নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পর্বতের চূড়া বেয়ে উঠে গেছে আমার বৃক্ষের মগডাল

রায়ান নূর

কবি ও কথাসাহিত্যিক

রায়ান নূর › বিস্তারিত পোস্টঃ

সকালবেলার গল্প

০২ রা জুলাই, ২০১৪ রাত ১২:৫৪

★ সকালবেলার গল্প

রায়ান নূর



1.

রাত শেষ হতে বেশি দেরি নেই ৷ দিনের আলো ফুটলেই কোরবানীর ঈদ ৷ বছরের এই দিনটা মুসলমানদের বিশেষ দিন ৷ একটি বছর পর এই দিনে গরীব,অনাথ আর আশ্রয়হীন মানুষগুলো এক টুকরো মাংসের স্বাদ পায় ৷



যারা দুর দেশ-বিদেশ আর শহরে থাকে তারাও অন্তত এই দিনটা নিজ পিতামাতার বাহুপাশে থাকে ৷ সব জায়গায় বিষম উৎসব ৷ হারানো সময়গুলো অলক্ষে কিছু সময়ের জন্য যেন খানিকটা ছায়া হয়ে আসে পিতামাতার কাছে বিশেষ করে যারা দূরে থাকে ৷এমন আনন্দের দিনে করুণকাহিনী কার ভালো লাগে?বড় হৃদয়—বিদারক,বিষাদের আধার,অশ্রু-জলের লীলাভূমি তেমনই একটি কাহিনী ৷

এই দিনে সৃষ্টিকর্তা সকলের মুখে হাসি ফোটাবেন?―শুধু প্রশ্নই হয়ে থাকে ৷ সৃষ্টিকর্তার অসাধ্য কিছু নেই ৷



রাতে খাবার খেয়ে সাবের ঘুমিয়ে পড়েছে সাত বছরের মেয়ে সীমা আর বার বছরের ছেলে রহীম ঘুমিয়ে আছে ৷ কাল ঈদ—মনের সাধ মিটাবে—কত কিছু করবে;এমনই কত ভাবনা নিয়ে ঘুমিয়ে গেছে সীমা ও রহীম তা বোঝার অসাধ্য ৷সাবেরের স্ত্রী সালমা খাতুনও অঘোর ঘুমে ৷ সকাল হতেই তাকে অনেক কিছু করতে হবে ৷ অভাবের সংসার―কালকের দিনটায় অন্তত ছেলে মেয়েদের মুখে ভালো খাবার তুলে দিয়ে অনেকদিনের ইচ্ছাটুকুর কিছু পূরণ করতে পারবে ৷ গ্রাম গঞ্জে বিলাসিতা নয়—মাংস খাবারটা বড় দামী ৷মাংস কেনার সাধ্য কয়জনের হয় ! হয়ত মাংস কিনলেও পাতিলে ভাত চড়ে না ৷ আবার চড়লেও তাতে মনোতুষ্টি হয় না ৷ বছরে দুই একবারই একটু আধটুতে মুখ ভিজে রাখতে হয়―তাতে সাধ মিটে না ৷ একমাত্রই ঈদই হল সাধ নিবারণের আশীর্বাদস্বরূপ ৷বিধাতা যে এই অসহায় মানুষগুলোর কথা ভাবেন তার ফলেই এই চির সঙ্গতি ৷ধনীলোকের পূণ্যের তাগিদে এই গরীব,এতিম আর অনাথদের মুখে রাজকীয় আর বিলাসী খাদ্যটুকু যায় ৷



রাত ফর্সা হয়ে আসছে ৷শেষরাতের দমকা হাওয়া বইছে এখনও ৷ কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব—জগতের সকল ঘুম যেন আজ সকলকে চেপে বসেছে ৷তাই কোন চিন্তা মাথায় থাকে না বললেই চলে ৷মসজিদের মাইকে বারবার ঘোষণা হচ্ছে ঈদের নামাজের সময়সূচী ৷ সালমা খাতুনের ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে কিন্তু জড়তাটুকু এখনও কাটে নি ৷ ঈদের কথা মনে হতেই বিছানা ছেড়ে উঠল ৷ এখন কাজ আর কাজ ৷দিনের আলো সবে মাত্র ফুটেছে ৷ ঘর-দোর ঝাড়ু দিয়ে এখন গরুর গোয়াল ঘরে যাবে গরু বের করতে ৷ অসহায়ের সম্বল একটিমাত্র ষাঁড়—সকল বিপদের বন্ধু ৷



