![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Nothing in this world is IMPOSSIBLE ,,,coz the word IMPOSSIBLE itself says I M POSSIBLE..
বাসন্তী রঙের শাড়ি, সোনালি ঝুমকো, কাজল আর ছোট্ট একটি মায়াবী কালো টিপ…আজ সরস্বতী পুজো…হৈমন্তীকে আজ বড়ই সুন্দর লাগছে। তবে, একথা তাকে কে বোঝায়? সকাল থেকে কমপক্ষে কুড়িবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের রূপ বিচার করা হয়ে গেছে তার। কখনও চুলটা এক কাঁধে ফেলে দেখে, তো কখনও কানের পিছনে দেয়। আবার কখনও কালো টিপের জায়গায় লাল টিপ পরার কথা ভাবে। মাসি, কাকু, মা, দিদা, মৌমিতা, মঞ্জরী, নিশা সকলে ওকে হাজারবার বলেছে যে, ওকে খুব সুন্দর দেখতে লাগছে। দিদা তো ওর চিবুক ধরে আদর করে ‘রানি রাসমণি’ পর্যন্ত বলে দিয়েছে! মঞ্জরী, নিশারা তো ওকে শ্রীদেবী পর্যন্ত বলতে বাকি রাখেনি! হৈমন্তী কিন্তু কারও কথাতেই যেন ভরসা পাচ্ছে না। সে নিজে খুব ভাল করেই জানে যে, তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, কিন্তু তার চিন্তা অন্য… শ্রীময়ীর সাজ যদি আজকে তার সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে যায়!
সকলে জানে, সে নিজেও জানে, সে শ্রীময়ীর চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর! শ্রীময়ীর নাক বোঁচা, ওর ঠোঁটের উপর একটা বড় তিল আছে। কিন্তু সবসময়ই সে এমন সেজেগুজে থাকে যে লোক তাকে ঘুরে দেখতে বাধ্য হয়। তা দেখুক, হৈমন্তীর রূপও কারও চোখ এড়ায় না! আসলে সমস্যাটা সূর্যকে নিয়ে। সূর্য সবসময় শ্রীময়ীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ! মুখে না বললেও তার চোখ জানিয়ে দেয় কথাটা।
হয়তো সকলে মিলে ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা মারছে। এর মধ্যে হঠাত্ যদি শ্রীময়ী এসে পড়ে, তা হলে সূর্যর মুখের কথা থেমে যায়, গালে আপনা-আপনি সূক্ষ্ম টোলটা দেখা যায়। হৈমন্তীর ভিতরটা জ্বলতে থাকে, শ্রীময়ীর প্রতি রাগ আরও বেড়ে যায়!
“হেমাদি, এই নিয়ে সাতাশবার হল!” মঞ্জরী কপালে ভ্রুকুটি নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হৈমন্তী আয়নার সামনে থেকে উঠে গিয়ে দরজার সামনে চেয়ারে বসল। সামনের কাচের আলমারির দিকে তাকিয়ে, মুখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগল। নিশা ছুটে এসে খবর দিল সূর্য আর তার বন্ধুরা এসে গিয়েছে! হৈমন্তী ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ল। আর-একবার আয়নায় নিজের মুখ দেখে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নেমে গেল সে।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে গিয়েছে। সরস্বতী পুজোর দিনে মেয়েদের ক-অ-অ-ত সুন্দর লাগে, এই নিয়ে সূর্য অনেক কথাই বলেছে। কিন্তু, একবারও মুখ ফুটে হৈমন্তীকে কেমন লাগছে বা তার সাজ নিয়ে কোন কথা বলেনি! হৈমন্তী মিষ্টি দিতে গিয়ে কখনও আলতো করে ঘাড়ের উপর থেকে চুলটা সরিয়েছে, কখনও ঘুরে দেখার সময়ে আঁচলটা উড়িয়ে দিয়েছে। সূর্যর যেন সে দিকে চোখ-ই গেল না!
