নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ঝড়া পাতা

কোনও কিছু নিজে থেকে পুরনো হয় না। আমরাই বেওকুফ, ভুলে গিয়ে গিয়ে পুরনো করি সব কিছু। নইলে মনে রাখার মতো কত দিনরাত, বিকেল গড়িয়ে প্রথম গোধূলি দেখা, লাইব্রেরির কোণের টেবিলে বসে আমাদের প্রথম প্রেমের ইন্তেজ়ার…

সিদ্ধা

Nothing in this world is IMPOSSIBLE ,,,coz the word IMPOSSIBLE itself says I M POSSIBLE..

সিদ্ধা › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রেমে পড়লে যা হয়

১৮ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০১

এখন সকাল ন’টা বেজে সাত মিনিট। আহেলি নিজের ঘরে, খাটের উপর বসে আছে। বসে আছে পিঠ সোজা করে। তার চোখমুখ থমথম করছে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পিঠ সোজা করে, থমথমে মুখে বসে থাকার মানে, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। জানালার বাইরে কাক ডাকছে ‘কা-কা’ করে। ডেকেই চলেছে। আহেলির ইচ্ছে করল, জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কাকটার গালে দু’টো চড় কষায়। এটাও মারাত্মক ব্যাপার। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়া কোনও মেয়ের যখন কাককে চড় কষাতে ইচ্ছে করে, তখন বুঝতে হবে, অবস্থা খুবই খারাপ।
ঘটনা তাই। আহেলির অবস্থা খুবই খারাপ। তার মাথায় আগুন জ্বলছে। রাগের আগুন! আগুন লেগেছে বেশ কিছুদিন আগে। নিয়ম হল, রাগের আগুন ধীরে-ধীরে কমবে। আহেলির বেলায় নিয়ম কাজ করেনি। তার রাগের আগুন বেড়েছে। বনের বদলে মনের ভিতর দাবানলের চেহারা নিয়েছে। রাগ কমানোর কোনও চেষ্টা আহেলি করেনি, এমন নয়। করেছে। গত সাতদিনে সে একটা সার্ভে করেছে। সার্ভের বিষয়, ‘প্রেমে পড়লে কী হয়?’ মোট
১১ জনের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। ভেবেছিল, একডজন করবে। কিন্তু মন এতই খারাপ হয়ে যায় যে, আর এগোয়নি আহেলি। ১১ জনের মধ্যে তার কলেজ এবং টিউশনের বন্ধুরা যেমন আছে, তেমন বাইরের দু’-একজনও আছে। সকলেই নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলেছে। আহেলির বিরাট আশা ছিল, কারও না-কারও সঙ্গে তার অভিজ্ঞতা মিলবে। বাস্তবে মেলেনি। তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, রাগও চড়চড়িয়ে বেড়েছে।
এই কারণে ঘুম ভাঙার পর পিঠ সোজা করে বসে আহেলি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, রনিতকে বলে দেবে, আজই বলে দেবে। কিন্তু কীভাবে বলবে? বেশি কথা বলবে, না কম? মনে হচ্ছে, কম বলাই ভাল। শুধু ‘গুডবাই’, নাকি আরও কড়া কিছু? ‘গেট লস্ট’ বা ‘কেটে পড়ো বাপু’ শুনতে খারাপ লাগবে না তো? লাগলে লাগবে! কড়া কথা অবশ্যই দরকার। যে ছেলে ধেড়ে বয়সে… তার জন্য নরম কথা চলে না।
