![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমাদের এক ব্লগার বড় ভাই সুহান সুহান অনেকদিন আগে এই গল্প টি লেখেন। আমি এই জীবন এ জা গল্প পড়েছি আমার কাছে এই গল্পটি অসাধারন লেগেছে।
তাই সবার কাছে রিকুয়েস্ট পড়ার জন্য
অদ্ভুত প্রেমের গল্প (পর্ব ১)
পুলক ড্রয়িং রুমে বসে আছে। একটু আগেও এই ঘরে পুলকের মা এবং রীতার মা ছিল। রীতা নামক একটি মেয়ের সাথে কথা বলতেই মায়ের সাথে এখানে আসা পুলকের। সেই মেয়েটির সাথে নিভৃতে কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্যেই তার মা আর রীতা নামক মেয়েটির মা অন্য ঘরে গিয়েছে। এটা রীতাদের ই বাসা।
‘মেয়ে দেখতে আসা’ – ব্যাপারটার মধ্যেই কেমন জানি একটা অস্বস্তিকর কিছু একটা আছে। তবে পুলক কিন্তু আগ্রহের সাথেই অপেক্ষা করছে। উলটাপালটা কথা বার্তা বলে মানুষকে ভড়কে দেয়ার কাজটা তার অনেক প্রিয়। এই জন্য বেশিরভাগ মানুষই তাকে তেমন পছন্দ করে না। এইখানে মেয়েটাকে কত তাড়াতাড়ি ভড়কানো যায়, সেটাই ভাবছে পুলক। খুব বেশী কিছু করতে হবে বলে মনে হয় না। যুক্তি দিয়ে কথা বললেই মানুষ খুব ভড়কে যায়। এটা অনেক আগেই খেয়াল করেছে পুলক। মানুষ আবেগী কথাবার্তা বললে খুব খুশি হয়। যৌক্তিক কথা ঠিক মানতে পারে না।
শাড়ি পরা একটা মেয়ে ঘরে ঢুকল। পুলক ভদ্রতা করে উঠে দাঁড়ালো। মেয়েটি বসলো। পুলকও বসলো।
-হেলো! আমি রীতা।
-আমি পুলক।
-কেমন আছেন?
-ভালো, আপনি?
-আমিও ভালো।
এরপর নীরবতা। এটা হচ্ছে সেই মুহূর্ত যখন মানুষ ভাবে যে এখন কী বলা যায়!! খুব বেশীক্ষণ নীরব থাকা লাগলো না। কারণ পুলক কথা খুঁজে পেয়েছে।
-আপনি কি করছেন?
হুমায়ূন আহমেদ এর উপন্যাস হলে উত্তর আসতে পারত, ‘বসে আছি!! দেখতে পারছেন না? আশ্চর্য মানুষ তো আপনি!!’
-আমি এমবিএ করছি।
-বাঃ! কোথায় করছেন?
-ডি ইউ তে। আই মীন ঢাকা ইউনিভার্সিটি।
পুলক ভাবছে অনেকক্ষণ চিট চ্যাট হয়েছে। এখন আক্রমনের সময়।
-খুবই ভালো। পড়াশোনা করছেন এবং ভালো জায়গায় পড়াশোনা করছেন। খামাখা বিয়ে করতে চাইছেন কেন?
রীতা যেন কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে। এরকম প্রশ্ন আশা করেনি সে একদমই।
-খামাখা বিয়ে করতে চাইছি কেন মানে?
-মানে, পড়াশোনা করছেন। নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। তার আগে বিয়ে করে ফেললে ঝামেলা না? ছেলেপক্ষ যতই লিবারেল হোক। আর বিয়ের আগে সবাই লিবারেল ভাব দেখায়। পরে দেখবেন পড়তে দিচ্ছে না, চাকরি করতে দিচ্ছে না। আগ বাড়িয়ে এরকম ঝামেলায় জড়ানোর কি দরকার?
রীতার হঠাৎ করে কেন জানি খুব মজা লাগলো। লোকটা তাঁকে ভয় দেখাচ্ছে। ঘটনা কী? প্রেমিকা আছে নাকি এনার? নাটক সিনেমায় যেমন হয়, প্রেমিকা থাকে তাও মায়ের অনুরোধে মেয়ে দেখতে আসা? ইন্টারেস্টিং!!
-কেন? আপনি আমাকে চাকরী করতে দেবেন না?
-আমি? মানে আমি আমার কথা বলছি না। আমি তো ইন জেনেরাল বলছি। মানে এখন বিয়ে করাটা আপনার জন্য বোকামি না? এই অর্থে বলছি আর কি!
-কেন? আমরা তো ‘বিয়ে’ নামক আনুষ্ঠানিকতার উদ্দেশ্যেই এখানে বসা। সো আপনি ইন জেনেরাল না বলে, নিজের কথা বলুন।
-আমার কথা?
-হম! আপনার কথা।
পুলক দেখলো যে কোথায় সে আক্রমণ করবে। উলটা তার দিকেই আক্রমণ হচ্ছে। ইটস টাইম টু রিটালিয়েট।
-ওকে। আমি পাত্র হিসেবে মোটেও সুবিধার না।
-তাই? কীরকম?
রীতা কৌতুকময় চোখে জিজ্ঞেস করলো।
-আমি খুবই বদরাগী ধরনের লোক। ধুরুম ধারুম রাগ উঠে যায়। গায়ে হাতও তুলতে পারি। খুবই পসসেসিভ। দেখা যাবে আপনি অন্য ছেলের দিকে তাকাতেও পারছেন না। এদিকে আমি অন্য মেয়ের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছি। এই নিয়ে কিছু বললেও মহাবিপদ। ভয়ানক রেগে যাবো। রোমান্টিকতার ‘র’-ও নাই আমার মাঝে। বরং ত্যাড়া ব্যাকা কথা বলে রোমানটিক মুড দূর করার আশ্চর্য ক্ষমতা আমার আছে। আমার যেটা ঠিক মনে হয়, সেটা পৃথিবী যদি উলটায়ে যাওয়ার ভানও করে তবু আমারটাই ঠিক।
এইটুকু বলে পুলক ভাবছে আর কী যোগ করা যায়! তখন রীতা তার কৌতুকময় চাহনি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো
-শেষ?
পুলক মনে মনে নিজেকে গালি দিচ্ছে। আরও কত কিছু বলবে সে ঠিক করে রেখেছিল। একটাও মনে পরতেসে না। ড্যাম!!!
-হুম! মোটামুটি।
রীতা মুচকি হাসল। তারপর সরাসরি পুলকের দিকে তাকিয়ে বলল,
-আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আপনার ইচ্ছা হলে আমাকে এই নাম্বার এ কল দিতে পারেন। আর আপনার নাম্বার আমার কাছে আছে। আমিও আপনাকে কল দিয়ে দিতে পারি কিন্তু!! এখন আমি যাই।
পুলক বেশ হতভম্ব হয়ে রীতার যাওয়া দেখল। তৈরি করে আসা পুরোটা না বলতে পারলেও যতটুকু বলেছে, একটা মেয়ের তাতে ভয় পাওয়ার জন্য যথেষ্ট মনে হয়েছিল তার। মেয়েটা দেখি ডেঞ্জারাস। এসব ভাবতে ভাবতে পুলক উঠে দাঁড়ালো।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প (পর্ব ২)
হতভম্ব পুলক বাসায় গেলো। তার মা তাঁকে বারবার জিজ্ঞেস করলো, “মেয়ে কেমন লাগলো, পুলক?” পুলক এই কথার কোন জবাব দিল না। দিলেও এড়িয়ে যাওয়া টাইপ কথাবার্তা। এরকম যে ঘটবে এটা তার ধারণাতে ছিল না। পুলকের মাস্টার প্লান ছিল যে মেয়ে দেখতে গিয়ে মেয়েকে এমন ভয় পাওয়াবে যে মেয়ে ভুলেও আর তাঁকে বিয়ে করতে চাইবে না। কিন্তু ঘটনা তো কেমন অদ্ভুত ঘটলো।
না, বর্তমানে পুলকের কোন প্রেমিকা নেই। কিন্তু আগে ছিল। সেই অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। যার জন্যই তার ধারণা তার সাথে কেউ লম্বা সময় থাকতে পারবে না। তাই সে একাই থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তার মা তার এই যুক্তি মানতে রাজি না। পৃথিবীর কোন মাই এই যুক্তি মানবে না। এটা সে জানে। কিন্তু জেনে শুনে একটা মেয়ের জীবন সে নষ্ট কখনোই করতে চায় না।
পুলকের বাবা নেই। না! মারা তিনি যাননি। বেঁচেই আছেন। কিন্তু তাঁর মা-বাবার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। পুলকের বাবা একজন মদ্যপ অত্যাচারী পুরুষ ছিলেন। বেশিদিন সেই অত্যাচার পুলকের মা সহ্য করতে পারেননি। পুলকের যখন তিন বছর বয়স। তখন তারা আলাদা হয়। এরপর পুলক কখনো তাঁর বাবাকে দেখেনি। শুধু এর ওর মুখ থেকে শুনেছে। বিয়ে না করার পেছনে তাঁর এই ‘বাবা’ও একটা কারণ। যদি পুলক তাঁর বাবার মত হয়!!! একই তো রক্ত। আর পুলক নিজেকে জানে। সে জানে তাঁর অনেক রাগ। এই রাগ যদি সে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। তাঁর মা তাঁকে অনেক যত্ন করে মানুষ করেছেন। এক ছেলে। কিন্তু অযথা আদর দেননি। যথাযথ শাসনও করেছেন। এরপরো কি কারণে পুলকের সেই ভয় কাজ করে। সে কাউকে কষ্ট দিতে চায় না।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁর জীবনে প্রেম এসেছিল। সাময়িক আকর্ষণের স্তর পাড় হওয়ার পর বুঝতে পারলো যে কোথায় বোঝাপড়ার সমস্যা হচ্ছে। মেয়েরা যেমন সবসময় চায় যে তাঁর প্রেমিক সবসময় তাঁর মেজাজ মর্জি বুঝে চলবে এটা পুলক কেন জানি মানতে পারতো না। বরং উলটা সে চাইতো যে ও আমার মর্জি বুঝে চলুক। কিন্তু সেটা তো হওয়ার নয়। সেই রাগ। সেই রাগকে বশে সে আনতে পারেনি। কখনো পারবে বলেও মনে হয়না।
তবে পুরোপুরি বদরাগী বলেই যে পুলকের পরিচয়টা দেয়া হয়ে যায় তা কিন্তু না। রাগের অংশটা যদি কেউ একটু সহ্য করে তাহলেই এরপরের নরম অংশটুকু দেখা যায়। হাতে গোনা দুই-একটা বন্ধু পুলককে জানে। একটু রাগটা সহ্য করতে পারলেই পুলকের চেয়ে ভালো মানুষ হয় না। কিন্তু প্রেম করতে গিয়ে পুরুষের রাগ সহ্য করবে, এরকম মেয়ে পাওয়া কিছুটা অসম্ভবই বটে।
এদিকে রীতার কিন্তু পুলককে ভালো লেগেছে। কিন্তু সে ধরেই নিয়েছে যে পুলকের কোন গার্লফ্রেন্ড আছে। নাইলে তো আর একটা লোক বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে এসে এসব কথা বলে না। রীতা দেখতে খারাপ না। ইউনিভার্সিটি তে অনেক ছেলেই তাঁর পিছনে ছোক ছোক করে। তাঁর কেন জানি ছোক ছোক করা ছেলে একদম পছন্দ হয় না। এরা সবাই সুযোগ পেলেই হাস্যকর কথা বলে।
স্কুল এ থাকতে একটা ছেলেকে তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। ছেলেটার খুব ভাব ছিল। তাকাতোই না ওর দিকে। ছেলেদের ভাব দেখলে তাঁর খুব ভালো লাগে। ছেলেদের ভাব দুই রকম। একদল বাদলা দিনেও সানগ্লাস পরে ঘুরে বেড়ায়। এই দলকে রীতার পছন্দ না। আরেকদল যারা সাধারণ কিন্তু কোথায় যেন তাদের মধ্যে অসাধারণ কিছু কাজ করে। তারা মেয়ে দেখলেই তেলতেলা চেহারা নিয়ে কথা বলতে চলে আসে না। এই দ্বিতীয় দলের লোক ইউনিভার্সিটি তে সে পায়নি।
তাঁকে অগ্রাহ্য করে এরকম পুরুষ সে কমই দেখেছে। তাঁর মধ্যে পুলক একজন। রীতা যে মোটামুটি দেখতে সুন্দরী, পুলক সেটাকে পাত্তাই দেয়নি। দ্যাট ইজ ভেরি ইনটারেস্টিং। এই লোক আবার সমকামী নাতো!! সুন্দরী মেয়ে হিসেবে একটা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের প্রশংশাভরা চাহনি তো সে ডিসারভ করে। তাই না?
বিয়েটা সে এখন করতে চায় না। তাঁর বাবা তাঁকে কোন চাপ দেয়নি। কিন্তু মায়ের একটা তীব্র ইচ্ছা মেয়েকে এখনি পাড় করে দেয়া। মেয়ের বয়স হয়েছে। রীতারা দুই বোন। রীতা বড়। ছোট মেয়ে মিতা ক্লাস এইটে পড়ে। ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল এ। পাকার পাকা। এখনি বাসায় মাঝে মাঝে অসময়ে ছেলদের ফোন আসে। তারা সবাই মিতাকে চায়।
রীতা ভাবছে কিছুদিন পর পুলককে একটা ফোন করবে। এই লোক মনে হয় না নিজে থেকে তাঁকে ফোন করবে। কিন্তু মেয়ে হয়ে আগ বাড়ায়ে ফোন করাটা কিরকম ডেস্পারেট হয়ে যায় না? হোক!! অন্তত লোকটার আসল কাহিনীটা জানা যাক।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প (পর্ব ৩)
মানুষ নিজেকে একা ভাবতে খুব ভালোবাসে। এটা মানুষের একধরনের কল্পনাবিলাসিতা। আমি খুব একা। আমি খুব দুঃখী। এই কথাগুলা মানুষকে এক ধরনের দুঃখজনক আরাম দেয়। তাই ১৪ তালায় শুয়ে বসে থাকা মানুষ রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে, “আমি কত একা! আমার কত দুঃখ!! আকাশের তারারাও আমার চেয়ে সুখী। ওদের কত সঙ্গী সাথি।“
এরকমই দুঃখবিলাসে রত ছিল পুলক। মানুষ প্রাণীটা অদ্ভুত। হাজার মানুষের ভিড়ে দাড়িয়ে থাকা মানুষও ভাবে , “আমি কত একা?” আবার পুলকের মত আপাতদৃষ্টিতে নিঃসঙ্গ মানুষও ভাবে, “আমি কত একা?” আসল সমস্যা মনে হয় মানুষের একাকীত্ববোধটা। এরকম সময়ই মানুষ ভাবে, “এই জীবনের রহস্য কী? মানে কি এই জীবনের?” ঠিক তখনি পাশের ঘর থেকে টিভির সুরেলা আওয়াজ আসে, “জীবন মানে জি-বাংলা।“ পুলকের মায়ের প্রিয় চ্যানেল জি-বাংলা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুলক কম্পিউটার এর পর্দায় চোখ ফেলে। ফেসবুক এর হোম পেজ খোলা। একটা মেসেজ এসেছে ইনবক্স এ। রীতা হক নামের কারো কাছ থেকে। মেসেজ এ লিখা, “আপনাকে দেখি ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট ও পাঠানো যায় না। দয়া করে কি আমাকে একটি ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাবেন?” ইয়া খোদা!! এ দেখি সেই ডেঞ্জারাস মেয়েটা!!!
পুরুষ জাতি প্রকৃতিগতভাবেই নারীর প্রতি প্রকাশ্য রকমভাবে অনুরক্ত। তথাকথিত সামাজিক শিক্ষা সেই অতিরিক্ত অনুরাগকে লুকোতে শেখায়। তারপরো অনেক সময় সেই শিক্ষা যথেষ্ট হয় না। যার ফলপ্রসূতেই পুরুষরা বাস এর ভিড়ে, অন্ধকার গলিতে নারীদের দেখলে বেসামাল হয়ে যায়।
পুলকও একজন পুরুষ। একদিনের কথায় একটি মেয়ে তার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে এতে অবশ্যই সে পুলকিত হয়েছে। কিন্তু তার সত্তার ছোট খাটো একটা অংশ এতে কিছুটা বিচলিতও বোধ করছে। পূর্ব অভিজ্ঞতা, নিজের প্রতি অবিশ্বাস এসব কিছুই এই বিচলিত হওয়ার কারণ। সে কিছুক্ষণ কম্পিউটার স্ক্রীন এর দিকে তাকিয়ে থাকলো। ভাবল যে জবাব না দিলে কেমন হয়? ধরে নিবে পুলক দেখেনি। কিন্তু ফেসবুক এ ইদানিং ইনবক্স বা চ্যাট এ কাউকে পাঠানো মেসেজ অপর পক্ষ দেখলে লিখা থাকে ‘seen’। অতএব এই অজুহাত কাজে লাগবে না।
সে কোন রিপ্লাই দিল না। সে লগ আউট করে শুয়ে পরলো। রাত তখন ১১ টা। সকাল ৯ টায় অফিস। ঘুমিয়ে পরাই ভালো। কিন্তু ঘুম তো আসছে না। মেয়েটা কি রিপ্লাই না পেয়ে রাগ করলো? করলে করুক। আবার তাকে ব্লক করে দিবে না তো? দিলে দিক গা। আচ্ছা! ওর প্রোফাইল টা তো একটু চেক করা যায়। কেউ জানবে না। নিজেকে একটা কড়া ধমক লাগালো পুলক। ক্লাস টেনে পড়া ছেলের মত আচরণ করছে সে। সে এখন ছোট নেই। একটা মেয়ের সাধারণ একটা মেসেজ পেয়েই এরকম উতলা হয়ে পড়ছে সে? ছিঃ!!
বোকা পুলক বুঝতে পারছে না যে পুরুষের উপর নারীর এই নিয়ন্ত্রণ অনেক সাধনা করা যোগীকেও টলিয়ে দেয়। আর সে কোন ছাড়। পুলক চুপচাপ চোখ বন্ধ করে ঘুমের অপেক্ষা করছে। এপাশ ওপাশ করতে করতে ঠিক যখন রাত তিনটা। তখন সে উঠে আবার ফেসবুক এ লগ ইন করলো। রীতা হক। এমবিএ করছে ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টে। ছবিতে ভালই দেখাচ্ছে। মেয়েটা তো মনে হয় সুন্দরী। কি জানি!! ওইদিন ভালো করে দেখা হয়নি। আর ছবি আজকাল প্রচুর মিথ্যা বলে। পুলক রীতার প্রোফাইলে Add Friend অপশনে মাউস পয়েন্টার টা ঘুরাচ্ছে। ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠানো মানেই তো আর একে বিয়ে করা না। তাই না? কথা বলা শুধু। এমনিতেও আজকাল কথা বলার মানুষও খুঁজে পায় না পুলক। অবশেষে, পুলক রীতাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাল। ভোর সাড়ে চারটা। তাড়াতাড়ি লগ আউট করে শুয়ে পরলো। এখন ঘুমালেও তিন ঘণ্টা ঘুমানো যাবে।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প (পর্ব ৪)
মানুষের চাওয়া খুব অদ্ভুত। যখন যা থাকে তখন তা নিয়ে সে কখনোই সন্তুষ্ট না। পিছনে ফেলে আসা অতীত নয়তো সামনে থাকা ভবিষ্যৎ ই মানুষের সবচেয়ে প্রিয়। মানুষের সবচেয়ে অপ্রিয় সময় বর্তমান। রুটিনমাফিক জীবনের খাঁচায় নিজেকে আটকা মনে করে প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ।
পুলকের জীবনও রুটিনমাফিক। সকালে ৭টায় ঘুম থেকে উঠে ৮টার মধ্যে অফিসে রওনা। অফিস করে বাসায় ফেরা সন্ধ্যা ৭টায়। খাওয়া, ফ্রেস হওয়া, মায়ের সাথে গল্প করা, কম্পিউটার এর সামনে কিছুক্ষণ বসা, ফেসবুক মুভি টিভি সিরিজ , এরপর ঘুমিয়ে যাওয়া। এর পর আবার আরেকটা দিন। একইভাবে।
মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে সে। খুব আড্ডা দিতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু কাউকে খুঁজে পায় না। তখন ভারী একা লাগে তার। তখন তার মনে হয় ইশ কেউ যদি থাকত যার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করা যাবে। মনের দুই একটা কথা বলা যাবে। এবং এই কেউটা নারী কেউ হলেই যেন পূর্ণতা পায়। এসব ভাবে আর নিজের মনেই হাসে পুলক। কি হাস্যকর চিন্তা-ভাবনা।
আজকে যখন বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে ফেসবুক এ লগ ইন করে দেখলো যে রীতা তার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করেছে এবং একটা মেসেজ ও পাঠিয়েছে।
-ধন্যবাদ ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠানোর জন্য।
-ভালো আছেন?
সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই আসল।
-ও আপনি অনলাইন? যাক ভালই হলো, আপনার সাথে একটু গল্প করা যাবে।
-হুম
-তা দিন কেমন গেলো?
-এই যেমন যায় আর কি!
-অফিস করে ফিরলেন?
-হুম
-আচ্ছা! আপনি ক্লান্ত মনে হয়। পড়ে কথা হবে।
-না না! বলেন। অসুবিধা নেই। আপনার দিন কেমন কাটল?
-এজ ইউসুয়াল!! বাসা থেকে ক্লাস। ক্লাস এর পর আড্ডা। দেন আবার বাসা। এই তো!!!
-বাঃ!! আমার আবার ওই সময়টায় যেতে ইচ্ছা করে। কোন চিন্তা নাই ভাবনা নাই।
-এখন বুঝি আপনার অনেক চিন্তা!!
-না! ঠিক তা না! এখন অনেক আজেবাজে ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হয়। কিভাবে প্রমোশন হবে। আরও বেশী বেতনের জব কোথায় পাওয়া যাবে? ভবিষ্যৎ এ কী করব? এইসব হাবিজাবি চিন্তা আর কি!!
-বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা! আপনি সিনেমা দেখেন?
-হুম! দেখি তো!! ইংলিশ মুভি আর টিভি সিরিজ দেখা হয় বেশী।
-ওঃ!! আমি আবার হিন্দি মুভি দেখি। আমার প্রিয় নায়ক রানবির। হি ইস সো কিউট।
-হুম!!
-আপনি ওর একটা মুভি দেখবেন?
-কি নাম?
-রকস্টার
-আচ্ছা দেখা যাক।
-প্লিজ দেখবেন।
-দেখা যাক। এখন যাই। আবার পরে কথা হবে।
-ওকে! বাই। আমি কিন্তু মুভি রিভিউ শুনবো আপনার থেকে।
পুলক টরেন্ট এ রকস্টার ডাউনলোড দিয়ে শুয়ে পরলো। কি এমন মুভি যে এত মাতামাতি। মেয়ে মানুষ মাতামাতি করার বেলায় ওস্তাদ। বিরক্তিকর। রানবির রানবির!!! পেপার খুললেই আজকাল এই ফজলি আমের মত ছেলেটার চেহারা দেখা যায়।
পরের দিন ছিল শুক্রবার। এইদিনটায় পুলক একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। আজকে ঘুম থেকে উঠেই আশিককে ফোন দিল। পুলকের হাতে গোনা বন্ধুদের একজন।
-কী রে! কি খবর? সকাল সকাল!!
-এই তো!! তোর কি অবস্থা? অফিস এর হালচাল কী?
-এই চলে যাচ্ছে।
-আচ্ছা!! তুই তো অনেক হিন্দি মুভি দেখস। রকস্টার নামে কোন মুভি দেখসস নাকি?
-কী ব্যাপার? তোর আবার কবে থেকে হিন্দি মুভি এর ভুত চাপলো রে?
-আরে বল না!!
-হুম দেখসি। একটু অগোছালো। পোলাটা ভালো এক্টিং করসে। রানবির!!
-হুম!! আচ্ছা এখন রাখি।
-আরে!! ঘটনা কী? সাত সকালে রকস্টার। আর এখন রেখে দিবি?
-এমনেই। পরে কথা বলবো নে।
আশিক বন্ধুকে চিনে। কোন কারণে মুড অফ হয়েছে। তাই আর ঘাটাল না।
এদিকে পুলক রাগে রাগে গজ গজ করতে করতে গত রাতে ডাউনলোড হয়ে থাকা রকস্টার দেখতে বসলো।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প (পর্ব ৫)
• কোন এক অদ্ভুত কারণে পুলকের ‘রকস্টার’ মুভি টা ভালো লাগল। শুধু ভালো না। খুবই ভালো লাগলো। কিন্তু নিজের এই ভালো লাগাটাকে তার একটুও ভালো লাগলো না। পুলক সেই পুরুষদের দলে যারা কখনোই অন্য আর কোন পুরুষের জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারে না। তার এই দিকটা সে ভালো মতই জানে। যখন সে স্কুলে পড়ত তখন যেসব অভিনেতা গায়ক জনপ্রিয় ছিল, তাদের প্রতি তার তেমন বিরাগ ছিল না। তখন মনে মনে ভাবত যে বড় হলে আমিও অনেক জনপ্রিয় কিছু একটা হব। কিন্তু যখন সে তথাকথিত বড় হল তখন দেখা গেলো যে মোটেও তার জনপ্রিয় হওয়া হচ্ছে না। তাই সে যখন দেখত যে তারই বয়সী ছেলেগুলা দারুণ নামকরা হয়ে উঠছে। মেয়েরা এদের জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে। তখন তার অসহ্য বোধ হত। একধরনের অসহায়তা কাজ করত। সে জীবনে কিছুই হতে পারলো না এই ভেবে তার মনে খুব দুঃখ হত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তার এই ইগো যথেষ্ট সমস্যা তৈরি করেছে। দেখা গেলো, তার বান্ধবী জন নামে কোন এক ব্যান্ড ভোকাল এর জন্য পাগল। ও কোন কনসার্ট এ আসলে ওই মেয়ে অবশ্যই যেত। সাথে যেতে হত পুলককে। যতবার সে জন-কে দেখত ততবার সে জ্বলে-পুড়ে মরত। কারণ তার সেই তথাকথিত ‘ইয়ো’ হওয়ার ক্ষমতা ছিল না। সে একজন সাধারণ মানুষ। তার নিজের জানামতে তার মধ্যে অসাধারণ কিছু সে খুঁজে পেত না। তো সেই মেয়ে দিনে অন্তত ৪০-৫০ বার জনের নাম জপত। এতে তাঁদের প্রতদিনই ঝগড়া ঝাটি লেগেই থাকত।
যাই হোক! পুলকের ঈর্ষা সেইসব মানুষদের ক্ষেত্রেই বেশী কাজ করে যাদের সে খুব বেশী পছন্দ করে। তাহলে এই রীতার বেলায় এরকম হওয়ার কারণ কি? মেয়েটাকে তো সে ঠিকমত চেনে না। তাছাড়া এই মেয়ের সাথে কথা বলে প্রথম দিনই সে বুঝিয়ে দিয়েছে যে সে মোটেও তাকে বিয়ে করতে রাজি না। তাহলে নিজের মধ্যে এরকম ঘাপলা থাকার কারণ কি? মেয়েটা তার প্রতি কিছুটা আগ্রহ দেখিয়েছে। এটাই কি অবচেতন মনে এইভাবে কাজ করছে?
পুলক দেখতে খারাপ নয়। অনেকে তাকে সুপুরুষই বলবে। নারীমহলে তাকে সুদর্শন হিসেবেই অভিহিত করা হয়। কিন্তু তারপরো সেরকম ঘন ঘন নারীর আগমন তার জীবনে ঘটেনি। এর অন্যতম কারণ পুলক নারীদের কখনো আগ বাড়িয়ে পাত্তা দিত না। এমন না যে তার নারীসঙ্গ কাম্য না। তবে তার পৌরুষ তাকে চিরাচরিত ছ্যাবলা পুরুষ হতে নিরুৎসাহিত করত। সে দেখত যে ছেলেগুলা কিভাবে মেয়েগুলার পিছনে ঘোরে। আর মেয়েগুলা কিভাবে এদের বিভিন্নভাবে অপমান করে। তাও ছেলেগুলার কোন থামাথামি নাই। তারপর কোন এক সময় হয়তো কোন মেয়ে তাঁদের পিছনে ঘুরা ছেলেদের মধ্যে থেকে একজনকে প্রেমিক উপাধি দান করে। এরকম অপমানজনক পদ্ধতিতে কোন নারীর প্রেমিক হওয়া তার ধাতে সয়নি। তাই সে ঠিক করেছিল যে মেয়েদের যখন এত দেমাগ। তারই বা কম কিসে। সেও কাউকে পাত্তা দিবে না। সে না হয় দেখতে অত সুন্দর না। অপমানিত হওয়ার ভয়ে সে কোন মেয়েকেই পাত্তা দিত না। এতে মেয়েরা অনেকে তার প্রতি আগ্রহী থাকলেও ভয়ে তার দিকে কেউ অগ্রসর হত না। কারণ পুলক দেখতে সুপুরুষ হলেও চার্মিং সুপুরুষ নয়। তার চেহারার মধ্যে গাম্ভীর্য বেশী। যদিও সে সেরকম গম্ভীর নয়। মন মেজাজ ভালো থাকলে সে যথেষ্ট ফুর্তি করতে পারে।
তো শুক্রবার বিকেলে বসে বসে সে রীতার প্রিয় মুভি রকস্টার দেখল। রানবির নামক ছেলেটা এত ভাল অভিনয় করলো যে তার জ্বলুনি বেড়ে গেলো। এবং তার এই জ্বলুনি কেন বাড়ছে এরও কোন যৌক্তিকতা খুঁজে না পেয়ে তার মেজাজ আরও খারাপ হচ্ছে।
সন্ধ্যায় ফেসবুক এ। পুলক অফলাইন হয়ে আছে। সে বেশিরভাগ সময় অফলাইন এই থাকে। বেশীরভাগ মানুষের সাথেই কথা বলে সে মজা পায় না। প্রথম প্রথম ফেসবুকে সে যথেষ্ট গল্প করত। অচেনা মেয়েদের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টও দিত। ফেসবুক ছিল তার সেই জগত যেখানে সে সেই সব করত যা সত্যিকারের জীবনে করতে পারত না। এভাবে তার অনেক মেয়ে বন্ধু হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে থেকেই একজনের সাথে তার তথাকথিত প্রেম হয়েছিল। সেই প্রেম মোটেও সুখকর ছিল না। এরপর থেকে আর সে ফেসবুকের জগত আর সত্যিকারের জগতে তফাৎ রাখে না। যাই হোক! পুলক মাঝে মাঝে অনলাইন হচ্ছে এই দেখতে যে রীতা অনলাইন কিনা! কিছুক্ষণ এভাবে চেক করার পর সে ক্ষান্ত দিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ইনবক্স এ মেসেজ আসল।
-আছেন?
-হুম।
-কী খবর?
-ভাল
-রকস্টার দেখেছেন?
-হুম! দেখলাম।
- কেমন লাগলো? ভালো না? রানবির দারুণ না?
- আছে। চলে আর কি! এমন কিছু না। It was OK.
-OK? কি বলেন?
-হুম। সেরকম আহামরি কিছু মনে হয়নি আর কি। ছেলেটা ভাল করেছে।
-শুধু ভালো না। অনেক ভাল করেছে। আপনি আসলে ভালো বলতে জানেন না। আমার সব ফ্রেন্ড ওর জন্য পাগল। আর আপনি বলেন OK!!!
রীতা এর কথা পড়ে পুলকের ভিতরে মোটামুটি ছোটখাটো বিস্ফোরণ ঘটল। সে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে কীবোর্ড এর উপর ঝড় বইয়ে দিল।
- শুনুন!! প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ আছে। আপনার ভালো লাগলেই তা আমার ভালো লাগতে হবে এমন কোন কথা আছে? আমার ভালো নাই লাগতে পারে। ইন ফ্যাক্ট!! ওই ফজলি আমের মত চেহারার নায়ককে আমার একটুও পছন্দ না। আপনারা মেয়েরা মাতামাতি করতে পারেন খুব সহজে। একটা জিনিসকে পচায়ে না ফেলা পর্যন্ত আপনাদের কোন শান্তি নাই। প্রথম দিন থেকে রানবির রানবির করে কানের পোকাটা নাড়ায়ে ফেলতেসেন। জীবন মানেই আপনাদের কাছে সিনেমা আর ন্যাকামি। ন্যাকামি ছাড়া এক পা চলতে পারেন না আপনারা।
পুলকের এরকম রেস্পন্সে তো রীতা বেশ হতভম্ব হলো। লোকটা দেখি আস্ত পাগল। পুলক তখনো লিখে যাচ্ছে।
রীতা লিখল,
-আরে!! আপনি এরকম করছেন কেন?
- এরকম করছি কেন মানে? How dare you যে আপনি আমাকে বলেন আমি ভালো বলতে জানি না!! যেটা ভালো সেটা এম্নিতেই মানুষ ভালো বলবে। এখন আপনার ভালো লাগার উপর ভিত্তি করে আমাকে ভালো বলতে হবে?
-আশ্চর্য মানুষ তো আপনি!! আপনার মত মানুষ আমি জীবনে দেখিনি।
পুলক আরো ফুঁসতে লাগলো। তার রাগ এখন যে পর্যায়ে সেখানে শুধু লিখে তা বোঝান যাবে না। সে শুধু লিখল,
-সরি! আপনার সাথে আর কথা বলতে চাচ্ছি না।
এই লিখে সে তক্ষুনি রীতার প্রোফাইল এ গিয়ে ওকে ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে বাদ দিল। কম্পিউটার বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে লম্বা শ্বাস নিল। কত বড় সাহস তাকে কথা শুনায়!! এই মেয়ের সাথে সে জীবনে কথা বলবে না। একে আসলে ব্লক করে দেওয়া উচিৎ ছিল। আজকে আর কম্পিউটার খুলতে ইচ্ছা করছে না। কালকে সকালে উঠেই একে ব্লক করতে হবে। যত্তসব!!!
অদ্ভুত প্রেমের গল্প (পর্ব ৬)
তুচ্ছ কারণ থেকে যেসব রাগের উৎপত্তি সেসব রাগ এক ঘুম দিলেই পানি হয়ে যায়। রাগের সময়টা অতিরিক্ত রাগী মানুষেরা যুক্তিকে ঠিক পাত্তা দিতে চান না। কারণ রাগেরও একটা মাদকতা আছে। রাগী মানুষের কাছে রাগ অনেকটা নেশার মত। তারা জানে এটা করা ঠিক না। কিন্তু করার কারণ খুঁজে পেলে তারা তা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। সে কারণ সবসময় যৌক্তিক নাও হতে পারে।
পুলক সকালে উঠে ফেসবুক এ গেলো। দেখল যে রীতা তাকে ইনবক্স করেছে।
-কোন কারণে আপনি আমার উপর খুব রাগ করেছেন। যদিও আমি এখনো তা বুঝতে পারিনি। তারপরো আপনাকে রাগানোর জন্য I am sorry.
এমনিতেই ঘুম থেকে উঠার পর থেকে তার মনে হচ্ছে কালকে একটু বেশী বেশী করা হয়ে গেছে। সে তো এখন আর বাচ্চা নেই। তার তো নিজেকে আরো কন্ট্রোল করা উচিৎ।
পুলক রিপ্লাই দিল,
-আসলে আমিই সরি। হঠাৎ করে কেন জানি খুব বেশী রাগ উঠে গেলো। I hope আপনার মনে আছে আমি আপনাকে আপনাদের বাসায় বলেছিলাম যে আমি অনেক বদরাগী। আশা করি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন। যাই হোক!! ভাল থাকবেন।
পুলকের মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। তার সাথে আসলেই কেউ থাকতে পারবে না। নরমাল সিনেমার নায়ক নিয়ে মানুষ তার সাথে কথা বলতে পারে না। সারা জীবন থাকা তো ইম্পসিবল।
মনের দুঃখে সে ফেসবুক যাওয়া বন্ধ করে দিল।
এদিকে রীতা নিয়মিত পুলকের জন্য ফেসবুক এ অপেক্ষা করে। ইনবক্স করেছে অনেক মেসেজ। কিন্তু না seen হয়নি এখনো। লোকটা কি ফেসবুক এ আসাই বন্ধ করে দিল!!!
এক সপ্তাহ যাওয়ার পর রীতা পুলককে ফোন করলো।
- হ্যালো!
- আমি রীতা বলছিলাম।
- ও হ্যাঁ! বলুন। কেমন আছেন? (পুলক কিছুটা আড়ষ্ট। মেয়েটার সাথে খুব বেশী খারাপ ব্যবহার সে করেছিল। দুই দিনের কথায় এরকম ব্যবহার করার কোন যৌক্তিকতা নেই। আল্লাহ জানে কি বলতে চায় ও!!)
- আমি তো ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো? কোন খোঁজ নেই কিছু নেই। কোথায় আছেন আপনি এখন?
- আমি? আমি অফিস এ।
- বাসায় গিয়ে ঠিকঠাক মত ফেসবুক এ ঢুকবেন। (রীতার কণ্ঠে আদেশের সুর)
- কেন?
- আমি বলেছি তাই। অফিস এ আপনাকে বিরক্ত করবো না। ফেসবুক এ কথা হবে।
- আচ্ছা।
পুলক ঠিক বুঝতে পারলো না কি হল!! কিন্তু কেন জানি তার খুব খুশি লাগলো। এই খুশি যাবতীয় পুরুষ জাতি হয় যখন কোন মেয়ে তার উপর অযাচিত অধিকার ফলায়।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প (পর্ব ৭)
এরপর খুব অদ্ভুতরকমভাবেই পুলক আর রীতার মধ্যে খুব সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠল। আপাতত সম্পর্কটিকে বন্ধুত্ব বলতে পারি। রীতা ক্লাস করে বাসায় এসে অপেক্ষা করে কখন পুলক আসবে আর তারা ফেসবুক এ চ্যাট করবে। ফেসবুক এ চ্যাট ছাড়া তারা ফোনেও কথা বলে। বলা বাহুল্য যে পুলক কে আবার নতুন করে রীতাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতে হয়েছিল ফেসবুক এ। দুইজনই তাঁদের বাসায় বলে দিয়েছে যে আপাতত তারা বিয়েতে আগ্রহী নয়। পুলকের মা এতে কিছুটা রাগ করেছে। রীতার বাবা সবসময়য়ই মেয়ের সিদ্ধান্তকে মূল্য দিয়েছে। কিন্তু রীতার মাও বেশ রাগ করেছে। দুই পরিবারের কোন পক্ষই জানে না যে পাত্র-পাত্রির মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে।
রীতা আর পুলকের মধ্যে আপাতত অভ্যস্ততার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পুলকের এখন আর তেমন একা আর দুঃখী লাগে না। সে অফিস করে। বাসায় এসে ফোনে বা ফেসবুক এ রীতার সাথে গল্প হয়। এখন সে রীতাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে। রীতা কিন্তু তাকে ‘আপনি’ ই বলে। এই ‘তুমি বলা’ অন্তরঙ্গতার চেয়ে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পাওয়া অধিকার।
এরমধ্যে রীতা জেনে গেছে যে পুলকের কোন বান্ধবী নেই। এতে সে মনে মনে কিছুটা খুশি। তারপরও সে বাসায় ইতিবাচক কিছু জানায়নি। তার কারণ সে এত জলদি বিয়ে করে ফেলতে চায় না। আর এখন সময়টা তার খুবই ভালো যাচ্ছে। পুলক নামের এই পাগল কিসিম লোকটার সাথের এই সম্পর্কটা সে আরো কিছুদিন এইভাবে উপভোগ করতে চায়। এই লোকটা খুব সহজে রেগে যায়। প্রথমদিকে তো সে বুঝতেই পারতো না যে লোকটা কখন কোন কারণে রেগে যাচ্ছে। যেমন একবার কথায় কথায় সে পুলককে ‘বেকুব’ বলেছিল। এমন সিরিয়াস কিছু না। ঠাট্টা করে। সেই জন্য এই লোক তার সাথে দুই দিন ঠিকমত কথা বলেনি। অনেক কষ্টে সে এই রহস্য উন্মোচন করতে পেরেছিল। এখন সে মোটামুটি বুঝতে পারে কোন কথায় কখন তার মুড এক্কেবারে আকাশ কালো করা হয়ে যাচ্ছে। লক্ষণ বুঝা সহজ। গলার স্বর পরিবর্তন হয়। কথাবার্তা দুই-এক শব্দে শেষ করার প্রবণতা দেখা দেয়। এই তো!!
রীতা মাঝে মাঝে পুলকের কথা তার দুএকটা বান্ধবীকে বলে।
রেহানা নামে তার এক বান্ধবী বলল- বাবারে বাবা! এত দেমাগ!! এত দেমাগ তুই পাত্তা দেস কিভাবে? সুজনকে তো আমি আঙ্গুলের উপর রাখি। বসতে বললে বসে, উঠতে বললে উঠে।
কিন্তু এরকম অঙ্গুলিহেলনে চলা ছেলে রীতার পছন্দ না। ছেলে মানুষের কিছুটা আত্মসম্মান, কিছুটা পৌরুষময় রাগ থাকাটা তাকে আকর্ষণ করে।
যদিও পুলক আর রীতা আপাতদৃষ্টিতে প্রেমিক প্রেমিকা নয়। কিন্তু তারপরো রীতা অন্য কোন ছেলের কথা বললে পুলক নতুন প্রেমিকের মতই ফুঁসে ওঠে। একটা কথোপকথন এর বর্ণনা দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।
-জানেন!! আজকে না দারুণ একটা ঘটনা ঘটেছে।
-কি ঘটনা? আজকেও তোমার কোন বান্ধবী আছাড় খেয়ে পড়ে গেছে!!! হাহাহা!!
-আরে না! রোজ রোজ কি মানুষ আছাড় খায় নাকি!! ওইদিন বৃষ্টি ছিল দেখে উপমা টাল সামলাতে পারেনি।
-যাই বলো!! তাই বলে ওইরকম একটা দশাসই শরীর নিয়ে স্যার এর গায়ের উপর পড়ে যাওয়া। হাহাহাহাহাহা।
-হাহা ভেরী ফানি।
-বল কি দারুণ ঘটনা ঘটেছে।
-আজকে এত সুন্দর একটা ছেলে বাইক নিয়ে ইউনিভার্সিটি তে আসছিল!! আমরা তো একেকজন দেখে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম।
-(গলা চড়ে গেলো)তোমাদের কাজই তো এই। রাস্তায় যাকে তাকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যাও। তোমাদের কোন রুচিবোধ নেই। তোমার সাথে তো আসলে আমার কথা বলাই উচিৎ না।
-(হাসি চেপে)কেন? আমি আবার কী করলাম?
-(গলার স্বর চড়া)কিছু না। এখন আর কথা বলব না।
-না আমার কথা তো শেষ হয়নি। কথা শেষ না হলে ফোন রাখতে পারবেন না।
-(জোর করে গলা স্বাভাবিক করে) ওকে!! শেষ কর।
-ছেলেটা যখন কাছে এসে বাইক পার্ক করলো। তখন দেখলাম যে ছেলেটা আসলে বেশী সুন্দর না।
-(নরম স্বরে) হুম!!
ফোনের অপর প্রান্তে থাকা রীতার তখন খুব এই বোকা পাগল লোকটাকে খুব ছুঁতে ইচ্ছা হলো।
পুলক যে ভিতরে ভিতরে রীতার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে এটা সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। কিন্তু এটা সে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার অন্যতম কারণ হলো যে সে যেরকম ঠিক সেভাবেই তাকে রীতা গ্রহণ করতে পারছে। এটা খুব কম ক্ষেত্রেই পুলকের জীবনে ঘটেছে। স্বাভাবিক কথা বার্তাতেই মানুষকে ভড়কে দেওয়ার একটা প্রবণতা তার থাকে। এতে অনেকেই তাকে ভুল বোঝে। যেমন একবার ফেসবুক এ একটা মেয়ে তাকে তার মায়ের শরীরের কথা জিজ্ঞেস করলো।
-আপনার মা কেমন আছেন?
-বেচে আছে। এখনো মরে নাই।
এরপর থেকে ওই মেয়ে আর তার সাথে কথা বলে না। পুলকও বলে না। এটা পুলকের এক ধরনের টেস্ট। কিন্তু রীতাকে সে এই টেস্ট করেছে। রীতা কখনোই তাকে জাজ করে না। যেমন ওইদিনই কথা হচ্ছিল।
পুলক বলল
-মায়ের শরীরটা ভালো না।
-কি হয়েছে আন্টির?
-হাটু ব্যথা। শরীর নাড়াচাড়া করতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে যে কোন দিন পট করে মরে যাবে। বয়স তো ষাট হয়ে গেলো।
-আপনি যে এরকমভাবে কথা বলেন মানুষ আপনাকে ভুল বুঝবে।
-কি রকমভাবে বলি!!
-মায়ের কথা কেউ এইভাবে বলে?
-আমি বলি।
-আপনি সবাইকে দেখান যে আপনি খুবই কঠিন। কিছুই আপনাকে স্পর্শ করে না। কিন্তু এটা তো সত্যি না।
পুলক ভিতরে ভিতরে চমকে ওঠে। এভাবে তো কেউ তাকে বোঝেনি। পুলকের মা পুলককে চেনে। ছেলে ঠাট্টার স্বরে অনেক কথা বলে। আবেগ দেখানো একদম পছন্দ করে না। পুলক কখনো মাকে জন্মদিন উইশ করে না। কিন্তু জন্মদিনের জন্য ঠিকই কিছু না কিছু কিনে আনে। ভাব করে এমন যে এমনেই কোন কারণ ছাড়াই দিচ্ছে।
কিন্তু রীতা তো এসব জানে না। তাও কিভাবে সে এসব বুঝতে পারে।
একটা অদৃশ্য হাত যে সে রীতার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে তা সে ক্ষণে ক্ষণেই টের পাচ্ছে।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প (পর্ব ৮)
পুলক আর রীতার এখন মাঝে মাঝে দেখাও হয়। শনিবারে রীতার ক্লাস থাকে। পুলকের অফিস ওইদিন বন্ধ। তো রীতার ক্লাস এর পর ওরা দেখা করে। একটু ঘুরা ফিরা, গল্প আড্ডা চলে। যদিও রীতা বেশীক্ষণ থাকতে পারে না। সন্ধ্যার পর বাইরে থাকার অনুমতি নেই তার বাসা থেকে। তাতে পুলকের কোন অভিযোগ নেই। যতটুকু সময় কাটায় ওটাতেই সে খুশি থাকে।
রীতার ক্লাস দুইটা পর্যন্ত চলে। পুলক ক্যাম্পাসে চলে যায় ২টার মধ্যে। মাঝে মাঝে এরকমও হয় যে রীতা ক্লাস না করে পুলককে ফোন দেয় আগে আগে চলে আসার জন্য। ওর নাকি ওইদিন ক্লাস করতে ভালো লাগছে না। পরীক্ষা না থাকলে দেখা যায় শনিবার দিনটা পুরোটাই ওরা একসাথে কাটাতে পারে। দুইজনই মনে মনে শনিবারের জন্য অপেক্ষা করে। বলে রাখা ভালো যে এখনো তাদের প্রকাশ্য সম্পর্ক শুধুই বন্ধুত্ব।
সারাদিন ঘোরার পর পুলক তাকে রিকশা করে দেয়। তারা কেউ কাউকে ভালোবাসার কথা বলে না। কেউ কাউকে স্পর্শও করে না। কিন্তু তারপরও এই তথাকথিত বন্ধুত্বের বাইরেও একটা সম্পর্কের আবহকে তারা অগ্রাহ্য করতে পারে না। চোখে চোখে বহু কথা হয়ে যায় যা মুখে হাজার বার বলেও বোঝান যায় না। অন্যদের কাছে এই ব্যাপারটা যথেষ্ট ড্রামাটিক মনে হলেও ওদের কাছে মনে হয় এই তো স্বাভাবিক।
যাই হোক!! সম্পর্কের কিছু নতুন দিক আছে। রীতা পুলককে এখন তুমি সম্বোধন করে। কখন যে আপনি থেকে তুমি তে এসেছে এটা দুইজন ঠিকই জানে। কিন্তু ভাব করে এমন যে এটাই স্বাভাবিক।
আরও কিছু নতুন দিক আছে। যেমন আগে খালি পুলক রাগ করতো। এখন মাঝে মাঝে রীতাও রাগ করে। তবে তাঁর রাগ অযৌক্তিক রাগ না। যেমন পুলকের মেজাজ খারাপ হলে সে বেশীরভাগ মানুষের সাথেই উগ্র আচরণ করে। এই তো সেদিন পুলকের অফিস এর এক কলিগের সাথে দেখা ওদের। কোন কারণে পুলক একে দেখতে পারে না। তো সেই লোক চিরাচরিত ভণিতামূলক সামাজিকতা রক্ষার জন্য পুলকের সাথে অনেক বেশী সামাজিক কথাবার্তা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু পুলক ভান করতে একদমই ভালোবাসে না। সে মোটামুটি লোকটাকে পাত্তাই দিল না। এখন এদিকে রীতা খুবই অদ্ভুত অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। এই লোক তো আর তাঁর পরিচিত না যে সে সামাজিকতাটা রক্ষা করবে। পরে বেচারা লোকটা নিজেই বিদায় নিয়ে চলে যায়।
-ঘটনাটা কী হল?
