![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Nothing in this world is IMPOSSIBLE ,,,coz the word IMPOSSIBLE itself says I M POSSIBLE..
প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে,
আর সরবে এসেছে একাধিকবার। প্রতিবার এসেছে নতুন স্বপ্ন নিয়ে, আর চলে গিয়েছে সেই স্বপ্নের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি আর হদয় ভেঙে দিয়ে। হৃদয়ের টুকরোগুলো অ্যাডহেসিভ দিয়ে চটপট জুড়েছি। নতুন আশা নিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছি নতুন প্রেমে। তারপর আবার চুরমার!
সেই প্রেমগুলোর একটা খুব মনে পড়ছে। প্রেমে কী-কী ঘটেছিল, তা নয়। কী করে ভাঙল তা-ও নয়। কীভাবে শুরু হয়েছিল সেটাই বলতে বসেছি।
সূত্রপাত হয়েছিল চ্যাটাং-চ্যাটাং কথা দিয়ে, অর্থাত্, ইন্টারনেট চ্যাটিং দিয়ে। অদ্ভুত জাদু আছে এই ইন্টারনেট চ্যাটিং জিনিসটায়।
রাস্তায় কোনও মেয়েকে দেখে পছন্দ হয়েছে, নাম-ধাম শুধোতে যাও, দেখবে সে মৌনব্রত নিয়েছে, আর এগারো নম্বরের অ্যাক্সিলারেটারে চাপ দিয়েছে। তবে যদি সাহসী হয়, তা হলেই দেখবে সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ভুরু আর চোখের কোঁচকানি দেখানোর জন্য সানগ্লাস মাথায় তুলে নিয়েছে। ঘাড়টা সামান্য কাত করে তোমার চোখে তার দৃষ্টিবাণ ছুড়ে, চোয়ালটা শক্ত করে বলে উঠেছে, “কেন বলুন তো?”
তুমিও তখন টের পাবে, তোমার মুখ থেকে ‘ইয়ে’ ‘মানে’ ‘একটু আর কী’ ছাড়া আর কিছু বেরচ্ছে না। ততক্ষণে দেখবে, সে চোখ বুজে ঘাড়টা অন্যদিকে ঘুরিয়ে, চুলটা একহাত দিয়ে সরিয়ে নতুন কানের দুলের প্রতিফলনে তোমার চোখদু’টো ঝলসে দিয়ে হাঁটা দিয়েছে। আর-একটু লক্ষ করলে অবশ্য দেখবে, এবার তার হাঁটার ভঙ্গি আরও লোভনীয় হয়ে উঠেছে।
বন্ধুর জন্মদিনে তার কোনও তুতো বোনকে দেখে ভারী ভাল লেগে গিয়েছে। পরদিন থেকে সেই বন্ধুর চা-শিঙাড়া-সিগারেটের পয়সা জুগিয়ে, আর তার অ্যাসাইনমেন্টের খাতার বোঝাটা নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে কথাটা পেড়েই ফেললে, “আচ্ছা, সলিল, সেদিন তোর জন্মদিনে তোর ওই বোনটাকে দেখছিলাম। কী যেন নাম? কী বন্তিকা?”
“অবন্তিকা। কেন রে?”
“না, এমনিই… মানে, নামটা। মানে,
নাম-বারটা, একটু দিবি?”
“অবন্তিকার নাম্বার? ওর নাম্বার কী হবে?”
“ওই মানে একটু আলাপ আর কী, হেঁ হেঁ।”
সঙ্গে-সঙ্গে দেখবে, তোমার বন্ধু ভাঁড়ের বাকি চা-টুকু একচুমুকে শেষ করে, ভাঁড়টা দশ ফিট দূরে আংটির মতো শুয়ে থাকা কুকুরটার দিকে নিখুঁত টিপে ছুড়ে দিয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে বলছে, “তুই আমারই বোনকে ছক করবি, আর নাম্বারটা আমার কাছ থেকেই নিবি? তোর তো…”
“আরে, না না! ছক করব না। ভালবাসব, মাইরি বলছি, ভালবাসব। একেবারে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসব। বিয়ে…”
prasenjitদেখলে, তোমার বন্ধু হনহন করে হাঁটা মেরেছে। সঙ্গে-সঙ্গে তুমিও চেঁচিয়ে বললে, “সলিল, তোর অ্যাসাইনমেন্টের খাতাটা ফেলে যাচ্ছিস রে! নিয়ে যা!”
এবার দেখলে সলিল অ্যাবাউট টার্ন নিয়ে তোমার কাছে এসে, খাতা ফেরত নেওয়ায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে গলাটা নামিয়ে বলছে, “কাজগুলো একটু করে দে, ভাই। কেন বেকার ভাও খাচ্ছিস? আর নাম্বারটাও নে। ভালবাসবি তো, ভাই?”
নাম্বার তো পেলে। কিন্তু ফোন করে কথা বলা তো মহাজ্বালা! ফোনে তোমার নাম শুনেই বন্ধু-ভগিনী জিজ্ঞেস করবে, ‘নাম্বারটা কে দিল?’
সমস্যা এখানেই!
যদি তুমি যুধিষ্ঠির সেজে তোমার বন্ধুর নাম বলে দিয়েছ, তখন দেখবে, ‘ছিঃ! আমার দাদাই কিনা শেষকালে এরকম কাজ করল? দেখাচ্ছি! এখানে আর ফোন করবেন না,’ বলে সে ফোনটা রেখে দেবে।
যদি তুমি বন্ধুর নামটা গোপন করো তখন, ‘আমি অপরিচিত কারও সঙ্গে কথা বলি না,’ বলে সে ফোন রেখে দেবে।
এসব ঝক্কি ইন্টারনেটের দুনিয়ায় নেই। সেখানে গিয়ে সোজা একটা পাবলিক চ্যাট রুমে ঢুকে পড়ো। দেখবে, আপাদমস্তক অদেখা ও অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও সে দিব্যি তোমার সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছে। বন্ধুত্বও করে ফেলছে।
না। ব্যাপারটা এতটা সোজা অবশ্য নয়। যাও না পাবলিক রুমে, করো না কোনও মেয়েকে পার্সোন্যাল মেসেজ (পি এম)! দেখবে, তুমি কোনও পাত্তাই পাচ্ছ না।
কী করে পাবে? কোনও মেয়ে যখন চ্যাট করতে বসে, তখন তার লগ ইন করার সঙ্গে-সঙ্গেই কোথা থেকে একের পর-এক পিএম, পরস্পরের ঘাড়ে চেপে মেয়েটিকে বন্ধুত্ব নিবেদন করার জন্য ব্যতিব্যস্ত। একটা নয়, দু’টো নয়, গাদা-গাদা পিএম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেখা যাবে, তার কম্পিউটারের জানালা দিয়ে আর আকাশ দেখা যাচ্ছে না। প্রতি মুহূর্তে এক-একটা বাক্স খুলে যাচ্ছে। কোনওটাতে লেখা ‘হাই’, কোনওটাতে ‘হ্যালো’, কোনওটায় ‘এএসএল?’ এভাবে পিএম-এর পাহাড় জমতে থাকে, আর মেয়েটি অত্যন্ত বিরক্ত মুখে একটার পর-একটা পিএমে ক্লিক করে ‘ইগনোর’ করতে থাকে। কোনও ব্যক্তির পিএম ইগনোর করা মানে, তার কাছ থেকে আর কোনওদিনই পিএম আসবে না।
তার মানে, তুমি যখন একটি মেয়েকে প্রথম পিএম করছ, তখন সেটি সেই পিএম পাহাড়ের নীচে একটি ছোট্ট নুড়িপাথর মাত্র। অর্থাত্ এতজনের মধ্যে তোমায় নিজেকে জাহির করতে হবে। বোঝাতে হবে, তুমি স্বতন্ত্র। মেয়েটির সব নজর তোমার পিএম-এর দিকেই আটকে ফেলতে হবে। নজর একবার আটকে গেলেই কিন্তু সে মেয়ে তোমার সঙ্গেই কথা বলে যাবে। বারবার। তবে তাকে কথায় বেঁধে ফেলাটাও তোমাকে জানতে হবে বইকি। কী? খুব কঠিন মনে হচ্ছে কাজটা, তাই তো?
