![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যুক্তি ও বিজ্ঞানই পারে মানুষ , রাষ্ট্র ও সমাজকে পরিবর্তন করতে
অবশেষে বনচাড়াল গাছের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। প্রায় মাস ছয়েক যাবৎ এই গাছটির সন্ধান করেছিলাম বিশেষ প্রয়োজনে। বন্ধু-বান্ধব সকলের নিকট জানতে চেয়েও কোনো ফল মেলেনি। ফেসবুকে বিজ্ঞপ্তি দেয়াতে বেশ কয়েকজন বন্ধু ও সৃহৃদ এই বিষয়ে কিছু মন্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু গাছটি কোথায় পাওয়া যাবে সে বিষয়ে কোন তথ্য নেই তাতে। এদিকে গাছটির বিশেষ দরকার।
উপায়ন্তর না দেখে নৈসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার স্মরণাপন্ন হই। তাঁর জানতে চাইলাম এই গাছটির হদিস। তিনি ফোনেই গাছটির একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে দিলেন। এবং জানালেন গাছটি তাঁর বাসায়ই আছে। তাঁর এক শিষ্য কিছুদিন আগে বনচাড়ালের একটি চারাগাছ তাঁকে উপহার দিয়েছেন। মনে মনে ভাবলাম এরচেয়ে ভালো উপহার আর হয় না।
সময় অপচয় না করে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পরদিন মুন্সিগঞ্জ থেকে রওয়ানা দেই ঢাকার উদ্দেশ্যে। সঙ্গী লেখক কাজী আশরাফ ও ছাত্র মামুন মিয়া। একেতো ঈদের ছুটির আমেজ, তার উপর শুক্রবার। চিরপরিচিত জানজটের শহর ঢাকার এই চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাস্তাঘাটে যানবাহন খুবই কম। খুব অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম দ্বিজেন দা’র বাসায়। দুই ঘণ্টারও কম সময়েই মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় তাঁর বাসায় যেতে পারব এমনটা স্বপ্নেও ভাবিনি। সকাল নয়টায় মুন্সিগঞ্জ থেকে রওয়ানা দিয়ে ১০:৪৫ এর দিকে দ্বিজেন দার বাসায় পৌঁছলাম।
প্রচণ্ড উত্তেজনায় স্বাভাবিক সৌজন্যতাও উপেক্ষিত হয়। তাই বাসায় ঢুকেই প্রথমেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, গাছটি কোথায়?’ তিনি তাঁর সুন্দর বারান্দায় নিয়ে গেলেন যেখানে অন্য অনেক গাছের সাথে শোভা পাচ্ছিল এই গাছটি। নার্সারিতে যেমনটি দেখা যায়, গাছটি তেমনি একটি পলিপ্যাকের মধ্যে আছে। এখনও টবে লাগানো হয় নি। কারণ হিসেবে দ্বিজেন দা জানালেন গাছটিকে তিনি বাংলা একাডেমি চত্ত্বরে লাগাবেন। যাহোক গাছটিকে বেশ কিছুক্ষণ দেখলাম।
বনচাঁড়াল গাছটি খুব বড় নয়। দেড় থেকে দুই ফুট হবে। জানা গেল গাছটি খুব বেশি বড় হয় না। সাধারণত বনচাড়াল গাছ লম্বায় সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় মিটার পর্যন্ত হতে পারে। এর পাতাগুলো ছোট ও সরু। তিনটি পাতা প্রথম দুটি অত্যন্ত ছোট কিন্তু একটি তুলনামূলক বড়। তবে পরিণত পাতার একটি অংশ লক্ষ করা যায়। এই উদ্ভিদের দুই রকমের ফুল দেখা যায়- কমলা আর হাল্কা বেগুনি। তবে পাতার গঠন প্রায় একই। একে গুল্ম জাতীয় একটি উদ্ভিদ বলা চলে।
গাছটি একটি স্পর্শকাতর উদ্ভিদ। যেতে যেতে কাজী আশরাফ বললেন গাছটির প্রচলিত নাম তুরুক চণ্ডাল। কোথাও কোথাও একে তুরী চণ্ডাল নামেও ডাকা হয়। তুরী বাজালে গাছের পাতাগুলো নড়ে ওঠে তাই এর এমন নাম। গাছের পাতার সাড়া দেয়ার বিষয়টি সকালের দিকে খুব ভালোভাবে দেখা যায়। আলো বাড়ার সাথে সাথে এর সংবেদনশীলতা কমতে থাকে। কোথাও এই গাছটিকে গোড়াচান্দ বা বনচণ্ডাল নামেও ডাকা হয়। ইংরেজিতে একে টেলিগ্রাফ উদ্ভিদ বা ড্যান্সিং প্লান্ট বলা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Codariocalyx motorius.
