নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি লিখতে ভালোবাসি। তাও আবার শুধুই বাংলায়..........

রুপালী তারা

রুপালী তারা › বিস্তারিত পোস্টঃ

এবং তনুজা

০৫ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১১:৩০

১০।।
আজ খুব ভোরে আবির চলে গেছে লন্ডনে। তনুজা তাহমিদকে নিয়ে গিয়েছিল এয়ারপোর্টে। গিয়ে দেখে শ্বশুরবাড়ির সবাই আছে সেখানে। আবির মুখ শুকনা করে দাঁড়িয়ে ছিল এক পাশে। তনুজাকে দেখে ওর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেলো। চেহারায় খুশি খুশি ভাবটা লুকাতে পারলোনা সে। এত মানুষের মধ্যে তনুজা সেটা দেখেও না দেখার ভান করলো। কিছুক্ষন পর সবার থেকে বিদায় নিয়ে আবির ইমিগ্রেশন ডেস্কে চলে গেলো। যাবার আগে তনুজাকে বললো, ভালো থেক। আমি গিয়েই ফোন করবো তোমাকে। তনুজা চুপ করে শুধু মাথ নাড়লো। ইমিগ্রেশন পার হয়ে ওপাশে যাবার পরে আবির পেছন ফিরে তাকিয়েছিল। ওর চোখ দুটো শুধু তনুজাকে খুঁজছিল। তনুজা ওর শাশুড়ির পেছনে দাঁড়িয়েছিল। যে কেউ দেখে ভাববে লুকিয়ে আছে। আসল কথা হচ্ছে, আবিরের চলে যাওয়াটা দেখতে পারছিলনা সে। নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে এসেছিল। তাই শাশুড়ির পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সেখান থেকেই উঁকি দিয়ে দেখলো, আবির পেছন ফিরে তাকিয়েছে। ওর খুব ইচ্ছা করছিল, হাত নাড়বে। কিন্তু এত মানুষের মধ্যে খুব লজ্জা লাগছিল। ভেতরে চলে যাবার আগে শেষ বারের মত আবারো পেছন ফিরে তাকালো আবির। সবাইকে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছিল। তখনি চোখে চোখ পড়লো। আবির হাসলো। তনুজা এইভাবে চোরের মত লুকিয়ে আছে কেন?
প্লেনটা উড়ে যাবার পর পরই তনুজা তাহমিদকে নিয়ে বাসায় চলে এসেছে। শ্বশুরবাড়ির কারো সাথে খুব একটা কথা হয়নি। তনুজার শাশুড়ি প্রথম থেকেই মুখ গোমড়া করে ছিলেন। সারাটা সকাল ঘুমিয়ে কাটালো তনুজা। দুপুরের দিকে ওর ঘুম ভাঙল। আবির কি লন্ডনে গিয়ে পৌঁছেছে? বলেছিল, ১১/১২ ঘন্টা লাগবে। নাহ, মাত্র ৯ ঘন্টা হয়েছে। আরো ২-৩ ঘন্টা পর গিয়ে পৌছাবে। সেখান থেকে তো আবার বাসায় যেতে হবে। তনুজা মনে মনে হিসাব করলো, আরো ৪-৫ ঘন্টা পরে হয়ত আবির ওকে ফোন করবে। কিন্তু ওর অনুমান ভুল করে দিয়ে ২ ঘন্টা পরেই আবির ফোন করলো। এই মাত্র প্লেন থেকে নেমেছে। এখন হেঁটে হেঁটে ইমিগ্রেশনের দিকে যাচ্ছে। ফোন রাখার আগে তনুজাকে বললো,
- তনুজা, আমি প্লেনে বসে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
- কি?
- কথা ছিল, ১ বছর পরে আবার যাবো বাংলাদেশে। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য। কিন্তু...
- কিন্তু কি?
