নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌভিকের চিন্তাচর্চা

চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি

সৌভিক ঘোষাল

পেশায় সাহিত্যের শিক্ষক। মতাদর্শে মার্কসবাদী। কোলকাতার বাসিন্দা

সৌভিক ঘোষাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

অলোক রায় ও উনিশ শতক চর্চা

১৩ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ৮:৫৫

সম্প্রতি চলে গেলেন বাংলার সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক অলোক রায়। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ছয় দশক জুড়ে তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখালেখি করেছেন। এর মধ্যে বাংলা কথাসাহিত্য সম্পর্কে কয়েকটি বই পাঠকের চিন্তাকে বিশেষভাবে উশকে দিতে সক্ষম হলেও তাঁর গবেষণার প্রধান বিষয় ছিল উনিশ শতক। রাজেন্দ্রলাল মিত্রকে দিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর গবেষণাকর্ম। পরবর্তী ছয় দশক জুড়ে উনিশ শতকের বহু মনীষা ও প্রবণতা নিয়ে তিনি উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ঈশ্বর গুপ্ত, রঙ্গলাল, মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, বিহারীলাল, বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, ব্রজেন্দ্রলাল শীল, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, দ্বারকানাথ, ডিরোজিও, কৃষ্ণমোহন, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাসসুন্দরী, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ বা ব্রাহ্ম আন্দোলন, ইয়ংবেঙ্গলের আন্দোলন প্রভৃতি নিয়ে তিনি মূল্যবান গবেষণা করেছেন। উনিশ শতক নিয়ে গবেষণার অন্যতম প্রধান অথরিটি হিসেবে তিনি বাংলার সারস্বত সমাজে গণ্য হতেন।

উনিশ শতকের যে কোনও গবেষকের মতোই অধ্যাপক অলোক রায়কেও নবজাগরণ কেন্দ্রিক বিতর্কের মুখোমুখি হতে হয়েছে। উনিশশো চল্লিশের দশক থেকেই এই সংক্রান্ত বিতর্ক শুরু হয়ে যায় মূলত মার্কসবাদী চিন্তাবিদদের লেখালেখির মধ্যে দিয়ে। তাঁর আগে পর্যন্ত উনিশ শতকের নবজাগরণ প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আলোচনা করেছিলেন যদুনাথ সরকার বা রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত বিশিষ্ট ইতিহাসবিদেরা। কিন্তু ভবানী সেন এর মত তাত্ত্বিক মার্কসবাদী মহল থেকে ভিন্ন স্বরে নবজাগরণের মূল্যায়ন করা শুরু করেন। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ সুশোভন সরকার বা চিন্তাবিদ নরহরি কবিরাজও এই বিতর্ককে এগিয়ে নিয়ে যান। সত্তর দশকে নকশাল আন্দোলনের সময়ে মূর্তি ভেঙে ফেলা সংক্রান্ত কার্যকলাপ ও লেখালেখি এই বিতর্ককে নতুন মাত্রা দেয়। নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখালেখি করে সাড়া জাগান দেশব্রতী পত্রিকার সম্পাদক তথা বিপ্লবী আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা সরোজ দত্ত এবং বিনয় ঘোষ। পরবর্তীকালে অধ্যাপক রণজিৎ গুহের নেতৃত্বে যে সাব অল্টার্ন স্টাডিজের সূত্রপাত হয় সেখানেও নবজাগরণ সম্পর্কে নানামাত্রিক বিশ্লেষণ করেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র, দীপেশ চক্রবর্তী, জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, শাহিদ আমিন প্রমুখ। পাশাপাশি নবজাগরণ সংক্রান্ত আলোচনায় নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে লেখালেখি করেন অধ্যাপক অশোক সেন, সুমিত সরকার, বরুণ দে, সুদীপ্ত কবিরাজ, বিনয়ভূষণ চৌধুরী প্রমুখ বিশিষ্ট চিন্তাবিদেরা। এনাদের অনেক লেখালেখি প্রকাশিত হয়েছিল অলোক রায় সম্পাদিত উনিশ শতক চর্চার উল্লেখযোগ্য পত্রিকা “নাইনটিন্থ সেঞ্চুরী স্টাডিজ” এ।
অলোক রায় তাঁর লেখালেখিতে উনিশ শতকের রেনেসাঁকে সম্পূর্ণ অতিকথা বলে নস্যাৎ করে দেওয়ার যুক্তি যেমন খুঁজে পান নি, তেমনি এর সীমাবদ্ধতাগুলিও তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। এই রেনেসাঁর সঙ্গে ইউরোপীয় রেনেসাঁর পার্থক্যও তাঁর নজরে ছিল। ইউরোপীয় রেনেসাঁ হয়েছিল স্বাধীন ভূখণ্ডে, আর এখানে কলোনির আওতায়। আমাদের রেনেসাঁয় অতীত প্রাচ্য আর সমকালীন প্রতীচ্যর মধ্যে একটা উভয়ত আকর্ষণ ও দ্বন্দ্ব কাজ করেছে। সবচেয়ে বড় কথা রেনেসাঁ সেকুলার মানবতাবাদের পথ ধরে এখানে শুরু হলেও হিন্দু পুনরুত্থানবাদ পরবর্তীকালে তাঁর একটি অভিজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়। ‘উনিশ শতকের নবজাগরণ: স্বরূপ সন্ধান’ নিবন্ধে অলোক রায় এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘‘কিন্তু উনিশ শতকে নবজাগরণের সেই প্রথম সূর্যোদয়ে যে-মানবতাবাদ যুক্তিবিচার সমাজচেতনা বিশ্ববোধ বাঙালির চিত্তক্ষেত্রে আশার আলো দেখিয়েছিল, শতকের শেষভাগে বুঝি তার অবলোপ ঘটল—।’’

