নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সন্ধ্যা প্রদীপ

আমার সমস্ত চেতনা যদি শব্দে তুলে ধরতে পারতাম

সন্ধ্যা প্রদীপ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বুকের ভেতর মৃত নদী (পর্ব দশ)

১২ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১:১১


আগের পর্ব

চৌদ্দ,
সন্ধ্যা নামার ঠিক আগমুহূর্ত টা কেমন যেন মন খারাপ করা, অনেকটাই যেন বিসন্নতায় ভরা। মানুষের জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত থাকে যখন জীবন এক রূপ থেকে আরেক রূপে রূপান্তরিত হতে থাকে। পরিবর্তনের এই সময়টুকুর ঠিক আগ মুহূর্ত যখন একটা জিনিস থেকে আরেকটা জিনিস তৈরি হচ্ছে, জীবনের এক ধরন থেকে আরেক ধরনে রূপান্তরিত হচ্ছে সেই সময়টার একটা বিষন্নতা রয়েছে। এখন সেই সময়টায় চলছে শ্রাবণীর জীবনে। কিভাবে যেন একটা বছর পার হয়ে গেল। চাকরির ব্যস্ততায়,নতুন জীবনের সাথে মানিয়ে নেয়ার সময় গুলোর মধ্যেই এলোমেলোভাবে কেটে গেল এই একটা বছর। সময়টা ভালো কাটলো না খারাপ শ্রাবণী তা বুঝতে পারেনা।

একটা ব্যাপার গত বছর থেকে শুরু হয়েছে আর এখন দিনদিন বেড়েই চলেছে যা শ্রাবনীর জন্য মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়।সে আজকাল ফেসবুকে ঢুকলেই দেখে কোনো না কোনো বান্ধবীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বা কোনো পরিচিতজন নতুন জীবনের পথে পা বাড়িয়েছে। দেখে ভালো লাগে আবার মনের কোণে কোথায় যেন একটা বিষন্নতা সুর ভেসে ওঠে। তার ভেতর থেকে এক ধরনের তাগিদ কাজ করে, মনে হয় তারও তো ঘর বাধা দরকার, তারও একটা জীবনসঙ্গী চাই।

তুষারকে ব্যাপারটা অনেক বলেছে শ্রাবণী। আকারে-ইঙ্গিতে নানাভাবে। মান অভিমান ও করেছে কয়েকবার কিন্তু তুষার যেন বুঝেও বোঝে নি। আগে যখন ক্যাম্পাসে ছিল হঠাৎ হঠাৎ করেই তুষার বলে উঠতো- শ্রাবণী চলো বিয়ে করে ফেলি! এ কথাটা এত এতবার শুনেছে শ্রাবণী যে তার কখনো মনে হয়নি যে এই বিষয়টার কোন ব্যতিক্রম হতে পারে। কিন্তু পড়াশোনা শেষে যখন সত্যিকারের ঘর বাধার সময়, যখন সবাই একে একে সব নিজেদেরকে গুছিয়ে নিচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে তুষার কেমন যেন উদাসিন হয়ে গেছে।

শ্রাবণী বিশ্বাস করতে পারে না এই এই মানুষটাই আগে ওভাবে বলত। তুষারের মুখে কখনো বিয়ে, সংসার বা জীবনযাপনের স্বপ্নের কথা শুনে না সে। তাদের কথা হয়, প্রতিদিনই হয় এবং অসংখ্য অজস্র কথা হয় কিন্তু কখনো নিজেদের জীবনের বিষয়ে বিষয়ে বিষয়ে যে যৌথ আলোচনা তার ধারে কাছে যেতে চায় না তুষার। অনেক চেষ্টা করেছে তবে অনেকবার বলার চেষ্টা করা সত্ত্বেও শ্রাবণী খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি সুবিধা করতে পারেনি। কারণ তুষার প্রতিবারই কথা গুলো এড়িয়ে যায়, এমন কোনো অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করে যার ফলে শ্রাবনীর ওই মুহূর্তে মন খারাপ হয় নয়তো প্রচন্ড রাগ হয়। অনেক সময় তা ঝগড়ায় রূপান্তরিত হয়এবং চিল্লাচিল্লি করে কিছুক্ষণ পর সে ফোন রেখে দেয়। হয়ত কোনোদিন ভাবে আর এভাবে চলবে না।রাগ করে কথা বন্ধ রাখে।তবে একা-একা থাকলে রাগ করে বেশিদিন থাকা যায় না।নিসঙ্গতা যেন তাকে গিলে খেয়ে ফেলতে চায়।তুষার ফোন দিতে থাকলে একসময় সে ফোন রিসিভ করে।সবকিছু এমন চক্রাকারে চলতে থাকে।

