![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফুরফুরে মেজাজে
তানহা সাজিদ:
কয়েক বছর আগের ঘটনা। বরিশালের প্রত্যন্ত এক গ্রাম, যেখান আধুনিকতা ছোয়া তখনো লাগেনি। বিদ্যুত ছিলনা বলে সাঝ বেলাতেই গ্রামের প্রত্যেক ঘরে ঘরে প্রদীপের আলোই ছিল ভরসা। গ্রামটাতে শিক্ষিত লোকের সংখ্যাও ছিল খুব কম। একটা প্রাইমেরী স্কুল আর একটি মাদরাসা আর এতিমখানা ছাড়া তেমন কিছু নাই। সবমিলে গ্রামটা ছিলো খুব সাজানো গোছানো।
যাকে নিয়ে এই গল্প, সে এই গ্রামেরই এক যুবক কবির। নিম্নবিত্ত কবিরের বাবা ছত্তার মিয়া রিকসা চালায়, মা আমিনা বেগম অন্যের বাড়ি কাজ করে। বাবা-মা তিন ভাই ও এক বোন নিয়ে তাদের ছয় জনের সংসার।
দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগান দিতে কষ্ট হতো তাদের। তারপর ও একটা সুখ ছিল কবিরের পরিবারে। ভাই বোনের মধ্যে কবির ছিল মেজ। বড় ভাইটা ছিল হাবাগোবা, ছোট ভাইটার বয়স আট বছর আর বোনটা ছিল সবার ছোট, ছয় বছরের। সংসারে কবিরই ছিল বাবা মায়ের পরে আয়ের উৎস। বড় ভাইটা তেমন কিছুই করতে পারতোনা। তাই পরিবারের ভালো মন্দ কবিরকেই সামাল দিতে হতো্। কবিরের গায়ের রং শ্যামলা, সে খুব হাশিখুশি ও নরম স্বভাবের ছেলে। এজন্য গ্রামের সবাই কবির কে খুব ভালোবাসতো।
মানুষের জমি বর্গা নিয়ে কবির ও তার বাবা মিলে চাষাবাদ করতো। ওই গ্রামে তোতা মিয়া নামে এক ব্যাক্তি ছিল। গ্রামের মধ্যে অর্ধেক জমিই ছিল যার। কবির তোতা মিয়ার কাছ থেকে জমি বর্গা নিত। তোতা মিয়ার বাড়িতে কবিরের যাতায়াত ছিল প্রায়ই। ওই বাড়িতে গেলেই তোতা মিয়ার বউ বিলকিস বেগম, হাতের কাছে যা থাকতো তাই খেতে দিত কবিরকে। তোতা মিয়ার আট ছেলে মেয়ের মধ্যে দুটা মেয়ে বাদে, বাকিদের বিয়ে দিয়েছে।
ছেলে দুটো ছিলো সবার ছোট, তারা লেখাপড়া করে। কোন কিছুরই অভাব ছিলনা তোতা মিয়ার। কবির তোতা মিয়ার ছেলেদের ভাইও ডাকতো। বড় ছেলে তুহিনের সাথে মাঝে মাঝে বাজারে যেত কবির। তোতা মিয়ার পরিবারে সবাই কবিরকে খুব পছন্দ করতো। মাঝে মাঝে কবির ওর বর্গা জমিতে চাষ করা সবজি নিয়ে তোতা মিয়ার বাড়িতে গিয়ে হাজির হতো। গিয়ে চাচি আম্মাকে বলতো, এই নেন এগুলা দিয়া সালুন রাইনদেন।
কবিরের মা সবসময় কবিরকে নিয়ে চিন্তিত থাকে। ভালো কোনো খাবার রান্না করলে কবিরের জন্য লুকিয়ে রাখতো, যেন অন্য ভাইবোন না দেখে। কিন্তু কবির একা খেতনা সবাইকে নিয়েই এক সঙ্গে থেতেই বেশি ভালোবাসতো সে। কবিরের বাড়িটা ছিলো বিলের মধ্যে তাই ঐ জায়গার নাম ছিলো বিলের বাড়ি। ওখানে আরো বিশ থেকে বাইশটি ঘর ছিল। তারমধ্যে কবির আর কবিরের চাচারও ঘর আছে। ওখানকার মধ্যে ওর চাচারই টাকা পয়সা ছিলো বেশি। ওর চাচা সোবাহান মুনসি মাদরাসা ও এতিমখানার সভাপতি। একমেয়ে ও একছেলে। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ছেলেটা বাউন্ডেলে। কাউকে মান্য করে চলে না। এজন্য মনিরকে সবাই অপছন্দ করে। কবিরদরে সাথে ওদেরর সম্পর্কও খুব একটা ভালো না।