- একটু পরে ফোন করতেছি। ইমিগ্রেশনে চলে আসছি।
আধা ঘন্টা পরেই আবার ফোন করলো আবির। তনুজা এই আধা ঘন্টা মোবাইলটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। না জানি কখন ফোন করে। একটা রিং বাজতেই সে ফোন রিসিভ করলো।
- তনুজা
- বলেন
- আমি ঠিক করছি, ৪ মাস পরেই বাংলাদেশে যাবো। তখন বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। এই ৪ মাসের মধ্যে তোমার কাগজ পত্র সব রেডি করে ফেলতে হবে। আমি কালকেই আমার পেপারসগুলো রেডি করবো।পরশুদিন তোমাকে পোস্ট করে দিবো। তুমি কাল সকালেই পাসপোর্ট অফিসে যাবা। পাসপোর্ট করতে দিবা। ছবি তোলা না থাকলে আজকেই তুলে ফেলো। আর আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, তোমাকে আই,ই,এল,টি,এস করতে হবে। তুমি খোঁজ নাও এই ব্যাপারে। কোচিং করতে হবে। ৩ মাসের মত লাগবে। তুমি ২/১ মাস পরেই ব্রিটিশ কাউন্সিলে রেজিস্ট্রেশন করে ফেলো। ৩ মাস পরে কোচিং শেষ হবে এক্সাম দিয়ে দিবা। আমি আসতে আসতে রেজাল্ট পেয়ে যাবা। বুঝছ??
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে গেলো আবির। তনুজা ওর কথা শুনে হা হয়ে গেলো। এর তো দেখি কথার ঠিক নাই। আজকে এক রকম কথা বলে, কালকে আরেক রকম কথা বলে। ৪ মাসের মধ্যে বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রিপারেশন নেয়া সম্ভব নাকি? টাকা পয়সার ব্যাপার আছে। ফারনিচার কিনতে হবে। আত্নীয় স্বজনদের জানানো হয়েছে, এক বছর পরের কথা। তার উপর পাসপোর্ট করা, কাগজ পত্র সব রেডি করা, আবার নাকি আই,ই,এল,টি,এস দিতে হবে। এর জন্য কোচিং করতে হবে, ব্রিটিশ কাউন্সিলে এক্সাম দিতে হবে। কখন এসব করবে সে? চাকরীও তো করতে হবে। এমন তো না যে, তনুজা সারাদিন বাসায় বেকার বসে থাকে। ফোনের ওপাশে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আবির বললো,
- তনুজা, শুনতে পাচ্ছ?
- পাচ্ছি
- কথা বলো না কেন?
- আপনার বাসায় কি সবাই জানে?
- কি জানে?
- ৪ মাস পরে আপনি আসবেন। বিয়ের অনুষ্ঠান হবে।
- এখনো জানেনা। বাসায় গিয়ে সন্ধ্যার দিকে ফোন করবো আম্মাকে।
- উনারা কি এত তাড়াতাড়ি বিয়ের অনুষ্ঠান করতে রাজি হবেন?
- রাজি না হবার কি হলো?
- মানে এত তাড়াতাড়ি...
- ওসব আমি ম্যানেজ করবো। এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। তুমি শুধু তোমার বাসায় জানাও। আর কোচিংয়ে ভর্তি হও। পাসপোর্ট রেডি করো।
- আই,ই,এল,টি,এস না দিলে হয়না?
- না, এটা খুব ইম্পরট্যান্ট। তুমি খোঁজ নাও যত তাড়াতাড়ি পারো।
তনুজা আর কথা বাড়ালো না। আবির ফোন রেখে দেবার পর সে আম্মাকে গিয়ে খবরটা জানালো। আম্মাও শুনে খুব অবাক হলেন।
- এরকম তো কথা ছিল না। তুই কিছু বললি না??
- আমি কি বলব?
- আমাদের প্রিপারেশনের একটা ব্যাপার আছে। তুই আবিরের সাথে কথা বল। ওকে বুঝিয়ে বল।
- আমি পারবো না।
- কেন পারবি না?
- এখনো বুঝো নাই? ওদের ফ্যামিলির একটা প্রবলেম আছে। ওরা যা বলবে, তাই মানতে হবে। একটু উনিশ বিশ করলে ঝগড়া শুরু করে দিবে। আমি আবিরের সাথে ঝগড়া করতে পারবো না।
- ঝগড়া করতে বলছে কে? তুই শুধু...
