নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিমুল শিকদার

শিমুল শিকদার

কিছু বলার নাই।

শিমুল শিকদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছুটির গল্প

২১ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১১:০৬

প্রতি বছর স্কুল ছুটি হলে বাবা আমাদের ডেকে জিজ্ঞেস করে - তোমরা এবার কোথায় যেতে চাও- দাদাবাড়ি নাকি নানাবাড়ি? আমরা একসাথে বলে উঠি, নানাবাড়ি। আমাদের উত্তরটা বাবার জানা। তবুও প্রতি বছর একই প্রশ্ন করে এই আশায় যদি উত্তরটা বদলায়, যদি আমরা বলি- দাদাবাড়ি। আমাদের উত্তর বদলায় না। বাবার মুখ ভার হয়ে যায়। আমাদের খুশি করার জন্য বাবা নানাবাড়ি যাওয়ারই আয়োজন করে। এমন না যে দাদাবাড়ি আমাদের অপছন্দ। সেখানে আমার আর চুনির সমবয়সী কোনো ভাইবোন নেই। নানাবাড়িতে মামাতো ভাই চপল আর রাহাত আমার কাছাকাছি বয়সী। ওদেরই বোন নিলা আর রিতা চুনির বয়সী। ওহ, চুনি আমার ছোট বোন, সেভেনে পড়ে। বছরের এসময় আমরা প্রায় সবাই নানার বাসায় জড়ো হই। এতো ভাইবোন যখন একত্র হই, তখন একটা উৎসব উৎসব আমেজ আসে।



উঁচু প্রাচীর ঘেরা নানার বাড়িটা আমার কাছে রহস্যময় মনে হয়। শহরের বাড়ি যে এতো বিশাল হতে পারে, ভিতরে না ঢুকলে বিশ্বাস হতে চায় না। বাড়ির পেছনে বিশাল বাগান, বাগানের পরে দীঘি, দীঘির ওপারে ঘন জঙ্গল। ছোট বেলায় আমাদের দৌড় ছিল পেছনের বাগান পার হয়ে দীঘির পাড় পর্যন্ত। দীঘির দুই পাড়ই ঘাট বাঁধানো। কিন্ত সে বাঁধানো ঘাট এমন ভাবে দুমড়ে মুচড়ে আছে যে ওর ভিতর সাপ-গোপ ছাড়া আর কিছু আশা করা যায় না। দীঘির চারপাশের ইয়া বড় বড় কী সব গাছ দিঘিটাকে এমন ভাবে ঢেকে রেখেছে যে ডালপালার ফাঁক দিয়ে দিনেরবেলায়ও সূর্যের আলো ঠিকমতো পানিতে পড়ে না। দীঘির কালো পানিতে কাউকে কখনো নামতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। দীঘির ওপারটা আমাদের জন্য ছিল একটা রহস্য। ছোটবেলায় আমরা দলবেঁধে দু একবার ওপারে গিয়েছি, কিন্ত ভিতরে ঢোকার সাহস পাইনি কখনো। কৃষ্ণকুমারী নামের অপূর্ব এক সুন্দরী মেয়ে নাকি এই জঙ্গলে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ছোটবেলায় ও বাড়িতে গেলে কৃষ্ণকুমারীর ভয়টা আমাদের খুব তাড়া করতো। বড় হওয়ার পর খুব জানতে ইচ্ছা হতো কে এই কৃষ্ণকুমারী? কেনই বা সে আত্মহত্যা করেছে? মা পরিষ্কার করে কিছু বলতো না। বাবাকে এ নিয়ে মার সাথে বলতে দেখেছি। রাহাতের কাছেও অনেক কিছু শুনেছি।



