![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
"সত্য যে কঠিন; কঠিনেরে ভালবাসিলাম, সে কভু করেনা বঞ্চনা" ফেবুঃ https://www.facebook.com/humayundmc
১
অনেকক্ষণ ধরে টার্গেট করে আছি লেজটাকে। প্রচণ্ড ঘামছি। কয়েকবার মিস করেছি। খুব টেনশন হচ্ছে নিজেকে নিয়ে। সেরেবেলাম কাজ করা বন্ধ করে দিল নাকি? সেরেবেলাম মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ। মানুষের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজ কর্মগুলো নিয়ন্ত্রন করে মস্তিষ্কের এই অংশটি।
আমি মঈন। এমবিবিএস পাশ করার পর সাইকোলজির উপর কিছুদিন ট্রেনিং নিয়ে এখন উত্তরায় একটি চেম্বারে বসি। রোগী তেমন আসেনা বললেই চলে। প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল ১০ টায় চেম্বারে যাই ফিরি অনেক রাতে। মোটামুটি অলস ভাবেই কাটে সারাদিন। চা, সিগারেট আর টিকটিকির লেজ সংগ্রহ করেই দিন কাটে মোটামুটি আমার।
মানুষের পর আর কোন ধূর্ত আর আজব প্রাণী যদি থেকে থাকে তা হচ্ছে টিকটিকি। সরীসৃপ জাতীও মেরুদণ্ডী এই প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Hemidactylus frenatus । গত কয়েকদিনে প্রায় ২০ টার মত লেজ সংগ্রহ করেছি। বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নেই এর পিছনে। কোন টিকটিকি লেজ হারানোর কয়েকদিনের মাথায় আবার সাবেক লেজ নিয়ে ঘোরাঘুরি করে। আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি এই সৃষ্টি রহস্য। দেখতে ভালই লাগে ব্যাপারটা।
আজ বৃহস্পতি বার। সকাল থেকেই সামান্য খারাপ মনটা। চোখের সামনে একজনকে বাসের নিচে চাঁপা পড়তে দেখেছি। একদম মাথার উপর দিয়ে গেল চাকা দুটো। মগজটা ছিঁটকে বেরিয়ে গেল। মুহূর্তেই নিথর হয়ে গেল দেহটা। কেমন জানি গুলিয়ে উঠল শরীরটা।
বাটুলকে এক কাপ চা দিতে বলে একটা সিগারেট ধরিয়ে বসে আছি চেম্বারে। সমস্ত মনোযোগ নতুন একটা টিকটিকির লেজের দিকে। বাটুল চা নিয়ে এসে বলল- আফনের লগে একজন দেহা কইত্যে চায়। বাইরে খাড়ায়া আছে। পাডামু?
আমি বললাম- পাঠা।
লোকটার বয়স ৩৫ হতে ৪০ এর মাঝামাঝি হবে। অনেক লম্বা। তামাটে পেটানো শরীর। গোঁফ থাকার কারণে একধরণের জল্লাদ জল্লাদ ভাব এসেছে চেহারার মাঝে। চোখগুলো ধূসর। মনে হচ্ছিল বিষাদ আর আতংকে ভরা চোখ দুটো। আমি লোকটিকে বসতে বলার আগেই ঝুপ করে বসে পড়ল লোকটি। আমি লোকটিকে জিগ্যেস করলাম- চা খাবেন?
-না
-সিগারেট?