আমার কিন্তু মোটেই অতটা কঠিন লাগত না। দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রায় সব কৌশলই বোধ হয় আমার জন্মগত। তো, একের পর-এক মেয়ের সঙ্গে কথা হত। কিন্তু কোনওটাই স্থায়ী হত না। কারণ ছিল আমার নাকউঁচু স্বভাব। আমি চাইতাম, সে একটু সুশ্রী হবে, একবিন্দুও অহংকারী হবে না, স্বার্থপরতার ধার ঘেঁষে চলবে না, আর তার লেখার মধ্যে শিক্ষা ও বুদ্ধিমত্তার কিছুটা হলেও ছাপ থাকবে।
prasenjitএরকম হয় নাকি আবার? আমারও ধারণা হয়েছিল, এরকম মেয়ে হয় না। কিন্তু ধারণাটা চিরস্থায়ী হতে দিল না ঐন্দ্রিলা।
ঐন্দ্রিলা ছিল ঠিক আমি যেমনটি চাইতাম, তেমন একটি মেয়ে। আমাদের কথাবার্তার প্রথমদিন থেকেই ও আমার মন কেড়ে নিতে শুরু করে দেয়। কখনও আবার আমিও ওর মন কাড়ি। তবে মনের এই দড়ি টানাটানির একদম প্রথমদিন কিন্তু আমি নিজের অজান্তেই জিতে গিয়েছিলাম।
শুরুতেই ও আমাকে জানিয়েছিল যে, ও প্রচণ্ড মনঃকষ্টে ভুগছে। ওর বয়ফ্রেন্ড দু’বছরের প্রেমের পর ওকে ফাঁকি দিয়ে আর-একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে ভাঙা হৃদয়ের টুকরোগুলো খুঁজে বেড়িয়েছে ঐন্দ্রিলা। পায়নি। তাই তার হৃদয় আর জুড়বে না। সে আত্মহত্যা করতে চায়। শেষবারের মতো চ্যাট করে কিছু মানুষের সঙ্গে নিজের দুঃখ ভাগ করে নিতে চায়। জানিয়ে যেতে চায়, প্রেম বড়ই নিষ্ঠুর। কেউ যেন প্রেমের ফাঁদে পা না দেয়।
নিজের পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখতে চেয়েছিল ও। পরের দিনটা হতে চলেছিল ওর জীবনের শেষদিন।
ঐন্দ্রিলার (নামটা পরে জেনেছিলাম) এই অবস্থা দেখে আমি নিজেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম। ওর জন্য আমারও মনটা কেঁদে উঠত। জানতাম, কিছু কথা বলে জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করলে সোজা আমাকে ‘ইগ্গি’ (ইগনোর) মেরে দেবে।
একটা বদ অভ্যেস আমার বহুদিন ধরেই ছিল। শব্দের সঙ্গে শব্দ মিলিয়ে চটপট একটা এলোপাথাড়ি ছড়া দাঁড় করিয়ে দেওয়া। সেদিন ঐন্দ্রিলার কথা শুনতে-শুনতে আমার মাথার মধ্যে বাংলা শব্দগুলো পরস্পরের কাঁধে-মাথায়-পিঠে-কোলে চেপে তারস্বরে চেঁচামেচি করতে লাগল। চেঁচামেচি থামাতে ওদের একসঙ্গে নিয়ে, একটা ছড়া বানিয়ে ঐন্দ্রিলাকে শুনিয়ে দিলাম। যা থাকে কপালে, দু’চোখ বুজে ডান হাতের তর্জনীটা একবার নাকের ডগা আর-একবার থুতনির ডগায় ছোঁয়ালাম, তারপর লিখে দিলাম…
পৃথিবীর অন্যান্য দুঃখী মানুষ যেমন অভুক্ত শিশু, ধর্ষিতাদের কথা লিখলাম, যারা আমাদের চেয়েও অনেক দুঃখী।
ছড়াটা পড়ে ঐন্দ্রিলা লিখল, ‘কবিতাটা কেমন লাগল সেটা বলছি না। কিন্তু আমার তোমাকে বেশ ভাল লাগছে। ভাল লাগছে আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করোনি বলে। ভাল লাগছে তুমি এক অপরিচিতার দুঃখে কাতর হয়ে মুহূর্তের মধ্যে একটা কবিতা বানিয়ে আমার চেয়েও দুঃখী মানুষের মুখগুলো মনে করিয়ে দিলে বলে। ওদের কষ্টের কাছে এখন নিজের কষ্টটা অনেক ছোট মনে হচ্ছে।’
এটা ছিল আমাদের আলাপের শুরু। ঐন্দ্রিলার আর আত্মহত্যা করা হল না। ওর আত্মোপলব্ধি শুরু হল। শুরু হল আমাদের পরস্পরকে চেনা।
যত ওকে চিনতে লাগলাম, ততই ভাল লাগতে শুরু করল। যাদবপুরে ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিল ও। সেকেন্ড ইয়ার। কসবায় বাড়ি। বাড়িতে বাবা, মা আর ভাই।
জানলাম, ঐন্দ্রিলা ক্লাসে চিরকাল ফার্স্ট হত। ওর আঁকার হাত খুব ভাল। উচ্চ মাধ্যমিকের সঙ্গে ওর বাবা জোর করে জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ওকে বসিয়েছিলেন। র্যাঙ্ক যে যথেষ্ট ভাল ছিল, সেটা না বললেও চলে। ওর কিন্তু ইচ্ছে ছিল আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার।
অহংকারের লেশমাত্র ছিল না ঐন্দ্রিলার মধ্যে। ওর নিজের যে-কোনও গুণ অনেক খুঁচিয়ে আর কায়দা করে জানতে হত আমাকে। অনেক পীড়াপীড়ি করায় ও ওর নিজের আঁকা কয়েকটা ছবি স্ক্যান করিয়ে আমাকে দেখিয়েছিল। প্রায় সবক’টাই মানুষের ছবি। অসম্ভব নিখুঁত। আঁকা না শিখেও যে ওরকম আঁকা যেতে পারে, তা আমার ধারণা ছিল না। আরও আশ্চর্য এই যে, প্রায় সব ছবিই ওর মন থেকে আঁকা।
prasenjit
নিজের হাতে আঁকা ছবি তো দেখাত, কিন্তু নিজের ছবি একবারও দেখায়নি। আমিই বোকার মতো আমার একটা ছবি নিজের প্রোফাইলে রেখে দিয়েছিলাম। সেখান থেকেই ও দেখে নিয়েছিল। আমাকে নিজের থেকে দেখাতে হয়নি। মনে হল, ওর আমাকে দেখে খুব খারাপ লাগেনি। কিন্তু ওর ছবি যখনই দেখতে চাইতাম, তখনই ধ্বনি তুলত, “আমি একটা মেয়ে, ইন্টারনেটে ছবি দিই না।” বলত, “আমাকে সামনাসামনি দেখে নিয়ো।” ওর চেহারার বর্ণনা দিতে বললাম। বলল, “আমার হাইট পাঁচ ফিট সাত ইঞ্চি। ফরসা। স্লিম ফিগার। পিঠ অবধি চুল। মুখ দেখে লোকে বলে, খুব সুন্দর। আমার আয়না অতটা বলে না।”
একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে কথা বলছি, এই ব্যাপারটা কার না ভাল লাগে? আমারও লাগত। কিন্তু তার চেয়ে আরও অনেক বেশি ভাল লাগত ওর মাতৃসুলভ স্বভাব। যে-কোনও পুরুষ তার কাছের নারীর মধ্যে প্রধানত মাতৃত্বই খোঁজে। এমন একজন নারীকে প্রার্থনা করে যে মমতার বাঁধনে বেঁধে রাখবে। খেয়াল রাখবে। যত্ন করবে। কষ্ট পেলে সান্ত্বনা দেবে। আনন্দ পেলে নিজেও তাতে গা ভাসাবে। যা কিছু নিজের ভাল, সবকিছুই ভাগ করে দেবে।
কীভাবে যে একটা মাস কাটতে চলল, বুঝতেও পারলাম না। এই একমাসের প্রত্যেকটা দিন প্রায় আড়াই-তিনঘণ্টা ধরে ঐন্দ্রিলার সঙ্গে কথা বলেছি। ওর হিউমারে নিজের হিউমার মিশিয়ে দিয়েছি। ওর প্রাক্তন প্রেমিকের শোক সম্পূর্ণ ভুলিয়ে দিয়েছি। ওকে আমার একটা পোর্ট্রেট আঁকতে বলেছি। আর নিজেও আমার মনে ওর পোর্ট্রেট এঁকে গিয়েছি।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রাত আটটা বাজার জন্য অপেক্ষা করেছি। পূর্ণ সিনেমার মোড়ের সাইবার কাফে ‘জাংশন ৮৬’-এর ম্যানেজারকে বলাই থাকত, রোজ আটটার সময়ে একটা সিট খালি রাখার জন্য। তবুও যদি কোনওদিন গিয়ে দেখতাম যে সব সিট বুক্ড, আমার ফুসফুস দু’টো পাললিক শিলা দিয়ে তৈরি হয়ে যেত। লগ ইন করেই যদি দেখতে পেতাম ঐন্দ্রিলার নামের পাশে বাল্বটা জ্বলছে, তা হলে পাললিক শিলা গলে ঝরনা হয়ে যেত। রক্ত চলাচল বেড়ে গিয়ে সারা শরীরে কাঁটা দিত।
একদিন সাহস করে ওর ফোন নাম্বারটা চেয়ে বসেছিলাম। ও দিতে রাজি হয়নি। বলেছিল, “আগে দেখাটা তো হোক। তারপর কথা দিচ্ছি ওখানেই ফোন নাম্বার দিয়ে দেব। তোমারটাও নেব। ফোন নাম্বার ছাড়া ব্যাপারটায় থ্রিল বেশি আছে না?”