গাছটির সামনে বেশ কয়েকবার আঙুলের তুরী বাজিয়ে দেখলাম। কোন সাড়া লক্ষ করলাম না। কিছুটা হতাশ হলাম। সাথে থাকা মোবাইল ফোন থেকে একটি গান ছেড়ে গাছের খুব কাছে ধরলাম। কিন্তু এবারও কোনা সাড়া লক্ষ্য করলাম না। রাস্তায় উচ্চশব্দে দ্রুতবেগে ধাবমান গাড়িগুলোর প্রচণ্ড শব্দের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গাছটিকে নিয়ে আসলাম দ্বিজেন দার বসবার ঘরে। মোবাইল থেকে গান ছেড়ে দেখলাম গাছের পাতাগুলোতে কোন সাড়া নেই। হতাশা আরও বেড়ে গেল। এবার দ্বিজেন দাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘গাছটি সত্যিই বনচাড়াল তো?’ দ্বিজেন দা নিশ্চিত করলেন গাছটি বনচাড়ালই। যখন প্রথম তার বাসায় আনা হয়েছে তখন এটি সাড়া দিয়েছে। তিনি তা দেখেছেনও। ভাবলাম মোবাইলের অল্প শব্দে গাছটির কান পর্যন্ত পৌঁছছে না।
ছাত্র মামুনকে পাঠালাম একটি সাউন্ড বস্ক কেনার জন্য। এর মধ্যে গাছটিকে বারান্দ থেকে বাসার মধ্যের একটি কক্ষে নিয়ে আসা হল। প্রায় ঘণ্টা খানের পর মামুন যখন সাউন্ড বক্স নিয়ে আসল তখন আবার পরীক্ষা করলাম। এবার সফল! সঙ্গীতের তালে তালে গাছটির ছোট পাতাগুলো কিছুটা নড়েচড়ে উঠছে। বেশ কিছুক্ষণ উপভোগ করলাম বনচাড়াল গাছের ছোট ছোট পাতাগেুলোর এই নৃত্যদৃশ্য।
কিন্তু যতটা আশা করেছিলাম ততটা স্পষ্ট সাড়া পেলাম না। বুঝলাম গাছটি ঢাকার প্রচণ্ড শব্দে দুষণের মধ্যে এই নষ্ট পরিবেশে খুব বেশি ভালো নেই। গাছের পাতাগুলো লালচে হয়ে গেছে। দ্বিজেন দা বললেন গাছটি রুগ্ন হয়ে গেছে। এই মাটিতে জন্ম হলেও এখানকার পরিবেশ এখন গাছের জন্য বিরূপ হয়ে উঠেছে। মানুষেরা এই পৃথিবীর পরিবেশ ক্রমেই ভয়ঙ্কর করে তুলেছে নিজেদের ব্যত্তিস্বার্থে। পুঁজিবাদী মানুষের অর্থ ও বিত্তলোভের উগ্র থাবায় গাছটি মুমূর্ষুপ্রায়।
বাঙলাদেশের বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু এই গাছটিকে নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ নিয়ে তাঁর বেশ কয়েকটি প্রবন্ধও আছে। তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হলো বনচাড়ালের মৃত্যু। এ প্রবন্ধে তিনি লেখেন-
‘বনচাঁড়াল গাছ দিয়া উদ্ভিদের স্পন্দনশীলতা অনায়াসে দেখা যাইতে পারে। ইহার ক্ষুদ্র পাতাগুলি আপনা-আপনি নৃত্য করে। লোকের বিশ্বাস যে, হাতের তুড়ি দিলেই নৃত্য আরম্ভ হয়। গাছের সংগীতবোধ আছে কি না বলিতে পারি না, কিন্তু বনচাঁড়ালের নৃত্যের সহিত তুড়ির কোনো সম্বন্ধ নাই। তরুস্পন্দনের সাড়ালিপি পাঠ করিয়া জন্তু ও উদ্ভিদের স্পন্দন যে একই নিয়মে নিয়মিত তাহা নিশ্চয়রূপে বলিতে পারিতেছি।