এই বাড়ির মালিক ছিল নানার এক ধনাঠ্য বন্ধু গৌরাঙ্গ রায়। যুদ্বের সময় হিন্দুরা বাড়িঘর ফেলে দলে দলে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে। সুযোগ সন্ধানীরা সে সব বাড়ি দখল করে নিচ্ছে। নানার তখন চোখ পড়ে গৌরাঙ্গ রায়ের এই বাড়ির দিকে। নানার তখন পাক সেনাদের সাথে দহরম মহরম খাতির ছিল। গৌরাঙ্গ রায়কে সে ইন্ডিয়া চলে যেতে চাপ দিতে থাকে। গৌরাঙ্গ রায় তাতে রাজি না হলে এক রাতে নানার লোক গৌরাঙ্গ রায়ের বড় মেয়ে কৃষ্ণকুমারীকে তুলে নিয়ে যায়। গৌরাঙ্গ রায়ের ছিল অনেকগুলো মেয়ে। ভয় পেয়ে গৌরাঙ্গ রায় কৃষ্ণকুমারীকে ফেলেই পরিবার নিয়ে এক রাতে ইন্ডিয়া চলে যায়। কৃষ্ণকুমারী ছাড়া পেয়ে দীঘির পেছনের জঙ্গলে আত্মহত্যা করে। এরপর থেকে বাড়িটা নানার দখলে। মা অবশ্য বলে বাড়িটা নানা গৌরাঙ্গ রায়ের কাছ থেকে ন্যায্য দামে কিনেছে রেখেছিল।



রাহাত ছোট মামার ছেলে। ছোটমামা কাজকর্ম কিছু করে না বলে ওরা নানার সাথেই থাকে। আমি আর রাহাত একই বয়েসি। ও স্বভাবে কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক। এজন্য পরিবারের অন্য সবার সাথে ওর সম্পর্ক ছাড়াছাড়া হলেও আমার সাথে ওর হিসেবটা অন্য রকম। আমাকে ও কেন যেন অসম্ভব পছন্দ করে। ওর সব কথা মনে হয় জমিয়ে রাখে আমার জন্য। ওর আর আমার ভিন্ন একটা জগত আছে। অন্যদিকে বড় মামার ছেলে চপল থাকে ঢাকাতে। অসম্ভব খোলা মনের, হৈ চৈ স্বভাবের ছেলে চপল। এজন্য বয়সে কিছুটা বড় হলেও ওর সাথে আমার বন্ধুর সম্পর্ক। আমুদে স্বভাবের কারনে আমাদের কর্মকাণ্ড হয় চপলকে কেন্দ্র করে। এ নিয়ে রাহাতের মাঝে মাঝে আপত্তি হয়। রাহাত বলে বড় মামার অনেক টাকা পয়সা বলে চপলের এতো গুরুত্ব, সবাই ওকে এতো আদর করে। ছোট মামা কামাই রোজগার করে না বলে রাহাতের গুরুত্ব কম, আদরও কম। আমার ধারনা রাহাতের কথা পুরোপুরি ঠিক না। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে চপল সবার সব থেকে আদরের এটা সত্য। কিন্তু সেটার কারণ ভিন্ন। চপল জানে কিভাবে ভালবাসা আদায় করতে হয়। আমি নিজেও ওকে খুব পছন্দ করি।



নানার বাসার ছাদে চিলেকোঠার কামরাটা এমনিতে সারা বছর আটকা থাকে। কিন্তু আমরা গেলে সেখানেই থাকি। মা বাবা থেকে যত দূরে থাকা যায়। সেখানে কী করছি না করছি দেখার কেউ নেই। আমাদের সাথে যোগ হয় রাহাতের স্থানীয় কিছু বন্ধু। সারা রাত তাস খেলা, লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া। এ সময় গ্রামে যাত্রা, পালাগান চলে। পালিয়ে রাত জেগে সেই যাত্রা-পালাগান দেখা, হাউজি খেলা। আমরা কী করছি কোথায় যাচ্ছি, কেউ কিছু বলে না, কেউ শাসন করে না। কী আনন্দ! কী আনন্দ!

একদিন রাতে সবাই ছাদে তাস খেলছি আর সিগারেট ফুঁকছি। চপল তাস বাটতে বাটতে রাহাতকে জিজ্ঞেস করলো, অপর্ণা মেয়েটা কেমন রে ?

রাহাত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, কোন অপর্ণা?