-কী ঘটনা?
-তোমার অফিস এর কলিগ। তুমি তাঁর সাথে ঠিকমত কথাই বললা না!!
-এরকম ধামাধরা লোকদের সাথে আমি কথা বলি না। এ একটা বিশ্ব ধামাধরা চামচা। সারাক্ষণ বসের পিছে পিছে ঘুরে আর এর ওর নামে বদনাম করে। অথচ সামনে দেখা হলে ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না।
-যেটাই হোক। উনি না হয় এরকম। তাও তুমি কেন এরকম ব্যবহার করবা?
-বাঃ! তাও তুমি ওর সাপোর্ট নিচ্ছ!!!
-আমি মোটেও ওর সাপোর্ট নিচ্ছি না। ও আমার কেউ লাগে না। কিন্তু আমি চাই না তোমাকে কেউ খারাপ জানুক, খারাপ বলুক।
-দেখ রীতা!! এই লোক দেখানো ভাল আমি কখনো হতে চাই না। এই ভদ্রতার মুখোশে থাকা লোকজনদের দলে আমি যেতে চাই না।
-আমি জানি যে তুমি লোক দেখানো না। কিন্তু আমি চাই না তুমি কারো সাথে খারাপ ব্যবহার কর। ব্যাস!! এই নিয়ে আমি কোন কথা শুনতে চাই না।
-না এটা তো হলো না। তুমি লজিক এ আস।
-কোন লজিক ফজিক না। তুমি যদি এরপরো এরকম কর। তাহলে খুব খারাপ হবে।
পুলক ভিতরে ভিতরে রীতাকে ভয় পায়। কারণ রীতা তাঁর মত হুট হাট রাগ করে না। তাঁর রাগের পিছনে সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে। আর এই ধরনের রাগ সহজে যায়ও না। তাই সে এরকম পরিস্থিতিতে রীতার কথাই মেনে নেয়।
যথারীতি রীতাকে রিক্সা করে দিচ্ছে পুলক। তাঁদের দুইজনের বাসা দুইদিকে। রীতাকে উঠিয়ে পুলক নিজের বাসায় যাবে।
-এই রিকশা যাবেন?
-কই যাইবেন?
-মৌচাক।
-১০০ টাকা
-কি?????????????
আকাশ থেকে যেন গরম কড়াইয়ে পড়ল পুলক। রাগে তাঁর মনটা চাচ্ছে বেটার মাথায় একটা গাঁট্টা মারে। সে তাকে ভদ্র ভাষায় তুই তোকারি মুলক কিছু কথা বার্তা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ দেখল যে রীতা তাঁর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পুলক হাত মুঠ করে রিকশাওয়ালার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে অন্য রিকশার খোঁজে গেলো।
রীতা নিজের মনে হাসতে লাগলো। এই পাগলকে সে কাছ ছাড়া করতে পারবে না।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প (পর্ব ৯)
৩১ শে মে, ২০১৩ রাত ৯:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
রীতা মিতার মা নাজমা হক কড়া মহিলা। বিশেষ করে মেয়েদের বেলাতে কখনোই খুব একটা ছাড় দেননা। বড় মেয়ে রীতাকে তিনি খুবই কড়া শাসনে বড় করেছেন। মিতাকেও একইভাবে করার চেষ্টা করছেন কিন্তু কাজ হচ্ছে না। দুই বোন দুই প্রান্তের। বড়জন কখনোই তাঁর অবাধ্য হয়নি এবং তিনি জানেন হবেও না। খালি বিয়েটা নিয়েই একটু চিন্তার মধ্যে আছেন তিনি। সময়মত বিয়েটা হয়ে গেলে ভালো হয়। তবে বিয়ে তো আর ছেলেখেলা না। ভেবে চিন্তে দিতে হবে। আরেকটু হলেই রীতাকে ভুল জায়গায় বিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলেছিলেন। না ছেলে দেখতে শুনতে খারাপ ছিল না। ছেলের মায়ের সাথে কথা বলেও তাঁর খারাপ লাগেনি। কিন্তু পরে তিনি জানতে পেরেছেন যে ছেলের বাবা মা ডিভোর্সড। আর ছেলের বাবা নাকি মহা অত্যাচারী ছিল। যে ছেলের বাবা এমন সে ছেলেও যে এমন হবে এটা তো স্বাভাবিক। ভাগ্যিস এই পক্ষের সাথে আর কথা বেশিদূর আগায়নি। তনুজার কাণ্ডজ্ঞান দেখে তিনি খুবই মর্মাহত। তনুজা রীতার মায়ের বান্ধবী। তনুজা কিভাবে জেনে শুনে তাঁর মেয়ের জন্য এরকম একটা বাজে সম্পর্ক নিয়ে আসলো। জেনে শুনে তিনি মেয়েকে কি হাত পা বেঁধে পানিতে ফেলে দিবে? যাক রীতার যে ছেলে পছন্দ হয়নি এটাই শান্তি।
রীতার বাবা সালাম সাহেব। উনার উপরও নাজমা খুবই বিরক্ত। মেয়েকে একদম মুক্তমনা হওয়াতে চায়। মেয়ের সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত। হুহ!!! বাচ্চা মেয়ে। ওর আবার কিসের সিদ্ধান্ত। এই দুনিয়া শুধু আবেগে চলে না। বাবা মা থাকে কি জন্য! বাচ্চাদের জীবন যেন সঠিক পথে থাকে। তারা যেন শান্তিতে থাকে। এই জন্যেই তো!! তাঁদের সময়েও বাবা মা রা তাই করেছিলেন। কই তারা তো খারাপ নেই। আর বেশী সময় নেই। জলদি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবেন। মেয়ে তাঁর দেখতে ভালো। খালি গায়ের রঙটা আরেকটু ফর্সা হলে ভাল হত। তাঁর নিজের গায়ের রঙ ধবধবা ফর্সা। এত বছরেও গায়ের রঙ নষ্ট হয়নি। রীতা তাঁর বাবার দিকের গায়ের রঙ পেয়েছে। আবার ছোট মেয়ে মিতা আবার বেশী ফর্সা। এই মেয়ের বেলায় যে কি হবে খোদা তালাই ভালো জানেন!! এর মতি গতি সুবিধার না। ক্লাস সেভেন এ পড়ে। অথচ এখনই ছেলেবাজ হয়ে যাচ্ছে। রীতিমত পাহারা দিয়ে রাখতে হয় মেয়েকে। স্কুল এর বাইরেই ছেলেগুলা দাঁড়িয়ে থাকে। আচ্ছা!! এদের কি সারাদিন কোন কাজ থাকে না!! এদের বাবা-মা গুলা এদের শাসন করে না কেন? সারাদিন মেয়েদের স্কুল এর সামনে দাঁড়ানো। আশ্চর্য!!!এদিক দিয়ে বড় মেয়ের বেলায় শান্তি পেয়েছেন তিনি। বড় মেয়ে রীতা বরাবরই লক্ষী। ইউনিভার্সিটি তেও কারো সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই। প্রথম দিকে মেয়েকে একটু নজরে রাখত। মেয়ে বড় হয়েছে। ছোটবেলায় যেরকম ছিল বড়বেলাতেও তেমনই থাকবে ভাবা ঠিক না। কিন্তু রীতা কোন ছেলের প্রতি আগ্রহী হয়নি। কিছু ছেলে সহপাঠী আছে। কিন্তু তাঁদের দেখে সে বুঝেছে যে সেরকম কিছু না। ছেলেদের দিক থেকে থাকলেও মেয়ে যে এদের ওইরকমভাবে পছন্দ করে না তা বোঝা যেত।
‘মা!!! তোমার ফোন। তনুজা আন্টি।“ – রীতার গলা ভেসে এল পাশের ঘর থেকে।
নাজমা শোবার ঘরে বসে ছিলেন। উঠে দাঁড়ালেন। মনে মনে তনুজার সাথে ঝগড়া করার জন্য তৈরি হচ্ছেন। কি যেন ছেলেটার নাম!!! হ্যাঁ! পুলক আহমেদ। এরকম একটা ছেলের সাথে তাঁর মেয়ের সম্পর্কের কথা ভাবলো কি করে তনুজা?
পাশের রুমে রীতা তখন পুলকের সাথে ফেসবুক এ চ্যাট করছে। পুলক তাঁকে কিসব জানি লিখছে কিন্তু সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
-ATB
-মানে?
-মানে কিছু না। এমনি বললাম আর কি।
-এমনি বললাম আর কি মানে কি!! ঠিক করে বল পুলক।
-আরে বললাম না এমনি। তুমি কিন্তু বেশী কথা বল।
-ওকে যাও কথা নাই বলি তাহলে।
-ওকে!!
-আচ্ছা থাক। রাগার মত কিছু হয় নাই। কিন্তু কথাটার মানে তো আমাকে জানতে হবে।
-না জানতে হবে না।
-হবে।
-হবে না।
-হবেই।
-আচ্ছা আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। অফিস এ কালকে অনেক কাজ। গেলাম।
-ওকে!! অফিস এর কথা বলে এখন পাড় পাচ্ছ। কিন্তু আমাকে এটা জানতেই হবে পুলক সাহেব।
-বাই
মনটা খচ খচ করছে। পুলক কি লিখল এটা। এখন আবার মানে বলতে চাচ্ছে না। সে তখনি পুলককে এসএমএস করল।“পুলক! আমার ঘুম আসবেনা এটা না জানলে। পরে আমার খুব শরীর খারাপ করবে।“ এটায় কাজ হওয়ার কথা। পুলকের সাথে একবার ঝগড়া করে রাতে তাঁর খুব শ্বাসকষ্ট হয়েছিল। পুলক এটা জেনে এখন খুব ভয়ে থাকে। সহজে ঝগড়া করে না।
এসএমএস এর রিপ্লাই আসলো। “this is blackmailing rita!!! কথাটা এমন কিছু না। মানে আমার এক বন্ধু তাঁর বান্ধবীকে এরকম বলেছিল। আমিও বলে দেখলাম আর কি। সিরিয়াস কিছু না।“
-উফফ!! ভনিতা ছাড়ো। এটার মানে কি!!
-শুনো। মানে বলছি। তাঁর আগে বলে রাখি যে এটা কিন্তু আমার কথা না। A- আমি T- তোমাকে B- ভালোবাসি। এরকম করে আর কি ওই ফ্রেন্ড বলেছিল ওর বান্ধবীকে। আমি দেখলাম যে তুমি বুঝো কিনা!!
রীতার শরীরটা ঝিম ঝিম করছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দা থেকে ঘুরে আসলো। পুরা বাসাটা একবার হেঁটে আসলো। তাঁর মা ফোনে কার সাথে জানি ঝগড়া করছে। কিন্তু কথাগুলা তাঁর কানে ঢুকল না। তাঁর শুধু মাথায় ঘুরছে ATB। আবার বারান্দায় গিয়ে গ্রিল ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। ঠিক কি করলে যে ওর মনের অবস্থাটা স্থির হবে সে বুঝতে পারছে না। ইস সে যদি এখন পুলকের হাতটা ধরতে পারত!! অল্প একটু সময়ের জন্য হলেও। তাহলে সে আর কিচ্ছু চাইতো না।
ঘরে এসে রীতা মোবাইল টা হাতে নিল। পুলককে এসএমএস করলো।
- পুলক। ATKB। এটা কিন্তু আমার কথা।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ১০)
একে অপরের জন্য। Made for eachother. কথাগুলোর মধ্যে কীরকম মেলোড্রামা কাজ করে। এই একই কথা একটু অন্যভাবে কীভাবে বলা যায়!!! আমরা যদি ক্রিকেটের বাংলা ধারাভাষ্যে যাই তাহলে বলা যায় ‘ব্যাটে বলে হওয়া’। আরেকভাবে বলা যায়। ‘খাপে খাপ মিলা’।
মানুষ সম্পর্কে আবদ্ধ হয় অনেকটা দায়ে পড়ে। কীসের দায়? সামাজিক রীতি-নীতির দায়, শারীরিক চাহিদার দায়, একাকীত্ব থেকে বাঁচার দায়, এরকম আরো অনেক ঠাহর করতে না পারা দায়। এইসব দায় থেকে বাঁচার জন্য মানুষ দিনের পর দিন সম্পর্কগুলো নিয়ে এগিয়ে যায়। এর মধ্যে ঠিক কটা সম্পর্ক ‘ব্যাটে বলে হয়’ কিংবা ‘খাপে খাপ মিলে যায়’? বলাই বাহুল্য যে উত্তরটা হবে হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র।
আপাতদৃষ্টিতে পুলক আর রীতার সম্পর্কটা হাতে গোনা সেই কয়েকটা সম্পর্কের মধ্যেই পড়ে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তথাকথিত ভালোবাসার সম্পর্কের শুরুটা সবসময়ই এক অসাধারণ অনুভূতির জন্ম দেয়। যে অনুভূতির ঠিক ব্যাখ্যা হয় না। যুক্তিবাদীদের ভাষায় বলা যায় ‘কেমিক্যাল রিএকশন’। কিন্তু তারপরেও একটা সম্পর্কের মধ্যে অনুভূতির বাইরেও বোঝাপড়ার একটা ব্যাপার থাকে। শুরুর দিকের অনুভূতি যদি কিছুটা ফিকেও হয় তাহলে সেই বোঝাপড়া সম্পর্ককে শুধু রক্ষাই করে না। আরো গভীর করে।
বেশীরভাগ সময়েই দেখা যায় একই সম্পর্কে অবস্থিত দুই জন মানুষ দুই স্তরে বিরাজ করে। অনেক সময় চেঁচিয়েও তারা একজন আরেকজনের কথা শুনতে পায় না। এমনও দেখা যায় যে তারা জানতেও পারেনা যে তাদের অবস্থান একই স্তরে নয়। পাঠকরা হয়তো ভাবছেন এই স্তর আবার কোন স্তর। ধরা যাক! একটা মাঠ। সেখানে সবুজ গাছ-গাছালি আর অনেক পশু পাখি। দুজন মানুষ একইসাথে এই দৃশ্য দেখছে। একজন বুঁদ হয়ে দেখছে পশু পাখি। আরেকজন বুঁদ হয়ে দেখছে গাছপালা। এ থেকেও বোঝা যাবে না কে কোন স্তরে আছে। বোঝা যাবে ঠিক তখন যখন একজন জানবে যে আরেকজন ঠিক কী দেখছে!! যদি মেলে তাহলে তারা একই স্তরে। না মিললে ভিন্ন স্তরে। থাক আমরা এই জতিল মনস্তত্বের ব্যাখ্যা থেকে বের হয়ে এসে পুলক আর রীতার কাছে ফিরে যাই।
অবশেষে পর্দার অন্তরাল থেকে পুলক আর রীতা একজন আরেকজনের সামনে এসে দাঁড়ালো। কিছুটা সংকোচ, বেশ অনেকটা ভালোলাগা, তার চেয়েও বেশ অনেকটা ভালোবাসা যাকে আমরা কেমিক্যাল রিএকশনও বলতে পারি, এসব কিছু নিয়ে তারা একে অন্যের সামনে দাঁড়ালো। নিজেদের যেন আরো গভীরভাবে আবিষ্কার করতে থাকল।
আবেগের জগত থেকে বাস্তবের জগতে ফেরা যাক। রীতার মা নাজমা হক মেয়ের জন্য নতুন ছেলের খোঁজ এনেছেন। ছেলে ডাক্তার। বাইরে থাকে। বাইরে বলতে লন্ডনে। দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্যই। বাড়ির ছোট ছেলে। এবার নাজমা হক নিজেই ছেলের সব খোঁজখবর নিয়েছেন। এ ছেলে নিখুঁত। অভিজাত পরিবারের ছেলে। ছেলের বাবা-মাও ডাক্তার। ছেলের দাদা ছিলেন টাঙ্গাইলের নামকরা ব্যারিস্টার। এরকম একটা ছেলে হাতে পাওয়া গেছে তা নাজমা হকের বিশ্বাসই হচ্ছে না। আল্লাহ!! কোনোভাবে যদি এই ছেলের সাথে রীতার বিয়েটা হয়ে যেত!! মেয়েটার কপাল খুলে যেত।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ১১)
তরুন-তরুণী, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতি সবাই প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। প্রেমের সম্পর্কে দুই পক্ষের সমান রকমের যোগদানের কয়েক মাস অতিক্রান্তের পর যে কোন এক পক্ষ অবশ্যই ভাবে যে কোন আক্কেলে আমি এই ঝামেলায় জড়ালাম। আগেই তো ভালো ছিলাম। ছেলে বলে “ওই ছেলে কে? কার সাথে এতক্ষণ কথা বলতেসিলা?” মেয়ে বলে “ তখন থেকে দেখতেসি তুমি ওই মেয়েটার দিকে তাকায়ে আস। মেয়েদের দেখলে তোমার চোখ ঠিক থাকে না, না?” এরকম উভয় পক্ষের অধিকার চর্চায় প্রেম আর ভালোবাসা ত্রাহি ত্রাহি রব তোলে।
তবে এসবের মাঝেও খুব অল্প হলেও হাতে গোনা কয়েকটা সত্যিকারের বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এইসব সম্পর্কে স্বাস্থ্যকর হাওয়া বয়। মন উৎফুল্ল থাকে। প্রেমিক-প্রেমিকার চেয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই বড় থাকে। এতে করে অকারণ একে অপরের গলা চেপে ধরার দরকার পড়ে না। এইসব সম্পর্কের মানুষেরা নিজেদের দুর্বলতা খুব সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে।
পুলকের মধ্যে ইদানিং কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অফিসের সবাইও ব্যাপারটা লক্ষ্য করছে। কাজে কর্মে সে সব সময়ই ভালো। কিন্তু একটু অন্তর্মুখী। কিন্তু আজকাল যেন একটু বেশি হাশি-খুশি থাকে। ক্যান্টিনে মাঝে মাঝেই পুলককে হো হো করে হাসতে দেখা যায়। বন্ধু মহলে পুলকের সাথে সহজে ঠাট্টা করা যেত না। সহজ ঠাট্টাকেও সে জটিল বানিয়ে রেগে মেগে একাকার করে ফেলত। আজকাল ভুলে ভালে কেউ দুই একটা ঠাট্টা করে ফেললেও সে খুবই স্বাভাবিকভাবে নেয়। তারপরো কেউ খুব একটা রিস্কে যায় না।
পুলক নিজেও তার ভিতরের পরিবর্তন টের পাচ্ছে। আজকাল সে ভেতর থেকে খুশি থাকছে। জোর করে না। কোন নির্দিষ্ট কারণে না। যা করছে তাই তার ভালো লাগছে। রাস্তায় হাঁটছে। আহা!! তার মনে হচ্ছে রাস্তায় হাঁটার মত স্বর্গীয় অনুভূতি আর হয় না। রিকশায় উঠল। এমনিতেই পুলকের রিকশায় চড়তে ভালো লাগে। কিন্তু আজকাল রিকশায় উঠলে মনে হয়...মনে হয়...আসলে কি যে মনে হয় সেটাও সে ঠিক বুঝতে পারে না। খালি জানে সে এখন অনেক সুখী। রীতা নামে একটা মেয়ে তার জীবনে আছে আর কিছু তার দরকার নেই। এই একজনের মাঝে পুলক তার জীবনের সব চাওয়া পাওয়া খুঁজে পেয়েছে। আশেপাশে যত প্রেমিক-প্রেমিকা দেখে তাদের দিকে সে মনে মনে তাচ্ছিল্য ভরে বলে। আমার মত সুখী তোমরা কেউ নও।
রীতার সাথে এখন তার নিয়মিত দেখা হচ্ছে না। জুন মাস। ভার্সিটি বন্ধ এক মাস। তাই রীতা আর এখন সেভাবে বের হতে পারে না। মাঝে মাঝে বান্ধবীদের বাসায় যেতে হলে পুলকের জন্য একটু আগে আগে বের হয়। একসাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে চলে যায়। পুলকের এই নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। একজন মানুষ যখন আরেকজন মানুষকে হৃদয়ে ধারণ করে তখন তার সবসময় সামনে না থাকলেও চলে। তবে হ্যাঁ, প্রতিদিন তার রীতার সাথে ৫ মিনিট হলেও কথা বলা লাগে। এই ৫ মিনিটের কথা যার সাথে বলে সে একই সাথে তার প্রেমিকা, বন্ধু এবং আত্মার সঙ্গী। তার রীতা। এই পৃথিবীতে লাখো কোটি মানুষকে যা মুখে বলে দিলেও বুঝবে না, রীতাকে তা না বলে দিলেও সে বুঝবে। যখন পুলক আর রীতার দেখা হয়, তখন কেন জানি পুলকের মনে হয় যে সে যদি কোন কথা না বলে রীতার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকে তাহলেও রীতা তার মনের কথা বুঝে যাবে। মাঝে মাঝে তার নিজের খুশি চিৎকার করে প্রকাশ করতে ইচ্ছা করে।
রীতার এই এক মাসের বন্ধ অসহ্য লাগছে। তার সবসময়ই এই এক মাসের বন্ধ অসহ্য লাগে। এই একমাস যেন তার কারাগার। কারণ রীতার মা নাজমা হক মেয়েকে তেমন বের হতে দিতে চান না। মেয়েদের অকারণ বের হওয়া হওই তার একদম পছন্দ না। মেয়ের বন্ধু বান্ধবের সাথেও কোন অনুষ্ঠান থাকলে তিনি মেয়েকে তেমন বের হতে দেওয়ার পক্ষপাতি নয়। তিনি একবার মেয়েকে তার সিদ্ধান্তের কথা জানান। মেয়ে এ নিয়ে আর তার কাছে কোন অনুনয় বিনয় করেনা। মেনে নেয়। বড় মেয়েকে এই জন্যই তিনি অনেক পছন্দ করেন। এই মেয়ে কখনো তার অবাধ্য হবে না। তিনি জানেন। কিন্তু ছোট মেয়েটাকে কেন জানি তিনি সামলাতে পারেন না। ছোট মেয়ে মিতার অনেক জেদ। অনেক সময়ই তাকে এই জেদের কাছে হারতে হয়। আসলে কি জেদের কাছে হারেন? নাকি ছোট বলে একটু বাড়তি স্নেহ আদায় করে নেয় মিতা? এটা ঠিক ধরতে পারেন না নাজমা হক। আসলে ধরতে চান না। সব বাবা-মায়ের কাছে সন্তান দুই প্রকার। একটি হল আদর্শ সন্তান- যাকে সব ঠিক কাজ করতে শেখানো হবে। যাকে বড় করা হবে কড়া শাসনে। আরেকটি হল আদরের সন্তান- এই সন্তানের বেলায় বাবা মায়ের মন দ্রবীভূত থাকে সবসময়। এর সব আবদার মেনে নেওয়া হয়। আহা!! থাক না!! বাচ্চা মানুষ!! এখানে রীতা হচ্ছে নাজমা হকের আদর্শ সন্তান। আর মিতা আদরের।
কিন্তু রীতার এবারের অস্থিরতা বেশি। এবারের এক মাস আর অন্যবারের এক মাসে অনেক পার্থক্য। তখন পুলক ছিল না। এখন পুলক আছে। ওর সাথে ঠিকমত কথা না হলে রীতার সারাদিন মন খারাপ থাকে। দেখা হলে মনে হয় জীবনে আর কোন দুঃখ নেই। রীতার যখনই মন খারাপ হয়। মায়ের উপর রাগ হয়। অনেক দুঃখ হয়। সে তার সব দুঃখ জমা করে রাখে পুলককে বলার জন্য। পুলক সব মন দিয়ে শোনে। রীতাকে বোঝায়। পুলক ওঁকে ওর মায়ের মন বুঝতেও সাহায্য করে।
এই যেমন কিছুদিন আগে কথা হচ্ছিল।
- জানো পুলক!!! মা আজকে আমাকে অকারণ বকাবকি করলো। আমি নাকি কোন কাজ করি না বাসার। অথচ আমি সকাল থেকে মায়ের কথামতই সব করেতসি।
- আরে ধুর!!! ওইটা উনার রাগের কথা।
- না!! রাগের কথা না। তুমি বুঝতেস না। মা আমাকে সহ্যই করতে পারে না।
- শোনো!! তোমার মা তোমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।
- তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগতেসে না। তুমি কথা বুঝতেসই না।
- আরে বোকা মেয়ে!! আমার যখন খুব রাগ হয় তখন আমি কার উপর ঝাড়ি?
- কার উপর আর ঝাড়বা!!! আমার উপরেই ঝাড়।
- কেন ঝাড়ি?
- জানি না।
- কারণ একমাত্র তুমিই আমার আশ্রয়। তোমার কাছে এসে আমি নিজের সব হতাশা, রাগ, দুঃখ, ভালোবাসা সব উজাড় করে দিতে পারি তোমাকে হারানোর চিন্তা ছাড়াই। তোমার মাও ঠিক তাই করে। তুমিই তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। তাই তোমার উপরই তার সবচেয়ে বেশি দাবি। মানুষ তার কাছেই দুর্বলতা প্রকাশ করে যাকে সে ভালোবাসে। বুঝলে হে বোকা রীতা?
- হুম।
এসব কথাবার্তায় রীতার মন নিমিষে ভালো হয়ে যায়। পুলক নামের এই মানুষটার অদ্ভুত এই দুই দিক তাকে বিস্মিত করে, আকর্ষিত করে। একই মানুষ ছেলেমানুষের মত রাগারাগি করে, আবার এই একই মানুষ জটিল থেকে জটিল জিনিস সহজভাবে বুঝতে পারে। রাগী পুলকের রাগও খুব তীব্র। বিচক্ষণ পুলকের বিচক্ষণতাও খুবই তীব্র। দুই তীব্রতার মাঝে রীতার অবস্থান। তার নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয়।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ১২)
পুলক আর রীতা। আপাতত গল্পের প্রধান দুই চরিত্র। এই পর্বে আমরা এই দুই চরিত্রের আশেপাশে থাকা মানুষদের নিয়ে কথা বলবো। আমাদের জীবনের উপর আমাদের আশেপাশের মানুষের প্রভাব অনস্বীকার্য। ঠিক তেমনি পুলক আর রীতার জীবনেও তাঁদের আশেপাশের মানুষদের প্রভাব অনস্বীকার্য।
পুলকের মা আফরোজা আক্তার একজন মানসিকভাবে শক্ত মানুষ। জীবনে কম ঘাত-প্রতিঘাত তিনি সহ্য করেননি। কিন্তু কোনকিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি। নিজের সম্মান, নিজের পায়ের উপর ভিত্তি স্থাপন করার জন্যই তিনি লড়ে গেছেন। অনেক কম বয়সেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে এ জগতে অসহায়দের দয়া দেখানো ছাড়া এ সমাজ কিছু করে না। তিনি নারী হয়ে জন্মেছেন বলেই যে সবার দয়া দাক্ষিণ্যে তাঁকে চলতে হবে, তা তিনি মানতে পারেননি। সমাজের এই ভুল তিনি ভেঙ্গেছেন। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। দুর্বল মানুষদের জীবনে চলার জন্যে অন্য কারো সহায় লাগে। আফরোজা সেই দুর্বলদের দলে নন। নিজের পথ তিনি নিজেই চলেছেন। কিন্তু তারপরো জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে গিয়ে মানুষের বেঁচে থাকার একটা অজুহাত লাগে। একটা কারণ লাগে। একটা উদ্দেশ্য লাগে। তাঁর ছেলে পুলক হলো তাঁর জীবনের সেই উদ্দেশ্য। বেঁচে থাকার কারণ। এই এক জায়গায় আফরোজা দুর্বল। পুলকের বাবার সাথে ছাড়াছাড়ির পর নতুন করে জীবন শুরু করার হাতছানি তাঁর কম ছিল না। কিন্তু কেন জানি তাঁর মনে হয়েছিল বিয়ে বা সংসার হয়তো ঠিক তাঁর জন্য না। তিনি তাঁর মন-প্রাণ দিয়ে ছেলেকে বড় করেছেন। শুধু আদর দেননি। শুধু শাসন করেননি। যখন যা দরকার ছিল তাই করেছেন। তাঁর এই সংঘাতময় জীবনে ছেলে তাঁর একনিষ্ঠ সঙ্গী। পুলককে তিনি নিজের মনের মত করে তৈরি করেছেন। নিজের বিশ্বাস, আদর্শ সবকিছু ছেলেকে শিখিয়েছেন, বুঝিয়েছেন। এখন ছেলে বড় হয়েছে। বিয়ের বয়স হয়েছে। ছেলের জন্য মেয়ে দেখছেন। বিয়ের পর ছেলে যে একটু হলেও ভাগ হয়ে যাবে তা তিনি জানেন। কিন্তু আফরোজা বাস্তববাদী মানুষ। যখন যা করার সময় তাই করা উচিৎ। তিনি আর দশটা মায়ের মত না। জীবন দেখেছেন তিনি। একলা মহিলা কিভাবে সমাজকে সামলে জীবন চালাতে হয়, সন্তান বড় করতে হয়, জানেন তিনি। টিভি সিরিয়ালের শাশুড়ি তিনি হবেন না। ছেলে বড়। তাঁর নিজস্ব বিচার বিবেচনাতে সে জীবন চালাবে। সেখানে তিনি কোন হস্তক্ষেপ করবেন না। সারাজীবন চাকরি করেছেন। বাকি জীবন নিজের টাকায় চলার সামর্থ্য তাঁর আছে। সেরকম কিছু দেখলে ছেলে বউকে রেখে বের হয়ে যাবেন। সবরকম মানসিক প্রস্তুতি তাঁর নেয়া আছে। জীবনে কখনো কারো বোঝা হননি। এই শেষ বয়সে এসেও হবেন না।
রীতার মা নাজমা হক সম্পর্কে বলা হয়েছে যে উনি খুব কড়া। হ্যাঁ, মেয়েদের বেলায় বরাবরই তিনি কড়া। কিন্তু মা হওয়া ছাড়াও একজন মানুষ হিসেবেও তাঁর একটা পরিচয় থাকা উচিৎ। কলেজে পড়ার সময় রীতা মিতার বাবার সাথে তাঁর বিয়ে হয়। সৎ পাত্র পেয়ে বেশ খুশি হয়েই নাজমা হকের বাবা মেয়েকে বিয়ে দেন আরিফুল হকের সাথে। সেই কলেজে পড়ার সময় নাজমা হক একটু ছেলেমানুষ ছিলেন। তিনি ভাবতেন বিয়ে করে সে তাঁর স্বামীর সাথে সেইসব শখ পূরণ করবেন যা তিনি তাঁর বাবা-মায়ের সাথে থেকে করতে পারেননি। তাঁর ইচ্ছা ছিল সিনেমার মত জ্যোৎস্না রাতে আরিফ আর নাজমা একসাথে হাত ধরে ছাদে থাকবে। সারারাত বাইরে রিক্সা দিয়ে ঘুরবে। এরকম আরো কত কী!!! কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তাঁর স্বামী আরিফুল হকের গুণ ওই একটাই। সততা। তাছাড়া তিনি খুবই বেরসিক মানুষ। অফিস করে এসে ঘুম। এর বাইরে যে কোন কাজ থাকতে পারে বা তাঁর স্ত্রীর কোন কথা থাকতে পারে এটা তাঁর কখনোই মনে হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই ছেলেমানুষ নাজমা হক খুব বেশীদিন ছেলেমানুষ রইলেন না। আমাদের দেশের গৃহিণীদের এমনিতেও খুব বেশীদিন ছেলেমানুষ থাকা হয়ে ওঠে না। শাশুড়ি, ননদ আর স্বামীর মনমত চলতে গিয়েই কবে যে মন একটু একটু করে প্যাঁচালো হয়ে ওঠে তা গৃহিণীরা নিজেরাই বুঝতে পারেন না। একটু একটু করে নিজের চাওয়া পাওয়ার অবদমন দেখতে দেখতে কখন যে তাঁদের মন নিরেট পাথর হয়ে যায় তাও তাঁরা বুঝতে পারেন না। এ পৃথিবীতে সবাই প্রতিবাদ করে না। বাড়ির বউরা তো আরো না। তাঁদেরকে শিখানোই হয় চুপ করে থাকতে। কষ্টে বুক ফেটে গেলেও মুখ যেন না ফাটে। আর দশটা গৃহিণীর মতই নাজমা হক নিজের রাগ হতাশা সব সময় নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারেন না। মাঝে মাঝে আশেপাশের মানুষের উপর উগড়ে দেন। সবচেয়ে বেশি উগড়ান বড় মেয়ে রীতার উপর। বেচারী সারাদিন তাঁর বকা খায়। কিচ্ছু বলে না। নাজমা হক যে ভিতরে ভিতরে কত অসহায় তা কি তাঁর এই মেয়ে বোঝে!!
হ্যাঁ, রীতা বোঝে। আগে না বুঝলেও, এখন বুঝতে চেষ্টা করে সে তাঁর মাকে। খুব বেশি চেষ্টা করা লাগে না। কারণ সে তাঁর মাকে খুব ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষের সাত খুন মাফ রীতার কাছে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর সব সিদ্ধান্তই তাঁর মায়ের নেওয়া। কোন ড্রেস পড়বে, কোথায় যাবে, কোথায় যাবে না। কে তাঁর বন্ধু হবে, কে হবে না। সব। মাঝে মাঝে তাঁর অভিমান হলেও পরে তাঁর মনে হত মায়ের কথাই ঠিক। তাঁর চেতন-অবচেতন দুই মনই তাঁর মায়ের কাছে ধরা দেয়া। সেটা রীতা এখনো তেমন করে টের পায়নি। হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই পাবে। তাঁর মা যে একজন অসুখী মহিলা তা টের পায় রীতা। বাবার সাথে কোথায় যেন একটা বোঝাপড়ার গণ্ডগোল আছে। সেটা খুব সূক্ষ্ম। ভালমত খেয়াল না করলে বোঝা যায় না।
নাজমা হকের আজকে মেজাজ অনেক খারাপ। ডাক্তার পাত্ররা রীতাকে দেখতে আসতেই রাজি না। তাঁরা খোঁজ নিয়ে দেখেছে রীতা নাকি কোন ছেলের সাথে নিয়মিত ঘুরাফিরা করে। এরকম একটা মিথ্যা কথা তাঁরা কার কাছ থেকে শুনল তিনি বুঝতে পারছেন না। নাহয় তাঁর মেয়ে একটু শ্যামলা। তাই বলে!!! মেজাজ ঠিক করতে টিভি ছাড়লেন। সিরিয়াল চলছে। উফফ!! এখন এইসব ঝগড়া-ঝাটি দেখার সময় আছে। জীবন তো এইসব দেখেই কেটে গেল। বিয়ের প্রথম দিকে আরিফকে একবার বলেছিলেন দুজনে মিলে ছাদে জ্যোৎস্না দেখবেন। আরিফ বলেছিল আগামী মাসে। বিয়ের ত্রিশ বছর চলে গেল। সেই আগামী মাস এখনো আসেনি। আর কখনোই আসবে না। বাস্তবে ফিরে এলেন নাজমা। ছেলেটা এইভাবে হাতছাড়া হয়ে গেল। তাঁর চেয়েও বড় কথা হল মেয়ের নামে কুকথা ছড়িয়ে গেল। সামনেই মেয়ের এম.বি.এ ফাইনাল। ছুটি শেষ গরমের। আবার ক্লাস শুরু হয়েছে। চাকরী করার ইচ্ছা মেয়ের। এই ইচ্ছায় তিনি আপত্তি করেন না। নিজের পায়ে মাটি রাখার দরকার আছে।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ১৩)
শনিবার। পুলক আরাম করে দেরী করে ঘুম থেকে উঠল। রীতার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আজকে দেখা হবে তাঁদের। বেশ অনেকদিন পর দেখা। শেষ দেখা সপ্তাহ দুয়েক আগে হয়েছে। কোন শার্টটা পরবে? মন ভালো থাকলে নিজের দিকে একটু মনোযোগ দিতে ভালো লাগে। রেডি হয়ে ভালমত নিজেকে আয়নায় দেখে সন্তুষ্ট হল পুলক। খারাপ না।
আজকে রীতাকে বিয়ের কথা বলবে। এখন তো আর সেই বয়স নেই যে অনির্দিষ্টকাল ধরে প্রেম করে যাবে। পুলকের মনে কোন ‘কিন্তু’ নেই। সে রীতাকে পছন্দ করে। রীতাও তাঁকে পছন্দ করে। এটাই সবচেয়ে বড় কথা যে রীতা তাঁকে পছন্দ করে। তাঁকে বোঝে। তাঁকে সহ্য করে। এর চেয়ে বেশী আর কিছুই চাওয়ার নেই।
-কি হে!! কী অবস্থা? শুকায়ে গেস দেখি। খাওয়া দাওয়া কর না, নাকি?
রীতাকে দেখে পুলক বলল।
পুলককে দেখে রীতার হাসি যেন ধরেই না। কতদিন পর দেখা। যেন কয়েক বছর পর দেখা হল। ও পুলকের হাতটা ধরল। আহ!! খুব আনন্দ হচ্ছে রীতার। বাচ্চা মেয়েদের মত পুলকের হাত ধরে দোলাচ্ছে রীতা। রীতার এরকম পাগলামি পুলকের খুব মজা লাগে। কারো কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ আগে সে কখনোই ছিল না। সে সারাজীবন এরকম অনুভব করতে চায়।
-কই? এত শুকাইলা কেমনে?
পুলক আলতো করে গালে হাত বুলায় রীতার।
-কই শুকাইসি। আমি একদম ঠিক আছি।
-বললেই হল!!! যাই হোক বাদ দেও। চল কোথাও বসি। আর হাঁটতে ইচ্ছা করতেসে না।
-ওকে
দুইজনে বসল।
-রীতা তোমার বাসায় কবে যাবো?
-মানে? বাসায় কেন যাবা?
-আরে!! বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।
-ও বিয়ে? না বাবা! এখনি না।
-কেন? এখনি না কেন?
-আগে আমার মাকে বলা লাগবে।
-কি বলা লাগবে?
-আরে! তোমার আমার কথা।
-এতে এত বলাবলির তো কিছু নাই। এমনিতেও আমাদের দেখা বিয়ের উদ্দেশ্যেই হয়েছিল। এবং তা আমাদের অভিভাবকদের কথামতই।
-তাও আমি মাকে আলাদা করে বলতে চাই। তুমি তো জানো মায়ের কাছ থেকে কিছু লুকালে আমার শান্তি হয় না। মনে হয় যে কিছু একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে।
-আচ্ছা বাবা!! ঠিক আছে। তুমি মায়ের সাথে কথা বল।
-কিন্তু পুলক!! আমি চাকরি না পাওয়ার আগে বিয়ে করতে চাচ্ছি না।
-আচ্ছা তাও সই। বিয়ে তো আর বললেই হয়ে যাচ্ছে না। তোমাকে একটু বুক করে রাখি। নইলে কবে আবার কোন দিকে দৌড় দিবা। ঠিক আছে কোন?
-(কৌতুকময় স্বরে) তা অবশ্য ঠিকই বলসো। কোনোই ঠিক নাই। এক লোকের সাথে আর কত?
-(রাগতস্বরে)কি??? আমার সাথে আর থাকতে ভালো লাগছে না? ওকে। থাক। তোমার আর আমার সাথে থাকা লাগবে না।
পুলক রাগে উঠে দাঁড়াতে গেল। রীতা জোর করে ওঁকে হাত ধরে বসিয়ে পুলকের গালে একটা চুমু দিল।
-আমার বোকা বাবু।
পুলক রীতার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাগের পরপরই তক্ষুনি কেউ রাগ থামিয়ে দিলে খুব কান্না আসে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষমানুষের কান্না মোটেও শোভন নয়। সে তাড়াতাড়ি উঠে পরল।
-চল। খিদে লেগেছে। আজিজে যাই।
রীতা বসা অবস্থায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাঁর দিকে। ওঁকে টেনে তুলে ওরা আজিজ সুপার মার্কেট এর দিকে চলল।
নাজমা হক আজকে একটু বের হয়েছিলেন। বাসার আকুয়ারিয়ামের জন্য গোল্ড ফিশ কিনতে হবে। মিতার খুব শখ হয়েছে গোল্ড ফিশ কিনার। বেশ অনেকদিন ধরে চিল্লায়ে কানের পোকা নাড়িয়ে দিচ্ছে মেয়েটা। গোল্ড ফিশ কিনে আনো! গোল্ড ফিশ কিনে আনো! মেয়েটা এত অস্থির আর অবাধ্য!! যা বলবে তাই তাঁর কিনা লাগবে। মেয়েদের শার্ট পড়া একদম পছন্দ না নাজমা হকের। রীতাকে সে কখনো সালওয়ার কামিজ আর শাড়ি ছাড়া কিছু পড়তে দেননি। কিন্তু মিতা ঠিকই শার্ট পড়ে ঘুরে বেড়ায়। তাঁকে কিছুই বলা যায় না।
একটু আজিজেও যাওয়া দরকার। রীতা-মিতার বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনতে হবে। লোকটার জন্মদিন সামনের সপ্তাহে। হঠাৎ নাজমা হক যেন ভূত দেখলেন। তিনি দেখলেন তাঁর সামনে দিয়ে রীতা একটা ছেলের হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। তাঁর মেয়ে রীতা।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ১৩)
শনিবার। পুলক আরাম করে দেরী করে ঘুম থেকে উঠল। রীতার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আজকে দেখা হবে তাঁদের। বেশ অনেকদিন পর দেখা। শেষ দেখা সপ্তাহ দুয়েক আগে হয়েছে। কোন শার্টটা পরবে? মন ভালো থাকলে নিজের দিকে একটু মনোযোগ দিতে ভালো লাগে। রেডি হয়ে ভালমত নিজেকে আয়নায় দেখে সন্তুষ্ট হল পুলক। খারাপ না।
আজকে রীতাকে বিয়ের কথা বলবে। এখন তো আর সেই বয়স নেই যে অনির্দিষ্টকাল ধরে প্রেম করে যাবে। পুলকের মনে কোন ‘কিন্তু’ নেই। সে রীতাকে পছন্দ করে। রীতাও তাঁকে পছন্দ করে। এটাই সবচেয়ে বড় কথা যে রীতা তাঁকে পছন্দ করে। তাঁকে বোঝে। তাঁকে সহ্য করে। এর চেয়ে বেশী আর কিছুই চাওয়ার নেই।
-কি হে!! কী অবস্থা? শুকায়ে গেস দেখি। খাওয়া দাওয়া কর না, নাকি?
রীতাকে দেখে পুলক বলল।
পুলককে দেখে রীতার হাসি যেন ধরেই না। কতদিন পর দেখা। যেন কয়েক বছর পর দেখা হল। ও পুলকের হাতটা ধরল। আহ!! খুব আনন্দ হচ্ছে রীতার। বাচ্চা মেয়েদের মত পুলকের হাত ধরে দোলাচ্ছে রীতা। রীতার এরকম পাগলামি পুলকের খুব মজা লাগে। কারো কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ আগে সে কখনোই ছিল না। সে সারাজীবন এরকম অনুভব করতে চায়।
-কই? এত শুকাইলা কেমনে?
পুলক আলতো করে গালে হাত বুলায় রীতার।
-কই শুকাইসি। আমি একদম ঠিক আছি।
-বললেই হল!!! যাই হোক বাদ দেও। চল কোথাও বসি। আর হাঁটতে ইচ্ছা করতেসে না।
-ওকে
দুইজনে বসল।
-রীতা তোমার বাসায় কবে যাবো?
-মানে? বাসায় কেন যাবা?
-আরে!! বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।
-ও বিয়ে? না বাবা! এখনি না।
-কেন? এখনি না কেন?
-আগে আমার মাকে বলা লাগবে।
-কি বলা লাগবে?
-আরে! তোমার আমার কথা।
-এতে এত বলাবলির তো কিছু নাই। এমনিতেও আমাদের দেখা বিয়ের উদ্দেশ্যেই হয়েছিল। এবং তা আমাদের অভিভাবকদের কথামতই।
-তাও আমি মাকে আলাদা করে বলতে চাই। তুমি তো জানো মায়ের কাছ থেকে কিছু লুকালে আমার শান্তি হয় না। মনে হয় যে কিছু একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে।
-আচ্ছা বাবা!! ঠিক আছে। তুমি মায়ের সাথে কথা বল।
-কিন্তু পুলক!! আমি চাকরি না পাওয়ার আগে বিয়ে করতে চাচ্ছি না।
-আচ্ছা তাও সই। বিয়ে তো আর বললেই হয়ে যাচ্ছে না। তোমাকে একটু বুক করে রাখি। নইলে কবে আবার কোন দিকে দৌড় দিবা। ঠিক আছে কোন?
-(কৌতুকময় স্বরে) তা অবশ্য ঠিকই বলসো। কোনোই ঠিক নাই। এক লোকের সাথে আর কত?
-(রাগতস্বরে)কি??? আমার সাথে আর থাকতে ভালো লাগছে না? ওকে। থাক। তোমার আর আমার সাথে থাকা লাগবে না।
পুলক রাগে উঠে দাঁড়াতে গেল। রীতা জোর করে ওঁকে হাত ধরে বসিয়ে পুলকের গালে একটা চুমু দিল।
-আমার বোকা বাবু।
পুলক রীতার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাগের পরপরই তক্ষুনি কেউ রাগ থামিয়ে দিলে খুব কান্না আসে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষমানুষের কান্না মোটেও শোভন নয়। সে তাড়াতাড়ি উঠে পরল।
-চল। খিদে লেগেছে। আজিজে যাই।
রীতা বসা অবস্থায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাঁর দিকে। ওঁকে টেনে তুলে ওরা আজিজ সুপার মার্কেট এর দিকে চলল।
নাজমা হক আজকে একটু বের হয়েছিলেন। বাসার আকুয়ারিয়ামের জন্য গোল্ড ফিশ কিনতে হবে। মিতার খুব শখ হয়েছে গোল্ড ফিশ কিনার। বেশ অনেকদিন ধরে চিল্লায়ে কানের পোকা নাড়িয়ে দিচ্ছে মেয়েটা। গোল্ড ফিশ কিনে আনো! গোল্ড ফিশ কিনে আনো! মেয়েটা এত অস্থির আর অবাধ্য!! যা বলবে তাই তাঁর কিনা লাগবে। মেয়েদের শার্ট পড়া একদম পছন্দ না নাজমা হকের। রীতাকে সে কখনো সালওয়ার কামিজ আর শাড়ি ছাড়া কিছু পড়তে দেননি। কিন্তু মিতা ঠিকই শার্ট পড়ে ঘুরে বেড়ায়। তাঁকে কিছুই বলা যায় না।
একটু আজিজেও যাওয়া দরকার। রীতা-মিতার বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনতে হবে। লোকটার জন্মদিন সামনের সপ্তাহে। হঠাৎ নাজমা হক যেন ভূত দেখলেন। তিনি দেখলেন তাঁর সামনে দিয়ে রীতা একটা ছেলের হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। তাঁর মেয়ে রীতা।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ১৪)
Arranged marriage এর বাংলা কী? সাধারণত এর বাংলা আমরা বলি ‘বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করা’। আর কি কোন ভাবানুবাদ আছে? যাইহোক!!! বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করার যে পদ্ধতি তা কিন্তু বেশ সময়সাপেক্ষ। প্রথমে বাবা মায়েরা চেনা অচেনা সবাইকে ছেলে বা মেয়ে দেখতে বলে। অনেকে ঘটকও নিয়োগ করে। এরপর শুরু হয় প্রাথমিক প্রার্থী বাছাই। প্রাথমিক প্রার্থী বাছাইয়ের কাজটাও বাবা মায়েরাই করেন। বিশেষ করে মায়েদের উৎসাহ এতে বিপুল। তাঁরা পারলে অন্যের বিয়ের পাত্র পাত্রীও বাছাই করে দিয়ে আসেন। প্রাথমিক প্রার্থী বাছাইয়ের পর সেখান থেকে ফাইনাল বাছাই করেন পাত্র বা পাত্রী। এরপর পাত্র বা পাত্রীর বাছাইকৃত প্রার্থী যাচাইয়ের পালা। প্রথমে পুরো পরিবার মিলে যাচাই। এরপর একজন বনাম একজন যাচাই। এভাবে কাঙ্ক্ষিত প্রার্থী বাছাই না হওয়া পর্যন্ত চলতেই থাকে। এই বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করার কাহিনী বিশদভাবে বলার কারণ আর কিছুই না। এটাই বোঝানো যে, এটি খুবই জটিল এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তা যদি না হত, তাহলে নাজমা হক একদিনের নোটিসে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিতেন। নিজেকে এতটা প্রতারিত তাঁর আগে কখনো মনে হয়নি। তাঁর মেয়ে একটা ছেলের সাথে হাত ধরে মার্কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে!!! তাহলে ডাক্তার পাত্রের পক্ষের লোকজন যা বলেছে সব সত্যি!! তিনি এখনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত, তাঁর সবচেয়ে বাধ্য যে মেয়ে সেই মেয়ে এই কাজ করে বেড়াচ্ছে!!!