একটা সিগারেট ধরিয়ে লোকটি কিছুক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-আমাকে আপনি চিনবেন না স্যার। আমার বাড়ি দিনাজপুরের শিবপুর। কিছুদিন থেকে খুব খারাপ একটা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি স্যার। আমাকে বাঁচান স্যার। আমাকে হোসেন মাস্টার পাঠিয়েছে।
হোসেন মাস্টারের কথা মনে পড়ল আমার। বছর দুয়েক আগে ওনার মেয়েকে ঢাকায় এনেছিল চিকিৎসার জন্য। ওনার মেয়ের ধারণা, তার পেটের ভিতর বিশাল বড় একটা কৃমি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারা দেশের বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েও কোন কাজ হয়নি। কোন এক কারণে এই খবর আমার কানে আসে। আমি পিজি হসপিটালে যাই মেয়েটাকে দেখতে। সব শুনে, রিপোর্ট দেখে বুঝতে পারি এটা কোন রোগ নয়। জাস্ট সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম। বিশেষ সাইকো থেরাপি প্রয়োগ করে ভাল করে দেই মেয়েটিকে। তখন থেকেই হোসেন মাস্টারের ধারণা আমি অনেক বড় মাপের একজন ডাক্তার।
-আমার নাম স্যার সব্যসাচী চক্রবর্তী। বাবা মার আদরের ছেলে। রংপুর কারমাইকেল কলেজ হতে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স কমপ্লিট করেছি গত বছর। চাকরি বাকরি করিনা। অনেক আগে মা বাবা মারা গেছে। আমাদের গ্রামে পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি দেখাশোনা করি এখন। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে থাকতে মানসী নামের একটা মেয়েকে বিয়ে করি। আপনাদের ধর্মে স্যার বেহেস্তের হুরদের কথা উল্লেখ আছে, আমার ধারণা মানসী হুরদের চেয়েও বেশি সুন্দর। এমন সুন্দর মেয়ে আমার জীবনে আমি একটাও দেখিনি স্যার। যে কেউ প্রথম দেখাতেই তার প্রেমে পড়ে যাবে। সুন্দরী ছিল বলে আমাদের এলাকার অনেকেই ওকে পছন্দ করত। এমনকি ওকে বিয়ে না করার জন্য কেউ কেউ আমাকে হুমকিও দিয়েছিল স্যার। মানসীকে নিয়ে আমার দিনগুলো খুব সুখেই কাটছিল। সমস্যা শুরু হল গত বছরের এপ্রিল থেকে।
সেদিন ছিল মঙ্গল বার। অমাবস্যা ছিল বলে আমি বাজার থেকে সেদিন একটু তাড়াতাড়িই ফিরি। রাত তখন আনুমানিক ৮ টা কিংবা ৯ টার মত হবে। গ্রামে স্যার ৮ টার সময়ই অনেক রাত হয়ে যায়। বাড়িতে এসে দেখি দরজা খোলা। সারা বাড়িতে থমথমে অন্ধকার। মানসী, মানসী বলে কয়েকবার ডেকে কোন সাড়া না পেয়ে কুয়ার পাড়ে যাই। কুয়ার পাড় থেকে স্যার আমাদের গ্রামের কালী মন্দিরটা দেখা যায়। খুব চিন্তিত ছিলাম বাড়িতে মানসীকে না পেয়ে। তখন স্যার মন্দিরের পাশ থেকে স্পষ্ট একটা গোঙানির মত শব্দ শুনতে পাই আমি। সাহস করে কাছে গিয়ে দেখি বীভৎস একটা দেহ পড়ে আছে ওখানে। যখন স্যার বুঝতে পারি ওটা মানসীর দেহ এবং নিষ্প্রাণ তখন প্রচণ্ড এক চিৎকার দিয়ে আমি জ্ঞান হারাই স্যার। আমার জ্ঞান ফেরে পরদিন সকালে। ততক্ষণে পুলিশ এসে নিয়ে গেছে মানসীর লাশ। মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়েছিল কয়েকজন মিলে ধর্ষণ করে মানসীকে। এরপর ওকে উপর্যুপরি কুপীয়ে চলে যায় ওরা।
-এরপর এলোমেলো হয়ে যায় আমার জীবনটা স্যার। আমি স্যার হিন্দু হলেও ওর লাশটা পোড়াতে দেইনি। আমার জানালার পাশেই পুঁতে রাখি মানসীকে।
এরপর থেকেই শুরু হয়ে যায় আমা জীবনের ভয়ংকর দিনগুলো।