ছত্তার মিয়া কবিরেকে নিয়ে খুব গর্ব করতো। তিনি তার ছেলেকে নিজের প্রানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন।
সবমিলে দিনগুলো ভালই চলছিল ওদের। প্রতিদিনের মতো কবির তার বর্গা জমিতে কাজ করছিল। এমন সময় তার ছোট ভাইটা দৌড়াতে দৌড়াতে আসে। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে বলে ভাইও তাড়াতাড়ি বাড়ি লও আব্বারে মাইরাহালাতাছে, বড় চাচামিয়া আর মনি ভাই মিইলা।বাড়িতে গিয়ে দেখে, তার মা বারান্দার খুটি ধইরা বসে বসে কাদছে। ওদিকে তার বাবা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। মাথা দিয়ে ক্রমেই রক্ত গড়ে গড়ে পড়ছে। কবির আরো কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে জেলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। দুদিন পর বাবাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরে কবির।
বাবাকে বাড়ি রেখে সোজা তোতা মিয়ার বাড়িতে গিয়ে বিচার চায়। তোতা মিয়া ও কয়েকজন মিলে সালিস ডাকে। সালিসে রায় হলো, কবিরের জায়গা দখল না করার জন্য কড়া নির্দেশ দিলেন সোবাহান মুনসি ও তার ছেলেকে মনিকে। সেইসাথে ছয় হাজার টাকা জরিমানা করাও হলো। বিচার শেষে যে যার মতো বাড়ি চলে যায়।
সবকিছু আগের মত ঠিকঠাকই চলে।
প্রতিদিনের মত সেদিন রাতেও খেয়েদেয়ে শুতে যায়। হটাৎ মনে হলো সবকিছু যেন ভেগ্ঙেচুড়ে যাচ্ছে প্রচন্ড ঝড়ে। কবির মাকে ডাকলো ওমা –মা–মাগো তাড়াতাড়ি জানালা কপাট লাগাও, তুফান আইতাছে। ঘন্টা দুয়েক পর ফজরের আজান দেবে, এমন সময় ঘর থেকে বের হয় কবির। বেরিয়ে দেখে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এক দৌড়ে বড় রাস্তায় গিয়ে দেখে বড় বড় সব গাছ-পালা পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। কিছুই চেনার উপায় নাই। বড় রাস্তার পাশে তোতা মিয়ার বাড়ি সামনে বিশাল পুকুর, পুকুরের দক্ষিণ পাশেই একটা খাল। খালটা খাগদন নদীর সাথে মিশে গেছে। অনেক স্রোত হয় খালে। কিন্তু সেদিন খালের রূপ পল্টে যায় গাছপালা পরে। গ্রামের মানুষের মধ্যে হাহাকার পড়ে যায়। যে যেভাবে পারে একে অপরকে সাহায্য করে।
ঝড়ের পরদিন সন্ধ্যায় তোতা মিয়ার পুকুরের দক্ষিণ পাশে একটা কালর্ভাড বসে কবিরকে ডাকে মনির। কবির মনিরের কাছে গিয়ে বলে ভাইও মোরে ডাকছেন। কথাটা শেষ না হতেই পানির মধ্যে ঝুপ করে শব্দ হয়। মনির কবির কে খালের মধ্যে ফেলে দেয়। কবির সাঁতার জানলেও সেদিন আর পারছিল না। গাছের কারণে খালটা একেবারে বন্ধ হয়ে আছে। নড়াচড়া করার মতো কোনো জায়গা নাই। কবির বাচার জন্য কত আকুতি মিনতি