শ্রাবণীর অফিস চলছে আগের মতোই। কিছুদিন চাকরি করার পর শ্রাবনী বুঝতে পেরেছে এটা ঠিক তার ক্ষেত্রে উপযুক্ত ধরনের চাকরি নয়।সে মনেমনে ভাবে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে হয়ে গেলে বেশ হতো।সে পড়ুয়া ধরনের মানুষ।শিক্ষাকতা করতে করতে উচ্চতর লেখাপড়ার চেষ্টা করতো।লম্বা ভ্যাকেশন গুলোতে মায়ের কাছে যেতে পারতো।পরিবারের প্রতিও তো তার একটা দায়িত্ব আছে।দুদিন পর সংসার হলে,সন্তান হলে তাদেরকেও বেশ খানিকটা সময় দেয়া যেত।

এদেশে চাকুরিজীবী মেয়েদের অনেক কষ্ট।ঘর আর অফিস এক হাতে সামলাতে হয়।অন্যের কাছে সংসারের দায়িত্ব পুরোপুরি দিয়ে দিলে হয় সংসার উচ্ছন্নে যায় নয়ত ঘর ভাঙে।আর দুদিক সামলাতে গেলে ভাঙে মেয়েটির মন আর শরীর।স্বামী বা তার বাড়ির লোক ভালো হলে তো ভালই।আর না হলে জীবনটাকে জাহান্নাম বানিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।সবাই যেন চাকরিজীবী নারীর অগ্নিপরীক্ষা নেয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে।সহযোগিতার হাত না বাড়িয়ে বরং যত রকম অসুবিধা সৃষ্টি করা যায় তা করে।এজন্যই চ্যালেঞ্জিং জব করারা মেয়েদের জন্য খুব কষ্টের হয়ে যায়।

এদেশে অফিসগুলো মেয়েদেরকে চাকরিতে নেয় ঠিকই তবে মেয়েদের যেসকল সুবিধা দরকার তা দিতে চায় না। শ্রাবণীর এক কলিগের সদ্য ডিভোর্স হয়েছে।তার তিন বছরের এক কন্যা সন্তান রয়েছে।কাজের লোকের কাছে বাচ্চাকে রেখে অফিস করতে হয়।মেয়েটির যদি জ্বর বা অন্য কোনো সমস্যা থাকে সেজন্য যদি ভদ্রমহিলাকে আগে চলে যেতে হয় তখনই অন্য কলিগদের মধ্যে কটু কথার বন্যা শুরু হয়।অথচ এটুকু মানবিক সহযোগিতা করা সবারই উচিৎ।মেয়েরা যেহেতু মা হয় এবং তাদের সংসারের দায়িত্বটা বেশি পালন করতে হয় তাই তাদের জন্য কিছু সুযোগসুবিধা পুরুষের চেয়ে বেশি থাকা উচিৎ।

শ্রাবণী জানে এই ব্যবস্থা একদিনে পরিবর্তিত হবে না তাই তাকেই সুবিধাজনক একটা চাকরি খুঁজে নিতে হবে। তবে ভাবলেও বাস্তব অর্থে এর জন্য যা করা দরকার তা করে উঠতে পারে না সে। অফিসের ব্যস্ততার সেরে উঠে রান্নাবান্না করে ঘর গুছিয়ে সময় থাকে কম। এই সময়টুকুতে পড়াশোনা করা যায় বটে, সে মাঝে মাঝে পড়েও কিন্তু পুরোপুরি মন বসাতে পারেনা। একটা মানুষ সম্পূর্ণ একা একা থাকা কি যে যন্ত্রণা এই একটা বছরে সে তা প্রচন্ডভাবে অনুভব করেছে। আগে ছাত্রীজীবনে হলের হলের রুমে একা থাকতে পারত না। রুমমেট আপু আপু যখন বাইরে যেতেন তখন রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যেত। মনে হত আপু কবে আসবে! সেই ছোট্ট রুমে রাতে একা না থাকতে পারা মানুষটি আজ এত বড় একটা বাড়িতে সম্পূর্ণ একা থাকে।ভাবা যায়!