প্রথমতঃ পরীক্ষার সুবিধার জন্য বনচাঁড়ালের পত্র ছেদন করিলে স্পন্দন ক্রিয়া বন্ধ হইয়া যায়। কিন্তু নল দ্বারা উদ্ভিদরসের চাপ দিলে স্পন্দন ক্রিয়া পুনরায় আরম্ভ হয় এবং অনিবারিত গতিতে চলিতে থাকে। তাহার পর দেখা যায় যে, উত্তাপে স্পন্দনসংখ্যা বর্ধিত, শৈত্যে স্পন্দনের মন্থরতা ঘটে। ইথার প্রয়োগে স্পন্দন ক্রিয়া স্তম্ভিত হয়; কিন্তু বাতাস করিলে অচৈতন্য ভাব দূর হয়। ক্লোরোফরমের প্রভাব মারাত্মক। সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, যে বিষ দ্বারা যে ভাবে স্পন্দনশীল হৃদয় নিস্পন্দিত হয়, সেই বিষে সেই ভাবে উদ্ভিদের স্পন্দনও নিরস্ত হয়। উদ্ভিদেও এক বিষ দিয়া অন্য বিষ ক্ষয় করিতে সমর্থ হইয়াছি।
এক্ষণে দেখিতে হইবে, স্বতঃস্পন্দনের মূল রহস্য কি। উদ্ভিদ পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পাইতেছি যে, কোনো কোনো উদ্ভিদপেশীতে আঘাত করিলে সেই মুহূর্তে তাহার কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। তবে যে বাহিরের শক্তি উদ্ভিদে প্রবেশ করিয়া একেবারে বিনষ্ট হইল তাহা নহে; উদ্ভিদ সেই আঘাতের শক্তিকে সঞ্চয় করিয়া রাখিল। এইরূপে আহারজনিত বল, বাহিরের আলোক, উত্তাপ ও অন্যান্য শক্তি উদ্ভিদ সঞ্চয় করিয়া রাখে; যখন সম্পূর্ণ ভরপুর হয় তখন সঞ্চিত শক্তি বাহিরে উথলিয়া পড়ে। সেই উথলিয়া পড়াকে আমরা স্বতঃস্পন্দন মনে করি। যাহা স্বতঃ বলিয়া মনে করি প্রকৃতপক্ষে তাহা সঞ্চিত বলের বহিরোচ্ছ্বাস। যখন সঞ্চয় ফুরাইয়া যায় তখন স্বতঃস্পন্দনেরও শেষ হয়। ঠাণ্ডা জল ঢালিয়া বনচাঁড়ালের সঞ্চিত তেজ হরণ করিলে স্পন্দন বন্ধ হইয়া যায়। খানিকক্ষণ পর বাহির হইতে উত্তাপ সঞ্চিত হইলে পুনরায় স্পন্দন আরম্ভ হয়।’
বনচাড়াল গাছের আদি জন্মভূমি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল সহ দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলেই। সেই হিসেবে গাছটি আমাদের স্বদেশীই। এই গাছের অনেকগুলো প্রকারভেদ আছে। এর মধ্যে রাহু চণ্ডাল, গুরু চণ্ডাল, তুরুক চণ্ডাল, রক্ত চণ্ডাল, উলট চণ্ডাল, ব্রহ্ম চণ্ডাল উল্লেখযোগ্য। এই গাছের প্রায় সব প্রজাতিরই ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে। চামড়ার বিভিন্ন রোগের জন্য এই গাফের পাতা উপকারী। মহিলাদের মাসিক ঋতুস্রাব এবং পাইলসের রক্ত বন্ধ করার জন্য এই গাছের পাতা বেশ উপকারী।