রীতা-মিতার বাবার পাঞ্জাবি আর কেনা হয়নি। ওই দৃশ্য দেখে তিনি আর ওখানে দাঁড়াতে পারেননি। বাসায় চলে এসেছেন। এখন ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে হবে। তারপর কয়েক ঘণ্টার ঘুম। তারপর ভাববেন কী করা যায়!!
রীতা বাসায় আসলো সন্ধ্যার পর। এসে দেখল বাসায় বেশ থমথমে ভাব। মিতা ফেসবুক এ চ্যাট করছিল। ওঁকে জিজ্ঞেস করলো।
-কিরে!! বাসা এরকম থমথমে কেন?
মিতা ঠোঁট উলটিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল। তাঁর এসব কিছুতে খেয়াল নেই। যতক্ষণ না তাঁকে কেউ বিরক্ত করছে ততক্ষণ সেও কাউকে বিরক্ত করে না। সিম্পল!!
বাসাতে সবসময় মায়ের চিল্লাপাল্লা থাকেই। বুয়াকে বকা দিচ্ছে নইলে মিতাকে। নাহলে টিভিতে সিরিয়াল। কোন না কোন আওয়াজ এর সাথে তাঁর মায়ের সম্পৃক্ততা থাকেই। যখন থাকে না তখন বুঝতে হবে বড় কিছু ঘটেছে। রীতা মায়ের ঘরে উঁকি দিল। ঘর অন্ধকার করে মা শুয়ে আছে। ঘরে ঢুকল না রীতা। পুলকের কথাটা মাকে বলতে হবে। আজকে তো বলার প্রশ্নই আসে না।
নাজমা হক খুব জলদি স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। তিনি রীতাকে কিছু বললেন না। বরং এরপরের কয়েকদিন তিনি অন্যান্য দিনের চেয়ে খুব বেশী স্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলেন। ব্যাপারটা বাসার প্রায় সবাই খেয়াল করল এবং খুব স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলো না। কাজের বুয়া ভয়ের চোটে অন্যান্য দিনের চেয়ে আরো হড়বড় করে কাজ করতে থাকল। সারাদিনে সে ৩টা চায়ের কাপ ভাঙল। নাজমা হক কিছু বললেন না। মিতা স্কুল থেকে এসেই এম টিভি ছেড়ে বসেছিল স্কুল এর ড্রেস চেঞ্জ না করেই এবং অপেক্ষা করছিল কখন তাঁর মায়ের হুংকার শোনা যাবে। এটা প্রতিদিনেরই রুটিন। মিতা স্কুল থেকে এসেই টিভি ছাড়ে। নাজমা হক হুঙ্কার ছাড়ে ‘ওই শয়তান’। তখন মিতা দৌড়ে নিজের রুমে যায়। কিন্তু আজকে সে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও কোন হুঙ্কার শুনতে পেল না। সে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুল এর ড্রেস চেঞ্জ না করেই টিভি দেখল। মাঝে ওই অবস্থাতেই খেল। নাজমা হক কিছু বললেন না। রীতা-মিতার বাবা আরিফ সাহেব আসেন অফিস করে। কোন অস্বাভাবিকতাই তিনি ধরতে পারেন না। রাতের খাবার খেয়ে ঘুম দেন। পরিবারের মধ্যে এই অস্বাভাবিকতা যার কাছে সবচেয়ে বেশী প্রকট হয়ে ধরা পড়ল সে হচ্ছে রীতা। সে তাঁর মাকে চেনে। খুব বড় কিছু ঘটেছে। পুলকের কথা কি মা কোনভাবে জেনে গেছে? রীতা পুলককে এসএমএস করল, “পুলক! আমার খুব ভয় করছে। মায়ের আচরণ সুবিধার ঠেকছে না।“ ভয়ে সে পুলককে ফোন পর্যন্ত করছে না। দুই দিন সে ল্যাপটপও অন করেনি, ফেসবুক এও যায়নি।
দুই সপ্তাহ পরের ঘটনা। নাজমা হক একজন নামকরা হুজুরের কাছে গিয়েছেন। সাথে আছেন বান্ধবী তনুজা। হাজার ঝগড়াঝাঁটি হলেও তনুজাকে তিনি সব কথাই বলেন। সদ্য ঘটে যাওয়া চাক্ষুষ ঘটনাও তিনি তনুজার কাছে বলেছেন। মেয়ের এই প্রতারণা তিনি মানতে পারছেন না। নিশ্চয়ই কোন বাজে ছেলের পাল্লায় পড়েছে। নইলে রীতা তাঁর এমন মেয়ে নয়। মা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব মেয়েকে এই বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করা।
তনুজাই বলেছে এই হুজুরের কথা। এই হুজুরের পড়া পানি খেলে কাজ হয়। সাথে হুজুর তাবিজও দিয়ে দিবেন। হুজুরের তাবিজে কাজ হবে না, এরকম কোন নজির নেই। মেয়ে চেয়েও ছেলের কথা মনে করতে পারবে না। প্রত্যেকবার কাজ হয়েছে।
হুজুরের অনেক সাক্ষাতপ্রার্থী। বাইরে একজন খাদেম গোছের একজন আছেন। তিনি এসে একজন একজন করে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন। অবশেষে তাঁদের পালা আসল। হুজুর চোখ বন্ধ করে আছেন। খাদেম হুজুরের কানে কানে কিছু বললেন। হুজুর চোখ খুলে তাকালেন।
বললেন,
-তাবিজ কার লাগবে?
নাজমা হক আর তনুজা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছেন। তনুজা অভয় দিলেন। ইশারা করলেন জবাব দিতে।
-জি হুজুর!! আমার মেয়ের।
-বিস্তারিত বল।
নাজমা হক সব বললেন। হুজুর চোখ বন্ধ করে সব শুনলেন।
এরপর বললেন,
-এক গোছা চুল লাগবে। এক সপ্তাহ পর বাদ মাগরিব আসবা।
কথা শেষ হতেই হাতে খাদেমকে ইশারা করলেন। খাদেম দুই মহিলাকে ইশারায় বাইরে নিয়ে এলেন।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ১৫)
পুলকের মনটা বেশ খারাপ। অফিসে তাঁর বসের বস তাঁর কাজে খুশি নয়। না, সরাসরি এরা দোষারোপ করে না। অন্যভাবে কথার মারপ্যাঁচে বুঝিয়ে দেয়। পুলকের ডাইরেক্ট বসের সাথে পুলকের খুবই ভালো সম্পর্ক। অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের কলিগরা তাঁর বসভাগ্য নিয়ে বেশ ঈর্ষা করে। পুলকের বস রায়হানুল ইসলাম মাটির মানুষ। তিনি পুলককে অনেক পছন্দ করেন। ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করেন। যুগে যুগে আমরা যত সামনে আগাচ্ছি আমাদের মধ্যে দ্বৈত সত্তার আবির্ভাব প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে। আমাদের মুখে এক, অন্তরে আরেক। রায়হান সাহেব কখনো এই জিনিসের সাথে মানিয়ে নিতে পারেননি। তারপরো যতটুকু মানিয়ে নিতে হয় সেটা জোর করে। খুশি মনে নয়। পুলককেও তাঁর সেইরকম মনে হয়। এই জন্য যে কোন কিছুর অনেস্ট অপিনিওন এর বেলায় তিনি পুলককে ডাকেন।
রায়হান সাহেবের বস ভারতীয়। নাম বিবেক রয়। উনি কাজ যতটুকু করায় তাঁর চেয়ে যন্ত্রণা বেশি দেয়। এই সকল যন্ত্রণা মানসিকভাবেও হয়। রায়হান সাহেব তাঁর নিচে কাজ করা সবাইকে আগলিয়ে রাখতে চান। এইসব মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি এর মালিক পক্ষ কখনো চায় না কর্মচারীদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকুক। তাঁরা চায় এদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করুক সব সময় এতে তাঁরা কখনো একতাবদ্ধ হতে পারবে না। বিবেক কোনভাবে বুঝতে পেরেছে যে রায়হান সাহেব পুলককে আর দশ জনের চেয়ে একটু বেশি পছন্দ করেন। তাই তিনি রায়হান সাহেবকে বলেছেন, “ Mr. Ahmed seems to be very relaxed. Make him work harder. “ রায়হান সাহেব কিছু বললেন না।
একটু পরেই বিবেক পুলককে ডেকে পাঠালেন এবং তাঁর কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। পুলক গিয়ে রায়হান সাহেবকে সব বললেন। রায়হান সাহেব একটু সময় নিলেন। পরে পুরো ঘটনা পুলককে বুঝালেন যে এটা একটা কর্পোরেট স্ট্রেটেজি। রায়হান সাহেবের জায়গায় অন্য যে কেউ হলে পুলক বিশ্বাসই করতো না। কিন্তু পুলকের মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। কাজে ফাঁকি সে একদমই দেয় না। আসলে ফাঁকি সে দিতে পারে না। দিলে তাঁর খুব অস্বস্তি লাগে। নিজের কাজ খুব অবহেলায় করলেও অন্যের কাজ সে খুব দায়িত্বের সাথে করে। তারপরেও কর্মক্ষেত্রে এসব হলে মন খারাপই হওয়ার কথা। তাঁর খুবই মন খারাপ হল। সে ওয়াশরুমে কিছুক্ষণ একা বসে রইল। বের হয়ে রীতাকে ফোন দিল। সব বলল ওঁকে। পুলক খেয়াল করে দেখেছে যে যতই সে নিজের পুরোটা দিয়ে কাজ করে, তারপরো কোথাও যেন ঘাটতি থেকে যায়। এর চেয়ে কাজ না করাই ভালো। মনের সব অভিমানের কথা সে রীতাকে ফোন করে বলতে লাগল। রীতা সব শুনল। বাচ্চাদের যেভাবে বুঝায় ঠিক সেভাবে পুলককে বুঝাল যে চারপাশে পুলকের মত ভালো একজনও নেই। তাই সবাই পুলককে ঈর্ষা করে। রীতা তো জানে পুলক সবচেয়ে ভালো। সবার চেয়ে আলাদা। পুলকের মন তরল হল। তারপর তাঁরা আরো কিছুক্ষণ এমনি অনেক টক ঝাল মিষ্টি আলাপ করল। পুলকের মন একদম ভালো হয়ে গেল। ৫ মিনিটেই।
.......................................................................................................
নাজমা হককে হুজুর সময় দিয়েছেন এক সপ্তাহ। তিনি অবশ্য এরই মধ্যে মেয়ের চুল যোগাড় করে ফেলেছেন। কিন্তু এই এক সপ্তাহের মাঝেই অনেক কিছুই ঘটল।
রীতা অনেক চিন্তা করে সাহস করে ঠিক করেছে যে সে আজকে মাকে পুলকের কথা বলবে। কিভাবে বলবে আর কী বলবে এটা নিয়ে এখনো একটু রিহারসেল দিতে হবে নিজে নিজে। মাকে সে ছোটবেলা থেকেই ভয় পায়। সেই ভয় এখনো কাটেনি। মা যদি না করে দেয়। তাহলে কী হবে? কী করবে সে? ভাবতেই মাথা গুলিয়ে ওঠে তাঁর।
অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মা-কে পুলকের কথা বলে রীতা। নাজমা হক চুপচাপ শোনেন। কিছু বলেন না। রীতার বলা হয়ে গেলে রীতা মায়ের দিকে আড় চোখে তাকায়। তাঁর মা ভাবলেশহীন মুখে বসে আছে। কিছু বলছে না। রীতা তাঁর নজর সরিয়ে আবার মাটির দিকে আনে। তাঁর বুকটা হাল্কা লাগছে। যাক!! মাকে বলা হয়ে গেছে। নাজমা হক কিছুই না বলে উঠে চলে যান।
বাসার ভেতরটা আবার থমথমে। রাতের খাওয়া দাওয়া হচ্ছে টেবিলে। সবাই চুপচাপ খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে যে যার মত চলে গেল। রীতা টেবিল গোছালো। মায়ের সাথে রান্না ঘরে সাহায্য করলো। কিন্তু নাজমা হক একদম চুপ। মেয়ে যে তাঁর কাছে কিছু শুনতে চাচ্ছে, তা তিনি একদমই পাত্তা দিচ্ছেন না। রীতা যতক্ষণ পারে মায়ের কাছে কাছে থাকল। আস্তে আস্তে সে নিজের রুমে চলে গেল।
রাত ১২টা। রীতা শুয়ে পড়েছে। কিন্তু তাঁর খুব অস্থির লাগছে। মা কিছুই বলল না!! হ্যাঁ না কিছু তো বলবে! পাশে মিতা ঘুমাচ্ছে। আর যাই হোক! মিতা রাত জাগতে পারে না। ১২টা বাজতে না বাজতেই ঘুম। এ বাড়িতে রাত জাগার চল নেই। পুলক বেশ রাত জাগতে পারে। যদিও অফিস থাকে বলে ইচ্ছা থাকলেও সে এখন রাত জাগে না। আগে নাকি ভোরের দিকে ঘুমাত ছাত্র থাকা অবস্থায়। ওঁকে এখনো জানানো হয়নি যে মাকে সে ওর কথা বলে দিয়েছে। নিজের অস্থিরতাটা পুলকের মধ্যে দিতে চাচ্ছে না। বেচারা ঘুমাক রাতটুকু ঠিকমত।
রীতা মিতার একটাই রুম। দরজা বন্ধ থাকে না রাতে। হাল্কা ভেজানো থাকে। রুমের বাইরে করিডোর। করিডোরে একটা বাতি জ্বলে রাতে। সেখানে কারো ছায়া দেখা গেল। নাজমা হক আস্তে করে রুমে ঢুকলেন। রীতা উঠে বসল। নাজমা হক বিছানার পাশে বসলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
হঠাৎ বললেন, “ তোমার এ পছন্দ আমি কখনো মেনে নেব না। আমি জানি আমার এ কথা তোমার ভালো লাগবে না। কিন্তু তুমি কখনো এই ছেলের সাথে সুখী হবে না। আমি জেনে শুনে নিজের মেয়েকে এরকম ভুল করতে দিব না। এই ছেলের বংশ ভালো না। রক্ত ভালো না। খুব টাকা পয়সা আছে যে তাও না। তোমার চেয়ে খুব যে বয়সে বড় তাও না। আমারই ভুল ছিল যে আমি কোনরকম খোঁজখবর না করেই এরকম একটা ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করেছিলাম।“
রীতার চোখে পানি চলে আসছে। সে পুলকের সম্পর্কে কোন খারাপ কথা সহ্য করতে পারে না। সে কান্না আটকাতে পারছে না। নাজমা হক একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন কিন্তু এতে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না।
তিনি বলতে থাকলেন,
“আবেগের বশে অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু জীবন আবেগে চলে না। আমি জানি তোমরা আজকালকার মেয়েরা এসবকে মুল্য দাও না। কিন্তু আমি জানি আমি যা বলছি ঠিক বলছি। তাই আমি চাই তুমি এই ছেলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দাও। যোগাযোগ বন্ধ না করলে তুমি নিজের সাথে সাথে এই ছেলেটির সাথেও প্রতারণা করবে। আমার কথাগুলো ভাল করে ভেবে দেখ।“
তিনি উঠে পড়লেন। দরজা আবার ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। রীতার মধ্যে দিয়ে যেন একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে মিতার দিকে তাকিয়ে দেখল যে সে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। রীতার জোর একটা কান্নার দমক আসল। সে দৌড়ে ওয়াশ রুমে গিয়ে কল ছেড়ে যত আস্তে কাঁদা যায় কাঁদতে লাগলো।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ১৬)
পুরো ঘটনা কিন্তু পুলক বেশ স্বাভাবিকভাবেই নিল। যদিও কিছুটা খটকা থেকে যায়। যেখানে পুলকের সাথে রীতার বিয়ের জন্যই দেখা হয়েছিল এবং দুই পরিবারের সম্মতিতেই হয়েছিল। সেখানে এখন হঠাৎ করে কী সমস্যা দেখা দিতে পারে!! হ্যাঁ, পুলকের মা ডিভোর্সি। এটা তো তাঁরা লুকায়নি কখনো। রীতার মায়ের বান্ধবী তনুজা, উনার সাথেই পুলকের মা আফরোজা আক্তারের বিস্তারিত কথা হয়েছিল। যাই হোক!! এত কিছুর পরেও পুলক খুব একটা হতাশ হয়নি। রীতাকে সে ভালোবাসে। ‘ভালোবাসা’ কথাটা ঠিক পুলকের পছন্দ না। তাঁর কেন জানি মনে হয় রীতার জন্য তাঁর যে অনুভূতি তা শুধুমাত্র একটা শব্দ দিয়ে বোঝানোর মত না। এই ‘ভালোবাসা’ শব্দটা এখন ছেলে মেয়েরা দুই দিনের দেখাতেও ব্যবহার করে। তাঁর আর রীতার সম্পর্ক এত অগভীর না। ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে ‘shallow’। মানে হচ্ছে ‘অগভীর’। তাঁর আর রীতার সম্পর্ক এত shallow না। পছন্দের মানুষের মধ্যে বন্ধু খুঁজে পাওয়া যে কোটি টাকার লটারি পাওয়ার চেয়েও বেশী। তা পুলক খুব ভালো করেই জানে। তাই এটা যে এত সহজে পাওয়া যাবে না। এটাও পুলক জানে। এর জন্য সে মানসিকভাবে তৈরি আছে। তাঁর এখন দায়িত্ব হল রীতাকে শান্ত রাখা। মেয়েটা মুষড়ে পড়েছে। মেয়েটা খুব সহজে কাহিল হয়ে পড়ে। পৃথিবীর কয়টা প্রেম বাবা-মা একেবারে হাসিমুখে মেনে নিয়েছে!!! খুব কম। তাঁরা দুইজন যদি শক্ত থাকে। নিজেদের উপর বিশ্বাস রাখে! তাহলে কতদিন ওঁর মা বেঁকে থাকবে।
কিন্তু রীতা এমনি এমনি মুষড়ে পড়েনি। সে চেনে তাঁর মাকে। যা একবার না। তা না-ই থাকে। তা কখনো হ্যাঁ হয় না। আর তাছাড়া তিনি প্রতিদিন রীতাকে একা পেলেই কেন পুলককে তাঁর বিয়ে করা ঠিক হবে না তা শোনান। এসব শুনে রীতার প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। সে পুলককে ফোন করে কাঁদে। পুলক তাঁকে অনেক বোঝায়। সে মায়ের সাথে দেখা করতে চায়। কিন্তু রীতা মানা করে। আর কিছুদিন যাক। দেখা যাক!! মাকে রাজি করানো যায় কিনা। কিন্তু সে ভেতরে ভেতরে জানে যে নাজমা হক কখনো রাজি হবে না। সেই মানুষ নাজমা হক নন।
রীতা শুয়ে ছিল। এমবিএর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। আজকাল আর বের হওয়াই যায় না। চাকরীর জন্য চেষ্টা করছে রীতা। অনলাইনে খুব অ্যাপ্লাই করছে। দেখা যাক কী হয়!! ঘরে থাকতে থাকতে তাঁর মন বিষিয়ে উঠছে। দরজা খুলে কেউ ঢুকছে। রীতা ভাবল মা ঢুকছে। সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। জেগে থাকলেই মা আবার তাঁকে পুলককে নিয়ে খারাপ কথা শোনাবে। পুলকের সাথে বিয়ে হলে সে কখনো সুখী হবে না। পুলককে তিনি কখনো মেনে নেবেন না। মায়ের এক ছেলেরা কখনো মায়ের কথা ছাড়া চলে না। পুলকের মা নিজে সংসার করতে পারেনি। তিনি কখনোই ছেলের বউকে শান্তিতে থাকতে দেবেন না। নিজের সংসার না করার ঝাল ঠিকই তিনি ছেলের বউয়ের উপর উঠাবেন। রীতা জীবন দেখেনি। তিনি তো দেখেছেন। রীতার ভাল-মন্দ তাঁর চেয়ে ভালো কে বুঝবে!! এরকম আরো নানা কথা!! রীতার এসব শুনতে শুধু যে ভালো লাগে না তা না। তাঁর প্রচণ্ড কষ্ট হয়। পুলককে সে কতটা পছন্দ করে, পুলক তাঁর জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা যদি মা একটিবার বুঝত!!
নাজমা হক না। ঘরে ঢুকল মিতা। সে আজ স্কুল যায়নি। তাঁর শরীর ভালো না। হাল্কা জ্বর জ্বর আছে। সে এতক্ষণ মায়ের ঘরে শুয়ে ছিল।
রীতা বোনকে জিজ্ঞেস করল-
-কিরে!! তোর শরীর কেমন? জ্বর আছে এখনো?
মিতার কপালে হাত দিল রীতা। না তেমন জ্বর নেই। ঘামছে এখন মিতা। বড় বোনের পাশে শুয়ে পড়ল। হঠাৎ রীতার দিকে ঘুরে মিতা বলল,
-আপু!! তুমি কি একটা কথা জানো?
-কি কথা?
বোনটার দিকে তাকাল রীতা। এই বোনটা এই পুরো পরিবারের সবচেয়ে আদরের। ওঁর চুলে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো রীতা।
-কই? বল কি কথা?
-মা যে তোমাকে তাবিজ কবজ করছে এটা কি তুমি জানো?
-মানে???
বিস্ময়ে রীতা আর কিছু বলতে পারল না।
-হুম!! তুমি যখন ছাদে গেসিলা তখন তোমার বালিশ ছিঁড়ে তাবিজ ঢুকায়ে আবার বালিশ শিলাই করে রাখসে।
-দেখ মিতা!!! বানায়ে বানায়ে কথা বলা আমি একদম পছন্দ করি না। আর মা অকারণ কেন আমাকে তাবিজ করবে!! তুই দিনকে দিন এরকম......।
রীতা কথা শেষ করতে পারল না। মিতা রীতার মাথার বালিশটা টান দিয়ে কি যেন হাতড়ে খুঁজতে শুরু করল। কি যেন পেয়েও গেল। পেয়ে রীতার হাতটা টেনে নিজের দিকে নিয়ে বালিশে পাওয়া জিনিশটা ধরাল। রীতা ধরে দেখল। হ্যাঁ, তাবিজের মতই কিছু একটা।
মিতা বলল,
- তোমরা তো ভাব আমি বাচ্চা। আমি মোটেও বাচ্চা না। আমি সব বুঝি। আমি সব জানি।
রীতা তাঁর বোনের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। মিতা আবার মাথা ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ল।
...................................................................................................
প্রেমের সম্পর্কে প্রেমিক-প্রেমিকার পালিয়ে বিয়ে করা নতুন নয়। কিন্তু এখানে আমাদের গল্পের পাত্র-পাত্রী পালিয়ে বিয়ে করতে একেবারেই নারাজ। পুলকের যুক্তি এখানে প্রবল। সে কখনো তাঁর মায়ের অমতে রীতাকে বিয়ে করত না। যে মা তাঁকে এত বছর কষ্ট করে পেলে বড় করেছে। তাঁকে কষ্ট দিয়ে সে বিয়ে করবে না। কয়েক বছরের সম্পর্কের জন্য এত বছরের সম্পর্ক ভাঙ্গার কোন মানে সে খুঁজে পায় না। যে যুক্তি সে নিজে মানে সেই যুক্তির বিপরীতে সে রীতাকে কিছু করতে বলে না। রীতাও পুলকের সাথে একমত। পুলকের ইচ্ছা রীতার বাবা-মায়ের সাথে সে কথা বলবে। তাঁদেরকে সে অবশ্যই বোঝাবে। পুলক গুছিয়ে কথা বলতে পারে। সে অবশ্যই রীতার বাবা-মাকে রাজি করাতে পারবে। শুধু রীতাই কেন জানি পুলককে না করে যাচ্ছে সেই কবে থেকে।
এদিকে রীতার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মাঝে একদিন রীতা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। এত মানসিক চাপ বোধহয় সে আর সহ্য করতে পারছিল না। নাজমা হকও মেয়ের পরিস্থিতিতে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। এখন তাঁর সুর নরম। কিন্তু মোটেও তা পুলক আর রীতার পক্ষে না। সে এখন নরম সুরে মেয়েকে বোঝায় যে, রীতা এখন তাঁকে বুঝতে পারছে না। কিন্তু একদিন ঠিকই বুঝবে যে মা যা বলেছিল তাই ঠিক।
রীতা কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। ছোটবেলা থেকেই মায়ের কথাই তাঁর কাছে ধ্রুব সত্যি। মায়ের সব নিষেধ সে মন থেকে মেনে নিত। শুরুতে কষ্ট লাগলেও পরে মনে হত এটাই ঠিক ছিল। তখন তাঁর জীবনে পুলক ছিল না। এখন পুলক আছে। পুলককে শুধু সে তাঁর প্রেমিক হিসেবে দেখে না। তাঁর বন্ধু, মেন্টর। আর দশটা পাঁচটা সম্পর্কের মত তাঁদের সম্পর্ক না। এটা সে মাকে কিভাবে বুঝায়!! রীতার বুকটা ভারী হয়ে উঠল বেদনায়। আজকাল মাঝে মাঝে সে মায়ের বলা কথাগুলো ভাবে। ছোটবেলার মতই কখনো কখনো তাঁর মনে হয় যে যদি মায়ের কথাগুলো সত্যি হয়। যদি সে আসলেই পুলকের সাথে সুখী না হয়? পুলক যদি তাঁকে অত্যাচার করে? এসব ভেবে তাঁর মনটা অপরাধবোধে ভরে যায়। কিন্তু মাঝে মাঝেই ভাবনাগুলো আসে। পুলককে সে তাঁর সব কথা বলে। এই ভাবনাগুলোর কথা সে কখনো ওঁকে বলে না, বলতে পারবেও না।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ১৭)
রীতার চাকরি হয়েছে। একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে। এরা বিভিন্ন ধরনের ছোটখাটো পার্টি থেকে বড়সড় কর্পোরেট সেমিনার এরেঞ্জ করে। রীতা এখানে একজন জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে জয়েন করেছে।
চাকরীটা রীতার খুব দরকার ছিল। বাসায় থাকতে থাকতে সে শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল। ঘর থেকে বের হয়ে সে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। আর অফিসটাও তাঁর খারাপ লাগছে না। সবাই বেশ হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল। অফিস এর পর প্রায়ই এখানে ওখানে খাওয়া দাওয়া হয় দল বেঁধে। এটাও কাজেরই অংশ। এ এক অন্য স্বাদ। নিজেকে সে অন্যভাবে আবিষ্কার করছে। আগে রীতার জীবন ছিল ভার্সিটি আর বাসা। তাও এর মাঝে ছিল মায়ের কড়া অনুশাসন। ঠিকভাবে যেন নিশ্বাস ফেলা যেত না। ক্লাস এর অন্যান্য মেয়েরা ঢাকার বাইরে থেকে এসে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করত। আর রীতা ঢাকার মেয়ে হয়েও সব জায়গায় যাওয়ার অনুমতি পেত না। এই চাকরীটা হচ্ছে রীতার বড় হওয়ার সার্টিফিকেট। কারণ মা নাজমা হক মেয়ের চাকরী করার বিপক্ষে নন। বরং মনে মনে চাইতেন মেয়ে চাকরী করুক। চাকরী করলে নিজের পায়ের মাটি শক্ত হয়। নিজে চাকরী করতে পারেননি। এ নিয়ে তাঁর মনে আক্ষেপ আছে। তবে জীবনের আর বড় বড় আক্ষেপের চেয়ে এই আক্ষেপ নগণ্যই বলা যায়। সুতরাং মেয়ে চাকরী করছে এতে নাজমা হক খুশি। মায়ের খুশি রীতার জন্য অলিখিত সার্টিফিকেট। নইলে সে মনে শান্তি পায় না। যেমন পুলকের ব্যাপারটা নিয়ে সে অনেক অশান্তিতে আছে। বেশ অনেকদিন সে বাসায় এ নিয়ে চিন্তা করল। কতকিছু কতভাবে চিন্তা করল। কিন্তু কিছুতেই কোন কূলকিনারা পেল না। একটা সময়ে এসে সে এটা নিয়ে ভাবনা চিন্তাই বন্ধ করে দিল। যা হোক হবে!! আর ভালো লাগে না। কপালে যদি থাকে তাহলে পুলকের সাথে তাঁর বিয়ে হবে। নয়তো হবে না। তখনই চাকরীটা যেন তাঁকে আরো সাহায্য করলো। এখন সে অফিস এর সময়টা কাজ করে উপভোগ করে কাটিয়ে দেয়। আর বাসায় গিয়ে খুশি মনে সবার সাথে অফিসের গল্প করে, মাকে কাজে সাহায্য করে আর ছোট বোন রীতার সাথে খুনসুটিতে মাতে। হ্যাঁ, পুলকের সাথে আলাপ কমে গেছে। ফেসবুক এ নয়তো এসএমএস এ। ফোনে অফিস এ টুকটাক। বাসায় আসলে তো আর ফোনে কথা বলার যো-ই পাওয়া যায় না। পুলকের ঘটনা জানার পর থেকে মা ফোন আসলেই সরু চোখে তাকায়। তাই পুলকের সাথে কথা এসএমএস এই বেশি হয়। পুলক এ নিয়ে কোন অভিযোগ করে না। অন্যায় রাগ পুলকের মধ্যে নেই বললেই চলে। হ্যাঁ, এখন যদি রীতা সিনেমা দেখতে গিয়ে পুলকের সাথে কথা না বলে তাহলে পুলক মহাশয়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়বে। ঝগড়াঝাঁটি করে এক সা করবে। সেই রাগ কবে ঠাণ্ডা হবে রীতাও জানে না। প্রথম প্রথম এ ধরনের রাগ ঠাণ্ডা হতে ২-৩ দিন সময় লাগত। কিন্তু যেখানে আসলেই সমস্যা। সে বেলায় পুলক সব সময়ই আন্ডারস্ট্যান্ডিং। সামনে মা। পুলকের এসএমএস এর জবাব দেয়া যাচ্ছে না। শুধু একবার কোনাভাবে শুধু এসএমএস করলেই হবে যে '‘মা'’। ব্যাস!!! আর কিছু না! পুলক আর এ নিয়ে কোন সমস্যাই করবে না। মাঝে মাঝে রীতার মনে হয় সে পুলককে ঠকাচ্ছে। রীতার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে সে পুলককে আরো কত সময় দিত। রীতা তো আর তা দিতে পারে না।
পুলক বেশ খুশি হয়েছে রীতার চাকরি পাওয়াতে। রীতা বাসায় থেকে থেকে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল। ওঁর জন্য খুব দরকার ছিল অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকা। পুলক এখন আর রীতাকে তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলে না। সে বুঝতে পারে রীতা এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু ডিস্টার্বড। আরো একটু সময় যাক। রীতার অস্থিরতা কমুক। রীতাকে অস্থির দেখলে তাঁর ভালো লাগে না। রীতার যে কোন সমস্যা তো তারই সমস্যা। রীতার চাকরী পাওয়াতে পুলক ভেবেছিল এখন থেকে তাঁর আর রীতার বেশ ঘন ঘন দেখা হবে। এটা ভেবেও সে খুব খুশি হচ্ছিল। কিন্তু আদতে তা হচ্ছে না। লাঞ্চ টাইম এও রীতা সময় করে বের হতে পারে না। অফিস এর পর যাও দুএক দিন দেখা হয় তখন রীতার বাসায় যাওয়ার খুব তাড়া থাকে। দেরী হলে মা বকবে। পুলক মেনে নেয়। একটু একটু অভিমান জমতে চাইলেও সে জমতে দেয় না। বাসায় সমস্যা হলে রীতারই মন খারাপ হবে। রীতার মন খারাপ হোক এটা সে চায় না। কখনো চায় না।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ১৮)
‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নামে মুনীর চৌধুরীর একটা নাটক আছে। নাটকের একটা সংলাপ খুব জনপ্রিয়। সংলাপটা মানুষ কারণে অকারণে ব্যবহার করে। ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়’। এখন মানুষ যে বদলায় এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু মানুষ কখন বদলায়? মানুষ বদলায় পরিস্থিতি বদলের সাথে সাথে। জেলে বন্দি থাকা মানুষ এক রকম। সেই একই মানুষ মুক্তি পেলে অন্য মানুষ। দুঃখে থাকা মানুষ এক রকম। আবার সেই একই মানুষ দুঃখ কাটিয়ে উঠলে অন্য মানুষ। পরিস্থিতি বদল। মানুষ বদল। নিজের বদলে যাওয়া সম্পর্কে মানুষ নিজেই অবগত না। কারণ পরিস্থিতির বদলে যাওয়া সম্পর্কেও মানুষ আগে থেকে বলতে পারে না। এমতাবস্থায়, আমরা খুব স্বাভাবিকভাবেই বলতে পারি যে মানবজাতি একটি অননুমেয় জাতি।
চাকরীর আগে রীতার জীবন ছিল অসম্পূর্ণ। সেই অসম্পূর্ণ জীবন পূর্ণ হয়েছিল পুলকের মত একজনকে পেয়ে। যে তাঁর জীবনের সব সমস্যাগুলোর ভার নিয়ে নিয়েছিল। রীতার কষ্ট হলে রীতা সেই কষ্টের ভারটা পুলকের কাঁধে রেখে হাল্কা হতে পারত। তাঁর তথাকথিত বন্দি জীবনে পুলকই ছিল আশ্রয়।
এরপর চাকরী পাওয়ার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটল। রীতার সামনে খুলে গেল নতুন জগৎ। যে জগতে পুলক আর তাঁর মা ছাড়াও বহু লোক আছে। যে দুনিয়াতে সময় কাটালে সব দুশ্চিন্তা ভুলে থাকা যায়। ততদিনে ‘পুলক’ নামক ব্যক্তিও তাঁর দুশ্চিন্তার তালিকার মধ্যে ঢুকে গেছে।
প্রত্যেক মানুষের জীবনেই এমন একজন থাকে যার অনুমোদন ছাড়া সামনে এগোতে ঠিক সাহস হয় না। মনে যেন একটা কামড় লেগে থাকে। হতে পারে সেই মানুষটি আমাদের মা-বাবা, বন্ধু অথবা এর চেয়েও কাছের কোন মানুষ। কিন্তু এই কাছের মানুষের সংখ্যা যদি একের বেশি হয় আর তাঁদের মতামত যদি একই রকম না হয় তখন হয় একটি বিরাট সমস্যা।
রীতার কাছে পুলক আর তাঁর মা এরকমই দুজন মানুষ। যাদের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। তাই সে এসব থেকে যতদূরে থাকা যায় থাকছে। অফিস করে দেরী হলেও মা এখন আর তাঁকে কিছু বলে না। এখন মেয়ে জব করে। মেয়ে বড় হয়েছে। তাও মেয়েকে জিজ্ঞেস করে-
-কীরে!! এত দেরী কেন?
-ওই শেষ দিকে আরিফ ভাই প্ল্যানিং এর ডিটেইলস জানতে চাইল। তারপর সবাই মিলে FFC তে কফি খেলাম। তাই দেরী হয়ে গেল।
নাজমা হক কিছু বলেন না। তবে তাঁর মাঝে কোন অসন্তোষ দেখা দেয় না। অফিস এর কলিগদের সাথে হাল্কা মেলামেশা তাঁর কাছে দোষনীয় মনে হয় না। খালি মৃদু স্বরে একবার বলেন-
-ভালো!!! অন্য কিছু না করলেই হলো।
কথাটা রীতা শুনেও না শোনার ভান করে চলে যায়।
যতক্ষণ মেয়ে পুলক নামক ছেলেটার থেকে দূরে থাকবে ততক্ষণ তাঁর কোনকিছুতেই আপত্তি নেই।
পুলকও আস্তে আস্তে রীতার পরিবর্তনগুলো টের পাচ্ছে। সে রীতাকে বোঝার চেষ্টা করছে। এমন একটা সময় ছিল যখন পুলককে কেউ মেনে নিতে পারত না। পুলকের মনে হত তাঁর জন্য এই পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে তাঁকে বুঝবে। সেই সময় রীতা তাঁর জীবনে এসেছিল। সে যেমন তেমন করেই। এখনকার পুলক আর আগের মত চট করে রেগে যায় না। সে বড় হয়েছে। এই ‘বড়’ সে হয়েছে রীতার সহযোগিতায়। সে এখন ঘটনার পিছনের ঘটনা বোঝার চেষ্টা করে।
রীতার সাথে তাঁর আজকাল ওইভাবে ফোনে কথা হয় না। এমন না যে আগেও খুব হত। কিন্তু এটা নিয়ে কখনোই পুলকের অভিযোগ নেই। বাসায় সমস্যা হচ্ছে। যখন রীতা সুযোগ পাবে তখন ফোন করবে। এটা নিয়ে অশান্তি করার তো কিছু নেই। হ্যাঁ, বাইরে আগে দেখা হত ভালই যখন রীতার ক্লাস থাকত। এরপর তো রীতা আর বাইরে তেমন বের হত না। তাই দেখাও হত না। এটা নিয়েও কেন জানি পুলকের তেমন অস্থিরতা ছিল না। এই পুরো সম্পর্কটাতেই পুলকের মধ্যে একটা নিরাপত্তাবোধ ছিল। ‘নিরাপত্তাবোধ’ শব্দটার বদলে আমরা যদি ইংরেজি শব্দ ‘secure’ ব্যবহার করি তাহলে হয়তো ব্যাপারটা আরো ভালো বোঝা যাবে। এরপর পুলকের কথা রীতা ওঁর মাকে বলল। এতে মাসখানেক রীতার খুব খারাপ সময় গেল। সৌভাগ্যবশত রীতার চাকরিটা হয়ে গেল।
কিন্তু এখন মাঝে মাঝে দেখা হলেও রীতাকে কেমন যেন অচেনা লাগে। এ যেন তাঁর আগের রীতা নয়। আগে রীতা অনেকদিন দেখা না হলে অস্থির হয়ে যেত। দেখা হওয়ার পর খুশিতে কিছুটা আবেগী হয়ে যেত। অনেকক্ষণ হাত ধরে বসে থাকত। কিন্তু এখন কোথাও যেন কিছু একটা গরমিল আছে। কিছু একটা নেই। কি নেই!!! সেটাই পুলক ধরতে পারছে না। পুলক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রীতাকে কত কিছু জিজ্ঞেস করে। এটাও নতুন। আগে রীতাকে তাঁর এত কিছু জিজ্ঞেস করা লাগত না। রীতা নিজে থেকে তাঁকে সব বলত। মাঝে মাঝে পুলক একটু হতাশ হয়ে যায়। হতাশা থেকে আসে রাগ। নিজেই নিজের রাগকে প্রশমিত করে। প্রশমিত রাগ থেকে আসে স্থবিরতা। সে কিছু বুঝে উঠতে পারে না।
আজকাল রীতার বাইরে বেশ পার্টি থাকে। সেরকমই এক পার্টি হচ্ছে পিজা হাট এ। পুলক রীতাকে ফোন দিল।
-হ্যালো!!
-হ্যাঁ, বল।
-কোথায় তুমি?
-আমি একটু পিজা হাট এ। অফিস এর কলিগদের সাথে আছি।
-আমি যে আজকে তোমার সাথে দেখা করতে চাইলাম। তুমি তো বললে আজকে বাসায় তাড়া আছে।
-হ্যাঁ ছিল। বাসায় বলে দিয়েছি ফোন করে যে আসতে দেরী হবে।
রীতার স্বর ঠাণ্ডা। কোন অপ্রস্তুতকর ভাব নেই গলায়। যেন এটাই স্বাভাবিক। পুলকের খুব রাগ হওয়ার কথা ছিল। খুব চেঁচানোর কথা ছিল। রাগে পাগল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রীতার ঠাণ্ডা নিঃস্পৃহ গলায় পুলক যেন অনুভূতিহীন হয়ে গেল। কার কাছে রাগের দাবি জানাবে!! এ তো তাঁর চেনা কাউকে মনে হচ্ছে না। এ অন্য কেউ। ‘ও আচ্ছা’ বলে ফোন রেখে দিল। শুরু হল পুলকের অভিমান জমা।
প্রিয় মানুষকে খুব বেশী অভিমান করতে দেওয়া উচিৎ না। কারণ একটু একটু করে অভিমান জমে পাহারসম অভিমান জমা হয়। সেই পাহাড় সরানোর ক্ষমতা আমাদের আর থাকে না।
রীতা জানে এসব। সে জানে সে পুলকের সাথে ঠিক করছে না। কিন্তু তাঁর জীবনের এত জটিলতা আর ভালো লাগছে না। সে সব ঝামেলা থেকে মুক্তি চায়। যেখানে তাঁকে পুলক আর তাঁর মায়ের মধ্যে থেকে কাউকে বেছে নিতে হবে না। যেখানে তাঁর কোন মানসিক অশান্তি থাকবে না। একমাত্র কাজের মধ্যে, কাজের মানুষদের সাথে থাকলে সে এসবকিছু ভুলে থাকতে পারে। তাই সে যতক্ষণ পারে বাইরে কাটায়। এতে করে যে তাঁর আর পুলকের মধ্যেকার সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এটাও সে বুঝতে পারছে। কিন্তু তাঁর কিচ্ছু করতে ইচ্ছা করছে না। পুলক অভিমান করে আছে। একটা ফোন করলেই পুলকের সব রাগ অভিমান পানির মত গলে যাবে। সব জানে সে। কিন্তু রীতার কিচ্ছু করতে ইচ্ছা করছে না। কেন করছে না। তাও সে জানে না।
এক সপ্তাহ হয়ে গেছে পুলক রীতাকে কোন ফোন দেয় না। রীতা মাঝে মাঝে পুলককে ফোন এসএমএস করে। পুলক খুব ফরমালি রিপ্লাই করে। যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু পুলক বেশিক্ষন এই মাইন্ড গেম খেলতে পারলো না। পুলক সেই মানুষদের দলে যারা মনের ভিতর রাগ অভিমান জমিয়ে রাখতে পারে না। যখন রাগ হল চিল্লাচিল্লি করে ঠাণ্ডা। রীতার সাথেও তাই করত। কিন্তু এখন তো তাঁর রাগ অভিমানকে রীতা বুঝতেই পারছে না। নাকি বুঝতে চাইছে না।
পুলক রীতাকে একটা মেইল করল।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ১৯)
গতানুগতিক জীবনের প্রতি সবার খুব অভিযোগ। মানুষের ক্ষমতা থাকলে মানুষ তাঁর জীবন থেকে গতানুগতিকতা মুছে ফেলত। কিন্তু মানুষকে এত ক্ষমতা দেয়া হয়নি। চাইলেই মানুষ এই গৎ বাঁধা জীবন থেকে মুক্তি পায় না। চাইলেই মানুষ তাঁর জীবনকে ৪-৫ বছর রিওয়াইন্ড বা ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে নিতে পারে না যে ধুর এখন ভালো লাগছে না। দেখি!! ৫ বছর পরের কী অবস্থা? কিন্তু একজন লেখক হিসেবে আমি খুব সহজেই এই কাজটা করতে পারি। আমার গল্পের চরিত্রদের আমি কয়েক মাস বা কয়েক বছর এগিয়ে বা পিছিয়ে নিয়ে যেতে পারি। এভাবে করে আমি আমার এই গল্পকে গতানুগতিকতা থেকে মুক্তি দেব।
বছরখানেক পর।
পুলক বসে আছে বসুন্ধরা সিটি এর ফুড কোর্ট এ। চারপাশে বেশ ভীড়। এ জায়গাটায় সবসময়ই ভীড়। কপলদের জন্য ভালো জায়গা। ফুড কোর্ট টা টপ ফ্লোর এ। ফ্লোরটার সাইড দিয়ে কপলদের মুখোমুখি বসার জন্য সিট এরেঞ্জ করা। তারই একটায় পুলক বসা। পরনে গাঢ় নীল রঙের টি-শার্ট আর জিন্স। এক বছরে বেশ কিছুটা শুকিয়ে গেছে সে। এতে চেহারায় অন্য মাত্রা এসেছে। দেখতে খারাপ লাগছে না তাঁকে।
- কখন এসেছ?
প্রিয়াঙ্কা সামনে দাঁড়ানো। শার্ট আর জিন্স পরা প্রিয়াঙ্কাকে আশেপাশের মানুষেরা ঘুরে ঘুরে দেখছে। দেখার মতই লাগছে তাঁকে। আর এমনিতেও সে খুবই সুন্দরী।
পুলক উত্তর দিল-
- ১০ মিনিট!!! বস।
প্রিয়াঙ্কা বসলো।
- এত ক্রাউড!!! পুরা বাজার বানিয়ে ফেলল দেখি মানুষজন। (চোখ-মুখ কুঁচকে প্রিয়াঙ্কা বলল)
- এটা তো বাজারই। (পুলক হেসে বলল)
- ইয়া!! আই মীন। মাছের বাজার!!!
এখন অনেকক্ষণ ন্যাকা ন্যাকা কথা শুনবে পুলক। তাঁর খারাপ লাগে না। ভালোই লাগে। সে চুপ চাপ শুনে যায়। মেয়েরা সম্ভবত শ্রোতা পছন্দ করে। না শুধু মেয়েরা না। সবাই-ই শ্রোতা পছন্দ করে। আমাদের আশেপাশে বক্তা বেশি। শ্রোতা নেই বললেই চলে।
আধা ঘণ্টা পুলক প্রিয়াঙ্কার কথা শুনল। ও নতুন কোন কোন ডিজাইনার এর ড্রেস কালেক্ট করেছে। ওঁর হাইট ৫’ ৭” । সেই তুলনায় ওঁর ওয়েট অনেক হয়ে যাচ্ছে। she needs to control her diet। ওঁদের ইউনিভার্সিটি তে কতগুলা wanna be আসছে। (wanna be মানে যারা খুব স্মার্ট হতে চায় কিন্তু কিছু একটা গোলমাল করে ফেলে, এর ফলে এদের খুব বেশি আনস্মার্ট লাগে) এরা খুব happening হওয়ার try করছে কিন্তু পারছে না। ওরা এমন সব ড্রেস পড়ে যে প্রিয়াঙ্কা আর ওঁর ফ্রেন্ডরা হাসতে হাসতে মরে যায়। নিজেদের যে এরা কী ভাবে!!! এরকম আরো নানা কথা।
পুলকের ভালই লাগে ওঁর কথা শুনতে। মেয়েটা হাত নেড়ে নেড়ে অনেক রকম মুখভঙ্গি করে কথা বলে যাচ্ছে। পুলক কিছু শুনছে কিছু শুনছে না। প্রিয়াঙ্কা সুন্দরী। এবং সে জানে সে সুন্দরী। এতে তাঁর কথায়, চলেফেরায়, অঙ্গভঙ্গিতে অহংকারের প্রকাশ স্পষ্ট। সুন্দরী কোন মেয়েকে সামনে থেকে দেখার মাঝেও আনন্দ। তবে খুব কাছে না যাওয়াই ভালো। আসলে কারোই খুব কাছে না যাওয়া ভালো। দূর থেকে সবই ভালো সবই সুন্দর। যত কাছে তত সত্য। সত্য খুব কম সময়ই সুন্দর হয়।
- কী ভাবছ? (প্রিয়াঙ্কার প্রশ্ন)
- নাঃ!! কিছু না তো!!
ন্যাকা স্বরে প্রিয়াঙ্কা বলল, “পুল!!! আমার খুব খিদে পেয়েছে”
- কী খাবা?
- জুস খাবো আগে।
- আরে জুস খেলে খিদা যাবে নাকি?
- আরে তোমাকে বললাম না আমার ওয়েট বেড়ে গেছে। তুমি দেখি আমার কোন কথা শুনো না!!
- ওকে ওকে!!! আনছি। স্ট্রবেরি উইথ আইস!!! রাইট?