আহেলিকে দেখতে সুন্দর। এখন তাকে আরও সুন্দর লাগছে। সম্ভবত রাগের জন্যই! তবে ‘সুন্দরী’ হয়ে, পিঠ সোজা করে, রাগী মুখে বসে থাকার সময় এটা নয়। এই সময় তার স্নান সেরে ফেলার সময়। তারপর হুড়োহুড়ি করে তৈরি হয়ে, কোনওরকমে নাকে-মুখে খাবার গুঁজে কলেজের উদ্দেশে ছোটার সময়। আজ ফার্স্ট পিরিয়ড টিকেসি-র। মানে, তনিমাকণা চক্রবর্তীর। কঠিন প্রফেসর। তিনি ক্লাস কামাই করা ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ রেখেছেন। ক্লাস পরীক্ষার খাতার মাথায় ‘মাইনাস টেন’ বসিয়ে খাতা দেখতে শুরু করেন! এই মাইনাস টেনের ব্যাপারে টিকেসি নির্দয়। একদিন কামাইতেও দশনম্বর কাটা, আবার দশদিন কামাইতেও তাই। এই কারণে ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে আড়ালে ‘টেন টিকেসি’ বলে। তাঁর ক্লাসের কথা ছাত্রছাত্রীরা সবসময় মাথায় রাখে। আগের দিন রাত থেকেই প্রস্তুতি নেয়। কম্পিউটারের সামনে বসে রাত জাগে না, বিছানায় যাওয়ার সময় কানে আইপড নেয় না, মোবাইলে অ্যালার্ম দেয়। মোবাইলের বেশিরভাগ অ্যালার্মই আবার ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি হয়। কোনও-কোনও অ্যালার্মে ঘুম আরও গাঢ় করারও ব্যবস্থা আছে। সেগুলো খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু টিকেসির ক্লাসের আগের রাতে ছেলেমেয়েরা নিজেদের মোবাইলে খরখরে ধরনের বিচ্ছিরি আওয়াজের অ্যালার্ম সেট করে। যাতে একবার বাজলেই ধড়ফড় করে উঠে পড়া যায়। তবে এই মুহূর্তে ‘টেন’ কেন, ‘হান্ড্রেড টিকেসি’-র কথাও মাথায় নেই আহেলির। তার কোলে ডায়েরি। বন্ধুদের ইন্টারভিউ। এটাই তার সার্ভে রিপোর্ট। ডায়েরির পাতা ফরফর করে উড়ছে। আহেলি সেদিকে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে, এখনই পাতাগুলো ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফ্যালে… ইন্টারভিউয়ের কতগুলো নমুনা দেওয়া যাক,
ময়ূরী : প্রেমে পড়ে আমি এত খুশি হয়েছি যে, সারাক্ষণ ‘ওর’ জন্য মনকেমন করে। সে যে কী মনকেমন, তুই ভাবতেই পারবি না, আহেলি! একেবারে উথালপাথাল অবস্থা। খালি মনে হয়, কখন ওর সঙ্গে দেখা হবে। ওর পাশে বসেও ওর জন্য মনকেমন করে। কেউ শুনলে ‘ন্যাকা’ বলবে। বলুক! আমার কিছু এসে যায় না। আমার মনকেমন করা মুখের দিকে তাকিয়ে ও বলে, “কী হয়েছে, ময়ূরী?” আমি বলি, “তোমার জন্য মনকেমন করছে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।” ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
পূর্বাশা : আমার প্রেমের সিনড্রোম হল, তেতো সিনড্রোম! উচ্ছে, করলা, নিমপাতার ব্যাপার। আমি ছিলাম মিষ্টির ভক্ত। তেতো দেখলে একশো হাত দূরে পালাতাম, তেতো খাওয়া নিয়ে মায়ের সঙ্গে রোজ খাওয়ার টেব্লে যুদ্ধ হত। প্রেমে পড়ার পর দেখছি, সিচুয়েশন কমপ্লিটলি পালটে গিয়েছে। আজকাল তেতোর জন্য মন হু-হু করে। চেটেপুটে শুক্ত খাই, পরম আরামে চোখ বুজে করলা চিবোই, একবাটি নিমপাতার ঝোল দিলে, একচুমুকে শেষ করে আর-একবাটি চাই! খবর নিয়ে জেনেছি, প্রেমের আনন্দে জিভের টেস্ট বাডগুলোও নাকি বদলে যায়, তেতোকেও মিষ্টি লাগে!