- তোদের প্রতিবেশী।

- রামেশ স্যারের মেয়ে?

- বাপ কি মাস্টার না কী?

রাহাত গম্ভীর হয়ে গেলো। বলল,

-এদিকে তোমার মনে হয় চোখ না দেওয়াই ভাল।

- আরে, আমি চোখ দিলাম কই? ওই তো আমার দিকে চোখ দিলো।

- ও ওরকমই, যাকে দেখে তাকেই নাচায়।

- আচ্ছা দেখি কে কাকে নাচায়।



রাহাতের ব্যাপারটা পছন্দ হল না। ওর স্যারের মেয়ে। তাছাড়া প্রতিবেশী।

প্রতিবছর এক মাসের জন্য বেড়াতে এসে নানান ফুর্তির মধ্যে চপলের প্রেমঘটিত ব্যাপার আমাদের দারুন আনন্দ দেয়। এক একটা মেয়েকে টার্গেট করবে আর সেটা নিয়ে আমাদের শুরু হয় দারুন উত্তেজনা। মেয়ের সবচেয়ে কাছের বান্ধবীকে খুঁজে বের কর, সেই বান্ধবীর মাধ্যমে খবরটা পৌঁছে দেও, মেয়ে তো প্রথমে না বলবেই, সেটাকে কিভাবে হাঁ বানানো যায় সে সব নিয়ে জল্পনা কল্পনা। আমাদের মামাতো খালাতো বোনদের ডাক পড়ে তখন। ওদেরও উৎসাহের সীমা থাকে না। বরাবর চিঠি লেখার দায়িত্বটা আমার উপর আসে। চপল বলে, তোর মধ্যে তো কবি কবি ভাব আছে, এই দায়িত্বটা তোকে দিলাম।

অপর্ণাকে নিয়ে কথা বার্তায় রাহাতের কোনো উৎসাহ দেখা গেলো না। বরং সে ক্রমশ গম্ভীর হতে থাকল। রাহাতের কোনো সহযোগিতা লক্ষণও বোঝা গেলো না। তাতে চপলের আরও জেদ চেপে গেলো। চপল ঘোষণা দিলো, অপর্ণা-প্রোজেক্ট থেকে রাহাত বাদ। তাকে বাদ দিয়ে এ প্রোজেক্ট চলতে থাকবে। রাহাত উঠে চলে গেলো। পরিস্থিতি আরও গম্ভীর হয়ে গেলো। সে রাতে তাস খেলা আর জমল না।



রাহাতকে বাদ দিয়েই চপল প্লান তৈরি করতে বসলো। আমাকে বলল, চিঠিটা লিখে ফেল।এই প্রথম কোনো হিন্দু মেয়ের সাথে প্রেম। কাজেই লেখার ধরনটা নিয়ে একটু ভাবিস। রাঁধা কৃষ্ণের ব্যাপারটা আনতে হবে। বোনদের ডাক পড়লো। সবাই গোল হয়ে বসলো। রাহাতের মামাতো বোন টুনির বান্ধবী হল অপর্ণার ছোট বোন । সে অপর্ণার রূপ গুনের ভক্ত। সে চপলকে দারুন উতসাহ দিলো। চপল জানতে চাইল, টুনি কোন চকলেট পছন্দ করে। রাহাতের আর এক মামাতো বোন মিতু আর অপর্ণা এক সাথে নাচ শিখে। চপল খুবই উতসাহিত বোধ করলো। শুধু রাহাতের ছোট বোন রিতা অপর্ণার চরিত্র নিয়ে আপত্তিকর কথা বলায় তাকেও প্রোজেক্ট থেকে বের করে দেওয়া হল।

কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই দুই দিনের মাথায় চপল অপর্ণাকে নিয়ে এক ভর দুপুরে আমাদের চমকে দিয়ে চিলে কোঠার কামরায় হাজির হল। রাহাত ভীষণ ভাবে অপ্রস্তুত হয়ে নিচে নেমে গেলো। অপর্ণাকে প্রথম দর্শনে আমার হিচকি ওঠার মতো দশা। টুনি ঠিকই বলেছে। এতো অপূর্ব সুন্দর মেয়ে আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি। সৌন্দর্যের সাথে তার খিলখিল হাসি দারুন মানিয়ে গেছে। চপল এভারেস্ট বিজয়ের হাসি হেসে বলল, কেমন দেখলি?

