![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কার্যকর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে স্বাধীন গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজের অভিমত এবং জনমত যাচাই সমীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে জনমত জরিপের ফলাফল প্যাথলজিতে রক্তপরীক্ষার রিপোর্ট নয়। কোনো সমীক্ষাই যে ‘শতভাগ নির্ভুল’, সে দাবি কেউই করেন না। তবে জনমত জরিপে মোটের ওপর যে বাস্তবতা ও মানুষের আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটে, তা অস্বীকার করা যায় না। জনমত জরিপের উপযোগিতা এখানে যে তাতে যাঁদের সম্পর্কে মতামত নেওয়া হয়েছে, তাঁরা উপকৃতই হন। সংশ্লিষ্টদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে জনমত সমীক্ষা সহায়ক।
বিগত তিন বছরের মতো ২০১২-তেও প্রথম আলো যে জাতীয় জনমত জরিপ করেছে তা বিবেচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সরকার, সরকারি দল ও বিরোধী দলের কাজকর্ম সম্পর্কে পাঁচ হাজার মানুষের মতামত জরিপ করা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নারী ও পুরুষের মতামত। জরিপ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে এবং স্বীকৃত পদ্ধতিতে।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মহাজোট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে চার বছর আগে। একটি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ম্যান্ডেট দেওয়া হয়েছিল ওই নির্বাচনে। জনগণের প্রত্যাশা ছিল অসামান্য। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, প্রত্যাশা রূপ নিয়েছে হতাশায়। দুটি বড় দলের কোনোটির প্রতিই সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট নয়। আর কোনো বিকল্প গড়ে না ওঠায় সুবিধা ভোগ করছে দুই প্রধান দল। পূর্ববর্তী তিন বছরের তুলনায় বিগত বছরে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অনেকটাই কমেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জনপ্রিয়তাও বেড়েছে সামান্যই। জরিপে দেখা যায়, জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা কিছুটা বেড়েছে। জাতীয় পার্টি মহাজোটের অংশ হয়েও সরকারের সঙ্গে প্রকাশ্যে দূরত্ব রক্ষার কথা বলে থাকে। যদিও তারা একটি মন্ত্রিত্বও পেয়েছে। জামায়াতের সমর্থক ৩ শতাংশের মতো।
রাজনৈতিক দল ও সরকারের জনপ্রিয়তার ওঠা-নামা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। জনগণের মন পরিবর্তনশীল। কোনো একটিমাত্র ঘটনায় একটি সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নামতে পারে। সব গণতান্ত্রিক সমাজেই তেমনটি ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পরদিনই মুসলিম লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। চুয়ান্নর নির্বাচনে জনগণ জানিয়ে দেয়, তারা লীগের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনড় থাকায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অভাবিত রকম বেড়ে যায়।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জনপ্রিয়তা কেন কমেছে, তার কারণ অনুসন্ধান করা দুই দলেরই নেতাদের জরুরি কাজ হওয়া উচিত। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সরকারি দলের নেতাদের ও মন্ত্রীদের কথাবার্তা ও ভূমিকায় মানুষ ক্ষুব্ধ। তার মধ্যে হল-মার্ক, ডেসটিনি, রেলওয়ে-বাণিজ্য কেলেঙ্কারি, ব্যাংক ঋণ লুটপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি-বাণিজ্য, টেন্ডার প্রভৃতি নিয়ে সরকারি দলের লোকদের আচরণ; উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাস প্রভৃতি কারণে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। অনেকগুলো ঘৃণার্হ ও চাঞ্চল্যকর অপরাধের তদন্ত ও বিচারে সরকারি দলের নেতাদের হস্তক্ষেপ মানুষ মোটেই ভালো চোখে দেখেনি।
তাহলে প্রধান বিরোধী দলের প্রতিও মানুষ অপ্রসন্ন কেন? বিএনপি দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের সংসদে অনুপস্থিত থাকা ৭৯ শতাংশ উত্তরদাতা অনুমোদন করেনি। অস্বাভাবিক ঘটনাবহুল বছরটিতে বিএনপি সংসদে গিয়ে জনগণের আবেগ-অনুভূতি ও দাবিদাওয়া তুলে ধরেনি। সংসদের বাইরেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে তাদের আচরণ সন্তোষজনক নয়। অর্থাৎ জাতীয় সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বিএনপির ভূমিকা গঠনমূলক নয়। তার ফলে তাদের জনসমর্থনও একটি জায়গায় স্থির হয়ে আছে।
জাতীয় নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া তাঁদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারেননি। তাঁদের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ২০১০ সালের চেয়ে ২০১২ সালে দেখা যায় বেশ কমেছে। তবে উভয়ের জনপ্রিয়তায় ব্যবধান বিশেষ নেই বললেই চলে—প্রায় সমান সমান।
ছয়জন মন্ত্রীর মূল্যায়ন করা হয়েছে। আরও চার-পাঁচজন মন্ত্রীকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল। যাঁদের সম্পর্কে জনমত নেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তাঁদের ভালো করার কারণ তাঁরা কর্মতৎপর এবং দুর্নীতির অভিযোগমুক্ত। এবার নতুন বছরের শুরুতেই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে বই পৌঁছানো শিক্ষামন্ত্রীর বড় কৃতিত্ব। বিপর্যস্ত সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে নাগরিক সমাজের যে অভিযোগ ছিল, ওবায়দুল কাদেরের অক্লান্ত পরিশ্রমে তার যথেষ্টই উন্নতি হয়েছে গত বছরে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, সফলতার বিচারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী পিছিয়ে পড়েছেন।