ভাবলে শ্রাবনীর নিজেরই অবাক লাগে।কিভাবে পারে সে? কিন্তু শ্রাবণী যে পণ করেছে সে হারবে না। অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে এই চাকরি করতে এসে। তার ভূতের ভয় আছে ব্যাপারটা তা নয় কিন্তু একা বাসায় গা ছমছম তো করতেই পারে। পুরনো বাসা বেশিরভাগ জায়গাতেই পানির কল গুলো নষ্ট। চাকরির প্রথম দিকে একবার একটা ভয়ের ঘটনা ঘটলো। রাতে বেসিনে হাতমুখ ধুয়ে ট্যাপ বন্ধ করেছে। অন্য রুমে আসার পরে শোনে কলকল করে পানি পড়ার শব্দ। গিয়ে দেখে বেসিনে পুরোদমে কলকল শব্দ করে পানি পড়ছে। শ্রাবণী তো অবাক! সে ট্যাপটা আবার বন্ধ করল।এরপরে আর পানি পরেনি।আরেকদিন দুপুরে মাস্টারবেড এর সাথের বাথরুম টাতে এমন ঘটলো। এমন ঘটনা আরো দু-একবার ঘটার পরে শ্রাবণী বুঝতে পারলো আসলে ট্যাপের প্যাঁচে সমস্যা সেটা ঠিক করে লাগে না অনেক সময়। সে হয়তো ট্যাপ বন্ধ করে।জং ধরা চাবি ঘোরে ঠিকই কিন্ত আসল জায়গার প্যাঁচ ঘোরে না ফলে পানিও বন্ধ হয়না।খেয়াল না করলে পানির শব্দ অন্য ঘর থেকে শোনা যায়।ঝড়ের রাতগুলোতে বেডরুমের বন্ধ দরজায় এমন আওয়াজ ওঠে যে মনে হয় প্রচন্ড জোরে কেউ ধাক্কা দিচ্ছে।প্রথমবার শ্রাবণী ভয়ানক চমকে উঠেছিল।পরে খেয়াল করেছে দরজার ছিটকানিটা টাইট হয়ে লাগেনা।তাই বাতাসে ধাক্কায় পুরো দরজা সামনে পেছনে নড়তে থাকে।সে সায়েন্সের ছাত্রী তাই অনুসন্ধিৎসু মনে কারনগুলো খুঁজে বের করে।রাতে ছাদে যে পায়ের শব্দ শোনা যায় সেগুলোকেও সে আমলে আনেনা।অন্য ফ্লাটের কেউ ছাদে যেতেই পারে।আর একা মানুষকে একটু ভয় দেখানোর জন্য নানাভাবে শব্দ করতে পারে।তার বাসার ভেতরে কোনো সমস্যা না হলেই হয়!সাহস নিয়েই তো তাকে টিকে থাকতে হবে। না হলে যে চাকরি ছেড়ে বাড়ি গিয়ে বসে থাকা লাগবে!