আমার আমার মুখে আসলেই কোনও ভাষা ছিল না।



সেদিন রাতে চপল সব ভাই বোনদের ঘোষের দোকানে লুচি-লটপটি খাওয়াল। রাহাত আর রিতা দুই ভাইবোন বাদ পড়লো। চপল বলল, রাহাতও অপর্ণার পিছে লেগেছিল, বুজলি। পাত্তা না পেয়ে এখন আজেবাজে কথা বলে। অপর্ণা আমাকে সবই বলেছে।

আমি বললাম, অপর্ণার ব্যাপারে রাহাতের আগ্রহ থেকে থাকলে, তোমার সেখানে না যাওয়াই উচিত ছিল।

- অপর্ণা তো রাহাতকে পছন্দ করে না। তাছাড়া…

- তাহলে রিতা কেন অপর্ণাকে পছন্দ করে না?

- ভাইয়ের ব্যর্থতা কি ওর ভাল লাগবে? সবই হিংসা। সহ্য হয় না।

- তুমিও তো ওদের ভাই!

- এটা হল এক ফুল দো মালি অবস্থা। এখানে হিসাব অন্য।



অপর্ণার ব্যাপারে রাহাতের কোনো বিশেষ আগ্রহ আছে তা কিন্তু আমার মনে হয় না। সব কথাই তো রাহাত আমাকে বলে। তবে অপর্ণার প্রতি রাহাতের আগ্রহ থাক বা না থাক চপলের আগ্রহ সময়ের সাথে সাথে তীব্র হতে থাকল। তার ধ্যান-জ্ঞান, শয়ন-স্বপন সবই অপর্ণা। একদিন রাতে ডেকে বলল, দেখতো আমার হাতে কী লেখা?

দেখি ডান হাতে কেটে রক্তারক্তি অবস্থা। আমি চমকে উঠলাম, তোমার এ কী অবস্থা?

- হাত কেটে নাম লিখেছি।

- কী লিখেছো এ সব?

- এটা সংস্কৃত ভাষায়। তিভাম কামাইয়ামি অপর্ণা, I Love You, Aporna.

- তাই বলে হাত কেটে সংস্কৃত চর্চা!

- সংস্কৃত অপর্ণা ভাল জানে। ওর কাছ থেকে ভাষাটা রপ্ত করার চেষ্টা করছি। সংস্কৃত ভাষায় আস্ত একটা কবিতা মুখস্ত করে ফেলেছি, শুনবি?

- এসব করলে কখন?

- Everything is possible in Love. জীবনে তো কখনো খাঁটি প্রেমে পরিস নাই বুঝবি কিভাবে?



চপলের সাথে রাহাতের দূরত্ব বাড়তে রইল। এ নিয়ে রিতার সাথে অন্যান্য বোনদের ও মনমালিন্য হল। সেবার আমাদের ছুটিটা ভারী হয়ে গেলো।



একদিন সকালে হৈচৈ শুনে ঘুম ভেঙ্গে দেখি ছোটমামা বাসার নুতন কাজের ছেলে মতিকে উঠানের পেয়ারা গাছের সাথে বেঁধে দারুন পেটাচ্ছে। নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। সবাই মিলে ছোটমামাকে থামাতে পারছে না। বড় মামী সকালে টেবিলের উপর আংটি রেখে বাথরুমে যায়, বেরিয়ে দেখে আংটি নাই। কাজের বুয়া ওই সময় মতিকে মামীর রুম থেকে বের হতে দেখেছে। ছোটমামা মতিকে পেটাচ্ছে আর জিজ্ঞেস করছে, ওই রুমে কেন ঢুকেছিলি? আংটি কোথায় রেখেছিস? মতি কোনও সদুত্তর দিতে পারছে না।

মতির নাক মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। নানা মতিকে মামার হাত থেকে উদ্ধার করে রক্তাত অবস্থায় পুলিশে হাতে তুলে দিলো।



সেদিন দুপুরে চপল আমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে ছোট একটা বাক্স হাতে দিয়ে বলল,

দেখতো কেমন হয়েছে?