- ইয়াপ!!! (খুশি হয়ে বলল প্রিয়াঙ্কা)
পুলক উঠে গেল প্রিয়াঙ্কার জুস আনতে। প্রিয়াঙ্কা পুলকের দিকে তাকিয়ে আছে।
ফেসবুক এ পুলকের সাথে পরিচয়। খুবই হাস্যকরভাবে পরিচয়। প্রিয়াঙ্কার খুবই happening সব প্রোফাইল পিক ফেসবুক এ। বেশীরভাগ ই pout পোজ। pout হচ্ছে সেই পোজ যেখানে মেয়েরা চুমু খাওয়ার মত ভঙ্গি করে ছবি তোলে। বেশীরভাগ ছবিই প্রিয়াঙ্কার নিজের তোলা। প্রিয়াঙ্কা যতবার ওয়াশরুমে যায় ততবার বিভিন্ন পোজে ছবি তোলে সে। কতরকমই না ভঙ্গিতে সে আয়নাতে নিজের পিক তোলে সে। কোন wanna be এর ক্ষমতা নেই প্রিয়াঙ্কার মত পারফেক্ট প্রোফাইল পিক দেওয়ার। এই জন্যই প্রতিদিন গড়ে ৫০টার মত ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পায় সে। পুলকও তাঁকে সেইভাবে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিল। সাথে ছিল টিপিকাল ছেলেদের ইনবক্স মেসেজ “Hi”। এরকম অসংখ্য ইনবক্স মেসেজ জমে আছে প্রিয়াঙ্কার। কিন্তু এরপর পুলক তাঁকে ইনবক্স করল-
- I would like to talk with you.
- Do I know you?
- How would I know?
- Do you know me?
- Nope!!
- Then why did you send me request and bothering me in the inbox?
এরপর পুলক ইংলিশ ছেড়ে বাংলায় গেল।
- তোমার প্রোফাইল দেখে তোমাকে অনেক হট লাগসে। আমি এখন ফেসবুক এ হট মেয়ে দেখলেই ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দেই। ওকে? ভালো লাগলে কথা বল না লাগলে নাই। ফুটো।
খুবই রাগ উঠেছিল প্রিয়াঙ্কার। কিন্তু এক সপ্তাহ পর ঠিকই নক করেছিল পুলককে। he is a nice guy। সস্তা প্রেম করার উদ্দেশ্য নিয়ে সে কথা বলতে আসেনি। প্রিয়াঙ্কার ফিলসফি এর সাথে মিলে। No commitment. Only pure friendship. That’s all. কিন্তু কথা খুব কম বলে। এটা অবশ্য প্রিয়াঙ্কার জন্য ভালো। প্রিয়াঙ্কা বলতে ভালোবাসে। শুনতে না।
পুলক নিজের জন্য চকলেট ড্রিঙ্ক নিল আর প্রিয়াঙ্কার জন্য স্ট্রবেরী জুস। নিয়ে এসে আরো কিছুক্ষণ গল্প করলো এরা। তারপর বের হয়ে যাওয়ার জন্য উঠল এরা। হঠাৎ পুলকের ফোনে একটা এসএমএস আসল।
“কেমন আছ পুলক?”
পুলক অনেকক্ষণ স্থবির হয়ে মোবাইল ফোনের স্ক্রীনটার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিয়াঙ্কা ওঁর সাথেই হাঁটছিল। প্রিয়াঙ্কা হঠাৎ দেখল পুলক পিছনে দাঁড়িয়ে গেছে আর এক দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।
-কি হয়েছে পুল? কোন প্রবলেম? কার এসএমএস?
পুলক তখনো তাকিয়েছিল। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেল।
-না কিছু না। চল।
-চল। আমরা এখন কোথায় যাব পুল?
পুলক অন্যমনস্ক হয়ে আছে। এক বছর পর এই এসএমএস এর কী মানে?
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ২০)
সম্পর্ক কেন ভাঙ্গে? কত সুখ দুঃখ!! ভালো সময় মন্দ সময় পাড় করে দুইজন মানুষ একসাথে!! তারপর ঠিক কী এমন হয় যে আর একসাথে থাকা হয় না? প্রশ্নগুলো খুব সহজ কিন্তু তীব্র। এবং এর উত্তর কারো জানা নেই।
পুলক আর রীতার সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে। ঠিক কী হয়েছিল!! এক বছর আগে কিভাবে তারা দূরে চলে গেল।
পুলক রীতাকে বেশ লম্বা একটা মেইল করেছিল। মেইল এ সে রীতার কাছে তাঁর মনের অবস্থাটা তুলে ধরেছিল। রীতার কী হয়েছে? কেন সে এরকম অচেনা হয়ে যাচ্ছে? পুলকের কোথায় ভুল হচ্ছে? পুলক তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করতে চাইছে যে সে কোথায় ভুল করছে? রীতার ভিতরে কী চলছে? রীতা তো কখনো পুলকের থেকে কিছু লুকোত না। তাহলে এখন কেন লুকোচ্ছে? পুলক জানে রীতার মা তাঁদের ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু তাঁরা দুইজন যদি এক থাকে, শক্ত থাকে তাহলে কী রীতার মা এমনিতেই একদিন মেনে নিতে বাধ্য হবেন না? প্রয়োজনে পুলক রীতার মায়ের সাথে কথা বলবে। তারপরও যদি উনি না মানেন তাহলে না হয় নিজেরা খুশি মনেই আলাদা হয়ে যাবে। কারণ পুলকের কাছে বাবা-মায়ের উপরে আর কোন সম্পর্ক নেই। তাঁদেরকে কষ্ট দিয়ে পুলক কিছু করতে চায় না। এইসব কথাবার্তা তো আগে থেকেই রীতা জানে। তাহলে সে কেন এরকম করছে? পুলক তো সবসময় রীতার সমস্যা বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু পুলকের যদি কখনো রাগ হয়, অভিমান হয় সেটা কে বুঝবে? পুলক কার কাছে যাবে রীতা ছাড়া?
রীতার রিপ্লাই আসল বেশ কিছুদিন পর। সে পুলককে আশ্বস্ত করল যে পুলকের কোথাও ভুল হচ্ছে না। সে নিজেই খুব ডিস্টার্বড হয়ে আছে। তাঁর জীবনে তাঁর মা আর পুলক দুইজনেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোন একজনকে সে কিভাবে বেছে নেবে? সে জানে তাঁর মা কখনো মন থেকে পুলককে মেনে নিতে পারবে না। আর আজকাল তাঁর মনে হচ্ছে যদি মা ঠিক বলে থাকে!!! যদি সে পুলকের সাথে সুখী না হয়!!! রীতা জানে পুলকের মত মানুষ হয় না। তারপরো সে একটা অন্তরদ্বন্দে ভুগছে যা সে আগে কখনো অনুভব করেনি। এই অনুভূতির জন্য সে নিজের কাছেই অনেক ছোট হয়ে আছে। সে পুলককে কী বোঝাবে? রীতা নিজেকেই নিজে বুঝতে পারছে না। কিন্তু এটুকু রীতা জানে যে পুলকের চেয়ে আত্মার বন্ধু তাঁর আর কেউ নেই আর হবেও না। এ নিয়ে তাঁর মনে কোন সন্দেহ নেই।
পুলকের কী খুব দুঃখ হওয়া উচিৎ রীতার মেইলটা পড়ে? পুলক ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তাঁর কী খুব কষ্ট হওয়া উচিৎ? তাহলে কিছু হচ্ছে না কেন? সে মেইলটা আরো কয়েকবার পড়ল। নাঃ!! কোন কষ্ট হচ্ছে না। তাহলে কি ভেতরে ভেতরে এই ধরনের কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল সে? তাঁর অবচেতন মন অনেক আগে থেকেই জানত কি হতে যাচ্ছে? পুলক বেশ কিছুদিন নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে রাখল। সে রীতাকে ফোন দিল না। এসএমএস করলো না। রীতার ফোন রিসিভও করলো না। রীতা এসএমএস করলে জবাব দিত না। নিজের সাথে একটু কথা বলে নেয়া উচিৎ পুলকের।
নিজের সম্পর্কে কখনোই খুব উচ্চ ধারণা ছিল না পুলকের। বরং কিছুটা হীনমন্যতা ছিল নিজেকে নিয়ে তাঁর। আত্মবিশ্বাস নামের যে বিশাল পাহাড় ছিল তাঁর সামনে তা কখনো চড়া হয়নি পুলকের। ওই বিশাল পাহাড়ে সে উঠেছে রীতার হাত ধরে একটু একটু করে। যত উপরে উঠেছে তত তাঁর ভিতরের হীনমন্যতাবোধ দূর হয়েছে। সাথে সাথে দূর হয়েছে রাগ, অসামাজিকতা। আজকে সে আত্মবিশ্বাস নামের সেই পাহাড়ের চূড়ায়। যে মানুষটা তাঁকে সেই পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গেল। আজকে সেই মানুষটা তাঁকে ধাক্কা দিয়ে সেই পাহাড় থেকে ফেলে দিচ্ছে। রীতার মনে তাঁকে নিয়ে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে!!! রীতা তাঁর সাথে সুখী হবে কিনা এ নিয়ে ওঁর মনে প্রশ্ন উঠছে!!! বুকটা কীরকম ব্যাথায় চিন চিন করে উঠল। এরকম ব্যাথার সাথে সাথে শরীর যেন কিছুটা ঝিম ঝিম ও করে উঠে। চোখটা মনে হয় একটু জ্বালা করে। ইংরেজীতে একটা শব্দ ব্যবহার করলেই যেন পুরো পরিস্থিতির বিবরণ দেয়া হয়ে যাবে। “self-pity”। তাহলে কী এত বছেরে তাঁর যা যা প্রাপ্তি সব মিথ্যে? রীতা যা যা বলেছে? না!! পুলক আবেগে যুক্তিহীন হবে না। আবেগ পুলকের প্রকৃত অস্ত্র নয়। বরং যুক্তিই তাঁর প্রিয়।
আসলে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়ে রীতার মন পরিবর্তন হয়ে গেছে। এই রীতা তাঁর আগের রীতা নয়। এ নতুন কেউ। এখন কারো মন পরিবর্তন হওয়ার জন্য তো কাউকে দোষারোপ করা যায় না। তাই পুলক রীতার উপর রাগ অভিমান কোনটাই করতে পারল না। রীতার জায়গায় পুলকেরও মন পরিবর্তন হতে পারত। খালি একটাই আফসোস হচ্ছে পুলকের। তাঁর মানে ভালোবাসা বা সত্যিকারের অনুভূতি বলে কিছু হয় না। যেখানে আমাদের মনেরই নিশ্চয়তা নেই সেখানে ভালোবাসা আবার কী জিনিস? নিজের মনেই হাসে পুলক। নাহ!!! এখনো যে কষ্ট হচ্ছে না তেমন। পুলক জানে এ ধরনের কষ্ট কত তীব্র হয়। আগের সম্পর্কটা যখন ভেঙ্গে গেল, তখন কী মারাত্মক কষ্ট হয়েছিল পুলকের। বুকের ভিতর যেন খামচি মারা ব্যথা ছিল। বুকের ভেতর এমন এক জায়গায় ব্যথা হয় যেই জায়গাটার অস্তিত্ব সম্পর্কেই অবগত ছিল না আগে পুলক। কই!! সেই জায়গাটাতে তো কিছু হচ্ছে না।
পুলক রীতাকে ফোন দিল।
-হ্যালো!! রীতা!!
-হ্যাঁ
-রীতা আমি তোমাকে মুক্তি দিতে ফোনটা করেছি।
-(রীতা নিশ্চুপ)
-আসলে আমি এই কদিন বুঝতে পারিনি যে তুমি আসলে আমার কাছে মুক্তি চাচ্ছ।
-পুলক!! (হাউমাউ করে কেঁদে) এভাবে বোইলো না প্লিজ।
-কানতেস কেন রীতা? আমার তোমার উপর কোন রাগ নেই। অভিমান আছে কিনা এটা surely বলতে পারি না। হয়তো একটু আছে। কিন্তু বিশ্বাস কর। সত্যি সত্যি আমার তোমার উপর কোন অভিযোগ নেই। তবে আজকের পর তোমার সাথে আমার আর কথা হবে না। আমি তোমাকে ফোন করবো না। তুমিও আমাকে আর ফোন করবে না।
-পুলক!! তুমি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু।
-আমি জানি। কিন্তু এই বন্ধুত্ব তোমার আমার দুইজনের জন্যই ক্ষতিকর। তোমার কথা বাদ দেই। আমার জন্য ক্ষতিকর। আজ না হোক কাল আমি কাউকে না কাউকে বিয়ে করবো। তোমার জন্য যে জায়গাটা ছিল সেই জায়গাটা আমাকে ফাঁকা করতে হবে রীতা। নইলে সেখানে অন্য কেউ আসতে পারবেনা। জোর করে আনলেও অন্যায় হবে। তোমার বেলায়ও একই কথা সত্যি। তাই না?
-(রীতা নিশ্চুপ)
বিচক্ষণ পুলকের বিচক্ষনতার সাথে তো সে পরিচিত। পুলক যা বলে ঠিক বলে।
-তাহলে রীতা। তুমি ভালো থেকো। বাই।
পুলক ফোন কেটে দিল। নাহ!! তাঁর চোখে পানি নেই। বুকে ব্যথা নেই। তাঁর কষ্ট হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? এটা কি অস্বাভাবিক না
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ২১)
নদীর মধ্যে সুন্দর একটা নৌকা। নৌকায় কোন মাঝি নেই। নৌকায় পুলক আর রীতা বসা। অল্প দুলছে নৌকাটা। সন্ধ্যা হবে হবে করছে। একা মানুষদের কাছে সময়টা খুবই বিষাদের, হাহাকারের। কিন্তু সঙ্গে প্রিয় মানুষ থাকলে অন্য কথা। পুলকের তাই মন খুব তরল। হঠাৎ করে নৌকাটা খুব জোরে জোরে দুলে উঠল। পুলক নৌকা থেকে নদীতে পড়ে গেল। পুলক সাঁতার পারে না। একবার ডুবছে আর ভাসছে। যতবার ভেসে উঠছে ততবার বলছে ‘রীতা আমাকে ধর’ , ‘রীতা আমাকে ধর রীতা’। রীতা চুপচাপ বসে আছে। একটুও নড়ছে না। পুলক ডুবে যাচ্ছে। ডুবে যেতে যেতে পুলক দেখছে রীতার চেহারা ভাবলেশহীন। সে একদৃষ্টিতে পুলকের ডুবে যাওয়া দেখছে। পুলকের খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। পানির নিচ থেকে পুলক রীতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। নৌকার মুখ ঘুরে যাচ্ছে। রীতার চেহারাটা দূরে সরে যাচ্ছে। ডুবে যেতে যেতে সে শেষবারের মত ডাকল, ‘রীতা!!! রীতা!!!’।
ধড়মড় করে বিছানায় লাফিয়ে উঠল পুলক। ফোন বাজছে। প্রিয়াঙ্কার ফোন।
- পুল!!! কখন থেকে তোমাকে কল করছি।
- কে? (পুলকের ঘোর এখনো কাটেনি)
- কে মানে? আমি প্রিয়াঙ্কা। were u sleeping, পুল?
- হুম!!
- Anyways!! আজকে মিট করতে পারছি না। সরি। সান্ডির বাসায় যেতে হবে।
- হুম।
- কি হুম হুম করছ!! ধুর!! রাখলাম। বাই।
- হুম! বাই।
স্বপ্নটা থেকে এখনো বের হতে পারেনি পুলক। বুকটার মধ্যে এখনো চিনচিনে ব্যাথা। এই ব্যাথা এরকম হঠাৎ হঠাৎ হয়। তাও খুব অল্প সময়ের জন্য। এই এক বছর ধরে সে ব্যাথাটার জন্য অপেক্ষা করে আছে। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত ব্যাথাটা আসে। কিন্তু থাকে না। চলে যায়। ব্যথা বা কষ্টের জন্য অপেক্ষা করাটা গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়ার মত। বোঝা যায় না ঠিক কী করা উচিৎ! পুলকও এতটা সময় গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী বিশাল শুন্যতা পুলকের অস্তিত্ব জুড়ে। কষ্ট ছাড়া শূন্যতা ভোঁতা যন্ত্রণার মত। এই শূন্যতা কিছুতেই ভরাট হয় না।
সারাদিনে আমাদের জীবনে অগুরুত্বপূর্ণ কত কিছু ঘটে। জ্যামে আটকে আছি। অফিসে ঢুকতে লেইট হয়ে গেছে। বাসের কন্ডাক্টরের সাথে আজকে খুব ঝগড়া হয়েছে। টেম্পোতে পাশে বসা লোকটার গা থেকে বিটকেলে গন্ধ বের হয়েছিল। মা আজকে এই বলেছিল। পুরোনো এক বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা। ভার্সিটি এর কাছ দিয়ে যেতে মনটা খুব স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিল। আজকে প্যান্টটা টাইট টাইট লেগেছে। মনে হয় খুব খেয়ে ফেলছি। আমার ওই যে খুব প্রিয় একটা শার্ট ছিল নীল রঙের। ওইটা খুঁজে পাচ্ছি না। এরকম কত কথা আমাদের এই মনে জমে। এই আপাতদৃষ্টিতে অগুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো আমরা আমাদের প্রিয় মানুষকে বলি। সবাইকে এসব কথা বলা যায় না। সবার কাছে এসব কথার গুরুত্বও থাকে না। পছন্দের মানুষ, ভালোবাসার মানুষেরাই এসব গুরুত্বহীন কথার মাঝেও গুরুত্ব খুঁজে পায়। আর মানুষেরা পায় না।
রীতা যখন ছিল তখন পুলক এরকম ৫ মিনিটের জন্য কল করে কথা বলে নিত। গুরুত্বপূর্ণ অগুরুত্বপূর্ণ সব কথা। না বললে যেন ঠিক শান্তি হত না। বেশ কয়েক মাস আগে। পুলকের একটা প্রেজেন্টেশান ছিল অফিসে। এই প্রেজেন্টেশানটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রেজেন্টেশানটা ভালো হলে কিছুদিনের জন্য বসদের নজরদারি থেকে মুক্তি। প্রেজেন্টেশান যতটুকু ভালো হওয়ার কথা ছিল। তাঁর চেয়েও ভালো হল। সবাই তাঁকে কনগ্রাচুলেট করল। তাঁর বসের বস বিবেক রয় তাঁর খুব প্রশংসা করল। এই সেই বিবেক রয় যে কয়েক মাস আগে তাঁর ডাইরেক্ট বসের কাছে তাঁর নামে কমপ্লেইন করেছিল। আজ সে তাঁকে ভালো বলছে। পুলকের মনটা খুশিতে ভরে উঠল। সে কনফারেন্স রুম থেকে বের হয়ে অভ্যাসবশত ফোনটা বের করল। রীতার নাম্বার এ ডায়াল যেই করতে যাবে অমনি তাঁর মনে পড়ে গেল যে রীতাকে তো আর সে কোনোদিন কল করতে পারবে না। পুলক পকেটে ফোন রেখে দিল। তাঁর আর কাউকে কল করার নেই।
যাদের মধ্যে বিশাল শূন্যতা কাজ করে তাঁরা অর্থহীন কাজ করে। অর্থহীন কাজগুলো তাঁদের করতে হয় শূন্যতা ভরার জন্য। কিন্তু যে বিশাল গর্ত তৈরি হয় তা ভরাট করার ক্ষমতা মনে হয় ঈশ্বর মানুষকে দেননি। মানুষ তাও বৃথা চেষ্টা করে। মেনে নিলেই কিন্তু হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ মেনে নেয় না।
পুলক সারাজীবন দেবদাস কিসিম এর পাবলিকদের নিয়ে কৌতুক করে এসেছে। একটা মেয়ের জন্যে কি অবস্থা করছে ছেলেগুলা। ছিঃ!! এ মদ খায়। আবার একটু পর পর কাঁদে। উদাসীন হয়। সারাদিন ঘুমায়। কী অবস্থা!!! এইগুলা কিছু হইল!!!!
সেই পুলকের কাছেই এই সময় মনে হল জীবনের আসলে কোন অর্থ নেই। এইরকম বোধ থেকেই যে মানুষ অর্থহীন কাজে লিপ্ত হয় এটাও সে উপলব্ধি করল।
অসামাজিক মানুষেরা প্রবল রকমের নীতিবান হয়। কারণ তাঁদেরকে সমাজের বাকি মানুষদের সাথে না মিশলেও চলে। কারণ তাঁরা অসামাজিক। পুলকের মত রাগী মানুষেরা তাই প্রবল রকমের নীতি মেনে চলতে চেষ্টা করে। পুলক সারাজীবন যে কোন ধরনের নেশা করা অপছন্দ করেছে। এর পিছনে অবশ্য তাঁর বাবার নেশা করার ব্যাপারটা ছিল। তাঁর বাবা নেশা করত এবং বাসায় এসে হই চই করত। যাক সে কথা!! মেয়েদের পিছনে ঘোরা, এদের অতিরিক্ত পাত্তা দেয়া। এসবও পুলক সারাজীবন অপছন্দ করেছে। সেই পুলককে দেখা গেল সিগারেট খেতে। অনেক রকম মেয়ের সাথে তাঁর আলাপ হয়ে গেল। সে আজকাল তেলতেলে কণ্ঠে প্রয়োজন হলে হাসতে পারে। তবে খুব একটা চেষ্টা করার প্রয়োজন তাঁর হয় না। সে সুদর্শন। এটা সে আগে জানত না। এখন জানে। তাই এটা সে ব্যবহার করে। মেয়ে মানুষ যে প্রথম পদক্ষেপ কখনো নেয় না। এটাও সে জানে। তাই প্রথম পদক্ষেপ নেয়ার কাজটা আজকাল সেই করে। মাঝে মাঝে নতুন পুলকের সাথে পুরাতন পুলকের তুলনা করে সে। নাঃ!! তাঁর কোন লজ্জা হয় না। নীতি ফীতি সব বাজে কথা মনে হয় তাঁর। সবই অর্থহীন লাগে। এই অর্থহীন জগতে নীতির কোন জায়গা আদৌ আছে কি? এভাবেই প্রিয়াঙ্কার সাথে পরিচয়। সময় কাটানোর জন্য উদাসীন হাঁটাহাঁটি, সিগারেট খাওয়া আর কয়েক ঘণ্টা মেয়েদের অর্থহীন আলাপ শোনার চেয়ে ভালো কিছু হয় না।
কিন্তু এত কিছুর পরেও শূন্যতা ভরে না। হাহাকার দূর হয় না। খালি মনে হয় কি যেন নেই!!! কি যেন নেই!!! মেঘলা দিনটা আজকাল পুলকের সহ্যই হয় না। কি এক আজব মন খারাপ পেয়ে বসে পুলককে মেঘলা দিনে। সেই মন খারাপের উৎসস্থল যে রীতা এটা সে বুঝতে পারলেও মানতে চায় না। এইদিন সে শুধু হাঁটে অফিস এর পর। কারো সাথে দেখা করে না। কারো ফোন ধরে না। একটার পর একটা সিগারেট। আর হাঁটা। এখনো সিগারেটে অভ্যস্ত হতে পারেনি সে। খালি ধোঁয়া ছাড়ে। দুয়েক বার ভিতরে নিয়ে দেখেছে। দারুন জ্বলে।
পুলকের পরিবর্তন কেউ খুব একটা ধরতে পারে না। খালি তাঁর কিছুটা স্বাস্থ্যহানি ঘটেছে এটা চোখে পড়ে। মুখটা শুকনো থাকে। কিন্তু আজকাল যেন আরো বেশি হাসে সে। কথাও বেশি বলে। কোথাও বেশিক্ষন বসে থাকে না সে। অফিস এও আজকাল হেঁটে হেঁটে কাজ করে।
রীতার এসএমএস এ একটু চমকালেও খুব বেশী আলোড়িত হয়নি পুলক। হঠাৎ হয়তো পুলকের জন্য রীতার guilt হচ্ছে, খারাপ লাগছে। পুলকের তো রীতার উপর কোন রাগ নেই। মানুষের মন পরিবর্তন হয়। রীতারও হয়েছে। হতেই পারে। এতে সে রীতাকে দোষ কখনোই দেয় না। তবে এটা সে জানে এখন যে রীতা আছে, সে তাঁর রীতা নয়। সে কোথাও হারিয়ে গেছে। এইভাবে যদি কেউ হারিয়ে যায় তাঁকে কেউ কখনো ফিরে পায় না।
পুলক অপেক্ষা করছে কষ্টটার জন্য। একটা কষ্ট হওয়ার কথা। খুব কষ্ট। কষ্টটা হচ্ছে না। সে জানে কষ্টটা আছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকের মত কষ্টটা আসে। এই যে সেদিন তাঁর বসের বস বিবেক তাঁকে তাঁর রুমে ডাকলেন।
- কেমন আছ পুলক?
- জি স্যার। ভালো।
- আমি তোমার কাজে খুব খুশি।
পুলক হাসিমুখে বিবেকের দিকে তাকিয়ে রইল। এই লোকের মুখের কথার কোন দাম তাঁর কাছে নেই।
- পুলক সামনের বছর তোমাকে জার্মানিতে ট্রান্সফার করে দিব বছর দুয়েকের জন্যে। ওইখানের ব্রাঞ্চে তোমার মত কিছু লোক দরকার। তুমি মানসিকভাবে তৈরি থাক।
কথাটা শোনামাত্রই পুলকের বুকের ভিতর কি যেন একটা খামচে ধরল। তাঁকে বাইরে যেতে হবে!!! সে রীতাকে ছেড়ে কেমনে কই যাবে!!! তাঁর তখন মনে হলো না যে সে রীতাকে ছাড়াই ৬ মাস কাটিয়ে দিয়েছে। চোখটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। বিবেক তাঁর সামনে বসে জার্মানির অফিস এর কথা বলে যাচ্ছে। পুলক অনেক চেষ্টা করছে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করার।
রুম থেকে বের হয়ে সে অফিস এর বাইরে চলে গেল। গ্যারেজের যে দিকে অন্ধকার ওখানে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ল পুলক। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। বসা মাত্রই কি প্রবল বর্ষণে চোখ দিয়ে পানি পড়ল!! কেন কাঁদছে! কি হয়েছে! কিছুই বুঝতে পারল না পুলক। বুকের কোন জায়গা থেকে এত ব্যথা হচ্ছে কেঁদে কেঁদে হাজার হাতরিয়েও খুঁজে পায়নি সে।
সেদিনের কান্নার পর কষ্টটা আবার চলে যায়। কিন্তু জানান দিয়ে যায় সে আছে। এবং তাঁর তীব্রতা প্রবল। এই কষ্ট সে কিভাবে সামলাবে!!! একা কিভাবে সামলাবে যখন এটা পুরোপুরি আসবে!!!!
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ২২)
অফিসে পুলকের জার্মানি যাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছে। এখনো কিছুই ফাইনাল হয়নি। পুলকের মা পুলকের বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। ছেলে বাইরে চলে যাবে। বাইরে যাওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। পরে দেখা যাবে ক্যাথরিন ম্যাথ্রিন বিয়ে করে নিয়ে আসছে। তাঁর চেয়ে বিয়ে করায়ে রাখলে শান্তি। রীতা নামের মেয়েটার সাথে ছেলেটার ভালো সম্পর্ক ছিল। বিয়েটা হলে ভালোই হত। একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। বিয়ে হয়ে অশান্তি হওয়ার চেয়ে বিয়ের আগেই অশান্তি হয়ে গেছে। এটাকে আফরোজা শাপে বর হিসেবেই দেখেন।
পুলক বাইরে যেতে চাইছে না। না, রীতা কোন কারণ নয়।
খুব বেশীদিন চাইলেও মানুষ কষ্ট আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে না। কষ্টগুলোকে মনের এক কোণে ফেলে রাখতে হয়। এগিয়ে যেতে হয় জীবনে। কষ্টগুলো মনের কোণে পড়ে থাকে। জীবনের ব্যস্ততার মাঝে মাঝে মানুষ খেয়াল করে দেখে যে কষ্টগুলো ঠিকঠাকমত আছে কিনা!! কারণ এই কষ্টগুলোই তো তাঁর সঙ্গী। অনেক প্রিয় সঙ্গী।
পুলক বাইরে যেতে চাইছে না তাঁর মায়ের জন্য। তাঁর মায়ের বয়স হয়েছে। এই সময় মাকে ফেলে যাওয়াটা ঠিক মনে হচ্ছে না তাঁর। আর তাছাড়া তাঁর মায়ের সাথে যদি কোন সঙ্গী সাথী থাকত তাহলে একটা কথা ছিল। একা মাকে ফেলে কিভাবে যায়!! আর যেতেও যে খুব ইচ্ছা করছে তাও না। এখন আর ওইভাবে কেন জানি জীবনে কোন কিছু নিয়ে উৎসাহ উদ্দীপনা কাজ করে না। জীবন কেটে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে। যাক!! আর কী!!! বয়ে চলাই তো। অথচ ছাত্রজীবনে দুনিয়াটাকে কত রঙ্গীন মনে হত। আসলে তখন চোখে ছিল রঙ্গীন চশমা। এখন মনে হয় বাকি জীবনটা ঝামেলা ছাড়া কেটে গেলেই হয়। ব্যস!! যেমন চলছে চলতে থাকুক।
প্রিয়াঙ্কা কল দিচ্ছে। পুলক রিসিভ করলো না। মেয়েটা ইদানীং বেশ জ্বালাচ্ছে। আসলে মেয়েটার দোষ নেই। পুলকের আজকাল একই মানুষের সঙ্গ বেশীদিন ভাল লাগে না। আসলে অবচেতনভাবে এক ধরনের ভয় কাজ করে। আবার নতুন করে একজনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার মত বোকামি পুলকের অবচেতন মন পুলককে করতে দিতে চায় না। এই জন্যই পুলক খুব বেশীদিন কোনকিছু নিয়ে পড়ে থাকে না। সিগারেট খাওয়া আপাতত বাদ।
আরেকটা কারনেও জার্মানি যেতে চাচ্ছে না পুলক। আজকাল কোনকিছুতেই সেভাবে মনোযোগ দিতে পারছে না সে। মাঝে মাঝে মনে হয় চাকরীটা ছেড়ে দিতে। কিন্তু তা তো আর করা যায় না। এখনো এত অস্থির সে হয়নি।
প্রিয়াঙ্কার এসএমএস। ‘পুল!!! তুমি আমার ফোন ধরছ না কেন?’। পুলকের ভুরু কুঁচকে গেল। সে রিপ্লাই দিল না। এসএমএস এর লিস্টে এখনো রীতার এসএমএস টা আছে। “কেমন আছ পুলক?”। কিছুক্ষণ মোবাইলের স্ক্রীনটায় হাত বুলাল সে। ভালোই আছে রীতা। নিশ্চয়ই ভালো আছে।
আবার প্রিয়াঙ্কার কল।
-সরি প্রিয়াঙ্কা!! একটু ব্যস্ত ছিলাম। বল!!!
-তুমি কি আজকাল আমাকে এভয়েড করছ পুল?
-এটা কী ধরনের কোয়েসচেন!! Why should I avoid you?
- I don’t know but I am having this feeling that you are avoiding me.
-দেখ প্রিয়াঙ্কা!! এই ধরনের কথাবার্তায় আমি খুব বিরক্ত হই। আমার মনে হয় তুমি কিছু নিয়ে ডিসটারবড। আমরা বরং পরে কথা বলি।
-Sorry to disturb you.
প্রিয়াঙ্কা ফোন কেটে দিল।
নাঃ। এই জন্যই একটা মেয়ের সাথে বেশীদিন কথা বলা ঠিক না। এরা পেয়ে বসে। দম বন্ধ করা একটা পরিবেশ সৃষ্টি না করা পর্যন্ত শান্তি নেই। খুব রাগ হচ্ছে পুলকের। রাগ হলেই পুলকের রীতার কথা মনে পড়ে। একমাত্র রীতা পারত তাঁর রাগ ঠাণ্ডা করতে। শুধু রাগ না। খুব অপমান হলেও রীতার কথা তাঁর খুব মনে পড়ে।
অফিস থেকে বের হওয়ার সময় মা ফোন দিল।
-পুলক জলদি বাসায় আয়।
-কেন?
-আমার এক জায়গায় যেতে হবে। পাইকপাড়া। আমি চিনি না। তুই নিয়ে যাবি।
-ওখানে কে থাকে? কার বাসা?
-আছে। তুই চিনবি না। জলদি আয়।
-আচ্ছা।
আফরোজা আক্তার ছেলের জন্য মেয়ে দেখে রাখছে। একটা মেয়ে তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছে। মেয়েটা মাত্র অনার্স পড়া শুরু করেছে। ওই মেয়ের বাসায়ই যাবে। পুলককে আগে থেকে বললে পুলক জীবনেও যাবে না। ছোট মেয়ে বলেও খুব চিল্লা পাল্লা করবে। কিন্তু আফরোজা বউ হিসেবে কেন যেন ছোট মেয়েই খুঁজছেন। ছোট মেয়ে হলে তাঁর সাথে একটু থাকবে। চাকরিজীবী মেয়ে তো অনেক ব্যস্ত হয়। তাঁর সাথে কথা বলার সময়ই পাবে না। জীবনের এই শেষদিকে এসে মাঝে মাঝেই আফরোজা আক্তার এর খুব একা লাগে। মাঝে মাঝে খুব বিষণ্ণতা পেয়ে বসে। এতবড় জীবনটা কিভাবে শেষ হয়ে গেল। প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসাব করে ফেলেন মাঝে মাঝে মনে মনে। জীবন সায়াহ্নে এসে অপ্রাপ্তির ঝোলাটাকেই কেন যেন ভারী মনে হয়।
কলিং বেল বাজল। পুলক এসেছে। ছেলে বাসায় ফিরলেই তাঁর মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। প্রাপ্তির ঝোলার প্রায় অনেকটা অংশ জুড়ে তো শুধু ছেলেই।
মা ছেলে বের হয়ে গেল তড়িঘড়ি করে।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ২৩)
খুব জোরে দৌড়াচ্ছে পুলক। ভোরবেলার পার্ক। বয়স্ক থেকে মধ্য বয়স্ক নারী-পুরুষরা উদ্দীপনার সাথে হাঁটছে। পুলকের বয়সী কিছু মানুষদেরও দেখা যাচ্ছে। কেউ খুব জোরে হাঁটছে। কেউ বা দৌড়াচ্ছে। বেশ ভালো স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। পুলক সবাইকে পিছন ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। বেশীক্ষণ দম ধরে রাখতে পারছে না সে। তখন সে হাঁটছে। আবার দম নিয়ে দৌড়াচ্ছে। ইদানীং সকালে হাঁটতে বের হচ্ছে পুলক। জীবনটার মধ্যে যেন নেতিবাচকতা ভরে গেছে। কিছুটা ইতিবাচকতা না আনলে মরে যাওয়া উচিৎ। ধুঁকে ধুঁকে আর বেঁচে থাকতে ভালো লাগছে না পুলকের। তাই সকালের এই বের হওয়া।
অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর পুলক একটু বসল।
-anything wrong? (মেয়েলী কণ্ঠ)
পুলক হাঁপাতে হাঁপাতে পিছনে ঘুরে তাকাল। সকালের অনেক স্বাস্থ্যসচেতন নারীদের মধ্যে একজন।
পুলক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাল। মুখে কিছু বলল না।
-না আপনি কি রকম উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়াচ্ছিলেন। তাই জিজ্ঞেস করলাম।
পুলক নিজের মনে খুব হাসল। এরকম কতবার মনে মনে কল্পনা করত যে কোথাও বসে আছে আর একটা মেয়ে নিজে থেকে এসে কথা বলবে তাঁর সাথে। পুলকের পক্ষে আগ বাড়িয়ে কথা বলা সম্ভব ছিল না তখন। বাসে কোথাও একলা যাচ্ছে। মনে মনে ভাবতে ভালো লাগত যে আহা কোন মেয়ে যদি পাশের সীটে বসত!!! কিন্তু দেখা যেত পাশের সীটে মোটাসোটা কোন লোক বসত। আর আজকে একটা নিজে থেকে এই ভোরবেলায় তাঁকে জিজ্ঞেস করছে anything wrong!!! দারুণ!! এই ঘটনাই আরো কয়েক বছর আগে ঘটলে হয়ত এর রোমাঞ্চ অন্যরকম হত। এখন তেমন কিছু হচ্ছে না।
-নাহ! সব ঠিক আছে।
মেয়েটাও একটু দূরে বসল। পুলক আড়চোখে মেয়েটাকে একটু পরখ করে নিতে চাইল। ঢোলা ট্রাউজার। সাদা গেঞ্জি পড়া। উপরে ওড়নাও দেয়া আছে। ওই ওড়নাই হল মধ্যবিত্ততার প্রতীক। বয়স বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে তার সমান বা বড়ও হতে পারে।
মেয়েটা উঠে দাঁড়ালো। একটা বেশ সুঠাম শরীরের ছেলে এসে মেয়েটার পাশে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটা বেশ সপ্রতিভভাবে পুলককে বিদায় জানাল।
-আচ্ছা আসি।
পুলকও সৌজন্য হাসি ফেরত দিল। তাঁর মনটা অল্প খারাপ হয়ে গেছে। দুনিয়ার তাবৎ পুরুষের এই সময়ে মন খারাপ হয়। যখন আপাতদৃষ্টিতে একা থাকা মেয়েটা কোন পুরুষের সাথে চলে যায়। তাও সে পুরুষ যদি সুদর্শন হয়। নিজের মনের কথা নিজেই বুঝতে পেরে খুবই মজা লাগল তাঁর। রীতা থাকতে যে সে অন্য মেয়েদের দেখত না এমন না। কিন্তু তাঁদের পেতে ইচ্ছা তাঁর হত না। হয়তো তাঁদের সুন্দর শরীরটায় একটু চোখ বুলিয়ে নিত। রীতার সাথে সে এসব নিয়ে গল্পও করতে পারত। রীতা একটু পাগল কিসিমের ছিল। এসব বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনত। মজাও পেত। অন্য বন্ধুদের কাছে তো গল্প শুনত সে। ওঁদের বান্ধবীরা কিরকম দারোগা গোছের একেকজন। কোন মেয়ের কথা ওঁদের সামনে বলাই যেত না। বললেই শেষ। হিন্দুরা মরলে যেমন বলে ‘রাম নাম সত্য হে’। অন্য কোন মেয়ের নাম বান্ধবীর সামনে বলা মানে ব্যাকগ্রাউন্ড এ ‘রাম নাম সত্য হে’ বাজা স্টার্ট হয়ে যাওয়া।
হায়রে!!! আবার রীতা!! ধুর!! এর থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায়!!! পুলক আবার উঠে দাঁড়ালো। জোরে দৌড় দিতে হবে। এত জোরে যেন স্মৃতিগুলোও যেন পিছু নিতে না পারে। দেখাক তাঁকে উদ্ভ্রান্তের মত। সে তো উদ্ভ্রান্তই।
বাসায় ফিরে গোসল। নাস্তা। অফিস এর জন্য রেডি হওয়া। মা তাঁর সাথে কয়েকদিন ধরে কথা বলছে না। নাস্তার টেবিলে নাস্তা দেয়া থাকে। সে আসে না। পুলক তাও মায়ের ঘরে যায়। মা হু হাঁ করে উত্তর দেয়।
ওইদিন পুলককে না বলে মেয়ে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল আফরোজা আক্তার। মেয়েটাকে পুলকের সাথে কথা বলতে দিয়ে ওরা বেশ চালাকির সাথে বসার ঘরে এসে বসল। হঠাৎ করে মেয়ে দৌড় দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। কী হল!! আফরোজা দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করল।
-পুলক!! কি হয়েছে রে!!
-কই কিছু না তো!! ওঁর মনে হয় বাথরুম লেগেছে। তাই ওভাবে দৌড় দিল। বাচ্চা মেয়ে তো!! (পুলকের হাসি হাসি মুখ)
-ঠিক করে বল!!
-আরে!! আমি কী ভুল করে বলছি নাকি!! চল। চল। কালকে অফিস আছে আমার!
আফরোজা পরে শুনেছে মেয়ের মায়ের কাছ থেকে। পুলক মেয়েকে বলেছে ওঁর নাকি মাথার ঠিক নেই। যে কোন সময় ধরে যে কাউকে আছাড় দিতে পারে। বসায় নাকি মাকেও দুয়েক বার দিয়েছে। ব্যাথা বেশি লাগে না। এইসব কথা শুনে মেয়ে খুবই ভয় পেয়েছে। মেয়ে বলেছে সে মরে যাবে। তাও এই লোককে বিয়ে করবে না।
ঘটনাটার কথা মনে করলেই পুলকের হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যায়। সকালে অফিস এ গিয়ে সে এভাবেই হাসছিল। এক কলিগ ঢুকে ওকে জিজ্ঞেস করল।
-এভাবে পাগলের মতও হাসতেস কেন?
এই ধরনের হাসি হঠাৎ করে আটকানো খুবই কঠিন। সে অনেক চেষ্টা করে হাসি থামাল।
-না কিছু না।
তাঁর বলতে ইচ্ছা করছিল। ভাই!! আপনাকে একটা আছাড় দিলে কি আপনি খুব রাগ করবেন? ভাবতে ভাবতেই আবার হাসি শুরু হয়ে গেল। রক্ষা এই যে ততক্ষনে কলিগ বের হয়ে গেছে। নইলে তাঁকে পাগল টাগল ভাবত।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ২৪)
পুলক কেন তাঁকে এত অ্যাভয়েড করছে বুঝতে পারছে না প্রিয়াঙ্কা। সাথে সাথে এটাও বুঝতে পারছে না যে পুলক অ্যাভয়েড করাতে সে এত বোদারড-ই বা হচ্ছে কেন!! তাঁর পিছনে ছেলেদের লাইন লেগে থাকে। আর কোথাকার কোন পুলক!! এসব ভাবতে ভাবতেই প্রিয়াঙ্কার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সে নিজের মনে ভেবে যাচ্ছে, “ পুলকের মত ছেলেদের আমি আমার জুতাও পরিষ্কার করাই না। ওঁদের সেই যোগ্যতাও নাই। How dare he avoids me!!! Son of a bitch!!! ও কি মনে করসে! ওঁর জন্য আমি পাগল হয়ে গেসি। ওঁর মত ফালতু আন-কালচারড ছেলের জন্যে!! হাহ!! প্রিয়াঙ্কা এখনো রাস্তায় হেঁটে গেলে হাজার হাজার ছেলে জিহ্বা বের করে থাকবে।“
কিন্তু এ ধরনের রাগ শুধু অসহায়তা বাড়ায়। আর কিছু বাড়ায় না। অহংকারী মানুষেরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করে যে তাঁদের অহংকার যা এতদিন কত উপরে ছিল তা মুহূর্তের মধ্যেই কিভাবে মাটিতে মিশে যায়। কোন একজনের কাছে গিয়ে তা কিভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়।
রাগে গজ গজ করতে করতে প্রিয়াঙ্কা ঠিক করে সে পুলককে আর কখনো ফোন দিবে না। পুলক যদি ওর পা ধরেও বসে থাকে, তাহলেও সে তাঁকে কখনো forgive করবে না। এসব ভাবতে ভাবতে সে নিজেকে সাজায়। একমাত্র ঠিকমত সাজগোজ করলেই প্রিয়াঙ্কার মনটা ভালো হয়ে যায়। ভালো করে সে নিজেকে এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে দেখে। পুলকের শাড়ি পছন্দ। এখন একবার শাড়ি পড়ে ওঁর সাথে দেখা করে আসলে কেমন হয়? যদিও প্রিয়াঙ্কা শাড়ি পড়তে পারে না। শাড়ি খুবই ঝামেলার জিনিস। মা-কে আবার বলতে হবে শাড়ি পরায়ে দেয়ার জন্যে। এত্ত ঝামেলা কে করবে!! একটু আগেই প্রিয়াঙ্কা পুলকের সাথে জীবনে দেখা করবে না বলে ঠিক করেছে। কিন্তু সে একটু পরেই পুলককে ফোন দিল।
-হেল্লো
-হ্যালো!! কি খবর প্রিয়াঙ্কা?
-কি করছ পুল?
-এই তো!! কাজ কর্ম!! অফিসে যা করে আর কি!!
-হুম!! তুমি কখন ফ্রী আজকে পুল?
-আমি তো আজকে ফ্রী নেই প্রিয়াঙ্কা।
-কালকে?
-হুমমমমমমম!!!! আমি বরং sure হয়ে কালকে তোমাকে কল দেই? ওকে??
-থাক!! তোমার আমাকে কল দেয়া লাগবে না। আমিও তোমাকে আর কল দিব না।
প্রিয়াঙ্কা ফোন কেটে দিল।
ফোন রেখে প্রিয়াঙ্কা ফুঁসতে ফুঁসতে আবারো সিদ্ধান্ত নিল যে আর না!! যথেষ্ট হয়েছে। পুলক চ্যাপ্টার ক্লোজ।
পার্কে ভোরবেলায় সাধারণত মানুষ হাঁটাহাটি, ব্যায়াম আর মুক্ত বায়ু সেবন করতে বের হয়। এ সময় সাধারনত প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলদের দেখা যায় না। কিন্তু আজকে এক যুগল এসেছে। কোন এক কারণে তাঁদের মধ্যে কোন মতবিরোধ হয়েছে। এতে তাঁদের ঘিরে উৎসাহী লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। ভোরবেলার নিয়মিত দৌড়বিদেরা অবশ্য এই জটলাকে এড়িয়ে ঠিকই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। এরা প্রায় সবাই-ই চাকরিজীবী। রাস্তাঘাটের এসব সমস্যা দেখে তাঁদের লাভ নেই।
ইতি-ও এই জটলাটাকে এড়িয়ে সামনে দৌড়াতে লাগল। জীবনের একটা পর্যায়ে তাঁকে সবসময় ঝগড়াঝাঁটি নিয়ে থাকতে হয়েছে। তাই অন্যের ঝগড়াঝাঁটি তাঁকে আর আকর্ষণ করে না।
ওই দিনের সেই ছেলেটি বসে আছে আগের জায়গাতেই। কি রকম উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়াচ্ছিল ওইদিন ছেলেটি। পার্কে বহু মানুষ বহুভাবে দৌড়ায়। প্রথম প্রথম এসব দেখে মনে মনে হাসত ইতি। মানুষগুলোর এই কসরত হাসার মতই। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষগুলোর প্রাণান্তকর চেষ্টা দেখলে হাসিও লাগে, মায়াও লাগে। ইতিও প্রতিদিন এক রাউন্ড দৌড়ের পর ওখানে বসে। এ মনে হয় নতুন।
পুলক এক রাউন্ড দৌড় দিয়ে বসে একটু জিরোচ্ছিল। তাকিয়ে দেখল আগের দিন ‘anything wrong!!’ জিজ্ঞেস করা মেয়েটি আসছে। কাছাকাছি আসতেই পুলক মেয়েটিকে দেখে বলল, ‘হেলো!!’ মেয়েটি তাঁর দিকে তাকাল কিন্তু জবাব না দিয়ে দৌড়িয়ে চলে গেল। পুলক একটু বেকুব হয়ে বসে রইল। এটা কি ওইদিনের মেয়েটা না? হ্যাঁ, সেই মেয়েটাই তো।
এই সময় পুলকের ফোন আসল। এত সকালে কে ফোন দিল!!! মেয়েটার দৌড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে সে ফোন বের করল পকেট থেকে। প্রিয়াঙ্কার ফোন!!! এত সকালে!!! ও তো ঘুম থেকেই এত আগে উঠে না। ওঁর বাসা পার্কের কাছেই। পুলক ওকে বলেনি যে ওঁদের বাসার কাছেই পার্কে সে রোজ সকালে দৌড়াতে আসে। মেয়েটা আজকাল কেমন জানি বিরক্তিকর আচরণ করে।
-হেলো!!
-পুল!! (প্রিয়াঙ্কার গলা কাঁপা) আমি একটু তোমার সাথে দেখা করতে চাই।
-কি হয়েছে প্রিয়াঙ্কা?
-কিছু না। এমনিই। তুমি কোথায় এখন?
-আমি এই তো একটু পার্কে হাঁটতে আসছি।
- আমাদের বাসার কাছের পার্কে?
-হুম!
-ওকে!! আমি এখনই আসি?
-হুমম!! ওকে but don’t be late। অফিস যেতে হবে।
-ওকে!!