শ্রাবণী তা করতে চায়না। খালি বাড়িতে দেয়াল থেকে একটা টিকটিকি টেবিলের উপরে পড়লেও বোমা ফাটার মতো জোরে আওয়াজ হয়। শ্রাবণী প্রথম প্রথম চমকে উঠত প্রচন্ডভাবে।সবসময় স্নায়ু থাকত টানটান,কান খাড়া। তারপরে আস্তে আস্তে সে সাহস সঞ্চয় করেছে। আস্তে আস্তে বাসাটা তার আপন হয়েছে। শ্রাবণীর বাসার প্রতিটা ঘর ঝেড়ে মুছে রাখে।সব ঘরেই কিছু কিছু সময় কাটায়।যদিও তার একটা ঘর হলেই চলে তবুও বাসায় ময়লা আবর্জনা ভরা একটা বন্ধ ঘর থাকবে সেটা সে সহ্য করতে পারবে না।মুহম্মদ জাফর ইকবালের পিশাচিনী বইয়ের 'বন্ধ ঘর' গল্পটি তার খুবই মনে গেঁথে আছে।সে মনে করে এই মুহূর্তে এই বাসাটা তার।তাই তার অনুমতি ব্যাতিত কেউ এখানে থাকতে পারবে না।ভুতপ্রেত ও না।

আসলে সে ভাল করেই জানে ভয় পেলে এই মুহূর্তে কেউ বাঁচাতে আসবে না।একা থাকে বলে সে ভুতের গল্প আর ভুতের মুভিগুলো এড়িয়ে চলে।কে জানে কখন কোন অলীক কল্পনা এসে তাকে ভয় পাইয়ে দেয়। চাকরি মাস ছয়েক যেতেই শ্রাবণী তার মাকে বলেছিল একা থাকার কষ্টের কথা।ইঙ্গিতে বলেছিল যে এই মুহূর্তে তুষারের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করা যায় কিনা? তার মা খুব বুদ্ধিমতি এবং ঠান্ডা মাথার মানুষ। ছেলে এখনো কিছু করেনা তারউপরে পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে একটা জটিলতা আছে। এই অবস্থায় বিয়ে দিয়ে দিলে তার ফলাফল কি হতে পারে তা নিয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না ছিল তাই শ্রাবণী কে বলেছিলেন--এখন তো তোমার ছোট বোনের পরীক্ষা সামনে। পরীক্ষা শেষ হোক তারপরে আমরা এগুলো নিয়ে ভেবে দেখব, এখন এই সময়ে এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না তুমি আরো কিছুদিন অপেক্ষা কর।

শ্রাবনী অপেক্ষা করেছে। পরবর্তীতে অবশ্য মাকে কথাটা বলেনি আর। বলার সাহস হয়নি কারণ নিজেদের সম্পর্কটাই ঠিক নেই। কোন ভরসায় এসে মাকে বিয়ের কথা জানাবে? যেখানে তুষার ছেলেটি বিয়ের কথা মুখ ফুটে একবারও বলে না। শ্রাবণ চিরকালই লাজুক এসব ব্যাপারে। কিংবা হয়তো বলা যায় তার এই বিষয়ে কিছু ইগো আছে।তার কথা হলো বিয়ের প্রপোজাল ছেলে আগে দেবে। ছেলেকেই আগে দিতে হবে! যতই কষ্টে থাকুক তার পক্ষে সম্ভব না মুখ ফুটে কথা বলা যে 'আমাকে বিয়ে করো' তাই সে আকারে-ইঙ্গিতে তুষারকে বুঝিয়েছে যে তার একা থাকতে কষ্ট হয়।তুষার শোনে কিন্তু গুরুত্ব দেয় না।কি যে ভাবে তা বোঝা মুশকিল।

রাতে একা থাকতে থাকতে সব সময় তো আর সিনেমা দেখতে ভালো লাগে না। সব সময় বই পড়তেও ভালো লাগে না। সবচেয়ে বড় কথা নিজের জীবনের বড় কোনো সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকলে কোন কিছুই আর ভালো লাগেনা। তার নানা সন্দেহ কাজ করে।গঠনগত দিক দিয়ে তুষার হয়ত তাকে তেমন পছন্দ করেনা।হয়ত শ্রাবণী তেমন ভালো হতে পারেনি, এমন হতে পারেনি যাকে কোন ছেলে ভালবাসতে পারে বা পছন্দ করতে পারে। এসব ভাবতে ভাবতে তার আত্মবিশ্বাস দিন দিন কমতে থাকে।