গোয়ালে গিয়ে চোখ একটু ভালোভাবে মেলতেই চোখে অন্ধকার দেখল ৷ শূণ্য গোয়াল—গরু নেই ৷ চোখে জল আসতে লাগল ভাবনায় কিন্তু এমন সময় হঠাৎ দেয়ালের দিকে চোখ পড়তেই অঝোরে কাঁদতে শুরু করে মূর্ছা গেল ৷



কী হয়েছে!কী হয়েছে!—সাবের কান্না শুনে এগিয়ে গেল গোয়াল ঘরে ৷বুঝতে তার আর দেরি হল না ৷সে পুরুষ হয়েও কান্না সংবরণ করতে পারল না ৷



এই খুশির দিনে সিঁধেল চোরের একটুও দ্বিধা হয় না কারও ক্ষতি করতে ৷গরীবের সম্পদ চুরি করে গরীবি মেটায়—হায় রে জগৎ! হায় রে টাকা!হায় রে পাষাণ হৃদয়! কাওকে কাঁদাতে কি নিজের অন্তরে বাঁধে না? তোমার কি পরিবার পরিজন নেই? তাদের মুখের দিকে তাকিয়েও কি এমন অনিষ্ট করতে ইচ্ছা হয়? সকল অভাব,সকল নেশা,সকল প্রবৃত্তি কি আজ এই দিনের অপেক্ষায় ছিল?সকলে যখন একটু সুখের আশায়,পরিতৃপ্তির আশায়,মিলন মুহূর্তের আশায় বুক বেঁধে আছে—আপনার মনে কী এই দুরভীসন্ধি ছিল কালো নিশার স্বপনে?কে এই মন্ত্রণা দিয়েছিল পিশাচ হৃদয়ে?

সীমা ও রহীম কান্না শুনে চোখ মুছতে মুছতে ঘুম থেকে উঠে এসে বলল,"বাবা,মার কী হয়েছে—কাঁদছে কেন?"

সাবের উত্তর দিতে পারল না তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ৷



সালমা কিছুটা প্রকৃতিস্থ হলে ছেলেমেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে ৷ তারাও মায়ের কান্না দেখে কাঁদতে শুরু করে ৷ কিছুই জানে না তারা ৷ অবুঝের মত শুধু প্রশ্নবাণ ছোড়ে ―কোন উত্তর আসে না ৷

সীমা কাঁদতে কাঁদতে মাকে বলল,"মা,কি হয়েছে? বলছো না কেন?বল―মা!"

"মা,তোর কালুরে চোরে নিয়ে গেছে"

"কখন নিয়ে গেছে ৷ তুমি দেখ নি ?"

"দেয়াল কেটে ―"

এই কথা শুনা মাত্র সীমা গগনবিদারী নাদে কাঁদতে লাগল ৷রহীমের কান্নাও থামে না ৷ গতকাল সারাদিন রোদে পড়ে সারা মাঠ চষে একবস্তা ঘাস কেটে কালুকে পেট পুরে খাইয়েছে ৷ঘাস কাটতে কাটতে তার হাতে ফোসকা পড়েছে ৷

আজকের দিনে পশুরা খেতে চায় না—কষ্ট পায় বলে রহীম গতকাল রাত পর্যন্ত কত আদর করেছে তা এই সামান্য কথায় বর্ণনা করা অসম্ভব ৷ সীমাও গুড়া―ভাত দিয়ে পানি খাইয়েছে রাতের বেলা ৷ অন্তত আজকের দিনে কালু যেন কষ্ট না পায় ৷

গরীবের সামান্য ধন কত যে আদর যত্নে,মায়া মমতায় থাকে তাই সীমা আর রহীমের মাঝে উপলব্ধ ৷ দুই ভাই বোন কত দিন ধরে তিলে তিলে কালুকে ছোট থেকে শিশুর মত পরিচর্যা করেছে তা অতুলনীয় ৷ কে জানে আজ কার ছুড়ির নীচে কালুর প্রাণ নাশ হবে—কার মঙ্গল সাধনে—কার নামে উৎসর্গ করা হবে?একমাত্র অন্তর্যামী জানেন ৷ অন্তত সৃষ্টিকর্তা এত নির্দয় নন যে এই ছোট দুই ভাইবোন আর এক পরিবারের চোখের জল অবজ্ঞা করে সকল মায়া মমতা বিসর্জন দিয়ে অই চোরের মনস্কামনা পূর্ণ করবেন?