৫ মিনিটের মধ্যেই প্রিয়াঙ্কা চলে আসল। আলুথালু বেশে মেয়েটাকে এই প্রথম দেখল পুলক। একটু অগোছালোভাবে থাকলেও যে মেয়েদের দেখতে সুন্দর লাগে এটা মনে হয় অনেক মেয়েই জানে না। প্রিয়াঙ্কাও জানে বলে মনে হয় না। সময় পেলে এখনো পাঙ্কু সেজে আসত।
-এখন বল তো কী হইসে প্রিয়াঙ্কা? রাতে ঘুম হয় নাই নাকি?
-হুম! ঘুম হয় নাই।
-কেন? আমি তো জানি তোমার রাতের ঘুম কোনোভাবেই ডিস্টারবড হয় না।
-হ্যাঁ, এই কয়েকদিন ধরে হচ্ছে না।
-কারণ কী?
-আমি জানি না।
পুলক দেখল ওই দিনের ওই মেয়েটি আরেক রাউন্ড দিয়ে আসছে। ওঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। প্রিয়াঙ্কাকেও দেখল। পুলক হঠাৎ প্রিয়াঙ্কা সাথে থাকাতে খুব খুশি হয়ে উঠল। মনে মনে বলল, “হাহ!!! শুধু তুমিই হ্যান্ডসাম হাঙ্ক নিয়ে ঘুরতে পারবা!! আমিও সুন্দরী নিয়ে ঘুরতে পারি!!” আজকাল চ্যাটিং, ফেসবুক এ মানুষজন জিহ্বা বের করা emoticon দেয় ভেঙ্গানো বুঝানোর জন্যে। তাঁর ইচ্ছা করছে সেও মেয়েটিকে একটু জিহ্বা বের করে ভেঙ্গায়। কিন্তু সে তো আর বাচ্চা না। বড়দের দুনিয়ায় যা মন চায় তা করা যায় না। মুখোশ পড়ে থাকতে হয়।
-পুল!!!
পুলক আড়চোখে মেয়েটার দিকে চোখ রাখছিল। প্রিয়াঙ্কার ডাকে ফিরে তাকালো।
-হ্যাঁ, বল।
-I think I am in love।
-বাঃ!!! That’s really good। এই জন্য তুমি রাতে ঘুম টুম বাদ দিয়ে বসে আছ। ধুর!! এটা কিছু হল!!
পুলক আসলে একটু অবাক হয়েছে। প্রিয়াঙ্কার মত মেয়ের প্রেমে ছেলেরা পড়বে। কোন ছেলের প্রেমে ও পড়বে এটা ভাবা যায় না। আর ওঁর কাছে তো সবাই wanna be। LOVE যে ঠিক কাকে বলে তা এখন আর ঠিক বুঝতে পারে না পুলক। মাঝে মাঝে মনে হয় এসবই একটা লুকোচুরি খেলা। অনুভূতির লুকোচুরি খেলা। প্রেম তো আসলে মনেরই একটা খেলা। অদ্ভুত খেলা। শুধু কি খেলাই?
প্রিয়াঙ্কা কাউকে পছন্দ করেছে। এটা আসলে খুবই ভালো খবর। এখন ওঁর বিরক্তিকর আচরণ ওই ছেলে সহ্য করবে। এই উসিলায় দেখা করাও বন্ধ করে দিবে পুলক। কেন জানি আর এসব ভালো লাগছে না। অন্য কোন কিছু চেষ্টা করতে হবে নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য।
প্রিয়াঙ্কা অনেকক্ষণ চুপ করে আছে। পুলক খেয়াল করে জিজ্ঞেস করল।
- তো!!! Who is the lucky guy?
প্রিয়াঙ্কা পুলকের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দৃষ্টি নামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।
- YOU।
একই দিনে দ্বিতীয়বারের মত বেকুব হয়ে পুলক তাকিয়ে রইল।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ২৫)
‘ভালো লাগা’ আর ‘ভালোবাসা’ এই দুইটা জিনিস যে ঠিক এক না, এটা বুঝা খুব জটিল ব্যাপার। এছাড়া ‘ভালোবাসা’ বলে আসলে কিছু আছে কিনা!! তা অন্য আরেক তর্ক। আপাতত আমরা কথা বলছি ‘ভালো লাগা’ আর ‘ভালোবাসা’ নিয়ে। ইংরেজিতে ‘ভালো লাগা’-কে বলা হয় ‘Infatuation’। ‘ভালো লাগা’-র মধ্যে থাকে শুধু আকর্ষণ আর মুগ্ধতা। যা সম্পর্কের প্রাথমিক স্তরের পরও যদি টিকে থাকে এবং আরো দুএকটি বৈশিষ্ট্য যেমন ‘শ্রদ্ধাবোধ’ এবং ‘বোঝাপড়া’ যোগ হয়, তবেই আমরা তাঁকে ‘ভালোবাসা’ বলতে পারি। কিন্তু শুরুর দিকের অনুভূতি এত তীব্র থাকে যে ‘ভালো লাগা’ আর ‘ভালোবাসা’-র পার্থক্য ঠিক বোঝা যায় না। অনেকে আবার ‘অভ্যস্ততা’-কেও ‘ভালোবাসা’ বলে ভুল করে।
যাইহোক!! পুলক এখন আটকে আছে ‘ভালো লাগা’ আর ‘ভালোবাসা’ এর মাঝে।
সেইদিন প্রিয়াঙ্কার চলে যাওয়ার পরও পার্কে কিছুক্ষণ বসে ছিল পুলক। বসে বসে ভাবছে যে এটা আবার কী হল!! এরকম কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। তবে এটা খুব পাত্তা দেওয়ার মত ঘটনাও না। প্রিয়াঙ্কা বাচ্চা মেয়ে। ‘Calf love’ বলে একটা ব্যাপার আছে। যেটা এরকম বাচ্চাদের বেলায়-ই ঘটে। এরা প্রাথমিক আকর্ষণকে ‘ভালোবাসা’ বলে ধরে নেয়। এই আকর্ষণ বা মুগ্ধতা কেটে গেলেই আর পুলককে এই মেয়ের ভালো লাগবে না। পুলকের পক্ষেও এত দেমাগী মেয়ের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা কখনোই সম্ভব হবে না। আর তাছাড়াও, সেই জায়গাটা কি কাউকে দেয়া সম্ভব যেখানে রীতা ছিল!! আসলে ওই জায়গাটার কোন অস্তিত্বই ছিল না কখনো। ওটা ছিল একটা জাদু। জাদু সত্যি হয় না। তবে জাদুর রেশ থেকে যায়। যেমন পুলকের জীবনে ‘রীতা’ নামক জাদুর রেশ থেকে গেছে। কিন্তু তারপরেও কেন জানি পুলক ভাবে যে জাদুটা যদি সত্যি হত। ওইরকম সত্যি-ই যদি কেউ থাকে!!
এরকম আবোল তাবোল কত কী-ই না ভাবছিল পুলক। এই সময় সে শুনতে পেল-
-সরি!!
পুলক ফিরে তাকাল। ওই মেয়েটা যে একটু আগেই তাঁর ‘হেলো’ এর জবাব না দিয়েই চলে গিয়েছিল।
মেয়েটা বলল-
-আসলে আপনি যে আমাকে হেলো বলেছেন এটা আমি তখন ঠিক বুঝতে পারিনি। আপনাকে পাস করার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মনে হল যে আপনি হয়তো আমাকে হাই বা হেলো জাতীয় কিছু বলেছেন। পরের রাউন্ডে আপনি ব্যস্ত ছিলেন বলে আপনাকে আর ডিস্টার্ব করিনি। I hope you understand।
পুলক হাসল। বলল,
-ইটস ওকে!! আজকে যাই। অফিস এর দেরী হয়ে যাচ্ছে।
-চলুন। আমিও যাবো। একসাথে বের হই।
-আপনার নামটা?
-আমি ইতি
-আমি পুলক
-আমি একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীতে আছি।
-ও আচ্ছা।
রীতার কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। রীতার কোম্পানীও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর কাজ করে।
-কী নাম আপনার কোম্পানীর?
নাম বলল ইতি। নাহ!! মেলেনি।
পুলক নিজে কোথায় কাজ করে তাও বলল।
এভাবে তাঁরা ওইদিনের মত বিদায় নিল।
পরের কয়েকদিন পুলক হাঁটতে বের হয়নি। প্রিয়াঙ্কা খুব ফোন করেছে এই কয়দিন। পুলক মনে মনে খুব বিরক্ত হয়েছে। এই মেয়েকে তো সে কখনো কোন কথা দেয় নাই। পরক্ষনেই আবার তাঁর এও মনে হয় যে মনের উপর তো কারো জোর থাকে না। প্রিয়াঙ্কা তো নেহাতই বাচ্চা মেয়ে। ওঁর তো আরো থাকার কথা না। মন বড়ই অদ্ভুত। কিন্তু তাই বলে তো আর জোর করে কাউকে পছন্দ করা যায় না। ঠিকও না করা। আর পুলক এও জানে এই মেয়ে তাঁকে শেষ পর্যন্ত পছন্দ করবে না। কোন এক দিন এও তাঁকে ছেড়ে চলে যাবে। মুগ্ধতা শেষ হয়ে গেলে কেউ দাঁড়ায় না। তাই প্রিয়াঙ্কার ভালোর জন্যেই পুলককে খারাপ হতে হবে।
কয়েকদিন পর আবার যখন পার্কে গেল পুলক, ইতির সাথে দেখা হয়ে গেল। তাঁদের একসাথেই দৌড়াতে দেখা গেল। অনেক কথা-বার্তাও হল। জানা গেল ইতি পুলকের চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। রেগুলার দৌড়ানোর কারণে উনাকে দেখে বোঝা যায় না। ডিভোর্সি। পার্কের কাছেই তাঁর বাসা। একাই থাকেন।
‘একা’, ‘সুন্দরী’, ‘ডিভোর্সি’। শব্দগুলো যেন একটা আরেকটার সাথে জড়িত। নিতান্ত ভদ্র মানুষের মনেও শব্দগুলো অন্যরকম আলোড়ন তৈরি করবে। পুলকের মাথাতেও শব্দগুলো এসেছে। পুরুষ তো!! কিন্তু সে ওইভাবে পাত্তা দেয়নি। বরং ইতির সাথে কথা বলে তাঁর ভালোই লেগেছে। পুলকের নিজের মা একা হাতে ছেলেকে মানুষ করেছে। শুধু ছেলে মানুষ-ই না। আর দশটা পুরুষ মানুষের মত তাঁকে সবদিক সামলাতে হয়েছে। তাই একা মেয়েদের প্রতি অন্যরকম শ্রদ্ধা অনুভব করে পুলক ভিতর থেকে।
পুলক আর ইতির সম্পর্কটা শুধু পার্কে সীমাবদ্ধ থাকল না। দেখা গেল মাঝে মাঝে তাঁরা একসাথে রিক্সায় ঘুরছে অফিস এর পর। আবার কোথাও খাচ্ছে। এরকম।
প্রিয়াঙ্কা মাঝে মাঝে ফোন দেয়। কখনো ধরে পুলক। কখনো ধরে না। প্রিয়াঙ্কার কথা ইতিকে বলেছে পুলক। ইতির নিজেরও অনেক ছেলে বন্ধু। বন্ধুই। আর কিছু না। কেউ হয়তো ভার্সিটি এর বন্ধু। কেউ হয়তো অফিস এর কলিগ। এদের সাথে মাঝে মাঝেই ঘোরা হয় তাঁর। একা জীবনটার যে ফাঁকা অংশ তা এভাবেই ভরাট করে নেয় ইতি। আর বিয়ে করবে না সে। বিয়ে তাঁর জন্য না। যদিও পুলককে সে তাঁর বিয়ে না টিকার কোন কেচ্ছা-কাহিনী বলেনি। এসব নিয়ে কথা বলা ইতির রুচিতে বাঁধে। আর পুলকও এমন লোক নয় যে সে এসব নিয়ে প্রশ্ন করবে। প্রত্যেক মানুষেরই নিজের নিজের কথা থাকবে। যা তাঁর নিজের একান্ত কথা। জরুরী নয় যে সব কথা সবাইকে বলতে হবে। পুলক যেমন রীতার কথা কাউকে বলে না। এটা মানুষকে বলার মত কোন কথা বলেও মনে হয় না তাঁর।
প্রাথমিকভাবে এ ধরনের সম্পর্ক নিয়ে কোন পক্ষই দুশ্চিন্তা করে না। মেয়েরা তো সমবয়সী ছেলেদেরকেই বাচ্চা হিসেবে ভাবে। আর ছোটদের তো গোনাতেই ধরে না। আর একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর ছেলেরাও এ ধরনের সম্পর্ককে স্বাভাবিকভাবে নেয়ার চেষ্টা করে। বেশ একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
কিন্তু সমস্যা হল, এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলো শেষমেশ শুধু বন্ধুত্বে থাকে না। একটা জটিলতার দিকে মোড় নেয়। সবার আগে বন্ধুত্বের সীমানাটা অতিক্রম করতে চায় ছেলেরা। এবং তাঁরা অপর পক্ষকেও বাধ্য করে সীমানা অতিক্রম করার জন্যে। কোন মেয়ে রাজি হয়। কোন মেয়ে হয় না। মেয়েদের জন্য ব্যাপারটা বেশ একটু বিড়ম্বনার। পুরুষ জাতির মত হরদম প্রেমে পড়ার অভ্যাস সাধারণ মেয়েদের থাকে না। এরা বন্ধু থাকতেই ভালোবাসে। কিন্তু পুরুষ জাতি তাঁর চরিত্রের তীব্র অধিকারবোধ থেকে নারীকে নিজের বলে মনে করতে চায়। দেখা যায়!! একটি মেয়ের সাধারণ কথাবার্তাতেই ৫-৬টি পুরুষ হৃদয় অকারণ বিগলিত হয়ে যায়। এতে ঠিক কাউকে দোষারোপ করা যায় না। প্রাকৃতিকভাবেই নারী জাতির নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা বেশি পুরুষের চেয়ে।
এইসব তাত্ত্বিক ব্যাপার পুলক ভালোই জানে। এসব ব্যাপার সে বহুভাবে চিন্তা করে। বিচার বিশ্লেষণ করে। তাই নিজেকে সে আর দশটা পুরুষের মত ভাবে না। এটা তাঁর একটা অহংকারের জায়গা। লুক্কায়িত অহংকার। কিন্তু খুব জলদি-ই তাঁর এই লুক্কায়িত অহংকার লুক্কায়িত ভাবেই ভূলুণ্ঠিত হল। কেউ জানল না সে নিজে ছাড়া।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ২৬)
বিয়ে বিয়ে করে মাথাটা নষ্ট করে দিচ্ছে মা। আফরোজা অস্থির হয়ে গেছেন ছেলেকে বিয়ে দিতে। বুড়ো হয়ে গেলে এই ছেলের জন্য কোন মেয়ে পাওয়া যাবে না। অথচ ছেলে বলছে সে আরো একটু সময় চায়। এত সময়ের কী দরকার তিনি বুঝতে পারছেন না। যেই বয়সে যেই কাজ করা উচিৎ!! এখন পুলকের উচিৎ বিয়ে করা। ভালো চাকরী করছে। বাইরেও যেতে হতে পারে সামনের বছর। আচ্ছা!! তাঁর পছন্দমত না করুক বিয়ে। নিজে পছন্দ করে আনুক। এক রীতা চলে গেছে বলে কি দুনিয়াতে আর মেয়ে নেই? বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করবে না। আচ্ছা!! করিস না!! বিয়ে তো করবি!! আগের বার মেয়েটাকে কী ভয়টাই না পাওয়াল। রাগ করে বহুদিন ছেলের সাথে কথা বলেননি তিনি। কিন্তু রাগ করে তো মনে হচ্ছে লাভ নেই। বিয়ের নাম মুখে আনে না পুলক। এখন আফরোজার বয়স হয়েছে। মন নরম হয়েছে অনেক। মৃত্যুভয়ও দানা বেঁধেছে। এত আদরের ছেলের বিয়েটা দেখে যেতে পারবেন না? কপালে থাকলে হয়তো নাতি-নাতনীর মুখটাও দেখা যেত। কিন্তু তাঁর জন্য তো বিয়ে করা লাগবে।
অফিস থেকে বাসায় ফিরেছে পুলক। বাসায় ফেরার পর ওঁর ব্যবহারেই বোঝা যায় ছেলের মেজাজ মর্জি কেমন!! ছেলেটা বাবার মত মেজাজী হয়েছে কিন্তু কোথাও যেন সে বাবার মত না। অন্তত আফরোজা চেষ্টা করেছেন ছেলেকে অন্যরকমভাবে গড়ে তুলতে। ‘মা!! মা!!’। হুম!! ছেলের মেজাজ ভালো। এখন এসে অকারণ তাঁকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করবে, “কেমন আছো মা? মা!!! কেমন আছো?? হ্যাঁ!! হ্যাঁ!!”এসব হচ্ছে মুড ভালো থাকার পাগলামি।
ঠিকই পুলক ঘরে ঢুকল। আফরোজার পাশে এসে বসল।
-কেমন আছ মা? হ্যাঁ, কেমন আছ?
বলতে বলতে আফরোজার পিঠে হাল্কা থাপ্পড় দিতে লাগল। আদরের থাপ্পড় আর কি!! এরকমই হয় পুলকের মন মেজাজ ভালো থাকলে। সেদিন পাড়ার সবাই তাঁর গলার গান শুনে ফেলে। সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গোসল করতে করতে গান গায়।
গোসল শেষ পুলকের। মা ছেলে খেতে বসেছে। আফরোজা কথা তুললেন।
-তুই কি বিয়ে করবি না পুলক?
-কেন করব না মা? অবশ্যই করবো। (খুবই উৎফুল্লভাবে বলল পুলক)
-কবে করবি? আমি মরলে?
-তুমি মরলে যদি বিয়ে করি তাহলে অনেক দিক দিয়ে সুবিধা।
-কী? কি সুবিধা?
-রাগো কেন মা? লজিকালি চিন্তা কর। এখন যদি আমি বিয়ে করি। নতুন বউ আসবে। স্বাভাবিকভাবেই আমার নতুন বউকেই বেশি ভালো লাগবে। ওঁর আশেপাশেই ঘুর ঘুর করব। তোমার খোঁজখবর নেয়া কমে যাবে। তুমি আবার এতে মনে দুঃখ পাবা। আমাকে কিছু বলতেও পারবা না। কারণ তুমিও অনেক যুক্তিবাদী নারী। আবার ধর আমি খুবই আদর্শ ছেলে। বিয়ের পরেও পরিবর্তন হইল না আমার। এতে আবার তোমার নতুন বউমার অসুবিধা হল। তখন? আমি তো স্যান্ডুইচ!! এত ঝামেলা করার চেয়ে এখনি কি সব ভালো আছে না?
-তুই বেশী কথা বলস!!!
-আরে মা!!! সিরিয়াসলি!! আজকাল চারপাশে বিয়ে করে সুখী আমি কাউকে দেখি না। আমাদের অফিস এর এক আপু। সে ঝাল ছাড়া খেতে পারে না বলে জামাইকে বলসে মাংস ধুয়ে ধুয়ে খেতে। ব্যাটা খাইতেসেও!!! চিন্তা করতে পার!!
আফরোজা উঠে যাওয়ার ভঙ্গি করতেই পুলক বলল,
-যাইও না মা!! আরেকটা আসে। আরেকটা আসে!! এইটা মজার!! শুনো!! মেয়েদের!! হ্যাঁ!! মেয়েদের কিন্তু আবার অনেক কোড ল্যাঙ্গুয়েজ থাকে। ওগুলা না বুঝলে ওরা স্বামীদের পাশ নাম্বার দেয় না। ধর! রাত তিনটায় বউ ঘুম থেকে ডেকে বলল আমার ভালো লাগতেসে না। এই ‘ভালো লাগতেসে না’ কথা থেকেই তোমাকে বুঝে নিতে হবে যে তোমার বউ ছাদে গিয়ে চন্দ্র তারা দেখিতে চায়। বা ও এই রাত্র তিনটায় ঢাকা শহর ঘুরিয়া দেখিতে চায়। এই কথা তোমাকে অবশ্যই তাহাদের পেটের ভিতরে গিয়ে উদ্ধার করিতে হইবে। আর মা!!! আমি এমনিতেই সোজা ল্যাঙ্গুয়েজই বুঝি না। কোড কেমনে বুঝব বল!!! তুমি জেনে শুনে আমার এরকম সর্বনাশ করতে চাও!!
পুলক মায়ের দিকে শয়তানি দৃষ্টিতে তাকাল।
আফরোজা চরম বিরক্ত হয়ে উঠে চলে গেল। পুলক খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল।
এক এক দিন এরকম পাগলামিতেই দিন যায় পুলকের। তাছাড়া আজকের দিনটা তাঁর ভালই গিয়েছে। অফিস থেকে বের হয়ে ইতি-কে কল দিল। ইতি আর সে মিলে রিক্সায় সারা বিকাল ঘুরল।
সন্ধ্যার সময়টা একটু কেমন যেন!! মন খারাপ করে দেওয়ার মত ভালো লাগা আচ্ছন্ন করে মানুষকে। কারণ একমাত্র মানুষ-ই পারে মন খারাপকেও উপভোগ করতে। এই সন্ধ্যার মুহূর্তটাতেই মানুষ খানিক সময়ের জন্যে ইহ জগতের ছোট খাটো ব্যাপারকে তুচ্ছ করতে পারে। বর্ষার সময়েও এরকম অনুভূতি হয়।
রিক্সা চলছিল। পুলক আর ইতি সূর্য ডোবার সময়টাতে চুপ করে ছিল। কেউ কোন কথা বলেনি। মনের কোণে পড়ে থাকা দুঃখ নিয়ে মনে হয় একটু নাড়াচাড়া করে নিচ্ছিল যে যার মত।
ছোটবেলা থেকেই ইতি খুব প্রানবন্ত। উচ্ছল। ছেলেরা তাঁকে আলাদা গুরুত্ব দিত। খুব সহজেই ছেলেদের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব হয়ে যেত। কিন্তু কেন জানি ছেলেগুলো শুধু বন্ধু থাকতে চাইত না। একটু বড় হওয়ার পর বিরক্ত হয়ে ছেলেদের সাথে মিশা বন্ধ করে দিয়েছিল সে। এরপর অনেকদিন পর আসফাক এর সাথে পরিচয় হল। কেন জানি ওকে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু করতে মন চাইল। এরপর তারা বিয়ে করল।
মানুষ সাধারণত যখন মনের দিক থেকে, নিজের অস্তিত্বের কাছে নিরাপদ থাকে তখন সাবধান কম থাকে। ইতি আসফাকের সাথে সুখী ছিল। তাই বোধহয় অসাবধানও ছিল। আসফাকের অনেক বন্ধু ছিল। ছেলে মেয়ে দুই দলেরই। এতে ইতির কোন সমস্যা ছিল না। বরং আসফাকের সব বন্ধুই ইতিরও বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। সব বন্ধুরাই ঠিক ছিল। শুধু রানা ছাড়া। রানা দেখতে সুদর্শন ছিল। সম্ভবত আসফাক রানাকে এই জন্যই আগে থেকেই কম পছন্দ করত। রানা এমনিতেও একটু গায়ে পড়া ছিল। কিন্তু আসফাকের রানাকে অপছন্দ করা, রানার গায়ে পড়া ভাবের পেছনে অন্য উদ্দেশ্য এসব কিছুই জানত না ইতি। আর ইতিও ভুলে গিয়েছিল যে কিছু একটা সমস্যা হয় ছেলেদের তাঁর সাথে মিশলে। এরা স্বাভাবিক থাকতে পারে না। হয়তো নিজের অজান্তে ইতি নিজেই কোন সংকেত দেয়। আজো ধরতে পারেনি ইতি কী সে সংকেত। শেষমেশ রানাকে নিয়েই তাঁকে সন্দেহ করল আসফাক। শুধুমাত্র ইতিকে হারানোর জন্য সে অন্য আরেকটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়াল। ফলাফল ডিভোর্স। দুই বছরও টিকল না বিয়েটা। এরপর থেকে যেন নিজেকে নিয়ে গবেষণা করছে ইতি। অনেক পুরানো বন্ধুদের সাথে মিশছে সে। নতুন বন্ধু বানাচ্ছে। বেশিরভাগই ছেলে। সে জানতে চায় যে সে কী এমন করে যাতে করে এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
কোন একদিন কোন এক দুর্বল মুহূর্তে পুলককে সে তাঁর এই জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে বলেছে। পুলক তাঁকে আশ্বস্ত করেছে যে সে তাঁকে এ ব্যাপারে খুবই সাহায্য করবে। এবং এ নিশ্চয়তাও দিয়েছে যে সে ইতির প্রেমে পড়বে না। আর পড়লেও বলবে না। তারা দুজনেই খুব হেসেছে এইসব কথা বলতে গিয়ে।
মজার কথা হচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যেই ইতির গবেষণার ফলাফল পুলক বের করে ফেলল। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। ইতি খুব করে পুলককে বলেছিল যে একদিন বৃষ্টিতে ভিজবে। ইতির মধ্যে এ ধরনের ছেলেমানুষি রোমান্টিকতা ভরা। রিক্সাতে অকারণ ঘোরা। চা খেতে খেতে হাঁটা যাতে করে চা ছলকে পড়ে। গভীর রাতে ঘুরতে বের হওয়া(যা সে এখনো করতে পারেনি)। বৃষ্টির দিনে যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন!! ভেজা। মেয়ে মানুষ একা একা ভিজলে সারা দুনিয়ার লোক ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে শরীরের সব ভাঁজ দেখে ফেলতে চায়। শরীরটা কেমন রি রি করে ওঠে ইতির। সাথে কেউ থাকলে অতটা মনে হয় না।
এরকমই এক বৃষ্টির দিনে পুলক আর ইতি ভিজতে বের হল। পুলকেরও বৃষ্টি খারাপ লাগে না। কিন্তু সে স্বাভাবিক মানুষের মত আচরণ করতে পারে। মনে মনে বৃষ্টির আমেজ উপভোগ করতে পারে। কিন্তু ইতি যেন নিজেই বৃষ্টি। এই হাসছে। এই একটু মৃদু দৌড়াচ্ছে। আবার সিনেমার নায়িকাদের মত দুই হাত ছড়িয়ে দিচ্ছে যেন বৃষ্টিকে আলাদা করে ছোঁবে। পুলক মুগ্ধ দৃষ্টিতে ইতিকে দেখছে। এবং তক্ষুনি পুলক বুঝতে পারল কেন ছেলেরা ইতিকে শুধু বন্ধু ভাবতে পারে না।
হঠাৎ করে পুলকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। রীতার খুব ইচ্ছা ছিল পুলকের সাথে বৃষ্টি-তে ভিজবে। তা আর হয়নি।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ২৭)
বিপরীত লিঙ্গের কারো প্রতি কেউ আকর্ষিত হলে সেই আকর্ষণের মাত্রা খুবই তীব্র হয়। সেখানে ‘ভালো লাগা’ আর ‘ভালোবাসা’-র তর্ক মুখ্য থাকে না। সেই তীব্রতা থেকে দূরে সরা মানে হচ্ছে স্রোতের বিপরীতে যাওয়া। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে যাওয়া সব সময়ই কঠিন।
এরকমই কাঠিন্যের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে পুলক। বৃষ্টিতে ভেজার পর থেকেই ইতি-কে সে না চাইতেও অন্যভাবে দেখা শুরু করেছে। যেটা তাঁর কাছে খুবই বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। সে এত দুর্বল!! ইতি-র অফিসটা তাঁকে চুম্বকের মত টানে। না চাইতেও সে দেখে সে ইতি-র অফিস এর কাছে চলে গেছে। কোন এসএমএস আসলে সব সময় অবচেতনভাবে আশা করে যে এটা যেন ইতির মেসেজ হয়। কী হাস্যকর!!! ফোন আসলে এমনভাবে লাফ দেয় যে বিশ্বে কোন মহা ক্রাইসিস লেগে গিয়েছে। এখন ফোনটা না ধরলেই না। কিন্তু যেই দেখে ইতি-র ফোন না। সুবিশাল হতাশা।
এই পৃথিবীতে সব মানুষ-ই এক। মানুষের মন, চিন্তা-ভাবনা। সব প্রায় একই রকমভাবে কাজ করে। কিন্তু তারপরও কোন মানুষই নিজেকে ‘এক’ ভাবতে পছন্দ করে না। স্বাভাবিকভাবেই পুলকও তা করত না। কিন্তু এখন সে দেখছে যে সে আর সব পুরুষের মতই। সাধারণভাবে কোন মেয়ে তাঁর সাথে মিশলেই সে প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। ছিঃ!!! এত সস্তা তাঁর অনুভূতি!!
নিজের উপর খুবই বিরক্ত হল সে। সে জানে এটা কোন প্রেম বা ভালোবাসা নয়। এটা সাময়িক আকর্ষণ। কিন্তু এই আকর্ষণ কেন হচ্ছে!! প্রিয়াঙ্কার বেলায় তো তা হয়নি। ইতি-র বেলায় কেন? ইতি নিজেও অবশ্য তা জানতে চায়। এর উত্তরও বের করেছে পুলক। তেমন কোন জটিল বিষয় না এটা। স্বাভাবিকভাবেই মজার মানুষদের প্রতি মানুষের আকর্ষণ হবেই। যেসব মেয়ে সাজগোজ আর শপিং ছাড়া কিছু বোঝে না তাঁদের চেয়ে যেসব মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসে, তাঁদের আকর্ষণী শক্তি অনেক। বয়োসন্ধি কালের মেয়েরা বোহেমিয়ান ছেলেদের প্রতি আকর্ষিত হয়। যে ছেলে যত অগোছাল, যত বাউন্ডুলে তাঁর তত আকর্ষণ। আর ছেলেদের বেলায়, যেসব মেয়ে যত মজা করতে পারে তাঁর আকর্ষণ তত বেশি। যে মেয়ে চিন্তা-ভাবনা না করে ধুরুম ধারুম কথা বলতে পারে। ছেলেদের সাথে ছেলেদের মত করে মিশতে পারে। সেই মেয়ের খুব বেশী রূপসী হওয়ার দরকার নেই। তাঁর প্রেমে বহু ছেলে লুটোপুটি খাবে।
কিন্তু নিজেকে তো পুলক আর সব ছেলের মত ভাবত না। এই নিয়ে তাঁর কত গর্ব ছিল!!
অফিস এর প্রায় শেষ সময়। ইতি ফোন দিচ্ছে। পুলক তাকিয়ে আছে স্ক্রীন এর দিকে। তাঁর খুব ইচ্ছা করছে ফোনটা ধরতে। কিন্তু সে ধরল না। ইতি এসএমএস করল, “কি! খুব ব্যস্ত? ভাবসিলাম আজকে রিক্সায় ঘুরব অনেকক্ষণ। ফ্রী হলে জানাইও”।
পুলকের খুব ইচ্ছা করছে ইতির সাথে রাতে ঘুরতে। হঠাৎ কোথাও দাঁড়িয়ে পড়ে চা খেতে। ওলটপালট গল্প করতে। কিন্তু এতে সে নিজেরই ক্ষতি করবে। কী দরকার!! কষ্টকে ডেকে আনার। সে ইতিকে ‘না’ করে দিল।
অফিস থেকে বের হয়ে খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগল। এখনো ইচ্ছা করছে ইতি-কে একটা ফোন দিতে। এখনো ফোন দিলে এই রাতটা আর ফাঁকা ফাঁকা লাগবে না। আর তো কেউ নেই। কেউ অপেক্ষা করে নেই তাঁর জন্য।
এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে যার সাথে নিরুপদ্রবভাবে এই ফাঁকা সময়টা কাটানো যায়। কোনরকম জটিলতা ছাড়াই।
পুলক ফোন দিল কাউকে।
-হ্যালো!! এখন দেখা করতে পারবা? আমি তোমার বাসার সামনে।
একটু পর পুলকের সামনে এসে দাঁড়ালো প্রিয়াঙ্কা। এই মেয়েই পারে ফাঁকা অংশটা ফাঁকি দিয়ে ভরতে। আর তো কারো কাছে যেতে পারে না পুলক। নতুন করে কারো প্রতি দুর্বল সে হতে চায় না।
এভাবে এক সপ্তাহ সে ইতির থেকে দূরে দূরে থাকল। না, প্রিয়াঙ্কাকে আর ডাকেনি। আরেকটা মেয়ের আবেগ নিয়ে খেলা হবে এরকম করলে। ওই রাতের পর প্রিয়াঙ্কাকে আর সে ফোন করেনি। প্রিয়াঙ্কা আজকাল ফোন করে না। তবে সে ফোন করলে খুব খুশি হয়। মেয়েটা একটু চুপচাপ হয়ে গেছে। পুলকের মনটা খারাপ হয়েছে ওইদিন ওকে দেখে। তাই আর ওকে কল করেনি। আর করবেও না। পুলক নামের কেউ ছিল ওঁর জীবনে ভুলে যাক ও। ওঁর মত করে ও যেন ভালো থাকে।
এই এক সপ্তাহ দূরে থাকার ফল পেয়েছে পুলক। ইতির প্রতি তাঁর অনুভূতিটা যে শুধু ‘ভালো লাগা’-ই ছিল তা প্রমাণ হয়ে গেছে। এখন আর অতটা টান সে অনুভব করে না। কিন্তু তারপরেও ইতির সাথে সময় কাটানোর কথা সে ভুলতে পারে না। আর যাই হোক!! সময় সে খুব ভালো কাটিয়েছে। ইতি অনেক মজার মানুষ।
কাকতালীয়ভাবে যখন ইতির কথা ভাবছিল পুলক তখনই ইতি ফোন দিল।
-কি পুলক? তোমার দেখি কোন খোঁজখবর নাই।
-তা তোমার কী খবর?
-থাক!! এখন আর আমার খবর নেয়া লাগবে না। আমি তোমাকে ফোন দিলাম ইনভাইট করার জন্যে।
-কীসের ইনভাইটেশন?
-আমাদের অফিসে একটা পার্টি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। তোমাদের কোম্পানীকেও ইনভাইট করা হচ্ছে আমাদের প্রস্পেক্টিভ ক্লায়েন্ট হিসেবে।
-তাই নাকি? তাহলে তো অবশ্যই আসব। কিন্তু এভাবে তো হবে না। অফিসিয়াল ইনভাইটেশন যেহেতু!! লেটার কই?
-আরে!! লেটার আসবে। তুমি তোমার বসদের ইনফরম করে রাখো।
-ওকে।
-হুম্ম। সি ইউ!!
অবশেষে পুলককে একাই যেতে হলো ইতিদের কোম্পানীর পার্টিতে। বসরা সবাই বিজি। পুলককেই অ্যাটেন্ড করতে বলল।
বিশাল আয়োজন। অনেক লোকের সমাগম। কাউকেই চেনে না পুলক। সেও আসতে চায়নি। তাঁর বস তাঁকে বলল
-পুলক!! এসব অনুষ্ঠানে আমাদের কোম্পানীর একজন রিপ্রেসেন্টেটিভ থাকা প্রয়োজন।
এ জন্যই পুলকের আসা। বুফে সিস্টেমে খাওয়া দাওয়া চলছে। অনেক সাদা চামড়ার লোকজন দেখা যাচ্ছে। তবে এমনিতে পুরো অনুষ্ঠানে ছোট ছোট ছেলে মেয়ের ছড়াছড়ি। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী তো!!! অনেক দূরে ইতিকে দেখা যাচ্ছে। পুলককে দেখতে পেয়েছে ইতি। দূর থেকে হাত দিয়ে ইশারা করছে যে সে আসছে। নীল রঙ্গের স্লিভলেস ব্লাউজ এর সাথে ম্যাচ করা নীল শাড়ি। ইতির দিক থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। পুলক মুগ্ধ দৃষ্টিতে ইতিকে দেখছে। চুল টান টান করে পিছনে খোঁপা করে বাঁধা।
-কখন এসেছ?
-১০ মিনিট!!
-হুমম!! তোমাকে তো আজকাল পাওয়াই যায় না। এত ব্যস্ত থাক।
পুলক হাসে। কিছু বলে না।
ইতি পুলককে খাওয়ার জায়গায় নিয়ে যায়। লাইন এ দাঁড়িয়ে সবাই খাবার নিচ্ছে। পুলককে লাইনে দাঁড় করিয়ে ইতি অন্য গেস্টদের কাছে যায়। পুলক আস্তে আস্তে করে এগোচ্ছে। পাশের লাইনের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেল পুলকের। রীতা। একটা লম্বা করে ছেলের সাথে গল্প করে করে খাবার নিচ্ছে। হঠাৎ রীতা টাল সামালতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিল। ছেলেটা তাঁকে ধরল। রীতা হাসছে।
পুলক যেন স্ট্যাচু হয়ে গেছে। পিছন থেকে মানুষজন তাঁকে সামনে যেতে বলছে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পুলক লাইন থেকে বের হয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে সে প্লেটটা রেখে অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে গেল।
সুট টাই পড়েছিল পুলক। সব যেন গলায় ফাঁস হয়ে দাঁড়ালো। টাই ঢিলা করে উপরের বোতামটা খুলে ফেলল সে। নিচে নিচে আরো কয়েকটা বোতাম খুলল। হাঁসফাঁস লাগছে। বুকে হাত বুলাচ্ছে পুলক। বুকের ভিতরের কোন অংশটায় যে কিছু একটা খামচে ধরেছে বুঝতে পারছে না সে।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ২৮)
আকাশ কালো করে আছে। খুব কালো। মনে হচ্ছে ঝুম একটা বৃষ্টি হবে। এরকম আবহাওয়া খুব ঝামেলা সৃষ্টি করে। মানুষ যা প্রাণপণে ভুলে থাকতে চায় তা মনে করিয়ে দেয় এরকম কালো করে থাকা আকাশ। নিজের সাথে সাথে যেন সে বাকি সবাইকেও কাঁদাতে চায়। তাও মানুষ কাঁদে না। বিষণ্ণ হয়। যেমন রীতার মনটা এই কালো করে আকাশটা দেখে বিষণ্ণ হয়ে গেল।
যতক্ষণ অফিস করে কোন অসুবিধা হয় না। অফিস থেকে বের হলেই মনটা যেন একটু ভার ভার ঠেকে। সেটাকেও না হয় পাত্তা না দিয়ে থাকা যায়। কিন্তু এরকম কালো করে আসা আকাশকে ঠিক কীভাবে অগ্রাহ্য করা যায় তা জানে না রীতা।
রীতা তাঁর জীবনটায় কোন ফাঁকা জায়গা রাখতে চায়নি। সবসময় যেন কিছু না কিছুতে ব্যস্ত থাকা যায়। যেন কখনো নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে না হয়। কখনো যেন ভুলেও নিজেকে প্রশ্ন না করে ফেলে, “কেমন আছ রীতা?” এই প্রশ্নকে সে ভয় পায়। মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তরটা তাঁকে ভোগাবে। সে ভুগতে চায় না। সে পালাতে চায়। কিন্তু নিজের থেকে পালানো কি এতই সোজা? সোজা না। বরং বলা যায়। অসম্ভব। তারপরো দৌড়াতে থাকে রীতা। এই দৌড়ে তাঁর অফিস তাঁকে অনেক সাহায্য করে।
রীতার অফিসটা বেশ মজার। একই বয়সের অনেক লোক। অনেকগুলা গ্রুপ করা আছে। রীতার গ্রুপে লায়লা, রিয়ন, রাইয়ান আর তানিহা। এক এক গ্রুপের এক এক আসাইনমেন্ট। যার যার কাজের জন্য বাজেট জমা দিতে হয়। বাজেট এর মধ্যে করে যদি টাকা বাঁচে তাহলে সে টাকায় ধুমসে খাওয়া দাওয়া হয়। এক এক কাজের পর এক এক জায়গায় তারা খেতে যায়। খুব হাসে রীতা। যেন অনেক হাসলে ভিতরের যে আরেক রীতা থাকে সেও খুশি হয়ে যাবে। কত ছবি ওঠে তাঁর। তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ছবি ট্যাগ হতে হতে ভরে গেছে। সবগুলো ছবিতে তাঁর মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত থাকে।
গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। তখন সে পুলককে খোঁজে। ফেসবুকে। কোথাও পায় না। পুলক তাঁকে ব্লক করে দিয়েছে। তারপরো খোঁজে। কেন যে খোঁজে তা নিজেও জানে না রীতা। এই মানুষটাকে ভুলে যেতে পারলেই সবদিক থেকে শান্তি।
কিন্তু কিভাবে ভুলবে রীতা!! তাঁর জীবনের প্রত্যেকটা পরতে পরতে পুলকের কোন ছোঁয়া আছে। তাঁর প্রথম প্রেমিক পুলক। তাঁর একমাত্র আত্মার বন্ধু পুলক। তাঁর সব দুঃখ কষ্টের একমাত্র যে সাক্ষী সে পুলক। কিন্তু তারপরো সে পুলককে অপমান করেছে। দূরে ঠেলে দিয়েছে। প্রতিটা রাতে তাঁর এই কথা মনে হয়। বুকটা গ্লানিতে ভেঙ্গে যায়। কেউ জানবে না এই কষ্ট। পুলকও না। যে পুলক তাঁকে এত বুঝে সেও জানবে না যে এই রাত তাঁকে কত অসহায় করে তোলে। এই কষ্টের কোন যুক্তি নেই। এই কষ্টের কোন আশ্রয় নেই। অপরাধীর কাঠগড়ায় নিজেকে দাঁড় করায় সে। কেউ তাঁকে নিরপরাধ বলে না। সবাই যেন তাঁর দিকে আঙ্গুল তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কাউকে সে কিচ্ছু বলতে পারে না। তাঁর কী বলার কিছু আছে!! নাকি থাকা উচিৎ!! আচ্ছা!! পুলকের কী ওঁর কথা মনে হয়!! ও কী একবারো রীতার কথা ভাবে? পুলক কী রীতাকে ঘেন্না করে!! ভাবতে ভাবতে যেন বুকের মধ্যে পাথর জমা হয়। এই পাথর নিয়েই শুয়ে পড়ে রীতা।
এরপর আবার সকাল হয়। একটা নতুন দিন। সবকিছু নতুন করে শুরু করার আরেকটা সুযোগ। শুধু এই সুযোগ রীতার নেই। তাঁকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে পাথর সমান বোঝা। মাঝে মাঝে তাঁর মনে হয়-তাহলে কী তাঁর মায়ের তাবিজই কাজ করল। পুলক আর রীতার এক হওয়া তো হল না।
মিতাকে স্কুলে নামিয়ে রীতা অফিসে চলে যায়। স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে যায় মা। নাজমা হক ছেলের খোঁজে আছেন রীতার জন্যে। ছেলে পাওয়া এক বিশাল ঝামেলার ব্যাপার। মিতাকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার সময় সব মেয়েদের মায়েদের সাথে তাঁর আলাপ হয়। গৃহিণীদের জন্য এই সময়টা যে কত আনন্দের তা পৃথিবীর আর কেউ মনে হয় বুঝবে না। এর বাড়ির গল্প। ওঁর বাড়ির গল্প। কার মেয়ে কোথায় কোচিং করছে। কার কাছে কোন স্যারের নোটটা পাওয়া যাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হল বাসায় দেখা ইন্ডিয়ান সিরিয়ালগুলোর অ্যানালাইসিস এখানে বিশদভাবে হয়। কোন ভাবী যদি বাই চান্স কোন একটা পর্ব মিস করেও থাকে। কোন সমস্যা নেই। আশেপাশের ভাবীরা যে বর্ণনা দিবে তা সিরিয়াল দেখার চেয়ে কম লোমহর্ষক হয় না।
এছাড়াও আরো কিছু আলাপ হয়। এই ভাবীদের মধ্যে কেউ খাবারের ব্যবসা করে। কেউ বুটিক চালায়। কেউবা এর ওঁর বাড়ীর সুযোগ্য পাত্র-পাত্রীর খোঁজ রাখে। এরকমই একজন হলেন গুলশান আরা। তাঁর মেয়ে ক্লাস টু তে পড়ে। কিন্তু তিনি সব নাইন টেনে পড়া মেয়েদের মায়েদের কাছে সুযোগ্য পাত্রের খোঁজ নিয়ে যায়। সবার কাছে তিনি যায় না। যেসব বাড়ির মায়েরা মেয়েরা একটু রক্ষণশীল। তাঁদের কাছে তিনি যায়। এদের সাথে কথা বলেই তিনি মজা পান। এদের বাসার পুরুষরাই হয় বাড়ীর নীতিনির্ধারক। তাঁরা খুব ধর্মভীরুও হন। মেয়ে নাইনে উঠল কী উঠল না আশেপাশে ছেলে দেখা শুরু করে।
রীতা মিতার মা নাজমা হক গুলশান আরার সাথে কথা বলবেন ঠিক করলেন। বিয়ে অনেক ঝামেলার ব্যাপার। অনেক জায়গায় বলে রাখা হলে তারপর কিছু ভালো পাত্র কপালে জোটে। এখনো নাজমা হকের টাঙ্গাইলের সেই ডাক্তার পাত্রের জন্য মনটা হু হু করে ওঠে। কোথাকার কোন এক ফালতু ছেলের সাথে ঘুরার জন্য ওই রকম একটা ছেলে হাতছাড়া হয়ে গেল। কী আর করা যাবে!! যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে তো বসে থাকলে তো হবে না। চেষ্টা করে যেতে হবে।
তিনি গুলশান আরার কাছে গেলেন।
-কেমন আছেন আপা?
গুলশান আরা পান খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মুখে পান ঢুকিয়ে চাবাতে চাবাতে বলল,
-আসসালামু আলাইকুম আপা। আল্লাহ যেরকম রাখসে আপা।
একটু অবাক হয়েছে গুলশান আরা। নাজমা হক তাঁর কাছে কী চায় ঠিক বুঝতে পারছেন না। এদের মেয়ে মিতা এবার টেনে উঠেছে। দেখতে সুন্দরী। একটু দুরন্ত। কিন্তু এই পরিবারের তো এত জলদি মেয়ে বিয়ে দেওয়ার কথা বলতে আসার কথা না!! তাও মুখে কোন অবাক ভাব দেখায় না সে। বিগলিত ভঙ্গিতে বলে,
-তা আপা আপনি বলেন কেমন আসেন!! মিতার কী অবস্থা!! মেয়েটা দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল আপা।
-হ্যাঁ। তা তো ঠিকই।
অনেক রোদ উঠেছে। কিছুক্ষণ পরেই ছুটি হয়ে যাবে। তখন একটা হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। তিনি গুলশান আরাকে আলাদা নিয়ে যায়। রীতার কথা বলে। এমনকি তিনি এও বলেন যে আগেরবার এক বাজে পাত্রের পাল্লায় পড়ে তাঁকে অনেক ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। এবার তিনি সেরকম ঝামেলা চান না। এতক্ষনে গুলশান আরা আশ্বস্ত হয়। যাক!! বড় মেয়ের কথা বলতে আসছে। মানুষ চিনাতে তাঁর ভুল হলে খুব অশান্তি হয় গুলশান আরার। এখানে যে ভুল হয় নাই এটা প্রমাণ হয়াতেই তাঁর শান্তি লাগছে।
-আপনি কোন চিন্তা করবেন না ভাবি। আমি কালকেই আপনার বড় মেয়ের জন্য পাত্রের বায়োডাটা নিয়ে আসব। তবে আপনার মেয়ের যে একটা ছবি লাগবে। আর ওঁর বায়োডাটা টাও হলে ভালো হয়। কালকে নিয়ে আসেন।
কিন্তু নাজমা হক বায়োডাটা সাথে করেই নিয়ে আসছেন। এই বছরে রীতার বিয়ে না দিলেই না।
ছুটির দিনে মাঝে মাঝে মিতা বান্ধবীদের বাসায় বেড়াতে যায়। তখন মিতাকে আনা নেয়ার দায়িত্ব রীতাকেই নিতে হয়। মিতার বান্ধবী তানিশাদের বাসা ধানমন্ডির দিকে। পার্কটার সাথে লাগানো। খুলে দিল তানিশার বড় বোন। মেয়েটা খুব ফ্যাসনেবল। এক এক দিন এক এক রকম চুলের স্টাইল। অঙ্গভঙ্গিতেও ন্যাকা ন্যাকা ভাব প্রবল। এর কাছ থেকেই মিতা Pout ভঙ্গিতে ছবি তোলা শিখেছে। তার খারাপ লাগে না এসব ন্যাকামি। মিতার পাগলামি তার ভালোই লাগে। হয়তো নিজে যা করেনি তাই মিতার মধ্যে দেখে খুশি হয় রীতা।
তানিশার বড় বোনের নাম প্রিয়াঙ্কা। প্রিয়াঙ্কার ঘরে গিয়ে বসল রীতা। মিতা তানিশার রুমে। রুম আটকিয়ে ওরা গল্প করছে। প্রিয়াঙ্কা ওঁদের ডাকতে গেল। ওঁদের খুব গোপন কথা থাকে। রুম না আটকালে হয় না।
প্রিয়াঙ্কার ঘরে পিঙ্ক কালারটার প্রাধান্য বেশি। পুরা ঘরের বেডশিট, পর্দা, কার্পেট সব কিছুর মধ্যেই পিঙ্কের কোন না কোন শেড আছে। ওঁর কম্পিউটারটা খোলা। ফেসবুক এর পেজ ওপেন করা। কৌতূহলবশত রীতা উঠে একটু দেখতে গেল। কাউকে মেসেজ পাঠাচ্ছে প্রিয়াঙ্কা।
রীতা চমকে তাকাল। পুলক।
প্রিয়াঙ্কা পুলককে মেসেজ করছে।
-পুল!! Why don’t you answer me!! I want to meet you.
