নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যদিও আকিকা করা হয়নি তবুও নামতো তাদের রাখা হয়েছিল জন্মের পর, তবে গ্রামের সবাই তাদের নামটা ভুলতে বসেছে, গোলাপী আর কালুনি বলেই চেনে আর জানে। কালুনি আর গোলাপী দুই বান্ধবী ছোট বেলা থেকেই, একই সাথে বেড়ে উঠা গ্রামের হাওয়া আলো ছায়ায়, আর আট দশজন গরীব কৃষকের পরিবারের কন্যার মতোই অভাব, অর্ধাহার, এসবের সাথে নিত্য যুদ্ধ করে বেড়ে উঠা, লিখা পড়া বলতে প্রাইমারী স্কুলে গিয়েছিল তবে সেটাও যে শেষ করেছে তার নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছেনা, বয়েস এখন বার কি তের এর কোটায়, শহরে যে বয়েসটা কিশোরী বেলা গ্রামে সেখানে বিয়ের তোড়জোড় চলে, যেহেতু বাবা মার কাছে মেয়ে বোঝা হয়ে উঠে, নিত্য আহার এর আয়োজনটা ঠিক মতো করতে পারেনা সেখানে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে পার করতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাঁচার অবস্থা।
উপ নামের ধরণ থেকেই সহজেই অনুমেয় কালুনির গায়ের রঙ কালোই বটে আর গোলাপীর গায়ের রঙ কি করে এমন দুধে আলতায় হতে পারে সেটা অনেকের কাছেই অবাক করা বিষয়, তবে একটু পেছনে ফিরে তাকালে সেটা আর অবাক হবার কিছু থাকেনা, গোলাপি এমনই হবার কথা ছিল এবং এমনই আছে, গোলাপীর নানারা ছিল গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের কৃষক পরিবার, তাদের ছিল আবাদ করার পর্যাপ্ত জমি জায়গা, হালের বলদ ঘরের চাকর আর চাষের কামলা সবই ছিল, গোলপীর মা’র ধুম ধাম করেই বিয়ের আয়োজন হয়েছিল, পাত্র শহুরে মাষ্টার কি ডাক্তার সেটা অবশ্য যানা যায়নি, তবে কোন এক অজানা কারণে বিয়ের দিনে জামাই পক্ষ অনুপস্থিত থেকে খবর পাঠিয়েছিল অনিবার্য কারণ বশত এই বিয়ে হচ্ছেনা, তখন কনে পক্ষ কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলনা, কোন এক মুরুব্বী প্রস্তাব করে বসল, বিয়ে হবে এবং তা এক্ষুনি, পাত্র ঘরেই আছে, রহিম মিয়া, যে কিনা গোলাপীর নানার বাড়ীতে কামলা কাজ করত, এত লোক থাকতে রহিম মিয়ার নাম কেন প্রস্তাব করা হল তারও কারন আছে, রহিম মিয়া ছিল এতিম এবং ছোট বেলা থেকেই গোলাপীর নানা বাড়িতে থেকে আসছিল, সম্পর্কটা এমন আত্মার আত্মীয় এর মতো হয়ে গিয়েছিল যে, সে একজন ঘরের মেম্বার এর মতো হয়ে গিয়েছিল, দেখতে শুনতেও ছিল চোখে পড়ার মতো, তখনতো আর পাত্রী থেকে অনুমতি নেবার প্রয়োজন ছিলনা তাই মন্ত্র পাঠ শুনে ঘোমটার ভেতর মাথাটা একটু নড়ে উঠলেই আলহামদুলিল্লাহ বলে বাতাসা পর্ব শুরু হয়ে যায়, মাথার ঢুলানিটা কি পাত্রী দিয়েছে নাকি সেটা অন্য কেউ মৃদু ধাক্কা দিয়ে বাতাসা খাবার ব্যাবস্থা করে দিয়েছে সেটা বিবেচ্য বিষয় না।
সবকিছু চলছিল ঠিক মতোই কলকল নদীর ঢেউ, কিন্তু কেন জানি নদী একদিন ফোসে উঠল, ভাঙ্গনের কবলে একাকার ঘরবাড়ি, হাট বাজার, স্কুল মাদ্রাসা, গোলাপির নানা মামারা চলে গেল শহরের পথ ধরে, রয়ে গেল রহিম মিয়া, সে কাজের লোক, নিজের জমি না থাকলেও অন্যের জমিতে হাল দিয়েই তো তার বেড়ে উঠা, পাশ্ববর্তী গ্রামে গিয়ে স্থিতি হল, এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়াল গোলাপি, সবার চোখ গোলাপীর দিকে, গরীব এর ঘরে সুন্দর মেয়ে হতে নেই, সবার নজর থাকে ওদিকে, ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে হয় কখন ছোবল মারে চিল, প্রায়ই বিয়ের প্রস্তাব আসে তবে রহিম মিয়ার বুঝতে কষ্ট হয়না তারা ঘর করার জন্য প্রস্থাব নিয়ে আসেনা, ইশারা ইংগীত অন্য কিছু বহন করে।