উত্সব : প্রেমে পড়ার পর থেকে আমার চেহারায় ভেলকি এসেছে। দুর্বল ভাব, পেটের অসুখ, অ্যাসিডিটি ভ্যানিশ! একটা ঝকঝকে, চকচকে ভাব। মুখ তেলতেলে, যেন সবসময় ক্রিম মেখে ঘুরছি। অনেকেই বলে, “কী রে, উত্সব, চেঞ্জে গিয়েছিলি নাকি? বলতে নেই, শরীরটা বেশ লাগছে তোর। চেঞ্জে গেলে ওজন বাড়ে।” আমি লজ্জা পাই। কারণ, আমি দু’দিন আগে দেখেছি, ওজন বেড়ে গিয়েছে। একলাফে তিন কেজি! কাউকে তো আর বলতে পারব না, ওটা আমার নয়, আমার প্রেমের ওজন!
অরিণ্যা : প্রেমে পড়ে আমার খুব একটা লজ্জার ব্যাপার হয়েছে। খালি ইচ্ছে হয় … সরি, বলা যাবে না। (ফিক করে হাসি)।
আদিত্য : প্রেমে পড়ার ফার্স্ট ডে থেকেই আমি লাফিং ডিজ়িজ়ে আক্রান্ত হয়েছি। সেই ডিজ়িজ় চলছে। সর্বক্ষণ হাসি! কখনও জোরে হাসি, কখনও মুচকি হাসি, কখনও মিটমিট করে হাসি। না হাসলেও মুখ হাসি-হাসি হয়ে থাকে। এই তো কিছুদিন আগে ক্লাস টেস্টে ফিজ়িক্সে পেলাম কুড়িতে আড়াই। খাতা হাতে একচোট হাসলাম। স্যার গম্ভীরমুখে বললেন, “মনে হচ্ছে, মাথায় ডিফেক্ট হয়েছে!” আমি মনে-মনে বললাম, ‘অবশ্যই হয়েছে! মাথার গোলমাল দেখা দেওয়া প্রেমে পড়ার সবচেয়ে বড় অ্যাডভান্টেজ। সব ভাল লাগে।”
বন্যা : প্রেমে পড়ে আমার কাঁধের দু’পাশে দু’টো ডানা গজিয়েছে। যখনই অ্যাপো থাকে, আমি উড়ে চলে যাই। যেদিন নিজে উড়তে ইচ্ছে করে না, সেদিন বাস, ট্রাম বা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ডানাজোড়া ধার দিই। তখন ওরাই আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। এই তো সেদিন বৃষ্টিতে খুব জল জমল, একটা রিকশা ডেকে বললাম, “ভাই, এই নাও, ডানাদু’টো কাঁধে ফিট করে নাও, তারপর উড়িয়ে নিয়ে চলো!” রিকশওয়ালাও বেজায় খুশি হয়ে পিঠে ডানা লাগিয়ে সাঁইসাঁই করে উড়তে আরম্ভ করল। সকলে দেখে হাঁ। (ইন্টারভিউ দিতে-দিতে হেসে গড়িয়ে পড়া)।


সার্ভে রিপোর্ট বলছে, প্রেমে পড়ে সকলেই খুশি। আহেলিও খুশি হয়েছিল। কিন্তু সেই খুশি অন্যদের মতো টিকল না। তার কারণ রনিত। সেই রনিত এমন কাণ্ড করতে লাগল…