এক রাতের ঘটনা। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি হবে। প্রচণ্ড গরম পড়েছিল সেদিন। আমি সেদিন জানালা খোলা রেখে ঘুমিয়েছিলাম। মাঝ রাতের দিকে কেমন যেন একটা ধুপ পোড়ালে যেরকম গন্ধ হয় ঠিক সেরকম গন্ধ পাচ্ছিলাম স্যার আমার রুমে। আমি হঠাৎ চোখ খুলে দেখতে পাই আমার জানালার পাশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। একটু ভাল করে দেখার চেষ্টা করতেই যা দেখলাম তাতে আমার সমস্ত অনুভূতি মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল স্যার। আমি স্পষ্ট দেখলাম জানালার শিক ধরে মানসী এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলামনা। ওর সাথে কথা বলতে যাব ঠিক তখনি চেয়ে দেখি জানালায় কেউ নেই। হ্যালুসিনেশন, ডিলিউসন ব্যাপারগুলো সম্বন্ধে সামান্য জানতাম আমি। ব্যাপারটাকে হ্যালুসিনেশন ভেবে ঘুমিয়ে পড়ি সেদিন। কিন্তু স্যার এই ঘটনা তার পর থেকে প্রতিদিন ঘটতে শুরু করল।
আমি লক্ষ করলাম প্রচণ্ড ঘামছে লোকটা। আমি তাকে বললাম- পানি খাবেন?
-না স্যার। আমি আর একটা সিগারেট ধরাব।
এরপর থেকে আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে শুরু করল। একের পর এক অপরাধ করতে শুরু করি আমি। মানসী মারা যাবার পর আমার দূর সম্পর্কের এক মামা ও তার মেয়েকে আমাদের বাড়িতে এনে রেখেছিলাম স্যার। আমার মামাতো বোনের নাম ছিল সুরভী। ১৫-১৬ বছরের মত বয়স হবে। ওর চেহারাও ঠিক মানসীর মত ছিল। মামাতো বোন হলেও ওকে নিজের বোনের মতই দেখতাম। ওকে নিয়ে কখনো কোন কুচিন্তা আসেনি আমার মনে। একদিন সন্ধ্যা বেলা বাড়িতে এসে দেখি মামা নেই। সুরভী বলল মামা নাকি জরুরী কাজে বাড়িতে গেছেন। আজকে আসতে পারবেন না। আমি রুমে গিয়ে শরৎচন্দ্রের “শ্রীকান্ত” পড়ছিলাম। রাত ৮ টার দিকে সুরভী আমার রুমে খাবার দিতে আসে। খাবারগুলো টেবিলে রাখতে গিয়ে ওর ওড়নাটা হঠাৎ পড়ে যায়। মুহূর্তেই যাকে নিজের বোনের মত দেখতাম তাকে নিয়ে নানা ধরণের কুচিন্তা শুরু হয়ে যায় আমার মাঝে। ওর ভরাট বুক, ফর্সা চেহারা, গোল মুখ বার বার ভাসতে থাকে আমার চোখে।
বিবেক আর আবেগের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় আমার মাঝে। ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য জাল নিয়ে বের হই মাছ ধরার জন্য। আমাদের বাড়ির পাশেই স্যার করতোয়া নদী। ভালই মাছ পাচ্ছিলাম। মাছের লোভ কঠিন লোভ স্যার। যে মাছ ধরেছে একমাত্র সেই জানে এটা সম্বন্ধে। মাছ ধরতে ধরতে কখন যে আমাদের শ্মশানের পাশে চলে গেছি আমি বুঝতেও পারিনি। পানির ধারে অর্ধ পোড়া কাঠ দেখে বুঝতে পারি শ্মশানে চলে এসেছি। সামান্য ভয় ঢুকে যায় মনের মধ্যে। জাল গুছিয়ে নিয়ে আসব ঠিক সেই মুহূর্তেই দেখতে পাই আমার থেকে সামান্য দুরেই কি যেন নড়াচড়া করছে। ভাল করে দেখতেই স্পষ্ট একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পাই আমি। প্রচণ্ড আতংকে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। দৌড় দিতে যাব ঠিক সেই মুহূর্তে কে যেন পিছন থেকে হিম শীতল কণ্ঠে ডাক দিল- সব্য, দাঁড়াও। মুহূর্তেই বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার সমস্ত শরীরে। আমার সমস্ত অনুভূতি গ্রাস করে নিয়েছিল ওই কণ্ঠ স্যার। মানসীর কণ্ঠ আমি খুব ভাল করে চিনি স্যার। আমি যদি আজ থেকে ১০০ বছর পরও তার কণ্ঠ শুনি তাহলেও আমি চিনতে পারব স্যার। আমার সমস্ত ভয় কোথায় যেন মিলিয়ে গেল স্যার। আমি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গীতে মানসীর সাথে কথা বলেছিলাম স্যার। কি কথা হয়েছিল তা আমি আপনাকে বলতে পারবনা।