রেনেসাঁর প্রথম পর্বের চিন্তানায়ক, যেমন রামমোহন বা বিদ্যাসাগরের সাথে পরবর্তী পর্বের চিন্তানায়ক, যেমন বঙ্কিম বা বিবেকানন্দের তুলনা করলেই এটা বোঝা যাবে। বিবেকানন্দ ও বিশেষ করে বঙ্কিমের মধ্যে প্রচুর দ্বন্দ্ব ও স্ববিরোধও লক্ষ্য করা যায় এবং অলোক রায় তাঁর নানা রচনায় এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রথম জীবনে বিবেকানন্দের ব্রাহ্মধর্মপ্রীতি, পরে রামকৃষ্ণের কাছে যাওয়া ও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ — বিবেকানন্দের জীবনের বাঁকবদলগুলি নিয়ে অলোক রায় মূল্যবান আলোচনা করেছেন। হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভূমিকা থাকলেও শশধর তর্কচূড়ামণির ঘরানায় সঙ্গে তার পার্থক্যের দিকটি বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন, ‘‘... স্বামী বিবেকানন্দের ‘পরিব্রাজক’ ও ‘বর্তমান ভারত’ পড়লে বোঝা যায় (তাঁর চিঠিপত্রে আরও বেশি) তাঁর মধ্যে ইতিহাসবোধ ও সমাজবোধ প্রবল। তিনি একই সঙ্গে স্বপ্নদ্রষ্টা ভাবুক ও বাস্তবদৃষ্টিসম্পন্ন কর্মী। শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীপ্রচার তাঁর জীবনের লক্ষ্য হলেও কখনও তিনি প্রভু ও গুরুকে দেবতা বানাতে চাননি।’’ তবে বিবেকানন্দের স্ববিরোধের জায়গাগুলিও তিনি স্পষ্ট করেছেন, ‘‘স্বামী বিবেকানন্দের ‘স্বদেশ মন্ত্রে’র মধ্যে শূদ্রজাগরণের কথা যেমন আছে, তেমনি আছে সীতা সাবিত্রী দময়ন্তী, সর্বত্যাগী শঙ্করের আদর্শ অনুসরণের কথা। এই দ্বৈধতা উনিশ শতকের বঙ্গীয় নবজাগরণের মধ্যে যেমন দেখা গেছে, স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যেও তা দুর্নিরীক্ষ নয়।’’

বিবেকানন্দের মতো বঙ্কিম মননকে বিশ্লেষণ করতে গিয়েও অলোক রায় এই উনিশ শতকী দ্বন্দ্বের জায়গাটি মাথায় রেখেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রকে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীদের সঙ্গে একাসনে বসানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। ‘বঙ্কিম-মনীষা’ রচনায় তিনি স্পষ্টত জানিয়েছেন - ‘‘উনিশ শতকের শেষ পাদে বাঙালির মধ্যে পিছুটান এক ধরনের সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয়। বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষে শশধর-কৃষ্ণপ্রসন্ন, এমনকি শ্রীরামকৃষ্ণের অনুগামী হওয়া সম্ভব ছিল না।’’ অলোক রায় দেখিয়েছেন বঙ্কিম কৃষ্ণের ঈশ্বরত্বে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু ‘কৃষ্ণচরিত্র’ লিখতে গিয়ে তাঁর মানবচরিত্র প্রতিষ্ঠা করার দিকেই তিনি জোর দিয়েছেন।
উনিশ শতক বা প্রাচীন ভারতের গবেষণা বর্তমান ভারতে আর নেহাৎ অ্যাকাডেমিক চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিজেপি - আর এস এস হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণার দিকে এগনোর উপায় হিসেবে তাদের নিজস্ব ইতিহাস পুরাণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে প্রবলভাবে হাজির ও ব্যবহার করেই চলেছে। দেশে পুনর্বার রাজনৈতিক বিজয় এবং পশ্চিমবঙ্গেও ক্ষমতা দখলের দিকে তাদের এগনোর পর্বে উনিশ শতক কেন্দ্রিক চর্চা নিয়ে নতুন নতুন বিতর্ক দেখা দেবে, এমন সম্ভাবনা প্রবল। উনিশ শতকী নবজাগরণের সেকুলার যুক্তিবাদী ধারাটিকে খণ্ডন করে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী ধারাটির ওপর জোর দেওয়ায় তাদের আগ্রহও অনুমান করা যায়। উনিশ শতকের বস্তুনিষ্ঠ চর্চা একারণে বিশেষভাবে প্রয়োজন এবং অন্যান্যদের পাশাপাশি অধ্যাপক অলোক রায়ের লেখালেখিও এক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ সাহায্য করবে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ৯:৩০

রাজীব নুর বলেছেন: অনেকদিন আগে বঙ্কিম মনীষা নামে তার লেখা একটা বই পড়েছিলাম।

২| ১৩ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ১০:১২

মাহমুদুর রহমান জাওয়াদ বলেছেন: মার্ক্সবাদ আমার অপছন্দ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.