বেশ অনেকটা সময় কেটে গেল। হৈমন্তী আর পারছে না! তার ভিতরটা উথালপাথাল করছে সূর্যর মুখে দু’টো মিষ্টি কথা শোনার জন্য। সে আর না থাকতে পেরে নিজেই বলে বসল যে আজ তার দিদা তাকে ‘রানি রাসমণি’ বলেছে। কথাটা শেষ করবার আগেই পিছন থেকে কেউ সূর্যর চোখ টিপে ধরল। সূর্য একগাল হেসে চোখ থেকে সেই দু’টো হাত নামাতে-নামাতে বলল, “শ্রী! পাগলি কোথাকার!” হৈমন্তী শ্রীময়ীর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। কিন্তু শ্রীময়ীর সাজ দেখে সে আশ্বস্ত হল। না! আজ তাকে শ্রীময়ীর চেয়ে বেশি সুন্দর দেখতে লাগছে। শ্রীময়ী বসা মাত্র সকলে তাকে দেরি করে আসার জন্য বকাবকি করতে লাগল। আবদার করা হল যে, শাস্তি হিসেবে তাকে এখনই একটা গান গাইতে হবে! শ্রীময়ীও চট করে গান ধরল ‘প্রাণ চায়, চক্ষু না চায়…’ গান শেষ হওয়া মাত্র হাততালিতে ঘর ভরে গেল। সূর্য বলল, ‘‘এতক্ষণে এনজয় করা শুরু করছি! রবি ঠাকুর দিয়ে শুরুটা বেশ ভাল হল। এবার একটা ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র গান হয়ে যাক…” হৈমন্তীর বুকে যেন সমুদ্রের মতো বড়-বড় ঢেউ আছাড় খেতে লাগল। সে কাজের ছুতো করে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
সেদিন রাতে হৈমন্তীর চোখে ঘুম এল না। তার পরের দিনও এল না। সে ভাবতে লাগল। সে গান গাইতে পারে! (যদিও হয়তো শ্রী-র মতো ভাল নয়) নাচতে পারে! ছবি আঁকতে পারে! সে পড়াশোনাতেও ভাল এবং অনেক বেশি বুদ্ধিমতী! তা হলে সকলে কেন শুধু শ্রীকে নিয়ে মাতামাতি করে?! সূর্য ব্যাটাও একটা ইডিয়ট! হৈমন্তী ওকে পাত্তা দিচ্ছে, তাতে সূর্যর তো ধন্য হয়ে যাওয়ার কথা। তা নয়, তার মুখে শুধু ‘শ্রীময়ী!’ ‘ময়ী’ তো মইয়ের মতো-ই লম্বা! আবার ঠিক করে বাংলা পর্যন্ত বলতে পারে না, ‘চ’-র জায়গায় ‘ছ’ উচ্চারণ করে!
হৈমন্তী মনে-মনে ঠিক করল, সে যে শ্রী-র চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর ও গুণবতী, তা সকলকে বুঝিয়ে দিতে হবে… বিশেষ করে সূর্যকে!
পরের দিন হৈমন্তী নাচের গ্রুপের মেয়েদের জানাল যে, তারা পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠানে ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যটি পরিবেশন করবে। সকলের মাথায় বাজ পড়ল যেন! এতদিন ধরে ঠিক ছিল যে, এবছর তারা শুধু একটা গানেই নাচবে এবং এতদিন শুধু সেটার রিহার্সালই করা হয়েছে। একমাসে এতবড় নৃত্যনাট্য কী করে তুলবে তারা? এর আগে তারা তো কখনও এত বড় করে কিছু করেনি! তার মধ্যেই আবার পরীক্ষা সর্বনাশ! কিন্তু কিছু উপায়ও নেই। হৈমন্তী শুধু টিম লিডার নয়, সে ভীষণ জেদিও! সে যদি বলে নাটক হবে, তো হবে-ই!