এরপর বাড়িতে এসে খুব ঠাণ্ডা মাথায় সুরভীকে খুন করে ডোবার পাশে পুঁতে রাখি। এলাকাবাসীর কাছে এখনও নিখোঁজ হিসেবেই আছে সুরভী। এরপর আরও একটা খুন করি আমি। কিছুদিন আগে নিউজে এসেছিল স্যার ধনপতি নামক একজনের রহস্যজনক মৃত্যু। এটাও আমার দ্বারাই ঘটেছিল স্যার। এরপর থেকে নিয়মিত আমি মাঝ রাতে শ্মশানে যেতাম এবং একের পর এক অপকর্ম করতাম স্যার। এই ব্যাপারগুলো আপনি আর হোসেন মাস্টার ছাড়া আর কেউ জানেনা স্যার। হোসেন মাস্টার মানুষটা খুব ভাল। আমি তাকে বিশ্বাস করি স্যার।
আমি বুঝতে পারি, দিন দিন আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কখনও কখনও ব্যাপারটা বাস্তব মনে হয় আবার কখনও কখনও উন্মাদ মনে হয় নিজেকে। আমি খুব খারাপ আছি স্যার। আমি এমন ভয়ংকর জীবন চাইনা। আমাকে বাঁচান স্যার। আপনি যদি ব্যাপারটাকে আমার অসুস্থ মনের কল্পনা, হ্যালুসিনেশ ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করেন তাহলে ভুল করবেন স্যার। আপনি চাইলে আপনাকে মানসীর সাথে কথা বলিয়ে দিতে পারব।
সব্যসাচীর শেষ কথাটা হতভম্ব করে দেয় আমাকে। আমি চাইলে সে আমাকে মানসীর সাথে কথা বলিয়ে দিতে পারবে! কিভাবে সম্ভব একজন মৃত মানুষের সাথে কথা বলা? কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছিলামনা। আবার অবিশ্বাস করার কোন কারণও খুঁজে পাচ্ছিলামনা।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম- আমি লোকটার সাথে যাব, কথা বলব মানসীর সাথে; মুখোমুখি হব ন্যাচারাল আর সুপার ন্যাচারাল জগতের সাথে।
২
টানা ৭ ঘণ্টা জার্নি করে দিনাজপুর শহরে পৌছাই আমরা। দিনাজপুর থেকে লোকাল বাসে নবাবগঞ্জ, নবাবগঞ্জ থেকে ভ্যান যোগে শিবপুর পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।
সব্যসাচীর বর্ণনার সাথে পুরোপুরি মিলে যায় ওদের গ্রাম। বিদ্যুৎ আর ভাল যোগাযোগ বঞ্চিত একটি গ্রাম। সন্ধ্যা বেলাতেই অস্বাভাবিক নীরব পুরো গ্রাম। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। সন্ধ্যা থেকেই পূর্ণ চাঁদের আলোয় আলোকিত চারদিক। মাঝে মাঝে সাদা মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে চাঁদটা। এরকম সন্ধ্যা আমার জীবনে আর একবারও আসেনি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল জন মিল্টন তার “Now come still evening” কবিতাটি এরকম কোন সন্ধ্যাবেলাতেই লিখেছিলেন।
"Now came still Evening on, and Twilight grey
Had in her sober livery all things clad;
Silence accompanied, for beast and bird,
They to thir grassie couch, these to thir nests
Were slunk, all but the wakeful nightingale;
She all night long her amorous descant sung;
Silence was pleas'd: now glow'd the firmament
With living sapphires: Hesperus that led
The starry host, rode brightest, till the moon
Rising in clouded majestie, at length
Apparent queen unveild her peerless light,
And o're the dark her silver mantle threw."