হ্যাঁ। এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। পেয়েও না পাওয়ার যে কী ভীষণ আনন্দ তা যে সবকিছু একবারেই পেয়ে গিয়েছে সে কী করে বুঝবে? আমিও তাই আর চাইনি ওর নাম্বার। কিন্তু দর্শনলাভ? সেটাই বা হবে কবে?
বোমাটা কিন্তু ঐন্দ্রিলাই ফাটাল,“কাল আমাদের বন্ধুত্বের একমাস পূরণ হচ্ছে, মনে আছে?”
“তা থাকবে না আবার?” সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠলাম আমি।
“আচ্ছা! কীভাবে সেলিব্রেট করছি আমরা কালকের দিনটা?” টকাস করে আমার কোর্টে বলটা গলিয়ে দিল ও।
আকাশ-পাতাল ভেবে কিছুই মাথায় না আসাতে বলে বসলাম, “এক কাজ করা যাক। কাল রাত আটটায় আমি একটা চকোলেট কিনে এখানে ঢুকব। তুমিও একটা চকোলেট কিনে চ্যাট করতে বসবে। তারপর আমরা লগ ইন করেই খেতে শুরু করব। আমি আমার চকোলেট উপরের অর্ধেকটা খাব আর তুমি তোমার চকোলেটের নীচের অর্ধেকটা। কী? কেমন আইডিয়া?”
কোনও সাড়া নেই। আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়ল নাকি?
“ঐন্দ্রিলা আছ? নাকি আবার ডিস্কো গেলে?” ‘ডিস্কো’ মানে ডিসকানেকটেড। শর্টফর্মটা আমিই বানিয়েছিলাম।
golpo_amar_prem_repeat22পাক্কা দু’মিনিট পরে ওর জবাব এল, “দু’জনে মিলে একটাই চকোলেট কিনলে কেমন হয়?”
“মানে?” মানেটা না বোঝার মতো বুদ্ধু আমি অবশ্য কোনওকালেই ছিলাম না। সারা শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল। সেই ফুটন্ত রক্তের তোড়ে নাক-মুখ লাল হয়ে উঠল আমার। কোনও মতে লিখলাম, “তার মানে তুমি কি দ্যাখ…”
“আমরা দেখা করলে তোমার আপত্তি নেই তো?” আবার আমার কোর্টে একটা বল ছুড়ে দিল ঐন্দ্রিলা। তবে এবারেরটা ক্যাম্বিসের নয়, কাচের বল। একটু অসাবধান হয়েছ কি ভেঙে চুরমার!
লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে সামলালাম বলটা, “আপত্তি! সে কী! আপত্তি কেন? আমি তো ভাবছিলাম তুমি দেখা…”
“কী ভাবছিলে? আমি দেখা করছিলাম না কেন?”
এই সেরেছে রে! “না মানে তা নয়। ভাবছিলাম তুমি দেখা করলে তোমায় চিনব কী করে!’’ নিজের উপস্থিত বুদ্ধি দেখে এক-এক সময় তারিফ করতে ইচ্ছে হয়।
“আমি তো আমার ডেসক্রিপশনটা দিয়েইছি। সেটা দিয়ে আমাকে চিনতে পারবে না?”
“হ্যাঁ তা তো পারবই, মানে তবুও আর কী…” এবারও কিন্তু আমি বেশ চাপে
পড়ে গেলাম।
চাপ দিয়ে আবার চাপ মুক্ত করতে ঐন্দ্রিলার কোনও জুড়ি নেই। বলল, “ডোন্ট ওয়ারি ডিয়ার। তোমার ফোটো তো আমি দেখেছি। তোমাকে ঠিক চিনে নিতে পারব আমি। একটু সারপ্রাইজ় দিই না তোমায়?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে ঠিক আছে। তা হলে কোথায় কখন মিট করবে?”
“কাল রাত আটটায়। যাদবপুর থানার উলটোদিকে।”
“কেয়া বাত হ্যায়। ডান!” আমি সঙ্গে-সঙ্গে লিখলাম।
“কিন্তু একটা কথা আছে। কাল আমায় কেতকী ম্যামের বাড়ি যেতে হবে। তাই তোমাকে পাঁচ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত দাঁড়াতে হতে পারে। দাঁড়াবে নিশ্চয়ই?” সামান্য হলেও এই প্রথম একটা অহংকারের সুর বেজে উঠল ঐন্দ্রিলার কথায়।
আমি কিন্তু জানি ও মজা করছে। তাই আমিও লিখে দিলাম, “এক ঘণ্টা কেয়া, তুমহারে লিয়ে তো জ়িন্দগি ভর ইন্তেজ়ার করনে কে লিয়ে তইয়ার হুঁ ম্যায়!”
আর মাত্র আধঘণ্টা কথা বললাম। উত্তেজনায় টগবগ করছি। আর কতক্ষণ পরে কালকের সন্ধেটা আসবে? সময় যে কাটতেই চাইছে না।
সময় কাটানোর একটা উপায় আমার জানা আছে। ঘুমনো। এক ঘুমেই রাত কাবার হয়ে যাবে। অনেকটা সময় পেরিয়ে যাবে। তাই ওকে লিখলাম, “আজ উঠি গো। বাড়ি গিয়ে খেয়ে-দেয়ে ঘুমোই গিয়ে।”
“কেন? কী হল?” ও তো অবাক।
লিখলাম, “না মানে… তুমি আসবে বলে।”
ঐন্দ্রিলা আরও অবাক হল, “আমি কাল আসব বলে তুমি এখন খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়বে? মানে?”
এবার আমি চুপ।
ঐন্দ্রিলা আমাকে ডেকে চলল, “কী? কিছু বলো? আমি তো কিছুই বুঝলাম না। অ্যাই! ডিস্কো গেলে নাকি?”
আমি কথা বলব কী? আবার একটা প্রেমে ভরপুর ছড়া লিখে দিলাম ঐন্দ্রিলাকে।
“হি হি হি হি!” জবাবে শুধু এইটুকু লিখল ঐন্দ্রিলা। কিন্তু আমি বুঝলাম ওর হাসির সেতার ঝঙ্কার দিয়ে উঠল। তারপর লিখল, “আচ্ছা যাও তা হলে। কাল আমাদের প্রথম দেখা। আয়্যাম সো এক্সাইটেড!”