- ঐ তো একি হলো। তোমাদের কথা শুনে ওকে বুঝাতে যাব...শুনো আম্মা, আমি এখন আবিরের বউ। ওদের বাড়ির বউ। আবির অলরেডি আমাকে বলে দিছে, বাপের বাড়ির সাথে সম্পর্ক ফরমাল করে ফেলতে। আমি এখন থেকে তাই করবো। তোমাদের কোন ঝামেলার মধ্যে আমি নাই।
- এসব কি বলতেছিস তুই? তুই না থাকলে...
- এতক্ষনে মনে হইছে আমি না থাকলে হবে?? ৪ মাস পরে লন্ডনে চলে যাব। তখন কি করবা? এইসব আগেই ভাবা দরকার ছিল। আবির লন্ডনে থাকে শুনেই আমি মানা করে দিছিলাম। আমি চাইছিলাম, বাংলাদেশে থাকব। বাংলাদেশে সেটল এরকম একটা ছেলেকে বিয়ে করবো। তাতে করে আমি তোমাদের দেখাশুনা করতে পারতাম। তুমি প্রায়ই অসুস্থ থাক। তখন তো আমাকেই দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। আমি চলে গেলে তখন কে দেখবে? তাহমিদ, তনিমা ওরা এখনো ছোট। এতসব করতে পারবেনা। কিন্তু তখন তো তোমরা সবাই অন্ধ হয়ে গেছিলা আবিরকে দেখে। রাজপুত্র হাতে পেয়েছি রে। আমাকে বললা, আবিরকে বিয়ে না করলে তুমি বিষ খেয়ে মরবা। তোমাদের জন্য চুরি করতে গেছিলাম আর তোমরাই আমাকে চোর বলা শুরু করে দিছ। এখন বিয়ে করছি। এখন আবার তোমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা আমার উপর চাপায়ে দিতেছ। কি পাইছ আমারে? ব্যাটারি দেয়া পুতুল? ইচ্ছা মত চাবি ঘুরাবা আর আমি ঘুরতে থাকব?
আম্মা চুপ করে থাকলেন। তনুজা আবার বলতে শুরু করলো,
- প্রিপারেশন নাই তো মেয়ে বিয়ে দেবার জন্য পাগল হয়ে গেছিলা কেন? আবির লন্ডনে চলে না গেলে তো বিয়ের অনুষ্ঠান এখনি করতে হইত। তখন কেমনে করতা? এখন আবার বলতেছে, আবিরকে ফোন করে বুঝা। আমি কিছু করতে পারবোনা। যা করার, তোমরা করো। তোমাদের যা মন চায়, কর। আমাকে কিছু বলতে পারবানা। এই কয়দিনে তোমরা আমার জীবনটা একেবারে অতিষ্ঠ করে দিছ। আল্লাহই জানেন, কি এমন পাপ করছিলাম। বিয়ের আগে বাপের বাড়ির মানুষেরা কথা শুনায়, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা কথা শুনায়। বিয়ের দিন থেকে আমার জামাই আমার সাথে ননস্টপ ঝগড়া শুরু করছে। এখন লন্ডনে চলে গেছে। এখনো ঝগড়া বাঁধানোর তালে আছ?
