে বারবার ফোন করে অনেক কথা শুনাচ্ছেন। এর মধ্যে একবার ওর সাথেও কথা বলেছেন। কথা বলেছেন না বলে বলা ভালো, কথা শুনিয়েছেন। এরকম ফ্যামিলিতে ছেলেকে বিয়ে করানো উচিত হয়নাই। ওর মধ্যে আবির কি দেখলো, কে জানে। বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেল। ওর মত মেয়েরা নাকি তাদের বাড়ির বউ হবার কোন যোগ্যতা রাখেনা। তনুজা সবকিছু চুপচাপ শুনে গেলো। এই সময়ে কথার পিঠে কথা না বলাই ভালো হবে। তাছাড়া শাশুড়ির মুখে মুখে সব কথার উত্তর দিতে হবে এমন কোন কথা নাই। সে ছোট থেকে দেখে এসেছে, ওর দাদী ওর আম্মাকে কত কথা বলতেন। আম্মা কখনো সেসব কথা মনে রাখেন নি। এক কান দিয়ে ঢুকিয়েছেন, আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছেন। আম্মার কাছ থেকেই সে জেনেছে, শাশুড়ি হচ্ছে মুরব্বী। মায়ের মতন। তিনি তো কত রকম কথা বলবেনই। সব কথা ধরলে হয়না। তাই চুপচাপ শুনে যাওয়াই ভালো। মুখে মুখে কথা বললে বেয়াদবি করা হবে। ফোন রেখে তনুজা আবিরকে জিজ্ঞেস করলো,
- আপনি আপনার আম্মার কাছে কি বলেছেন?
- কি বলেছি?
- আমাদের বাসায় নাকি আপনাকে ঠিক মত আপ্যায়ন করা হয়নাই।
- যা সত্যি সেটাই বলছি। আমি কি এখন আম্মার কাছে মিথ্যা কথা বলব নাকি?
- আগে থেকে না জানালে কেমনে হবে? হুট করে হাজির হয়ে গেছেন বাসায়।
- তুমি তো জানোই যে, আমি তোমাকে নিতে আসবো। তোমার সাথে ফোনে সেরকম কথাই হইছিল।
- আপনি বলছিলেন, আপনাদের বাসায় যাবার কথা। আমি রাজি হইলে আপনি এসে নিয়ে যাবেন। আমি তখন বলছিলাম, চাচা আর আম্মাকে জিজ্ঞেস করে জানাবো। তার আগেই আপনি এসে পড়ছেন।
- আমি তোমাকে ফোন করছিলাম ৩ ঘন্টা আগে।
- আপনি আপনার সময় মত বললে তো হবেনা। আমাদের বাসায় কেউ এত সকালে ঘুম থেকে উঠে না। আমি কি ভোর ৫টায় সবাইকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খবর দিবো?
- আমাদের বাসা আমাদের বাসা করবানা। তুমি এখন আমার বউ। আমাদের বাসাই এখন থেকে তোমার বাসা।
- এটা কেমন কথা?
- বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িই মেয়েদের আসল ঠিকানা। বাপের বাড়ি শুধু বেড়াতে যাবার জন্য।
- সেটা অন্যসব মেয়েদের জন্য। আমার জন্য না। বিয়ের আগেই এটা আমি পরিস্কার করে বলছিলাম। আপনাকে সবকিছু বলছিলাম কেন আমি আমার বাপের বাড়ি ছাড়তে পারবো না। আমার বাবা নাই। আমি ফ্যামিলির বড় মেয়ে। আমার মা আর ভাইবোনের দায়িত্ব নেয়া আমার কর্তব্য।
- এজন্যই কি বিয়ের দিন তোমার ফ্যামিলি তোমাকে আমাদের বাসায় যাইতে দিলো না??
- সেদিন শুধু আকদ হবার কথা ছিল। বউ নিয়ে যাবেন আপনারা, সেটা তো বলেন নি।
- আগে বলিনি তো কি হইছে। তখন আম্মা এত করে বললো, তোমাকে নিয়ে যাবে।
- হুট করে বললেই তো হবেনা। আপনাদের তাড়াহুড়ার জন্য আমাদের অনেক আত্নীয় স্বজনই জানতে পারেনাই। আমি ফ্যামিলির বড়ো মেয়ে। আমার বিয়ে নিয়ে আমার চাচা চাচি, আম্মার নিজেদের পরিকল্পনা আছে, শখ আহলাদ আছে। হুট করেই আপনার আম্মার কথায় তারা মেয়ে তুলে দিবে কেন? আর কথা সেটা না। কথা হচ্ছে, আমি আমার মা ভাই বোনকে পর করে দিয়ে শুধু আপনাদের নিয়ে থাকতে পারব না। এটা আমি বিয়ের আগেই বলে দিছি।
- তাহলে বিয়ে করার কি দরকার ছিল?