দ্বিতীয় অংশ
golpo_amar_prem_repeat22যাদবপুর থানার উলটোদিকে যেখানে সকলে ইএম বাইপাসে যাওয়ার বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানে আমার বাইকটায় আধবসা হয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছি। উলটোদিকের রাস্তায় চোখ রেখেছি কারণ ঐন্দ্রিলা ওই দিক থেকেই আসবে। ও কেতকী ম্যামের কাছে গিয়েছে মানে গড়িয়া থেকে আসবে।
মাঝে-মাঝেই ঘড়ি দেখছি। সেই কখন দেখেছি আটটা পাঁচ বাজে, এখন তাকিয়ে দেখি মাত্র আটটা ছয়!
হঠাত্ একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলাম যেটা এই রাতের বেলায় পাওয়ার কথা নয়। একটা কাক ডেকে উঠল। কিন্তু পাশের গাছের উপরের অন্ধকারে ঠাওর করার চেষ্টা করে কোনও কাক দেখতে পেলাম না। হয়তো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে বলে অভিযোগ জানাচ্ছে। তাও ভাল, সাদা দই ফেলে অভিযোগ জ্ঞাপন না করলেই হল।
কিন্তু এবার যে আওয়াজটা শুনলাম হলফ করে বলতে পারি যে সেটা কস্মিনকালেও কেউ রাতের বেলায় শোনেনি।
“বিগিরিওয়ালা! পুরানা সিসি বোতল কাগজ বিগরি। চামড়ার জুতো আছে বিগিরি করবেন! কাগোইজ!!”
সন্ধে পেরিয়ে রাত ঢলে গেল, ব্যাটা শিশি-বোতল-কাগজ কেনার আর সময় পেল না? কে বাবা তুমি? দেখি তো চাঁদবদনটা।
আওয়াজটা পিছন থেকে আসছিল। তাকিয়ে কিন্তু তেমন কাউকে দেখতে পেলাম না। মুখ ঘুরিয়ে সবে রাস্তার ওপারে চোখ রেখেছি, হঠাত্ আমার পিঠ ঘেঁষে একটা কুকুর ডেকে উঠল।
চমকে পিছন ফিরেই দেখি দিব্যা ভারতী দাঁড়িয়ে আছে। না মানে দিব্যা ভারতী ঠিক নয়, তবে মনে হল ভগবান যেন দিব্যা ভারতীর মুখের ছাঁচটা নষ্ট না করে এই মেয়েটির মুখটাও বানিয়ে দিয়েছেন।
“কী? বুঝতে পারছ আমি কে?” মেয়েটা মাথা নাচিয়ে বলে উঠল।
“ঐন্দ্রিলা!” আমার মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে গেল।
“হা হা!”
ঐন্দ্রিলা এসেছে একটা কালো রঙের স্লিভলেস কুর্তি পরে। আর ক্রিম রঙের জিন্স। বললাম, “তার মানে ওই আওয়াজগুলো তুমি করছিলে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। কারণ ঐন্দ্রিলা যে হরবোলার কাজটাও দারুণ ভাল পারে এটা আমার জানা ছিল না।
“তা হলে আর কে করছিল শুনি?” ভুরু নাচিয়ে বলল ঐন্দ্রিলা। ওর রূপের ছটায় ইতিমধ্যেই আমার গরম লাগতে শুরু করেছে। তারপর হঠাত্ আমার ঠোঁটের পাশেই ডান গালের কাটা দাগটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওখানে কী হয়েছিল?”
“কোনটা? এটা? এটা ছোটবেলায় কেটে গিয়েছিল।”
“সারিয়ে দেব?”
অদ্ভুত এই প্রশ্নটার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না, “কী-কীভাবে?”
ঐন্দ্রিলা ওর গোলাপি লিপস্টিকে রাঙানো ঠোঁটটা আমার ঠোঁটের খুব কাছে এনে বলল, “এইভাবে।”
ভিড় রাস্তার মধ্যে এবার যেটা ঘটল সেটার জন্য আমি প্রস্তুত তো ছিলামই না, উপরন্তু সেটা কোনও সাহসী হিন্দি ছবি ছাড়া কোথাও দেখেছি বলে মনেও পড়ে না।
আচমকা ঐন্দ্রিলা ওর টকটকে জিভটা বের করে আমার ঠোঁটের পাশের কাটা দাগটা একবার চেটে দিল।
অত্যন্ত বিস্ময়ে বলে উঠলাম, “একী দিব্যা, মানে ঐন্দ্রিলা! কী করছ?”
এটা শুনে ও আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার ঠোঁটদু’টো চেটেই চলল। আর আমার কোনওদিকে জ্ঞান নেই। আমার দু’চোখ বুজে গেল। আর থাকতে না পেরে এবার আমি ওর নরম বাহুদু’টো চেপে ধরলাম।
কিন্তু একী! ঐন্দ্রিলার হাতে এত লোম!!
নিমেষে চোখ খুলে ফেললাম। ভাল করে তাকিয়ে দেখি ঐন্দ্রিলা-টৈন্দ্রিলা নয়। এ হল আমার প্রিয় পোষা কুকুর অ্যাটিনা। আমি খাটে শুয়ে আছি। আর অ্যাটিনা খাটে উঠে আমার বুকের দু’পাশে পা রেখে মনের আনন্দে আমার মুখ চেটে চলেছে।
“ধ্যাত্! যাঃ! যা এখান থেকে। ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিল!” ঠেলে সরিয়ে দিলাম কুকুরটাকে।
হায় ভগবান আমি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম। অ্যাটিনা এসে পুরো স্বপ্নটা চৌপাট করে দিল। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, রোদ বেশ কড়া হয়ে উঠেছে। রাস্তা দিয়ে আওয়াজ আসছে, “বিগিরিওয়ালা! পুরানা সিসি-বোতল-কাগজ বিগরি। চামড়ার জুতো আছে, বিগিরি করবেন! কাগোইজ!!”
খাটের পাশে চেয়ে দেখি আমার মা পড়ার টেব্লটা গোছাচ্ছে। আমার বিরক্ত মুখ দেখে বলল, “আর কত ঘুমলে তোর শান্তি হবে? পড়াশুনো নেই, কাজকর্ম নেই, ঘুমের ঘোরেও খালি দিব্যা আর দিব্যা! আহা রে! মরে গিয়েও মেয়েটা শান্তি পেল না! তা ইন্দিরাটা আবার জুটল কোত্থেকে?”