রিহার্সাল শুরু হল। অনেক উদ্দীপনা, শ্রম, ভয় ও আনন্দ নিয়ে রিহার্সাল চলতে থাকল। হৈমন্তীর এখন দম নেওয়ারও সময় নেই! প্রতিদিন প্রায় বারো ঘন্টা ধরে নাচের প্র্যাকটিস চলছে! একইসঙ্গে পাগলের মতো পড়াশোনাও করে চলেছে সে। পরীক্ষায় যাতে শ্রী তাকে কোনভাবে ছাপিয়ে না যায়! মাঝে-মাঝে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে সর্বাঙ্গ ব্যথা করে তার, মনে হয় আজকের দিনটা ছুটি নিলেও হয়। কিন্তু শ্রী-র ঠোঁটের উপর সেই তিলটা মনে পড়ে গেলেই তার অঙ্গে কোন ব্যথা থাকে না! হয় তো থাকে, কিন্তু মনের জ্বালা সেটাকে ছাপিয়ে যায়।
অনুষ্ঠানের দিন এসে গেল। আবৃত্তি, গান ইত্যাদির পরে শুরু হল ‘শ্যামা’। হৈমন্তী নিজের মনপ্রাণ উজাড় করে নাচল। কোথাও নিজের হাসিতে দর্শকের মনে ফুলের বৃষ্টি ঝরাল! কোথাও আবেগে, কান্নায়, তার নৃত্যের তালে-তালে দর্শকের দীর্ঘশ্বাসও যেন তালে-তালে পড়তে লাগল। নাচ একসময়ে থামল। অনুষ্ঠান শেষ হল। সারা হলঘর হাততালিতে ফেটে পড়ল!
হৈমন্তী গর্বের সঙ্গে সাজঘরে ঢুকে নিজের বান্ধবীদের জড়িয়ে ধরল। মঞ্জরীকে জিজ্ঞেস করল, “বাকিরা কোথায়?” ‘বাকিরা’ বলতে সে সূর্যর কথা-ই বোঝাতে চেয়েছিল।
“সূর্যদা তো আসেনি! ওর বাবার অসুখ তাই বিকেলেই বাড়ি চলে গিয়েছে”, জানাল মঞ্জরী। হৈমন্তী যেন আর কিছুই শুনতে পেল না, চারদিক যেন অন্ধকার হয়ে এল! হৈমন্তী কান্নায় ভেঙে পড়ল। সেই কান্নার কারণ বোঝার কারও সাধ্য নেই! কেউ তার কান্না থামাতেও পারল না। হৈমন্তী সেই সাজঘরের বড় আয়নার সামনে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। এ কান্না শ্যামার একাকিত্বের চেয়েও অনেক বেশি। তার মনের আশার ভেলা ভেঙে জলে মিশে গেছে। সেই জল তার চোখ দিয়ে বৃষ্টির মতো পড়তে লাগল…
বেশ ক’টা দিন কেটে গেল। ছুটি চলছে। হৈমন্তীর সূর্যের সঙ্গে দেখা হয় না। সূর্য ফোন করলে হৈমন্তীকে খুব কম পাওয়া যায়। কেমন আছে হৈমন্তী? সূর্যের যেন মনের ভিতরটা সকাল-বিকেল উসখুস করতে থাকে। শ্রীময়ী প্রায় তার বাড়ি আসে, আড্ডা মারে, গান শোনায়। বাকি বন্ধুরাও মাঝে-মাঝে এসে হুল্লোড় করে। শুধু…হৈমন্তী আসে না। এই শ্রীকে সবটা পাওয়াতেও সূর্যের কোনও আনন্দ নেই! কোথাও যেন হৈমন্তীর সেই ঈর্ষায়, হিংসেয় লাল-হয়ে-যাওয়া মুখটা সে খুব মিস করছে! অজান্তেই, কোথাও যেন তাল কেটে গিয়েছে…
একদিন সূর্য হৈমন্তীর বাড়ি এসে উপস্থিত হল। তার ঘরে ঢুকে দেখল যে, হৈমন্তী খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে কিছু পড়ছে। খাটে পায়ার পাশে ঘুঙুরগুলো পড়ে আছে। তার এলোচুলগুলো অগোছালোভাবে এক কাঁধে ফেলা রাখা। কাছে গিয়ে সূর্য দেখল তার মুখের সামনে গীতবিতান খুলে রেখেছে হৈমন্তী।
সূর্য ডাকল, “হেমা, কী পড়ছিস?”
হৈমন্তী মাথা তুলে তাকাল। তারপর হঠাত্, যেন তার সবে ধ্যানভঙ্গ হয়েছে এমনভাবে চোখদু’টো রগড়ে বলল, “চিত্রাঙ্গদা।”
সূর্য হেসে পাশে বসল, “নাচ বুঝি এখন নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে? তা ভাল। সকলে তোর নাচের খুব প্রশংসা করছে! বলছে তুই নাকি এক্কেবারে ফাটিয়ে দিয়েছিস!”