পুলকের প্রোফাইল পিকচার টার দিকে তাকিয়ে আছে রীতা। কতদিন পুলককে দেখেনি সে। তৃষিত নয়নে সে তাকিয়ে রইল।
কোথা থেকে প্রিয়াঙ্কা দৌড়ে এসে উইন্ডোটা মিনিমাইজ করে দিয়ে বিরক্ত চোখে রীতার দিকে তাকাল।
রীতা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সাথে সাথে তার প্রিয়াঙ্কা নামের এই মেয়েটাকে অসহ্য লাগতে শুরু করল।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ২৯)
একটা রেস্টুরেন্টের গোল টেবিলে চারজন বসা। আশিক, পুলক, রহমান এবং রাসেল। তিনজন সিগারেট খাচ্ছে। পুলক খাচ্ছে না। পুলকের খেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু সে কাউকে কিছু বলছে না। এরা সবাই পুলকের ভার্সিটি এর ক্লাসমেট। বন্ধু বলতে যাকে বোঝায় তা শুধু আশিক। এরা কেউ জানে না যে পুলক সিগারেট খেয়েছে আগে। এমনকি আশিকও না। ওরা সবাই অপেক্ষা করছে রত্না আর রেবেকা নামে আরো দুই জনের জন্য। সপ্তাহে দুই তিন বার এরা কোথাও না কোথাও বসে আড্ডা দেয়। পুলক ছাড়া বাকিরা নিয়মিত। তাই পুলক চুপচাপ। বাকিরা কথা বলছে। নতুন জায়গায় গেলে এমনিতেই পুলক সহজ হতে পারে না। সময় লাগে। আশিক বন্ধুকে অনেকদিন থেকেই চেনে। বন্ধুকে সহজ করার জন্যে সে কিছু বলে না। জানে এতে পুলক আরো সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। থাকুক ও ওঁর মত। হঠাৎ-ই রাস্তায় পুলকের সাথে আশিকের দেখা। পুলক অন্যমনস্কভাবে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। আশিক ডাকে। পুলক শোনে না। এত করে ডাকে তাও পুলক শোনে না। শেষমেশ দেখা গেল জ্যামে আটকে থাকা সবাই পুলককে ডাকা শুরু করেছে। সে এক দৃশ্য বটে। এরপর কথাবার্তায় বোঝা গেল পুলক ঠিক ধাতস্থ নেই। Something is wrong!!! পুলককে আশিক ধরে নিয়ে আসে তার আড্ডায়।
ওইদিন রীতাকে দেখার পর কি এক আশ্চর্য অথচ অপেক্ষা করে থাকা কষ্টের দেখা পুলক পেয়েছে। কিন্তু এর তীব্রতা তার ধারণাকেও ছাড়িয়ে যায়। রাতে ঘুম হয় না। কোথাও এক দণ্ড বসে থাকতে পারে না সে। অফিস যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল সে। বাসায় ও থাকত না। রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াত। আর মাথায় খালি ঘুরে বেড়াত কে ছেলেটা!!! যার সাথে রীতা এত ঘনিষ্ঠ ছিল!! এত জলদি ভুলে গেল তাঁকে রীতা!! সে কেন পারছে না!! কত চেষ্টা করছে সে। তাও কেন পারছে না!! এতদিন ছিল ভোঁতা যন্ত্রণা। হঠাৎ করে ছুরিটায় যেন ধার এসেছে। সবকিছু এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। কাউকে বলতে পারছে না সে। কী অসহায় নিজেকে লাগে পুলকের!! পুরো শরীরে কোথাও কোন আঘাত নেই। কোন দাগ নেই। অথচ কী নিদারুন যন্ত্রণা!!! রাতটাই সবচেয়ে কষ্ট দেয় তাঁকে। এত বড় মনে হয়নি রাতকে আগে কখনো। দিনে তাও মানুষের ব্যস্ততা দেখেও সময় কেটে যায়। কিন্তু রাত তো নীরব। নিস্তব্ধ। যন্ত্রণাগুলো যেন হামলা করে তাঁকে। কতবার তার ইচ্ছা হয় রীতাকে একটা কল দিতে। সে দেয় না। সে জানে এটা একটা অসুখ। এত কষ্টের মধ্যেও তার যুক্তিবাদী মন পুরোপুরি বিদায় নেয় না। থেকে থেকে জানান দেয়। তাঁকে বোঝায় যে এটাই নিয়ম। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু এরকম সময়ে মানুষের যুক্তিবাদী মনের পাশাপাশি দরকার একজন বন্ধুর। আমাদের এই ক্ষুদ্র তুচ্ছ জীবনে ঠিক বেঠিকের সংজ্ঞা তো আমরা তথাকথিত শিক্ষিতরা জানিই। কিন্তু তারপরেও কাউকে না কাউকে এসে আমাদের বলে দিতে হয়। এটা কর। এটা কোরো না। এটা ঠিক। এটা ঠিক না।
মানুষের মন এক বিচিত্র বস্তু। কোন পোশাক আর অলংকার ছাড়া মানুষের মন খুবই স্বার্থপর। ‘পোশাক’ আর ‘অলংকার’ বলতে এখানে ‘শিক্ষা’ আর ‘সামাজিকতা’-কে বোঝানো যায়। এই শিক্ষা আর সামাজিকতা আমাদের শেখায় যে আমাদের মনের সব কথা শুনতে নেই। অথবা মনের স্বার্থপরতাটাকে একটা নতুন মোড়কে এনে হাজির করে। মানুষ অন্য মানুষের দুঃখে খুশি হয়। এই খুশি হওয়াকে সামাজিকতার মোড়কে মুড়িয়ে মানুষ সান্ত্বনা দেয়। দয়া দাক্ষিণ্য দেখাতে মানুষের বরাবরই ভালো লাগে। অপরের দুঃখে চু চু করতে মানুষের অনির্বচনীয় সুখ। যদি না চু চু করা যায়। যদি সেই দুঃখী কোনোভাবে দাঁড়িয়ে যায়। এতে মানুষ আবার খুবই রেগে যায়। চু চু করা গেল না যে!!!
প্রেমের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই নিয়মনীতি অনুসরণ করে মানুষ। প্রেমিক প্রেমিকা আলাদা হয়ে যাওয়ার পর দুই পক্ষই শিক্ষা ও সামাজিকতার নির্দেশে নিজেকে এবং আশেপাশের সবাইকে বোঝায় যে আমি চাই সে ভালো থাকুক। কিন্তু আসলে প্রত্যেক পক্ষের অবচেতন মন চায় যে অপর পক্ষ তার বিরহে কষ্ট পাক। এর উল্টা কিছুর নিদর্শন পেলেই মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। নিজেকে বুঝতে পারে না। কারণ অবচেতন মনের কতটুকুই মানুষ বুঝতে পারে!!!
আমাদের গল্পের পুলকও সেই অবচেতন মনের যন্ত্রণার শিকার। রীতাকে ছেড়ে আসা যায়। কিন্তু রীতাকে অন্য কারো সাথে সুখী দেখা যায় না।
আমরা আবার আড্ডার টেবিলে ফিরে যাই। এতক্ষনে রত্না আর রেবেকা চলে আসে। এই টেবিলের সবাই-ই কোথাও না কোথাও চাকরী করে। শুধুমাত্র রাসেল ছাড়া। তার এটা নিয়ে খুব বেশি একটা মাথা ব্যথাও নেই। তাঁকে কিছু বলা হলেই সে মুখটাকে দুখী দুখী করে বলে, “হ ভাই!! আমি বেকার মানুষ।” কিন্তু আসলে তাঁকে তত দুখী দেখায় না। রত্না আর রেবেকা পোশাক আশাকে বিপরীত। রেবেকার শাড়ি পড়া। রত্নার পড়া শার্ট প্যান্ট। কাউকেই সুন্দরী বলা যাবে না। কিন্তু তাঁদের সাবলীলতা তাঁদের মধ্যে আলাদা সৌন্দর্য যোগ করেছে।
‘পচানি’ নামে যে একটা শিল্প বহু আগে থেকেই গড়ে উঠেছে তা এই আড্ডার টেবিলে প্রমাণিত। হাসতে হাসতে মানুষকে ভয়ঙ্কর অপমান করাই হচ্ছে ‘পচানি’। এতে যে অপমান করে সেও হাসে, যাকে অপমান করে সেও হাসে এবং মনে মনে অপমানকারীকে পাল্টা অপমান করার সুযোগ খোঁজে। এই ‘পচানি’ নামক শিল্পর সামনে সবসময়ই পুলক নিজেকে অনিরাপদ বোধ করত। টেবিলের মধ্যেও করতে লাগল। জীবনের যে কোন ক্ষেত্রেই কেউ যদি তাঁকে একটা টিকা টিপ্পনী দিয়েছে, সে তাঁকে উগ্রভাবে আক্রমন করেছে। কথা দিয়েই। তবে তা কখনোই শিল্পের পর্যায়ে থাকত না। টেবিলে এরা একে অপরকে পচাচ্ছে আর হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পুলক শুধু মুছকি মেকি হাসি দিয়ে যাচ্ছে। তার এখানে একটুও ভালো লাগছে না। কিন্তু এরকম একটা সময়ে সে বেরও হয়ে যেতে পারছে না। আশিক তাঁকে এখানে নিয়ে এসেছে। ওকে বলতেও ইচ্ছা করছে না সে চলে যাবে। পুলক বসে রইল।
সাধারণত ‘পচানি’ নামক শিল্পতে একজনকে টার্গেট করা হয়। সে হয় সবার বিনোদন এর কেন্দ্রবিন্দু। এখানে সেই টার্গেট হল রহমান। সে কথাবার্তায় তত পটু না। সে থাকে তার মামা মামীর সাথে। কিছু হলেই সে বলে ‘মামী এটা বলসে!!! মামী ওইটা বলসে!!’ সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় পচানি।
রত্না ওকে জিজ্ঞেস করে,
- রহমান দোস্ত!!! তোর রাতে বাথরুম লাগলে কী করস!!
রহমান বিরক্ত হয়। বলে,
- কী করি মানে কি!! বাথরুমে যাই!!!
- কেন!! মামীর পারমিশন লস না!!!
আবার শুরু হয়ে যায় টেবিল চাপড়ানো হাসাহাসি। পুলক বিরক্ত হয়। রহমান- কে সেরকম কিছু মনে হয় না।
হঠাৎ করেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই আক্রমনের দিক ঘুরে যায় পুলকের দিকে। আক্রমন করে রত্নাই। ‘পচানি’ শিল্পের এই টেবিলের লিডার সে। আশিক যদিও ইশারায় রত্নাকে না করে। রত্না পাত্তা দেয় না। সে মিট মিট করে হেসে সবাইকে তার সাথে যোগ দিতে ইশারা করে-
- আচ্ছা!! আপনার নামটা কি যেন বলেছিলেন!!!
- পুলক
- বাঃ!! খুব পুলকিত হইলাম আপনার নাম শুনে।
পুলক ভদ্রতার হাসি দেয়।
- ছ্যাক খাইসেন নাকি ব্রাদার!!! আপনাকে দেখে কি রকম ছ্যাক খাওয়া লাগে।
টেবিলের সবাই-ই হাসে আশিক ছাড়া। সে অপ্রস্তুত হয়ে থাকে। সে হাসলে যে পুলক তাঁকে ছেড়ে দেবে না এটা সে জানে। ভার্সিটি লাইফ এ এরকম বহুবার হয়েছে যে সে কোন কারণে পুলকের উপর ঠাট্টা করে হেসেছে। আর পুলক রেগে মেগে আগুন হয়ে গিয়েছে।
পুলকের কিন্তু খুব রাগ উঠেছে। কেউ তাঁকে খোঁচা মেরে কথা বললে সে সহ্য করতে পারে না। তার মাথায় কোথায় জানি একটা ‘টং’ করে সাউন্ড হয়। তার ইচ্ছা করছে সে মেয়েটাকে ‘টাস’ করে একটা চড় মারে। কিন্তু তা না করে সে একটা স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করল। সে হাসল আর বলল।
- তাই?
রত্না বলল-
- আবার জিগস।
বলে আরেক দফা হাসি। পুলকও হাসল এবার।
-আপনাকে দেখেও আমার তাই মনে হয়!!
রত্নার মুখের হাসি চলে গেল।
- মানে?
- মানে খুবই সোজা। আপনিও আপনার ভাষায় ‘ছ্যাক’-ই খাওয়া। ওইটা আড়াল করতেই এত হাসাহাসি আর অন্যকে অপমান করা। তাই না?
এখন আর কেউ হাসছে না। পুলক মনে মনে হাসল। এই রত্না মেয়েটাও তার মত। পচাতে পছন্দ করে। পচতে না। এই জন্যই টেবিলের সবাই হাসি চেপে আছে। রত্নার মুখ কালো।
পুলক উঠল। আশিককে বলল, “ দোস্ত!!! আজকে যাই রে!! আবার দেখা হবে। আমি কল দিবনে তোকে।“
পুলক বের হয়ে গেল।
অন্যদিকে রীতার জীবনে অন্য আরেকটি পুরুষের আগমন ঘটল। তার নাম মাসুদ পারভেজ।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ৩০)
গুলশান আরার বাসাটা শান্তিনগরের বেশ ভেতরে। বাজারের পাশ দিয়ে বেশ অনেকটা দূরে যেতে হয়। রাস্তার অবস্থাও বেশ সুবিধার না। এবড়ো থেবড়ো। রিক্সা দিয়ে গেলে অনেক ঝাঁকুনি খেতে হয়। হেঁটে গেলেও আরেক বিড়ম্বনা যদি বৃষ্টি হয়ে থাকে। প্যাচপ্যাচে কাদা। এই কাদা পাড় হয়ে যাওয়া বিশাল ঝক্কি ঝামেলা। আফরোজা এই বিশাল ঝক্কি ঝামেলা ঘাড়ে করে নিয়েই গুলশান আরার বাসায় গেল। ছেলের জন্য পাত্রীর খোঁজ নেওয়াই তার উদ্দেশ্য। অনেকের কাছেই ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে বলেছে। তাদেরই কারো কাছ থেকে গুলশান আরার নাম শুনেছেন। ইনি নাকি অনেক মেয়ের খোঁজ জানেন। তবে টাকাটা একটু বেশী নেন। টাকা নিয়ে আফরোজার চিন্তা নেই। দেবেন যা লাগে। কিন্তু ছেলের বিয়ের চিন্তায় তার ঘুম হচ্ছে না আজকাল। তার ছেলেটা কি এরকমই একলা থেকে যাবে? একলা থাকাটা খুব সুখের নয়। এই ছেলেকে বুকে চেপেই সে এতগুলো বছর একলা চলেছেন। একলা মহিলার এমনিতেই অনেক রকম ঝামেলা। কিন্তু তারও তো একটা মন ছিল। অন্ধকার রাতে তার মনটাও কি কারো সঙ্গ পাওয়ার জন্য হু হু করতো না!! করতো। তাই তিনি চান না ছেলে একা থাকুক। বিয়ে করুক। বাচ্চা হোক। সুখের একটা সংসার হোক তার। আফরোজা দায়ী নয় তাও ছেলেকে একটা পরিপূর্ণ পরিবারের স্বাদ সে দিতে পারেনি এ জন্য তার মনে অনেক দুঃখ। বাবার আদর। বাবা কী? বাবার দিকের কোন আত্মীয় এই ছেলে দেখেনি। নিজের বাবার কথা মনে হলে আফরোজার আরো মনটা খারাপ হয় পুলকের জন্য। আফরোজার বাবা, পুলকের নানা স্বল্পভাষী ছিলেন। কিন্তু বাবা হিসেবে সব দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন। মাথার উপর বাবার ছায়া যে কতবড় অবলম্বন তা তিনি জানেন। তার ছেলে পুলক জানে না। তার কাছে মা-ই সব। মা-ই বাবা। মা-ই মা। আজকাল আফরোজার মনটা খুব দুর্বল হয়ে গেছে। নরম হয়ে গেছে।
এসব ভাবতে ভাবতে গুলশান আরার বাসার কাছে চলে আসলেন আফরোজা। রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে ঠিকানা দেখলেন কাগজে। হ্যাঁ, সামনের বাড়িটাই। তিনিতালায়।
কলিং বেল টিপলেন। একটি ছোট মেয়ে দরজা খুলল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
-গুলশান আরা বেগমের বাসা?
ছোট মেয়েটি বেশ অভ্যস্তভাবে বলল-
-ভিতরে আইসা বসেন।
মেয়েটাকে নির্দেশ দেয়া আছে। মহিলা যারাই আসুক তাঁদের যেন বাইরের ঘরে বসানো হয়।
আফরোজা বসলেন।
ঘরটা ভালোই সাজানো। খালি কলর কম্বিনেশন খুব উৎকট। সব ক্যাটক্যাটে কলরের জিনিসপাতি। কলাপাতা কলরের পর্দা। ম্যাজেন্টা কলরের সোফা আর কার্পেট। ছোট মেয়েটা চা আর ঠাণ্ডা পানি এনে রেখে গেল।
৫ মিনিট পরেই গুলশান আরা ঢুকলেন। বিগলিত হাসি হেসে সালাম দিলেন। তিনি মানুষ চড়িয়ে খান। তাই সব মানুষের প্রতিই তার সমান আদব। তার আদবই তার অনেক কাস্টমার জুটিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে দূর দূর থেকেও তার কাছে লোক আসে। মহিলারাই বেশি আসে।
আফরোজা ছেলের বায়োডাটা নিয়ে এসেছিলেন। দিলেন। গুলশান আরা দেখলেন, বললেন
-আপা!! আপনার ছেলে তো হীরার টুকরা। এর জন্য মেয়ে আমার খুঁজাই লাগবে না। এরকম ছেলের জন্য কত মেয়ে আছে। ঝুট ঝামেলা কিচ্ছু নাই। এক মায়ের এক ছেলে। আর বাবা সাথে নাই এটা কোন বিষয় না। এরকম বহু কেস আমি হ্যান্ডেল করসি। আপনি চিন্তা কইরেন না। আমার কাছে কিছু মেয়ের ছবি আসে। দেখেন আপনি।
বলেই ‘সমীরন’ বলে একটা ডাক দিল। সেই ছোট মেয়েটা কিছু ছবি এনে টেবিলে রেখে দিল।
আফরোজার টেবিলে পড়ে থাকা প্রথম ছবি দেখেই বিরক্তি লাগল। কিরকম গ্রাম্য চেহারার মেয়ে। আসলে মেয়েটা গ্রাম্য ছিল না। ছবি তোলার ভঙ্গিটা একটু গ্রাম্য ছিল। আর ছবির কলরটাও এই ঘরের কলরের মত।
গুলশান আরা লোক চড়িয়ে খান। তিনি আফরোজার মনোভাবটা যেন বুঝতে পারলেন। বহুরকমের মানুষের সাথে তার দেখা হয়েছে। মানুষের রুচিবোধ যে একেক জনের একেক রকম তা তিনি জানেন। এই রুচিবোধ এলাকা অনুযায়ী আলাদা হয়। মানুষের পড়াশোনা অনুযায়ী আলাদা হয়। অনেক বড়লোক ঘরের মহিলারা এসে এসব ক্যাটক্যাটা ছবি দেখেই খুশি হয়। আবার মধ্যবিত্ত ঘরের পড়াশোনা জানা মেয়েদের রুচিবোধ অন্যরকম।
তিনি বললেন,
-আপা, পরের থেকে দেখেন। এই ছবিটা বেশি ভালো না। মেয়ে কিন্তু দেখতে ভালো।
আফরোজা উল্টিয়ে গেলেন। বেশ কয়েকটা ছবি উল্টানোর পর একটা ছবিতে তার চোখ আটকে গেল।
গুলশান আরা আড় চোখে দেখছিলেন। ঠিক কোন ছবিটায় আফরোজার চোখ আটকে গেল তা খেয়াল করলেন তিনি।
গুলশান আরা বললেন-
-আপা!! এই পাত্রী পছন্দ কইরেন না। এদের নখড়া অনেক। এদের জন্য অন্য পাত্র খুজতেসি। এর আগে জানি কোন আজে বাজে ছেলে কে গছানোর চেষ্টা করসে তাই এরা এইবার খুব সাবধানী।
আফরোজার মুখটা সাদা হয়ে গেল। ছবিটা রীতার ছিল। রীতাকে দেখতে তিনি আর পুলক দুজনেই গিয়েছিলেন। তার পুলককে ‘আজে বাজে’ ছেলে বলেছে। কত কষ্ট করে এই ছেলেকে তিনি বড় করেছেন। নিজের সবটুকু নির্যাস দিয়ে তিনি এই ছেলেকে বড় করেছেন। তাহলে কেন তার ছেলেকে ‘আজে বাজে’ বলছে। কিসের ভিত্তিতে। সেটা কী শুধু তিনি সংসার করতে পারেননি বলে। এই দায়ভার তো তিনি সারা জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। কত কথা শুনেছেন। কখনো সরাসরি। কখনো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে। মেয়েরাই মেয়েদের কাটা জায়গায় খোঁচা দিতে বেশি পছন্দ করে। তাঁদের কখনো কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছেন। কখনো এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁকে এভাবে কেউ আঘাত করতে পারেনি যতটা আজকে এই একটা শব্দ করল।
আফরোজা আর একটা ছবিও দেখলেন না। শরীর খারাপ লাগছে বলে তিনি উঠে পড়লেন।
তার ছেলেকে ‘আজে বাজে’ বলেছে। তার কত গর্ব। তার কত অহংকার তার এই ছেলে। তাঁকে ‘আজে বাজে’ বলেছে। কি ‘আজে বাজে’ কাজ করেছে তার ছেলে।
খুব ছোট একটা শব্দে এক বিশাল বড় দুঃখ নিয়ে বাসায় ফিরলেন আফরোজা। বাসায় কেউ নেই। পুলক তখনো ফেরেনি। ফেরার কথাও না। মাত্র দুপুর। আফরোজা শুয়ে পড়লেন।
পুলক বাসায় ফিরল সন্ধ্যায়। পুরো বাড়ি অন্ধকার। ‘মা’ ‘মা’ করে ডাকল সে কিছুক্ষণ। সাড়া নেই। মায়ের ঘরে গিয়ে দেখল মা শুয়ে আছে। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করল পুলক। অন্যদিন মা ঘুমিয়ে থাকলে শ্বাস প্রশ্বাসের উঠা নামা দেখে সে। আজকে তা খেয়াল করেনি। করলে বুঝতে পারত আফরোজা এই পৃথিবীতে তার এত আদরের সন্তান পুলককে একদম নিঃস্ব আর একা করে দিয়ে অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ৩১)
মাসুদ পারভেজ একজন আটাশ বছর বয়সী গোছানো মানুষ। তিনি দেখতে খুব সুদর্শন নন। কিন্তু তাঁকে অগ্রাহ্যও ঠিক করা যায় না। তিনি একটি জাপানীজ কোম্পানীর জেনেরাল আফ্যায়ারস বিভাগের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। উচ্চতা ৫ ফিট ৭ ইঞ্চি। গায়ের রঙ ফর্সা বলা যায় না। তাই বলে কালোও না। কদাচিৎ হাসেন বলে তাঁকে বেশ গম্ভীর দেখায়। কিন্তু লোক হিসেবে তিনি বেশ অমায়িক। তবে কাজের ব্যাপারে তিনি আপসহীন। জাপানীজদের সাথে কাজ করতে করতে এদের খুঁতখুঁতে স্বভাব তার মধ্যেও চলে এসেছে। কোন জিনিস ১০০% তার মনমত না হলে তিনি সেই কাজ করেই যেতে থাকেন যতক্ষণ তা ১০০% হচ্ছে। এই জন্য জাপানীজ ম্যানেজমেন্টও তার কদর বোঝে। খুব শিগগিরি হয়তো তাঁকে ম্যানেজার পোস্টে প্রমোশন দিতে পারে। এখনের ম্যানেজার খুব সম্ভবত অন্য কোথাও শিফট করবেন।
কোম্পানীর একটা পার্টি আয়োজনের দায়িত্ব পড়েছিল মাসুদের কাঁধে। মাসুদ একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করলেন। তারা তাঁদের একটা দল মাসুদের অফিস এ পাঠিয়ে দিলেন। সেই দলে ছিল আমাদের গল্পের রীতা। ৫ জনের দল। এদের প্রথম কাজ মাসুদের সাথে কথা বলে পার্টির ধরন ধারণ বুঝে নেয়া। এরপর পার্টির লোকেশন দেখা। তারপর পরিকল্পনা করা।
মাসুদ দেখা করলেন দলটির সাথে। দলটিতে ৩টা ছেলে। ২টা মেয়ে। সবাই কম বয়সী। খুব বেশীদিন হয়নি কাজ করছে। কিন্তু এদের দলনেতা বেশ অভিজ্ঞ। এটা একটা ভালো দিক। সব নতুন দেখলে জাপানীরা বেঁকে বসতে পারে। তাছাড়া জাপানীদের তুষ্ট করার মত ক্ষমতা এদের আছে কিনা তাও পরীক্ষা করে দেখার মত একটা বিষয়। বহু মানুষদের সাথে কাজ করেছেন মাসুদ। বড় বড় নামকরা লোকরা নাজেহাল হয়েছে এই জাপানীজ স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখতে। দেখা যাক!!! এরা কতদুর পারে। জাপানীজদের পেশাদারিত্ব নজিরবিহীন। মাঝে মাঝে মাসুদের মনে হয় জাপানীজদের মধ্যে আবেগ নেই।
প্রথম মীটিং এর পর লোকেশন দেখা। এরপর আবার মীটিং। দুই মাস পর ইভেন্ট। এর মাঝেই কাজ গুছিয়ে নিতে হবে। লোকেশনে কাজ করবে রীতা আর রাইয়ান নামের ছেলেটি। বাকিরা অন্য সব কিছু আয়োজনে থাকবে। কাজ শুরু হল। না ভালোই করছে এরা। মাঝে মাঝে এসে যাচাই করে দেখেন সব ঠিকঠাক হচ্ছে কি না!! মাঝে মাঝে জাপানীজ এমডিও এসে দেখে যান। খুশিই হয় মনে হয়। এদের চেহারার উপর আস্থা রাখে না মাসুদ। এদের চেহারাই হাসি হাসি। আবার অসন্তোষ যখন দানা বাঁধে সেটাও এই হাসি হাসি চেহারায় ভালোই বোঝাতে পারে তারা। এই জন্যই নিজেই সবকিছু কড়া চোখে দেখে মাসুদ।
রাইয়ান ছেলেটা একটু অস্থির। রেগে যায় অল্পতেই। মাসুদ কিছু পরিবর্তন আনতে চাইলে খুবই অন্ধকার চেহারা নিয়ে তা করে সে। মাসুদ অবশ্য মুখে জাপানীজ হাসি ধরে রাখে। কর্পোরেট কালচারে হাসি মুখ ছাড়া কথা নেই। গালিও হাসিমুখে দিতে হয়। মেইলে যে কতরকমের কর্পোরেট ঝগড়াঝাঁটি তাঁকে করতে হয়। তার ইয়ত্তা নেই। এই ঝগড়াঝাঁটি কত ভালোভাবে করা গেল এর উপরো মাসুদের কাজের মুল্যায়ন করা হয়। জাপানীজদের প্রিয় লোকদের সাথে ঝগড়া করলে ওরা রাগ করে। আর বাকিদের সাথে ঝগড়া করলে খুব খুশি হয়। আধো আধো ইংরেজিতে বলে “Keep it up!! Keep it up!!” ।
রাইয়ানের সাথে যে মেয়েটা এই মেয়েটা মাসুদকে বেশ ইম্প্রেস করল। মেয়েটা কখনোই দমে যায় না। এটা একজন বাংলাদেশীর মধ্যে বিরল। কেন যেন মাসুদের মনে হয় বাঙ্গালীরা মন থেকে কাজ করতে পছন্দ করে না। অনেকটা ঠেকায় পরে করে। কিন্তু এই মেয়েটি। রীতা হক। কাজ খুব আগ্রহের সাথে করে। এবং কাজের সাথে কোন আপস করে না। একদিনের ঘটনাই খুব বেশী অবাক করেছে মাসুদকে।
স্টেজের জন্য স্পেশাল কিছু ফরমায়েশ ছিল জাপানীদের। কতটুকু উঁচু হবে। কোনদিকের পর্দা কী রঙের হবে। অতিথিরা কোন দিক দিয়ে উঠবেন। আর জাপানীদের কিছু অক্ষর ডিজাইন হিসেবে রাখতে হবে। কয়েকটা প্রোডাক্ট এর ছবি থাকবে। ব্যাকগ্রাউন্ড এ কোম্পানীর চেয়ারম্যান এর ছবি। এসব খুঁটিনাটি ব্যাপার স্যাপার।
বাকি আছে দুইদিন। অথচ স্টেজ এর কাজ অনেকটাই বাকি। এইদিকে রাইয়ান বেশ ছটফট করছে। তার আজকে একজনের সাথে দেখা করার কথা। বিশেষ কেউ। তাই আজকে তার কোনোভাবেই কাজে মন বসছে না। রীতা মনে হয় ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে। তাও সে কিছু বলছে না ওকে। তাঁদের দুইজনের তত্ত্বাবধায়নে আরো বেশ কিছু লোক কাজ করছে স্টেজের। রাইয়ান কাকে যেন খুব বকা ঝকা করল। তখন রীতা রাইয়ান-কে বলল,
- তোমার যদি কোন কাজ থাকে! তাহলে চলে যেতে পার। আমি স্টেজ সামলে নিতে পারব।
- আরে কী বল!! আমার আবার কী কাজ!!
বলে সে আবারো কাকে যেন খুব ঝাড়ি দিল। এভাবে নিজের কাজের জন্য অফিসিয়াল কাজে ছাড় দিয়ে যাবে রীতার কাছে!! এটা সে মানতে পারছে না। এসব পরে রিপোর্ট হবে। কিন্তু যাওয়াটাও খুব দরকার। আজকে তানিয়ার জন্মদিন। ইদানীং ওঁর খুব অভিমান বেড়েছে। আজকে একটু সময় না দিলেই না। কিন্তু এখান থেকে বের হয়ে গেলে আবার ফিরে আসা যাবে না। এত ঝামেলা!!! রাইয়ান আবারো গিয়ে কাকে যেন কি বোঝাতে লাগল। তার গলার পারদ উঠছে একটু একটু করে।
রীতা আর কিছু বলল না। একজন সহকর্মী হিসেবে এইটুকু সাহায্য সে করতেই পারে। কিন্তু কেউ নিতে না চাইলে অন্য কথা। তার দায়িত্ব সে পালন করল।
রাইয়ান খুব বেশীক্ষণ তার ভাব ধরে থাকতে পারল না। কিছুক্ষণ পরে সে বেশ অস্থির হয়ে বলল-
- আচ্ছা!! আমাকে একটু অফিস এর কাজেই বাইরে যেতে হবে। আজকে বোধহয় ফিরতে পারব না। তুমি তো এটা শেষ করে দিতে পারবে। পারবে না? আজকে কিন্তু স্টেজ শেষ করতেই হবে। নইলে ঝামেলা লেগে যাবে শেষ সময়ে।
রীতা মুচকি হাসল। মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। রাইয়ানের পুরোটাই যে অজুহাত এটা সে জানে। জেনেও সে কিছু বলল না। মানুষের পিছনে লাগার অভ্যাস রীতার নেই। আর রাইয়ান তার আগে এখানে জয়েন করেছে। তো ওঁর পিছে লাগার আরো দরকার নেই। তাছাড়া কাজ করতে রীতার ভালো লাগে। যত ব্যস্ত থাকা যায়। তত নিজের কাছ থেকে পালিয়ে থাকা যায়। ইচ্ছা করেই সে এই কাজটা নিয়েছে। এই গ্রুপে ভালো কাজ করতে পারলে সে আরো বড় প্রোজেক্টে কাজ পাবে সে। সে কিচ্ছু ভাবতে চায় না। ভাবতে তার একদম ভালো লাগে না। কোন কারণে সে নিজের কাছে হেরে গেছে। জীবনের হেরে যাওয়া মানুষেরা আশ্রয় খোঁজে কাজের মাঝে, ব্যস্ততার মাঝে। রীতাও এখন সেই বলে যোগ দিয়েছে।
পুরো কাজ শেষ করতে তার রাত ৮ টা বেজে গেল। অফিস টাইম ৬টায় শেষ। কিন্তু আজকের কাজ আজ শেষ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
মাসুদ সাধারণত একটু দেরী করেই অফিস থেকে বের হয়। ওইদিন যেন আরো দেরী হয়ে গেল। ৮টার দিকে বের হয়ে দেখল রীতা মাত্র কাজ শেষ করল। মাসুদ বেশ অবাক হলেন। সাধারণত এরা ৬টার বেশি থাকে না। যদিও এদেরকে সে বলেছে ডেডলাইন দুই দিন পরে। কিন্তু আসলে অনুষ্ঠান এক সপ্তাহ পরে। ডেডলাইন ঠিক রাখার জন্য এরকম সে প্রায়ই করে। কারণ জাপানিজরা ডেডলাইন মেইন্টেইন না করাকে বিশাল গাফিলতি মনে করে। তাই মাসুদ যে কোন কাজ এভাবে করে থাকেন। করিয়েও থাকেন। মাঝে মাঝেই দেখা যায় নকল ডেডলাইন অনুযায়ী কাজ শেষ হয় না। তখন তার এই পদ্ধতি বেশ কাজে লাগে।
রীতাকে এতক্ষণ কাজ করতে দেখে মাসুদ বেশ অবাক হলেন। রীতাকে সে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। রীতা বের হয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। খুব ক্লান্ত। তার পরনে জিন্স আর ফতুয়া। গলায় ওড়না ঝোলানো। মাসুদের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি উঠে মাসুদকে বলল-
- ফিনিশিং ছাড়া বাকি সব শেষ। কালকে শুধু ফিনিশিং।
মাসুদ পুরো কাজটা একবার ঘুরে দেখলেন। মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে। কিছু জিনিস একটু এদিক ওদিক করতে হবে। সেটা আজকে না করলেও হবে।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন-
- আপনি যাবেন কীভাবে?
- বাস এ করে চলে যাবো। অসুবিধা নেই।
- আসুন আপনাকে নামিয়ে দেই।
রীতা একটু ইতস্তত করল। কিন্তু না বলল না। আসলেই রাত খারাপ হয়নি। লিফট পেলে খারাপ হয় না।
রাস্তায় টুকটাক কথা বার্তা হল। রীতার বাসার খবরাখবর নিলেন মাসুদ। নিজের কিছু কথা বার্তা বললেন। স্বাবলম্বী মেয়েদের মাসুদ বেশ সম্মানের চোখে দেখেন।
এরপর থেকেই রীতাকে কেন জানি মাসুদ পারভেজ একটু অন্য চোখে দেখলেন। তিনি নিজে পরিশ্রমী মানুষ। তাই কাজ করা লোক তার পছন্দ।
মাসুদ পারভেজ অবিবাহিত। কাজ করতে করতে বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি এখনো। বাসা থেকে প্রেসার আছে। কিন্তু কেন জানি তার বিয়ে করতে ইচ্ছা হয় না। তিনি নিজে একটু কাজ পাগল মানুষ। তার এই পাগলামি কোন মেয়ে বুঝবে। আর ওইভাবে কোন মেয়েকে তার কখনো ভালো লাগেনি।
কিন্তু রীতাকে তার বেশ পছন্দ হল। মেয়েটা পরিশ্রমী। স্মার্ট। দেখতেও খারাপ না। সমস্যা একটাই। মাসুদ পারভেজ পেশাদারিত্বে বিশ্বাসী মানুষ। এভাবে কাজের জায়গায় মেয়ে পছন্দ করা বা তাঁকে প্রস্তাব দেয়া তার রুচির সাথে খাপ খায় না। তাছাড়া তিনি জানেনও না যে মেয়েটা তাঁকে পছন্দ করবে কী না!! ওঁর তো আলাদা পছন্দও থাকতে পারে।
ওইদিন বিকালে কাজের শেষে মাসুদ পারভেজ রীতা আর রাইয়ান, দুইজনকেই কফি খাওয়ার আমন্ত্রন জানালেন। রীতা এর মাঝে অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পেল না। সে এটাকে কর্পোরেট কালচার হিসেবেই ধরে নিল।
অন্যদিকে পুলকের জীবনে আরেকজন নারীর আগমন ঘটল। খুবই তীব্র সেই আগমন। খুবই অনভিপ্রেত। খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। রীতার পর আবারো কেউ আসলো।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ৩২)
ভোর ৪টা। আকাশে আজকে চাঁদ নেই। চারপাশ অন্ধকার। ছাদের চারপাশে রেলিঙ দেয়া। অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকলে অন্ধকার চোখ সয়ে আসে। একটু একটু করে ছাদের মধ্যে গাছ-পালা, পানির ট্যাঙ্কি আর এখানে ওখানে সাপের মত ছড়িয়ে থাকা পানির পাইপের লাইন দেখা যায়।
রেলিঙের উপর একটা মনুষ্য মূর্তি দেখা যাচ্ছে। তার গাল ভর্তি দাড়ি। খালি গা। পরনে ট্রাউজার। সে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে কেউ দেখলে কারো মনে হতে পারে যে মানুষটা বুঝি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। আসলে পুলকের সেরকম কোন ইচ্ছা নেই। আত্মহত্যা করার মত সাহস তার নেই। সে এমনিতেই দাঁড়ায় এখানে। মাঝে মাঝে মনে মনে ভাবে যে কোন বাতাস যদি এসে তাঁকে ফেলে দিত। তাহলে ভালো হত। সেরকম কোন বাতাস আসে না।
পুলক বরাবরই কিছুটা সুখী স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল। সব সময়ই কিছুটা মেদ শরীরে থাকতই। কিন্তু এখন তার শরীরে মেদের ছিটে ফোঁটাও নেই। চেহারাও কিছুটা ফ্যাকাশে। মুখ ভর্তি দাড়ি হয়েছে তার। তিন মাসের ছুটি নিয়েছে সে অফিস থেকে। আসলে চাকরীটা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল সে। পুলকের বস রায়হান সাহেবই তাঁকে সময় নিতে বলেছে। উনি নিয়মিত ফোন করেন তাঁকে। অনাত্মীয় এই ছেলেটাকে তার খুব আপন লাগে। কেন লাগে!! তা জানেন না তিনি। সব কেনর মনে হয় উত্তর হয় না।
অনেকক্ষণ রেলিঙের উপর দাঁড়িয়ে থেকে পুলক গভীর মনোযোগ দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকল। কি ভাবনা চলছে মাথায় তার ঠিক বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে মানুষের মাথা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায় । যখন আমরা কিচ্ছু ভাবি না। শুধু তকিয়ে থাকি। পুলকও সম্ভবত শুধু তাকিয়ে আছে। কিছু ভাবছে না। এভাবে ঠিক আধা ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল পুলক। তারপর নেমে আসল। এখন রেলিঙের উপর পা ঝুলিয়ে বসল। ভোরের আলো না ফোটা পর্যন্ত এভাবেই বসে রইল। চেহারাটার মধ্যে ভাবলেশহীনতা প্রবল। ১ মাস হয়ে গেল মা চলে গেছে। জীবনটা ওলট পালট হয়ে গেছে। বাসায় ফিরতে ইচ্ছা হয় না। বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায় সে। খাওয়ার জন্য মামার বাসায় যায়। ওখানেই খায় সে। থাকে না। রাতে এই একা বাড়িতেই থাকে সে। এমনিতে একাকীত্ব তার খারাপ লাগে না। শুধু মায়ের ঘরটাতে গেলেই কেমন জানি লাগে। ঘরটা বন্ধ করে রাখে সে।
আশিক মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যায়। ওকে নিয়ে বের হতে চায়। পুলক ওঁর সাথে বের হয় না। নিজে নিজে একা একা ঘোরে সে। মানুষের সঙ্গ তার ভালো লাগে না। তার কথা বলতেও ভালো লাগে না। একভাবে টানা বসে থাকে সে কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে এক মগ কফি নিয়ে। আশেপাশের মানুষদের দেখে সে। কি সুখী সবাই!! সবার জীবনে কত মানুষ। কত প্রিয়জন। জীবন কত অর্থবহ এদের কাছে। কিন্তু এই জীবনের অর্থ আর পুলক খুঁজে পায় না। আশেপাশে হাতড়িয়েও কাউকে পায় না সে। সমস্যা পুলকেরও আছে। সবাইকে যে তার ভালো লাগে না।
পাশের টেবিলেই একটা গ্রুপ বসে খুব আড্ডা দিচ্ছে। পুলকের বয়সীই হবে ওরা। কোন একটা অফিস এর কলিগরা একসাথে খেতে এসেছে। হাসাহাসি আর ছবি তোলা চলছে। সংখ্যায় ভালোই এরা। অনেকগুলা টেবিল একসাথে জড় করে এক জায়গায় করা হয়েছে। কেউ বসে নেই টানা। উঠছে। গল্প করছে। ছবি তুলছে। বসছে। একটা মেয়ের দিকে পুলকের দৃষ্টি আটকে গেল। মেয়েটার চুল খোলা। কপালে বড় করে একটা লাল টিপ। চোখে ঘন করে কাজল দেয়া। আর কোন সাজ নেই তার। তার এই সাজ না থাকাটাই যেন বিশাল এক সাজ। মেয়েটাকে চেনে পুলক। মেয়েটারও তাঁকে চেনার কথা। তবে বর্তমান অবস্থার পুলককে আগের দিনের পরিচিত কারো চিনতে পারার কথা না। এক মাথা চুল। আর মুখ ভর্তি দাড়ি। তার চেহারাটা এত কিছুর ভিতরে আড়াল হয়ে গেছে। মেয়েটার নাম রিমকি। পুলকদের ডিপার্টমেন্টের না ও। অন্য ডিপার্টমেন্টের ছিল ও। রিমকির কোন বেস্ট ফ্রেন্ড পুলকদের সাথে পড়ত। ছন্দা। ওঁর সাথেই দেখা করতে আসত মেয়েটা। এই মেয়েটাকে পুলক দুই চোখে দেখতে পারত না। তবে এটাও চিন্তার বিষয় যে ঠিক কাকে যে পুলক পছন্দ করত এটাও বোঝা যেত না। বলা যায় যে ঠিক কোন কারণ ছাড়াই ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জনকেই পুলকের পছন্দ হত না সেই সময়। ছাত্র জীবনে। তবে রিমকিকে অপছন্দ করার যথেষ্ট কারণ ছিল। এক তো এটা এই মেয়ের ডিপার্টমেন্ট ছিল না। অথচ মনে হত পুলকই অন্য ডিপার্টমেন্টের আর রিমকি এই ডিপার্টমেন্টের। লাফালাফি। ন্যাকামী। ঢং করে কথা বলা। মানুষ অল্প পরিচয়ে কিভাবে এত ন্যাকা হয়ে যেতে পারে!! শুধু রিমকি না। এরকম বহু মানুষ দেখেছে সে। তার হতবাক লাগত। এরা এসে লাফালাফি জাপটা জাপটি করে। নারী পুরুষ ভেদাভেদ নেই। পুলক এসব পছন্দ করত না। পুলকের পছন্দ অপছন্দ সূক্ষ্ম মাপকাঠিতে রাখা। তার মতে মানুষের ভালো লাগা খুবই বিশেষ কিছু। এটা জোর করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বোঝানোর কিছু নাই। যে জিনিস যত জোর করে বুঝানো লাগে তার ভিত্তি তত দুর্বল। তাই কেউ যখন খেলাচ্ছলে কাউকে জড়ায়ে ধরে ভালো লাগা বুঝায় পুলক খুব বিরক্ত হয়। তার চরিত্রে সব কিছুকে মোটা দাগে বিচার করার একটা বিশেষ দিক আছে যেটা তাঁকে আর সবার সাথে মিশতে বাঁধা সৃষ্টি করে।
কিন্তু তখনের পুলক আর এখনের পুলকে কিছুটা পার্থক্য তো আছেই। সময় মানুষকে বিচক্ষণ করে তোলে। সময়ের চেয়ে বড় শিক্ষক বোধহয় আর কেউ নেই। এখন সে জানে যে খালি চোখে যা দেখা যায় তাই দিয়েই বিচার করা যায় না। কথার পিছনে কথা থাকে। দৃশ্যের পিছনে আরো অনেক না জানা ব্যাপার থাকে। যে ব্যাপারগুলো না জেনে কাউকে ভালো মন্দ বলে নির্দেশ করা ঠিক না। পুলক বরাবরই নিঃসঙ্গ। আগে তার এটা নিয়ে হাল্কা দুঃখবিলাস ছাড়া আর কিছু ছিল না। রীতা চলে যাওয়ার পর নিঃসঙ্গতা প্রকৃত রূপে অনুধাবন করেছিল সে। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর সারা দুনিয়াটাই যেন নাই হয়ে গেল তার কাছে। এখনো নাই হয়েই আছে। এরকম অবস্থায় অন্যকে ভালো মন্দ বলার অবস্থা থাকে না। তবে মানুষ তো প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক প্রাণী। পুলকের মত কিছু মানুষ যতই অসামাজিক হোক। তারাও ভিতরে ভিতরে তৃষিত থাকে দুই দণ্ড ভালো সময় কাটানোর জন্য। তাঁদের দুর্বলতাকে তারা আত্মঅহমিকার আড়ালে নিয়ে যায়। এতে সবাই শুধু আত্মঅহমিকাই দেখে। অসহায়ত্বটা দেখে না। দুর্বলতাটা দেখে না।
পুলক কফি শেষ করে বিল দিয়ে উঠে যাচ্ছিল। সেই সময় পিছন থেকে কে যেন কাউন্টারে ঝড়ের বেগে আসল। পুলক দেখল। রিমকি। এসেই সে বলল কাউন্টারে যে তাঁদের আরেকটা টেবিল লাগবে। আরো লোক আসছে। পুলক তার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করে বসল। সে রিমকির দিকে তাকিয়ে বলল-
- তুমি রিমকি না?
রিমকি ভুরু কুঁচকে পুলকের দিকে তাকিয়ে রইল। এটাই তার তাকানোর ভঙ্গি। আরো বেশ কিছুক্ষণ দেখল সে পুলককে। পুলকের কিন্তু বেশ মজা লাগছে। তার এই চেহারা মাঝে মাঝে তাকে পরিচিতদের সাথে কথা বলা থেকে বাঁচিয়ে দেয়। সে মিটিমিটি হাসছে। কিন্তু পুলককে অবাক করে দিয়ে রিমকি চিৎকার করে বলল-
- তুমি পুলওওওওওওক!!!!!! হাহাহাহাহাহাহা
বলে সে বিকট জোরে হাসা শুরু করল। পুলক একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। রিমকি যে এই রকম এটা সে জানত। কিন্তু এত বছর পরেও যে মানুষ এরকমই থেকে যায় তা কে জানত। তবে তার সাথে কখনোই ওই রকম খাতির ছিল না রিমকির। পুলক গায়ে পড়া ভাব সাব একদমই সহ্য করতে পারে না। যাইহোক!! এদিকে রিমকির হাসি তো থামে না। সে হাসতে হাসতেই বলছে-
- তোমার একি অবস্থা!! হি হি হি। আমি ভাবলাম যে আমি পাগল হলেও যোগাযোগ সুস্থদের সাথেই ছিল। এখন দেখি পাগলরাও আমাকে চিনে ফেলতেসে।
পুলক কিছু বলছে না। চুপ করে আছে। রিমকি এবার একটু সামলে নিল।
- সরি সরি!! আসলে অনেকদিক পর। তাও হঠাৎ করে। তাও আবার এই অবস্থায়।
- ইটস ওকে। আমি অনেক আগেই তোমাকে দেখসিলাম। সামনেই যখন চলে আসলা তাই ডেকে ফেললাম।
- তুমি ডাকস দেখে আমি আরো অবাক হইসি। তোমার মত ভোঁতা মুখের মানুষ আমি সারা জীবন খুব কম দেখসি। তোমাকে দেখলেই আমার ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে মন চাইত।
- কী?