সে যখন প্রথম অফিসে জয়েন করে তখন তরুন একজন অফিসার ছিল। অফিসার নতুন বিয়ে করেছেন।মেয়েটি আগে তার গার্লফ্রেন্ড ছিল।এই ছেলেটি যে বৌকে অসম্ভব ভালোবাসে তা দেখেই বোঝা যায়।সে তার বউকে নিয়ে প্রায় সময়ই বিকেলে হেঁটে বেড়াতো। কোন অনুষ্ঠানে বা অন্য কোনো কারণে যদি দেখা হয়ে যেত স্পষ্ট বোঝা যেত তাদের মধ্যে অন্যরকম ভালোবাসা। এই জুটিকে ঘুরে বেড়াতে দেখলে শ্রাবনীর মনের মধ্যে কোথায় যেনো একটু শূন্যতা কাজ করত।ইশ তার ও তো একটা জুটি ছিল। সেও তুষারের সাথে এমনি করে ঘুরে বেড়িয়েছে একসময়।এ সময়টাতে তুষারকে সে খুবই বেশি পরিমাণে মিস করত। মনে হতো সমস্ত জটিলতা, সমস্ত অভিমান আর সমস্ত হিসাব নিকাশ ফেলে যদি শুধু তুষারের সাথে থাকা যেত। সবকিছু ত্যাগ করে যদি একটা মেঠোপথ ধরে ঠিক এই ভাবে হাঁটতে পারত তুষারের হাত ধরে তাহলে বুঝি তার মনের আশা পূর্ণ হতো। তুষারকে সে কতটা মিস করে সে কি তা জানে?? জানলে কি কেউ এই সুদূরে তার প্রেমিকাকে এভাবে ফেলে রাখতে পারে?

পনেরো
আজকাল শ্রাবনীকে ভয়ে ধরেছে।বয়স ত্রিশ হয়ে যাওয়ার ভয়! ত্রিশ পেড়িয়ে গেলেও অবিবাহিত থেকে যাওয়ার ভয়।এই ভয়ে সে কখনো আক্রান্ত হবে তা আগে ভাবেনি।জীবনের প্রতিটি পরিবর্তনকে সে সহজ ভাবে নেয়ার চেষ্টা করেছে চিরকাল। তবুও পারিপার্শ্বিকতার কারনে সে আজকাল খুব অসহায় বোধ করে।বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই করছে কিন্ত বিয়ে হয়নি এমন মেয়েদের জীবনে সমাজ যে আর্টিফিশিয়াল ক্রাইসিস তৈরি করে দেয় তা সে ভালোমতোই ভোগ করছে।


এদেশে এখন মেয়েদের পড়ালেখা বা চাকরির চল হয়েছে বটে কিন্ত সমাজের মনোভাব খুব একটা বদলায় নি।বেশিরভাগ শিক্ষিত লোকেরাও ভাবে পঁচিশ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়া সর্বোত্তম! আটাশ ঊনত্রিশ তাও চলে কিন্ত সর্বনাশ!বয়েস যদি ত্রিশ ছুয়ে ফেলে সেই মেয়েটি হয়ে যায় অচ্ছুৎ। ত্রিশ পেড়িয়ে গেলে তো লোকে এমন ভাব করতে থাকে যে মেয়েটিকে খাটিয়ায় করে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে,সে যেন একেবারেই অচল।বিয়েতে দেরি হলে মেয়েদের মন এমনিতেই দূর্বল থাকে।মানুষের কথার তীরে বিদ্ধ হয়ে সে ভেতরে ভেতরে সত্যি সত্যিই কেমন নির্জীব হয়ে যায়।আত্মীয় স্বজনেরা এক্ষেত্রে ক্ষতি করে সবচেয়ে বেশি।কটু বাক্য তো খারাপ লাগেই,অযাচিত পরামর্শ গুলোও তখন বিষের মত মনে হয়।


অশিক্ষিত লোকের কথা যদি বাদ দেয়া হয়,আগের আমলের শিক্ষিত, আধা শিক্ষিত বাবা মায়ের কথাটাও নাহয় বিবেচনায় না আনা হয়।আজকের যুগের মর্ডান, স্মার্ট, শিক্ষিত ছেলেদের মনোভাবটাও যে এমনি!তারা যত যোগ্য হয় তত কচি মেয়ে খোঁজে। এরা ভুলেই যায় স্ত্রী শুধু শয্যাসঙ্গিনীই নয় জীবনসঙ্গিনীও বটে।রূপের মোহ কেটে গেলে এই ছেলেগুলো স্ত্রীর গুনের দিকে নজর দেয়।পঁয়ত্রিশ চল্লিশের পুরুষ আঠারো- ঊনিশের স্ত্রীর কাছে ম্যাচুরিটি খোঁজে। না পেলে বেঁধে যায় তুলকালাম কান্ড!