রাতের খাবার শেষ করে সামান্য রেস্ট নিয়ে শ্মশানে যেতে যেতে আমাদের প্রায় রাত একটার মত বেজে যায়। ওদের গ্রামের পর একটা মরা নদী, বিস্তীর্ণ এক বালুচর তারপর শ্মশান।
শ্মশানে পৌঁছানোর পর থেকেই কেমন যেন অদ্ভুত একধরণের অনুভূতি সৃষ্টি হয় আমার মাঝে।
প্রায় ঘণ্টা খানেকের মত বসে থেকে যখন ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলাম ঠিক তখনি অস্পষ্ট একটা শব্দ আমার কানে আসে। শব্দটা শোনার সাথে সাথেই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায় সব্যসাচী। ও আমাকে জিগ্যেস করে- কিছু দেখতে পাচ্ছেন স্যার?
আমি না সুচক মাথা নাড়ালে সব্যসাচী আমাকে বলে- আপনার ডান দিকে দেখুন স্যার।
আমার ডান দিকে আমার থেকে ১০-১৫ হাত দূরত্বে অস্পষ্ট একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পাই আমি। একটা অজানা ভয় ঢুকে যায় আমার মধ্যে। মুহূর্তেই আমার সমস্ত যুক্তি আবেগের কাছে পরাজিত হতে থাকে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল মারাত্মক বিপদ অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমি সব্যসাচীকে বলি- এখানে আর থাকা যাবেনা। চল, আমরা চলে যাই।
আমি চলে আসতে যাব ঠিক সেই মুহূর্তে সচল হয় ছায়ামূর্তিটি। হিমশীতল কণ্ঠে বলে- তুমি কাকে নিয়ে এসেছ সব্য? ওই মানুষটা তোমার আর আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে এসেছে। তুমি ওকে যেতে দিওনা; ওকে মেরে ফেল তুমি।
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলামনা।
মুহূর্তেই সব্যসাচীর পরিচিত ছবিটা অপরিচিত মনেহয় আমার কাছে। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল- আমি এখন আপনাকে খুব ঠাণ্ডা মাথায় খুন করব স্যার। কেউ কোনদিন জানতে পারবেনা, কোন প্রমাণও থাকবেনা। আমি কোনদিন মানসীর কথার অবাধ্য হইনি স্যার। এতদিন প্রত্যেকটা অপকর্ম করেছি আমি এই মানসীর নির্দেশেই। আমি ওকে খুব ভালবাসি স্যার।
অবশ্য একটা সুযোগ আপনি পাবেন স্যার। আপনি এখনও যদি কোনভাবে প্রমাণ করতে পারেন যে ব্যাপারটা অলীক, পুরোটাই আমার অসুস্থ মনের কল্পনা তাহলে আপনি বেঁচে যাবেন স্যার। কিন্তু আমি জানি এটা অবাস্তব না। তাছাড়া আজকে পুরো ব্যাপারটা আপনার চোখের সামনে ঘটল। আপনি তো একে অস্বীকার করতে পারেননা স্যার।
৩
পুরো গ্রামের সবাই ঘুমিয়ে তখন। শেষ রাত। আমি আর সব্যসাচী ওর রুমে মুখোমুখি বসে আছি। সব্যসাচী আমাকে বলল- কিছু বলবেন স্যার? হাতে সময় বেশি নেই।
আমি বললাম- একগ্লাস পানি খাব।
এক নিঃশ্বাসে পুরোটা পানি শেষ করে সব্যসাচীকে বললাম- বিজ্ঞান এখন অনেকদূর এগিয়ে গেছে মিস্টার সব্যসাচী চক্রবর্তী। আগে যেসব বিষয়কে ভুত-প্রেত, শয়তানের কাণ্ড বলে অস্বাভাবিক মনে করতাম সেগুলো এখন খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছে, পরিণত হয়েছে হাঁসির সম্পদে।
কোয়ান্টাম ফিজিক্স সম্বন্ধে কি কোন ধারণা আছে তোমার?
