নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিজস্ব ভাবনা চিন্তা নিয়ে আমার ভার্চুয়াল জগত!

এস.এম. আজাদ রহমান

মানুষ

এস.এম. আজাদ রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

রাজকুমারী হাসিনা: এক সাক্ষাৎকার, এক রাজনৈতিক দলিল

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৫৯

রাজকুমারী হাসিনা: এক সাক্ষাৎকার, এক রাজনৈতিক দলিল

ফরহাদ মজহারের নেওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। প্রায় আড়াই ঘণ্টার এই আলাপ ফরহাদ মজহারের গ্রন্থ ‘রাজকুমারী হাসিনা’-র সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশ। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—এটাই ছিল শেখ হাসিনার সঙ্গে ফরহাদ মজহারের জীবনের প্রথম সামনাসামনি কথোপকথন।

১৯৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরপরই এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়। সেই আলাপে ফরহাদ মজহার শেখ হাসিনাকে ‘বোন’ সম্বোধন করে তাঁর প্রতি ভালোবাসার কথাও প্রকাশ করেন। এই লেখায় শেখ হাসিনার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা যেমন উঠে এসেছে, তেমনি রয়েছে মজহারের তীক্ষ্ণ মূল্যায়ন ও সংশয়।

সবার পড়ার সুবিধার্থে মূল লেখাটিকে সংক্ষেপিত ও বিষয়ভিত্তিকভাবে সাজানো হয়েছে—যেখানে শেখ হাসিনার বক্তব্য এবং ফরহাদ মজহারের বিশ্লেষণ আলাদা করে উপস্থাপন করা হয়েছে।

বিশেষ কৃতজ্ঞতা: হাসান মাহমুদ টিপু ভাইয়ের প্রতি—এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য, লেখােটি ইষত্‌ পরিবর্তন, পরিবর্ধন করা হয়েছে।

ভূমিকা: রাজকুমারী ও দাসীর রূপকথা
সাক্ষাৎকারের শুরুতেই শেখ হাসিনা ফরহাদ মজহারকে একটি রূপকথা শোনান। এই গল্পটি পরবর্তীতে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এক শক্তিশালী প্রতীক হয়ে ওঠে।

হাসিনার বয়ানে রূপকথা
এক রাজকুমারের সারা গায়ে সুঁই ফোটানো। এক রাজকন্যা গভীর মমতায় একে একে সব সুঁই তুলে ফেললেন। কিন্তু চোখের ওপরের শেষ দুটি সুঁই তোলার আগে তিনি স্নানে গেলেন—কারণ তিনি চাইছিলেন, রাজকুমার যখন চোখ মেলবেন, তখন তাঁকে সুন্দর সাজে দেখবেন। পাহারায় রেখে গেলেন এক দাসীকে। কিন্তু চতুর দাসী সেই শেষ দুটি সুঁই তুলে ফেলল। রাজকুমার চোখ খুলে দাসীকেই দেখলেন এবং তাকেই প্রাণদাতা ভেবে বিয়ে করলেন। দাসী হলো রানী, আর প্রকৃত রাজকন্যা প্রতারিত হলেন।

ফরহাদ মজহারের বিশ্লেষণ
মজহারের কাছে এই গল্পটি নিছক রূপকথা নয়। তাঁর মনে হয়, এখানে রাজকন্যা আসলে শেখ হাসিনা নিজেই—যিনি বহু কষ্টে দল ও দেশকে টিকিয়ে রেখেছেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে অন্য কেউ ক্ষমতার কৃতিত্ব দখল করে নিয়েছে। মজহার প্রশ্ন তোলেন—এই গল্পের শেষ কি বাস্তবেও রাজকন্যার জয় দিয়ে শেষ হবে, নাকি তিনি ‘ঘরের মেয়ে’ হয়েই থেকে যাবেন?