“ইন্দিরা নয় ঐন… জানি না, যাও তো!” আর-একটু হলেই নামটা বলে ফেলছিলাম।
মায়ের এই জিনিসটা আমার খুব বিরক্ত লাগে। কোনওদিন সকালে আমি একটু বেশিক্ষণ ঘুমলেই অ্যাটিনাকে লেলিয়ে দেয়, “যা, ব্যাটাকে ডেকে তোল তো।”
অ্যাটিনাও দিব্যি ঘেউ-ঘেউ করে ডাকতে শুরু করে দেয়। আর তাতেও কাজ না হলে খাটে উঠে শুরু করে দেয় আমার মুখ চাটা।
হাই তুলতে-তুলতে ক্যালেন্ডারওলা দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালাম। ন’টা বেজে সাত। সতেরোই জুন। দু’হাজার দশ। সোমবার।
সারাটা দিন ধরে কত যে কাজ করলাম তা বলে শেষ করা যায় না। ব্ল্যাক জিন্স, ব্লু অন হোয়াইট চেক শার্ট আর সাদা রুমালটা ধরে-ধরে ইস্তিরি করা, মাত্র একবার পরা ব্রাউন রঙের বুট জোড়া ক্রিম দিয়ে পালিশ করা, তিনটে ঘড়ির মধ্যে একটা, চারটে বেল্টের মধ্যে একটা আর ছ’টা পারফিউমের মধ্যে একটা বেছে নেওয়ার মতো শক্ত কাজ, কোন মোজার দু’টো পাটিই একসঙ্গে আছে খুঁজতে গিয়ে না পেয়ে হতাশ হওয়ার শেষে অ্যাটিনার কাঁথার সাইড থেকে একটা মোজার জোড়া উদ্ধার করা, বাইকটা পেট্রল পাম্পে ধোয়াতে দিতে গিয়ে পনেরো মিনিট ধরে দর কষাকষি করা, বড় একটা সেলুনে গিয়ে চুল সেট করিয়ে, ক্লিনেস্ট শেভিং করানোর শেষে হার্বাল ফেশিয়াল মুখে লাগিয়ে আধঘণ্টা বসে থাকা, ঐন্দ্রিলাকে যে গ্রিটিং কার্ডটা দেব সেটা ওকে দেওয়ার ভঙ্গিমায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাঁচটা স্ক্রিন টেস্ট দেওয়া, খেতে বসে টেনশনের চোটে অর্ধেকের বেশি ভাত তুলে রেখে দেওয়া, অন্তত ন’বার মায়ের “তোর কী হয়েছে বল তো”-র উত্তরে “উফ! কিছু না বলছি না!” বলা, মুখে ক্লান্তির ছাপ না পড়ে সেজন্য দুপুর তিনটে থেকে পাঁচটা অবধি একটা স্বপ্নবিহীন আপত্কালীন ভাতঘুম নিয়ে নেওয়া আর সন্ধে হতেই একটা শাওয়ার নেওয়া হতে-হতে দেখি সাতটা বাজে।
আমার চিরকালীন অভ্যেসকে সম্মান জানিয়ে শেষমুহূর্তের ব্যস্ততায় পড়িমরি করে পোশাক-টোশাক পড়ে যখন বেরলাম তখন দেখি ঘড়িতে বাজে সাড়ে সাতটা।
হাজরায় এসে মনে পড়ল যে একটা বড় আর একটা মেজো সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। মেজোটা হল আমি মোবাইল নিতে ভুলে গিয়েছি। বড়টা হল গ্রিটিং কার্ডটাই আনিনি। কিন্তু আর ফিরে গিয়ে নিয়ে আসা যাবে না। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। আকাশ মেঘলা। ঝোড়ো আবহাওয়া। বৃষ্টি হলেই সব কেলো।
অবশেষে গন্তব্যস্থলে পৌঁছলাম। আটটা বাজতে দু’মিনিট বাকি। ভবানীপুর থেকে যাদবপুর এই রাস্তাটুকু যেন কাটতে চাইছিল না। থানার উলটোদিকে যেখানে দাঁড়াবার কথা সেখানে বাইকটা স্ট্যান্ড করালাম। মাথা থেকে ‘নরকের সঙ্গী’ হেলমেটটাকে খুলে বাইকের লুকিং গ্লাসে তাকালাম। যা ভেবেছি ঠিক তাই। চুলের একদম দফারফা। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলাম কেউ আমায় লক্ষ করছে কি না। বিশেষত কোনও মেয়ে কি না। তারপর পিছনের পকেট থেকে চিরুনিটা বের করে সাঁই-সাঁই করে চুলটা আঁচড়ে ঘাড়টা একটু ডানদিক-বাঁদিকে বেঁকিয়ে ঠোঁট চেটে নিলাম। মুখটা ভাল করে দেখে নিয়ে এপাশ-ওপাশ দেখতে-দেখতে চিরুনি ঢোকালাম।
গোঁফ গজানোর জায়গা আর কপালটা বারবার ভিজে যাচ্ছে, জুলফি দু’টো থেকে ঘামের ধারা নীচে নেমে আসার প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে। রুমাল দিয়ে প্রতিহত করে চলেছি আর রাস্তার ওপারে নজর রেখে চলেছি। কোনও সুন্দরী মেয়ে দেখতে পেলেই রোজকার চেয়ে আরও অন্তত দশগুণ বেশি সজাগ হয়ে উঠছি।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। কাঁটায় কাঁটায় আটটা দশ বাজে।
prasenjitওপারে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। মেরুন রঙের। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, কারণ সবক’টা কাচ তোলা। ওপাশে কেউ একজন নামছে। গাড়ির কাচে আড়াল হয়ে আছে। তাকে নামিয়ে গাড়িটা চলে যেতেই দেখতে পেলাম একটা মেয়ে। ওদিকটা একটু অন্ধকার থাকায় তার মুখ ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। তবে চেহারার বর্ণনায় যে সে ঐন্দ্রিলা সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। হাইট পাঁচ ফুট সাত কি আট। পিঠ অবধি খোলা চুল। মেয়েটা এগিয়ে আসছে। যত এগোচ্ছে, ততই তার অবয়ব স্পষ্ট হচ্ছে, কিন্তু এখনও মুখটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটুকু বুঝতে পারছি যে তার দৃষ্টি আমার দিকেই নিবদ্ধ।
অর্ধেক রাস্তা পেরিয়ে সে ডিভাইডারে উঠল। ওখানে ল্যাম্পপোস্টের আলোটা সরাসরি পড়ছে। ডিভাইডারে উঠে ও একটু দাঁড়াল, বোধ হয় আমাকে দেখছে।
এবার ওর মুখে আলো পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে একটা দমকা বাতাস ওর চুল উড়িয়ে দিল।
ব্যাপারটা নিজেরই যেন ঠিক বিশ্বাস হল না। কে ও? ও কি দেবী? এন্ট্রি নেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে দমকা হাওয়া, এ জিনিস সিনেমায় হতে দেখেছি। মুখশ্রী দেখতে পেলাম। অপরূপ সুন্দরী। ভগবানকে আমি মানুষের মধ্যেই দেখতে পাই। যে নারী ভিতরে ও বাইরে থেকে সুন্দর সে-ই হল আমার কাছে দেবী। মনে-মনে তাকে পুজো করি আমি।
ঐন্দ্রিলার মনের ভিতরটা তো আগেই দেখে নিয়েছিলাম আমি। আজ ওর বাহ্যিক সৌন্দর্যটাও দেখলাম। এত সুন্দরী একটা মেয়ে আমার জন্য ছিল?
তবে আমি প্রথমে হাসব না। আর কিছুতেই ওই ভুল নয়।
ঐন্দ্রিলাই হাসল প্রথম। ডিভাইডারের উপরে দাঁড়িয়েই। ওর হাসি দেখে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। আমিও হাসলাম।
এবার ঐন্দ্রিলা নেমে বাঁদিকে একবার চেয়ে গাড়ি আসছে কি না দেখে নিয়ে আবার আমার দিকে ফিরে হাসতে-হাসতে এগিয়ে আসতে লাগল।
আমার পা দু’টো উত্তেজনায় কাঁপছে। ঠোঁটের গোড়াটাও তাই। কান দু’টো টোস্টারে স্যাঁকা হয়েছে। সারা গায়ের লোম একবার শুকনো ব্লেড দিয়ে চাঁচলেই উঠে আসবে এমনভাবে খাড়া হয়ে আছে।
এবার এপারে এল ও। আরও ভাল করে দেখলাম আমার মন চুরি করে নেওয়া ঐন্দ্রিলাকে। গায়ের রং ফরসা, তবে অত্যন্ত নয়। পরনে একটা কালো রঙের ট্রাউজ়ার আর আকাশি রঙের টি-শার্ট। না, আকাশি নয়। রংটা টারকোয়াজ়। কানে দু’টো বড়-বড় রিং। ও বাবা, আবার নাকের বাঁ লতিতেও ছোট রিং। চোখে একটু আইলাইনার আর ঠোঁটে ন্যাচারাল কালারের লিপস্টিক। হাতে একটা ছোট হ্যান্ড ব্যাগ। পায়ে ফ্ল্যাট জুতো। আর চেহারা, একেই বুঝি বলে ডাগর-ডোগর।
আমার হাঁ করে দেখা বন্ধ করতে হল ওর ভুরু নাচানি দেখে, “কতক্ষণ এসেছ?”
“এই তো মিনিট দশ-পনেরো হল।” নাকটা চুলকে বললাম আমি।
“আয়্যাম সো সরি গো, তোমাকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য। বিশ্বাস করো গড়িয়ায় এত জ্যাম যে কী বলব! তারপর জানো, রাস্তায় একজন বয়স্ক ভদ্রলোক মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছেন। এত্ত খারাপ লাগছিল। তাড়াতাড়ি আসতে হল বলে ওঁকে একটুও হেল্প করতে পারলাম না।
“এ হে। প্রেশার ফল করেছিল বোধ হয়। আরে না, না, এটা আবার দেরি নাকি? এত বলতে হবে না। তা, আমাকে ঠিক চিনেছ বলো?” আমার হাসি অব্যাহত।
“বা রে! চিনব না?” ঐন্দ্রিলা হেসে উঠল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এবার বলো কোথায় যাবে? রেস্তরাঁ?”