যে কুঁড়িটি ঠিকমতো বিকশিত হতেই পারেনি তাকে জোর করে তুলে নিয়ে তার স্বাভাবিক বিকাশটাই বন্ধ করে দেয়া হয়।কিছুদিন পর তাকে জোর করে ফোটানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে নষ্ট করা হয়।এদিকে পূর্নতাপ্রাপ্ত সুরভিত হৃদয় নিয়ে যে ফুল ফুটে রয়েছে তাকে গ্রহণ করতেই এসব পুরুষদের যত দ্বিধা। এই মেয়েগুলো যেন দুদিনেই ফুরিয়ে যাবে,নিঃশেষ হয়ে যাবে।অথচ সংসার এবং সম্পর্ক সামলানোর জন্য মানসিক পরিপক্কতা খুবই প্রয়োজন।

এদেশে বয়সের অনেকটাই নষ্ট করে ফেলে সেশন জট।শ্রাবণীর প্রায় দুই বছর সময় এভাবে নষ্ট হয়েছে।একটি মেয়ে পড়াশোনা করে বের হতে হতে তার বয়স সাতাশ আটাশ হয়ে যায়।আগে থেকে বিয়ে ঠিক না হয়ে থাকলে এই পড়ুয়া ক্যারিয়ার গড়তে চাওয়া মেয়েগুলো সমাজে এতটাই অবহেলার স্বীকার হয় যেন সে বড় কোনো পাপ করেছে।ভাবলেও কষ্ট লাগে স্বল্প শিক্ষিত কম বয়েসে বিয়ে হওয়া, স্বামী গরবে গরবিনী মেয়েরা এই চাকরিজীবি উচ্চ শিক্ষিত মেয়েদের সুযোগ পেলেই টিটকারি মারে।তাদের ভাবটা এমন - 'কি?কর পড়াশোনা, করো চাকরি।কিন্ত যতই যোগ্য হও, না পাবে তুমি ভালো বর, না জুটবে ভালো ঘর।'এই প্রতিষ্ঠানের ভাবি সম্প্রদায়ের কাছে এমন পরোক্ষ অপমান অনেক পেয়েছে সে।তাই আজকাল পিকনিক বা নানারকমের দাওয়াতে যাওয়াটা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।


বাড়িতে গেলেও আত্মীয় প্রতিবেশীদের ভয়ে থাকতে হয়।সেখানেও কতদিন যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয় নি শ্রাবণী তা বলে বোঝানো যাবে না।আজকাল লোকে শ্রাবণীর মাকেও কটু কথা শোনাতে ছাড়েনা।সবকিছু মিলিয়েই শ্রাবণীর খুব অসহায় লাগে।এত চতুর্মুখী মানসিক চাপ তাকে কেমন যেন বিপর্যস্ত করে ফেলেছে।যদি কোনোকিছু ঠিক করা না থাকতো তবে শ্রাবণী এই পরিস্থিতিটা মেনে নিতে পারতো। কিন্ত এতদিনের সম্পর্ক থাকা সত্তেও যদি তাকে এই কষ্ট সহ্য করতে হয় তবে সে তা মেনে নেবে কিভাবে?