- আমি বিয়ে করতে চাইনাই। ফ্যামিলি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে।
- ফ্যামিলি জোর করে বিয়ে দিলো আর তুমিও বিয়ে করে ফেললা?
- ফ্যামিলি তো জোর করছেই। আপনার জোরাজুরিও কি কম ছিল নাকি? আপনিও দুনিয়াতে আর মেয়ে পান নাই। আপনাকে কয়েকবার বলছি, আমি এই বিয়েতে রাজি না। তারপরেও আপনি পিছনে লেগে ছিলেন।
আবির কোন উত্তর দিলনা। তারপর থেকেই তনুজার মুড অফ। কক্সবাজার আসার ইচ্ছা না থাকলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিল এই ভেবে যে, বিয়ের আগে থেকেই অনেক রকম ঝামেলা হচ্ছে, বিয়ের সময়ও বড়ো একটা ঝামেলা লেগে গেলো। এতে দোষ যাদেরই হোক, আবির আর ওর মধ্যে দুরত্ব বাড়ানোর জন্য যথেষ্ঠ। আবির মনে মনে ওকে ভুল বুঝতেও পারে। সেজন্যই সে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও কক্সবাজার এসেছে যাতে করে ওরা দুজন ফ্যামিলি থেকে দূরে গিয়ে কিছুটা সময় কাঁটাতে পারে। নিজের ভুল বুঝাবুঝি গুলো ঠিক করে নিতে পারে। সম্পর্কের শুরুতেই এমন ভুল বুঝাবুঝি শুরু হলে বাকি জীবন কিভাবে কাটবে? কিন্তু ওর শাশুড়ির জ্বালায় সেটা সম্ভব হলো না। মহিলা ওদেরকে এক মুহূর্ত শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেনা। একটু পর পর ফোন করে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছে। ওর ফ্যামিলির উপর রাগ ঝাড়তেছে। বউকে কেন নিতে দিলো না সেই কথা থেকে শুরু করলো, তারপর তার ছেলেকে ঠিক মত আপ্যায়ন করা হলো না কেন, এখন আবার গহনা নিয়ে শুরু করছে।
বিয়ের পরদিন তনুজা কথায় কথায় ওর জাকে বলেছিল, ওরা তনুজাকে যে গহনা দিয়েছিল, সেগুলোর একটা কিছুটা ভাঙ্গা ছিল। তনুজার জা শুনে বলেছিল, পুরানো গহনা। তাই হয়ত ভেঙ্গে গেছে, ওরা খেয়াল করেনি। তনুজা সেটা নিয়ে আর কথা বাড়ায়নি। জাকে বলেছিল, আবির চলে গেলে সে ভাঙ্গা গহনা জুয়েলারির দোকানে নিয়ে ঠিক করে ফেলবে। সেই কথা নিয়েও তনুজার শাশুড়ি হালুম ফালুম শুরু করে দিয়েছেন। এত হালুম ফালুম করার কি হলো? সে তো গহনা নিয়ে কোন অভিযোগ করেনি। শুধু ওদের জানানোর দরকার মনে করেছিল। তাতেই সে যেন একেবারে মহাপাপ করে ফেলেছে।
তনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিয়ে হলো একদিন আগে। এর মধ্যেই এত সব ঝগড়া ঝাটি, ওকে নিয়ে, ওর ফ্যামিলি নিয়ে এতসব অভিযোগ...এদের মধ্যে সে কিভাবে টিকবে?? শুরু থেকেই ওর মন কখনো সায় দেয়নি এই বিয়েতে রাজি হবার জন্য। তারপরেও সে মনের কথাটা পাত্তা না দিয়ে চেষ্টা করেছে সম্পর্ক ঠিক রাখতে। কিন্তু সেটা পারলো কই? ঝাগড়া ঝাটি করে এখন আবির বাইরে গিয়ে বসে আছে। তনুজার সামনে মায়ের সাথে চিল্লাচিল্লি করতে পারতেছেনা হয়ত। এজন্য বাইরে গিয়ে বসে আছে। কিন্তু আদৌ কি এই ঝামেলা থামবে??
সন্ধ্যা ৭টার দিনে আবির হোটেলে ফিরতেই তনুজা বলল, চলেন ঢাকায় ফিরে যাই। এখানে আর ভালো লাগতেছেনা। ভাগ্য ভালো থাকলে বাসের বা ট্রেনের টিকেট পাওয়া যেতে পারে। আবিরও রাজি হয়ে গেলো। ওকে দেখে মনে হলো, এই কথাটাই সে তনুজাকে বলতে পারতেছিলনা। তনুজা নিজে থেকে বলায় সে হাঁফ ছেঁড়ে বেঁচে গেলো। ঘন্টাখানেকের মধ্যে নিজেদের ব্যাগ জিনিষপত্র সব গুছিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ওরা। (চলবে)
©somewhere in net ltd.