বাক্স খুলে দেখলাম, সোনার আংটি।

একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, মতি বেচারাকে খামাখা মার খাওয়ালে কেন?

- ভালবাসা একটা যুদ্ধ। আর জানিসতো যুদ্ধে কোনও ন্যায় অন্যায় বিচার হয় না। আংটিটা অপর্ণাকে দিতে চাচ্ছি, তুই কী বলিস?

- মামীর কাছে চাইতে পারতে?

- আরে ধুর, মা কী দিতো না কী? ডায়মন্ডের আংটি। বাবা লন্ডন থেকে এনেছিল। দাম কত জানিস?

- তোমার উদ্দেশ্য কী?

- উদ্দেশ্য খুবই সরল। এবার এনগেজমেন্টা সেরে ফেলবো। পাশ করে চাকরি- বাকরি, তারপর বিয়ে।

- ধর্মটা বিষয় না?

- সংস্কৃতিতে একটা কথা আছে, উপায়ওগাম তু না পৃতিরভীচারায়্যাতি - ভালবাসা কোনো বাধা মানে না।

- এই কথাটা কী অপর্ণা জানে?

- এটা ওরই কথা।

- তার মানে তোমরা দুইজনেই একটা সিদ্ধান্তে এসেছ?

- Yes and That’s Final.

- বাবার মানিব্যাগ টাও কী তুমি মেরেছ?

- বুজিসতো অনেক খরচাপাতি থাকে।

- মামা মামী মানবে?

- এরমধ্যে মামা মামী এলো কোত্থেকে? This is my Love! শোন কাল সকালে তো চলে যাচ্ছি। আজ রাতে আমাদের এনগেজমেন্ট হবে। তুই কিন্তু আমার একমাত্র অতিথি.

- আর কাউকে দাওয়াত দিচ্ছো না?

- কেউ না। শুধু তুই। লোকজন বেশী থাকলে নানান ফ্যাজর ফ্যাজর যন্ত্রণা। প্রপোজালের আইডিয়া শুনবি? সতেরোটা মোমবাতি থাকবে ডানপাশে, তেইশটা মোমবাতি থাকবে বামপাশে। মাঝখানে থাকবে অসংখ্য গোলাপ ফুলের পাপড়ি। গান বাজবে- এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে। অপর্ণা মাঝখানে দাঁড়ানো থাকবে। আমি হাঁটু গেড়ে ওকে প্রপোজ করবো, Will You Merry Me? আইডিয়াটা কেমন? আমার অবশ্য অনেক টাকা বের হয়ে গেছে। No Problem, টাকা আসবে, টাকা যাবে। ভালবাসা থেকে যাবে। কী বলিস তুই।

- তোমাকে তো এতো রোমান্টিক কখনো মনে হয় নাই।

- সত্যি সত্যি প্রেমে পরলে সাহস বাড়ে, বুদ্ধি খোলে, পাখা গজায়। আমার সেই দশা। ‘আমি দুর্বার, আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার।’ হাহাহাহা….তুই থাকবি কিন্তু।

- কোথায় আসতে হবে?

- সময়মত মতো জানানো হবে।

চপল শিস বাজাতে বাজাতে নিচে নেমে গেলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চপল মুসলমান, অপর্ণা হিন্দু। সমাজ সংসারের নিয়ম অনেক জটিল। কিন্তু মনের নিয়ম তো সহজ সরল। চপল অপর্ণা নামের মেয়েটাকে ভালবাসে। হয়তো সেটা নিখাত ভালবাসা। চপল অপর্ণার সম্পর্ক নিয়ে কাউকে কোনো কথা বলতে শোনা গেলো না।