“এ বাবা। না না না। চলো না খোলামেলা কোথাও গিয়ে বসে আড্ডা দিই। এই কাছেপিঠেই কোথাও।”
“খোলামেলা? কাছেপিঠে? মধুসূদন মঞ্চের সামনে যাবে?” একটু ইতস্তত করে বললাম।
“ওয়াও! দারুণ হয়। তাই চলো।” ভীষণ আনন্দ পেয়ে বলে উঠল।
বাইকে উঠে বসলাম। ঐন্দ্রিলাও বসল দু’দিকে পা দিয়ে। তারপর স্টার্ট দিলাম।
ঐন্দ্রিলা আমাকে জড়িয়ে ধরেনি। কিন্তু যেটুকু ধরেছে তাতেই আমার ভাল লাগছে। ওর সারা গায়ে মেখে থাকা মিষ্টি গন্ধটা প্রাণভরে নাকে টেনে নিয়ে বললাম, “যাই বলো, তুমি কিন্তু ডাকসাইটে সুন্দরী। কী করে হলে বলো তো?”
ঐন্দ্রিলা লজ্জা পেল। বলল, “ধ্যাত! কী যে বলো! বাবা প্রায় পনেরোজনকে টপকে আমার মাকে বিয়ে করেছিল। আমার মা দুর্দান্ত সুন্দরী। তাই বোধ হয় তার মেয়েকেও একটু দিয়েছে। কিন্তু তুমি যতটা বলছ অতটা মোটেও না।”
হাসলাম। বললাম, “তা আজ বাঁধা গোরু কতক্ষণের জন্য ছাড়া পেয়েছে?”
“দেড়ঘণ্টা,” আমার পিঠে আলতো ভর দিয়ে ঘাড়ের কাছে মুখটা এনে হালকা ফিসফিসিয়ে বলল, “দশটার মধ্যে বাড়ি না ফিরতে পারলে মা আচ্ছা করে বকুনি দেবে। গিয়ে ভাইকে তিনটে ছবি এঁকে দিতে হবে।”
বললাম, “আচ্ছা! ঠিক আছে তোমাকে সাড়ে ন’টায় ছেড়ে দেব। ওকে?”
লুকিং গ্লাসে ঐন্দ্রিলার চুল নাড়ানো দেখে বুঝলাম ও ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি জানাল।
পাঁচ মিনিটও লাগল না পৌঁছতে। বাইকটা রেখেই ঐন্দ্রিলাকে একটু দাঁড়াতে বলে চট করে একটা চকোলেট কিনে আনলাম। এনে ওকে দেখাতেই ও বলল, “এ কী! তুমি আনলে, আর আমি?”
আমি বললাম, “ওকে বাবা, অর্ধেক দাম তুমি দিয়ে দাও।”
ও হাসল, “আমি জানি, এভাবে দাম দিলে তোমার খারাপ লাগবে।”
মধুসূদন মঞ্চের সামনেটায় একটা পরিষ্কার সিঁড়ি দেখে তাতে জোরে ফুঁ দিলাম। নিজের বসার জায়গায় ফুঁ দিতে যাব, আবদারের ঢঙে বলল, “আমি ফুঁ দেব।”
ঐন্দ্রিলা তার পাতলা ঠোঁটদু’টো জড়ো করে মিষ্টি একটা ফুঁ দিল। তাতে সিঁড়ির ধুলো কতটা উড়ল জানি না, তবে আমার মনের সব ধুলো উড়ে গিয়ে এক নিমেষে মনটা যেন নির্মল আর পবিত্র হয়ে উঠল।
দু’জনে পাশাপাশি বসলাম। আমি হাজার রকম আগডুম-বাগডুম বকে যাচ্ছি, আর ঐন্দ্রিলা হাঁটুর উপরে হাত রেখে নিজের মাথাটাকে শুইয়ে দিয়ে একমনে আমার কথা শুনতে লাগল আর মাঝে-মাঝে ওর মুখের উপরে এসে পড়া চুলগুলোকে বাঁ হাত দিয়ে সরিয়ে ফুলের মতো নিষ্পাপ মুখটা বারবার যেন পাতার আড়াল থেকে বের করে আনতে লাগল। আর আমার কথা শুনে হাসতে লাগল।
ঐন্দ্রিলা যতই হাসছে ততই আমি মুগ্ধ হচ্ছি। পাতলা দু’টো ঠোঁটের মাঝখানে মুক্তোর মতো দু’সারি দাঁত। লক্ষ করলাম হাসির সময় ও কিছুতেই ওর চোখদু’টো খুলে রাখতে পারে না। তাতে হাসিটা আরও সুন্দর হয়ে যায়।
ও যত হাসছে ততই যেন আমার মনটা ওর কাছে একটু-একটু করে এগিয়ে আসছে। তাই ওকে আরও হাসাব ঠিক করলাম। বললাম, “তুমি এতেই এত হাসছ?” তা হলে আজ সকালে তোমাকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখেছি শুনবে?”
“স্বপ্ন? আমাকে নিয়ে? সত্যি?” হাসি আর ভুরু কোঁচকানোর অদ্ভুত কম্বিনেশন নিয়ে বলল ঐন্দ্রিলা, “কী স্বপ্ন গো? বলো না।”
“বলব। কিন্তু তার আগে এই চকোলেটটা খুলি। তারপর আমি হাফ আর তুমি হাফ।” চকোলেটটা খুলতে-খুলতে আমি বললাম।
“উফ্! দারুণ মজা। কিন্তু ও কী করছ?” যখন ভাঙতে গেলাম তখন বাধা দিয়ে বলল ও, “না গো, ওভাবে নয় তুমি এক-একটা ব্লক ভাঙো। তারপর সেটার অর্ধেক তুমি কামড়াও, বাকিটা আমি। ওকে?” বললাম, “ওকে। কিন্তু মাঝে-মাঝে তুমিও কামড়াবে আর বাকিটা আমি। ঠিক হ্যায়?”
“ওকে বস!” ঘাড়টা প্রায় শুইয়ে বলল ও।
শুরু হল আমার স্বপ্নটার কথা শোনানো। একটু করে কথা বলছি আর লক্ষ করছি ঐন্দ্রিলার প্রতিক্রিয়া। সেইসঙ্গে চলতে থাকল একটা করে চকোলেটের ব্লক ভেঙে আধখানা কামড়ে অপরজনকে দেওয়া। আমি একটু কামড়ে ওকে খাওয়ালে ওর কী হচ্ছিল বলতে পারব না কিন্তু ও যখন একটু কামড়ে বাকিটা ওর হাতে করে এগিয়ে আনছিল তখন দেখতে পাচ্ছিলাম ভাঙা অংশের কিছুটা ভিজে গিয়ে চকচক করছে। সেটা ওর নিজের হাতে করে আমার মুখে ঢোকানোর পর পরম তৃপ্তিতে আমার চোখ বুজে আসছিল।
golpo_amar_prem_repeat22স্বপ্নটা শেষ করার সঙ্গে-সঙ্গে আমাকে একেবারেই আশাহত না করে ঐন্দ্রিলা খিলখিলিয়ে আমার কাঁধে প্রায় ঢলেই পড়ল। ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম এই সে মেয়ে। ইন্টারনেটে যেমন ভেবেছি ঠিক তেমন। কাচঢাকা গাড়ি চড়ে এসে সে অবলীলায় আমার বাইকে শুধু বসে পড়েনি, কোলাহলের মধ্যে খোলা আকাশের নীচে নোংরা সিঁড়ির ধাপে বসে অনায়াসে আমার সঙ্গে গল্প করছে। এমন সুন্দরী অথচ নিরহঙ্কার, পবিত্র মনের মেয়ে কি দেবী ছাড়া আর কিছু হতে পারে? একে তো কিছুতেই হাতছাড়া করা যায় না। শুভস্য শীঘ্রম।
এবার আমি কোনও কথা না বলে আমার ডান হাতের তেলোটা ঐন্দ্রিলার দিকে মেলে ধরলাম। দেখলাম ও শুধু ঠোঁট দিয়ে হেসে ওর তুলোর মতো নরম হাতটা রাখল। সঙ্গে-সঙ্গে সারা শরীরের মধ্যে দিয়ে একটা হিমেল প্রবাহ খেলে গেল। চারদিকের এত আলো, এত কোলাহল কোনওকিছুই আমি আর দেখতে পাচ্ছি না, শুনতে পাচ্ছি না। দেখছি শুধু ঐন্দ্রিলার টানা-টানা দু’টো নিষ্পলক চোখ।
“আই লাভ ইউ!” একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে কথাটা বলেই ফেললাম।
আমি জানি ঐন্দ্রিলা আমার হাত ধরেছে মানে আমাকে সিগন্যাল দিয়েছে। ওর মুখ চোখ সব বলছে যে ও রাজি। শুধু আমার কথা শুনে ভীষণ লজ্জা পেয়ে আলতো করে হাতটা সরিয়ে নিতে-নিতে ও বলল, “যাঃ! কী যে বলো না তুমি বিশ্বজয়!”