সকল কিছু সংবরণ করে দুই ছেলে মেয়েকে গোসল করিয়ে সালমা চোখে কাজল আর আতর দিয়ে দিল ৷নতুন জামাকাপড় পড়িয়ে সাবের তাদের ঈদগাহ মাঠে নিয়ে চলল ৷ এই দুটো ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে সে নিজের কাপড় কিনতে পারে নি ৷ পুরনো কাপড় কেঁচে মাড় দিয়ে শুকিয়ে পড়ে সেই কাপড়ে ঈদগাহ মাঠে গেছে ৷ নিজে নতুন কাপড় না পড়লেও ক্ষতি নেই কিন্তু ছেলে মেয়েরা নতুন কাপড় না পড়লে পাড়ার অন্যান্য ছেলে মেয়েরা তাদের অবজ্ঞা করবে—এই ভেবে তাদের ইচ্ছাটুকু অপূর্ণ রাখে নি ৷



সালমা সামান্য ধানের আঁটা দিয়ে রুটি তৈরি করছে―কিছুক্ষণ পড়ে নামাজ শেষ হলে সকলে চলে আসবে ৷এদিকে ভাত চড়ানো আছে ৷ ভাত চুলা থেকে নামলে সে গোসল সেড়ে নিল ৷

এদিকে নামাজ শেষ হলে পাড়ায় গরু-ছাগল জবাই করার ধুম পড়ে গেল ৷ সাবের বাড়ি থেকে ছোট ছুঁড়িটা নিয়ে গিয়ে সমাজের গরুর চামড়া খসাচ্ছে ৷সে কোরবানী দিতে পারে না—এই ছোটসমাজ থেকে যেটুকু মাংস পাওয়া যায় তাতেই সব ৷ চামড়া খসালে একটি পায়ের কব্জার হাড় নিতে পারে ৷ সীমা পায়ের হাড় খেতে খুব পছন্দ করে ৷ ছোট মেয়েটার এইটুকুর জন্য সে বাড়িতে বসে থাকতে পারে না ৷ হাজার হলেও, বাবা হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এই কষ্টটুকু করতে তার মনে একটুও ক্লান্তি আসে না ৷



রহীম কোথা থেকে ছুটে এসে সালমা খাতুনের কাছ থেকে একটা বেগ নিয়ে চলে গেল ৷

"কোথায় যাস,একটু খেয়ে যা বাবা"

সালমা খাতুনের কোন কথার উত্তর না করে রহীম দৌড়ে চলে গেল ৷ সীমা চুলার পাড়ে তার মায়ের সাথে কাজ করতে লাগল ৷ সামান্য মাংস পেয়েছে সমাজ থেকে পরিবারের সদস্যসংখ্যা বিবেচনায় ৷ সমাজে পরিবারে লোক গণনা করে মাংস সমানভাবে বিতরণ করা হয় ৷ যারা কোরবাণী দেন তারা একভাগ নেন আর দুইভাগ সমাজে দেন ৷ মাত্র সাত পরিবার কোরবানী দিতে সক্ষম হলেও দেখা যায় সেই সমাজে অক্ষম পরিবার দশের নিচে নয় ৷ সমাজ থেকে যা মাংস তা দিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ৷



"রহীম কোথায় গেছে"―সাবের সালমাকে বলল ৷

"ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে চলে গেল―কিছুই বলল না"

"ঐ যা― গোস্ত চাইতে গেছে বুঝি অন্য সমাজে"

"যাক—ছোট ছেলে—দুটো বটি পেলে অমন্দ কী?"