বিকেল বেলা থানা থেকে খবর এলো, মতি থানার মধ্যে রক্ত বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। নানা আমাকে আর রাহাতকে নিয়ে থানায় দৌড়ালো। ওসি সাহেব বললো, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যান, মারা গেলে ঝামেলায় পড়বেন। বাহিরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো । এর মধ্যেই মতিকে ধরাধরি করে আমরা হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তাররা অবস্থা খুব ভাল মনে করলো না। তাড়াতাড়ি করে অপারেশান থিয়েটারে নিয়ে গেলো। মতির জন্য আমার খুব খারাপ লাগছিল। অপরাধী না হয়েও বেচারার শাস্তি হচ্ছে। একবার ভাবলাম চপলের এনগেজমেন্টের কথাটা রাহাতকে বলি। আবার ভাবলাম আংটির ব্যাপারটা জানাজানি হলে ঝামেলা হবে। তাছাড়া রাহাত কেন যেন অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর হয়ে আছে। রাহাত বলল, ওর শরীর খারাপ লাগছে। ও তখনই বাসায় চলে গেলো। হাসপাতাল থেকে আমার আর নানার বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলো। একমাত্র সাক্ষী হিসেবে চপলের এনগেজমেন্টে আমার আর থাকা হলো না।



পরদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে শুনলাম চপল রাতে বাসায় ফিরেনি। সকালে চপলদের ঢাকা ফিরে যাওয়ার কথা। গুছগাছ শেষ কিন্তু চপলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ বাসা ও বাসা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব সব জায়গায় খোঁজ লাগানো হল। কিন্তু কোথাও খোঁজ মিলল না। কিন্তু তার আগেই আমি আর একটা খবর জেনে গেলাম, গতকাল রাত থেকে অপর্ণাও নিরুদ্দেশ। চপল-অপর্ণার নিরুদ্দেশ হাওয়ার খবর সন্ধ্যার আগে পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়লো। সব শুনে মামী অজ্ঞান হয়ে পড়লো। তার মাথায় অনবরত পানি ঢালা হচ্ছে। ভাই বোনরা ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না। নানা পুলিশ পাঠিয়ে অপর্ণার বাবা রমেশ কুণ্ডুকে ধরিয়ে আনলো। মামা তাকে পেয়ারা গাছের সাথে বাঁধবেই। কোনমতে তাকে ঠেকানো হল। নানা বসিয়ে ঠাণ্ডা ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, চপল কোথায়?

রমেশ কুণ্ডু কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি দাদা কিছুই জানি না। আপনার নাতি, আমার ও তো মেয়ে। লজ্জায় মুখ দেখাব কিভাবে? আমার যে ধর্ম কর্ম সব গেলো।

ছোট মামা লাফাতে লাগলো- চপল কোথায় বল, নইলে শালা তোকে কিন্তু মুসলমানি করিয়ে দিবো। আমাকে চিনিস নাই।

রমেশ কুণ্ডু কাঁদতে কাঁদতে বললেন, রাম রাম তুমি এগুলো কী বলছো? আমি ব্রাহ্মণ।

ছোট মামা হুংকার দিয়ে উঠলো, শালা ব্রাহ্মণগিরি তোর পাছা দিয়ে ঢুকাবো। মেয়ে দিয়ে ব্যবসা খুলেছিস।

এই বলে কষে একটা চড় বসিয়ে দিলো রমেশ কুণ্ডুর গালে। রমেশ কুণ্ডু ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলো।



রমেশ কুণ্ডুর গায়ে হাত তোলাটা আমার ভাল লাগলো না। পরিস্থিতি ভীষণ গুমট লাগছে। চপল অপর্ণাকে নিয়ে কেন পালিয়ে যাবে এটা আমি বুজতে পারছি না। তাছাড়া এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা ওর ছিল বলেও জানি না। আবার মনে মনে ভাবি, অসম্ভব আবেগি ছেলে, যখন যা মনে ধরে করে বসে। আমি বাসা থেকে একা একা বের হয়ে গেলাম। রাহাত সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ফিরে নাই। কোথায় গিয়েছে কে জানে? আমি রাহাতের এক বন্ধুর বাসায় রাতে থেকে গেলাম।