- আচ্ছা, দেখি আমি আবিরের মায়ের সাথে ফোন করে কথা বলব।
- বলো। যা বলবা, নিজের দায়িত্বে বলবা। আমার শাশুড়ী যেন আমার উপর দোষ না চাপায়। আরেকটা কথা শুনলে আমি শ্বশুরবাড়িতে চলে যাবো।
আম্মা কোন কথা না বলে চলে গেলেন চুপচাপ। তনুজা কাঁদতে বসলো। এই রকম জীবন সে চায়নি। আব্বা মারা যাবার পর থেকে সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। সংসারের যাবতীয় টেনশন, কাজ কর্ম নিজের মাথায় তুলে নিয়েছিল। সংসার চালাবার জন্য, ভাই বোনদের ঠিক মত দেখাশুনার করার জন্য আব্বা মারা যাবার এক মাসের মাথায় সে চাকরিতে ঢুকেছিল। সেই সাথে পড়াশুনাটাও চালিয়ে গেছে অনেক কষ্টে। যাতে করে সে ভালো চাকরী করতে পারে। সংসারে আগের মত স্বচ্ছলতা ধরে রাখতে পারে। দিন রাত গাধার মত খেটেছে তনুজা। সব এই সংসারের জন্য। আপন মানুষদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।
আর এই আপন মানুষেরা কি করলো? প্রতিদানে ওর বুকে ছুরি ঢুকিয়ে দিলো। এমন একজনের সাথে ওর বিয়ে দিল, যার সাথে বয়সের ব্যবধান অনেক, মন মানসিকতায় বিস্তর ফারাক। ফুপু এই বিয়ের প্রস্তাব আনলেও তনুজা নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। যা কিছু হোক, সে কোনভাবেই আবিরকে বিয়ে করবে না বলে ঠিক করেছিল। মাঝখান থেকে আম্মা ওকে ফাঁসিয়ে দিলো। আবিরকে বিয়ে না করলে নাকি বিষ খেয়ে মরবে। এত কিছুর পরেও তনুজা ভেবেছিল, আকদের পরে ওর হাতে ১ বছরের মত সময় থাকবে। এই এক বছরে সে তাহমিদকে কোন একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দিবে। ইন্ডিয়া থেকে আম্মার চিকিতসা করিয়ে আনবে। তনিমার শ্বশুরবাড়িতে কথা বলে একটা ছোট খাট ঘরোয়া অনুষ্ঠান করে ওদের সাথে সম্পর্ক সহজ করবে। তারপর নাহয়, ১ বছর পরে সে আবিরের কাছে চলে যাবে লন্ডনে। আর এখন কিনা তার হাতে সময় আছে মাত্র ৪ মাস। এর মধ্যে সে কাগজ পত্র নিয়েই দৌড়াবে, নাকি কোচিং করবে, নাকি বিয়ের প্রিপারেশন নিবে নাকি চাকরী করবে। কোনদিক দিয়ে কিভাবে কি করবে সে? এত অল্প সময়ের মধ্যে এতকিছু কেমনে সম্ভব হবে?
বিকেলে ডাইনিং টেবিলে বসে বাড়ির সবার সাথে এ ব্যাপারে কথা বললেন আম্মা। সবকিছু শুনে চাচাও বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। চাচী তো এক রকম রাগ হয়ে গেলেন। বললেন, এরকম আগে জানলে কিছুতেই তনুজার বিয়ে দিতেন না তারা। শুরু থেকেই ঝামেলা করেই যাচ্ছে। মেজ কাকা আর মেজ কাকি গম্ভীর হয়ে বসে থাকলেন। কোন কথা বললেন না। ফুপুকে খবর দেয়া হয়েছিল। ফুপু আসেননি।
তনুজা চুপচাপ কথা শুনলো আর মজা দেখলো। এতদিনে সবার চোখ খুলেছে। আবির আর ওর বাড়ির মানুষদের যা তা ব্যবহারে আর খামখেয়ালী দেখে এখন বাড়ির সবাই কমবেশি বিরক্ত। আর কত সহ্য করা যায় এরকম? মাঝখান থেকে ওর জীবনটা তেজপাতা হয়ে গেলো। আরে না... তেজপাতা তো এখনো হয়নি। তেজপাতা হবার খেলা তো মাত্র শুরু।
পাক্কা দুই ঘন্টা মিটিং হবার পরে চাচা জানালেন, আবিরের আম্মাকে ফোন করার দরকার নাই। মহিলা এমনিতেই কড়া মেজাজের মানুষ। তাকে ফোন করে একটা বুঝাতে গেলে বুঝবে আরেকটা। তখন আবার আরেক ভেজাল লেগে যেতে পারে। তনুজা ঠিকই বলেছে। ওর দরকার নাই আবিরের সাথে এই নিয়ে কথা বলার। আজ হোক, কাল হোক, বিয়ের অনুষ্ঠান তো করতেই হবে। আগে আগে করলে একটু তাড়াহুড়া হয়ে যাবে এই আর কি। (চলবে)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.