এমন উপকারী গাছটির এমন দূর্দশা দেখে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। মেন খারাপ হওয়ার রোগটা ছোয়াছে ধরনের। তার প্রমাণ কিছুক্ষণের মধ্যেই পাওয়া গেল। হতাশ হৃদয়ে দ্বিজেন দা’র বসার কক্ষে এসে বসলাম চারজন। শুরু হল গল্প। দ্বিজেন দা’র জীবনের নানান গল্প। বরিশালের বিএম কলেজ থেকে ঢাকার নটরডেম কলেজে এবং অতপর রাশিয়ায় তার কর্মজীবন। দেশের সাম্প্রতির পরিস্থিতি কোনো কিছুই বাদ যায়নি এর মধ্যে। দ্বিজেন দা’র মতো বয়সী মানুষেরা এক সময়ে এ দেশটিকে নিয়ে অনেক আশা করেছিলেন। অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করেছেন দেশের মানুষকে আলোকিত করে গড়ে তোলবার জন্য। কিন্তু জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে তাঁকেও খুব একটা আশাবাদী বলে মনে হলো না। চরম হতাশাবাদীর মতোই একবার তিনি বললেন ‘মানুষ নিজেই তার নিজের কবর খুড়ছে।’ তাঁর এই গভীর হতাশার সাথে বনচাড়ালের রুগ্ন অবস্থার সম্পর্কটি স্পষ্ট।
এই হতাশার পেছনে হয়তো অন্য আরো অনেক অপ্রাপ্তি এবং প্রত্যাশার মৃত্যু জড়িয়ে আছে। ঢাকার দূষিত পরিবেশে এই বনচাড়ালের অনুভূতি চোখের সামনে ক্ষীণ বা লীন হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা একটা মানুষের জন্য যতটা কষ্টের, যতটা অসহনীয় এবং যতটা ক্ষতির বাংলাদেশের এই দূষিত পরিবেশে থেকে থেকে এর মানুষগুলোর অনুভূতির অবনতি এবং এর অপমৃত্যু তারওচেয়ে হাজারগুণ অধিক ক্ষতির। এই ক্ষতি অপূরণীয়। এই ক্ষতি ভাষায় ও গণিতে অপ্রকাশযোগ্য। এই অবস্থায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিইবা করার থাকে একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষের কাছে?
দ্বিজেন দা’র আশা গাছটি বাংলা একাডেমির চত্ত্বর রোপিত হবে। কিন্তু বাংলা একাডেমির চত্তরে গাছটি ভালো থাকবে তো? এই শংকা ছিল মনে। তবু মানুষ আশা নিয়েই বেঁচে থাকে। হয়তো গাছটি বাংলা একাডেমি চত্বরে ভালো থাকবে। এই তাঁর আশা।
প্রায় তিন ঘণ্টার আলাপ শেষে বেরিয়ে পড়লাম তিনজন। রিক্সায় চড়ে দোয়েল চত্ত্বরের কাছে শিশু একাডেমির উল্টা পাশে দেখলাম রাস্তার পাশে বেশ কয়েকটি নার্সারিতে হরেক রকমের ছোট ছোট দেশি বিদেশী গাছের চারার সমাহার নিয়ে বসেছে দোকানীরা। রিক্সা থেকে নেমে কয়েকটি নার্সারিতে জিজ্ঞেস করলাম তুরী চণ্ডাল গাছের কথা। সাত-আটটি খোঁজার পর একটিতে পেলাম স্বদেশী এই গাছটিকে। দোকানী দাম হাকাল পাঁচশ টাকা। কিছুটা দরাদরি করার পর তিনশ টাকায় মিলল গাছটি। গাছটিকে নিয়ে মুন্সিগঞ্জের উদ্দেশ্যে যখন রওয়ানা দেই তখন পড়ন্ত বিকেল। শিক্ষকের কষ্ট লাঘবের জন্য ছাত্র মামুন গাছটিকে নিজের কাধে নিতে চাইল। ল্যাপটপ আর চীন থেকে আনা দামী ক্যামেরার ব্যাগটা মামুনের কাধে দিয়ে টবে বসানো গাছটিকে নিজের কাঁধে নিয়ে চললাম বাড়ীর উদ্দেশ্যে।
©somewhere in net ltd.
১|
০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৫:৪৫
মোস্তাক খসরু বলেছেন: কত অজানারে।