পরের দিন ভোরে শুনলাম, রমেশ কুণ্ডু আত্মহত্যা করেছে।



দুইদিন পর অপর্ণার খোঁজ পাওয়া গেলো। ঝিনাইদহের এক ধনাঠ্য ব্যবসায়ীর ছেলে রতন সাহার সাথে ওই দিন রাতে পালিয়ে গিয়েছিলো। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে ছুটে এসেছে।



ঠিক ওইদিন বিকেলে নানার বাসার পেছনের মঝা দিঘিতে চপলের লাশ ভেসে ওঠে। পুকুরের ওপাশের পাড় মোমবাতি আর ফুলের পাপড়ি দিয়ে সাজানো ছিলো। বাক্সের ভিতর আংটিটাও পাওয়া যায় ওভাবেই। চপল কিভাবে মারা যায় তা নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা চলে। কিন্তু আমার ধারনা, ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে পাড়ে পা পিছলে পুকুরে ডুবে যায়। চপল সাতার জানতো না। ঘটনা যাই ঘটুক, নানার রোষানলের স্বীকার হয়ে অপর্ণাকে জেলে যেতে হয়।



ঘটনাটা এখানেই শেষ হয়ে যেতো, যদি না ছোট্ট আর একটা ঘটনা এর সাথে যোগ হতো।



চপলের মৃত্যুতে সবাই মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। রাহাত ও কেমন যেন হয়ে গেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। আমার সাথে খুব একটা দেখা বা কথা বার্তা হয় না। আমাদের যাওয়ার তারিখ পেরিয়ে আরো কিছুদিন বেশী থাকতে হল। এদিকে চুনির ও স্কুল খুলে গেছে। আমার ও ক্লাস শুরু হয়ে গেছে।



যাওয়ার দিন সকালবেলা মা, চুনি ওরা কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে উঠলো। গাড়িতে উঠে আমার মনে হল, এতো লম্বা পথ চুপচাপ যেতে হবে, একটা গল্পের বই হলে সময়টা কেটে যেতো। রাহাত বই পড়ার ছেলে না, তবুও যদি ওর রুমে কোনো বই পাওয়া যায় এই ভেবে গাড়ি থেকে নামলাম। ওর খাটের নিচে ধুলো পরা নাম না জানা কয়েকটা বই খুঁজে পেলাম। তাই ব্যাগে ভরে আবার গাড়িতে উঠলাম।



গাড়িতে উঠেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেই কী একটা স্বপ্ন দেখলাম, চপল যেন বলছে, Love is a war. I am the commander of that war. Commander knows only one rule, win, win and win....and i have to win.. বলতে বলতে হা হা হা করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। আমরা কতদূর এসেছি? দুই পাশের হলুদ সরিষা ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে গাড়ি ছুটছে। জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস সরিষা ক্ষেতের গন্ধ বয়ে আসছে। চুনি সামনের সিটে ঘুমাচ্ছে। আমার পাশে বসা মা’র চোখ বন্ধ। চপল নানার পরিবারের প্রথম এবং সবার প্রিয় সন্তান। চপলের মৃত্যু মাকেও ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে।



ব্যাগ হাতড়ে একটা বই বের করলাম। আতিকুল ইসলাম না কী এক লেখক। দুই পৃষ্ঠা পড়ার পর মনে হল, সময় নষ্ট। দ্বিতীয় বইটার নাম সর্বনাশা প্রেম, লেখক মলয় কর্মকার। মনে হয় ভারতীয় লেখক। বইটা খুলতেই ভিতর থেকে টুপ করে একটা ছবি পড়লো পায়ের উপর। ছবিটা হাতে নিয়েই চমকে উঠলাম। রাহাতের সাথে তোলা অপর্ণার অন্তরঙ্গ ছবি। তার মানে রাহাত-অপর্ণার সম্পর্কের কথা চপল ভুল বলেনি। কিন্তু রাহাত এ ব্যাপারে আমাকে কখনো কিছু বলেনি। ও তো কোনো কথা আমার কাছে লুকায় না। মনটা ভীষণ ভার হয়ে গেলো।