-খুব ভাসা ভাসা জানি কোয়ান্টাম ফিজিক্স সম্বন্ধে স্যার। প্যারালাল ওয়ার্ল্ড, সম্ভব্যতা এসব কিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কোয়ান্টাম ফিজিক্সে।
-গুড। কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীরা মনে করে, আমাদের এই দৃশ্যমান জগতের সাথে এমন আরও অসংখ্য জগত পাশাপাশি বিদ্যমান। এসব জগতেও হয়ত প্রাণের অস্তিত্ব আছে। হয়ত এসব জগতেও মঈন, সব্যসাচী নামের একই চেহারার একই মাত্রার কেউ আছে। এখানকার মঈন সব্যসাচীর সামনে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে; অন্য মঈন তখন হয়ত রাস্তায় বসে বাদাম বিক্রি করছে।
আরও সহজ করে বলতে গেলে মঈন, মানসী এবং সব্যসাচীকে নিয়ে লেখা একটা বইয়ের কথা চিন্তা কর। ধর, বইটির প্রত্যেকটি পাতা একটা করে জগত। বইটির কোন এক পাতায় মানসী এবং সব্যসাচির ঘটনা লেখা আছে কিন্তু অপর পাতায় মানসীর বদলে মঈন উপস্থিত। পাতা উল্টালে অপর পাতার মানসীর সাথে মঈন বা সব্যসাচী কারো সাথেই মানসীর যোগাযোগ হওয়া সম্ভব নয়। শুধুমাত্র তখনি সম্ভব হবে যখন পাতাটির মাঝ বরাবর একটা ফুটো করা হবে।
বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছে আমাদের জগতের ওপাশের জগতটার সাথে যোগাযোগ করতে। তারা প্রমাণ করেছে দুই জগতের মাঝে যে অদৃশ্য পর্দাটা আছে সেটা শুধুমাত্র সময়ের ব্যাবধান ছাড়া আর কিছুই নয়। উপযুক্ত পরিবেশে উপযুক্ত কৌশল প্রয়োগ করে এই পর্দা ভেদ করা সম্ভব।
তুমি সেই কাজটিই করেছ সব্যসাচী যে কাজটি পৃথিবীর বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা এত দিনেও করতে পারেনি। হয়ত শেষ রাত আর শ্মশান তোমার কাছে ছিল উপযুক্ত পরিবেশ আর নিখাত ভালবাসা ছিল উপযুক্ত কৌশল।
সব্যসাচী অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল- কিন্তু মানসী আমাকে দিয়ে কেন শুধু অপকর্মই করাচ্ছে? সেতো আমাকে দিয়ে ভাল কাজও করাতে পারত?