পুলকের গলায় বিস্ময়। একই সাথে তার মধ্যে থাকা গাম্ভীর্য যেন অনেকটা তরল হয়ে গলে পড়ছে। অনেকদিন পর কেউ তার সাথে এত স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলছে। সে আবার বলল
- ধাক্কা দিতে মন চাইত মানে কী?
- মানে আমার যাকে পছন্দ হইত না তাকেই আমার ধাক্কা দিতে মন চায়।
পুলক হাসতে লাগল। বলল-
- তা অবশ্য ঠিক। কিছুটা ধাক্কা খাওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল।
- এখন নাই? আমার তো মনে হয় এখনো আছে।
পুলক বলল-
- আচ্ছা!! তাহলে তুমি যাও এখন। তোমার জন্য ওয়েট করছে।
পুলক রিমকির কোম্পানীদের দিকে ইশারা করল।
রিমকি বলল-
- তোমার সেল নাম্বার দেও। এখানে প্রায়ই আসো নাকি। আমি মাঝে মাঝেই এসে কফি খেয়ে যাই।
- আমার ঠিক নাই। একেক দিন একেক জায়গায়।
ওরা একজন আরেকজনের নাম্বার নিল। বিদায় নেওয়ার আগে রিমকি বলল,
- তোমার কোন একটা কাহিনী হইসে। আমি একদিন এসে কল দিব। সুন্দর এসে বলে যাবা। ওকে?
পুলক হেসে মাথা নেড়ে সায় দিল। দুজন দুজনকে বাই বলে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ পুলক ঘুরে রিমকিকে বলল,
- এই তোমার বয়ফ্রেন্ডের কী খবর?
রিমকিও চটজলদি উত্তর দিল।
- আছে। আগের মতই।
যে যার পথে চলে গেল।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ৩৩)
পুলক!!!! পুলক!!!! পুলক!!!! পুলক!!!!
ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠল পুলক। মা ডাকছে। হঠাৎ হঠাৎ রাতে দরকার হলে মা ডাকে। মা ডাকছে। জলদি তড়িঘড়ি করে উঠে মায়ের রুমের দিকে গেল পুলক। একি!! দরজা বন্ধ কেন!! তাড়াতাড়ি দরজা খুলল পুলক। লাইট জ্বালাল। মা কই? মা!! মা!! মা!! সারা ঘর খুঁজেও মাকে কোথাও খুঁজে পেল না পুলক। সে তখনো ঘুমের ঘোর থেকে বের হয়নি। সে যে স্পষ্ট শুনল মা তাকে ডাকছে। ফাঁকা ঘরে আবারো পুলক ডাকল,
- মা!! মা!! ও মা!!
আরেকবার ডাকতে গিয়ে পুলকের যেন সম্বিৎ ফিরল। সে স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্নের মধ্যেই মায়ের ডাক শুনতে পেয়েছে। কিছুক্ষণ জম্বির মত দাঁড়িয়ে রইল সে। রাত ৩টা। ঘরের সবকিছুতে ধুলা জমে আছে। এক মাসেই ধুলা জমে যায়!!
মায়ের বিছানায় বসল। বালিশ আর কোলবালিশ এক সাইড করে রাখা। বালিশটার উপর পরম মমতায় হাত বুলাচ্ছে পুলক যেন বালিশটাই আফরোজা। একটু একটু করে হাত বুলাচ্ছে আর একটু একটু করে চোখ ভরে যাচ্ছে মোটা ধারার অশ্রুতে। আস্তে আস্তে কান্নার দমক বাড়তে লাগল। ভেউ ভেউ করে কাঁদছে পুলক।
- আম্মা!! আম্মা!! আম্মা!! ও আম্মা!! আমার কত কষ্ট হচ্ছে আম্মা। বুকটার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে আম্মা। আম্মা!! আম্মা!! আমার কী কষ্ট হচ্ছে আম্মা!! আমার তো কেউ নাই আম্মা। তুমি তো সব জানো আম্মা।
শক্তপোক্ত একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ভোরের আলো ফোটার আগে আগে অসহায়ের মত বিলাপ করে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকি উঠছে। তাও পুলকের কান্না থামছে না। এখন তার বিলাপে কোন কথা বুঝা যাচ্ছে না। মনের সব দুঃখ কষ্ট কোন এক অজানা ভাষায় নিজের মৃতা মাকে বলে যাচ্ছে পুলক। বুক চাপড়াচ্ছে। যেখানে প্রচণ্ড কষ্ট জমা হয় সেখানে। আস্তে আস্তে সব কিছুই শান্ত হয়ে যায়। মায়ের বিছানাতেই পুলক গুটিসুটি মেরে কাঁপতে কাঁপতে শুয়ে পড়ে।
সময় সবকিছু ঠিক করে দেয়। আসলে কী কিছু ঠিক হয়!! হয় না। সময় মানুষকে কষ্ট সহ্য করার উপযোগী করে তোলে। সময়ের সাথে সাথে মানুষ কষ্ট সহ্য করতে শিখে নেয়। তা যে কষ্টই হোক না কেন! পৃথিবীতে এমন কোন কষ্ট নেই যা সহ্য করার ক্ষমতা মানুষকে সৃষ্টিকর্তা দেয়নি।
সকালে ঘুম ভাঙলেও পুলক বিছানা থেকে ওঠে না। কী হবে উঠে!! তার তো কোথাও যাওয়ার নেই। কিচ্ছু করার নেই। কারো তাকে দরকার নেই। সে উঠে কার কাছে যাবে!! মৃত্যু কি শুধু আফরোজারই ঘটেছে? পুলকও এক অর্থে মৃত। দুপুর পর্যন্ত সে শুয়ে থাকে। শুয়ে শুয়ে শরীর ব্যাথা হয়ে গেলে সে না পারতে ওঠে। ল্যান্ড ফোনটা বেজে যাচ্ছে। মামার বাসা থেকে হবে। খেতে ডাকছে। সে ফোন ধরে না। পাশের গলিতে মামার বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি হয় সে।
খেয়ে দেয়ে ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়ায় সে। যখন যে বাস পায় উঠে পড়ে। কত দূর দূর চলে যায় সে। জানালার পাশে বসে সে বাইরের দৃশ্য দেখতে থাকে। হঠাৎ কোন একটা জায়গায় নেমে যায় সে। সেখানে অনেকক্ষণ ছন্ন ছাড়ার মত ঘুরে বেড়ায় সে। আবার ফিরতি একটা বাসে উঠে পড়ে।
একদিন বাসে একটা ছোট বাচ্চা তার মাকে খুঁজে না পেয়ে সে কী কান্না শুরু করল। মা সামনের দিকে মহিলা সিটে বসা। যতই বাচ্চাকে বুঝানো হয় সামনের সিটেই মা আছে। সে কিছুতেই বুঝবে না। সে ভ্যা করে কাঁদছে আর বলছে তার মা হারিয়ে গেছে। পুলক কী মায়া নিয়ে ছোট ওই বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে রইল। সারা দুনিয়াতে এই ছোট বাচ্চাটাই যেন তার একমাত্র সমব্যাথী। খালি পার্থক্য এই যে বাচ্চাটা একটু পরেই তাঁর মাকে খুঁজে পাবে। পুলক কখনো পাবে না।
এভাবেই এক মাস চলে গেছে পুলকের। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়িয়ে সে কাটিয়ে দিচ্ছে। দূরে কোথাও যায় না সে। কাছাকাছির মধ্যেই থাকে। সন্ধ্যা হলে কোন একটা কফি শপে ঢুকে এক মগ কফি খায়।
এরকমই একটা কফি শপে ঢুকতে না ঢুকতেই রিমকিকে দেখতে পেল। সে একা একটা টেবিলে কফি খাচ্ছে আর কী একটা বই যেন পড়ছে। একটু পড়ছে আর একটু উদাস নয়নে দূরে কোথাও তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। আজও তার কপালে লাল টিপ। চোখে ঘন করে কাজল দেয়া। এটাই বোধহয় তার সাজ। আগে খেয়াল করেনি পুলক ওকে। খেয়াল করার মত মনেও হয়নি তাকে। এখনো যে খুব মনে হচ্ছে তাও না। সে ওঁর টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রিমকির দৃষ্টি আকর্ষণ করল। রিমকি দূরে কোথাও তাকিয়ে ছিল। অনেকক্ষণ সে খেয়ালই করল না যে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। যখন খেয়াল করল তখনও তার বাস্তব জগতে ফিরতে একটু সময় লাগল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ওঁর চেহারা পরিবর্তন হল। উদাসীন থেকে মুখটা হাসিতে উদ্ভাসিত হল।
- আরে তুমি?? বস বস।
পুলক হাসিমুখে বসল। বলল,
- আমি দূর থেকে দেখলাম তুমি উদাস নয়নে বসে আছ।
রিমকি বলল,
- উদাস তো আমরা সবাই-ই। কারোটা দেখা যায়। কারোটা দেখা যায় না। বাদ দাও। তোমার কী খবর বল!! তোমার সাথে আবার দেখা হয়ে গেল। বিশ্বাস কর আমি তোমাকে ফোন দিব দিব ভাবছিলাম দেয়া হয় নাই। কিন্তু মন থেকে যে ডাকছিলাম এই জন্যই হয়তো দেখা হয়ে গেছে।
পুলক মনে মনে ভাবছে যে মেয়েটা ভালোই নাটুকে সংলাপ জানে!! মনে মনে ডাকছিল!! হাহ!!
সে বলল,
- তা কী বই পড়ছিলে?
- আমি?? আমি সুনীল এর ‘একা এবং কয়েকজন’ পড়ছিলাম। তুমি পড়স এটা?
এক সময় পুলক ভালোই বই পড়ত। এই বইটা তার পড়া আছে। তার অনেক প্রিয় একটা বই ছিল। যদিও বইটা সে প্রথম পড়েছিল ক্লাস ফাইভে থাকতে। পরে আবার বড় হয়েও পড়েছিল। সুনীলের লিখা তার প্রিয়। একটা বয়সে তার অনেক বই-ই সে পড়েছে।
- হুম!! পড়সি।
- পড়স????????
খুব খুশি হয়ে গেল রিমকি। সে অনেক বই পড়ে। বলতে গেলে সে বই পাগল, বই পোকা। বই নিয়ে যা যা বলা যায় তা সবই সে। কিন্তু আশেপাশে বই নিয়ে কথা বলার মত মানুষ সে খুঁজে পায় না। অনিক, রিমকির প্রেমিক, সে তেমন বই পড়ে না। মুভি দেখতেই বেশি পছন্দ করে সে।
- হুম!! পড়সি তো!! আমার অনেক প্রিয় একটা বই। তাছাড়া সুনীল এর মোটা উপন্যাস আমার খুবই প্রিয়। ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’। এসবই আমার অনেক প্রিয়।
- ওয়াও!! তুমি বই পড়? আমিও না অনেক বই পড়ি। বলতে পারো বই ফ্রিক।
- আমি এখন আর পড়ি না। একটা সময়ে বেশ পড়তাম।
- তুমি ‘তিতাস একটা নদীর নাম’ পড়স?
- না।
- তুমি ‘সারেং বৌ’ পড়স?
- না
- তুমি মানিক এর ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ পড়স?
পুলক মাথা নাড়াল। তার আর মুখ দিয়ে এত ‘না’ বলতে ভালো লাগছে না। এই মেয়ে দেখি অনেক বই পড়ে। বই পড়া মানুষজন পুলকের খুব পছন্দ।
- আমি যদি তোমাকে বই গিফট করি তুমি নিবা?
- হুম! নিব।
- জানো? তোমাকে না আমার ‘সূর্য’ ডাকতে ইচ্ছা করছে। ‘সূর্য’ ডাকলে কী তুমি রাগ করবে?
পুলক মনে মনে হাসল মেয়ের ন্যাকামী দেখে। ‘সূর্য’ হল ‘সূর্যকুমার ভাদুড়ী’। ‘একা এবং কয়েকজন’-এর একটা পাগলাটে চরিত্র যে কিনা একাধারে বিপ্লবী, একরোখা গোঁয়ার প্রেমিক। খুবই আকর্ষণীয় চরিত্র। সে বলল,
- আমাকে ‘সূর্য’ মনে হওয়ার কোনই কারণ নেই। আমি অত নায়কোচিত নই।
- আমার ডাকতে ইচ্ছা হচ্ছে। তুমি রাগ করলে ডাকব না।
রিমকি এত সুন্দর করে বলাতে পুলক বলল-
- না!! এতে রাগের তো কিছু নাই।
সেই থেকে পুলকের আরেকটা নাম হল ‘সূর্য’।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ৩৪)
রিমকি বরাবরই বইয়ের পাগল। হেন বই নেই যা সে পড়ে নাই। অনিক তাঁকে এ নিয়ে অনেক ঠাট্টা করে। কিন্তু কারো ঠাট্টাতেই তাঁর কিছু যায় আসে না। বই তাঁর এমন এক সঙ্গী যে কখনো তাঁকে ছেড়ে যায়নি এবং যাবেও না। পৃথিবীর যাবতীয় অবহেলা ঔদাসীন্য মানুষ মানুষকে করে। বই কখনো মানুষকে অবহেলা করে না। উদাসীনতা দেখায় না। অনিকের এরকম কত শত বারের ঔদাসীন্য অবহেলার সময়ে এই হাজার হাজার বই তাঁর ওষুধ হিসেবে কতবার কাজ করেছে তাঁর ইয়ত্তা নেই। ৫ বছরের সম্পর্ক অনিক আর রিমকির। প্রথমে বন্ধুত্ব। এরপর প্রেম। স্বাভাবিক গতির সম্পর্ক। ৫ বছর পর যেন এখন অনেকটা অভ্যস্ততার জায়গায় এসে পৌঁছেছে সম্পর্কটা। প্রত্যেকটা সম্পর্কে একটা জাদু থাকে। একটা বিশেষ অনুভূতি। রিমকির দিক থেকে এটা বহুদিন ছিল। ঠিক কবে থেকে যে অনিকের দিক থেকে ভাটা পড়েছে তা ঠিক বোঝা যায় না। হয়তো শরীরের অজানা রহস্য ভেদের পর থেকে। কী জানি!! ঠিক বুঝতে পারে না সে। তবে হ্যাঁ, এটা বুঝতে পারে যে সম্পর্ক বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই একটা সম্পর্ক বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা। এই জিনিস কেউ বুঝবে না। সবার চোখে তাঁদের সম্পর্ক আদর্শ। হ্যাঁ, আদর্শই বটে। প্রতিদিন নিয়ম করে ফোনে কথা। কে কোথায় আছে। কী প্ল্যান সারাদিনের। খাওয়া দাওয়া হয়েছে কী না!! ব্যস!! এই তো!! এতদিনের সম্পর্ক। অনিক আর রিমকির প্রত্যেক বন্ধু বান্ধব তাঁদের সম্পর্কের কথা জানে। এমনকি একে অপরের আত্মীয়স্বজনরাও জানে। সবাই জানে কয়েকদিন পর তারা বিয়ে করবে। শুধু রিমকি জানে যে কিছু একটা ফাঁকা আছে। ছোট একটা গর্ত। যা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। হয়েছে। অনিককে বহুবার এই গর্ত ভরাটের জন্য অনুনয় বিনয় করেছে রিমকি। কখনো সরাসরি। কখনো ঘুরিয়ে। কিন্তু অনিক কখনো তা দেখেও দেখেনি। বা কখনো দেখতে চায়নি। রিমকি এখন আর চেষ্টা করে না। কিন্তু মাঝে মাঝে চিন্তা হয় তাঁর। তবে কী এভাবেই বাকি জীবন কেটে যাবে তাঁর!! এই অতৃপ্তি নিয়েই তাঁকে সম্পর্কের দায়ভার বয়ে নিয়ে যেতে হবে! কেউ ধরতে পারে না। কেউ বুঝতে পারে না। সবাই তাঁর উচ্ছল হাসিখুশি বাইরের খোলসটা দেখে আর ভাবে যে হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। রিমকিও নিজেকে এই কয়দিন বলে এসেছে যে হ্যাঁ সবই ঠিক আছে। অনিকের রাগ, নিদারুন অবহেলাকে সবসময়ই কম গুরুত্ব দিয়ে এসেছে সে। দোষ যারই থাকুক, সবসময় রিমকিই আত্মসমর্পণ করেছে। এত বছরের সম্পর্কে একটিবারের জন্যও অনিক নিজের রাগ আর অহমিকা থেকে নেমে আসেনি। কখনো জানতে চায়নি রিমকির মধ্যে কী হচ্ছে। রিমকিও কখনো নিজের ভিতরের অভিমানগুলোকে খুব বেশি পাত্তা দেয়নি। এই পাত্তা না দেওয়ার কাজটা অনেকটাই সহজ করেছে তাঁর বই পড়া। আশুতোষ, সুনীল, সমরেশ, বিভূতিভূষণ, মানিক এবং হুমায়ূন আহমেদেরা পূরণ করে দিয়েছে তাঁর ভিতরের ফাঁকা অংশ। তাই ভালোই আছে রিমকি। কোন অভিযোগ নেই তাঁর।
বই পড়া মানুষেরা আরেক বই পড়া মানুষের সঙ্গ খুব পছন্দ করে। কিন্তু সেরকমভাবে কেন জানি ওইরকম কাউকে খুঁজে পায়নি সে। পেলেও কেন জানি বন্ধুত্বের চেয়ে শত্রুতা বেশি হয়েছে তাঁর। কারণ একেক মানুষের রুচিবোধ একেক রকম। রিমকির মত সত্যিকারের পাঠক আশেপাশে খুব কম। বিভিন্ন লেখকের বই পড়েছে তাঁর বয়সী এরকম মানুষ সে আশেপাশে কমই দেখে। যদিও রিমকির এখনো মনে হয় যে সে কিছুই পড়েনি। আরও কত পড়া বাকি আছে তাঁর। এক আশুতোষ এর বই-ই তো এখনো পড়া শেষ করতে পারল না। সব বই পাওয়াও যায় না তাঁর। নীলক্ষেতে পুরান পুরান বইয়ের দোকান ঘেঁটে ঘেঁটে সে বই কেনে। এমনো হয়েছে যে তাঁর ব্যাগ ছিঁড়ে গেছে, জিনিসপত্র রাখা যাচ্ছে না। সে ব্যাগ ঠিক করাতে গিয়ে তা না করে পুরান পুরান দুইটা বই কিনে নিয়ে সব টাকা শেষ করে ছিঁড়া ব্যাগ নিয়ে হাসিমুখে বাসায় ফিরেছে। অনিক তাঁকে কতবার বকা দিয়েছে। কিন্তু বইরা যেন তাঁকে ডাকে। এই ডাক সে অগ্রাহ্য করতে পারে না।
অনেক বই পড়ার সুফল যেমন আছে। কিছু কুফলও বোধহয় আছে। অনেক অনেক বই পড়া রিমকিকে একজন স্বপ্নবিলাসী মানুষে রূপান্তরিত করেছে। বাস্তবের জগতেও তাঁর একটা পা থাকে। কিন্তু স্বপ্নের জগতে তাঁর যে পা-টা দেয়া, ওই পায়ের উপর ভরটাই যেন বেশি দেয়া। যার ফলে তাঁর সাধারণ কথাবার্তার মধ্যে একটু আবেগ থাকলেই তা কারো কারো কাছে অতি নাটকীয় মনে হতে পারে। আর দশটা মানুষ এইভাবে কথা বলে না। তবে হ্যাঁ, বৈপরীত্য ব্যাপারটা তাঁর চরিত্রে ব্যাপকভাবে রয়েছে। একই সাথে সে মুখ খুলে গালি দিতে পারে। আবার একই সাথে তাঁর মধ্যে ভাবজগতের বিস্তারও প্রবল। একই সাথে সে মুখ দিয়ে কথায় কথায় ‘বাল’ বলতে পারে। আবার একই সাথে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-এর শশী ডাক্তার আর কুসুমের বিচ্ছেদের ব্যাথা তাঁর বুকে টনটন করে বাজে। হাতে গোনা কিছু মানুষ প্রকৃতভাবে রিমকিকে চেনে। বাস্তবজগতের মানুষেরা শুধু হাসিখুশি আর পাগলামি ভরা রিমকিকেই চেনে। যেভাবে এতদিন পুলক চিনত। তবে পুলকের মত এত অপছন্দ মনে হয় রিমকিকে কেউ করত না। পুলকও বই পড়ে। তবে সে বাছা বাছা লেখকের বই পড়ে। সবার বই না। পুলকের মা তাঁকে বই পড়তে উৎসাহ দিতেন। কিন্তু সত্যিকারের বই পড়া বলতে যা বোঝায় তা সে রিমকিকে দেখেই বুঝল। বই পড়া আর বই-কে অনুভব করা, অনুধাবন করা। এ যে আকাশ আর পাতালের মাঝের পার্থক্যের মতই তা রিমকির সাথে কথা বলেই সে বুঝতে পারে। ব্যাপারটা তাঁকে আকর্ষণ করে। সে আর রিমকি মাঝে মাঝেই বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে কফি খেতে খেতে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা করে। মাঝে মাঝে রিকশায় ঘুরে বেড়ায়। পুলক অবশ্য একদিন রিমকিকে জিজ্ঞেস করল-
- আচ্ছা!! তুমি যে আমার সাথে ঘুরে বেড়াও। অনিক কিছু বলে না!!!
- নাঃ!!! ওঁর এসবে কোন মাথা ব্যাথা নেই।
আসলেই অনিকের এসব নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। তাঁদের সম্পর্কের মধ্যে হিংসা, অধিকারবোধ ব্যাপারগুলো কখনো ছিল না। রিমকিও এতদিন ব্যাপারটা পছন্দই করত যে তারা একে অপরকে কত বিশ্বাস করে। কত নিশ্চিন্ত তারা এই সম্পর্কে। একে অপরকে আর সবার মত সন্দেহ করে মাথা নষ্ট করে না। কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝে রিমকির মনে হয় যে যদি একটু হিংসা, একটু অধিকারবোধ থাকত। তাহলে খুব একটা খারাপ হত না। সম্পর্কতে যেন এসব কিছুটা জল আর বাতাসের মত।
পুলক আর কথা বাড়ায়নি। আসলে সে ধরতে পারেনি। উদারতা নামক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের বেলায় ছিল না। সে কাউকে ভালোবাসে আর সে অন্য কারো সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা সে কল্পনাও করতে পারে না। রীতার বেলায় এরকম ভাবলেও তাঁর গা জ্বলে যেত। তবে হ্যাঁ, এটাও সে জানে যে নিরাপদ সম্পর্কে এত জ্বলুনি থাকে না। কিন্তু অধিকারবোধের বেলায় পুলকের অনুভূতি বরাবরই তীব্র। যা তাঁর তা শুধু তারই। এখানে সে অন্য কাউকে ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। রীতা অবশ্য তাঁর এই ব্যাপারটা পছন্দই করত। যাইহোক, পাছে রিমকি তাঁকে ব্যাকডেটেড আর সাম্প্রদায়িক মনে করে তাই সে এসব নিয়ে কিছু বলে না। সে নিঃসঙ্গ মানুষ। তাঁর কাছে এই মেয়েটির সঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সময় ভালো কাটে। সে সারা রাত রিমকির দেয়া একেকটা বই পড়ে। আর এসব নিয়ে আলোচনা করার জন্য সন্ধ্যায় রিমকির জন্য অপেক্ষা করে। তবে রাতেও তাঁদের কথা হয়। রিমকির রাতে টানা ঘুম হয় না। মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন তাঁর অনেক ভয় লাগে। এরকম সময়ে রিমকি অনিককে ফোন দেয়। কিন্তু অনিক খুব কম সময়ই ফোন ধরে। অনিকের ঘুম খুব গভীর। প্রথমদিকে অনিক ধরত। এখন বলতে গেলে ধরেই না। এখন প্রায় প্রতি রাতেই সে পুলককে ফোন দেয়। বেশীক্ষণ না। ৫ মিনিট কথা বলেই আবার ঘুমে ঢলে পড়ে রিমকি। কিন্তু এই ৫ মিনিটের কথা বলার জন্য পুলক অবচেতনভাবে অপেক্ষা করে প্রতি রাত। রিমকির ফোন রাখার পর সেও ঘুমে ঢলে পড়ে।
এভাবেই এই দুই চরিত্রের মধ্যে এক ধরনের অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়ে ওঠে। দুইজনের মধ্যের যে ফাঁকা অংশ তা দুইজন নিজেদের অজান্তেই ভরাট করতে থাকল। গল্প করতে করতে কথা বলতে বলতে একে অপরকে যেন নতুন করে চীনতে লাগল তারা। আগের কথা তুলে দুইজনই খুব হাসে। ৩-৪ বছর আগে কেউ কাউকে দেখতে পারত না। অথচ এখন তারা কত কথা বলে। পুলকের এখন এক ন্যাকা ঢঙ্গি মেয়েটার সাথেই অনেক কথা হয়। রিমকিরও এই মুখ ভোঁতা ছেলের সাথেই এমন অনেক কথা হয় যা অনিকের সাথে হয় না।
অনিক বোধহয় কিছুটা খুশি যে রিমকির এসব পাগলামি ভরা কথাবার্তা এখন আর তাঁকে শুনতে হয় না। সে শুনতও না। রিমকিও বহু আগেই অনিককে প্রাণের কথা, মনের কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে। পুলককে পাওয়ার পর থেকেই এখন সে আরো বলে না।
পুলক আবার নতুন করে ‘একা এবং কয়েকজন’ পড়ছে। সূর্য চরিত্রটা নতুন করে জানার জন্য। মজার একটা জিনিস খেয়াল করল পুলক। বইগুলোর স্বাদ যেন একেক বয়সে একেক রকম। সদ্য কৈশোরে যাওয়া পুলক যখন প্রথম বইটা পড়েছিল। তখন সূর্যর আদিম ভালোবাসাবাসির বর্ণনা পড়তেই বেশি ভালো লাগত। আরেকটু বড় হয়ে যখন পড়ল তখন প্রেমের মানে বুঝল। এখন যখন পড়ছে তখন এসবকে ঠুনকো মনে হচ্ছে। বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে গভীর জীবনবোধ।
পুলক পড়ে আর হতাশ হয়। নাঃ!! সূর্য হওয়ার কোন যোগ্যতাই তাঁর মধ্যে নাই। সূর্য স্বেচ্ছাচারী। গোঁয়ার। যা সে চায় তাঁর জন্য সর্বস্ব সে দেয়। প্রয়োজন হলে কেড়ে নেয়। এসব কিছুই পুলকের মধ্যে নেই। তারপরেও যে ঠিক কি মনে করে রিমকি তাঁকে ‘সূর্য’ ডাকে তা রিমকি-ই জানে। কিন্তু পুলকের এই আফসোস বেশীদিন টিকল না। প্রেম নামক অনুভূতির চরম তীব্রতা তাঁকে অদূর ভবিষ্যতে সূর্য না হোক, তাঁর মতই কারোর আবির্ভাব ঘটাল।
রাত তিনটা। আজকে পুলক বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। রিমকির ফোন। ফোন ধরল পুলক। রিমকি ঘুম জড়ান কণ্ঠে কথা বলছে। পুলকের খুব ভালো লাগছে ওঁর কণ্ঠ শুনতে। কিছুক্ষণ কথা বলে দুইজনই চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। একটু যেন বিরতি।
গভীর রাত। একটি ঘুম জড়ানো নারী কণ্ঠ। কিছুটা রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া। কিছুটা অবচেতনভাবে কাউকে পাওয়ার ইচ্ছা, চাওয়ার চেষ্টা। এসব থেকেই পুলক রিমকিকে সেই ঘুম ঘুম স্বপ্ন স্বপ্ন জগত থেকে ডাকল।
- রিমকি!!!
- হুম!!!
পুলক বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল-
- কাছে আস।
মুহূর্ত যেন ঠিক ঐ জায়গায় থেমে গেল। রিমকির শরীর ঐ ডাকে কোন এক অজানা কারণে অবশ হয়ে শিরশির করে উঠল। ব্যাখ্যার অতীত অনুভূতি বলে যদি কোন কিছু থেকে থাকে এ তবে তা-ই। বা হয়তো আশুতোষ, সুনীল, সমরেশ বা হুমায়ূন আহমেদ এই অনুভূতির যথার্থ ব্যাখ্যা দিতে পারতেন।
ঠিক যেন এক যুগ কেটে গেল।
মাতাল করা এক অনুভূতি নিয়ে রিমকি অস্ফুট স্বরে প্রত্যুত্তর করল-
- আসছি।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ৩৫)
কিছু মানুষ আবেগ দেখাতে পারে না। বা পারলেও দেখাতে পছন্দ করে না। আবেগ দেখানোকে তারা দুর্বলতা মনে করে। এদের মধ্যে অনেকে এরকম ভাবতেও পছন্দ করে যে তাঁদের মধ্যে হয়তো আবেগ নেই। কিন্তু হাস্যকর হলেও সত্যি যে এই ধরনের মানুষদের মধ্যেই নির্ভেজাল আবেগের অস্তিত্ব বেশী থাকে। তাঁর প্রকাশও ঘটে এমনভাবে যাতে তারা নিজেরাও অবাক হয়ে যায়। যেরকম অবাক পুলক হচ্ছে।
প্রেমিক পুরুষ ভাবার মত কোন গুণাবলী পুলকের আছে বলে তাঁর কখনো মনে হয়নি। রীতার সাথে সম্পর্কের পর সে বুঝেছিল যে আসলেই প্রত্যেক মানুষের মাঝেই হয়তো প্রেম লুকানো থাকে। সেই প্রেম প্রকাশিত হয় সেই প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে।
পুলকের একটা ডায়েরি ছিল। সেই ডায়েরিতে সে রীতাকে চিঠি লিখত। যখনই তাঁর রীতার কথা মনে হত। তখন-ই লিখত। রীতাকে তো আর সব সময় পাওয়া যেত না। মাঝে মাঝে ডায়েরিটা রীতাকে দেখাত। রীতা পড়ত। আবেগাপ্লুত হত। এমন কিছু লিখা থাকত না। আবেগের সময়ের বেশীরভাগ কথাই পরে পড়লে খুবই লজ্জা লজ্জা লাগত পুলকের। তাও লিখত। চিঠি লিখার সময় তাঁর মনে হত সে যেন সে যেন রীতার সাথে কথা বলছে। আর রীতা চুপ করে শুনছে।
জীবন অদ্ভুত। সেই ডায়েরি পড়ে আছে ঘরের কোণে। অনাদরে। অবহেলায়। ধূলায়। কিন্তু আজো পুলক চিঠি লিখছে। রিমকিকে। কতদিন পর পুলকের মন আবেগে দ্রবীভূত। কতদিন পর পুলকের বুকে দ্রিম দ্রিম করে আওয়াজ হচ্ছে। এত দ্রিম দ্রিম আওয়াজ যেন কখনো বাজেনি।
সেইদিনের সেই ডাকের কোন ব্যাখ্যা পুলক খুঁজে পায়নি। সেই ডাকের প্রত্যুত্তরে রিমকির সাড়া দেওয়ার ব্যাখ্যাও রিমকি পায়নি। খালি বুঝেছিল বুকের এমন এক জায়গায় স্পর্শ পেয়েছে যে জায়গাটা অবশ হয়েছিল। পা ঝিম ঝিম করলে যেমন হাজার চিমটি দিয়েও পায়ের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। বুকের ঐ জায়গাটাও যেন অনেকদিন ধরে অবশ হয়েছিল। হঠাৎ করে ঝিম ঝিম শেষ হয়ে গেলে পায়ে যেমন শিরশিরানি দিয়ে পায়ের অস্তিত্ব ফিরে আসে। পুলকের ডাকে যেন ঠিক ওইভাবে বুকের ঐ অবশ জায়গাটার অস্তিত্ব ফিরে এসেছিল। একই সাথে খুব আনন্দ আর খুব বেদনা হয়েছিল রিমকির। আনন্দ নিজের হারানো অনুভূতির অস্তিত্ব ফিরে পাওয়ার। আর দুঃখ হল ঠিক যে জায়গা থেকে ডাকটা আসার ঠিক সে জায়গা থেকে ডাকটা না আসায়।
‘নীতিবোধ’ খুবই কৌতুকময় একটা ব্যাপার। জীবনে সুবিধাজনক জায়গায় থেকে এই নীতিবোধকে কোলে নিয়ে সমাজের সাধারণ মানুষেরা অনেক ঠিক বেঠিকের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। কিন্তু আসলে এই নীতিবোধ যে কতটা ঠুনকো তা মানুষ তখনই বুঝে যখন তাঁদের নীতিবোধের সাথে প্রবল আবেগের সংঘর্ষ হয়। যেমন হয়েছে পুলক আর রিমকির।
খালি চোখে, মোটা দাগে সবাই দেখবে রিমকি আর অনিকের সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় মানুষ হিসেবে পুলকের আগমন। হয়তো পুলক পুরুষ বলে ক্ষমা পেয়ে যেতেও পারে এই সমাজের কাছে। কিন্তু কেউ কি রিমকি কে ক্ষমা করবে? করবে না। কেউ দেখবে না পুলকের শূন্যতা। কেউ দেখবে না রিমকির অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তি। কেউ দেখবে না কি আশ্চর্য অবর্ণনীয় এক সম্পর্কে তাঁরা আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। কেউ না। পুলক আর রিমকি যদি এখানে না থাকত তাহলে তারাও বুঝত না।
সেইদিনের ঐ ডাকের পর কফি খেতে গিয়ে আগের দিনগুলোর মত কথা যেন জমে উঠছিল না। দুজনেই চুপ। রিমকি তখনো রাতের সেই ডাকের আবেশে আবেষ্টিত। তাঁর খালি মনে হচ্ছে শেষ কবে অনিক তাঁকে ডেকেছিল। একটু আবেগ নিয়ে। একটু নরম হয়ে। কবে!!! স্মৃতির পাতা তন্ন তন্ন করেও তো খুঁজে পাচ্ছে না রিমকি। সবসময় রিমকি-ই ডেকেছে। আকুল হয়ে। একবারের জন্যও অনিক ডাকেনি। একটা সময় রিমকিও ডাকা বন্ধ করে দিয়েছে। নিজের অজান্তেই। তাতেই হয়তো বুকের ভিতরের ঐ জায়গাটা অবশ হয়ে গিয়েছে। আজ অনেকদিন পর অন্য এক পুরুষের ডাকে শরীর অবশ হয়ে এল।
এসব ভাবতে ভাবতেই হয়তো রিমকির চোখ পানিতে ভরে গিয়েছিল। পুলক এক দৃষ্টিতে রিমকিকে দেখছে। রিমকির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ছল ছল করছে কিন্তু পানি পড়ছেনা। অবশেষে এক ফোঁটা পানি মোটা দাগে গড়িয়ে পড়ল। পুলক হাত বাড়িয়ে রিমকির চোখের পানি মুছতে গাল স্পর্শ করল। পুলকের হাত রিমকির গালে স্পর্শ হতেই যেন রিমকি শিউরে উঠল। রিমকির শিউরে ওঠা দেখে পুলক চমকে গিয়ে হাত সরিয়ে নিতে গেল। কিন্তু রিমকি পুলকের হাত ওঁর গালে চেপে ধরল।
আরেকটা মুহূর্ত। ব্যাখ্যাহীন
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ৩৬)
সবকিছু জেনেও একটা অসম্পূর্ণ আর অনিশ্চিত সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গেল রিমকি আর পুলক। যদিও কোন সম্পর্কই নিশ্চিত নয়। তারপরো মানুষ স্বপ্ন দেখে নিশ্চিত ভবিষ্যতের। অনেক পরে গিয়ে মানুষ বুঝতে পারে যে ভবিষ্যৎ কখনোই নিশ্চিত হতে পারে না। ভবিষ্যৎ কখনোই নিশ্চিত না।
এতকিছুর পরেও মানুষ ভাবতে পছন্দ করে পাশের এই মানুষটি তাঁর। এই মানুষটির সাথে তাঁর বিয়ে হবে। একে নিয়ে তাঁর সংসার হবে। তাঁদের একটা সুন্দর বাবু হবে। তাঁদের জীবন অনেক রঙ্গীন হবে। সুখে দুঃখে একে অপরের সাথে কাটিয়ে দেবে। এটা পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিক-প্রেমিকার মনে কথা। হতে পারে সেই প্রেমিক-প্রেমিকা ক্লাস টেনে পড়ে। আবার হতে পারে সেই প্রেমিক-প্রেমিকা পুলক আর রিমকির বয়সী। সবাই একভাবেই স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে।
সমস্যা হয় অনিশ্চিত আর অসম্পূর্ণ সম্পর্কগুলোর বেলায়। যেমন পুলক আর রিমকির সম্পর্ক। চাইলেই আর ১০টা ৫টা সম্পর্কের মত এরা স্বপ্ন দেখতে পারবে না। চাইলেই পুলক ভুলতে পারবে না যে সে এখানে একজন তৃতীয় পক্ষ। চাইলেই রিমকি ভুলতে পারবে না যে তাঁর উপর প্রথম অধিকার অনিকের, পুলকের না। এই চরম সত্যিগুলো মানুষকে লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক বড় বড় কষ্ট দেয়। এমন কষ্ট যে কষ্ট পাশের মানুষটিকেও বলা যায় না। কারণ পাশের মানুষটিও তো তাঁর মতই অসহায়। অন্য কাউকেও বলা যায় না। সমাজের প্রতিনিধিরা এই সম্পর্কের বিচার করবে যুক্তি দিয়ে, আবেগ দিয়ে না। পৃথিবীর কোন বিচার-ই মনে হয় আবেগ দিয়ে হয় না।
পুলকের এই বিশাল শূন্য জগতটায় সে রিমকিকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। তাঁর হারানোর কিছু নেই। অনিক নামে একজনের বাগদত্তার পিছনে যে সে অনৈতিকভাবে ছুটে বেড়াচ্ছে। তা সে বুঝতে পারলেও একটুও পাত্তা দিতে চাইছে না। কেন শুধু সে অন্যের কথা ভেবে যাবে!! কেন!! একটা সময় ছিল যখন সে রীতার ভাল মন্দ, সুযোগ-সুবিধা ছাড়া কখনো কিছু চিন্তা করেনি। নিজের কোন দাবি উত্থাপন করেনি। সব মেনে নিয়েছিল। কই রীতার তো তাঁকে ছেড়ে যেতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি। রীতার মা তাঁকে বিচার করার আগে তাঁর মায়ের জীবনকে বিচার করেছে। তাঁকে তো কেউ এক বিন্দু ছাড় দেয়নি। সে কেন তাহলে এই দুনিয়ার তাবৎ লোকদের নিয়ে চিন্তা করতে যাবে। সে কাউকে পরোয়া করে না। ঠিক বেঠিকের সংজ্ঞাও সে বুঝতে চায় না। ভাবতে চায় না।
এসবই রাগের কথা। অভিমানের কথা। পুলকের যুক্তিবাদী মন ঠিকই ভাবে ভুল ঠিক নিয়ে। প্রতিরাতের ছোট্ট একটা মুহূর্তে সে ভাবে আজকে রিমকিকে গিয়ে বলবে যে এটা ঠিক হচ্ছে না। অনিকের সাথে অন্যায় হচ্ছে। আমাদের আর দেখা করা উচিৎ হবে না। কিন্তু রিমকিকে দেখলেই এসব কথা সে ভুলে যায়। তাঁর কাছে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ঠিক কাজ রিমকির সাথে সময় কাটানো। ওঁর লাল গোল টিপ আর কাজল ঘন চোখ দেখা। ওঁর গাল ছুঁয়ে ওকে শিউরে দেয়া।
পুলক এখন সকাল করে বের হয় রিমকির সাথে। রিমকিকে রিমকির অফিসে নামিয়ে দিয়ে সে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় রিমকির অফিস শেষ না হওয়া পর্যন্ত। তারপর তাঁরা একসাথে ফেরে। পুলকের মাঝে মাঝে এমন এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয় যা তাঁর আগে কখনো হয়নি। অনুভুতিগুলো তাঁকে একই সাথে অবাক করে, আবার রোমাঞ্চিতও করে। রাতের বেলা রিমকির পাশে হাঁটতে হাঁটতে যখন রিমকি গোল চাঁদ দেখে বাচ্চাদের মত খুশী হয়ে যায়। তখন তাঁর খুব ইচ্ছা করে এখনই আকাশটা বেয়ে উপরে উঠে চাঁদটা পেড়ে নিয়ে আসে। এখন চাঁদ যে কোন নারিকেল বা আম না এটা মনে করে তাঁর ফোঁস করে রাগ উঠে। তাঁর ইচ্ছা করে সারা পৃথিবীটা যদি সে রিমকির সামনে এনে ফেলে দিতে পারত!! নিজের মনে এসব ভাবে আর হাসে পুলক। রিমকি না হয় পাগল!!! অনেক বই পড়েছে। ওঁর পক্ষে এসব চিন্তা ভাবনা করা স্বাভাবিক হতে পারে। কিন্তু তাঁর মত যুক্তিবান একজন মানুষের এরকম চিন্তা ভাবনা হাস্যকরই বটে। কিন্তু তাও কেন একটুও হাস্যকর লাগে না। কেন মনে হয় এরকমই হওয়ার কথা ছিল।
শুধু এটুকুই না। আরো কিছু ব্যাপার পুলকের অদ্ভুত লাগে। পুলক সিনেমায়, নাটকে, টেলিফিল্মে বহুবার দেখেছে যে নায়ক নায়িকা একে অপরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মানে ন্যাকামীর চূড়ান্ত। এভাবে কেউ কারো দিকে তাকায় থাকে নাকি!! তাও আবার পাবলিক প্লেসে!! সবকিছুর একটা সীমা থাকা উচিৎ। কিন্তু সব সীমা পরিসীমা লঙ্ঘন করে পুলক যখন রিমকির চোখে তাকায় তখন দুই জোড়া চোখ যেন আটকে যায়। যেন চোখ না, চুম্বক। এক মুহূর্তের জন্যেও মনে হয় সরানো যাবে না। হার মেনে নেয় রিমকি-ই। পুলকের দৃষ্টি তাঁকে অবশ করে দেয়। ঐ তীব্র চাহনি তাঁকে অস্থির করে তোলে, পাগল করে তোলে।
রিমকি নানাভাবে চিন্তা করে। যা হচ্ছে তা সাদা চোখে অন্যায়। তাহলে কেন তাঁর অন্যায় মনে হচ্ছে না। কেন তাঁর মনে হচ্ছে যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে। রিমকির নীতিবোধ প্রবল। হ্যাঁ, তাঁর অনেক ছেলেবন্ধু। বহু ছেলে তাঁকে অন্যভাবে চেয়েছে। সে কাউকে পাত্তা দেয়নি। বুঝিয়ে দিয়েছে তাঁদের যে ঠিক কতটুকু তাঁদের অধিকার। তাহলে পুলকের একটা ছোট ডাকে সে কেন পাগলের মত হয়ে গেছে। কেন ওঁর একটা ছোট স্পর্শে শরীর এভাবে শিউরে উঠছে। কেন ওঁর চাহনি তাঁকে সম্মোহন করে রাখছে। এত্তগুলা ‘কেন’ এর কোন উত্তর সে খুঁজে পাচ্ছে না। অনিকের উদাসীনতা আজকের নতুন নয়। বহুদিনের। তাই এখানে অনিক কে দোষারোপ করা যায় না। অনিক কে কোনভাবেই দোষারোপ করা যায় না। ও সব সময়ই এরকম। ওঁর যা ঠিক মনে হয় তা-ই ঠিক। ওঁর রাগ। ওঁর অভিমান। এসবই এতকাল মেনে নিয়েছে রিমকি। অনিকের বন্ধু বান্ধব, অনিকের জগত তাঁর জগত। অনিকের বন্ধুরা ওকে খুঁজে না পেলে রিমকিকে ফোন দেয়। মাঝে মাঝে তাঁরা শুধু রিমকির সাথেই কথা বলতে চায়। হঠাৎ কোথা থেকে পুলক এসে তাঁর পুরো অন্তরটা জুড়ে বসল তাঁর ‘সূর্য’ হয়ে। শুধু তাঁর। এই ‘সূর্য’ রীতারও না। শুধু রিমকির। ঐ তাকানো। তাঁকে দেখার জন্য আকুলি বিকুলি। এসবই শুধু রিমকির জন্য।
এই ব্যাপারটাও রিমকির দারুণ অসহ্য লাগে। মানতে পারে না। এক তো এই ছেলেটাকে সে দুই চোখে দেখতে পারত না। এরকম গোমড়ামুখো আনসোস্যাল ছেলে তাঁর খুব অপছন্দ। সেই ছেলের জন্য সে এরকম পাগল আর দিশেহারা হয়ে গেল। মাত্র এক মাসের মধ্যে!! কীভাবে সম্ভব। তাও এই সময়ে। সৃষ্টিকর্তার এ কী ধরনের খেলা।
আরেকটা ব্যাপার হল যে রিমকি কখনো হিংসুটে ছিল না। আর দশটা মেয়ের মত তাঁর অন্য মেয়েদের নাম শুনলে গা জ্বালা করে না। অনিকের বান্ধবীদের সাথেও তাঁর অনেক খাতির। কখনো কাউকে নিয়ে তাঁর হিংসা হয়নি। কিন্তু পুলকের মুখে রীতার নামটা কেন সে সহ্য করতে পারে না তা সে বুঝতে পারে না। রীতার নাম বলতে গেলে পুলকের চোখটা বাড়তি উজ্জ্বল হয়ে যায়। একদিন খুব মজা করে ফোনে কথা বলার সময় পুলক ভুলে ওকে ‘রীতা’ ডেকে ফেলেছিল। রিমকি বুঝেও ব্যাপারটা না বোঝার ভান করেছে। যা অপ্রস্তুত হওয়ার পুলক হয়েছে। রিমকি জানে যে এত সহজে ঐ জায়গাটা কাউকে দেয়া যায় না। সবার আলাদা জায়গা। যেমন রিমকি চাইলেও হয়তো অনিকের জায়গা পুলককে দিতে পারবে না। পুলকের জন্য নতুন জায়গা তৈরি হবে। ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। সেই জায়গার তীব্রতাতে দিশেহারা রিমকি। এত তীব্রতা, এত ভালোবাসা সে আগে কখনো পায়নি। তাঁর একটু মাথা ব্যাথা। একটু কষ্ট হলেই পুলক ওষুধ, খাবার দাবার নিয়ে হাজির। মন খারাপ থাকলে যেখানেই থাকুক চলে আসবে। হাত ধরবে। হাত ধরার যে আলাদা কোন রোমান্টিকতা আছে এটা এতকাল রিমকি বইয়ে পেয়েছে। বাস্তবে পায়নি। বাস্তবে অনিক এসব আদিখ্যেতা পছন্দ করে না।
মজার কথা হল পুলকও এসব আদিখ্যেতা পছন্দ করে না।কিন্তু রিমকির কাছে আসলে তাঁর সব গোলমাল হয়ে যায়। রিমকি তাঁকে টানে। যেভাবে পোকাকে আলো টানে। ঠিক সেভাবে। সকালে দুপুরে বিকালে রাতে নিয়মানুবর্তীভাবে অনিকের ফোন আসে রিমকির ফোনে। অনিকের ফোন আসলেই পুলকের চেহারা শক্ত হয়ে যায়। সে কিছুতেই এটা মানতে পারে না। কিন্তু তাঁর কিছু করার নেই। এখানে মানতে না পারার অধিকার অনিকের আছে। পুলকের নেই। পুলক এখানে উপযাচিত।
পুলকের এই অসহায়তা রিমকি টের পায়। তাঁর এত মায়া লাগে এই বড় সড় দেখতে শিশুটাকে। খুব আদর করতে ইচ্ছা হয়। মাঝে মাঝে করেও গাল ধরে। বাচ্চাদের মত করে। রাস্তায় কেউ রিমকিকে দেখলে, পুলক তীব্র চোখে সেই ব্যাক্তির দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে চোখ বড় বড় করে। তাঁর চোখের ভাষা পড়তে পেরে রিমকির দিকে তাকিয়ে থাকা ব্যাক্তি অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নেয়। ঐ লাল গোল টিপ, ঐ চোখ, ঐ মানুষটা শুধু তাঁর জন্য। আর কারো কোন অধিকার নেই। থাকলেও সে মানে না। না!!! না !!! না!!! মানে না সে। কখনো মানবে না। পৃথিবী ছারখার করে দেবে সে।
হাতির ঝিলে একটা ছোট ফুটওভার ব্রিজে একবার ঘুরতে গিয়েছিল ওরা। ঘুরতে বলতে এমনিতে যাওয়ার পথে দাঁড়িয়েছিল। কোন এক অদ্ভুত কারণে দুজনেরই সে জায়গাটা পছন্দ হয়ে যায়। মাঝে মাঝেই মন দ্রবীভূত থাকলে তাঁরা সেখানে চলে যায়। আজকেও তাঁরা সেখানে যাচ্ছে। ব্রিজের কর্নারের জায়গাটা রিমকির প্রিয়। কিন্তু তাঁদের জায়গাটার দিকে অন্য কেউ যাচ্ছে। সেই অন্য কেউ তাঁদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তাঁরা এখনো রাস্তায়। লোকটা ব্রিজের সিঁড়িতে পৌঁছে গেছে।
রিমকি বলল-
‘ইস! আজকে যদি ঐ জায়গাটা পাওয়া যেত’
পুলক এক মুহূর্ত দেখল জায়গাটা। আরেকবার দেখল রিমকির চেহারা। তারপর শুরু করল দৌড়। রাস্তার মধ্যে দিয়ে গাড়ি টাড়ির দিকে একটুও মনোযোগ না দিয়ে পাগলের মত দৌড়াচ্ছে সে। ঐ জায়গাটা তাঁকে নিতে হবেই তাঁর রিমকির জন্য। চাঁদ না আনতে পারুক এটা পারতেই হবে।
পুলক দৌড়াচ্ছে। তাঁর মাথা ভর্তি চুল উড়ছে। একবার পিছন ফিরে দেখল সে রিমকিকে। রিমকি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুলক স্মিত হেসে দৌড়াতে থাকল। ঐ জায়গাটা তাঁকে পেতেই হবে।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ৩৭)
হাতির ঝিলের ছোট ফুটওভার ব্রিজে দুইজন মানব-মানবী দাঁড়ানো। পুলক আর রিমকি। খুব বাতাস। রিমকির খুলে রাখা চুল উড়ছে। পুলক মুগ্ধ নয়নে ওকে দেখছে।
রাতের বেলা। অনেক বাতাস। দুজন দুদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। মাঝে মাঝে একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ পুলকের খুব হাসি পেল। এ ধরনের দৃশ্য বাংলা টেলিফিল্মে দেখা যায় যে নায়ক নায়িকা দুইজন দুইদিকে ফিরে একে অপরের সাথে কথা বলছে। পুলকের খালি মনে হত এদের সমস্যা কী!! এরা স্বাভাবিক মানুষের মত কথা বলতে পারে না!! এরকম ত্যারা ব্যাকা হয়ে কথা বলার কী মানে!! অথচ এখন মনে হচ্ছে এটাই ঠিক।
হঠাৎ রিমকি বলল-
- আমি অনিককেই বিয়ে করব। সম্পর্কের দায়বদ্ধতা থেকে আমাকে তাই করতে হবে। কিন্তু ও কখনো জানবে না আমার ভেতরে কতটা তোলপাড় করে আমি ওঁর সাথে থাকব। একজনের বুকে শুয়ে আমি আরেকজনের কথা ভাবব।
পুলক কিছু বলল না। কী বলার থাকতে পারে তাঁর এখানে? সে শুনে যায়।
রিমকি বলে যায়।
- আমার সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে তোমার কাছে চলে আসতে ইচ্ছা হচ্ছে।
রিমকির চোখ টলমল করছে।
পুলক ওঁর গালে হাত রাখল। সেই স্পর্শ। অনেকক্ষণ এরা যেন এইভাবে স্ট্যাচু হয়ে রইল। রাস্তা দিয়ে যাওয়া কিছু মানুষ এই দৃশ্য দেখল। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত ছেলেগুলো উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বাকিরা যে যার মত চলে গেল।
রিমকির যতই পুলকের কাছে চলে আসতে ইচ্ছা হোক। একটা বিশাল দায়বদ্ধতা অনিকের প্রতি তাঁর আছে। একজন বন্ধু হিসেবে। একজন প্রেমিক হিসেবেও। ৫-৭ বছরের সম্পর্কে কত ভালো-খারাপ মুহূর্ত। কত স্মৃতি। চাইলেই এসবকে তুচ্ছ করা যায় না। যা হচ্ছে তা তো একদিক দিয়ে অন্যায়ই। কিন্তু অনিক তাঁকে কথা বলার সেই সুযোগ দিচ্ছে না। ওঁর সাথে কথা হয়ে উঠছে না।
রাতে অনিক ফোন দিল নিয়ম অনুযায়ী।
- কী অবস্থা? কী কর?