রনিত ছেলে চমত্কার। কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করছে। দেখতে লম্বা-চওড়া, ঝকঝকে। রাস্তাঘাটে মেয়েরা আড়চোখে দেখে। মনে হয়, সিরিয়ালের অভিনেতা ভেবে ভুল করে। রনিত এসব পাত্তা দেয় না। তার কথাবার্তাও সুন্দর। বইয়ের পোকা। শনিবার করে থিয়েটার দেখে। তার আইপডে রক, ফোক, ফিল্মের গানের সঙ্গে বেটোফেন, মোত্সার্টও রয়েছে। কম্পিউটারে লালন ফকিরের গানের স্টক করছে। নিজে গিটার বাজায়। শুধু গিটার বাজায় না, গান লিখে সুরও দেয়। তবে লজ্জায় কাউকে শোনায় না। আহেলিকে বলেছে, “একদিন শোনাব।” তবে সেই ‘একদিন’ এখনও আসেনি। প্রেমিক হিসেবে এই ছেলে যে দশে দশ নম্বর পাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রথমদিন আলাপেই আহেলি মনে-মনে দিয়েছিল দশে বারো। ইচ্ছে ছিল, পনেরো দেওয়ার। রনিত তাকে প্রপোজ় করার পর আড়াইরাত ঘুমই হয়নি আহেলির। এটা বড় কথা নয়। প্রেমে পড়লে এরকম হয়। ঘুম হয় না। বিছানায় ছটফটানি চলে। পরদিন করমচার মতো লাল-লাল চোখ নিয়ে বেরতে হয়। থেকে-থেকে ঘুম পায়। বাসে, ক্লাসে, ক্যান্টিনে, টিউশনে ঝিমুনি আসে। যারা জানে না, তারা বিরক্ত হয়। যারা জানে, তারা মুখ টিপে হাসে। আহেলির বেলায় আশ্চর্য ব্যাপার হল। রাতে না ঘুমিয়েও সারাদিন সে রইল ঝরঝরে আর চনমনে। নো ঝিমুনি, নো করমচার মতো লাল-লাল চোখ। আহেলির ধারণা ছিল, এটা রনিতের ম্যাজিক।
সেই ম্যাজিক হোঁচট খেল। ক’টাদিন পর রনিতের কাণ্ড দেখে অবাক হল আহেলি। ধেড়ে ছেলের এ কী আচরণ! শুধু ধেড়ে তো নয়, রনিত স্মার্ট, বুদ্ধিমানও বটে। তা হলে? ভারী আশ্চর্য তো! শুধু আশ্চর্যই নয়, মজারও বটে। তবে কিছুদিন যেতে যখন আবার একই ঘটনা ঘটল, তখন বিরক্ত হল আহেলি। রনিতকে বলল, “কী ব্যাপার, বলো তো? তুমি কি চুরি করছ? নাকি ডাকাতি?”
রনিত আমতা-আমতা করে বলল, “ছোটপিসি যদি দেখে ফেলত…”
আহেলি গলায় ঝাঁঝ এনে বলল, “দেখে ফেললে কী হত? এসে তোমার কান মুলে দিত?”
“না, তা নয়, আসলে যদি কিছু ভাবত…”
আহেলি থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “কী ভাবত? তুমি প্রেম করছ? ভাবলে ভাবত। তাতে কী হয়েছে? ভাইপোদের প্রেম করা কি অপরাধ?”
রনিত একটু হাসল। হাসিটা হল ক্যাবলা ধরনের। বলল, “যাহ্! কী যে বলো না, আহেলি। ছোটপিসি যদি দেখত প্রেম করছি, আমার সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা তৈরি হত না তার মনে?”
আহেলি হাঁটা শুরু করে বলল, “প্রেম করা খারাপ?”