বিশ্বজয়! বিশ্বজয়! বিশ্বজয়!
কী শুনলাম আমি? ঠিক শুনলাম কি? আমার নাম বিশ্বজয় হতে যাবে কেন? ও কি কারও সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলল? মুখ ফসকে ওর আগের প্রেমিকের নামটা বলে ফেলল? কিন্তু তার নাম তো আদিত্য। তা হলে কার নাম ভুল করে বলল ঐন্দ্রিলা?
আমার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। ওর মেলায়নি যদিও। কী বলব মুহূর্তের মধ্যে ভেবে নিতে হল আমাকে। একটু অন্যভাবে জিজ্ঞেস করতে হবে ওকে। বললাম, “বাঃ! আমার নামটা তোমার মুখে ভারী মিষ্টি শুনতে লাগল তো! আর-একবার বলবে?”
“হ্যাট! যাও আর বলব না।” কী মুশকিল, এ যে দেখি আরও লজ্জা পেয়ে গেল।
এবার বললাম, “আচ্ছা! আমার নাম বলতে হবে না। আমার নামের সঙ্গে মেলে এমন কোনও নাম বলতে পার? চটপট বলতে হবে কিন্তু।”
এবার কাজ দিল, ঐন্দ্রিলা বলল, “উম্ম… বিশ্বজয়ের সঙ্গে আর কী মেলে? দিগ্বিজয়!”
কোথাও একটা ভুল হয়েছে। এ রহস্যের সমাধান না হওয়া অবধি মরেও শান্তি নেই। বললাম, “আচ্ছা বেশ। তোমার নামের সঙ্গে মেলে এমন একটা নাম বলো দেখি।”
“হঠাত্ নামের মিল নিয়ে পড়লে কেন বলো তো?” হেসে বলল ও। তারপরে উপরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, “দেবলীনার সঙ্গে মেলে এমন নাম? উঁহু। ঠিক মনে পড়ছে না তো! আমার দাদার নাম তো দেবদত্ত। ওর সঙ্গে যে মেলাব তারও তো উপায় নেই। তুমি বলতে পারবে?”
আমার যা জানার জানা হয়ে গিয়েছে। এ ঐন্দ্রিলা নয়। এ হল দেবলীনা। তার মানে রং নাম্বার।
প্রবল হতাশায় ভেঙে পড়তে লাগলাম। আর-একটুও দেরি না করে মুখটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখে আমার নামটা ওকে বললাম। আমি যার জন্যে এসেছিলাম সে যে ঐন্দ্রিলা সেটাও বললাম। যাবতীয় ঘটনা যথাসম্ভব সংক্ষেপে বললাম।
দেবলীনা থাকে বাঁশদ্রোনীর কাছে। তাই এখানে আসতে ওকে গড়িয়া হয়েই আসতে হয়েছে। ও মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে অনার্স পড়ছে। ওর বাড়িতে বাবা, মা, দাদা আর ভাই আছে। তিনমাস আগে বিশ্বজয় নামে একটি ছেলের সঙ্গে ওর ইন্টারনেটে চ্যাটের মাধ্যমে আলাপ হয়। এখনও অবধি কেউ কাউকে দ্যাখেনি। ছেলেটি তার চেহারা, বিশেষত পোশাকের যা বর্ণনা দিয়েছিল তার সঙ্গে আমি মিলে যাওয়াতে আর সর্বোপরি আমিও দেবলীনাকে দেখে হেসে হাত নাড়াতে ওর কোনও সন্দেহই ছিল না যে আমিই হলাম বিশ্বজয়।
“বাবা কী করেন?” বাইকে উঠতে-উঠতে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
ও এবার একদিকে দু’পা ঝুলিয়ে বসে বলল, “চাকরি।”
“কীসের চাকরি সেটা বলা যায়?”
“থাক না ওসব,” থমথমে গলায় বলল দেবলীনা।
“ঠিক আছে থাক। এখন তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করাটা আমার সাজে না অবশ্য।” সামান্য একটু পিন ফোটালাম আমি।
“বাবা সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব কলকাতা পুলিশ,” অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল ও।
এ বিষয়ে আর কথা চলে না। অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে এলাম আমি, “তোমাকে যেখান থেকে উঠিয়েছিলাম সেখানেই ছাড়ব তো? বিশ্বজয় ওয়েট করছে নিশ্চয়ই।”
“না ও ওয়েট করছে না। ও আসেনি।”
“তার মানে? কী করে জানলে?” অবাক হলাম আমি।
“ও এলে ফোন করত আমাকে। আমি ওখান থেকেই বাস ধরে চলে যাব।”
“তুমিও তো একটা ফোন করতে পার ওকে?” একটু আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞেস করলাম।
“এতদিন ভুল করছিলাম। বিশ্বজয় আমার জন্য নয়। কথা দিয়ে কথা রাখে না এমন মানুষকে এড়িয়ে চলি আমি,” দেবলীনার গলার স্বর গম্ভীর,“হয়তো অন্য কোনও মেয়েকেও অন্য কোথাও টাইম দিয়েছে। তার সঙ্গেই আছে। ভাল থাকুক।”
মাত্র দু’তিন মিনিটের রাস্তায় আর কোনও কথা হল না। যাদবপুর থানার প্রায় একশো মিটার আগে একটা পেট্রল পাম্প আছে। দেবলীনা ওখানেই নামিয়ে দিতে বলল। ও বুঝেছে ঐন্দ্রিলা আমাদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখুক সেটা ঠিক নয়। ওখানে নেমে থানা অবধি ও হেঁটেই যাবে বলল। কিন্তু আমার কেন মনে হচ্ছে যে, দেবলীনা নয় আমার ঐন্দ্রিলাকেই আমি ছেড়ে আসছি? কেন ওকে ছেড়ে আসতে আমার মন কেঁদে উঠল?
থানার উলটোদিকে পৌঁছলাম যখন, তখন ন’টা বাজতে পাঁচ। হেলমেটের আড়াল থেকেই দেখতে পেলাম যে আগে আমি যেখানে বাইকটা রেখেছিলাম ঠিক সেখানেই একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
একই দিনে জেনে গেলাম দেবলীনার চেয়েও বেশি সুন্দরী থাকে এই কলকাতাতেই। এ নির্ঘাত ঐন্দ্রিলা। সৌন্দর্যে দেবলীনার চেয়ে এ কোনও অংশে কম তো যায়ই না বরং বেশি। গায়ের রং টুকটুকে ফরসা। নাকটা আরও সুন্দর। চোখের দৃষ্টি আরও মায়াময়। পরনে মিনি স্কার্ট আর টি শার্ট। হর্সটেল করা চুলটা দেবলীনার তুলনায় সামান্য ছোট। হাইটেও দেবলীনার চেয়ে সামান্য বেঁটে হবে।
ওর সামনে দাঁড়িয়ে হেলমেট খুললাম। চুল আর আঁচড়ানো হল না। হাত দিয়ে আমার চুলগুলো সরাতেই দেখি ও আমাকে চিনে ফেলল।
“লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখা হচ্ছিল বুঝি আমি আদৌ সুন্দরী কি না!” হালকা হেসে জিজ্ঞেস করল।
আমি আর কোনও ঝুঁকি না নিয়ে বললাম, “তুমিই ঐন্দ্রিলা তো?”