"হুশ বুদ্ধি কি কখনো হবে না—মানুষ বলবে কী৷"

"আরও তো অনেকেই যায়—তাদের সাথেই গেছে হয়ত৷"

"খাবারটা খেয়ে যাবে তো—এই রোদ্দুরে অসুখ করে যদি?"

"না খেয়ে গেলে জোর করে খাওয়ানো যাবে? "

রহীম বাড়ি আসলো ৷ পাড়ায় চেয়ে চেয়ে মাত্র কেজি মাংস পেয়েছে ৷বাড়ি আসলে বাবা একটু বকুনী দিল ৷ সালমা তাকে নিবৃত্ত করল ৷ সাবের বাবা হয়ে নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও গালি দিল কেননা আত্নসম্মানের প্রশ্ন ৷ ছোটকালে না হয় গিয়েছে কিন্তু এই বয়সে লোকে বলবে কী?



2

একটু বেলা বাড়লে সাবের তার বাবাকে একটু দেখতে গেল ৷ বৃদ্ধ মানুষ— বড় ভাই এর সংসারে থাকেন ৷ তার যে গরু চুরি গিয়েছে তা হয়ত জেনেছেন কারও কাছ থেকে—এমন ভাবনাই মনে আসল সাবেরের ৷অনেক দিন হল আলাদা সংসার করে দূরে বাড়ি করেছে ৷ তার বড় ভাই এর সংসারেও টানাটানি ৷ তিনি অন্য সমাজে আছেন ৷ সাবের গিয়ে দেখে তার বাবা বিছানায় শুয়ে আছেন ৷সাবের কে দেখে কেঁদে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ৷―বাবা দুঃখ করিস না৷ আমি সব শুনেছি ৷ একটা সম্বল গেছে তাই ভেঙে পড়িস না ৷ আমি বলছি তোর আবার হবে ৷

সাবের বাবার চোখ মুছে দিতে দিতে বলল,"তুমি এসব ভেবোনা বাবা ৷আমার কিছু হবে না ৷ তুমি শুধু দোয়া কর"

―দোয়া তো সব সময় আছে বাবা ৷ আমি বুড়ো হয়ে গেছি―আর কয়দিন ?

―খাবার খেয়েছ?

―দুটো দানা খেয়েছি ৷ মাঠ থেকে এসে বুকটা কেমন ধরপর করছে ৷

―ঔষুধ খাওনি ৷

―ঔষধ নেই ৷ একটা ছিল তাই খেয়েছি ৷

―বৈকালে কী ঔষুধ এনে দেব ৷

―টাকা খরচ করা লাগবে না ৷ এমনিতে ভালো হবে ৷ একটু হেঁটেছি তো তাই ৷

―তোমার অবস্থা তো ভালো ঠেকছে না ৷

―ওসব ভাবিস না ৷ যা,বড্ড ঘুম পাচ্ছে ৷ছেলেমেয়েদের একটু ভালোমন্দ খাওয়াস ৷ ওদের দিকে একটু নজর দিস ৷



3

আজ সাবেরের মাথাটা কেমন ধরছিল ৷সে বাড়িতে এসেই ঘুমিয়ে পড়ল ৷ অন্ধকারের মধ্যে ভেসে উঠল কতকগুলো তারা ৷ তারাগুলো হঠাৎ তার চোখে হানা দিয়ে উধাও হয়ে গেল ৷ সকল জ্যোতি নিভে গেল ৷চারদিকে কেমন ধূসর আভা গোচর হল ৷সে নিজেকে হঠাৎ একটি সুউচ্চ অট্টালিকার ছাদে আবিষ্কার করল ৷ মাথার উপরে আকাশ কালো মেঘ ছেয়ে গেছে ৷ কিছুক্ষণের মধ্যে ভীষণ ঝড় বইতে শুরু করল ৷ পাথর বৃষ্টি আসবে শীঘ্র এমনই মনে হল ৷ হলও তাই পাথর পড়তে লাগল—একদম সদ্য বড় বড় পাথর —গলতে শুরু করে নি এখনও ৷সে দৌড়াতে লাগল নিচে যাবার জন্য ৷ কোন সিড়ি খুঁজে না পেয়ে অঝোরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল ৷

রহীম ছুটে এল বাবার চিৎকার শুনে ৷―বাবা তুমি কাঁদছ কেন?