১. ‘ঘরের মেয়ে’ হাসিনা বনাম সমালোচক বুদ্ধিজীবী
হাসিনার বক্তব্য

“আমার নামটা দেখুন—হাসিনা। গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে এই নাম আছে। আমি তো আপনাদেরই মেয়ে। ডাক দিলেই আমি আছি। কিন্তু এই ঘরের মেয়ে হওয়াটাই আমার কাল হয়েছে। আপনারা যারা লেখালেখি করেন, আপনারা অহেতুক অকারণে আমার বিরোধিতা করেছেন—কখনো ভাবেননি এর রাজনৈতিক ফল কী হবে।”

মজহারের বিশ্লেষণ
এই বক্তব্যে মজহার এক ভিন্ন হাসিনাকে আবিষ্কার করেন—সহজ, ঘনিষ্ঠ, বাবার মতোই শক্ত উপস্থিতি নিয়ে। তাঁর মতে, এই ‘ঘরের মেয়ে’ ভাবমূর্তিই হাসিনাকে সহজ সমালোচনার লক্ষ্য বানিয়েছে। তবে মজহার প্রশ্ন তোলেন—তথাকথিত প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের আওয়ামী লীগ-বিরোধিতা কি শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই সুবিধা দেয়নি?

২. সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন
হাসিনার বক্তব্য

“আমরা ধর্মভীরু, কিন্তু ধর্মান্ধ নই। ‘বিসমিল্লাহ’ বাদ দেওয়া যায় না। ধর্মীয় অনুভূতি মানুষের মধ্যে থাকবেই। এই পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগ নয়, আপনারাই দায়ী—কারণ আপনারাই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে একঘরে করেছেন।”

মজহারের বিশ্লেষণ
মজহারের মতে, হাসিনা এখানে অত্যন্ত কৌশলে দায় ঘুরিয়ে দেন। তাঁর যুক্তি—প্রগতিশীল শক্তি আওয়ামী লীগকে সমর্থন না দিয়ে তাকে কোণঠাসা করেছে, ফলে দলটি ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হয়েছে।

৩. সিরাজ সিকদার হত্যা ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতা
হাসিনার বক্তব্য
“যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কেউ ধ্বংস চালালে রাষ্ট্র কী করবে? সিরাজ সিকদারের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন এজেন্সি ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে। যারা স্বাধীনতা মানতে পারেনি, তারাই হত্যা করেছে।”

মজহারের বিশ্লেষণ
মজহার মনে করেন, এই ব্যাখ্যা নতুন হলেও অসম্পূর্ণ। তাঁর মতে, শেখ মুজিব বিপ্লবী ছিলেন না; যুদ্ধ-পরবর্তী বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা দমন করা ছিল তাঁর অস্তিত্বের প্রশ্ন। তবে পরাশক্তির ভূমিকা পুরোপুরি অস্বীকার করাও রাজনৈতিক সরলতা হবে।

৪. ‘সার্বভৌম সংসদ’ ও গণতন্ত্র
হাসিনার বক্তব্য
“সংবিধানে ক্ষমতার মালিক জনগণ। প্রয়োগ কোথায় কিভাবে হচ্ছে সেটাই আসল প্রশ্ন।”

মজহারের বিশ্লেষণ
এখানেই মজহার সবচেয়ে বেশি সংশয়ী। তাঁর মতে, যদি সংসদ জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করতে পারে, তবে সেটি গণতন্ত্র নয়। এই জায়গায় হাসিনার গণতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

৫. বাঙালি বনাম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ
হাসিনার বক্তব্য
“আমি জাতিগতভাবে বাঙালি, নাগরিকত্বে বাংলাদেশি। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আলাদা ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।”

মজহারের বিশ্লেষণ
মজহার এটিকে আওয়ামী লীগের একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখলেও সতর্ক করেন—উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর ওপর ‘বাঙালি’ পরিচয় চাপিয়ে দেওয়া উগ্র জাতীয়তাবাদের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

উপসংহার: দ্বন্দ্বের রাজনীতি
ফরহাদ মজহারের চূড়ান্ত উপলব্ধি—রাজকুমারী হাসিনা ও ঘরের মেয়ে হাসিনার দ্বন্দ্বেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে। তিনি লেখেন, শেখ হাসিনাকে যদি সত্যিই জনগণকে ভালোবাসতে হয়, তবে তাঁকে গল্পের শেষ অধ্যায়টিও অভিনয় করতে হবে।

কারণ শেখ হাসিনা রাজকন্যা নন—তিনি এই দেশের জনগণের হাসিনা, ঘরের মেয়ে। আর সেই পরিচয়ই তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি, আবার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.