“কেন? কোনও সন্দেহ আছে? ওকে, দাঁড়াও আইডি দ্যাখাচ্ছি,” এই বলে ব্যাগ থেকে ফস করে ওর ভোটার আইডি কার্ডটা বের করে দেখিয়ে দিল ঐন্দ্রিলা।
ঐন্দ্রিলার মুখে বিন্দুমাত্র বিরক্তির ছাপ নেই। তাই এবার আমি আবার আমার উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগালাম, “ন’টা বাজতে চলল, এই এখন আসার সময় হল?”
শুনেই অদ্ভুতভাবে মুখটা বেঁকিয়ে উঠল ঐন্দ্রিলা, “উঁহু! একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখার জন্য মাত্র একঘণ্টা দাঁড়াতে পার না? জান, শয়ে-শয়ে ছেলেরা আমার জন্য বছরের পর-বছর লাইন দিয়ে আছে?”
“ও! জানলাম,” এইটুকুই শুধু বললাম।
“ওলে, বাবুলে, লাগ হয়েচে নাকি?” নেকিয়ে বলল ঐন্দ্রিলা। তারপরই গলাটা সামান্য চড়িয়ে বলল, “কী করব বলো তো! কী করে বুঝব যে, ওই বুড়োটার জন্য বাবা গাড়িটা আমার কাছে পাঠাবে না?”
“বুড়ো, মানে?”
“কে আবার? দাদু। আমার মায়ের বাবা। আমাদের বাড়িতেই তো থাকে। চোখ চেকআপ করাবার আর সময় পেল না। বাবা বুড়োটাকে আনতে গাড়িটা লেকটাউন পাঠিয়ে দিল। একটা ট্যাক্সিও পেলাম না। কতদিন পরে বাসে চড়ে এলাম জান!”
“আচ্ছা! বলো, কোথায় যাবে?”
“কোথায় যাবে মানে? তোমার বাইকে চড়িয়ে আমাকে নিয়ে যাবে নাকি? না, না। বাইক-ফাইক না। গেলে কোনও রেস্তরাঁয় যেতাম। কিন্তু আজ আর টাইম নেই গো। বাড়ি যেতে হবে।”
কে এ? এ তো আমার ঐন্দ্রিলা নয়। দেবলীনাকে খুব মিস করছি আমি। এতক্ষণে তো ওর এসে যাওয়ার কথা। ঐন্দ্রিলাকে ছাড়তে পারি। কিন্তু দেবলীনাকে? হে ঈশ্বর! এ কেমন তোমার লীলাখেলা?
ঐন্দ্রিলার কথা শুনে মনে হয়েছে ওর আমাকে পছন্দ হয়নি তাই তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে চাইছে। কিন্তু আমার ধারণা যে ঠিক নয় সেটা বুঝলাম ও ওর ফোন নাম্বারটা আমাকে দিতে চাওয়ায়।
“নাও এবার আমার নাম্বারটা নিয়ে নাও।”
“একটা কাগজ-পেন হবে? আমি আমার মোবাইলটা আনতে ভুলে গিয়েছি।”
ঐন্দ্রিলা পেন খুঁজতে তার ব্যাগ হাতড়াতে লাগল। এবার দেবলীনাকে দেখতে পেলাম। আমাদের থেকে হাত ছয়েকের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। চট করে আমাদের একবার দেখে নিল। দেখলাম ওর চোখদু’টো চকচক করছে। কাঁদছে নাকি?
“অ্যাই! ওইদিকে হাঁ করে দেখছ কী?” ঐন্দ্রিলা কোমরে একটা গুঁতো মারল।
“না মানে, তুমি আসার আগে না একটা মজা হয়েছে…” গলার স্বর খুব নামিয়ে দেবলীনার ঘটনাটা বললাম ঐন্দ্রিলাকে।
“ও হো! তার মানে খুব ভালই টাইম পাস হল বলো?” না হেসে বলল ঐন্দ্রিলা, “তা তাকে একবার ডাকো তো। ভাল করে দেখি আমার চেয়েও সুন্দরী কি না।”
ইশারায় ডাকলাম দেবলীনাকে। প্রথমে অবাক হয়ে, তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে এল।
আমি পরস্পরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। ঐন্দ্রিলা দেবলীনাকে বলে উঠল, “বাঃ! তোমাকে তো দেখতে খারাপ নয়। তা কী পড়ছ তুমি?”
দেবলীনা “আমি এই…” বলে শুরু করতে যাচ্ছিল, তার মাঝেই ঐন্দ্রিলা “এই নাও পেন,” বলে আমার দিকে একটা জেলপেন এগিয়ে দিল।
“আর-একটা কাগজ…”
“ও, কাগজ না? এই নাও।”
ঐন্দ্রিলার ডান হাতের কবজিতে ঘড়ির ব্যান্ডের ফাঁকে একটা বাসের টিকিট আটকানো ছিল। সেটা বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিল। তারপর ও ওর মোবাইল নাম্বারটা বলল, আমি ঝটপট লিখে নিলাম। তারপর রিপিটও করল।
“আর তোমার নাম্বারটা?” বলেই চট করে দেবলীনার দিকে ঘুরে “নাইস টু মিট ইউ দেবলীনা, আমাদের তো এবার যেতে হবে,” বলে একটা হ্যান্ডশেক করল। তারপর আমিও একটু ছোঁয়ার জন্য দেবলীনার দিকে হাত বাড়ালাম। দেবলীনা ওর হাত এগিয়ে দিল। হাত মেলানোর সময় দেখলাম ওর হাসিমুখটা একবার গম্ভীর হয়ে আবার হাসি ফিরে এল।
জানি ঐন্দ্রিলা পাশে, কিন্তু তবুও দেবলীনার হাত ছাড়তে একটুও ইচ্ছে করছিল না। দেবলীনাই দেখলাম ধীরে-ধীরে হাত সরিয়ে নিয়ে মৃদু স্বরে “আচ্ছা আসি” বলে আবার কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
“হ্যাঁ এবার তোমার নাম্বারটা দাও।” ঐন্দ্রিলা আমার দিকে ফিরে বলল।
আমার নাম্বার নেওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে তাতে উঠে পড়ল ঐন্দ্রিলা। তার আগেই অবশ্য দেবলীনাও বাসে উঠে চলে গিয়েছে।
বাড়ি ফিরলাম মুখে একরাশ বিষণ্ণতা নিয়ে। ভিতরে বাইকটা ঢুকিয়ে রাখার সঙ্গে-সঙ্গেই শুনতে পেলাম আমার মোবাইলটা বাজছে।
দৌড়ে গিয়ে ধরলাম।
‘‘বাপ রে! এত বুদ্ধি তুমি রাখো কোথায়?”
prasenjitমনটা অসীম আনন্দে ভরে গেল। কারণ, ফোনের ওপারের মিষ্টি গলাটা দেবলীনার।
হাসতে-হাসতে বললাম, “সবটা তো মাথায় ধরে না, তাই কিছুটা হাঁটুতেও রাখি। কেন গো?”
দেবলীনাও হাসছে। বলল, “কেন? জানো না যেন! টিকিটে তো খুব ঐন্দ্রিলার নাম্বার লেখার ভান করে নিজের নাম্বারটাই লিখলে। এ পর্যন্ত করা যায়। কিন্তু ওরই নাকের ডগা দিয়ে হ্যান্ডশেক করার নাম করে আমার হাতে টিকিটটা চালান করলে কী করে? তোমার ভয় করল না?”
“ভয় কীসের? ভয় করলে কি তোমাকে আবার পেতাম?” দৃপ্ত কণ্ঠে বললাম আমি।
“কিন্তু তুমি তো তোমার নাম্বারটা ঐন্দ্রিলাকে দিলে। ও তো ফোন করবে। তখন কী বলবে?” দেবলীনা কৌতূহলী।
শুনে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। বললাম, “আমি কি ওকে ঠিক নাম্বার দিয়েছি নাকি যে ও আমাকে ফোন করে পাবে?”
“ইস! ভারী দুষ্টু তো তুমি!” বলে দেবলীনাও প্রচণ্ড হেসে ফেলল। এবার
টের পেলাম বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
বেশ কয়েক সেকেন্ড হেসে হাসিটা একটু বাগে আনার পর দেবলীনা এবার সামান্য ফিসফিসিয়ে বলল, “এই যে মশাই, আই লাভ ইউ টু!”
©somewhere in net ltd.