চোখ মুছতে মুছতে তিনি বললেন,"স্বপ্ন দেখছিলাম তাই ৷"



রহীম আর কিছু না বলে ঘর থেকে একটা সাইকেলের চাকার রিং আর বাঁশের পান্টি নিয়ে পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলতে গেল ৷ বছরে শুধু মাত্র এই সময়টা তারা রিং চালায় ৷ এরপর আবার ধনুক খেলা ৷ তারপরে ক্রমে লাটিম ঘুরানো,মাঠে ফুর্তি পান্টি কখনো গুটি ৷ সারাটা বছর এভাবেই নানা খেলায় কেটে যায় এই বালকদের ৷ স্কুলে ভর্তি হয়ে থাকলেও যায় না ৷ কোনমতে তৃতীয় শ্রেণী খুব সম্ভব হলে পাঁচের ঘরে শেষ যাত্রা ৷ রহীম তৃতীয় শ্রেণীতে ৷ বছরে ফেলের সংখ্যা বেড়ে এই দশা ৷



সন্ধ্যাবেলা কিছু কেনাকাটার জন্য সাবের চারমাথার হাটে এসেছে ৷ পকেটে যে সামান্য টাকা তাতে শুধু দুই কেজি চাল ভিন্ন অন্য কিছু হবে না ৷ তবুও অল্প কিছু করে দিন চালানোর জন্য কেনাকাটা করল ৷কাল কি হবে? এমন ভাবনা সবসময় মাথায় থাকে ৷ ছোট সংসার সে চোখ বুজলে সব শেষ ৷ রাত হলে বাড়ি ফিরল ৷

সামান্য টাকাটুকু খরচ করায় সালমা একটু বকুনি দিল ৷ ―দুটো টাকা যদি হাতে না রাখ চলে কি করে ৷ বাজারে গেলেই কি সব কিনতে হবে ৷

"কিনেছি যখন, কি আর করা ৷"

"কালকে কি করবে,একবার ভেবেছ"

"সেই ভেবেই তো―"

"কাজের কোন খোঁজ পেলে ৷ যে ধানটুকু ছিল তা বিক্রি করে তা তো তাস খেলায় উড়ে দিলে ৷ হাতে টাকা এলে ভূতে কিলায় ৷"

"আর জ্বালাইও না ৷ সে আমি কাল ভাবব"৷



4

পরদিন সকাল বেলা মতিনের ছোট ছেলে মিন্টু এসে বলল,"দাদু সকাল থেকে কথা বলছেনা, চাচ্চু চল না ৷ বাবা তোমায় ডেকে পাঠিয়েছেন ৷"

সাবের কাল বিলম্ব না করে বাবার কাছে ছুটে গেল ৷ রহমত প্রধানের চোখের জ্যোতি টলটল করে সাবেরের চোখে কি যেন দেখছে ৷ কোন ভাষা নেই ৷ কী তার অর্থ? তা নিরূপণ করার যন্ত্র এখনও আবিষ্কার হয় নি ৷ কেবল বাবার পদপ্রান্তে মাথা ঠুকে সাবের কেঁদে চোখ লাল করল ৷ মাত্র একটি দিনের ব্যবধান ৷ঈদের পর একটি রাত পার হয়েছে ৷ সেই দিনের বাক্যই যে তার শেষবাক্য সাবেরের বুঝবার সাধ্য হল না ৷ কিন্তু এমন সময়ে তার বাক্য বন্ধ হল— না বলা কথা শুধু কথা হয়ে থাকল ৷অভাবের সংসারে মরার উপর যেন খাঁড়ার ঘা ৷কি করবে―কেমন করে এমন হল?সাবের যেন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল ৷ তার ভাই মতীন মাথায় হাত দিয়ে দরজায় বসে আছে ৷ ছেলে হয়ে সকল কর্তব্য দুজনকেই করতে হবে ৷ কিন্তু কেউ ভেবে উঠতে পারছে না―এখন কি করবে?