কালুনির খুব হিংসে হয় সবাই আড় চোখে গোলাপীর দিকে কেন তাকায়, তাকে কেন কাছে পেতে চায়না কেউ, জোয়ান বুড়া সবাই কেন গোলাপীকে এত পছন্দ করে, তারও তো শরীর আছে, মন আছে, সবাই গোলাপির জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে, সেও স্বপ্ন দেখে তার একজন বর হবে খুব সুন্দর, সিনেমার নায়ক এর মতো, নায়ক তো অনেক আছে কোন নায়কটা? ওটা ভাবতে গিয়ে বরাবরই কালুনি সালমান শাহকে প্রাধন্য দিয়েছে, কতবার গোলাপির সাথে ঝগড়া হয়ে গেল, তারা দুজনই সালমান শাহকে চায়, কালুনি তা হতে দেবেনা, সালমান শাহ শুধুই তার, গোলাপীকে তার ভাগ দেবেনা, সে চাইলে মান্নাকে পছন্দ করতে পারে।
সালমান শাহকে কে কতটা ভালবাসে তার প্রমাণ পাওয়া গেল তার মৃত্যুর পর, গোলপী আর কালুনির প্রেম দু'ফোটা চোখের জল বিসর্জনের মধ্যে সীমবদ্ধ ছিল, তাদের মাড়িয়ে যে খবরটা শিরোনাম হযে উঠল সে হল শিউলি, শিউলি আত্মহত্যা করে বসল, শিউলিদের বাড়িতে ঝি এর কাজ করত কালুনির মা, কালুনি শিউলির গল্প প্রায়ই করত গোলাপীর কাছে, এমন সুন্দরী মেয়ে পৃথিবীতে আর হয়না, খোদ যেন সাক্ষাৎ হুর পরী, এমন ভাবে শিউলির রূপের বর্ণনা করত গোলাপীর কাছে যেন গোলাপি কখনো দেখেনি শিউলিকে, গোলাপী ভাবত কালুনি একটু বাড়িয়ে বলছে কিন্তু এতে যে কালুনি তৃপ্তি অনুভব করে এই ভেবে যে গোলাপীর চাইতে আরো অনেক সুন্দরী আছে, সেই রহস্য গোলাপি কখনো বুঝে উঠতে পারেনি।
প্রত্যেক মাসের শেষ শুক্রবারে বিটিভিতে যে ছায়াছবি দেখায় সেটা কালুনি আর গোলাপি শিউলিদের বাড়ীতে গিযে শিউলির সাথে বসেই দেখত, তারা ছবি শুরু হবার বেশ খানিকটা আগেই চলে যেত সেখানে, দুজন মিলে শিউলির মাথায় তেল দিযে আচড়ে দিত আর টুকটাক এটা সেটাও করে দিত, সিনেমা যখন শুরু হতো আশে পাশে থেকে ছোট বড় আরো অনেকে এসে ভিড় জমিয়ে ফেলত।
নয়ক নায়িকার মৃত্যু হলে শেষ শুক্রবারের সেই দিনটিতে সেই নায়ক বা নায়িকার ছবি দেখাত বিটিভিতে সেটা সবার জানা ছিল, কিন্তু এবার সালমান শাহ এর বেলায় তা আর হলনা, যেভাবে চারদিক থেকে আত্মহত্যার খবর পত্রিকা নিউজের হ্যাড লাইন হচ্ছে তাতে সরকার ভাবল এখন যদি সেই নায়কের ছবি প্রদর্শিত হয় তাহলে মৃত্যুর মিছিল আরো দীর্ঘ হবে এতে কোন সন্দেহ নেই, তার পরে আরো মাস তিনেক চলে গেল কালুনি গোলাপিদের আর ছবি দেখা হয়না, শিউলিদের বাড়িতে শোকের মাতম তাই টিভি নামক বাকসটা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখবে সেটাই স্বাভাবিক।
তার আরো মাস খানেক পর হঠাৎ শোনা গেল আগামী শুক্রবার সালমান শাহ এর ছবি প্রদির্শিত হবে, যথারীতি হাজির কালুনি গোলাপী শিউলিদের বাড়ি, আগের সেই আমেজ আর নেই, কেমন যানি নির্জীব হয়ে আছে বাড়ীটা, আজকে দর্শনার্থীর সংখ্যাও খুব একটা বেশী নেই, তবে নতুন এক মেহমান সোফায় এলিয়ে বসে টিভি দেখছিল, পরে যানা গেল উনি শিউলিদের দুর সম্পর্কের এক মামা হোন।