“তা কেন হবে? প্রেম করা খুবই ভাল। বড়রা বুঝতে চায় না।”
আহেলির খুব রাগ হচ্ছিল। তার একটা কথাও বলতে ইচ্ছে করছিল না। ছোটপিসিকে দেখে রনিত যে তাকে ফেলে অমন লাফ দিয়ে ফুটপাথ বদলাবে, সে ভাবতেও পারেনি। অ্যাক্সিডেন্টও তো হয়ে যেতে পারত। এই ঘটনা আজই প্রথম নয়। প্রথম হয়েছে দশদিন আগে। দশ নয়, এগারোদিন। সেদিন সকাল থেকে অল্প-অল্প বৃষ্টি ছিল। আকাশ মেঘলা। ভেজা-ভেজা ঝোড়ো বাতাস। কফি নিয়ে প্রেম করার জন্য আইডিয়াল দিন। প্ল্যান করেই কফিশপে বসেছিল দু’জনে। আহেলি সবে কফির পেয়ালায় চুমুক দেবে হঠাত্, “এই রে! মেজকাকার বন্ধু ঢুকছে,” বলে রনিত লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে, সাঁ করে ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দিল। হতভম্ব আহেলি কাচের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল, ক’জন সুট-টাই-পরিহিত লোক গম্ভীর মুখ করে ঢুকল। টেব্লে বসে কফি আর স্যান্ডউইচ খেয়ে দ্রুত বেরিয়ে চলেও গেল। পুরো সময়টা ওয়াশরুমেই কাটিয়ে দিল রনিত। ধেড়ে রনিতের ভয় দেখে আহেলি সেদিন যেমন অবাক হয়েছিল, তেমন মজাও পেয়েছিল। খুব হাসল একচোট। প্রথমদিন তো তাই। পরদিন আর হাসি পেল না। পার্কস্ট্রিটে ‘বুলুদি’-কে দেখতে পেয়ে রনিত শাড়ির দোকানে ঢুকে লুকিয়ে পড়ল। গম্ভীর হয়ে গেল আহেলি। সেইসঙ্গে চিন্তিতও। এ কী ছেলে রে বাবা! রাতে চ্যাট করার সময় সে রনিতকে প্রশ্ন করল, “বুলুদি কে?”
রনিতের জবাব দিল, “আমাদের ফ্ল্যাটে থাকে। থার্ড ফ্লোর, ব্যাক সাইড।”
আহেলি ভুরু কুঁচকে লিখল, “তাকে দেখে লুকিয়ে পড়ার কী ছিল?”
“কী বলছ, আহেলি! যদি দেখে ফেলত!”
আহেলি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে টাইপ করল, “সো হোয়াট?”
“বুলুদি ফ্ল্যাটসুদ্ধ সকলকে বলে বেড়াত। বলে বেড়াত, রনিকে আজ দেখলাম একটা মেয়ের সঙ্গে ঘুরছে।”
বিরক্ত এবং অপমানিত আহেলি এবার লিখল, “এটা কোন সাল তুমি জানো? কোন সেঞ্চুরি?”
রনিতের জবাব, “কেন জানব না?”
“তোমার কাণ্ড দেখে আজ মনে হল, জানো না। মনে হচ্ছে, তুমি বহুবছর আগের কেউ। স্টোন এজের মানুষ। আইস এজও হতে পারে। অবশ্য আইস এজে কোনও বুদ্ধিমান ছেলে ফ্ল্যাটের বুলুদিকে দেখলে এমন নার্ভাস হয়ে যেত বলে আমার মনে হয় না। তোমার কী মনে হয়? যেত? হিস্ট্রি বই কনসাল্ট করতে পারো।”

আহেলি সেদিন হালকা রাগ দেখিয়ে কম্পিউটার বন্ধ করে দিয়েছিল, মোবাইলও। একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার। যে ছেলে প্রেমিক হিসেবে দশে বারো নম্বর পায়, তার এ কেমন টেনশন! প্রেম করতে এত ভয়! মেয়েরাও তো আজকাল এরকম করে না। দেবপ্রিয়ার বয়ফ্রেন্ড তো দেবপ্রিয়ার বাড়িতে গিয়েই আড্ডা মারে। আদিত্য কতদিন কলেজ থেকে মোটরবাইকে আয়ুসীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। এমনকী, ওর বাড়িতে খাওয়াদাওয়াও করে ফিরেছে। বিজনদার মা কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন। সকলের জন্য যেমন গিফ্ট এনেছেন, আনন্দীর জন্যও এনেছেন। নীল পাথর বসানো গলার হার। এসব শুনলে রনিত তো অজ্ঞান হয়ে যাবে। না, ছেলেটাকে বোঝাতে হবে। শুধু রুচি, লেখাপড়া, স্বভাবে ভাল হলেই তো হবে না, প্রেমের ব্যাপারেও স্মার্ট হতে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আহেলি ঠিক করল, রনিতকে বোঝাবে। বোঝাবে, এই ভয় জয় করতে হবে।
ক’দিন ধরে আহেলি বোঝাল। বোঝাল কখনও হেসে, কখনও গম্ভীর হয়ে। রনিতও বুঝল। নিজেই বলল, “সত্যি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। প্রথম প্রেমে পড়েছি তো, প্রেমে ঠিক কী-কী হয় বুঝে উঠতে পারিনি।”
আহেলি চোখ পাকিয়ে বলল, “তার মানে!”