অফিসেও তো তাকে নিয়ে কানাঘুষা চলতে থাকে।ব্যাচেলর অফিসারদের একজন দুইজন করে বিয়ে হয়ে যায় আর তার উপর চাপ বাড়তে থাকে।তার জন্য দু একটা বিয়ের কথাও এসেছে শুরুতে কলিগদের মাধ্যমে কিন্ত শ্রাবণী সাড়া দেয়নি।তুষারের কথা অবশ্য সে কাওকে বলেনি,শুধু ভদ্রভাবে প্রস্তাবটা এড়িয়ে গেছে।এতে জল্পনা কল্পনা আরো ডালপালা ছড়িয়েছে।

এসব ঝামেলার কথা বাদ দিলেও একটা শহরে আত্মীয় বন্ধুহীন ভাবে একা থাকার জটিলতা কম নয়। তরুণী একটা মেয়ে একা একটা অফিসে চাকরি করলে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়। মানুষের বদনজর পরে। পিয়ন দারোয়ান থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ অফিসার পর্যন্ত বাদ যায়না। সবাই তার খুটিনাটি সবকিছু লক্ষ্য করে।সেগুলো নিয়েই ফালতু গসিপ করে।সে বোঝে তাকে নিয়ে যে পিছনে কথা হয় সব মহলে। সঙ্গত কারণেই সে ব্যাচেলর অফিসারদের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখে কারন সে চায়না তাকে জড়িয়ে অন্য কারো সাথে রসাত্মক আলোচনা হোক।


শ্রাবণী উপলব্ধি করতে পারে তার দ্রুত বিয়েটা করা দরকার। বিয়ের পরে তাকে নিয়ে এ ধরনের আলোচনা কিছুটা হলেও বন্ধ হবে।এই ঘুনে ধরা সমাজের একটা অলিখিত নিয়ম আছে। একটা মেয়েকে নিজের মতো করে কিছু করা দেখতে সমাজ যেন পছন্দ করেনা। তার একটা অভিভাবক থাকতেই হবে। বিশেষ করে একটি স্বামী থাকতে হবে। মেয়েরা যেন সমাজে গবাদিপশুর মতো। মালিক না থাকলে যেন চলবেই না। শ্রাবনী ভাবে ভাগ্যিস সরকারি কোয়ার্টার নিয়েছিল! এটুকু সিকিউরিটি না থাকলে খারাপ লোকের চোখ পড়লে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারত।সে চায় না জীবনে এমন কোন দুর্ঘটনা ঘটে। তাই সে যথাসম্ভব সংযত থাকে। বাইরে গেলে শুধু বাজার করার জন্য যায়।বিনা কাজে খুব বেশি ঘোরাফেরা করে না। চেষ্টা করে সন্ধ্যার আগে আগে ফিরে চলে আসতে। এসব চেষ্টা করতে গিয়ে তার অনেক কষ্ট হয়।কোনো কোনোদিন মনে হয় যেন আর পারবেনা কিন্তু তবুও সে কোন রিস্ক নেয় না। এসব সময়ও তুষারের কথা খুব বেশি করে মনে হয় শ্রাবনীর।


মাসের বাজার করে ভারি ভারি ব্যাগ অনেক সময় তিন তলায় একাই তুলতে হয় কারন অনেক অটোরিকশা ওয়ালা টাকার বিনিময়েও এই কাজ করতে চায়না।এদিকের লোকগুলো কেমন যেন অদ্ভুত।এ অঞ্চলের রিক্সাওয়ালারা প্রচুর নবাব।তাদের ভাব বেশি। তাই তিন তলায় ভারী ব্যাগ নিয়ে উঠতে উঠতে প্রায়ই তার মনে হয় এই কাজটি তার করার কথা না। তুষার থাকলে এসব কাজে তাকে সাহায্য করতে পারতো। একা ব্যাচেলর লাইফের মত থাকাটা সহজ কিন্তু সে তো ব্যাচেলার বাসার মত বাসায় থাকেনা। একটা ফ্যামিলি বাসার সমস্ত কাজ নিজে করে। রান্নাবান্না করে, বাজার করে।মাঝে মাঝে সে খুবই ক্লান্ত হয়ে যায় মনে মনে বলে জীবন শেয়ারিং এর জন্য এই মুহূর্তে একটা মানুষ খুবই দরকার। তুষার কেন যে বোঝেনা!