- এই তো মাত্র ফিরলাম। শুয়ে আসি।
- আজকাল খুবই ব্যস্ত থাক মনে হয়!!!
- তা তো একটু থাকি-ই। অফিস করে বাসায় আসতে আসতে রাত হয়ে যায়।
- না!!! আজকাল ব্যস্ততাটা একটু অন্যরকম।
রিমকি কিছুটা চমকে উঠল। অনিক কি কিছু বুঝতে পারছে? ও তো এরকম খোঁচাখুঁচি করে না। তক্ষুনি ওঁর মনে হল অনিককে তাঁর সব খুলে বলা উচিৎ।
- দেখ অনিক!! খোঁচাখুঁচি করে তো লাভ নাই। আসো সামনা সামনি কথা বলি। আমি তোমার বাসার সামনে আসতেসি। তুমি নামো। আমরা কথা বলি।
- না! আমি তোমার সাথে কোন কথা বলব না।
- আমি আসতেসি। তোমার ইচ্ছা হলে নেমো। নইলে নেমো না। কিন্তু আমি আসতেসি।
অনিক ফোন কেটে দিল।
রিমকি রিক্সা করে অনিকের বাসার দিকে গেল। রিমকির চোখ জ্বলছে। ফোনা বাজছে। পুলক। ফোন ধরল রিমকি। পুলককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে বলল,
- পুলক!! তোমাকে আমি কিছুক্ষণ পরে ফোন দেই? ওকে।
রিমকি অনিকের বাসার সামনে পৌঁছে গেছে। রিমকি ফোন দিল অনিককে। অনিক ফোন ধরল।
- আমি তোমার বাসার নিচে।
- আমি তো বলসি আমি নামবো না। তা তুমি বাসার নিচে থাক বা জাহান্নামে থাকো।
- আমি তোমার বাসার নীচে অনিক। একবার নামো!!
- আমি নামবো না।
রিমকি রিক্সা ঘুরাতে বলল।
এদিকে পুলক রিমকির গলা শুনেই বুঝেছে কিছু একটা ঘটেছে। তাঁর খুব অস্থির লাগতে থাকল। সে আর পারল না। সে রিমকির বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো। ওকে এসএমএস করে রাখল। আমি তোমার বাসার সামনে। কিছুক্ষনের মধ্যে রিমকি রিক্সা করে ফিরল।
পুলকের হঠাৎ করে প্রচণ্ড রাগ উঠে গেল।
- এত রাতে তুমি কোথায় গেসিলা?
- অনিকের সাথে দেখা করতে।
- সেটা কি দিনে করা যেত না? তোমাকে কী এসব পাগলামি করেই যেতে হবে?
পুলকের চোখ জ্বলছে। সেখানে রাগ উৎকণ্ঠা সব ঠিকরে বেড়িয়ে আসছে। সে রিমকিকে বলল-
- তুমি বাসায় যাও। আমরা পরে এই নিয়ে কথা বলব। যাও বাসায় যাও।
চিৎকার দিয়ে বলল পুলক।
রিমকির চোখে পানি চলে আসল। একদিকে একজন মানুষের উদাসীনতা। অন্যদিকে আরেকজন মানুষের উৎকণ্ঠাভরা চাহনি। রিমকির জন্যে।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ৩৮)
স্বপ্নবিলাসী মানুষদের সমাজ কখনো ভালো চোখে দেখে না। কারণ স্বপ্নবিলসী মানুষেরা কখনো নিয়ম মেনে চলতে পছন্দ করে না। তাঁদের মধ্যে যদি নীতিবোধ থেকে থাকে তাহলে তাঁরা খালি যেটুকু করে তা হল, নিজের আত্মার কাছে প্রশ্ন করে যে আমি যা করছি তা কি ঠিক!! যদি উত্তর আসে যে ‘হ্যাঁ ঠিক’। তবে তাঁরা আর কিছু ভাবে না। কিন্তু সমাজ এই শোধ একটা না একটা সময়ে ঠিকই নিয়ে নেয়।
রিমকি একজন স্বপ্নবিলাসী মানুষ। তাঁর কাছে জীবন খুবই নাটকীয়। মনের কাছে যা ঠিক মনে হয় সে তা-ই করে। তাঁর যাকে ভালো লাগে সে তাঁর সাথে ঘুরে। তাঁর ইচ্ছা হল এক দঙ্গল ছেলের সাথে রাতে কোথাও ঘুরতে যাবে। সে চলে যায়। দরকার লাগলে রাত পাড় করেও আসে। এখন সমাজ কখনো একটা মেয়ের রাতে বাইরে কাটানোকে ভালো চোখে দেখবে না। তাঁকে কেউ অবশ্য কখনো আটকায়ওনি। অনিকও এসব ব্যাপারে উদারই ছিল সবসময়। রিমকির বড় ছোট সব ফ্রেন্ডরা ওঁর মতই বোহেমিয়ান কিসিমের। ওঁদের কাছে জীবনের মানে উপভোগ করা। এত চিন্তাভাবনা করে কী হবে!! কয়দিনের আর এই জীবন!! যে বয়সে চাঁদ দেখতে সুন্দর লাগে, ঐ বয়সে চাঁদ না দেখা হল চূড়ান্ত বোকামি। তা সে চাঁদ দেখার জন্য মাওয়া যেতে হলেও যেতে হবে। রাত পাড় হয়ে গেলেও কুছ পরোয়া নেই। কিন্তু সমাজ এসব বড় বড় চোখ মেলে দেখে। তাঁদের নিয়ম না মেনে যে চলে তাঁকে ধরার জন্য সমাজ বরাবরই বদ্ধপরিকর।
আশিক বসে আছে পুলকের বাসায়। মাঝে বেশ কয়েকদিন সে বন্ধুর খোঁজ নিতে পারেনি। আজকে সময় নিয়ে এসেছে। কিন্তু পুলক বেশ তাড়াহুড়ার মধ্যে আছে। মানে বেশ যেন একটু অস্থির ভাব। আশিক জিজ্ঞেস করল-
- তুই কি কোথাও বের হবি?
- হুম
- কোথায়?
- এমনিই বাইরে। তেমন কোথাও না।
- তোর কি ইদানীং কোন মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে?
- কেন? (তীক্ষ্ণ কণ্ঠে পুলকের জিজ্ঞাসা)
- না!!! ছন্দা বলতেসিল যে তোকে আজকাল রিমকির সাথে দেখা যায় খুব
পুলক রেগে গেল। সে এ ধরনের কথাবার্তা পছন্দ করে না।
- তাতে ওঁর কী?
- না মানে!! (ইতস্তত করছে আশিক) ও তো রিমকির ফ্রেন্ড। রিমকিকে ভালোমতই চেনে। ওঁর মাথার ঠিক নাই। বলল সময়মত দূরত্ব না রাখতে পারলে অকারণ তুই কষ্ট পাবি।
পুলকের মাথায় আগুন জ্বলে গেল। সে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল।
- তোরা সবাই চাস আমি কষ্টে থাকি!!! তোরা কেউ আমার সুখ দেখতে পারিস না? আমি এই মেয়ের সাথে ভালো আছি। এটা তোদের সহ্য হচ্ছে না। আমি ওকে চিনি। আমি পুলক আহমেদ কোন মানুষকে যদি পছন্দ করি তাহলে বুঝতে হবে সে মানুষ খাঁটি। হ্যাঁ, ওঁর মাঝে পাগলামি আসে। কিন্তু কেউ কখনো আটকায় নাই বলে। I can take care of her. ছন্দাকে বলে দিবি সে যেন এসব নিয়ে চিন্তা না করে। বেশি চিন্তা করলে আমি ওঁর চিন্তা কমায়ে দেওয়ার ব্যাবস্থা করব।
ফুঁসতে ফুঁসতে পুলক এতগুলা কথা বলল।
আশিক বন্ধুর দিকে তাকিয়ে দেখল এক মোহাচ্ছন্ন ব্যাক্তিকে। এরকম মোহ কাটানোর মত ক্ষমতা তাঁর নেই। তাঁর এই বন্ধুকে সে খুব পছন্দ করে। আশেপাশে এত হাজার রকমের ভেজাল মানুষের মধ্যে পুলক একজন খাঁটি মানুষ। অমিশুক। অসামাজিক। কিন্তু খাঁটি। একটু সহ্য করতে পারলে, বুঝতে পারলে ওঁর মত মানুষ হয় না। সেই মানুষটার এরকম মোহাচ্ছন্ন ভাবে সে ঠিক বুঝতে পারল না যে তাঁর ঠিক কি করা উচিৎ। আশিক স্বল্পভাষী মানুষ। সে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। শুনতেই বেশি পছন্দ করে। ঠিক কী বলবে সে পুলককে তা বুঝতে পারল না। আশিক চলে গেল।
আশিক চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ পুলক একা একা ফুঁসতে ফুঁসতে লাগল। মেয়ে মানুষের এরকম একজন আরেকজনের পিছনে লেগে থাকা সে কখনো মানতে পারে না। জেনে না জেনে এরা মানুষকে খারাপ বলে দেয়। রিমকির বন্ধু হওয়ার পরও ছন্দা রিমকিকে চিনতে পারল না? হ্যাঁ, ও হয়তো আর সবার মত না। একটু পাগলাটে। তাই বলে ওকে খারাপ বলবে!! How dare she!! ওঁর সাথে থাকলে পুলক কষ্ট পাবে!!! আসলে ওরা কেউ ওকে সুখী দেখে সহ্য করতে পারছে না।
পুলক রিমকির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
রিমকি জিজ্ঞেস করল-
- রেগে আস কেন?
- এমনিই
- উহু!! কিছু হলেও তো চিনি তোমাকে।
- বেশী চিনা ভালো না।
- কি হইসে বল সূর্য?
নরম স্বরে বলল রিমকি। হাতটা রাখল পুলকের হাতে।
ঝাঁঝের সাথে পুলক এক গাদা কথা বলা শুরু করল।
- তোমার আসলে কোন ভাল বন্ধু নাই। তোমার কোন বন্ধুই ভালো না। যখন যা খুশী করে বেড়াইস। এমন একটা মানুষ ছিল না যে তোমাকে সামলাবে। বালের বয় ফ্রেন্ড জুটায়ে রাখস যে তুমি রাতে মাওয়া চলে যাও!! কিছু বলে না। মানুষ কী বলবে ভাবে না। আমি একজনকে ভালোবাসি। তাঁর ভালো মন্দের দায় দায়িত্ব তো আমাকেই নিতে হবে। আমার প্রেমিকাকে খারাপ বলবে মানুষ এরকম কাজ আমি কেন করতে দিব!! তোমাদের এই সুবিশাল উদারতার কোন মানে আমি খুঁজে পাই না। আমার সাথে ঘুরে বেড়াইতেস। তোমার প্রেমিকের কোন মাথা ব্যথা নাই। এই রকম ফালতু রিলেশনের কোন মানে তো আমি খুঁজে পাই না। এসব অসুস্থ উদারতা।
রিমকি কোণঠাসা হয়ে গেছে। কথাগুলো তাঁর সত্যি মনে হচ্ছে। কিন্তু তাঁকে কেউ কখনো এসব বুঝায়নি। অনিকও না। অন্য কেউও না। সে বলল-
- কেউ কিছু বলেছে আমাকে নিয়ে?
পুলক সব খুলে বলল। এরপর আরেক দফা ঝাড়ি দিল। রিমকি বাচ্চা একটা মেয়ের মত সব শুনল। মানল। কোন কারণে পুলকের এই অধিকারবোধ তাঁকে পুলকের প্রতি আরো আকর্ষিত করল। সুদর্শন এই মানুষটার দাবি নিয়ে কথা বার্তা শুনলে তাঁর ভিতরটা কেন যে এত কেঁপে ওঠে তা সে বুঝতে পারে না। নিজের সবকিছু সঁপে দিতে ইচ্ছা হয়। মন। শরীর। সব।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ৩৯)
ঘুম থেকে উঠে রিমকিকে অফিসে দিয়ে এসে বাসায় এসে পড়ল পুলক। একটু ঘুমিয়ে নেবে। রিমকির অফিস শেষ হবে সন্ধ্যায়। এতক্ষণ আর রাস্তায় ঘুরতে ভালো লাগছিল না। যদিও এই কয়দিন সে রাস্তায়ই ঘুরেছে। অপেক্ষা করেছে রিমকির জন্যে। আজকে কেন জানি ভালো লাগছে না। তাই বাসায় চলে এল পুলক। বিছানায় শোয়া মাত্রই ফোন আসল রিমকির।
- কই তুমি?
- বাসায় চলে আসছি।
- শরীর খারাপ লাগতেসে?
- না না!!! এমনেই। তুমি কী কর? বস কই তোমার?
- আসে নাই এখনো।
- হুম!! আজকে ফেরার পথে চল হাতির ঝিল যাবো নে!!
- আচ্ছা!!!
- কী!! মন খারাপ নাকি?
- না!! অনিক ফোন দিসিল।
- কী বলল?
- নরমাল কথাবার্তা। নাস্তা খাইসি কিনা!!! বাসায় কখন যাব!! এইসব।
- হুম!!
পুলক একটু চুপ হয়ে রইল। অনিকের নামটা আসলেই সে চুপ হয়ে যায়।
রিমকি বলল-
- কী? মেজাজ খারাপ হইল?
- না!! মেজাজ কেন খারাপ হবে!!
- আমি জানি মেজাজ খারাপ হইসে।
- বেশি জানা ভালো না।
- ছুঁয়ে বল মেজাজ খারাপ হয় নাই?
- আমার কিন্তু এসব ন্যাকামী একদম ভালো লাগে না।
- তুমি বললে ন্যাকামী হয় না,আমি বললেই ন্যাকামী!!
পুলক চুপ করে আছে। তাঁর আসলে খুবই মেজাজ খারাপ। এটা স্বীকার সে করবে না। রিমকি এখন নরম সুরে ডাকল-
- বেইবী!!! আমার বেবী!!!
পুলক কিছুটা বিপর্যস্ত বোধ করছে। এই ডাক সে অগ্রাহ্য করতে পারে না। এই ডাক শুনলে তাঁর ইচ্ছা করে সারা দুনিয়ার সবকিছু ফেলে সে রিমকির কাছে চলে যায়। সে তাও চুপ করে রইল।
রিমকি বলল-
- আমার কিন্তু প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আমি এখন রাখব। আমার শরীর ভালো লাগতেসে না।
পুলক ফোনের মধ্যেই রিমকির শ্বাসকষ্টের শব্দ পেতে থাকল। উফ!! এই মেয়ে এত জ্বালান জ্বালাইতে পারে!! এর সাথে ছোটখাটো ঝগড়া হলেও এর শরীর খারাপ হয়। শ্বাসকষ্ট হয়। পুলকের নিজেরো শ্বাসকষ্ট আছে। তাই এই কষ্টের যন্ত্রণা সে ভালো করেই জানে।
পুলক বলল-
- এসব আমার একদম ভালো লাগে না। যাও! ছুঁয়ে বললাম, রাগ করি নাই। মেজাজও খারাপ হয় নাই। এখন ঠিক হউ।
রিমকি তাও ঠিক হয় না। বলে-
- নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যাবে।
বলতে বলতে হাঁপায় সে। পুলকের খুব ইচ্ছা করে মেয়েটার পাশে গিয়ে ওঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এই মেয়েটাকে সে ভালোবাসে। একই সাথে এর প্রতি প্রচণ্ড দায়িত্ব অনুভব করে সে। রিমকি বলে যে পুলকের মত এত আগলায়ে তাঁকে কেউ কখনো রাখে নাই। পুলক নিজের সর্বস্ব দিয়ে দিতে পারে এই মেয়েটার জন্যে।
ফোন রেখে দেয়। দিনের মাঝে আরো বহুবারই ফোন করবে তাঁকে রিমকি। পুলক নিজে কাজের সময়ে ফোন করা একদম পছন্দ করে না। কিন্তু রিমকি শুনবে না। সে করবেই সুযোগ পেলে। পুলক বাসে উঠে ফোনে খেজুরে গল্প করাও একদম পছন্দ করে না। রিমকির পাল্লায় পড়ে তাঁকে তাও করতে হয়। মজার কথা হল। রিমকির সাথে যোগাযোগের সময় বা ওঁর কাছাকাছি থাকার সময় পুলক চারপাশে কাউকে দেখতে পায় না। তাঁর শুধু মনে হয় তাঁর পাশে থাকা এই রক্ত মাংসের মানবী ঠিক কোন মানবী নয়। যেন কোন দেবী। ঘোর লাগা চোখে সে তাকিয়ে থাকে রিমকির দিকে।
রিমকি বলে-
- কী দেখো?
পুলক কোন উত্তর দেয় না। চোখও সরায়ে নেয় না।
আবার ফোন। রিমকিই হবে। পুলক দেখে অপরিচিত নাম্বার। ধরল সে।
-হ্যালো
-হ্যালো পুলক!!
-হ্যাঁ, কে বলছেন?
- আরে দোস্ত!! আমি ছন্দা।
পুলকের মুখ শক্ত হয়ে গেল।
-হ্যাঁ, কী ব্যাপার?
- তোর সাথে একটু দেখা করতাম। সময় হবে?
পুলকদের ক্লাসে ছন্দা ছিল সবচেয়ে প্র্যাকটিকাল মেয়ে। সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে দেখে আসছে পুলক। এই মেয়ে যে রিমকিকে নিয়েই কিছু বলবে মোটামুটি নিশ্চিত পুলক। দেখা যাক কী বলে!!
-ঠিক আছে। কোথায়?
ওরা সময় আর স্থান ঠিক করে নিল।
পুলক আর ছন্দা বসে আছে মুখোমুখি। ছন্দা চালাক মেয়ে। প্রথম ১৫-২০ মিনিট সে কুশল জিজ্ঞেস করতেই কাটিয়ে দিল। কে কোথায় আছে!! কী করছে!! বেশীরভাগেরাই ব্যাঙ্কে ঢুকে গেছে। এইসব হাবি জাবি। পুলক ধৈর্য ধরে ওঁর এইসব কথা শুনতে লাগল। অপেক্ষা করতে লাগল যে ঠিক কখন ও আসল কথায় আসে। অবশেষে ছন্দা আসল কথায় আসল।
- পুলক!! আমি জানি তুই আমাকে পছন্দ করিস না।
কথাটা সত্যি। কিন্তু পুলক বলল,
- এরকম কিছু না।
- যাই হোক!! আমি কিন্তু তোকে পছন্দ করি এবং তোর ভালো চাই।
- হুম
এরপর সরাসরি পুলককে প্রশ্ন করল,
- রিমকির সাথে তোর মেলামেশা কয়দিনের?
- কেন?
ছন্দার মুখে আগের মত হাসি নেই। পুলক একটু থমকাল।
- রিমকিকে আমি বহুদিন চিনি। চিনি বলেই তোর কাছে জানতে চাইছি।
- দেড় মাস হবে।
- Are you involved with her?
পুলক উত্তর দিল না। ছন্দা আবার বলল-
- Do you know that she has a boyfriend?
- Yes
- আচ্ছা!! রিমকির বাবা মা যে ডিভোর্সড তা জানিস?
- হুম! জানি।
- ওঁর ছোটবেলাটা ভালো যায় নাই। ও কিন্তু মানসিকভাবে স্থিতিশীল না।
- মানে?
- ও নিজে একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। চারপাশেও একটা ঘোর তৈরি করতে পারে ও। এটা ও জেনে শুনে যে করে তা কিন্তু না। অবচেতনভাবে করে। অনিকের সাথে ওঁর সম্পর্ক ৭ বছরের। অনিক ওকে ঠিকভাবেই সামলাতে পারে।
- তাই নাকি?
টিটকারির সুরে বলল পুলক।
ছন্দা হাসল ওঁর দিকে তাকিয়ে।
- কেন!! রিমকি কী বলেছে অনিককে নিয়ে?
পুলক কিছু বলল না। এটা ওঁর আর রিমকির কথা। সে এটা তৃতীয় কাউকে বলতে আগ্রহী নয়।
- আচ্ছা!! একটা কথা বল তো!! তোর সাথে ঝগড়া হলে ওঁর কি শ্বাসকষ্ট হয়?
পুলক চমকে গেল। এটা তো ওঁর জানার কথা না। সে চুপ করে রইল। ওঁর চুপ করে থাকা দেখেই ছন্দা উত্তর পেয়ে গেল।
- অনিকের সাথেও ওঁর এরকম হত প্রথম দিকে। অনিক অতটা পাত্তা না দেওয়াতে ওঁর সাথে ঝগড়ায় আর ওঁর শ্বাসকষ্ট হয় না। এটা অনেকটা মানসিক। দোস্ত!! আমি বলতেসি না ও কোন খারাপ মেয়ে। কিন্তু ও stable না। ও কখনো অনিক কে ছাড়বে না। ও তোকেও ছাড়বে না। আমি তোর ভালো চাই। তুই আমাকে পছন্দ না করলেও আমি তোকে পছন্দ করি। তুই ভালো ছেলে। Atleast!! I felt that you should be informed. By the way!! Do you know that they are physically involved?
পুলকের মেজাজটা খারাপের দিকে। সে জানে। রিমকিই প্রথম দিকে তাঁকে বলেছিল। এটা তাঁকে খুব অশান্তি করে। মাঝে মাঝে সে কল্পনায় ওঁদের ঐ অবস্থায় দেখতে পায়। তখন নিজের মাথাটা দেয়ালে ঠুকে ঠুকে ফাটায়ে দিতে ইচ্ছা হয়। কেন অনিকের আগে পুলক রিমকির জীবনে আসল না, এই নিয়ে তীব্র অভিমান হয়। যদিও পুলক বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কের ঘোরতর বিরোধী। কিন্তু সে যে মানুষকে ভালোবাসে তাঁকে কেউ আগে ছুঁয়েছে এটা তাঁর মানতে বাঁধে। যেখানে সে কোন পুরুষের নাম রিমকির মুখে সহ্য করতে পারে না, সেখানে এত বড় ব্যাপারটা মানতে যে তাঁর কত কষ্ট হয় তা আর কেউ জানবে না। পুলকের মাথাটা বিগড়ে যাচ্ছিল। সে নিজেকে ঠাণ্ডা করে ছন্দাকে বলল-
- দেখ ছন্দা!! তুই যা যা বললি তাঁর সবই আমি আগে থেকেই জানি। ও যে সিগারেট খায়, মদও খায়। তাও জানি। সো!! I appreciate your concern. আর কিছু বলবি? নাকি নিজের বান্ধবীর আরো সুনাম করবি?
ছন্দা ঘাবড়াল না। পুলককে সে একটু হলেও চেনে। ভয়ানক রাগী। এইটুকুই। আর কিছু ভয়ানক সে দেখেনি কখনো। মায়ের একমাত্র ছেলে। তাই কিছুটা অন্যরকম।
- জেনে শুনে নিজের লাইফটা নিয়ে খেলিস না পুলক। ও কখনো অনিককে ছেড়ে আসবে না তোর কাছে। অনিক-ই ওঁর জন্যে ঠিকআছে। এতদিন ওকে সামলেছে। মাঝখান দিয়ে তুই অনেক কষ্ট পাবি। তুই কষ্ট পাস আমি কখনোই চাই না। রিমকি মানসিকভাবে খুব অস্থির। ও নিজে কী চায়। তা ও নিজে কখনো জানে না। তোকে বলবে অনেক কিছুই। কিন্তু তা মানতে পারবে না। তোর শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু তুই যদি আবেগ দিয়ে চিন্তা না করে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করিস। তাহলে দেখবি যে ৭ বছরের সম্পর্কের কাছে ২ মাসের সম্পর্ক গোনার মধ্যে আসবে না। তোর সাথে ওইভাবে ক্লোজ আমি কখনোই ছিলাম না। কিন্তু আমার মনে হল যে তোকে এটা জানানো উচিৎ। বাকি তোর ইচ্ছা।
পুলক ‘Thanks’ বলে টেবিল থেকে উঠে গেল।
সেইদিন বিকালে অফিস থেকে ফেরার পথে রিমকি পুলককে বলল-
- আমি মোটামুটি 95% সিউর যে আমি অনিককে বিয়ে করব না। তোমার সাথে আমার কপালে বিয়ে আসে কিনা জানি না। কিন্তু অনিক কে বিয়ে করা সম্ভব না।
পুলক যেন অন্ধকারে আশার আলো দেখল। সে মুখে কিছু বলল না। ছন্দার কথায় সে মোটেই চিন্তিত না। পুলক কখনো পছন্দের মানুষকে অবিশ্বাস করতে পারে না। তাই রিমকিকেও সে অবিশ্বাস করে না। সে মনে মনে রিমকির সাথে তাঁর সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখে। রিমকির হাতটা ধরে নিজের দিকে টেনে নেয় ওকে। রিমকিও সরে আসে পুলকের দিকে।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ৪০)
জীবনে বড় বড় অসঙ্গতি কিন্তু জানান দিয়েই আসে। ছন্দার কথা ছাড়া যে একদম কোন অসঙ্গতিই যে রিমকির ব্যাপারে পুলকের চোখে পড়েনি তা কিন্তু না। পড়েছিল। কিন্তু আবেগের যে তীব্রতা আর রিমকির তাঁকে আশ্বস্ত করা। এসবই তাঁকে সেইসব অসঙ্গতিকে এড়িয়ে যেতে বাধ্য করেছে। কারণ সম্পর্ক যে রকমই হোক বিশ্বাসই যদি না থাকে তাহলে কিসের সম্পর্ক!!
কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ সরল নয়। আজকে যদি রিমকি অনিকের হাত ধরে ঘুরে বেড়ায়। আজকে যদি অনিক রিমকিকে ঘনিষ্ঠভাবে কাছে চায়। রিমকি যদি যায়ও। তবে কি এটাকে সাদা চোখে বিশ্বাসভঙ্গ বলা যাবে!!! যাবে না। এসবই পুলক জানে। জেনে শুনে সে কেন এরকম একটা সম্পর্কে জড়াল সে? এই প্রশ্নের কী উত্তর হয়!! সারা দুনিয়াটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আঁকড়ে থাকার মত কিছু পাচ্ছিল না পুলক। রিমকিকে পেয়েছে সে। কিভাবে ছাড়বে সে একে!! যত অসঙ্গতিপূর্ণই হোক না কেন শেষ তো সে দেখবেই।
আরেকটা জায়গাতে সে মিলাতে পারছে না। রিমকিকেও দোষ দিতে পারছে না। দেড় মাস হয়ে গেল তাঁরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাত দিন। অনিকের আবির্ভাব শুধু ফোনে। সে বলে সে কোথায় আছে। রিমকিও বলে কোথায় আছে। ব্যস!! কেউ কাউকে ডাকে না। কাউকে দেখতে চায় না। পুলকের আরো মনে হয় যে সে যা করছে ঠিক করছে। কারণ সম্পর্ক সেও করেছে। যতদিনই যাক। প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য অন্যরকম। কি জানি!! সে তো আর স্বাভাবিক না। অসামাজিক মানুষ। তাঁর কাছে তাঁর প্রিয় মানুষের অস্তিত্ব অন্যরকম। অনিকদের মত স্বাভাবিক মানুষদের কথা হয়তো আলাদা।
তো বিপরীত দিক থেকে কোন বাঁধা না আসাতে পুলকের নৈতিক বাঁধাটা অনেক শিথিল। মাঝে মাঝে সে কোন বাঁধা অনুভব করে না। সে রিমকিকে নিয়ে স্বপ্ন বোনে। সে রিমকিকে ছুঁয়ে থাকে। রিমকির কাছে থাকে। রিমকিও ওঁর কাছে সরে আসতে থাকে। গভীর থেকে গভীরে।
দুজন একসাথে সন্ধ্যা থেকে রাতের সময়টা ঘুরে বেড়ায়। অফিস থেকে নামার সময় ফোন করলে যতক্ষণ পুলক রিমকিকে চোখে দেখতে না পায় ফোন ছাড়ে না। ধরেই থাকে। রিমকি সিঁড়ি দিয়ে নামে। রাস্তায় আসে। পুলক রিমকিকে দেখেও ছাড়তে চায় না ফোন। রিমকি ধমক দিয়ে ফোন রাখায়। এসব পাগলামি রিমকিকে আলোড়িত করে। আবার হঠাৎ হঠাৎ রিক্সায় উঠে রিমকির সিগারেট খেতে চাওয়া আর পেশাদার সিগারেটখোরদের মত আড়াল করে সিগারেট খাওয়া দেখতেও পুলকের দারুণ লাগে। তারপর পুলক যখন রিমকিকে নামিয়ে দিয়ে আসে ওঁর বাসার কাছে। রিমকি ঘুরে ঘুরে ওকে দেখে। পুলক দাঁড়িয়ে থাকে রিমকির এই বার বার ফিরে ফিরে তাকানো ভঙ্গিটা দেখার জন্য। রিমকিও বার বার রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা অবয়বটার দিকে ফিরে ফিরে তাকায়। একেবারে চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত।
এভাবেই চলছিল সবকিছু। জীবনের কাহিনীতে মোচড় আসল অন্যদিক দিয়ে। দেড় মাসের সম্পর্কের পর পুলক আর রিমকি দুজনেই জানতে পারল যে অনিক তাঁদের সম্পর্কের কথা আগাগোড়াই জানে।
ইদানীংকার সম্পর্কে একে অপরের প্রতি খুব বেশী স্বচ্ছতা রাখতে গিয়ে প্রেমিক প্রেমিকার নিজস্বতা বলতে একে অপরের কাছে কিছু থাকে না। তাঁরা একে অপরের সাথে শরীর থেকে শুরু করে নিজের ফেসবুক পাসওয়ার্ড, ইমেইল আইডি সবই শেয়ার করে। রিমকির পাসওয়ার্ডও অনিকের কাছে ছিল। তাই অনিক প্রথম দিন থেকেই রিমকি আর পুলকের মধ্যে কি ঘটছে তা জানত। সবকিছু জানার পরেও সে কেন এতদিন চুপ ছিল তা আপাতদৃষ্টিতে রহস্যময়ই বটে। কিন্তু বেশীদিন তা আর আড়ালে থাকল না।
মানুষ তাঁর নিজের মনের হদিস কতটুকু রাখে!! কতটুকু রাখা সম্ভব!! মানুষ পরিস্থিতির দাস। মানুষ ভাবে যে এরকম হলে বড়জোর এরকম হবে। কিন্তু যখন সত্যিই এরকম কিছু ঘটে তখন সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করে যে তাঁর মনের মধ্যে যা হচ্ছে তা সে এর আগে কখনো অনুভব করেনি। প্রতিনিয়ত মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করে, খুঁজে পায়। এই আবিষ্কারের, খুঁজে পাওয়ার যেন শেষ নেই। দম্ভ করে যে মানুষ এতদিন বলে আসত যে “আমি হলে কখনোই এই ধরনের কাজ করতাম না।“ সেই মানুষই যখন পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে সেই ধরনের কাজ করে বসে যা তাঁর চোখে এতকাল অমার্জনীয় অপরাধ ছিল, তখন সে নিজের কাছে ছোট হয়ে যায়। আরো ছোট হয় সেই মানুষটার কাছে যাকে সে কিছু না বুঝেই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। তাই দূর থেকে মানুষের বিচার করে ফেলা খুব সহজ। কিন্তু সেই মানুষের মনটা বোঝা বড়ই কঠিন। তা পুরুষেরই হোক। নারীরই হোক। পুলকের হোক। রিমকির হোক। অনিকেরই হোক।
৭ বছরের সম্পর্কে অনিক একজন স্বেচ্ছাচারী প্রেমিক ছিল। ‘স্বেচ্ছাচারী’ শব্দটা শুধু প্রেমের বেলায় বললে তাঁর চরিত্রের প্রতি অন্যায় করা হবে। অনিক পুরোপুরি তাঁর ইচ্ছা অনিচ্ছা অনুযায়ী জীবন চালাতে পছন্দ করে। সেখানে অন্য কারো ইচ্ছা অনিচ্ছার গুরুত্ব নেহাত নেই বললেই চলে। সে তাঁর মা-ই হোক, ভাই-হোক আর রিমকি-ই হোক। একমাত্র বাবার কথাটা সে সরাসরি ফেলে দেয় না। ফেলে দিতে পারে না। রিমকিকে সে ভালোবাসে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করে বোঝাতে হবে তা সে কখনো অনুভব করে না। প্রত্যেক ঝগড়ার পরে তাঁর চিরাচরিত সংলাপ থাকত, “কারো থাকতে ইচ্ছা করলে থাকবে, না থাকতে ইচ্ছা করলে চলে যাবে। এখানে তো জোর জবরদস্তির কিছু নাই।“ নির্লিপ্তভাবে ঠাণ্ডা কণ্ঠস্বরে সে এসব বলতে পারত।
সেই অনিক যখন দেখল রিমকি অন্য কারো সাথে জড়িয়ে গেছে। তখন সে কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে বসে রইল। এত বছরে অনেক কিছুই ঘটেছে। অনেক রাগ অভিমান রিমকির জমেছে। কিন্তু বার বার সে অনিকের কাছেই ফিরে গেছে। অনিককে কখনো নিজের দোষের জন্যও রিমকির কাছে গিয়ে সরি বলা লাগে নাই। রিমকিই প্রতিবার তাঁর কাছে এসেছে। নত হয়েছে। এতে রিমকিকে অনেকটা নিজের সম্পত্তি বলে ভাবতে শুরু করেছিল সে। অবচেতনভাবেই। সেই নারী যে কখনো তাঁকে ছেড়ে অন্য কারো প্রতি আকর্ষিত হতে পারে তা মেনে নিতে বেশ অনিচ্ছুক ছিল সে। সব বুঝেও বুঝতে চাইছিল না।
ঠিক দুই মাস পরে তিক্ত কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে অনিক রিমকিকে জানাল সে সব জানে। একদম শুরু থেকে। সবটা।রিমকিও সব স্বীকার করে নিতা।অনেকদিন থেকেই বলতে চাইছিল সে। অনিশ্চিত অনৈতিক অসম্পূর্ণ সম্পর্কের যদি সেটা শেষ হত, তাহলেও হত। কোনটাই শেষ হল না। অনিক রিমকির সম্পর্কও না। পুলক রিমকির সম্পর্কও না। বরং জটিলতার শুরু হল এখান থেকেই।
অদ্ভুত প্রেমের গল্প- (পর্ব ৪১)
সম্পর্কের বেলায় বেশীরভাগ সময়ই মানুষ বুঝতে পারে না যে সে আসলে কী চায়!! ‘ভালোবাসা’ আর কাউকে ‘জয় করা’ যে দুইটা দুই বস্তু তা বেশীরভাগ মানুষই বুঝে না। ‘ভালোবাসা’-কে আমরা বলতে পারি হৃদয়ে ধারণ করা। ‘জয় করা’ বলতে বোঝায় কাউকে একবার নিজের করে ফেলতে পারলেই হল। তারপর সব আকর্ষণ, ভালো লাগা শেষ। এই দুইয়ের মাঝে পার্থক্য বেশীরভাগ মানুষই ধরতে পারে না। আবার কিছু কিছু সম্পর্কের বেলায় একজন আরেকজনকে পেয়ে বসে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Granted’ নিয়ে নেয়া। ও তো আছেই। যাবে আর কই। সাধারণত অনেকদিনের সম্পর্কের বেলায় এই জিনিশটা ঘটে। যা ঘটেছে অনিক আর রিমকির বেলায়। অনিক কখনো কল্পনাও করতে পারে নাই যে তাঁর রিমকি তাঁকে ছেড়ে অন্য কারো কাছে যেতে পারে তা সে যতই তাঁকে অবহেলা করুক আর উদাসীনতা দেখাক। পুরো ব্যাপারটা হজম করতে তাঁর কষ্ট হল। সে মানতে পারল না। পুরোপুরিই এলোমেলো হয়ে গেল সে।
এক রাতে সে এসে রিমকিকে ঠাণ্ডা গলায় বলল যে রিমকি ঠিকই করেছে। পুলক তাঁর চেয়ে সুদর্শন। ও রিমকির ঠিকমত খেয়াল রাখে যা অনিক কখনো রাখে নাই। পুলকই রিমকির জন্য ঠিক আছে।
মানুষের অবচেতন মন একটা দারুণ জায়গা। অবচেতন মনের মত চালাক, রহস্যময় হয়তো মনের কোন অংশ না। অবচেতন মন মানুষকে অনেক কিছু ভুল ভাল বোঝায়। যেমন এখন অনিককে বোঝাচ্ছে যে সে রিমকিকে পুলকের হাতে ছেড়ে দিচ্ছে। আসলে রিমকি আর পুলকের জন্য পথটা কঠিন করে দেয়াই তাঁর অবচেতন মনের উদ্দেশ্য।
বেশীক্ষণ নিজস্ব মতবাদে স্থির থাকতে পারল না অনিক। তাঁর মনজগতে এক বিশাল তোলপাড় শুরু হল। পুরুষ স্বেচ্ছায় নিজের নারীকে অবহেলা করতে পারে, এমনকি ছেড়েও দিতে পারে। কিন্তু অন্য পুরুষের কাছে হেরে যাওয়া বরদাস্ত করতে পারে না। অনিক কিছুতেই পুলকের কাছে হেরে যাওয়া মানতে পারছে না।সে বহুরকম আবোল তাবোল কথা বলছে রিমকিকে। একই কথা বার বার বলছে। কোনবার অপমান করছে, আবার পরক্ষনেই স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে।
পুলক আর রিমকি অনিকের এই হঠাৎ করে আসা আবেগের জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিল না। পুলক কখনো কোন সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় ব্যাক্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে চায়নি। নিয়তির কী খেলা!! এখন সে তাই!! একজন তৃতীয় মানুষ। রিমকিও কি কখনো এরকম চেয়েছিল। চায়নি। অথচ তাঁকে এখন নিজেকে ‘খারাপ মেয়ে’ হিসেবে দেখতে হচ্ছে। জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যখন নিজের আদর্শের কাছে নিজেরই ছোট হওয়া লাগে, তখনই মানুষ বুঝতে পারে অসহায়তা কাকে বলে।
কোন এক দুপুরে অনিক রিমকিকে ডেকে পাঠায় ওঁর সাথে দেখা করার জন্যে। অনিকের পক্ষে স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। পুলককে ফোনে জানিয়ে রিমকি অনিকের সাথে দেখা করতে বের হল।
পুলক কখনোই অনিকের নামটা সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এখানে তাঁর কিছু বলার নেই। সে একজন তৃতীয় মানুষ। আনুষ্ঠানিকভাবে রিমকি এখনো অনিকের। সে কখনোই পুলকের না। আর এখন ঝামেলা যখন সামনে চলেই আসছে। এটার অবশ্যই ফয়সালা হওয়া উচিৎ। কিন্তু নিজের ভালোবাসার মানুষ অন্য কারো সাথে দেখা করতে গেছে এটা মেনে নেয়া সব পুরুষের বেলায়ই মানসিক অস্বস্তি ও অস্থিরতা প্রদায়ক। পুলকও খুব অস্থির বোধ করল। বিকাল হতে না হতেই সে রিমকির বাসার সামনে এসে বসে রইল। সে রিমকিকে ফোন দিচ্ছে না। কিন্তু তাঁর ভিতরে ঝড় হচ্ছে। সেই দুপুরে গেল রিমকি। এখনো ওঁদের কথা শেষ হচ্ছে না। তাহলে কি রিমকি ফেরত চলে গেল অনিকের কাছে? তাহলে পুলকের কী হবে!! পুলক দিশেহারা হয়ে যেতে থাকল। বিকাল থেকে সন্ধ্যা হল। পুলক কোথাও এক জায়গায় বসতে পারছে না। সে হাঁটছে। থামছে। আবার হাঁটছে। তাঁর চোখ জ্বল জ্বল করছে। চারপাশে তাকিয়ে তাঁর মনে হচ্ছিল আশেপাশের সবাই যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসতেসে। সে যেন সবার হাসির পাত্র। সে আর না পেরে রিমকিকে ফোন দিল। ফোন বন্ধ। অস্থিরতা আরো কয়েক গুণ বাড়ল। হঠাৎ পুলকের মনে পড়ল যে রিমকি বলেছিল যে ওঁর ফোনে চার্জ নেই। কিছুটা যেন শান্ত হল সে। কিন্তু সময় যত বাড়তে লাগল অস্থিরতাও পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল। পুলক আর পারল না। আশিককে ফোন দিল। বন্ধুর গলার আওয়াজ শুনেই আশিক কিছু একটা আঁচ করল। সে পুলককে আশ্বস্ত করল যে সে আসছে। রাত ৯টা। পুলকের মাথা পুরোপুরি খারাপের দিকে। সে বুঝতে পারছে না কী করবে। সে রিমকিকে এসএমএস করে রেখেছে।
“আমি তোমার বাসার সামনে। যত দেরী-ই হোক দেখা করে যাব।“
এর মাঝে আশিক চলে আসল। শুনল সবকিছু। কিছু বলল না। পুলকের সাথে বসল।
রাত সাড়ে ৯টা। রিমকির এসএমএস আসল।
“তুমি চলে যাও। রাতে নাও ফিরতে পারি। পরে কথা হবে।“
‘রাতে নাও ফিরতে পারি’- এর মানে কী? কই থাকবে রিমকি? কার কাছে থাকবে? অনিকের সাথে রাতে থাকবে?
হায়রে পুলক!! হায়রে পুরুষ!! শরীরটাই তাঁর কাছে সব। সবার আগে ঐ জায়গাতেই আঘাত লাগে তাঁর। মাথা যদি কেউ দেয়ালে ঠুকে দিত তাহলেই বোধহয় শান্তি হত পুলকের। কিন্তু পুলক চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। আশিককে বলল চলে যেতে। আশিক অনেকক্ষণ জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে। পুলক কিছু বলল না। ওরা একসাথে কিছুক্ষণ হাঁটল। আশিক অসহায় চেহারা নিয়ে অনেকক্ষণ পুলকের সাথে থাকল। ঐ রাতে সে পুলকের সাথে থাকতে চাইল। কিন্তু পুলক রাজি হল না। আশিক চলে গেল।
রাত ১১টায় রিমকির ফোন আসল। পুলক ফোন ধরল।
রিমকি-
- তুমি কি কালকে আমার সাথে শেষবার দেখা করবা?
রিমকির গলা আদ্র। কিন্তু পুলক তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল
- মানে কি? তুমি কি অনিকের কাছে ব্যাক করস?
- হুম!!!
ঐ একটা ‘হুম’ শুনে পুলকের দুনিয়া যেন চুরমার হয়ে গেল। বলা হয় যে পশু পাখি আগত প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে আগেই ওয়াকিবহাল থাকে। মানুষও কি কিছুটা থাকে না জীবনের ঘটনার বেলায়? থাকে। কিন্তু তারপরও মানুষ মেনে নিতে পারে না।
পুলকের বুকটা চিন চিন করে উঠল। ব্যাথায়, বিশ্বাসভঙ্গের বেদনায় সে বাকহীন হয়ে গেল। সে ধরে রইল ফোন। ছন্দার কণ্ঠস্বর ভেসে আসল। ‘রিমকি কখনো অনিক কে ছাড়বে না’। ‘রিমকি কখনো অনিক কে ছাড়বে না’।
রিমকি বলল-
- তোমাকে একটা অনুরোধ করি। অনিক যদি তোমাকে ফোন করে উলটাপালটা কিছু বলে। তুমি কিছু মনে করো না।
খোলা বাজারে কেউ যদি পুলককে উলঙ্গ করে দিয়ে গায়ে আগুন লাগিয়ে দিত। তাহলেও হয়তো এত লজ্জা আর ধিক্কার লাগত না পুলকের। এতটা তুচ্ছ আর ঠুনকো মনে হত না নিজেকে। এতটা অকিঞ্চিৎকর লাগত না।
ফোন রেখে দেওয়ার পর পুলক জম্বির মত বসে রইল সারারাত। এই অনুভূতির কী নাম দেবে সে!! তাঁর কি এখন কাঁদা উচিৎ। এরকম অনুভুতিতে কি কাঁদতে হয়!! ঠিক কী করতে হয় এরকম সময়ে? কেউ যদি বলে দিত পুলককে তাহলে হয়তো সুবিধা হত ওঁর জন্যে। সে ঠিক বুঝতে পারছে না।
সুহান সুহান ভাই এর ব্লগ লিঙ্ক
সুহান সুহান
©somewhere in net ltd.