রনিত আওয়াজ করে হেসে উঠল। আহেলিও হাসল। বুঝল, রনিতের ছেলেমানুষি অনেকটা কেটেছে। কিন্তু সেই বোঝা যে কতখানি ভুল বোঝা, আহেলি টের পেয়েছে গত শুক্রবার। আজ থেকে সাতদিন আগে।
সেটা ছিল রনিতের সঙ্গে আহেলির প্রথম সিনেমা যাওয়ার দিন। আহেলির বুক ধুকপুক করছে। একই সঙ্গে উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ। অন্ধকার হলে দু’জনে পাশাপাশি বসবে। এক টাব থেকে পপকর্ন খাবে। কথা হবে ফিসফিস করে। কাঁধে কাঁধ লাগবে। হাতে হাত ঠেকবে। ছেলেদের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি কোনও ব্যাপার নয়। কলেজে তো ছেলেদের সঙ্গে মারপিটও হয়। তাতে বক্সিং, কুস্তিও বাদ থাকে না। কিন্তু রনিত তো আহেলির কাছে শুধু ছেলে নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি। এটাই ধুকপুকুনির কারণ। রনিত টিকিট কেটে ফিরে এলে দু’জনে হলে ঢুকতে গেল, আর তখনই এক মোটাসোটা, গোলগাল মাঝবয়সি মহিলা এগিয়ে এল রনিতের দিকে।
“আরে! রনি না!”
আহেলি চমকে একপা পিছিয়ে গেল। এ আবার কে! রনিত থতমত খেয়ে বলল, “হ্যাঁ, রনি, তবে আপনাকে ঠিক…”
মহিলা একগাল হেসে বললেন, “চিনতে পারছিস না তো? পারবি কী করে? কতদিন পরে দেখছিস, বল তো! আমিও তাই। তখন তুই এইটুকু ছিলি,” হাত দিয়ে মাপ দেখালেন মহিলা। সেই মাপ ফুটদুয়েকের বেশি হবে না। মেরেকেটে আড়াই। আহেলি ইতিমধ্যে আরও সরে গিয়েছে। রনিত মাথা চুলকে বোকার মতো হাসছে। তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, মহিলাকে সে চিনতে পারেনি।

মহিলা উত্সাহ নিয়ে বললেন, “আমি তোর বড়মাসি রে! ডিরেক্ট নয়, তোর মায়ের খুড়তুতো দিদির দূরসম্পর্কের বোন। বালিগঞ্জে থাকি। সেই যে একবার আমাদের বাড়ি গিয়ে একটা ফুলদানি ভেঙেছিলি, মনে পড়ছে? তখন কোন ক্লাসে পড়তিস যেন? থ্রি, না ফোর?”
রনিত বিড়বিড় করে বলল, “আমি… বালিঞ্জের বাড়িতে ফুলদানি…”
মহিলা রনিতের কাঁধে আদরের চাপড় মেরে বললেন, “থাক, আর কষ্ট করে দুষ্টুমির কথা মনে করতে হবে না। বাপ রে, কী লম্বা হয়েছিস! ফুলদি কেমন আছে রে?”
রনিত ঘাড় নেড়ে নার্ভাস গলায় বলল, “মা? মা ভাল আছেন।”
“সিনেমা দেখতে এসেছিস? ভাল করেছিস। তোরা ছেলেমানুষ, তোরা সিনেমা দেখবি না তো কে দেখবে? আমিও নিজের ইচ্ছেয় আসিনি। তোর মেসো জোর করে এনেছে। আমি বললাম, যাব না। ও বলল, একা-একা সিনেমা দেখায় নাকি মজা নেই। বুড়োবয়সে আদিখ্যেতা! তুই তো দিব্যি একা এসেছিস। তাই তো?”