রহমতপ্রধানকে সকালে চৌকির নিচে পড়ে থাকতে দেখেছে ৷কিন্তু রাতের বেলা কেউ লক্ষ্য করে নি ৷ সে যে মুখ বন্ধ হল— কোন কথা বলতে পারলেন না এমনকি ইশারাও ৷ অনেকটা প্যারালাইজড রোগীর মত ৷ গোটা শরীর অবশ ৷ দুই ভাই এর শেষ সম্বল খানিকটা জমি ডাক্তার আর কবিরাজের এর খরচেই গেল ৷ অনেকেই জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দিল—ভালো ডাক্তার এল ৷ শুধু ভিজিটের টাকা গেল—ব্যাগভর্তি ঔষধও হল ৷ সকল পথ্য পড়েই রইল কেবল এক চামচ শরবত অথবা মধু ছাড়া কোন কিছুই তার মুখে গেল না ৷ডাক্তারেরা কোন আগাম খবরও দিতে পারল না ৷ গ্রামের মণ্ডল মাতব্বরের কথায় ঝাড়ফুঁক সব আদ্যন্ত শেষ হল ;কিছুই অবশিষ্ট রইল না ৷ সকল অব্যর্থ ঔষধ আর চিকিৎসাশাস্ত্রকে অবজ্ঞা করে রহমত প্রধান সাতদিনের মাথায় ফযরের নিকটবর্তী প্রহরে বিনাবাক্যব্যয়ে মর্তলীলা সংবরণ করলেন ৷ পরিবারদ্বয়ে কান্নার রোল পড়ল ৷ সেদিন ভোরে একটু শিশিরবৃষ্টি হল ৷

5

বড়ই অভাব ৷ নুন আনতে যেমন পানতা ফুরায় ঠিক তেমনই অবস্থা সাবেরের ৷সামান্য অর্থের সংস্থান হচ্ছে না ৷ জন খাটে তবু কারো কোন ডাক পড়ে না ৷ বাইরের অঞ্চলের লোকেরা এখানে এসে জন খেটে যায় কিন্তু বড়লোকেরা নিজ গ্রামের অন্নহীন মানুষগুলোর কথা একটুও চিন্তা করে না―দুঃখের কারণ এটাই ৷ কোন উপায় না পেয়ে যেকোন একটি ব্যবস্থা হবে সংকল্প করে সাবের তার শ্বশুর বাড়িতে গেল৷ স্ত্রীপক্ষের আত্নীয়রা সাহায্য করবে এমনই ধারণা মনে মনে পোষণ করছিল সে ৷ তাছাড়া অনেক পরিরল্পনা মাথায় এসেছে ৷ সে সবের গুড়ে বালি হল যখন একে একে শালা-সমুন্ধি অভাবের অজুহাতে খালি হাতে ফিরে দিল ৷ এবার অবশিষ্ট থাকল ছোট শালা ৷ সালমার চার ভাই এবং সে একটি মাত্রই বোন ৷ কিন্তু এই বিপদ মুহূর্তে কোন ভাই মুখ ফিরে তাকালো না ,এমনকি তারা কেমন আছে তাও কোনদিন জানতে চায় নি ৷ পাড়ার কত লোকের বাসায় আত্নীয় আসে কিন্তু সাবেরের বাড়িতে স্ত্রীপক্ষের কারো পায়ের ধূলো পড়ে না ৷সালমার তিন ভাই একটু অবস্থাভাবাপন্ন ৷ ছোট শালা শুধু একটু গরীব ৷ সাবের ছোট থেকে তাকে কাজ শিখিয়ে পুষিয়ে নিজ ভাইয়ের মত পায়ে দাঁড়াবার একটা ব্যবস্থা করেছে ৷ সেও বিয়ে করেছে দুই বছর হল ৷সাবেরের শ্বশুরশাশুড়ি মারা যাবার পর সামান্য জমি ভাগে পেয়েছে ৷ সাবের তাকে অনুরোধ করল একটা ব্যবস্থা করার জন্য ৷ সে না সাহায্য করলে এই অভাগার আপন বলে যে কেউ থাকল না ৷ সে ছোট শালাকে অনুরোধ করল ৷

"টাকার অভাবে আমার দুবেলা ভাত জোটে না ৷ সব কিছু শেষ হয়েছে বাবার চিকিৎসায় ৷ সকল আশা ধুলোয় মিশে গেছে ৷ তুমি ছাড়া আর কোন দরজা নেই ৷ অন্তত একটি ব্যবস্থা করে দাও যাতে তোমার বড় বোনের মুখে একটু ভাত তুলে দিতে পারি ৷"