আমি বললাম- বিজ্ঞানী স্রোডিঞ্জার ১৯৩৫ সালে অদ্ভুত একটা আর্টিকেল জমা দিয়ে সারা পৃথিবীতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। ওনার এক্সপেরিমেন্টটা ছিল একটা বিড়ালকে নিয়ে। উনি বলেছিলেন, যদি একটা বিড়াল এবং কিছু পটাশিয়াম সায়নায়িড একটা বদ্ধ রুমে বা বক্সে রেখে দেয়া যায় তাহলে পটাশিয়াম সায়নায়িডের বিষক্রিয়ায় বিড়ালটির মরা এবং বাঁচার সম্ভাবনা ৫০/৫০। সেটা নির্ভর করবে যে প্রথম দেখবে অর্থাৎ অবজার্ভারের উপর। ফলাফলটা বিভিন্ন অবজার্ভারের কাছে বিভিন্ন আসতে পারে। তোমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এখানে তুমি অবজার্ভার। মানসীকে কে বা কারা রেপ করে মেরে ফেলেছে; এতে তোমার মনে একটা ক্ষোভের জন্ম নিয়েছে। আর এই ক্ষোভটাই মানসীকে তোমার কাছে এভাবে উপস্থাপন করেছে।
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সব্যসাচী আমার দিকে। ওর চোখের ভাষা আমি পড়তে পারছিনা। অনুভুতিশুন্য দুটি চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
পুব আকাশ আস্তে আস্তে লাল হয়ে আসছে। ভোরের আলো এসে পড়েছে সব্যসাচীর মুখে। লোকটা এখনও আমার দিকে অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে আছে; আর আমি তাকিয়ে আছি দেয়ালের টিকটিকিটার দিকে।
বিদ্রঃ এই গল্পে বর্ণিত সাইন্টিফিক ব্যাখ্যাটি সম্পূর্ণ সত্য।
০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৮:৪৯
রুদ্র হুমায়ূন বলেছেন: ২য় ভাল লাগা কেন ভাই?
২| ০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৮:৫৪
রুদ্র মানব বলেছেন: আমার আগেই তো দেখলাম পোস্টে আরেকটা প্লাস পড়ছে তাই
৩| ০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৯:২২
ইফতেখার5555 বলেছেন: গল্পের লেখনী বর্ণনার কৌশল খুব ভালো,কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটা মেনে নিতে পারলাম না, অন্য জগতের মানসী সব্যসাচীকে খুন করতে প্রলুব্ধ করবে কেন ???
ব্যাপারটা যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য নয়।
অন্য জগতের মানসী তো আর এ জগতের ঘটনাবলী অবহিত নয়........
০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১০:৩৫
রুদ্র হুমায়ূন বলেছেন: আসলে এই ব্যাপারটা আমিও ভেবেছি। এটারও ব্যাখ্যা দেয়া যেত। কিন্তু গল্পের পরিসর বড় হয়ে যাচ্ছিল বলে দেইনি। আপনি স্রোডিঞ্জারের বিড়াল থিওরি দিয়ে সহজেই এর ব্যাখ্যা দিতে পারেন।
৪| ০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১০:০০
আজ আমি কোথাও যাবো না বলেছেন: বেশ ভালো লাগলো। তবেমেষের কথাটিতে এসে অবাক হয়েছি। প্লাস!
০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১০:৩৬
রুদ্র হুমায়ূন বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।
৫| ০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১০:৪২
সপ্তম ইন্দ্রিয় বলেছেন: এইটা কি সায়েন্স ফিকশন না ভোতিক গল্প! সব প্যাচ খায়া গেল!
০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১১:৪৯
রুদ্র হুমায়ূন বলেছেন: ভাই, এটা হর-সাই-ফাই
©somewhere in net ltd.
১|
০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৮:৪৪
রুদ্র মানব বলেছেন: দারুণ লিখেছেন ,
গল্পটা একবারেই পুড়োটা পড়লাম ।
২য় ভাল লাগা রইলো