দূরে দাঁড়িয়েই আহেলি শুনতে পেল রনিত কপালের ঘাম মুছে বলল, “হ্যাঁ, একাই এসেছি।”
“ভাল। ফুলদিকে বলিস, ফোন করব। আজকালের মধ্যেই করব। সিনেমা শেষ হলে আমায় ফোন নাম্বার দিয়ে যাবি। এখন দেখি, তোর মেসো টিকিট পেল কি না। যা তুই আনন্দ করে সিনেমা দ্যাখ।”
আনন্দ কোথায়! সিনেমা হলের গদির চেয়ারে কাঠ হয়ে বসে রইল রনিত। যেন তার ফাঁসি হবে। পপকর্ন, সফ্টড্রিঙ্ক তো দূরের কথা, আগাগোড়া ভান করে গেল, পাশে বসা আহেলিকে সে চেনেই না। একবার শুধু ফিসফিস করে বলল, “চিনতে পারছি না। মনে পড়ছে না।”
আহেলি ঘাড় সোজা করে ফিসফিসিয়ে বলল, “তা হলে এত ভাবছ কেন?”
“আমি না পারি, উনি তো চিনতে পেরেছেন। তোমাকে দেখতে পায় যদি।”
“কী হবে দেখলে!” আহেলি দাঁতে দাঁত ঘষে বলল।
রনিত বিড়বিড় করে বলল, “তুমি বুঝবে না। শুনলে না, মাকে ফোন করবে বলল।”
“করলে কী হবে?”
রনিত কোনও উত্তর দিল না। ইন্টারভ্যালের সময় একছুটে হলের বাইরে পালাল। ফিরল অন্ধকারে, সিনেমা শুরু হওয়ার পর। ততক্ষণে রাগে-দুঃখে চোখ জল এসে গিয়েছে আহেলির। বুঝিয়েও লাভ হল না। মনে হচ্ছে, রনিত এখনও স্কুলে পড়ে। নইলে খুড়তুতো, না মাসতুতো বড়মাসিকে দেখে কেউ ভয়ে কাঁপতে পারে? আহেলি মোটামুটি নিশ্চিন্ত হল, প্রেমের বিষয়ে রনিতের যে অসুখটা আছে, তার নাম ক্যাবলামি! এবার মাথায় আগুন জ্বলল আহেলির। একবার মনে হল, সিনেমা না দেখেই উঠে যায়। তারপর ভাবল, থাক, যা করার পরে করবে, সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে। তবে আসল ঘটনা ঘটল সিনেমা শেষ হওয়ার পর। রনিত আহেলিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল। কত দ্রুত এলাকা ছেড়ে সরে পড়া যায়, তার চেষ্টা। আবার আকাশ ফুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন সেই মোটাসোটা, গোলগাল ‘বড়মাসি’। এবার সঙ্গে এক ভদ্রলোক। আহেলি রাগে মুখ ফেরাল। মহিলা অপ্রস্তুত গলায় রনিতকে বললেন, “সরি, একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। আসলে আমার বোনপো রনির সঙ্গে তোমায় গুলিয়ে ফেলেছিলাম, ওকে সেই ছোটবেলায় দেখেছি কি না… তোমাকে দেখে রনি ভাবলাম। অনেকটা একরকম চেহারা… একটু আগে আমার হাজ়ব্যান্ডের কাছে শুনলাম, রনি এখন আমেরিকায়। পড়তে গিয়েছে। রনির বাবার সঙ্গে পরশুই তার দেখা হয়েছিল। যাক, কিছু মনে কোরো না, ভাই।”
রাস্তায় নেমে রনিত বলল, “ভেরি সরি, আহেলি। আমারও ভুল হয়ে গিয়েছে। এখন লজ্জা লাগছে।”
আহেলি চুপ করে রইল। রনিত মাথা চুলকে বলল, “আসলে কী জানো, আমার মনে হয়, প্রেমে পড়লে এরকম হয়। অনেক ভুল হয়ে যায়। ভুল না হলে, যেখানে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই, সেখানে কেউ ভয় পায়? বলো তুমি?”