"ভাই,ওভাবে বলছেন কেন?আপনি না থাকলে আজ আমি সংসার পাততে পারতাম না ৷"

"তোমার বোন বড় আশা করে এখানে পাঠিয়েছে ৷সামান্য একটা ব্যবস্থা করে দাও ভাই"৷

ছোট শালা তাকে ফিরাতে পারলনা তার নিজ বোনের কথা চিন্তা করে ৷সকলে স্বার্থপর আর মুখ ফিরিয়ে নিলে বোনের স্নেহটুকুও যে বৃথা যাবে যদি তার মুখে অন্নটুকু না জোটে ৷



পাড়ার ক্লাবে পাঁচবছর আগে সাপ্তাহিক পাঁচটাকায় একটি সঞ্চয় খুলেছিল ছোট শালা ৷ সেটি কয়েকদিন আগে ভেঙে পাঁচহাজার টাকা পেয়েছে ৷ সেখান থেকে আড়াইহাজার টাকা সাবেরকে দিয়ে একটি ভ্যান কেনার পরামর্শ দিল ৷ সাবেরের দুচোখে আর জল ধরে না ৷সাবের শুধু একটি কথাই বলল,"যে উপকার করলে ভাই রক্ত দিলেও ঋণ শোধ হবেনা" ৷

"ভাই,ওসব ভেবোনা ৷ বোনের জন্য হলেও এটা আমার কর্তব্য ৷"

"আমি তাহলে যাই ভাই ৷ ওদিকে সালমা আবার ভাবনায় পড়বে ৷"

"দুপুরে খেয়ে যান ৷ না খেলে কিন্তু ভীষণ খারাপ লাগবে"৷

বেয়ে পড়ল স্নেহের সেই অশ্রুটুকু গাল বেয়ে ৷ তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন কিছুক্ষণ ৷তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে সাবের বাড়ির পথে যাত্রা করল ৷



6

দুইদিন পরে সেই টাকা দিয়ে বাজার থেকে সাবের একটি পুরনো ভ্যান কিনল ৷রহীম বাবার ভ্যান দেখে বেজায় খুশি হল ৷ আগে অন্যের ভ্যান সুযোগ বুঝে চালিয়েছে ৷ সামান্য খাবারের লোভেও অন্যের ভ্যান ঠেলেছে ৷ মনের খুশি মত দুই ভাইবোন ভ্যানে চড়ে খেলছে ৷

রাতে সাবের অর্থ রোজগারের উপায় সম্পর্কে ভাবতে লাগল ৷ সালমাও নানা পরামর্শ দিল ৷ সাবেরের মাথায় নানা উপায় এল ৷ শেষে স্থির করল সে ইটভাটায় মাটি কাটবে ৷এতে উপরি কিছু আয় হবে ৷মাটি কাটা যদিও অনেক পরিশ্রমের তবু সংসার চালাতে তাকে কাটতেই হবে ৷

কত লোকে ইটভাটায় মাটি কাটে এই সময় ৷দুপুরের পর পর্যন্ত টানা মাটি কেটে বৈকাল হলে বাড়ি ফেরে ৷ অসহ্য ব্যথা নিয়ে সারারাত ঘুমের ঘোরে কাতরায় ৷ তবু সংসার জ্বালা যে এর চেয়ে নেহায়েত কম নয় ৷সকাল হলে সাবের দুইগ্রাম দুরে একটি ইটভাটায় মাটিকাটা শ্রমিক হিসেবে নাম লেখায়ে আসে ৷ শ্রমিক কম ছিল এই কারণে সহজেই সে কাজ পেয়ে যায় ৷ হারভাঙা খাটুনির কারণে এই কাজে কম লোকই আসে ৷ যারা আসে তারা শক্তিশালী ও জোয়ান ৷ টাকার অঙ্কটাও তাই সামান্য বেশি ৷ শীর্ণকায় হলেও ইটভাটার ম্যানেজার সাবেরকে নিয়োগ দিল শ্রমিক স্বল্প বলে ৷সাবেরের মনটা অচেনা এক আনন্দে ভরে উঠল ৷ সারা রাস্তা গুনগুন গান গেয়ে ভ্যান চালিয়ে বাড়ি এল ৷ গরীবেরা অর্থের সন্ধান পেলে সুখ চিনতে ভুল করে না ৷ স্বপ্ন দেখে আকাশ ছোয়া ৷ আর এভাবেই পার করে জীবনের খানিকটা সময় ৷ সালমার চোখে সামান্য জল কচু পাতার পানির মত গড়ে পড়ল খুশিতে ৷ এত তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা হবে তা কল্পনাতীত ছিল ৷রাতের খাবার খেয়ে নানা গল্প শেষে ঘুমে পড়ল ৷স্বপ্নের শুরু নেই, শেষ নেই কেবল প্রভাতের আলো চোখে পড়তেই সবকিছু ম্লান হয়ে গেল ৷