শ্রাবণী তবুও অপেক্ষা করে। কল্পনায় দেখে অফিস শেষে বিকেলে দুজন মিলে বাজারে গেছে। বাজার করে রেস্টুরেন্টে বিকালের নাস্তা সেরে রাতের খাবার টুকু বেঁধে নিয়ে দুজনে ফিরে আসছে। দুজনে ধরাধরি করে ব্যাগ তুলে আনছে। বাজারের জিনিসপত্র গুলো ধুয়ে মুছে ফ্রিজে তুলে রাখছে। সেই সাথে চলছে অনর্গল হাসি গল্প। ছোট্ট একটা সংসারের স্বপ্ন রয়েছে তার দুচোখ ভরে। কিন্তু স্বপ্ন নিয়ে তুষারের সাথে কথা বলতে গেলেই বাধে বিপত্তি। তার এসবে মন নেই।সে আছে দেশ,কাল,রাজনীতি খেলা আর বন্ধু বান্ধব নিয়ে।


শ্রাবণী যখন ধৈর্য্য হারা হয়ে যায় তখন তুষার খুব ধৈর্য্য দেখানো শুরু করে।যাতে শ্রাবণী তাকে ছেড়ে চলে যেতে না পারে।এ যেন কেমন একটা দুর্বিপাকে জড়িয়ে পড়েছে সে।এ কেমন কথা, কেমন অবিচার তুষারের?সে বিয়ে করার উদ্যোগ ও নেবে না আবার শ্রাবণীকে ছেড়েও দেবেনা।আবার যে সম্পর্কের প্রতি যত্নশীল হবে তাও না।অবান্তর কথা বলে ঝগড়া করে শ্রাবণীর মনের আনন্দ আর জীবনের শান্তি সবই নষ্ট করে দেবে।


তুষার ছেলে মানুষ।সে হেসেখেলে বেড়িয়ে যখন ইচ্ছা অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে।কিন্ত শ্রাবনীর কি তখন সে বয়স থাকবে?তুষার যদি তাকে বিয়ে না করে তবে আরো কিছুদিন গেলে কে তাকে গ্রহণ করবে?যদি উন্নত কোনো দেশ হতো তাহলে বিয়ে বা বয়স নিয়ে সে চিন্তিত হতো না। কিন্ত এদেশে অবিবাহিত থাকা ব্যাপারটা কত কঠিন তা সে খুব ভাল ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে।ভয়টা সে এইজন্যেই পায়!

আর মাত্র পাঁচ মাস। তারপরেই শ্রাবণীর ত্রিশতম জন্মদিন!শ্রাবণী আয়নাতে নিজের মলিন চেহারাটা দেখে।চোখের নিজে কালি পড়েছে।সে যেন এক বিসন্নতার প্রতিমূর্তি।কিন্ত যার জন্য এতকিছু তার বিন্দুমাত্র উপলব্ধি নেই।

চলবে--

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১:৩০

রাজীব নুর বলেছেন: শ্রাবনীর ৩০ বছর!

১২ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১:৫৮

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: আশা ভঙ্গ হয়ে গেল নাকি?

২| ১২ ই অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ১:৫৬

রাজীব নুর বলেছেন: হুম হয়েছে।

১২ ই অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:১৭

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: দেখেছেন! আপনিও সেই কম বয়েসী নায়িকার ভক্ত।তবে সমাজের আর দোষ কি।
তবে শ্রাবণীর বয়স এখনো ত্রিশ হয়নি,হতে যাচ্ছে।গল্পের শুরুতে সে কিন্ত ছোটই ছিল।

৩| ১৪ ই অক্টোবর, ২০২০ ভোর ৫:৪৯

হু বলেছেন: আশা ভঙ্গের খেলা চলিতেছে।
যাই হোক তুষার ছেলেটা লোভী কিসিমের ছেলে। নিজে কিছু না করে বঊ এর উপরে ভর দিয়ে জীবন চালিয়ে দেয়। এরা বঊ পিটায়।

৪| ১৫ ই অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০২

মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: আশা পূর্ণ হলোনা-মনের বাসনা ।

মৃতপ্রায় নদীতে কি আর নাও ভাসবার সম্ভাবনা আছে?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.