"ও দাদি ও দাদি আমি তোমার দিওয়ানা," সিনেমায় মজে গেল সবাই, গোলাপী হটাৎ খেয়াল করল মামা তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন চোখ দিয়েই খেয়ে ফেলবে, সে একটু নড়ে চড়ে বসল, ওর্নাটা একটু টেনে দিযে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করল, সিনেমার বাকী অংসটা সে দেখেছে ঠিকই কিন্তু মাথায় কিছু ঢুকলনা, সে বার বার চোখ রাখছিল মামার দিকে, বেশ কবার চোখে চোখ পড়ল, কেমন যেন নির্লজ্য মামাটা, গোলাপী আবার চোখ সরিয়ে ফেলে, সিনেমা শেষে যে যার মতো বাড়ী ফিরল।
পরের দিন সকালে গোলাপীদের বাড়িতে এক ভদ্রলোকের আগমন, গোলাপী রান্নার কাজে তার মাকে সাহায্য করছিল, ভদ্রলোককে দেখে আৎকে উঠল গোলাপী, হাত থেকে পড়ে গেল ষ্টীলের বাটিটা, ঝন ঝন ঝননন করে শব্দ করে উঠল, এতো সেই মামা, গতকাল শিউলিদের বাড়ীতে একসাথে ছবি দেখেছিল, গোলাপী ভেবেছে নিশ্চয় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, ঘরে বসলনা, গোলাপীর বাবার সাথে কথা বলতে বলতে তারা বাড়ীর উঠোন থেকে হেঁটে রাস্তার দিকেই গেল, পরে জানা গেল, সে গোলাপির জন্য চাকরীর প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, ঢাকায় নিয়ে যাবে, সে নিজে একটা গার্মেন্টস এর ম্যানেজার, ওদিকে কালুনির পরিবারের সাথেও কথা হল, কালুনি যাচ্ছে, ঢাকায় চাকরী করবে, তিন হাজার টাকা বেতন, পরে অবশ্য বাড়াবে এখন শুরুতে তিন হাজার, তাছাড়া ঈদে বোনাস এটা সেটা ইত্যাদি
গোলাপীর বাবা একটু দিধায় ছিল মেয়েকে এভাবে একা দেবে কিনা, তবে গোলাপীর মা কোন ভাবেই রাজি হলনা, বেশ কবার এসে ঘুরে গেল মামা নামক সে ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত কালুনিকে নিয়েই রওয়ানা হল।
সবাইকে বিদায় দিয়ে ট্রেনে উঠে বসল মামার সাথে কালুনি, তার চোখে মুখে হাজার স্বপ্ন, গোলাপী না এসে ভালই করল, বছর খানিক পর যখন অনেক টাকা ইনকাম করে সে গ্রামে বেড়াতে আসবে তখন তার কদর বেড়ে যাবে অনেক, গোলাপী সুন্দরী হলেও পয়সার জন্য কালুনিকে সবাই সমীহ করবে, তাছাড়া ঢাকা শহরে থাকবে সে, এফডিসির কথা শুনেছে, মামা বলেছে তাকে সেখানে বেড়াতে নিয়ে যাবে, সব নায়ক নায়িকা কে নিজের চোখেই দেখবে, ভাবতেই সে শিহরিত হয়ে উঠে, তবে মনে মনে উৎকন্ঠাও কম নয়, নতুন জায়গা আর মামার সাথে পরিচয় সেটাও বেশী দিনের নয়।
বুঝলি হাসনা হেনা গোলাপী ট্রেন মিস করেছে, তার কপাল খারাপ, কত করে বললাম রাজী হলনা, বছর শেষে তুমি যখন গ্রামে বেড়াতে আসবে তখন দেখে নিও তোমাকে দেখে ওরা হিংসে করবে, এই প্রথম কালুনির নাম জানা গেল হাসনা হেনা, ফুলের নামে নাম, খুব সুন্দর, এতো সুন্দর একটা নাম থাকতে তাকে কিনা সবাই ডাকে কালুনি, মামার মুখে হাসনা হেনা নামটা শুনে খুবই ভাল লাগল কালুনির, সেতো মনে হয় নিজেই নিজের নাম ভুলে গিয়েছিল কালুনি নামটা শুনতে শুনতে।
পরের সপ্তাহে ফিরতি ট্রেনে কালুনি ফেরত এলো, খবর শোনা গেল তাকে ঢাকায় নিযে গিয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল, একটা অন্ধকার সেতসেতে ঘরে আটকে রেখেছিল তাকে, সেখান থেকে কি করে পালিয়ে সে আসতে পেরেছিল সেটা আর জানা গেলনা।
আসলে সব ট্রেন গন্তব্যে পৌছায়না.....
©somewhere in net ltd.