করছিলো আর বলছিলো ও মনির ভাইও মোরে উডাও মোর জানডা বাইর অইয়া যাইতাছে মোরে একটু উডাও। কে শুনে কার কথা এসময় মনির বড় একটা বাশ দিয়ে ওর মাথা পানির মধ্যে চেপে ধরে। কবির পনির নিচে ক্রমেই চলে যাচ্ছিল, হাত দিয়ে দিয়ে কিছু একটা আকড়ে ধরার চেষ্টা করেও পারে না। বেশী সময় লাগে নাই দমটা বের হতে। কিছুক্ষণের মধ্যে পানির নিচে তলিয়ে যায়, কবিরের নিথর দেহটা। কেউ আসার আগেই মনির খালপার থেকে সটকে পড়ে।
পরেরদিন সকালে খালের মধ্যে লাশ ভাসতে দেখে গ্রামের মধ্যে হৈচৈ পড়ে যায়। খবর শুনে কবিরের পরিবারে লোকজন ছুটে আসে। লাশ দেখে পাথরের মত শক্ত হয়ে যায় কবিরের মা।বার বার বেহুশ হয়ে যায়। বড় ভাই আর ছোট ভাইটা কবিরের লাশের পাশে বসে কাদে। বোনটা কিছু বোঝেনা বলে কবির এর মাথার কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলায় আর বলে ভাইও ওডো তুমি এহানে ঘুমাইতাছ ক্যা, ওডো কইতাছি। এই কথা শোনার পর গ্রামে মানুষের চোখের কোনে জল চলে আসে। গ্রামের শোকে ছায়া নেমে আসে।
পুলিশ আসার পর লাশ জানাযা দিয়ে দাফন করা হয়। গ্রামের সবই আগের মতো চলতে লাগলো। কিন্তু কবিরের পরিবারের সবকিছুই পালটে গেছে। কয়েকদিনে নাওয়া খাওয়া বন্ধই ছিল। এরই কয়েকদিন পর ওই গ্রামেরই এক মুদি দোকানদার মজিদ, তোতা মিয়ার বাড়িতে এসে বলে কবির তো মরে নাই, ওরে মারা হইছে।। আমি ওইদিন নিজের চোখে দেখছি মনির কবিররে ডাইকা লইয়া গেছে, মুইতো বুঝি নাই। পরে বুঝ্জি কবির মনে হয় গেছে গা। হেইর লেইগা মুই কোন কথা কইনা। হেরপর দেহি মুনির বাশ দিয়ে পানির মধ্যে চাইপপা ধরছে, মুই ভাবছি এমনেই মনে হয় বাশ দিয়া পানিতে ওমন করতাছে। হের পরের দিন শুনি কবিরের লাশ পাওয়া গেছে খালে। এইবার বোঝেন ভাইসাব ওরে কেডা মাইরাফালাইছে। তোতা মিয়া মজিদের কথায় অবাক হয়ে যায়। সবাইকে বিষয়টা জানায়। পরের দিন ছত্তার মিয়াকে ডেকে সব ঘটনা বলার পর মনিরের নামে থানায় মামলা করতে বলে। মামলার পর, পুলিশ নতুন করে লাশ তুলে ময়না তদন্ত করে। প্রমান মিললে, মনিরকে গ্রেফতার করা হয় খুনের জন্য। বিচার পাওয়ায় সবাই খুব আশস্তবোধ করে।
কয়েকদিন পর হঠাৎ করেই রাস্তায় তোতা মিয়ার সাথে মনিরের দেখা হয়। তোতামিয়া রীতিমত চমকে উঠে। মনির মুচকি হেসে সালাম দিয়ে বলে সবতো ডিসমিস হয়ে গেল চাচাজান। এখন একটু বিদেশ থাইকা ঢু মাইরা আসি। মনিরের এমন মন্তব্যে তোতামিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে মনে মনে ভাবতে থাকে খুন করেও পয়সার জোড়ে গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘোরা যায়। হায়!! লেখক: ছাএী
©somewhere in net ltd.
১|
৩০ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:৪০
sajid বলেছেন: ঘটনাটি বাস্তব,,,কিন্তু সেই খুনের এখনও বিচার হয়নি।