7

আজ ভোরে উঠেছে সালমা ৷ সকালবেলা কাজে গেলে তাড়াতাড়ি ফিরবে এমনই নিয়ম ৷ সামান্য কয়টা আলু ভাতে দিয়ে ভাত রান্না করছে সালমা ৷ আলুভর্তা ছাড়া অন্য কোন তরকারির যোগান নেই এই পরিবারে ৷সাবের ভ্যানটার বিয়ারিং আর চেনে তেল দিচ্ছে ৷ ভালো করে পরিস্কার করছে ভ্যানটি যাতে উপরি কোন শক্তিক্ষয় না হয় চালাতে ৷ চুলার পার হতে সালমা কথা বলছে আর উঠান থেকে সাবের উত্তর দিছে ৷

"দিন হাজিরা কত করে দিবে প্রথম প্রথম?"

"দিন হাজিরা নয় ভ্যানপ্রতি ত্রিশ টাকা ৷"

"তাহলে তো অনেক টাকা হবে ৷"

"যে শরীর একা চারটি টিপ দিতে পারব না কি সন্দেহ ৷"

"চারটি টিপ কেন?"

"অনেক দূর থেকে মাটি নিয়ে আসতে হয় কি না ৷"

"ও,আচ্ছা তুমি তাড়াহুড়া করে যেন কাজ করো না কিন্তু, তাহলে চোট লাগবে ৷"

"চোট যা লাগার লাগবে ৷ পাহাড়ে মাটি উঠাতে হবে টেনে নিয়ে ৷ টাকা তো এমনি দেয় না ৷"

"আসবে কখন ৷ ভাত সেজে দিব?"

"বৈকাল নাগাদ ৷ দিও৷"

রহীম কখন যে ঘুম থেকে উঠেছে কেউ জানে না ৷ চোখমুখ না ধোওয়া অবস্থায় এক কোণে চোপ করে বসে আছে আর বাবা মার কথা শুনছে ৷



ভাত হয়ে গেলে সালমা খেতে দিল বাপ-ব্যাটাকে ৷ সীমা এখনও উঠেনি ঘুম থেকে ৷খাবার শেষে সাবের ভ্যান নিয়ে রাস্তায় উঠল ৷ রহীম তার মার সাথেই দাঁড়িয়ে ছিল ৷

সাবের চিৎকার করে বলল "আমি চললাম৷"

বাবার চিৎকার শুনে রহীম বলল"বাবা কি ভাটায় যাচ্ছে?"

"হ্যা"

"আমিও যাব"

মায়ের কোন উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ভ্যানের পিছনে পিছনে দৌড়াতে লাগল রহীম ৷ ভ্যানের দুইটা চাকা ঘুরছে অবিরত ৷রহীমকে দেখতে পেয়ে সাবের তাকে ভ্যানে তুলে নিল ৷ অবশেষে দেখতে দেখতে পথে মিলে গেল দুজন ৷ কোন কিছু দেখা যাচ্ছে না―কেবল ধূ ধূ ধূলোয় ভরা রাস্তা ৷ সালমা বেগম অস্ফুট সুরে কেবল বলল,"এসো"





Apr 11,2014

রায়ান নূর

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা জুলাই, ২০১৪ ভোর ৪:৫৫

পে পোঁ কইরেন না, যান। বলেছেন: awesome

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.