আহেলি তাও কিছু বলে না। গত সাতদিনই কিছু বলেনি সে। রনিতের সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে। প্রেমে পড়লে কী হয়, তার সার্ভে করেছে। সে রিপোর্ট বলছে, প্রেমে পড়লে আর যা-ই হোক, রনিতের মতো কেউ ভয় পায় না, ক্যাবলাও হয়ে যায় না। এদিকে আহেলির মতো কাউকে মাথায় আগুন জ্বালিয়ে বসে থাকতেও হয় না। অতএব… আহেলি সেলফোনটা হাতে নিয়ে রনিতের নাম্বার ডায়াল করল। বিকেলে কফি হাউসের নীচে আসতে বলবে। সেখানেই ফিনিশ… দ্য এন্ড! ভিতু প্রেমিককে চিরকালের মতো বিদায়! জানালার বাইরে কাকটা এখনও ডাকছে। খাটে বসে কটমট করে তার দিকে তাকাল আহেলি।
কলেজ স্ট্রিট ধরে হাঁটছে রনিত আর আহেলি। আহেলি বকবক করেই চলেছে। সে ভেবেছিল, কথোপকথন ছোট হবে। জাস্ট কাজের কথা। তা আর হল না, কথা বড় হয়ে গেল। সার্ভে রিপোর্টের পুরোটা রনিতকে শোনাল আহেলি। সকালে ‘টেন টিকেসি’-র ক্লাস করতে না পারার জন্য আগামিকাল ক্লাসটেস্টে তার রেজ়াল্ট কতটা খারাপ হতে পারে, সেই আশঙ্কার কথা বলল। সাতদিন ধরে মাথায় আগুন জ্বলে থাকার খবর জানাল। এমনকী, কাকের কথা বলতেও ছাড়ল না। মেজাজ খারাপের সময় কাকের ডাক হল আগুনে ঘি। এর মাঝখানেই রনিত আপ্রাণ চেষ্টা করল বোঝাতে। সে নাকি নিজের গোলমাল ধরতে পেরেছে। মনে সাহস এনে সেই গোলমাল ঠিকও করে নিয়েছে। প্রেমে পড়লে যে এই সব সামান্য ভয়কে তুচ্ছ মনে করতে হয়, হেসে উড়িয়ে দিতে হয়! আর চিন্তা নেই! ছোটপিসি, মেজকাকা, বড়মাসি, বুলুদিরা তাকে আর কাবু করতে পারবে না। আহেলি, রনিতের এই কথায় আমল দিচ্ছে না। সে এই ছেলেকে চিনে গিয়েছে। ভিতু, ক্যাবলা ছেলের সঙ্গে আর যাই হোক, প্রেম করা যায় না। ছেলে চমত্কার হলেও নয়। বিবেকানন্দ রোডের মুখে এসে কাজে কথাটা বলতে মুখ তুলল আহেলি, আর তখনই চোখ পড়ল সিগন্যালে আটকে থাকা ট্রামের জানালায়। আঁতকে উঠল সে! ও কে? প্রফেসর টিকেসি না? ঠিকই তো! ওই তো ‘টেন টিকেসি’! চশমা নাকের উপর নামিয়ে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। একটাও কথা না বলে, দাঁড়িয়ে থাকা বাসটায় উঠে পড়ল আহেলি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা রনিতকে অবাক করে বাস ছেড়ে দিল হুড়মুড়িয়ে।
রাতে বাড়ি ফিরে আহেলি তার ‘প্রেমে পড়লে কী হয়’ সার্ভে রিপোর্টে নিজের নামটাও যোগ করেছে। পাশে লিখেছে, প্রেমে পড়লে একধরনের ক্যাবলামার্কা, বোকা-বোকা ভয় হয়। সেই ভয়টাই ভাল লাগে!

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৬

সাঈদ মোহাম্মদ ফাহিম আবরার বলেছেন: আ হা অনেক ভালো লেগেছে

২০ শে মে, ২০১৫ সকাল ১০:৪৮

সিদ্ধা বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.