জনমত বলছে, মহাজোট সরকারের চতুর্থ বছরে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের সবচেয়ে বেশি অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের প্রথম বছরে যতটা ছিল, বিগত বছরে তা অনেক নিচে নেমে গেছে। কেন এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা সরকারি দলকে ভেবে দেখতে হবে। ৮৪ শতাংশ অভিমতদাতা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে। তবে বিগত বছরে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় কম ছিল। এটা ভালো খবর। হতে পারে নাগরিক সমাজ, আন্তর্জাতিক মহল ও গণমাধ্যমের চাপের ফলেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে আসছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পূর্ববর্তী তিন বছরের মতোই উদ্বেগজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই। দুর্নীতির অবস্থাও একই রকম অথবা অবনতির দিকে। ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতার ধারণা, দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়েও মানুষের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। অধিকাংশ মনে করে এই কমিশন দ্বারা আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না।
স্কুলের ছেলেমেয়েদের কাছে বই পৌঁছে দেওয়াতেই শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নতি বোঝায় না। শিক্ষাপদ্ধতি মানসম্মত কি না তার ওপর জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। সরকারকে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বেকারত্ব দূর করার একটি প্রতিশ্রুতি ছিল মহাজোটের নির্বাচনী প্রচারণায়। প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজন বেকার চাকরি পায়নি। বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে মানুষ সন্তুষ্ট নয়। বিদ্যুৎ সরবরাহে অনিশ্চয়তায় গ্রামের মানুষ ও কৃষককে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কৃষক পাচ্ছে না ধান ও পাটের উৎপাদনমূল্য। কৃষক জাতিকে যা দিচ্ছে তার প্রতিদান পাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য অস্থিতিশীল। জরিপের নেতিবাচক অভিমতে এসবের প্রতিফলন ঘটেছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করে, দেশ সঠিক পথে পরিচালিত হচ্ছে না। অথচ এ সরকারের প্রথম বছরে ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করত সরকার সঠিক পথেই রয়েছে। কেন মানুষের মনে এ ধারণার সৃষ্টি হলো তা নীতিনির্ধারকদের খতিয়ে দেখা দরকার। দেশ পরিচালনায় সরকারের দক্ষতা-যোগ্যতার প্রশ্নে মানুষের মনে অনাস্থার ভাব সৃষ্টি হয়েছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজে সরকার যতটা আন্তরিক, ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের দক্ষতা ততটা নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি মুখ্য বিষয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের ঐতিহাসিক সম্পর্ক হাজার হাজার বছরের। একাত্তরে সেই সম্পর্কে যোগ হয় এক নতুন মাত্রা। বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে হূদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে অত্যন্ত আন্তরিক। তাতে বাংলাদেশ লাভবান হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নে ৪৯ শতাংশ উত্তরদাতা না-বাচক জবাব দেয়। ৩৮ শতাংশ উত্তরদাতা বলে, বাংলাদেশ লাভবান হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরও কূটনৈতিক তৎপরতা প্রয়োজন।
গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সরকারের আচরণকে ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা সমর্থন করে না। এই বিষয়টি বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। বিরোধী দলের সঙ্গেও সরকারের আচরণ যথাযথ নয় বলে ৭০ শতাংশ মানুষের অভিমত। বিষয়টি গণতন্ত্রের স্বার্থে সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখা দরকার। গণমাধ্যমের প্রতিও সরকারের আচরণ সমর্থন করে না ৮৬ শতাংশ মানুষ। স্বাধীন ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র টেকসই হয় না।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না বলে ৭৬ শতাংশ মানুষের ধারণা। ৫৯ শতাংশ মানুষ মনে করে এই ইস্যুতে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হবে না। কিন্তু আমরা মনে করি, এক ধরনের একটি সমঝোতায় দুই পক্ষকেই পরস্পরের কাছে আসতে হবে। অতীতেও এ জাতীয় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এবং নেতারা তা মীমাংসা করেছেন সমঝোতার মাধ্যমে। সমঝোতা না হলে তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক দুর্যোগ।
জনমত সমীক্ষা একধরনের সতর্কসংকেত। কখনো কোনো পক্ষের জন্য তা সাময়িক অস্বস্তিকর ও বিব্রতকর মনে হলেও বিচলিত ও হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আমাদের সবারই যদি অভিন্ন লক্ষ্য হয় একটি অসাম্প্রদায়িক উদার গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, যেখানে শোষণ, বৈষম্য ও দুর্নীতি থাকবে সহনীয় পর্যায়ে, থাকবে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার, সেখানে মতপার্থক্য সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা সম্ভব। আমরা আশা করব, নেতারা প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেবেন এবং আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ কলামসহ আরও জনপ্রিয় ও বিখ্যাত কলাম লেখকদের সব কলামগুলো একসঙ্গে পেতে এখানে ক্লিক করুন।
©somewhere in net ltd.