হটাৎ একটা ঘটনা মাথায় টোকা দিলো। চপল নিখোঁজ হওয়ার দিন সকালে ছাদে রাহাত জুতার তোলার কাঁদা পরিষ্কার করছিল। মতিকে থানা থেকে হাসপাতাল নেওয়ার পর রাহাত শরীর খারাপের কথা বলে বাসায় চলে যায়। হাসপাতাল থেকে যদি সরাসরি বাসায় যায় তাহলে জুতার নিচে কাঁদা আসলো কিভাবে? তাহলে রাহাত হাসপাতাল থেকে কী অন্য কোথায় গিয়েছিলো? আচ্ছা, জুতার কাঁদা পরিষ্কার করার সময় কাদায় লেপটে থাকা কয়েকটা গোলাপ ফুলের পাপড়ি আমার চোখে পড়ে। এই গোলাপের পাপড়ি কী দীঘির পাড়ের গোলাপের পাপড়ি? তাহলে কী রাহাত সেই রাতে দীঘির ওপাড়ে গিয়েছিলো? তাহলে কী চপলের মৃত্যুর সাথে রাহাতের কোনো যোগসূত্র আছে? এসব কী ভাবছি আমি?

- আচ্ছা মা, ওদিন রাতের বেলা তুমি কোথায় ছিলে?

মা চোখ বুঝা ছিল। চমকে উঠে বলল, কোন রাতে?

- যে রাতে মতিকে নিয়ে আমরা হাসপাতালে গেলাম?

মা একটু সময় নিয়ে বলল, বাসায়ই তো ছিলাম। কেন?

- তোমার কী ও রাতে রাহাতের সাথে দেখা হয়েছিলো?

- কেন? কী হয়েছে?

আমি অস্থির হয়ে বললাম,

- আহ বলো না, মনে পড়ে কিছু?

মা একটু ভেবে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল,

- হুম, আমি রান্না ঘরের জানালা দিয়ে দেখেছি ওকে বাগানের দিকে যেতে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো তখন। আমি ওকে ডাক দিয়েছিলাম কয়েকবার। ও শুনতে পায়নি। কেন?

- বাগানের ভিতর দিয়ে কোথায় যাচ্ছিলো দেখোনি?

- ওদিকটায় তো আলো ছিল না। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিলো না। কেন জিজ্ঞেস করছিস? কী হয়েছে?



কী হয়েছে তা তোমাকে কি করে বলি? যা আছে, যা গেছে সবই তো তোমার। দূরে পাট চাষীরা পচা পাট শুকাচ্ছে। পচা পাটের গন্ধটা আমার খুব ভাল লাগে। কিন্তু এখন অসহ্য লাগছে। পেটের মধ্যে গোলাচ্ছে। প্রচণ্ড বমি বমি লাগছে।

বার্ষিক পরীক্ষার ছুটিতে নিয়ম করে সেটাই ছিল আমাদের শেষ নানা বাড়ি যাওয়া। চপলের মৃত্যুর পর নানা বিছানায় শয্যাশায়ী হয়। তার কয়েকদিন পরেই মারা যায়। ঘটনার পর রাহাতও বহুদিন নিখোঁজ ছিল। এখন সে মানসিক রোগী। কথাবার্তা বিশেষ বলে না। সারাদিন ছাদে বসে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী দেখে কে জানে?



এরপর ছুটিতে বাবা আর কখনো জিজ্ঞেস করেনি, তোমরা কোথায় যেতে চাও? আমরাও কখনো নানাবাড়ি যাওয়ার বায়না ধরিনি। এরপর ছুটি পেলে আমরা দাদাবাড়ি যাই। এতে বাবার খুশি হাওয়ার কথা। কিন্তু কেন যেন সে খুশি তাকে মনে হয় না।





মন্তব্য ১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৫:৫২

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: অসাধারণ লাগলো । সত্য ঘটনা কি ? +++++++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.