হৈমন্তী একটু কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোকে কে বলল?”
“সকলে বলছে! গতকাল তো শ্রী বলছিল। তুই নাকি নিজের অভিনয়দক্ষতাও প্রমাণ করে দিয়েছিস! শ্যামার চরিত্রেও নাকি তোকে খুব মানিয়েছিল!”
“হুমমম…”
“আমি কি বললাম জানিস?” হৈমন্তী উত্তর না দেওয়ায় সূর্য নিজের হাতটা তার হাতের উপর রেখে বলল, “আমি জানতাম যে, ও খুব ভাল নাচে! ও যে ভাল করেছে এটাই তো স্বাভাবিক!”
হৈমন্তী এবারও কোনও উত্তর দিল না। সূর্য আরও একটু কাছে এসে বলল, “তুই রাগ করেছিস হেমা? বিশ্বাস কর, বাবার শরীরটা সত্যি হঠাত্ করে খারাপ হয়েছিল। না হলে আমি কখনও এরকমভাবে চলে যাই! তা ছাড়া আমি তো জানতাম যে, তুই খুব ভাল নাচিস! এবং শ্যামা…”
হৈমন্তী ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “থাক! আমি রাগ করিনি! নাচটা দেখে তারপর না হয় প্রশংসা বা নিন্দা করিস,” কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল, “এর পরের বার ‘চিত্রাঙ্গদা’ করব ভাবছি। তারই চিন্তা-ভাবনা নিয়েই একটু ব্যস্ত হয়ে রয়েছি। এখনও বুঝে উঠতে পারছি না আমি সুরূপা করব না কুরূপা,” এই বলে সে আবার বইয়ে মুখ গুঁজে ফেলল।
সূর্য কিছুক্ষণ বোকার মতো বসে রইল, যেন কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করল। তারপর বলল, “তুই আজকাল আর আড্ডা দিতে আসিস না কেন? আমার উপর রাগ, তাই বলে অন্যদের সঙ্গে কথা বলছিস না কেন?”
হৈমন্তী সূর্যর দিকে না তাকিয়ে বলল, “যাব। এই নৃত্যনাট্যটা নেমে যাক। আমি নিজেও তোদের মিস করি। আসলে, সকলের প্রত্যাশা খুব বেড়ে গিয়েছে তো! শুধু তুই বা অন্য বন্ধুরা ভাল বললেই তো হবে না! সকলের ভাললাগার মতো করে করতে হবে। তোরা তো প্রশংসা করবি-ই! তবে ওইটুকুই তো জগত্ নয়! আই হ্যাভ টু বি মোর প্র্যাকটিক্যাল, তাই না?”
সূর্য কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইল। বুঝতে পারল না, কী বলবে! বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর সে খাট থেকে উঠে পড়ল। সূর্য বেরিয়ে গেলে হৈমন্তী বই থেকে মুখ তুলল। দরজার দিকে তাকিয়ে থাকা তার চোখগুলো যেন একটু ছলছল করছিল। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল যেন বুকের উপর থেকে একটা বড় বোঝা নেমে গেল!
পৃথিবীটা নিমেষের মধ্যে অনেক বড় হয়ে গেল! জানলা দিয়ে যে মাঠটা দেখা যাচ্ছে সেটা আর হৈমন্তীর জগতের শেষ নয়। সেটা পার করে আরও অনেক-অনেক জায়গা আছে…দৃষ্টি না-ই ধরতে পারুক, তা বলে কিন্তু সেগুলো অবাস্তব নয়! আছে …সমুদ্র আছে…মরুভূমি আছে…সব আছে! এই জগতেই আছে! এই জগতে যেখানে হৈমন্তীর সৌন্দর্য আছে, তার নাচ আছে।
হৈমন্তী বইটা কোলে নিয়ে আবার গানের কথাগুলো পড়তে লাগল। হঠাত্ নিজেই থেমে গিয়ে, এক রাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নাচের ভঙ্গিমায় নিজের দু’হাত বুকের কাছে টেনে এনে হালকা সুরে বলল, “আমি চিত্রাঙ্গদা, রাজেন্দ্রনন্দিনী…” তার মনের মধ্যের অপরাজেয় শক্তির আভায় সে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে! তার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে উঠল।
©somewhere in net ltd.